রায়মােহন গ্রামের অ্যামবুশ
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার অন্তর্গত রায়মােহন একটি সীমান্ত এলাকার গ্রাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী লাহিড়ীরহাট ঘাঁটি থেকে উত্তরস্থ এ গ্রামে সর্বদা টহল দিত। লাহিড়ীরহাটের শক্ত ঘাঁটি থেকে ১টি ফাইটিং টহল দল মুক্তিবাহিনীর তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে বের হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করা। রায়মােহন গ্রামের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হওয়ায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়। গ্রামটি ভারতের খুব কাছে হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা প্রায়ই এ এলাকায় চলাফেরা করতেন। | ১৯৭১ সালের জুন মাসে রায়মােহন গ্রামে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার ও মুক্তিযােদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত দলের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি মুখােমুখি যুদ্ধ হয়। ৯ নম্বর উইংয়ের ইপিআর হাবিলদার মাে. মােস্তাফিজুর রহমান ২৫৩০জন ইপিআর, আনসার ও মুক্তিযােদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত দল নিয়ে ভারতের ঠোকরাবাড়ি অপারেশন ক্যাম্প হতে বাংলাদেশের মুণ্ডমালা বিওপি’র পাশ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এদের উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর খবর সংগ্রহ। করা। যখন মুক্তিবাহিনীর দল রায়মােহন গ্রামের পাশ দিয়ে এগােতে থাকে, তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সামনাসামনি হওয়ায় দ্রুত অবস্থান নিয়ে উভয়। বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড গােলাগুলি বিনিময় হয়। প্রায় ৪ ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর উভয় দল নিজ নিজ স্থানে চলে যায়। এ যুদ্ধে শক্রর ১জন ক্যাপটেন নিহত হয়।
হরিণমারী আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত হরিণমারী গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করা হয়। হরিণমারী ক্যাম্প ভারতের খুব কাছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশ্য, ভারত থেকে মুক্তিবাহিনী কোনােক্রমে বাংলাদেশে যেন প্রবেশ করতে না পারে। প্রাচীর ও ওভারহেড বাংকার নির্মাণ করে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে শক্ররা। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে হরিণমারী পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্পের নিকটস্থ বাগানে হরিণমারীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হরিণমারী গ্রামের যুদ্ধে ইপিআর-এর হাবিলদার মাে. মােস্ত ফিজুর রহমান ও ল্যান্স নায়েক আবদুল হাকিম নেতৃত্ব দেন। তাদের সাথে ইপিআর-এর ৭০-৮০জন সদস্য এবং প্রায় ৪০০জন মুক্তিযােদ্ধাসহ মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আবদুল বাসেদ, মাে. রেশাল উদ্দিন, মাে. আবদুল মান্নান, মাে. তরিকুল ইসলাম ও তাজিমুল ইসলাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইপিআর হাবিলদার মাে. মােস্তাফিজুর রহমানের নির্দেশে ইপিআর ল্যান্স নায়েক আব্দুল হাকিম ভারতের অপারেশন ক্যাম্প থেকে কিছু মুক্তিযােদ্ধা, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের বেওরঝাড়ী বিওপি’র পাশ দিয়ে হরিণমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হন। হরিণমারী শত্রুর ক্যাম্পের কাছে এসে একটি বাগানে অবস্থান নেন। তখন রাত আনুমানিক ২টা। কিছু সময় পর পূর্ব সংকেত অনুযায়ী পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শক্র ক্ষিপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর পালটা গুলি বর্ষণ করে। ইত্যবসরে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ফায়ার করা মাত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা পালটা। জবাব দেয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সদস্যসহ এলাকার বহু লােক আহত হন।
