You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক’-এর একটি প্রচ্ছদ রচনা।

বাংলাদেশ : বেঁচে থাকার সংগ্রাম

[আন্তর্জাতিক পরিসরে ঐ সময় নিউজউইক খুবই প্রভাবশালী পত্রিকা ছিল। এটাঅস্বাভাবিক নয় যে, এই পত্রিকায় মার্কিন ভাবাদর্শিক প্রভাব ছিল- যা এই প্রতিবেদনেও লক্ষ্য করা যাবে এবং বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যতম ঐ পরাশক্তির মনােভাবটিও বােঝা যাবে এ থেকে। তবে ঐ সময়ের বাংলাদেশকে এবং তখনকার আঞ্চলিক পরিস্থিতি বােঝার ক্ষেত্রেও এই প্রতিবেদন বিশেষ সহায়ক। উপরােক্ত দ্বিবিধ লক্ষ্য থেকেই সংযুক্তিতে প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে। এটি সংগৃহীত হয়েছে নিউজউইক-এ বাংলাদেশ : মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় এবং তারপর৬৭৭ শীষক গ্রন্থ থেকে । যদিও প্রতিবেদনের শুরু কিংবা শেষে প্রতিবেদকের নাম উল্লেখ নেই। তবে ধারণা করা যায়, পত্রিকাটির হংকংন্থ তৎকালীন ব্যুরাে চিফ টনি ক্লিফটন প্রচ্ছদ রচনাটি তৈরি করেছিলেন।]

কবিরা যে দেশকে ‘সােনার বাংলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বা প্রশংসা করেছেন সেই দেশটি আজ বসবাসের জন্য নরকে পরিণত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশটিতে মৌসুমী বন্যার মতাে দুর্ভিক্ষ, রােগ-ব্যাধি এবং গৃহযুদ্ধ লেগেই আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলােতে যে দুর্দশা বাঙালিদের ওপর পতিত হয়েছে অতীতে এ দেশের জনগণ তা প্রত্যক্ষ করেনি: একটি প্রলঙ্করী সাইক্লোন বয়ে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এবং সর্বশেষ একটি নৃশংস যুদ্ধ। সদ্য স্বাধীন দেশটির গর্বিত উত্তরসূরিরা ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আবির্ভূত হলেও বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা যেন।দিন দিন বাড়ছে। এখন নতুন করে আরেক দুর্দশার আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে তা হলাে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে দেশটি বিপ্লব, নৈরাজ্য ও ধ্বংসের দিকে চলে যেতে পারে।

দেশের মানুষের কষ্ট লাগবের পরিবর্তে স্বাধীনতা যেন বাঙালিদের নতুন করে একটি দুর্দশায় নিপতিত করেছে। যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ যেন একটি ধ্বংসস্তুপের জাতিতে পরিণত হয়েছে। এর অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর উন্নত ও উর্বর কৃষিভূমি পদদলিত ও অনুর্বর হচ্ছে এবং দেশটির কোষাগার দেউলিয়াত্বের দিকে যাচ্ছে। পনেরাে লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড চলছে। নতুন বাংলাদেশের গর্ব এবং জাতীয় বীর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হলেও দেশের এত বড় দায়িত্ব এখন পর্যন্ত দক্ষ হাতে সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি এবং তার সম্ভাবনাও নেই। সােভিয়েত ইউনিয়নই একমাত্র দেশ যে বাংলাদেশে নতুন প্রভাববলয় বিস্তারের চেষ্টা

……………………………….

৬৭৭) হাসান শাহরিয়ার, উৎস প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ১০৫-১১০।

Page 572

চালাচ্ছে। এ ছাড়া, বিশ্বের উন্নত দেশগুলাে বাংলাদেশের দুর্দশা মােচনের ক্ষেত্রে উদাসীন রয়েছে।

বিশ্বের কোনাে কোনাে সম্মানিত ব্যক্তি দেশটির পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে এটা হতবুদ্ধিজনক যে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের সব দেশ বাংলার নতুন সমস্যা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি বাঙালিদের জন্য হুমকিস্বরূপ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই পরিবর্তনের শিকার’, এই মন্তব্য করে ঢাকায় জাতিসঙ্রে ত্রাণ কার্যক্রমের পরিচালক সুইজারল্যান্ডের টনি হেগেন বলেন, এটি পরিমাপের কোনাে মাপকাঠি নেই। অতীতে বিশ্বে এ ধরনের ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায়নি।

এরপরও যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বড় ধরনের কোনাে বিপর্যয়ের আশঙ্কা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত মানবিক সাহায্যের ৬০ শতাংশ বাতিল করেছে। গত সপ্তাহের প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন্যাত্রার মান এত নিম্ন পর্যায়ের যে, অর্থনৈতিক সমস্যা তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। আর প্রশাসনের এই ধরনের বক্তব্য এডওয়ার্ড এম কেনেডির মতাে সমালােচকদের ক্ষুব্ধ করেছে। প্রশাসনের এই নীতি সত্যকে বুঝতে অস্বীকার করে, গত সপ্তাহে নিউজউইকের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে কেনেডি বলেন, প্রতিদিন প্রশাসন ত্রাণ বরাদ্দ আটকে রাখছে। এর অর্থ প্রতিদিনই দুর্দশার মাত্রা বাড়ছে।

নিক্সন প্রশাসন মনে করছে, বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত জরুরি সাহায্যের প্রয়ােজন নেই। কারণ বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নেই। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রা খুঁড়িয়ে চলছে। শিল্প কারখানা অলস হয়ে পড়ে আছে। অধিকাংশ কলকারখানার যন্ত্রপাতি ধ্বংস ও তছনছ করে দেয়া হয়েছে। যেসব কারখানা চালু করা যায় সেগুলাে কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বপর্যন্ত চার শত কারখানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের পক্ষীয়দের নিয়ন্ত্রণে। পরিত্যক্ত এই কারখানাগুলাে চালানাের মতাে দক্ষ লােক বাংলাদেশে নেই। প্রকৃতপক্ষে দেশটির পরিবহন এবং যােগাযােগ অবকাঠামাে ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধে পাঁচ শত সড়ক এবং রেল সেতু ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আঁ হাজার ট্রাকের মধ্যে সাত হাজারই ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়েছে। এমন কোন পথ নেই যেখান দিয়ে দেশব্যাপী খাদ্যদ্রব্য বিতরণের কাজটি সহজে করা যায়। হেগেন বলেন, অবস্থা খুবই হতাশাজনক এবং এটা ততােদিনই থাকবে যতদিন পর্যন্ত না আমরা যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত করতে না পারি। তবে এই কাজটি করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।

শখ : অবস্থার আরেকটি খারাপ দিক হলাে, বাংলাদেশে যে সাহায্য-সহযােগিতা করা হয়েছে কিংবা যেসব দ্রব্য সরবরাহ করা হয়েছে সেগুলাে কোনাে কাজে আসবে না। পশ্চিম জার্মানি থেকে দামি ২ লাখ ৫০ হাজার উলের তৈরি আন্ডারওয়ার এসেছে যা বাংলার এই দুঃসহ গরমে ব্যবহারের অযােগ্য। নরওয়ে থেকে আসা শীতের কাপড়গুলাে কেবল গুদামঘরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিমান ভর্তি সামুদ্রিক মাছ আসছে নদী বিধৌত মৎস্যসমৃদ্ধ এই দেশে। তাছাড়া, অপ্রয়ােজনীয় জিনিস কিনতে অর্থের অপচয় হচ্ছে। দেশের বৃহত্তম দুটি সেতুর পুনঃনির্মাণে ছয় মিলিয়ন ডলার হলেই যথেষ্ট। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে কম্বল কিনতে। একইভাবে দু’লাখ ডলার দিয়ে।

Page 573

হাজার হাজার কূপের পানি বিশুদ্ধকরণে হ্যান্ডপাম্প কেনা যেত। কিন্তু সেই অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে ঔষধ কেনার জন্য বিমানের ভাড়া পরিশােধ করতে।

দেশটিতে প্রতিদিনই কলেরার প্রকোপ বাড়ছে। আর এর কারণ দূষিত পানি। হেগেন বলেন, ‘বাংলাদেশ শৌখিন দাতব্য কাজের এক খেলার মাঠ। আপনি শিশুখাদ্য দিয়ে সেতু নির্মাণ করতে পারেন না এবং কম্বল দিয়ে খাদ্য পরিবহণ করতে পারবেন না। আমাদের প্রয়ােজন নগদ অর্থ।

শরণার্থী : বাংলাদেশে অরাজক পরিস্থিতি শক্ত হাতে দমন না করলে কেবল ভাগ্যপীড়িত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ লােককে যদি অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডায় জড়াে করা হয়, তাহলে জনসংখ্যার যে ঘনত্ব হবে তা বাংলাদেশের সমান। আর প্রতি সপ্তাহেই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী এক কোটি বাংলাদেশি শরণার্থীর মধ্যে ৯৭ লাখ দেশে ফিরেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দেশে ফিরে আসাটা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। জাতিসঙ্রে হিসাব মতে, ১৬ লাখ বাসগৃহে পরিবার প্রতি গড়ে সাত জন করে সদস্য আছে। এগুলাে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের শহরগুলােতে হাজার হাজার শরণার্থী ফিরে এসে ভাসমান অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত সপ্তাহে এক লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি বেকার যুবক রাজধানী ঢাকায় এসেছে। তাদের অনেকে দখল করা কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির নিচে অথবা অগ্নিদগ্ধ রেলকারে ইট মাথা দিয়ে ঘুমাচেছ।

বেকারত্ব ও অপুষ্টিজনিত মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে আগামী মাসগুলােতে পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটা হলে একটি মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। আগামী জুন মাসে গ্রীষ্মকালীন বন্যায় দেশটির তিন-পঞ্চমাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা অবশ্য এ ব্যাপারে সন্দিহান। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, এটা সম্ভব হলেও সম্ভাব্য নয়। তিনি বলেন, আমি এই।দফতরে গণদুর্ভিক্ষের কোনাে সম্ভাবনা দেখছি না। কিংবা উদ্বেগ লক্ষ্য করছি না। কিন্তু অন্যরা এতটা আশাবাদী নন। প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্য চালনা বন্দরে পড়ে আছে। বণ্টন না করায় সেগুলাে এভাবে রয়েছে। এখন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে খাদ্য।নিয়ে দাঙ্গা বাঁধতে পারে বলে হেগেন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

সহিংসতা : এই ধরনের দাঙ্গা বাঁধলে তা হবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। এই ধরনের একটি আশঙ্কা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সকলের মনে। প্রধান শহরগুলােতে রাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিত্যদিনই লুটপাট হচ্ছে। (এককালের ধনাঢ্য এক লােক সম্প্রতি থানায় আসেন আণ্ডারওয়্যার পরিহিত অবস্থায়। তার বাড়ি সাতবার লুট করার পর তার কাছে আর কিছুই ছিল না।) এর চেয়ে জটিল হলাে উত্তর ভারতের ঘৃণিত ১৫ লাখ বিহারি মুসলমানকে নির্যাতন। এরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযােগিতা করেছিল। স্বাধীনতার পর দুই সপ্তাহের কিছু কম সময়ের মধ্যে একটা মারাত্মক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। খুলনার কাছে একদল বাঙালি বিহারিদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। তারা নির্বিচারে এদের শত শত লােককে হত্যা করে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই চরম অবনতির একটা কারণ আছে। তা হলাে মুক্তিবাহিনীর অনেক গেরিলা এখনাে

Page 574

অস্ত্রসমর্পণ করেনি। অন্যতম সহিংস চরমপন্থী আব্দুল কাদের সিদ্দিকী আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি পাকিস্তানি বন্দিদের জনতার সম্মুখে বেয়ােনেট দিয়ে হত্যা করেছেন। তিনি এখনও ব্যক্তিগত বাহিনী পরিচালনা করছেন।

এই ধরনের অসংখ্য সমস্যার সমাধান করতে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন ব্যর্থ হয়েছে। অথচ মুজিব দিনে আঠারাে ঘণ্টা কাজ করে বাহ্যত এক ব্যক্তির শাসন পরিচালনা করছেন। তার বাড়িতে সব সময় সাহায্য প্রার্থীদের ভীড় থাকে। এমনকি তাঁর পােশাক পরার সময় এবং নাস্তা পরার সময়ও তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তার অফিসে ছাত্ররা বইয়ের জন্য আসছে। কর্মকর্তারা কাগজপত্র স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করছেন। আবার কেউ আসছেন হারানাে ট্রাক খুঁজে পেতে। দুঃখজনক বিষয়, সদয় প্রধানমন্ত্রী। কাউকে অসন্তুষ্ট করতে চান না। এই কাজটি করতে তিনি অক্ষম। এজন্য কোনাে কিছুই হয় না। অনেকে তিক্তভাবে হতাশা প্রকাশ করেন। এইভাবে কেমন করে এক লােক দেশ পরিচালনা করতে পারেন, ঢাকার এক কূটনীতিক এমন প্রশ্ন করে বলেন, এটা যেন একটা পাগলা গারদ।

তা-ই হবে। দেশের সমস্যার সমাধান নয়, মুজিবের রােজনামচায় অনেকের ব্যক্তিগত চাহিদা মিটানাের চেষ্টা। গত সপ্তাহে তিনি নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর আরনড ডি বর্শগ্রেভকে জানান, তিনি তাঁর বামবাহুতে এবং বক্ষস্থলে ব্যথা অনুভব করছেন। কিন্তু আমি কী করে বিশ্রাম নেব? আপনি দেখেন এসব লােক আমার। সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছে। যখন তারা চলে যাবে তখন অন্যকিছু হবে।’ তিনি অপর একজন বিদেশি সফরকারীর কাছে অভিযােগের সুরে বলেন, “এই কাজের চেয়ে পাকিস্তানের কারাগার মন্দ ছিল না।

এটা নিশ্চিত, মুজিবের প্রশাসন তার মিত্রদের কাছ থেকে, বিশেষ করে ভারতের সহায়তা পাচ্ছে। ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গত সপ্তাহে একদিকে ভারতীয় সর্বশেষ সেনাদলটি বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে।এবং অন্যদিকে মুজিব ভারতের সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একমত হয়েছেন। একটি হলাে তাঁর সরকার এসব পাকিস্তানি কারাবন্দির বিচার করতে পারবে যাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে নৃশংসতার অভিযােগ রয়েছে এবং আরেকটি দাবি ছিল, অন্য যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যাবর্তনের আগে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলােতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা ভাটা।পড়েছে। গত সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন মুজিবের সঙ্গে আলােচনার জন্য বাংলাদেশে আসেন তখন তাঁকে দেওয়া অভ্যর্থনা জৌলুসপূর্ণ ছিল না। পাকিস্তানি শাসনের শেষ দিনগুলােতে ভারতীয়রা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পাট নিয়ে যায় এবং বাংলাদেশ এর ফলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ভারত পাকিস্তানের সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল তখন এই সব অস্ত্রের জন্য কর পরিশােধ করতে হয়েছে এই বাংলার টাকায়। বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “যুদ্ধে লুষ্ঠিত যেসব জিনিসপত্র ভারত নিয়েছে সেগুলাে আমাদের।’

Page 575

বৈরিতা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাঙালিরা যে বৈরি ভাব পােষণ করে, সেই তুলনায় বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে ঠান্ডাভাব খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই দেশটি ছাড়া অপর বৃহৎশক্তি চীনও একই কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানান, ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার সহায়তার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা পরে বাতিল করা হয়। কারণ ওয়াশিংটন ও ঢাকার মধ্যে কোনাে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বললেন, এখন পর্যন্ত আমরা রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিইনি। অতএব আমরা সাহায্য দিতে পারি না। কিন্তু এই যুক্তি অনেকের কাছেই যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। মিশিগানের লেনসিং জরুরি ত্রাণ তহবিল ইনকরপােরেটেড-এর ৭০ সদস্যের একটি তহবিল সংগ্রহকারী দল গত সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে ফিরেছে। তারা ত্রাণের সংকটাপন্ন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে। একজন সদস্য বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, সম্পূর্ণ ভুলবশত আমাদের সরকার এই কাজে সাড়া দিচ্ছে না। অন্যরা বলেন, গত এক পক্ষকাল যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র ত্রাণের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। তারা মনে করেন, পাকিস্তানকে সমর্থন এবং ত্রাণ আটকে রাখার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখন মুখ দেখাতে পারছে না। এটি করলে তাদের হয়তাে ভুল স্বীকার করা হবে। এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য দানের ক্ষেত্রে সােভিয়েত ইউনিয়ন যেন আরও বেশি আগ্রহী হয়। ভারত এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাশিয়া চ্যাম্পিয়নের ভূমিকা পালন করেছে, এই মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, তারাই এখন অর্থ যােগান দিক’ এবং ডি বর্শগ্রেভ যখন গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেন তখন তিনি দেখেছেন রাশিয়া সেই কাজটিই করছে। নিম্নে তার প্রতিবেদন :

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাশিয়া সময়ের কোনাে অপচয় করেনি এবং চেষ্টার কোনাে ত্রুটিও করেনি। তিন সপ্তাহ আগে মুজিব মস্কো যাওয়ার আগে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভ্যালেন্তিন পপভ রিলিফ সরবরাহ তুরান্বিত করার লক্ষ্যে পােতাশ্রয় পরিষ্কার করার কাজটি রাশিয়াকে দিতে অনুরােধ জানান। নিমজ্জিত ২৯টি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচল ব্যাহত করছে এবং ১০০টি ছােট জাহাজ অপর বন্দর চালনাকে অক্ষম করে তুলেছে। ঢাকার কাছে এই প্রকল্পটি অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে ছিল। কিন্তু মুজিব এখন পর্যন্ত আশা করছেন, জাতিসঙ্ঘই কাজটি করে দিবে। জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ কার্যক্রমের প্রশাসক হেগেন আশ্বস্ত করেছিলেন, জাতিসঙ্ঘ এই প্রকল্পটি অনুমােদন দিবে। বাঙালির এই নেতা রাশিয়াকে কাজটি দেয়ার বিষয় থামিয়ে রাখেন। কিন্তু মুজিব মস্কো থেকে ফেরার পর দেখলেন নিউ ইয়র্কে অবস্থিত জাতিসঙ্ঘ সদরদপ্তর প্রকল্পটির অনুমােদন দেয়নি। ‘জাতিসঙ্ঘকে এই উদ্ধারকার্যটির বিষয় ভুলে যেতে বলুন, প্রধানমন্ত্রী তখন হেগেনকে বললেন। আমরা সােভিয়েতের প্রস্তাব গ্রহণ করেছি। আলােচনার এখানেই সমাপ্তি।

