মুজিব শাসন : একজন লেখকের অনুভব আহমদ ছফা
[এই লেখায় উল্লিখিত মতামত একান্তই প্রয়াত লেখকের। এখানে লেখাটি সংযুক্ত
হয়েছে তৎকালীন আর্থসামাজিক প্রসঙ্গগুলাে বােঝা ও তার বিরােধিতার স্বরূপ আঁচ
করার উদ্দেশ্যে। আ.প]
চৌদ্দই আগস্টের রাতে আমি নতুন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সাতাশ নম্বর সড়কের একটি হােস্টেলে এক বন্ধুর সঙ্গে ঘুমােতে গিয়েছিলাম। সাতাশ নম্বর আর বত্রিশ নম্বর সড়কের ব্যবধান বড় জোর তিন থেকে চার শ’ গজ। এই বত্রিশ নম্বরেই দারা পুত্র পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আনুমানিক রাত এগারােটা হবে হয়তাে। বত্রিশ নম্বর পেরােবার সময় খাকি পােশাক পরা আট দশজন পুলিশ দেখলাম। কয়েকজন অফিসার, বাকিরা সেপাই। বন্দুক উচিয়ে রাষ্ট্রপতির বাসভবনের সামনের সড়কের মুখে পাহারারত। এই পথে বেশ কদিন থেকে যাওয়া আসা করছি। প্রায়ই দেখতাম ঘুণটি ঘরে দু’ থেকে তিনজন সেপাই দাঁড়িয়ে। কোনাে অফিসার দেখেছি মনে পড়ে না। আজ পাহারাদারদের দল ভারি দেখেও মনে কোনােরকম ভাবান্তর আসেনি। আগামীকাল পনেরাে আগস্ট বেলা দশটার দিকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এককালের বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আগমন করছেন। হয়তাে সেজন্য এই অধিকসংখ্যক সেপাই-সান্ত্রীর আনাগােনা। এখন পর্যন্ত সবকিছু পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ঘটে আসছে। কোথাও কোনাে ঝঞ্জাট ঘটেনি। শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনােপলক্ষে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়ানাে-ছিটানাে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে সাজানাে গােছানাের পালা। রাস্তার এবড়াে-থেবড়াে গর্তগুলােতে সুরকি পড়েছে। রােলার ঘুরছে, পীচের আস্তরণ বসেছে। গত এক পক্ষকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলােতে, কলাভবনে, বাণিজ্যভবনে, বিজ্ঞানভবনে জোর মেরামতির কাজ চলছে। অনেকদিন অনাদরে মৃত জন্তুর কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাড়ামুড়া দেয়ালগুলাে চুন, সুরকির প্রসাধন স্পর্শে হেসে উঠেছে। সমস্ত এলাকাটায় একটা সাজ সাজ রব, তাড়াহুড়াে ব্যস্ততা এসব তাে আছেই।
রাতের আঁধারে শক্তহাতে আলকাতরা দিয়ে দাবড়া করে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা দেয়াল লিখনসমূহ নবীন চুনের প্রলেপের তলায় ঢাকা পড়েছে। সুন্দরীর ললাটে সিন্দুর বিন্দুর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সুইচ্চ শুভ্র প্রাচীরের কপােলদেশে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে লেখা সুন্দর লিখনমালা দৃষ্টিকে দূর থেকে টেনে নিয়ে যায়। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মহানায়ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লৌহমানব ইত্যাদি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় নানান রঙের চিত্রলেখায় সেজে সুন্দর হয়ে উঠেছে। চারদিকে একটা উৎসবের হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা কালাে কালাে সাপের শরীরের মত চেকন বাঁকা রাস্তাগুলাের মােড়ে মােড়ে উল্লসিত অভিনন্দনের বাণী বুকে ধারণ করে রাতারাতি ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে নানান রঙের প্ল্যাকার্ড। তােরণরাজি
Page 546
মাথা তুলেছে। সর্বত্র একটা উৎকণ্ঠার ভাব আগামীকাল কাঁটায় কাঁটায় বেলা দশটায় তিনি আসছেন।
প্রায় একপক্ষকাল ধরে দিনে রাতে কাজ চলছে। উপাচার্যের আহার নেই, নিদ্রিা নেই। সাড়ে সাত লাখ টাকা নগদে বিলিয়ে দিয়েও মনে মনে তিনি স্বস্তিবােধ করতে পারছেন না। দৈবাৎ যদি কোনাে ত্রুটি থেকে যায়, আর সেখানেই যদি মহামানবের দৃষ্টি আটকে যায়, তিনি মুখ দেখাবেন কেমন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতির এটা প্রথম আনুষ্ঠানিক আগমন। তিনি শুধু রাষ্ট্রপতি নন, বাঙালি জাতির পিতা, মুক্তিদাতা, বাংলার হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ, মাঠের মানুষের বন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সরকার সমর্থক ছাত্রদলটির হােমরা-চোমরা কর্মীদের বেশ ব্যস্তদিন কাটছে। তারা দিবসে কাজের তদারক করে, রাজনীতির পাহারায় থাকে। বাংলাদেশে দুষ্ট লােকের অভাব নেই। রাষ্ট্রপতির আগমনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিহীন অলক্ষুণে কোনাে দেয়াল লিখন কেউ লিখে যেতে পারে, অনেক অর্থব্যয়ের শ্রমের শিল্পকর্মগুলাের অঙ্গহানি ঘটাতে পারে, সুন্দর চিত্রলেখাসমূহের লাবণ্যহানি করতে পারে, এ রকম কিছু ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাই আগেভাগে এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। পুরাে দায়িত্বটা রাষ্ট্রপতির জ্যেষ্ঠপুত্র গ্রহণ করেছেন। তিনি তার দীর্ঘ দেহ এবং বহু বিশিষ্ট বন্ধুদের নিয়ে অবিরাম ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের গোঁড়া সমর্থক ছাত্র এবং শিক্ষকদের মনােভঙ্গিটা এ রকম, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুরে চরণ ফেলামাত্র বাংলাদেশে একটি অভিনব যুগের অভ্যুদয় ঘটবে।
* * *
শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনটা ছিল কৌশলগত দিক দিয়ে তার নতুন শাসনতান্ত্রিক বিধি চালু করার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। উনিশ শ’ পঁচাত্তর সালের শুরুর দিকে তিনি বিরােধীদলীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের বেশকিছুকে জেলে ভরেছেন। তাঁর একনায়কত্বের প্রতিস্পর্ধী তরুণ বয়স্ক রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের খুশিমাফিক হত্যা করা হয়েছে এবং সে কথা বলে প্রকাশ্যে গর্ববােধ করতেও তাঁকে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর স্থলে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেছেন তিনি। তার নিজের দল আওয়ামী লীগ, অন্য দুটো সমর্থক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেউ কোনাে ওজর আপত্তি উত্থাপন করেননি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত এই তিনটি দলের প্রত্যেকটিরই টিকে থাকার জন্য শেখ মুজিবের ছত্রছায়ায় দাঁড়ানাের প্রয়ােজন ছিল একেবারে অপরিহার্য। মুজিব থাকলে তারা সবাই আছেন, তিনি নেই তাে কেউই নেই। তাই তাদের কারাে পক্ষে এই জনগণনন্দিত অধিনায়কের কোনাে সিদ্ধান্তকে দলীয় কিংবা আন্তঃদলীয় শৃঙ্খলা প্রয়ােগ করে রাশ টেনে ধরা অসম্ভব ছিল।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি তার প্রতি সমর্থনবিমুখ পত্র-পত্রিকাসমূহের মুখ প্রায় বন্ধ করে নিয়ে আসছিলেন। বিরােধী পত্রিকাগুলােতে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে, সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে, সম্পাদকদের জেলে পুরে, ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে ইত্যাদি নানা ছলছতাের সাহায্যে অনেকগুলাে দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকার প্রকাশ সাফল্যজনকভাবে বন্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। এই চরম মার হজম করেও যে
Page 547
গুটিকয় পত্রিকা প্রাণ নিয়ে কোন রকমে বেঁচেছিল, সেগুলাের বিরুদ্ধে কোনাে রকমের অভিযােগহীনতাকেই অভিযােগ হিসেবে দাঁড় করিয়ে সরকারি ক্ষমতা প্রয়ােগ করে বন্ধ করে দিলেন।
তারপরে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরােধী কোন দলের মালিকানাধীন কোনাে পত্রিকা ছিল না। ব্যক্তিমালিকানাধীন পত্রপত্রিকার সংখ্যাও ছিল একেবারে অল্প । শেখ সাহেবের নিজের দল আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থক দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ চালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দলকে তিনি অঙ্গুলি হেলেনে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে ইচ্ছে পরিচালনা করতেন। এই দলগুলাের ঘােষিত রাজনৈতিক দর্শন যা-ই হােক না কেন, কার্যত তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সব রকম নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। অঙ্গদলসমূহের পরামর্শে নাকি নিজের বিবেচনা অনুসারে বলা খুব মুশকিল। তিনি সরকারি দল এবং সরকারের অন্ধ সমর্থক দল দুটিকে ভেঙে একটিমাত্র জাতীয় দল গঠন করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলেন। আর নতুন জাতীয় দলের নামকরণ করলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ সংক্ষেপে বাকশাল। বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নাম ঘােষণার পরে তখন পর্যন্ত যে কয়টি ব্যক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন পত্রিকা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আপসরফা করে বেঁচেছিল, সেগুলােকে পুরােপুরি সরকারি আওতায় নিয়ে আসার জন্য তিনি সুদীর্ঘ বাহু প্রসারিত করলেন।
বাংলাদেশে ব্যক্তি বা দলীয় মালিকানাধীন দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ছিল একেবারে স্বল্প । অনেকগুলােই সরকারি কোপানলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আইয়ুবের আমলে প্রত্যক্ষভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। একটি বাংলা, অন্যটি ইংরেজি। বাংলা পত্রিকাটির নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা নামে আত্মপ্রকাশ করে। ইংরেজি পত্রিকাটির নাম ‘মর্নিং নিউজ। এ পত্রিকা দুটি ছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারের প্রত্যক্ষ এখতিয়ারে আরাে তিনটি পত্রিকা চলে আসে। তার দুটি দৈনিকের মধ্যে একটি বাংলা এবং একটি সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র পত্রিকা। ইংরেজি দৈনিকটির পাকিস্তান আমলে নাম ছিল পাকিস্তান অবজার্ভার’। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অবজার্ভার’ নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা কাগজটি আগে থেকে দৈনিক পূর্বদেশ’ নামে পরিচিত ছিল এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটির নাম ছিল ‘চিত্রালী’। এই পত্রিকা তিনটির মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, যিনি ন’মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের কার্যকলাপ সমর্থন করেছেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন। তাই পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে পত্রিকা তিনটির প্রকাশনার দায়িত্ব সরাসরি সরকারকে গ্রহণ করতে হয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে বাংলাদেশ যুব আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সভাপতি কেন্দ্রীয় বাকশালের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা এবং রাষ্ট্রপতির বুদ্ধিবিবেচনার একমাত্র ভরসা বলে কথিত জনাব শেখ ফজলুল হক মণি স্বাধীনতার পরে একেবারে শুন্যাবস্থা থেকেই তিন তিনটি পত্রিকার জন্মদান করেছিলেন। একটি ছিল বাংলাদেশের বিচারে ঈর্ষাযােগ্য মানের অধিকারী ইংরেজি দৈনিক, নাম বাংলাদেশ টাইমস’, বাংলা দৈনিকটির নাম বাংলার বাণী এবং চলচ্চিত্র পত্রিকাটি ‘সিনেমা’ নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার
Page 548
আগে তিনি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সাব এডিটরের কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের শাসনকালে জনাব ফজলুল হক মণির মতাে অনেকে এ রকম সামান্য অবস্থা থেকে অকল্পনীয় অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন। অবশ্য তাদের বেশিরভাগেরই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না বলে টাকা-পয়সাকে এমন সুন্দর লাভজনকভাবে বিনিয়ােগ করতে পারেননি। ওপরে বর্ণিত তিনটি বাংলা এবং তিনটি দৈনিকের প্রত্যেকটিই সরকার সমর্থন করে যেত। এই সমর্থন অনেক সময় এত দাসােচিত এবং অমার্জিত রূপ গ্রহণ করত যে, রুচিবান মানুষদের পীড়িত না-করে ছাড়ত না। এই সকল পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা সরকারের সুনজরে পড়ার জন্য তােষামােদ এবং তােয়াজে কে কার চেয়ে অধিক দূর যেতে পারেন সেজন্য রীতিমত প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হতেন। যদিও সেসব লেখা পাঠ করে বিবমিষা ছাড়া নিরপেক্ষ পাঠকের মনে আর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত না।
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত উল্লিখিত ছয়টি পত্রিকা ছাড়া আরাে কয়েকটি পত্রিকা তখনাে ছিল। তার মধ্যে জনপ্রিয়তায় যেটি সবগুলােকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে পত্রিকার নাম দৈনিক ইত্তেফাক’। এই পত্রিকাটির সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নানা উত্থান-পতন ওতপ্রােতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি মাওলানা ভাসানী এই কাগজটির প্রতিষ্ঠাতা হলেও প্রখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়া ছিলেন পত্রিকাটির মালিক এবং সম্পাদক। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রাতিস্বিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী তফাজ্জল হােসেন সাহেব নিজেও ছিলেন একজন আওয়ামী লীগার, শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার পরামর্শ-বুদ্ধি-বিবেচনা আওয়ামী লীগ মহলে অপরিসীম মর্যাদা এবং গুরুত্বসহকারে গৃহীত হতাে। জন্মের শুরু থেকে এই পত্রিকাটি আওয়ামী লীগকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দান করে আসছিল। উনিশ শ’ পঁয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় করার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, ইত্তেফাক পত্রিকা এবং সম্পাদক তফাজ্জল হােসেনের অনন্য সাংবাদিকতার প্রতিভা তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি। তল্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রতি জোরাল সমর্থন প্রকাশ করার অভিযােগে আইয়ুব খান সরকারের গভর্নর মােনেম খান পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করেছিলেন এবং ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। উনিশ শ’ উনসত্তর সালের আইয়ুব বিরােধী অভ্যুত্থানের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে সামরিক সরকারকে বাধ্য হয়ে এই জনপ্রিয় পত্রিকাটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে হয়। এই ‘ইত্তেফাক’ও স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগকে অকুণ্ঠ সমর্থন করে আসছিল। তবে ইত্তেফাকের ভূমিকাটি অতটা মর্যাদাবিবর্জিত ছিল না। এই কাগজ মাঝে মাঝে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের প্রশ্নটি তুলে ধরার চেষ্টা করত। ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির সপক্ষে কখনাে-কখনাে, দু’চার কথা নরমে-গরমে সাহস করে লিখে বসত। ইত্তেফাক ছাড়া অপর প্রাচীন দৈনিক পত্রিকাটির নাম ‘আজাদ। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুসলিম লীগের পুরােধা, কৃতবিদ্য পণ্ডিত এবং এক সময়ের বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে নাম করা সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে এই প্রাচীনতম পত্রিকাটির দৃষ্টিভঙ্গি
Page 549
ছিল রক্ষণশীল এবং সরকার ঘেঁষা। বাংলাভাষা আন্দোলন ছাড়া তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের মধ্যে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে যখনই বিরােধ উপস্থিত হতাে সব সময়েই কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করত। মাওলানা আকরাম খাঁ যতদিন বেঁচেছিলেন এই সুচিহ্নিত ভূমিকা ‘আজাদ’ পত্রিকা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। মওলানা সাহেবের মৃত্যুর পর আজাদের প্রাক্তন ভূমিকার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও পত্রিকা হিসেবে আগের জনপ্রিয়তা হারিয়ে বসেছিল। পরিচালনার ক্রটিই সম্ভবত এর মুখ্য কারণ। স্বাধীন বাংলাদেশে কোনাে রকমে ধারদেনা করে আজাদ পত্রিকার দিন চলছিল। সরকারের বিরােধিতা করার তাে প্রশ্নই ওঠে না। মাঝখানে একবার সরকার পত্রিকাটিকে নিয়েও গিয়েছিলেন।
মােজাফফর আহমদের বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পত্রিকাটির নাম ‘সংবাদ’। এই কাগজ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়াও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করত। দুটি দলই যৌথভাবে ভারত থেকে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কিংবা বলা যায় তারও আগে থেকে অধিকাংশ বিষয়ে আওয়ামী লীগকে ছায়ার মত অনুসরণ করে আসছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই পার্থক্য কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছিল। অধিকন্তু মুজিবুর রহমানের যাবতীয় কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন যােগানাে পত্রিকাটির একটি নৈতিক কর্তব্যও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পত্রিকাটিতেও সরকারি কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হতাে। স্বাধীনতার পর জনপদ’ নামে আরেকটি বাংলা দৈনিক ঢাকা থেকে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের এককালীন সভাপতি এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য কামরুজ্জামান ছিলেন পত্রিকাটির নেপথ্য মালিক। এটিও ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা। দি পিপল’ নামে একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছুকাল আগে জন্মলাভ করেছিল। জনৈক উঠতি বাঙালি ধনী ছিলেন পত্রিকাটির স্বত্বাধিকারী। উনিশ শ’ একাত্তর সালের মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন লাগিয়ে কাগজটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন ভারতে গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থানুকুল্যে কাগজটির পুনঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে পুনরায় কাগজটির প্রকাশ ঘটার পর থেকে সরকারকেই সমর্থন দান করেছিল। উনিশ শ’ একাত্তর সালের পয়লা জানুয়ারি একবার মাত্র সরকারি গুলিবর্ষণ করার প্রতিবাদ করে গরম সংবাদ পরিবেশন করেছিল বলে প্রচণ্ড হুমকির মুখে ভাল ছেলের মতাে সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়।
উনিশ শ’ পঁচাত্তর সালের শুরুর দিকে বিরােধীদলীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ একেবারে পুরােপুরি বন্ধ ঘােষণার পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সমর্থক পত্রিকা গণকণ্ঠের প্রকাশ রুদ্ধ, সম্পাদক দেশের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদ কারারুদ্ধ এবং ছাপাখানায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর আগেও ‘গণকণ্ঠ পত্রিকাটি বন্ধ করার জন্য সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হত দুয়েকবার ডিক্লারেশনও বাতিল করা হয়েছে। মাঝখানে একবার বন্ধও করে দেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকদের সমবেত দাবির মুখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ রহিত হয়ে গেল। গণকণ্ঠের পিছু পিছু সরকার বিরােধী ইংরেজি সাপ্তাহিক ওয়েভ এবং হলিডে কিছুদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছিল। পরে দুটিকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ‘আপত্তিজনক সংবাদ পরিবেশনের
Page 550
দায়ে হলিডে’ সম্পাদক জনাব এনায়েতুল্লাহ খানকে জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। জনাব আলী আশরাফ সম্পাদিত বাংলা সাপ্তাহিক অভিমত’-এরও একই পরিণতি ঘটে।
বিরােধীদল তাে ছিলই না। বিরােধীদলীয় পত্রপত্রিকাগুলােকেও নির্মমভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারসমর্থক পত্রিকাসমূহ এবং সরকারের অন্য দুটো অঙ্গদলের মুখপত্রগুলাে প্রতিটি স্বৈরাচারী পদক্ষেপকে একেবারে নির্লজ্জভাবে অভিনন্দিত করে যাচ্ছিল । তথাপি শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন চালু করার প্রাক্কালে বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা একেবারে কমিয়ে এনে গণমতের বাহনগুলাের কর্তৃত্ব নির্ভরযােগ্য হস্তে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হবে ঠিক হলাে। দুটি বাংলা এবং দুটি ইংরেজি। এটাও টিক হলাে যে বাদ বাকি পত্রিকাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ইত্তেফাক’ কাগজটিকে পুরােপুরিভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হল। ইত্তেফাক’ ছাড়া অপর যে বাংলা কাগজটি বেঁচে থাকবে সেটির নাম দৈনিক বাংলা’। ইংরেজি কাগজ দুটির নাম বাংলাদেশ অবজার্ভার’ এবং বাংলাদেশ টাইমস’। এ পত্রিকাগুলাে একেবারে সরকারি পত্রিকা এবং সাংবাদিকেরা সরকারি কর্মচারীরূপে চিহ্নিত হবেন বলে ঘােষণা দেওয়া হলাে।
একসঙ্গে অনেকগুলাে পত্রপত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে গােটা দেশের সাংবাদিকবৃন্দ ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হন। এই নির্মম অর্থসংকটের দিনে সাংবাদিকেরা সবান্ধবে বেকার হয়ে পড়ার ফলে তাদের সামনে বেঁচে থাকার দ্বিতীয় কোনাে পন্থা উন্মুক্ত রইল না। যে চারটি পত্রিকা প্রকাশিত হবার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে গেছে, সেগুলােতে কোনাে রকমে স্থান করে নেয়ার জন্য প্রত্যেক সাংবাদিক মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের কাছ থেকে ভিন্ন আচরণ আশা করাও বােধহয় সম্ভব ছিল না। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তাদের কর্মসংস্থান করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দান করেছিল এবং সরকার থেকে তাঁরা অল্প-স্বল্প মাইনেও পাচ্ছিলেন। এই অনিশ্চিত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে সাংবাদিকদের মাথায় যে চিন্তাটা প্রথমে এসেছিল তাতে বাহ্যত দাসােচিত আত্মসমর্পণ এবং সুবিধাবাদী চরিত্রের পরিচয় স্পষ্টভাবে ফুঠে উঠলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিচারে তাই-ই ছিল একান্ত বাস্তব এবং যুক্তিসঙ্গত। প্রতিটি আলাদা আলাদা পত্রিকার সাংবাদিকেরা ভাবলেন তারা আগেভাগে যদি সরকারি দলে যােগ দেওয়ার আবেদনপত্রে সই দিয়ে বসেন, সরকার অনুকম্পা করে তাদের কথাটি বিবেচনা করে দেখবেন। এই ধরনের মনােভাবের বশবর্তী হয়ে বন্ধ হয়ে যাবার বেশ কয়েকদিন আগে “দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার ৫ সদলবলে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতরে গমন করে সই করা আবেদনপত্রসমূহ জমা দিয়ে এসে মনে করলেন, যা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এই ঘটনার পর থেকে অন্যান্য চালু এবং বাতিল পত্রিকার কর্মরত সাংবাদিকদেরও বােধদয় ঘটল। তাঁরা ভাবলেন, পূর্বদেশের সাংবাদিকদের মতাে তারাও যেয়ে যদি বাকশালের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই না করেন, তাহলে তাদের চাকুরি হবে না এবং চালু পত্রিকায় কর্মরত থাকলে চাকরিটি টিকবে না। সরকারি পত্রিকায় সরকারিদলের লােকদের কাজ পাবার নৈতিক দাবিই সবচেয়ে বেশি। তারপর থেকে সাংবাদিকেরা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দল বেঁধে নিয়মিত বাকশাল অফিসে ধাওয়া করতে থাকলেন। প্রতিটি পত্রিকার সরকার সমর্থক সাংবাদিকেরা উদ্যোগী হয়ে সহযােগী এবং কলাকুশলীদের টেনে নিয়ে
Page 551
জাতীয় দলের অফিসে হাজিরা দিতে আরম্ভ করলেন। রাষ্ট্রের তৃতীয় স্তম্ভ বলে কথিত সংবাদপত্রের কারিগরদের একাংশ পেশাগত মর্যাদা, স্বাধীনতাস্পৃহা, সত্য এবং ন্যায়- সাংবাদিকতাবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইত্যাদি মহৎ অনুষঙ্গসমূহ বাদ দিয়ে যে নাটকের অবতারণা করেছিলেন বাংলাদেশের সমাজে অনতিবিলম্বে তার প্রভাব অনুভূত হতে শুরু করে। অবশ্য সাংবাদিক মাত্রেই যে বাকশালে যােগ দেওয়ার জন্য লালায়িত ছিলেন তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। চাপের মুখে বাকশাল সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করে একজন সাংবাদিককে আমি সত্যি সত্যি নিজের চোখে কাঁদতে দেখেছি। বেশ ক’জন সাংবাদিক ভয়ভীতি অগ্রাহ্য করে শেষপর্যন্ত সাংবাদিকতার আদর্শ এবং নীতিতে অটল ছিলেন। ইত্তেফাক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব আসাফউদ্দৌলা রেজা আবেদনপত্রে সই করেননি। এই অভিযােগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ‘ইত্তেফাক’ নতুনভাবে প্রকাশ পাওয়ার সময় তার চাকরি চলে যায়।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘােষণা করেছিলেন, আমলা, কর্মরত সাংবাদিক, স্বায়ত্তশাসিত এবং আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারীবৃন্দ, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক যে কেউ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অবশ্য কাকে সদস্যপদ দেওয়া হবে, কাকে হবে না সেটি সম্পূর্ণ কর্তৃপক্ষের বিবেচনার বিষয়।
যেকেউ ইচ্ছা করলে সরকারি দলে যােগদান করতে পারবে, এটা ছিল সরকারি ঘােষণা। আসলে যােগ না দিয়ে কারাে নিস্তার পাবার উপায় ছিল না। ভেতরে ভেতরে সমস্ত সরকারি বেসরকারি দফতর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকার সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে চাচ্ছিলেন, সবাইকে জাতীয় দলে যােগ দেওয়ার আবেদনপত্রে সই করতে হবে। কর্তৃপক্ষ যাকে বিপজ্জনক মনে করেন সদস্যপদ দেবেন না, কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেঁচে-বর্তে থাকতে চাইলে জাতীয় দলের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করতেই হবে। সর্বত্র বাকশালে যােগ দেওয়ার একটা হিড়িক পড়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাকশালের কেন্দ্রীয় দফতর উদ্বোধন করতে এলেন তাঁকে স্বাগত সম্ভাষণ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে গােটা দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, কৃষক সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হাজির থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম ধারাস্রোতে প্লাবিত হয়ে ভেজা কাকের মতাে সুদীর্ঘ মানুষের সারি কীভাবে রাস্তায় তারা অপেক্ষা করছিলেন, যারা এ দৃশ্য দেখেছেন ভুলবেন মহিলাদের গাত্রবস্তু ভিজে শরীরের সঙ্গে একশা হয়ে গিয়েছিল। এই সুবিশাল জনারণ্যে আমাদের দেশের নারীকুলকে লজ্জা-শরম জলাঞ্জলি দিয়ে সশংকিত চিত্তে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিল।
নাগরিক জীবনের সর্বত্র একটা আতঙ্কের কৃষ্ণছায়া প্রসারিত হয়ে আসছিল। এ ধরনের চিন্তা, বুদ্ধি এবং সাহসরােধী পরিবেশে যেখানে মানুষের বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না, বেঁচে থাকা বলতে শুধু বােঝায় কোনাে রকমে পশু অস্তিত্বের সংরক্ষণ- নৈতিক সাহস, মানবিক মূল্যবােধ ইত্যাকার সুসভ্য জীবনের বােধগুলাে সর্বপ্রকারের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। সবখানে আতঙ্ক, উদ্বেগ। এ তাে গেল একদিকের চিত্র। অন্যদিকে গ্রাম-বাংলার মানুষদের অবস্থা দুর্দশার শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। নিত্য
Page 552
প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে। দেশে অভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ক্ষুধার তাড়নায় মা সন্তান বিক্রি করছে। স্বামী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করছে। বিনা কাফনে লাশ কবরে নামছে। সৎকারবিহীন অবস্থায় লাশ শৃগাল-কুকুরের আহার্য হওয়ার জন্য পথে পথে পড়ে থাকছে। চারদিকে জুলন্ত বিভীষিকা, চারদিকে হা-অন্ন, হা-অন্ন রব। এই অন্নহীন বস্ত্রহীন মানুষের দঙ্গল একমুঠো ভাত, এক ফোটা ফেনের আশায় ঢাকা শহরে এসে শহরের ফুটপাতে চিৎ হয়ে মরে থাকছে।
একদিকে উদ্ধত উলঙ্গ স্বৈরাচার, অন্যদিকে নির্মম দারিদ্র্য, বুভুক্ষা- এই দুইয়ের মাঝখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অতি কষ্টে, অতি সন্তর্পণে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক অন্তর্দাহের আঁচ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলােতেও লেগেছে। অনেকগুলাে পরিবার মাছ-মাংস স্পর্শ করা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে। কোনাে কোনাে পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা দু’বেলা ভাত খেত দু’বেলা আটা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আবার অনেক পরিবারের দু’বেলা আটাও জোটে না।
অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনক্ষমতার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সুযােগ-সুবিধার অন্ত নেই। তাদের হাতে টাকা, ক্ষমতা সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়মে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আইন তাঁদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির সহায়, সরকারি আমলারা আজ্ঞাবহ মাত্র, সামাজিক সুনীতি, ন্যায়-অন্যায়, নিয়ম-কানুন কোনাে কিছুর পরােয়া না করলেও তাঁদের চলে। উনিশ শ’ একাত্তর সালের যুদ্ধের পর থেকে এই শ্রেণীটি বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নৈরাজ্য থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করে উঁটো হয়ে মাথা তুলছিল। ঢাকা শহরের প্রশস্ত রাজপথ থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ীর আড়ত, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, রেডিও-টেলিভিশন, লেখক-সাহিত্যিকদের আড্ডা, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির এমনকি দূর-দূরান্তের পল্লিগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় এই হঠাৎ জন্মানাে নব্যনবাবদের সীমাহীন প্রতিপত্তি। এদের অনুমােদন ছাড়া মরণােন্মুখ রােগী এক ফোটা ওষুধ পেত না, শীতার্ত উলঙ্গ অসহায় মানুষের পরনে রিলিফের একখানি বস্ত্র উঠত না, এক সের রেশনের চাল কি আটা বিলি হতে পারত না। বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যার্থে যে দেশ থেকেই সাহায্য আসুক না কেন এই শ্রেণীটির দুষ্ট ক্ষুধার চাহিদা মিটাতে সবকিছু শেষ হয়ে যেত। এদের অনুমােদন ছাড়া কোন অফিসে একজন সামান্য পিয়নের নিয়ােগপত্র পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, যােগ্যতা যা-ই হােক না কেন। রােগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানাে যেত না, ছাত্রকে স্কুলে। বেবাক দেশের দশদিকে এরা ছড়িয়েছিল। আমলাদের মধ্যে, নিম্নশ্রেণীর মধ্যে, শিক্ষকদের মধ্যে, গায়ক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে অন্তরীক্ষে অবস্থান করে একজন মাত্র মানুষ সবকিছুর সুতাে ধরে রয়েছেন তিনি বাংলাদেশর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার তিন বছর সময়ের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি এ রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব এ দু’টো শব্দ পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেখ মুজিব যদি বলতেন আমিই হলাম গিয়ে বাংলাদেশ, তাহলে তিনি এতটুকুও মিথ্যে বলতেন না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে একে একে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের গলা টিপে ধরেছিলেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলােকে তিনি নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছেন। তাদের
Page 553
ঘরবাড়ি ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছেন, পরিবার-পরিজনদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছেন। তাদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করে কারাগারের উদরে নিক্ষেপ করেছেন। দেদার নেতা এবং কর্মী হত্যা করেছে রক্ষীবাহিনী। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী দমন করার নামে সরল মানুষদের পাখির মতাে গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। শেখ মুজিব বিরােধী কোনাে কিছুর আভাস পাওয়ামাত্র রক্ষীবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে ছুটে গেছে। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, ভেঙে-চুরে তছনছ লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা তিরিশ বছর বয়স্ক সিরাজ সিকদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদকক্ষে উল্লসিত উদৃঘােষণায় ফেটে পড়ে বলেছিলেন, এখন কোথায় সিরাজ সিকদার? গ্রেফতার, নির্যাতন। এসব শেখ মুজিব প্রশাসনের একটা অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য দিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিল, সম্পাদক আ স ম আবদুর রবসহ অসংখ্য নেতা এবং কর্মী, জাতীয় লীগের অলি আহাদসহ অনেককে তিনি কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। বিপ্লবী মতাদর্শী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের কথা বাদ দিয়েও তিনি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিকবােধে আস্থাশীল রাজনৈতিক দলগুলােরউপস্থিতিও বরদাশত করতে পারতেন না।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর তিনি দেশের বিপর্যস্ত অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য সময়ে অসময়ে হুঙ্কার দেওয়া ছাড়া কোন বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করেননি। পক্ষান্তরে তার বিরােধীদের সমূলে বিনাশ করার এক সর্বনেশে খেলায় মেতে উঠেছেন। এমনকি সে বিরােধিতা নিজের দলের লােক থেকে এলেও এবং একান্ত ন্যায়সঙ্গত হলেও তিনি সহ্য করেননি। দৃশ্যত বিরােধীদলবিহীন খােলা ময়দানের তিন তিনটি দলের সর্বময় কর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিশ্চিন্তবােধ করতে পারছিলেন না। তিনটি দলকে এক করে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন। সংবিধান বাতিল ঘােষণা করলেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বয়-বেয়ারার মতাে আচরণ করলেন। উদারনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সময়ের পরিসরে নিজেকে বাঙালি জাতির সংগ্রামী প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে নিতে পেরেছিলেন এবং বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের নায়করূপে সারাবিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিন বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ দলটির অস্তিত্ব বিলীন করে দিলেন। উনিশ শ’ উনসত্তর সালের পর থেকে এ পর্যন্ত তাকে ভাগ্যদেবতা অযাচিতভাবে কৃপা করে আসছে। উনিশ শ উনসত্তর সালে আইয়ুব বিরােধী অভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উঠিয়ে নিতে হয়। কারাগার থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন বাঙালি জাতির জনক এবং অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে। তাঁর প্রতি জনগণের আস্থা ভালােবাসা তাঁর মস্তকে হিমালয় পর্বতের চূড়ার মতাে উঙ্গ মহিমায় বিভূষিত করেছে। গােটা জাতি তার পেছনে। এর আগে কোনাে বাঙালি নায়কের পেছনে মানুষ অকৃত্রিম আস্থা এবং স্বতঃস্ফুর্ত ভালােবাসা এমন করে বিলিয়ে দেয়নি। তার আগেও এ রকমটি ঘটেছে বারবার। যে কোনাে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লব, উপবিপ্লব। শুরু হবার আগে শেখ মুজিব কোনাে জাদুমন্ত্র বলে কারাগারে ঢুকে পড়েছেন। ঘটনার নিয়মে ঘটনাটি ঘটে যাবার পর বিজয়ী বীরের মতাে শেখ সাহেব দৃপ্ত পদক্ষেপে প্রকাশ্য সূর্যালােকে বেরিয়ে এসে নেতার আসনটিতে বিনাদ্বিধায় বসে পড়েছেন। শেখ মুজিবকেই
Page 554
ঘটনাটির নায়ক বলে লােকে বিনাদ্বিধায় মেনে নিয়েছেন। তার নিজের দলের মধ্যেও এ নিয়ে বােধকরি কোন প্রশ্ন কখনাে উঠেনি। উনিশ শ’ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আপন বাসভবন থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং উনিশ শ’ বাহাত্তর সালের দশই জানুয়ারি তারিখে বাংলাদেশে এসে এমন একটি আসন পেয়ে গেলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসে কোনাে মানুষ সে রকম মর্যাদা, ভালােবাসা এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার আসনে উপবেশন করতে পারেনি। তাঁর তেজ, বীর্য এবং বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে বিস্ময়াবিষ্ট দেশবাসী বহুকাল আগেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালি জাতির পিতা ইত্যাদি দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। শ্রদ্ধা এবং ভালােবাসার আসনে তিনি রাজচক্রবর্তী হিসেবে বহুকাল আগে থেকে আসীন ছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি হৃদয়ের সিংহাসনের রাজা বাস্তবের সিংহাসনে আরােহণ করলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি তার দুঃশাসনে যতই বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় নেমে আসুক-না কেন, বন্যা, মহামারী, চোরাচালানী, ছিনতাইকারী, টাউট, স্বজনতােষণকারীরা বাংলাদেশে যে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশারই সৃষ্টি করুক-না কেন তার গোচরেই সবকিছু ঘটে আসছিল। যৌবনবতী মেয়ে মানুষ তার প্রেমিককে যে রকম বিশ্বাস করে এবং ভালােবাসে, বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে সেই অকৃত্রিম অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত বিশ্বাস এবং ভালােবাসা দিয়েছিল। তিনি এলেন, প্রধানমন্ত্রী হলেন। নতুন সংবিধান রচনা করলেন, নির্বাচন ডাকলেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর বছর ঘুরে না আসতেই প্রধানমন্ত্রীর পদ তার পছন্দ হলাে না। তাঁরই নির্দেশে রচিত সংবিধানের বিধানগুলাে আঁটোসাটো জামার মতাে ক্রমাগত তাঁর বিরক্তিই উৎপাদন করছিল। তাই তিনি নিজের হাতে গড়া অনুশাসনের নিগড় ছিন্ন করে ফেললেন। সংবিধান বাতিল ঘােষণা করলেন। যে সংসদীয় গণতন্ত্রের বাঁধানাে সড়ক বেয়ে আকাশস্পর্শী উচ্চাকাক্সক্ষার নির্দেশে একটি সবল, স্বাস্থ্য এবং দরাজ কণ্ঠস্বর মাত্র সম্বল করে এতদূর ঊর্ধ্বে আরােহণ করেছেন সেই সংসদীয় গণতন্ত্র শেখ মুজিবের হাতেই জখম হয়ে হয়ে লাশটি তাঁরই হাতে কবরস্থ হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। অবিলম্বে তিনি কর্তব্যকর্ম সমাপন করলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের লাশটি কবর দিলেন। একদলীয় সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নতুন পরিচয়ে তিনি নিজেকে পরিচিত করলেন। শেখ মুজিব যা করেন সব নিখুঁত। ইতিহাসের সঙ্গোপন আকাক্ষা তাঁর প্রতি কর্মে অভিব্যক্তি লাভ করে। এ হচ্ছে তাঁর পরিষদের ধারণা। কথাটি তিনিও আপন দল এবং বন্ধুদলের মানুষদের কাছ থেকে এতবেশি শুনেছেন যে নিজেও প্রায় অতিমানব বলে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। তিনিও মনে করতে আরম্ভ করলেন, যা কিছু হও বলবেন, অমনি হয়ে যাবে। এ যেন শেক্সপিয়ারের নাটকের নায়ক জুলিয়াস সিজার। আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডল বারেবারে শুভ-সংকেত বয়ে নিয়ে আসে। শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে সিজারের বীরত্ব এবং গুণপনা বর্তমান ছিল কিনা বিচার করবেন আগামীদিনের ঐতিহাসিক। তবে একথা সত্য, পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশে তিনি যা পেয়েছেন, যা আদায় করেছেন, অনুরূপ ভাগ্য কোনাে রােমান সিজারের কোনােদিন হয়নি।
সব শক্তিদর্পী মানুষের যেমন হয়ে থাকে তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানের মনে কিছু নিরীহ বস্তু না পাওয়ার ক্ষোভ বারবার পীড়ন করেছে। শক্তিদর্পী মানুষেরাও চায় মানুষ তাদের ভালােবাসুক বন্ধুর মতাে, আবার যমের মতাে ভয় করুক। আকাশের দেবতাকে
Page 555
যে রকম ভীতিমিশ্রিত ভালােবাসা দিয়ে বিচার করে, শেখ মুজিবুর রহমানের মনেও অবিকল সে রকম একটি বাসনার উদয় হয়েছিল।
তিনি বিলক্ষণ জানতেন, পাণ্ডিত্যাভিমানী শিক্ষিত সমাজের মানুষ তাঁকে অন্তর থেকে অবজ্ঞা করে। এই শ্রেণীটির চরিত্রের খাজগুলাে সম্বন্ধে পুরােপুরি অবহিত ছিলেন তিনি। উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের পূর্ব পর্যন্ত এই শ্রেণীর লােকেরা তাকে বাগড়ম্বর সর্বস্ব অমার্জিত হামবাগ ছাড়া কিছু মনে করতেন না, তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। বিভিন্ন বিবৃতি, বক্তৃতা, ঘরােয়া বৈঠক এবং আলাপ-আলােচনায় এদের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃণা এবং বিরক্তি তিনি কুণ্ঠাহীনভাবে ব্যক্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষিত আমলা, লেখক- সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সম্ভ্রান্ত সমাজের একাংশ তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলে যে সম্বােধন কেন করতেন শেখ মুজিব তা বুঝতেন এবং তা তার ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রাপ্য হিসেবেই গ্রহণ করতেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী বলে কথিত শ্রেণীটির হীনমন্যতাবােধ এবং চারিত্রিক দস্যতা অনেকটা প্রবাদের শামিল। যে-কোনাে নতুন শাসক এলেই সকলে মিলে তার গুণপনা ব্যাখ্যা করা এখানকার বহুদিনের একটি প্রচলিত প্রথা। কচিত কদাচিত ব্যতিক্রমী কণ্ঠ শােনা যায়। এর কারণ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সমাজ শরীরের মধ্যে সংগুপ্ত রয়েছে।
শক্তিপী মানুষেরাও যে শেষপর্যন্ত একেকটা দিকে কাঙাল থেকে যান শেখ। মুজিবের মধ্যেও তার পরিচয় পাওয়া যায় । যে বস্তুটি সহজভাবে পাওয়া যায় না তাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য এদের অনেক সময় নিয়মমত খাওয়া-শােয়ার ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। তার আসন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমণের ঘটনাটিকেও এ পর্যায়ে ফেলা যায়। যদিও তিনি দেশের একচ্ছত্র অধিপতি তথাপি তাঁর অন্তরে একটা মর্মান্তিক ক্ষোভ সব সময়ে প্রবাহমান ছিল। দেশের সকল জ্ঞানী এবং গুণী পণ্ডিত সমাজে তিনি শ্রদ্ধার আসন লাভ করতে পারেননি। মােসাহেবরা তার কানের কাছে অনেক উচ্চকণ্ঠ চিৎকার করেছে, বাচাল ও অর্বাচীনেরা অনেক কথা লিখেছে, কিন্তু পণ্ডিতেরা বারবার নিশ্চপ থেকেছেন। এই অর্থবােধক নিশুপতা তার বুকে শেলের মতাে বেজেছে। সেজন্যই তার অত ঘটা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা। যে লােকেরা সহজভাবে তাঁকে স্বীকার করে নেয়নি, তাদের তার
মহিমা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। নইলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শেখ মুজিব সকাল-সন্ধে ভাঙা কাপে চা খেয়েছেন, সেখানে আসার জন্য সাড়ে সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করার কি প্রয়ােজন থাকতে পারে? বিশেষত বাংলাদেশের মতাে দেশে যেখানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রের পয়সার অভাবে সকালবেলার টিফিন জোটে না।
তাছাড়া আরেকটি কারণে বিশ্ববিদ্যালয় আসা তার পক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। যতই তিনি জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন ততই তার চরিত্রের স্বৈরাচারী লক্ষণসমূহ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। ক্ষমতার নির্মম একাকীতু তাঁকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে গণতন্ত্রের ধারাস্রোতে বাহিত হয়ে তিনি এসেছিলেন, তাতে তার পুনরায় অবগাহন করার কোনাে উপায় নেই। কেননা এই তিন বছরে শরীর অনেক ভারি হয়ে গিয়েছে এবং সাঁতারও প্রায় ভুলে গিয়েছেন। যদি তাঁকে বেঁচে থাকতে হয়। একজন মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকতে হবে- জনতা তার শাসন সাংঘাতিক রকম অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। সংবিধান, জাতীয় পরিষদ, পরিষদের সদস্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি
Page 556
সবকিছু দাবার বাের্ডের মতাে এই লক্ষ্যেই চালনা করে আসছিলেন। তবু তিনি বলতেন, তিনি জনগণকে ভালােবাসেন এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আর জনগণ তাঁকে দেখতে ভিড় করতেন, তাঁর বক্তৃতা মনােযােগ দিয়ে শুনতেন, তাঁর কথায় হাত উঠাতেন- এটাও জনগণের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনে এবং কথায় কথায় হাত উঠিয়ে অভ্যস্ত। আসলে জনগণ অনেকদিন থেকেই তার ওপর ভয়ানকরকম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ বাংলাদেশের যে দুর্দশা বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি ধরে নিয়েও বলা যায় তার আশি ভাগই মনুষের সৃষ্টি এবং তার জন্য মুখ্যত দায়ী তার পরিচালিত তৎকালীন সরকার। গ্রামের সরল মানুষকে, অনাহারক্লিষ্টা বিধবাকে আমি নিজের কানে তাদের তাবৎ অভাব অভিযােগের জন্য দায়ী করে অভিসম্পাতের বাণী উচ্চারণ করতে শুনেছি। তিনি যে ধীরে ধীরে স্বখাত সলিলে ডুবে যাচ্ছেন খুবই টের পাচ্ছিলেন। জনগণের রুদ্ররােষ কি বস্তু উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি। এই জনগণই আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করিয়ে শেখ মুজিবকে আইয়ুব খানের কারাগার থেকে মুক্তমানব হিসেবে প্রসন্ন দিবালােকে বের করে এনেছে। উনিশ শ’ একাত্তর সালের মার্চ মাসের দিনগুলােতে জনগণের সঙ্গবদ্ধ শক্তির গভীরতা, তীব্রতা কতদূর হতে পারে, বাঁধভাঙা বন্যার স্রোতের মত রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক জীবনে কি অঘটন ঘটিয়ে তুলতে পারে সে জ্ঞান তিনি হাতে কলমেই লাভ করেছেন। তাই তিনি ক্রমে জনগণের ক্ষোভ আক্রোশ বন্ধ করার পন্থা হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মুখে বালির বাঁধ রচনা করে যাচ্ছিলেন। তিনি তিনদল ভেঙ্গে একদল করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী থেকে সরাসরি একনায়ক সেজে বসেছেন।
তিনদল ভেঙে একদল করার পর তার হাতে প্রভূত ক্ষমতা সঞ্চিত হয়েছিলে বটে, কিন্তু তিনি রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পরঠিকানার মানুষ হয়ে পড়েছিলেন। সম্মিলিতভাবে তিনি তিনদলেরই কর্তা, কিন্তু আসলে কোনাে দলের কেউ নন। এই ঠিকানাহীনতা তাঁকে একনায়কত্বের দিকে আরাে জোরে ঠেলে দিচ্ছিল। জনগণমন অধিনায়ক নেতার পক্ষে একনায়ক পরিচয়ের পথে রাজার পরিচয় আরাে প্রীতিপদ এবং সম্মানের। বিশেষত তিনি দেশ এবং বিদেশের সামনে প্রমাণ যখন করতে পেরেছেন, তিনি চাননি তবু জনগণ তাকে রাজার আসনে বসিয়েছে। এই রাজকীয় পরিচয়টা দেশের মানুষের মনে ভালােভাবে দাগ কাটে মত বসিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়ােগ করে যাচ্ছেন। একদলীয় শাসন কায়েম করেছেন, আঁকালাে রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেছেন, উপবেশনের সুবিধার জন্য দিনাজপুরের মহারাজার সিংহাসনটা আনিয়ে নিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলের ঘুণে ধরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছেন। পূর্বের জেলা এবং বিভাগগুলাের সীমানা চিহ্ন মুছে দিয়ে গােটা দেশকে একষট্টিটি নতুন প্রশাসনিক এলাকা তথা জেলায় বিভক্ত করে, প্রতি জেলায় একজন করে গভর্নরও মনােনয়ন দান করেছেন। গভর্নররা যাতে সর্বেসর্বা হয়ে বসতে না পারে সেজন্য বৈরী গ্রুপ থেকে একজন বাকশাল সাধারণ সম্পাদককে মনােনয়ন দান করা হয়েছে। শাসনব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢালাই করার নামে আইয়ুবের মত শেখ মুজিবও তার সিংহাসনে থাকার পথটি পাকাপােক্ত করেছেন। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মৌলিক বস্তুটির সঙ্গে জনগণের চাক্ষুষ পরিচয় ঘটেছে। মুজিবের মৌলিক বস্তুটিরও প্রয়ােজনীয়তা কতদূর ছিল আগামীদিনের প্রশাসনবিদরা বিচার- বিবেচনা করে দেখবেন। আমার বক্তব্য হলাে, আইয়ুব সরকার এবং মুজিব সরকার
Page 557
নিজেদের ক্ষমতায় অটুট থাকবার জন্য উদ্ভাবিত পথটিকেই শাসনতান্ত্রিক বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছেন। জেলাসমূহের গভর্নর এবং বাকশালের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করার ব্যাপারেও শেখ সাহেব রাজকীয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের শাসক নেতৃশ্রেণীতে যত ধরনের চাপ প্রয়ােগক্ষম গ্রুপ রয়েছে, সব গ্রুপ থেকে প্রতিনিধি গ্রহণ করেছেন- রাজনৈতিক দল ও ন্যাপ থেকে, আমলাদের থেকে, আইনজীবী শ্রেণী থেকে, সেনাবাহিনী থেকে আনুপাতিকহারে গভর্নর ও সম্পাদক নিয়ােগ করার পেছনের কারণ ছিল সার্বিকভাবে গােটা শাসক নেতৃশ্রেণীটার কাছে তার শাসনটা গ্রহণযােগ্য করে তােলা।
ব্যাবহারিক দিক দিয়েও তিনি রাজার মতাে আচরণ করে যাচ্ছিলেন। তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দের কেউ তাঁর সামনে টু-শব্দটি উচ্চারণ করতে সাহস পেতেন না। তাঁকে বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারে মতাে কেউ ছিলেন না। তিনি যদি কখনাে মন্ত্রিসভার সদস্যদের ডাকার প্রয়ােজন মনে করতেন, ডাকতেন। এ কারণে যে তারা যেন সকলে স্বীকার করে নেন তার মতটিই চূড়ান্ত। এ ছাড়া তাঁর নিজস্ব পরিবারটিকে কেন্দ্র করে একটি রাজপরিবারের ছবি ক্রমে লক্ষ্যগােচর হয়ে উঠেছিল। তাঁর ছেলে, তাঁর ভাগ্নে, ভগ্নিপতি, ভাই সকলে সত্যি সত্যি দুধের সরের মতাে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর পুরােভাগে ভেসে উঠছিলেন। বাকি ছিল রাজমুকুটটা মস্তকে ধারণ করা এবং রাজউত্তরীয়খানি অঙ্গে চড়িয়ে দেওয়া। এই জন্যই তার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। নেপােলিয়নের মতাে বিশ্ববিখ্যাত বীরযােদ্ধার হাতে প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাজমুকুটটি নিজে নিজে পরে বসেননি। রােম থেকে পােপকে আসতে হয়েছিল। এই সমস্ত শক্তিধর মানুষেরা শক্তি দিয়ে সব কাজ করে আনলেও শেষের কাজটি করার জন্য এমন কাউকে খোঁজ করে আনেন, যার প্রতি মানবসাধারণের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা রয়েছে এবং যা ঐতিহ্যসম্মত।
নেপােলিয়নের যুগ গেছে, পােপের যুগ গেছে। কিন্তু মানুষের অন্তরের আগুন সে রকম আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা উদ্ধত হয়ে এখনাে আকাশ ছুঁড়ে ফেলতে চায়। তাই শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। একক হাতে বেবাক ক্ষমতা তুলে নেয়ার সপক্ষে সারস্বত সমাজের রায় গ্রহণ করবেন। তাছাড়া আরেকটি গােপন অভিলাষ তার মনের কোণে থাকার বিচিত্র কী। উচ্চশিক্ষাভিমানী পণ্ডিতম্মন্য লােকেরা যাদের তিনি মনে মনে অপরিসীম তাচ্ছিল্য করেন, তারা সকলে একযােগে এসে তার বিরাটত্ব ও মহতুের সামনে দণ্ডত হবেন। একজন শিক্ষকও যাতে অনুপস্থিত না থাকতে পারেন এবং একজনও যাতে অর্থহীন নিরীহ একগুঁয়েমিকে আশ্রয় করে কাগুজে বীর হিসেবে পরিচিত হতে পারেন আগেভাগে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সরকারসমর্থক ছাত্রদের যাবতীয় দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসনামলে সামরিক সরকারের আরােপিত হাজারাে বাধা-বিঘ্ন অগ্রাহ্য করে বাঙালি মনীষা পাথরের ভেতর দিয়ে পথ কেটে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে অগ্রসর হচ্ছিল। কী সংস্কৃতি চর্চায়, কী রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে, কী মননশীলতার লাবণ্য সঞ্চারে পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করেছে তা বাঙালির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ, বাংলার জাতীয় জাগরণের প্রথম আন্দোলন, উনিশ শ” উনসত্তরের আইয়ুব বিরােধী বিক্ষোভ, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ এ সকল জাতীয় জীবনে অপরিসীম প্রভাববিস্তারী ঘটনাগুলাে ঘটিয়ে তােলার উদ্যোগে পূর্বে
Page 558
নেতৃত্বদান করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনীতিতে ছাত্ররা অনিবার্যভাবে কোনাে ভূমিকা পালন করে থাকে শেখ মুজিব তা জানতেন। তিনি নিজেও এ রকম ছাত্র আন্দোলনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাই তাঁকে শুরু থেকে ছাত্রদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি অত্যন্ত মনােযােগ সহকারে ভাবতে হয়েছে।
তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিন পরেই, যে ছাত্রপ্রতিষ্ঠানটির পেশল সমর্থন তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক মূলধন ছিল সেই ছাত্রলীগকে চোখের সামনে দু’টুকরাে হয়ে যেতে দেখেছেন। তাদের তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়া ও ছাত্রলীগের একাংশের সক্রিয় সহযােগিতার ওপর নির্ভর করে অপর একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখে নিশ্চয়ই হতবাক হয়েছেন তিনি। উনিশ শ’ তিয়াত্তর সালের পয়লা জানুয়ারির ঘটনা। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে একজন ছাত্র ঘটনাস্থলে নিহত হয়, কয়েকজন মারাত্মকভাবে আহত হয়। তার প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন সমস্ত ঢাকা শহরে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিলের আয়ােজন করে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী আখ্যায় ভূষিত করে। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ চালিত ‘ন্যাপ এবং ‘বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছাত্র ইউনিয়নের দখলে ছিল। গুলিবর্ষণের প্রতিবাদস্বরূপ বিক্ষুব্ধ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ছাত্রসংসদের খাতার যে পৃষ্ঠাটিতে শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের আজীবন সদস্য হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলেন সেই পৃষ্ঠাটি ছিড়ে ফেলে। অথচ এই ছাত্র ইউনিয়নই পদে পদে শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের মূল রাজনৈতিক দল দুটোর মতাে অন্ধভাবে সমর্থন দান করে যাচ্ছিল। নিজের সমর্থক ছাত্ররা যখন এ অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে পারে, বিরােধীদলীয় ছাত্ররা যে প্রতিবাদে কতদূর মারমুখী হতে পারে, একটি সম্যক ধারণা তার হয়েছিল। তাই শক্তহাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর ছাত্রসমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
উনিশ শ’ বাহাত্তর সালের পর থেকে প্রকৃত প্রস্তাবে চার পাঁচজন ছাত্রই স্টেনগান হাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালাত। উপাচার্যবৃন্দ এই অস্ত্রধারী ছাত্রদের কথাতে উঠতেন, বসতেন। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে মুক্তির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেবাক পরিবেশ কলুষিত করে তােলা হলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, কল্পনা, নিরপেক্ষ গবেষণার পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সরকার সমর্থক ছাত্ররা প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘােরাফেরা করত। দরকারবােধে তারা এগুলাে ব্যবহার করতে কোনাে রকম কুণ্ঠা বা সংকোচবােধ করত না। বর্তমানে ঢাকা জেলার জেলা জজের কোর্টে একটি লােমহর্ষক হত্যামামলার বিচার চলছে। সরকার সমর্থক দু’দল ছাত্রের মধ্যে মতামতের গরমিল হওয়ায় অবাধে রাতের বেলা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সাতজন সতীর্থকে হত্যা করা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে হাজী মুহম্মদ মুহসীন ছাত্রাবাসের টিভিকক্ষের সামনে এই শােকাবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারসমর্থক ছাত্ররাই যখন মতামতের গরমিলের জন্য স্বদলীয় ছাত্রের হাতে এভাবে বেঘােরে প্রাণ হারাতে পারে, সাধারণ ছাত্র এবং শিক্ষকদের অবস্থা কী হতে পারে
Page 559
সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারসমর্থক ছাত্রের মতাে শিক্ষকদেরও অবশ্য বিশেষ অসুবিধে হওয়ার কথা নয় । এঁদের অনেকে পূর্ব থেকে ক্ষমতাসীন সরকারগুলাের সেবা করে আসছেন। সুতরাং এই নতুন শাসনামলেও তারা বস্তু-সম্পদের দিক দিয়ে কিঞ্চিত লাভবান হওয়ার সাধনা করে যাচ্ছিলেন এবং নানাভাবে সরকারসমর্থক ছাত্রদের সক্রিয় সহায়তা দান করে যাচ্ছিলেন। আর সরকার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর কোনাে মতামত এবং প্রতিষ্ঠান যাতে মাথা তুলতে না পারে সেজন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি মতামতের লালনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে এমন একটা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলাে, যার সঙ্গে অধিকাংশ শিক্ষক এবং ছাত্র মিলিয়ে নিতে পারলেন না। শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা এবং রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতিকে মুজিববাদ আখ্যা দিয়ে, তার প্রচার, প্রসার এবং বাস্তবায়নের জন্য সরকারসমর্থক ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এমন একটা সুসংগঠিত অভিযান পরিচালনা করলেন, কোনাে স্বাধীনচেতা, ন্যায়বান ছাত্র কিংবা শিক্ষক তার সঙ্গে অন্তরের সামান্য সংযােগও অনুভব করতে পারলেন না। এই না পারার কারণেই সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ শিক্ষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা অপরিসীম মানসিক উল্কণ্ঠা নিয়ে শঙ্কা, ত্রাস এবং ভীতির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হলেন। অতি শিগগির গােটা দেশের তাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মুজিববাদী ছাত্রদের এবং তাদের পেছনে বুদ্ধি-পরামর্শ যােগানাে শিক্ষকদের প্রভাব ঘূর্ণিহাওয়ার মতাে অপ্রতিরােধ্য বেগে ছড়িয়ে পড়ল।