গুঞ্জুরী আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর থানার অন্তর্গত একটি স্থানের নাম গুজুরী। এখানে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান গ্রহণ করে। এখান থেকেই তারা আশপাশের এলাকা খবরদারি করে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করার জন্য শক্রর ক্যাম্পে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ১৯৭১ সালের ১৭-১৮ আগস্ট আনসার অধিনায়ক আজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৩০-৩৫জন গেরিলার ১টি দল শত্রুর ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। ২০-২৫টি রাইফেল, ৪-৫টি এসএলআর, ৩টি স্টেনগান, ১টি ২ ইঞ্চি মটার ও ১টি এলএমজি, প্রত্যেককে ২টি করে হাতবােমা এবং ১০০ রাউন্ড গুলি দেওয়া হয়। রাতের অন্ধকারে সতর্কতার সাথে ঝােপজঙ্গল পেরিয়ে দোলুয়া হয়ে খোচাবাড়িতে শক্রর অন্য একটি ক্যাম্প অতিক্রম করে মুক্তিযােদ্ধারা সাহারাজপুর গ্রামের আজিজ অধিনায়কের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখান থেকে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সাহায্যকারী দোগাছীর রহিমউদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। শত্রুর ক্যাম্পের মাইল খানেক আগেই রাজাকারদের ১টি ক্যাম্প ছিল। রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনের খবর পেয়ে যায়। ফলে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সম্ভাব্য নির্যাতন ও গণহত্যা এড়ানাের জন্য গেরিলা মুক্তিবাহিনীর দলটি পার্শ্ববর্তী বিশাল আখ ক্ষেতের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরের সারাদিন দলটি কেবল আখের রস খেয়ে ক্ষেতের মধ্যে অবস্থান করে। ৩জন গেরিলা আখ ক্ষেতের চাষি হিসেবে সারাদিন পাহারা দিতে থাকেন। ১জন সহায়তাকারীর মাধ্যমে যাবতীয় খবরাখবর নিয়ে প্রথমে দলটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। অত্যন্ত কৌশল অবলম্বন করে প্রথমে ক্যাম্পের ২জন প্রহরীকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময় ক্যাম্পের বাকি আরও ১৫জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের চোখ-মুখ বেঁধে রাতের অন্ধকারে সীমান্তবর্তী। ভারতীয় ঠোকরাবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
মুক্তিবাহিনী এখান থেকে বেশ কিছু গােলাবারুদ দখল করে খােকসার আক্রমণ ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার অন্তর্গত খােকসা গ্রামে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার ও এফএফ বাহিনীর সমন্বয়ে খােকসা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয় । খােকসা যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর হাবিলদার মাে. আবদুল মান্নান নেতৃত্ব দেন। | ১০-১২জন ইপিআর সৈনিক, আনসার ও মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে যৌথ মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক পুলিশ হাবিলদার আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে ভার7ে ঠাকুরমারী অপারেশন ক্যাম্প থেকে রাত আনুমানিক ৩টায় বাংলাদেশের বেওরঝাড়ী বিওপি’র পাশ দিয়ে প্রবেশ করে এবং খােকসা শত্রু ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করার জন্য খােকসা গ্রামের উত্তর পাশে একত্র হয়। মুক্তিবাহিনীর মুখ, উদ্দেশ্য, খােকসা পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্প আক্রমণ করে সবাইকে হত্যা ও পুনর্দখল করা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের উত্তর পাশে ভাের ৫টার সময় পজিশন নিয়ে অধিনায়কের নির্দেশে একই সাথে হামলা করা হয়। শক্রর প্রধান উদ্দেশ্য হলাে মুক্তিবাহিনী যেখানেই থাকুক না কেন খুঁজে বের করা এবং তাদের সমূলে ধ্বংস করা। আর সে কারণেই খােকসা শত্রু ক্যাম্পের চারপাশে বাংকার করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। খােকসা পাকিস্তানি সৈন্যরা শক্ত প্রতিরক্ষার উপর মুক্তিবাহিনী গুলি করা মাত্র শত্রু একই সাথে গর্জে ওঠে এবং ঘােরতর যুদ্ধ সংগঠিত হয়। পুলিশ হাবিলদার আ. মান্নানের নেতৃত্বে ১০-১২জন ইপিআর সৈনিকসহ ভারতের অপারেশন ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের ভিতর খােকসা এলাকা আক্রমণ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়।
রাত আনুমানিক ৩টার সময় ঠাকুরমারী অপারেশন ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযােদ্ধা দলটি খােকসা আর্মি ক্যাম্পের নিকটবর্তী হয়ে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে পজিশন নেয়। অতঃপর উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৩ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযােদ্ধা আ. করিম এবং ২জন নিরীহ গ্রামবাসী যুদ্ধে শহিদ হন। এ । যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন:
১. মােঃ আবদুল হামিদ
২. মােঃ নূরুল হক।
৩. মােঃ আবদুস সাত্তার
৪.মােঃ সামছুল হক
৫. মােঃ মােকসেদ আলী।
৬. মােঃ আবদুল মালেক
৭. মােঃ শহিদুল ইসলাম
৮. মােঃ গােলাম মােস্তফা
৯. মােঃ আলী প্রমুখ।
শহিদ করিমের লাশ কাসুয়া খাদিমগঞ্জ নামক স্থানে সমাহিত করা হয় ।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড