You dont have javascript enabled! Please enable it!
ফাঁসিদহ আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার লাহিড়ীরহাটের ১ মাইল পশ্চিমে বামুনিয়া গ্রামে ফাসিদহ এলাকা অবস্থিত। মুক্তিযােদ্ধাদের এ এলাকায় ডিফেন্স ছিল। এ পথে শত্রু ও রাজাকাররা চলাচল করতাে। রাজাকারদের মাধ্যমে শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানতে পারে। মুক্তিযােদ্ধাদের মেরে ফেলার জন্য ৮০-৮৫জনের ১টি সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষার উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপটেম্বর সকাল ৮টায় শত্রুপক্ষ অতর্কিত আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। দীর্ঘ ১ ঘন্টা ধরে তুমুল গুলি বিনিময় হয়। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তানিম হােসেনের নেতৃত্বে ৪০-৫০জনের অপর ১টি মুক্তিযােদ্ধার দল সেখানে হাজির হয়ে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে ৩জন শত্রু সৈন্য ও ৪জন রাজাকার নিহত হয় এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। শক্ররা লাশ নিয়ে পিছু হটতে থাকে এবং এক পর্যায়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
বঙ্গভিটা আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার অন্তর্গত বঙ্গভিটা। ধনতলা এলাকায় ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে বঙ্গভিটা যুদ্ধ সংঘটিত হয়।  ১৯৭১ সালের সেপটেম্বর মাসে ৯ নম্বর উইংয়ের ইপিআর সিপাহি খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে কিছু ইপিআর, আনসার, মুজাহিদসহ প্রায় ৪০-৪৫জন মুক্তিবাহিনীর সদস্য ভারতের অপারেশন ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের মুণ্ডমালা। বিওপি’র পাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বঙ্গভিটা নামক স্থানে অস্থায়ীভাবে (সেপটেম্বর মাসের শেষের দিকে) ক্যাম্প স্থাপন করে। বঙ্গভিটা ক্যাম্প করার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খবর নিয়ে তাদের ধ্বংস করা। মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপনের খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দোলুয়া ও লাহিড়ী ক্যাম্পের সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর বঙ্গভিটা ক্যাম্প আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেয়। বঙ্গভিটা নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যাতে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প স্থাপন করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে দোলুয়া ও লাহিড়ী ক্যাম্প থেকে প্রায় ৫০-৬০জন শত্রু ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ বঙ্গভিটায় এসে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ফলে উভয়পক্ষে প্রায় ১০ ঘণ্টা গােলাগুলি চলার পর শত্রুর আক্রমণের সামনে মুক্তিবাহিনী টিকতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্রসহ সমস্ত বাহিনী। প্রত্যাহার করে ভারতের অভ্যন্তরে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ৩-৪জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। কয়েকজন পাকিস্তান সেনাসদস্যও আহত হয়।
বৈঠার ব্রিজ ধ্বংস
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার অন্তর্গত চাপসা সীমান্ত এলাকায় বৈঠার ব্রিজ বা রাউতনগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। তারা যাতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে, সে জন্য মূলত বৈঠার ব্রিজ রক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়ে সেখানে তারা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের যাবতীয় গােপন খবর সংগ্রহ করে তাদের পিছনে ফাঁদ পেতে সমূলে ধ্বংস করাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পনায় ছিল। | ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার মাে. সফিউল্লাহ, নায়েব সুবেদার মাে. কাওছারসহ মুক্তিযােদ্ধা, আনসার সদস্য মিলে মুক্তিবাহিনীর ১টি যৌথ দল অপারেশন ক্যাম্প থেকে যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতিসহ বাংলাদেশের চাপসা বিওপি’র পাশ দিয়ে রাউতনগর বৈঠার ব্রিজে অবস্থানরত শত্রুকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য রাউতনগর এলাকায় প্রবেশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের সেপটেম্বর মাসে যৌথ মুক্তিবাহিনী সদলবলে বৈঠার ব্রিজ পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে। লাগাতার ৪-৫ ঘণ্টা গােলাগুলির পর শত্রুর পরাজয় ঘটে এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ আক্রমণে ৩জন পাকিস্তানি সৈন্য এবং ২জন রাজাকার মারা যায়। মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি ।
তালপুকুরে আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল থানার অন্তর্গত তালপুকুর গ্রাম। এ গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ১টি আনসার ক্যাম্প ছিল। এ আনসার ক্যাম্পে ১০-১২জন পাকিস্তানি সৈন্য বেড়াতে আসে। মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামবাসীর মাধ্যমে এ সংবাদ জানতে পেরে তালপুকুর গ্রামের আনসার ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের সেপটেম্বর মাসের এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার ও মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত ১টি দল। তালপুকুর গ্রামের যুদ্ধে ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার সফিউল্লাহ, নায়েব সুবেদার কাওছার ও সিপাহি মােস্তাফিজুর রহমান নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধে ইপিআর-এর ২০-২৫জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে নায়েব সুবেদার সফিউল্লাহ, নায়েব সুবেদার কাওছার, হাবিলদার আবদুল গনি, নায়েক আনিছুর রহমান, হাবিলদার ইয়াদ আলী ও সিপাহি মােস্তাফিজুর রহমান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। যৌথ মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল তালপুকুর নামক আনসার ক্যাম্পটি সমূলে ধ্বংস করা। বাংলাদেশের চাপসা সীমান্ত ফাঁড়ির পাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তালপুকুরের দিকে অগ্রসর হয়। আনুমানিক ভাের ৫টার সময় তালপুকুর আনসার ক্যাম্প আক্রমণ করে সমূলে ধ্বংস করা হয়। এ ক্যাম্পে কয়েকজন। পাকিস্তানি সৈন্য ঐ রাতে উপস্থিত ছিল। প্রায় ৪ ঘন্টা ক্রমাগত গুলি বিনিময়ের পর পাকিস্তানি সৈন্যর গুলি বর্ষণ বন্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি বরং শত্রুপক্ষের ৩জন সৈন্য এবং ৬-৭জন রাজাকার মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধারা ১টি মেশিনগান উদ্ধার করে পুনরায় ভারতের অপারেশন ক্যাম্পে ফেরত যান।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!