যে সমস্ত শিক্ষক চরিত্র এবং বিদ্যাবত্তার জন্য ছাত্রদের মধ্যে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন মুশকিল হলাে তাদেরই। তারা তাদের পরিবারবর্গ নিতান্ত ভয়ে ভয়েই দিবস রজনী পার করতেন। যে কোনাে সময়, যে কোনাে বিবাদ এসে ঘাড়ে আশ্রয় করতে পারে। সে সময়ে আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডে বাস করেছি। এই সন্ত্রাসজনক পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছুকিছু অনুভব করেছি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’বছর পরেও দেখেছি শিক্ষকরা ফ্ল্যাটে বাইরের দিক থেকে তালা লাগিয়ে রাখতেন। কোনাে অচেনা লােক খোঁজ-খবর করতে গেলে বাড়ির লােকেরা জবাব দিতেন, তিনি বাসায় নেই। যে মুষ্টিমেয় ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করত সংখ্যায় ছিল তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনরত মােট ছাত্রছাত্রীর এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। সরকারি পুলিশ সব সময়ে তাদের সাহায্যে মােতায়েন থাকত। ছাত্রাবাসের ভােজনকক্ষে খাওয়ার জন্য তাদের কোনাে অর্থ দিতে হতাে না। অধিকন্তু মন্বন্তরের সময় ছাত্রাবাসের প্রভােস্ট এবং হাউজ টিউটরের সঙ্গে মিলেমিশে রেশনে পাওয়া চাল, ডাল কালােবাজারে বেচে দিয়ে.প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করার সুযােগ তারা পেত। তাছাড়া সরকারদলীয় লােকদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকরি বণ্টন করার সুযােগগুলাে তাে ছিলই।
বিশ্ববিদ্যারয় কিংবা কলেজের ছাত্রসংসদসমূহের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করত, ভীতি এবং ত্রাস সৃষ্টি করে ছাত্র সাধারণের কাছ থেকে ভােট আদায়ের চেষ্টা করত। তারপরেও যখন দেখা যেত নির্বাচনে তারা শতকরা বিশটি ভােটও লাভ করতে পারেনি এবং পরাজয় অবধারিত, রাতের বেলা আলাে নিভিয়ে ভােটের বাক্সগুলাে লুট করে নিয়ে যেত। তাদের অনুমােদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্রভর্তি হতে পারত না, ছাত্রাবাসসমূহে থাকবার জায়গা পেত না। শিক্ষকদের নিয়ােগ বরখাস্তও অনেকটা তাদের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল ছিল।
Page 560
শেখ মুজিবুর রহমান তার একদলীয় শাসন চালু করে দেশে যে নতুন শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করার কথা ঘােষণা করেছিলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে ক্ষমতার অংশভাগী করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একশাে পনেরােজন সদস্যের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যত্রয় এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালিকা ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষাকে স্থান দিয়েছিলেন। জাতীয়দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের স্থান দিয়ে সরাসরি বিধিবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার আয়ােজন সম্পূর্ণ করলেন। অর্থাৎ এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনাে ঘােরপ্যাচ ব্যতিরেকে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি শাসন বলবৎ করা হবে। পূর্বেকার সরকারসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব করতেন বটে, কিন্তু সে পন্থাটি ছিল গােপন এবং অদৃশ্য। বাইরের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। সরকার প্রশাসন কিংবা পরিচালনায় প্রকাশ্যত কোনাে হস্তক্ষেপ করেন না। শেখ মুজিবই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশীদার করলেন।
প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা আইন-কানুন এগুলােকে তিনি ক্রমে ক্রমে ভেঙে নতুন করে সাজিয়ে, তার মধ্যে সরকারি বিরােধিতার বীজকে উপড়ে ফেলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত যে আধুনিক শিক্ষাভিমানী পণ্ডিতসমাজ তাঁকে অবজ্ঞা করেন, তাদের অন্তরলালিত অহংকার চূর্ণ করতে পারবেন। নতুন পদ্ধতিটা এমনভাবে রচনা করা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদেরও তাঁর আওতার বাইরে থাকার উপায় নেই এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সিংহাসনের পেছনে না দাঁড়িয়ে তাদের গত্যন্তর থাকবে না। তৃতীয়ত বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের হাতের মুঠোতে পুরে তিনি দেশের মানুষ এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করতে পারবেন যে তিনি মন্দ অর্থে একনায়ক নন। দেশের কৃষকসমাজ থেকে শুরু করে সারস্বত সমাজ পর্যন্ত তাকে এত অনুরােধ উপরােধ করেছেন যে, বাধ্য হয়েই তিনি দেশের কল্যাণ চান এবং বাংলার মানুষকে ভালােবাসেন। সমস্ত দেশের মানুষের সমবেত প্রার্থনা তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তাঁর দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ভুল চিন্তা করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ উপাচার্য পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেই বসলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে এমন একজন বলিষ্ঠ নেতা হাজার বছরে জন্মগ্রহণ করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান যে বলিষ্ঠ নেতা সে বিষয়ে কারাে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করার জন্য ওই সময়কে বেছে নিয়েছিলেন কেন তা অনেকের কাছেই খুব তাৎপর্যবহ মনে হয়েছে। বাস্তবেও তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় দলে যােগদানের আবেদনপত্রসহ তাদের নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে আসলেন। সেই ছবি কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হলাে।
এই উপাচার্য দ্রলােককে দেশের মানুষ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে জানতেন। অতটুকু দাসত্ব তার কাছ থেকে কেউ প্রত্যাশা করেননি। তার এ ধরনের কার্যকলাপের দু’রকম প্রতিক্রিয়া হলাে। তার মতাে লােকের পক্ষে তথাকথিত জাতীয়দলের এ ধরনের কাণ্ডজ্ঞানহীন তােষামােদ দেখে জ্ঞানীগুণী সমাজের একাংশ চিন্তিত হয়ে উঠলেন, আরেক অংশের প্রতিরােধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে এল। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার এ দহরম-মহরম
Page 561
অন্যান্য উপাচার্য এবং সরকার সমর্থক শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত নেতৃশ্রেণীর মনে ঈর্ষার উদ্রেক করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তিনি যদি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অতবেশি মাখামাখি করার সুযােগ আদায় করে ফেলেন, অন্যান্যদের সুযােগ-সুবিধে মাঠে মারা যাবার সম্ভাবনা। তাই অন্যান্যরাও উঠে পড়ে লাগলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক আবুল ফজল ছাড়া আর সকল উপাচার্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং শিক্ষকদের জাতীয়দলে যােগ দেওয়ার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়ােগ করে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে সরকার সমর্থক ছাত্রদল উপাচার্যদের সহায়তা দিয়ে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়দলে যােগদানের জন্য যে ভয়ভীতি এবং নানামুখী চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা আমি খুব কাছে থেকে নিজের চোখে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। অধ্যক্ষরা বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে আবেদনপত্র বিলি করেছিলেন এবং সরকারি প্ররােচনায় তরুণতর শিক্ষকদের সই করতে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করেছিলেন। অনেক শিক্ষক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সই করতে চাননি। কিন্তু হুমকি, ভীতি এবং চাপের মুখে তাদের বেশিরভাগ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। যে সকল শিক্ষক সই করেননি, তাঁদের নাম বাকশাল কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। সরকার সমর্থক ছাত্রদল এই বিদ্রোহী শিক্ষকদের দেশদ্রোহী হিসেবে শিগগির ধরে নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করল। এই জোর-জুলুম, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাসের মধ্যে চৌদ্দ আগস্ট সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল মাত্র পনেরােজন শিক্ষক জাতীয়দলে সদস্যপদের আবেদন করে সই করেননি। বাকি সকল শিক্ষকের সই সম্বলিত আবেদনপত্র সংগৃহীত হয়ে গেছে। আগামীকাল যখন রাষ্ট্রপতি আসবেন, তখন প্রায় হাজারখানেক শিক্ষকের আবেদনপত্র তাঁর সকাশে দাখিল করা হবে। তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন এবং তাঁদের কাছে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি চাইবেন এবং শিক্ষকরাও হাত তুলে তিনি যা বলবেন তার প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হবেন। এই.পর্যন্ত সকলে তাই করছে।