সােভিয়েত ইউনিয়ন এটা সুস্পষ্টভাবে আশা করেছিল, পােতাশ্রয় পরিষ্কারকরণের কাজটি করতে পারলে তারা দীর্ঘদিনের জন্য বঙ্গোপসাগরের দুটি বন্দরের কাজ পেতে পারে এবং ভারত মহাসাগরে তাদের রণতরী মােতায়েন করতে পারবে। কিন্তু রাশিয়া অন্যভাবেও বঙ্গোপসাগরে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা নতুন এই জাতিকে মিগ বিমানবহর এবং ছােট পরিবহন বিমান কেনার প্রস্তাব দেয়। তারা তাদের দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৯০ জনে উন্নীত করে। এদের মধ্যে অনেকে অনর্গল।

Page 576

বাংলা বলতে পারে। তাদের প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে হাত করে তারা যে কোনাে কাজ করিয়ে নিতে পারে। সােভিয়েত গাড়িগুলাে কূটনীতিক নম্বরপ্লেটের লাইসেন্স পায়। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন সােভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি দৃশ্যমান। কমিউনিজম প্রচারণার ছবি টেলিভিশনে দেখানাে হয়। বিভিন্ন শহরে কমিউনিজমের ওপর সেমিনার-সিম্পােজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়।

তদবির : সামান্য গােয়েন্দাগিরির মাধ্যমে বাংলাদেশে রাশিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য জানা যায়। সােভিয়েতরা বিশ্বাস করে এবং নিজেদের মধ্যে ঘরােয়া আলােচনায় বলে, বাংলাদেশে সত্যিকারের বিপ্লব এখনাে আসেনি। যখন আসবে, তখন যেন এর ধরন হয় রাশিয়ার মতাে, চীনের মতাে নয়। সােভিয়েত দৃশ্যপট অনুযায়ী, বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশা ও অস্থিরতাকে সম্বল করে তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল মুজিবকে আরও বামের দিকে ফেরানাে যাবে। বাংলাদেশ যদি কোনােভাবেই সেই লক্ষ্যের দিকে না যায় তাহলে সােভিয়েত ইউনিয়ন তদবির করবে। তারা তাদের স্থানীয় সহানুভূতিশীলদের বলেছে, বাংলাদেশের মেহনতী মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুফল পায়নি। অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পকেট ভারী হচ্ছে।

মুজিব ব্যতীত অনেক বাঙালিই মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকলে তাদের সমস্যা থাকবে না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা (আমেরিকানরা) যদি চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারেন, তাহলে আপনারা সবকিছুই করতে পারেন। আমি আপনাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা আমার জনগণকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসুন। আসছে সপ্তাহে নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশকে কূটনীতিক স্বীকৃতি দিতে পারে। এর ফলে আমেরিকার সাহায্য বাড়বে। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি এশীয় অঙ্গীকারে সায় দেবে। যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বহুবিদ সমস্যায় সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ আরও হ্রাস পাবে। ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে, সােভিয়েত ইউনিয়ন অমীমাংসিত সমস্যা কাঁধে নিয়েছে এবং তা দেশটির জন্য দুঃখের কারণ হতে পারে। কিন্তু এই আর্থিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা বড় ধরনের মানবিক সাহায্যের ক্ষেত্রে বাধা হলে তা সামগ্রিকভাবে গ্রহণযােগ্য হবে না। কোনােভাবেই তা সর্বজনীনভাবে গ্রহণযােগ্য হবে না। গত সপ্তাহে ঢাকায় এক বিদেশি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে উদার জাতি এতটা উদাসীন হবে না। লাখ লাখ লােক যখন ক্ষুধার্ত, তখন অবশ্যই তাদের পাশে দাড়াবে।

নিউজউইক

২৭ মার্চ ১৯৭২

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!