বাংলাদেশের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ বলে কথিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তা, ভাবনা, বুদ্ধি এবং মননশীলতার নেতৃত্বদানকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন শক্তিধর মানুষকে যা দেয়নি শেখ মুজিবুর রহমানকে সেই অকুণ্ঠ আনুগত্য স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। গােটা দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখার জন্য বেদনাহত চিত্তে প্রতীক্ষা করছিল। রাষ্ট্রপতির বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষ্যে জাতীয় দৈনিকগুলাে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল। রেডিও ‘ঘনঘন সংবাদ দিচ্ছিল। টেলিভিশনে উপাচার্যের বিশেষ সাক্ষাৎকার দেখানাে হচ্ছিল। এ উপলক্ষ্যে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে সাজানাে গােছানাে হয়েছে আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ রেডিও, টেলিভিশন প্রচার করছিল। এই দিনটিকে ভাবগম্ভীর, পবিত্র এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণরূপে দেশের মানুষের দৃষ্টিতে.চিত্রিত করার জন্য পূর্ণপ্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল। সরকারি প্রচারণার ধরনটা এমন ছিল, কোনাে রকমের বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে এই.ঐতিহাসিক সংবর্ধনা প্রদান করা হচ্ছে। পূর্বে একনায়করা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে যেরকম ছাত্রদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, আক্রোশ কোনাে না কোনাে পথে ফেটে পড়ে, খুন, জখম, রক্তারক্তি কাণ্ড অবধারিত ঘটে যেত এবার সে সবের কোনাে লক্ষণ নেই। তিনি তাে আর ঔপনিবেশিক শাসনকর্তা নন, তিনি স্বয়ং বাঙালি জাতির পিতা। সুতরাং তিনি
Page 562
বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন করছেন, তার জন্য কেন বিক্ষোভ এবং অশান্তি হবে। বরঞ্চ এই মহানায়ককে আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের মধ্যে পাবেন এ আনন্দে সকলে বিভাের হয়ে আছেন। আগামীকাল উনিশ শ’ পঁচাত্তর সালের পনেরাে আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে বিরাজ করবে।
*************
চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম কার্জন হলে এবং লাইব্রেরিতে বােমা ফুটেছে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে এসেছে। উৎসবমুখর পরিবেশ হঠাৎ যেন কেমন থিতিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সকলের চোখেমুখে আশঙ্কা। ছাত্রদের সিংহভাগ যারা এই সুবিশাল এলাহিকাণ্ডের নীরব নিরুপায় দর্শকমাত্র ছিলেন, তাদের মনের গতিটা অনুসরণ করতে চেষ্টা করলাম। তাদের চোখমুখ দেখে মনে হলাে এ রকম একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটায় সকলে যেন মনের গভীরে খুশি হয়েছে। হাতে পায়ে শেকল, শেকলের পর শেকল পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারুদ এবং আগুনের ভাষায় শেষপর্যন্ত আসন্ন মুহূর্তটিতেই কথা কয়েছে। অর্থাৎ কোনাে স্বেচ্ছাচারীকেই এই পবিত্র বিদ্যাপীঠ কোনােদিন অতীতে বরণ করেনি এবং ভবিষ্যতের বরণ করতে প্রস্তুত নয়।
কথাগুলাে ভেবে নিয়েছিলাম আমি। মনের ভেতরে একটা ভয়ার্ত আশঙ্কাও দুলে উঠেছিল। দুয়েকটা বােমা ফুটেছে এই ভয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা স্থগিত রাখবেন তিনি তেমন মানুষ নন। তিনি নিশ্চিতভাবে আসবেনই। অপার শক্তিবলে মুখরা নগরীর স্পর্ধিত জিহ্বা যিনি স্তব্ধ করে দিয়েছেন, দুয়েকটি বােমা ফুটলে কি তিনি সেই ভয়ে ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকবেন? তার প্রতি সবচেয়ে বিরূপ শ্ৰেণীটি আগামীকাল সকালে সদলবলে নতমস্তকে আস্থা নিবেদন করতে যাচ্ছেন। নাটকের এই রােমাঞ্চকর দৃশ্যে তিনি কী করে অনুপস্থিত থাকতে পারেন? হয়তাে আরাে বােমা ফুটবে। পুলিশ ছাত্রাবাসসমূহের কক্ষে কক্ষে খানাতল্লাসী চালাবে, সন্দেহজনক ছাত্রদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার আসা বন্ধ হবে না।
রাতে হেঁটে ফিরছিলাম সাতাশ নম্বর সড়কের দিকে। মনে এসব কথা তােলপাড় করছিল ভয়ংকরভাবে। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘবাহু প্রসারিত করে সমস্ত দেশটাকে কঠিন আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছেন, যা কিছু বাধা দিচ্ছে, প্রতিবাদ করছে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শক্তিপী মানুষটি যা করতে চাইছেন বাস্তবে তার অবিকলটি ঠিক ঠিক ঘটে যাচ্ছে। কোথাও কোনাে কথা নেই, কোনাে বাধা নেই। বাংলাদেশে কণ্ঠ একটি, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানের মানুষ ওই একজন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। ভয়ে দুরুদুরু করছিল বুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পনেরােজন বাকশালের যােগদানপত্রে সই করেননি, তাদের অনেকেই আমার চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব। তাদের অবস্থার কথা চিন্তা করছিলাম। তাঁদের কী হবে? তাদের কি চাকরি চলে যাবে? তাঁরা কী খাবেন? এই বাজারে বউ ছেলে নিয়ে কীভাবে জীবনধারণ করবেন? তাঁদের কি পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে? কী হতে পারে এই রাজদ্রোহিতার পুরস্কার?
ভয়ংকর চাপ অনুভব করছিলাম। একা একা হাঁটছিলাম। ভয়ানক একা বােধ।করছিলাম। চারপাশের লােকজনের কারাে সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, যেন কোনকালে ছিলও না। একা একা আমি যেন সুড়ঙ্গ পথে বিচরণ করছি। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমি দেখে আসছি,
Page 563
কীভাবে আমার লালিত মূল্যবােধগুলাে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। লােভীর লােভ, প্রবলের অন্যায়কে এমনভাবে রূপ ধরে জেগে উঠতে আমি কোনােদিন দেখিনি। এত অশ্রুতে ভেজা, এত গাঢ়রক্তে রঞ্জিত আমাদের স্বাধীনতা আমাদের এমনভাবে প্রতারিত করছে প্রতিদিন, সে কথা কার কাছে যেয়ে বােঝাই। যাদের মনের কথা ব্যক্ত করতে যাবাে, তাদের অবস্থাও আমার মতাে। এ কেমন স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা আমাদের গােটা জাতিকে সম্পূর্ণ ভিখিরীতে পরিণত করে? এ কেমন স্বাধীনতা যে স্বাধীনতায় আমরা একটা কথাও বলতে পারবাে না।
চোখের সামনে সত্য মিথ্যের আকার নিচ্ছে। জলজ্যন্ত মিথ্যে নধর তাজা সত্যি হিসেবে। এসে প্রতিদিন হাজির হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গােটা জাতিটাকে নিয়ে কী করতে চান? তার কথায় কথায় উঠে বসে এ জাতির তাে আর কোনােকিছু অবশিষ্ট নেই। এত অত্যাচার দেখেছি, এত জমাট দুঃখ দেখেছি, এত কাপুরুষতা দেখেছি এ জাতি আর মানুষের পর্যায়ে নেই। ক্রমে পশুর নিচে চলে যাচ্ছি আমরা। দুর্নীতির জাতীয়করণ করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তর তিনি বিষিয়ে তুলেছেন। এই জাতির যা কিছু গভীর, যা কিছু পবিত্র, উজ্জ্বল এবং গরীয়ান বিগত তিন বছরে সমস্ত কিছু কলুষিত করে ফেলতে পেরেছেন।
তার বাহিনী অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বের মতাে যেদিকেই গেছে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে। শেষমেষ ছিল আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা ভাবতে শিখেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বাধীনতা, শান্তি, কল্যাণ, প্রগতি, সাম্য এবং হরিত্বরণ আশা-আকাক্ষার লালনক্ষেত্র। এইখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন এক শঙ্কাহীন স্বাধীনতা নিবাস করেন, বিরাজ করেন এমন এক সুস্থশালীনতা আমাদের জ্ঞানদায়িনী মা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গে অঙ্গে এমন এক প্রসন্ন পবিত্রতার স্রোত প্রবাহিত হয়, কোনাে রাজন্য, কোনাে সমরনায়ক, কোনাে শক্তিপী মানুষ কোনােদিন তা স্থূল হস্তের অবলেপে কলঙ্কিত করতে পারেনি। আকাশের মতাে উদার, বাতাসের মতাে নির্ভর, অনির্বার ঝরনার উৎসের মতাে স্বচ্ছ এবং সুনির্মল স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা এইখানে প্রতিদিন, প্রতিদিন বসন্তের নতুন মুকুলের আবেগে অঙ্কুরিত হয়। এই অঙ্কুরিত স্বাধীনতার পরশমণির ছোঁয়ায় প্রতিটি আপদকালে এই জাতি বারেবারে নবীন হয়ে উঠে। এর প্রতিষ্ঠাকালের পর থেকে আমাদের জন্মভূমির ওপর দিয়ে কতই না ঝড় বয়ে গেছে। কতবার ঘােড়ার খুরে, বন্দুকের আওয়াজে কেঁপে উঠেছে আকাশ, গর্বিত মিলিটারির বুটের সদম্ভ পদবিক্ষেপে চমকে উঠেছে রাত্রির হৃদয়। কত শাসক এল, কত মানুষ প্রাণ দিল। আমাদের এই ধৈর্যশীলা জ্ঞানদায়িনী মা সংহত মর্যাদার শক্তি, সাহস, বলবীর্য সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরেও শিখিয়েছে কী করে প্রতীক্ষা করতে হয়। নীরব ভাষায় মৌন আকাশের কানে কানে বারেবারে জানতে চেয়ে গেছে শক্তি, ক্ষমতা, দম্ভ এসবের পরিণতি কোথায়? ব্রিটিশ।সাম্রাজ্যবাদের অতন্দ্রপ্রহরীর দল, তারা কোথায়? কোথায় মি. জিন্নাহ, কোথায় নাজিমুদ্দিন, কোথায় নুরুল আমিন? জেনারেল আইয়ুব খান, আবদুল মােনেম খান, ইয়াহিয়া খান এই সমস্ত শক্তিপী মানুষেরা আজ কোথায়? তাঁরা যে আতঙ্ক, যে ঘৃণা, যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এ দেশের জনপদবাসীর জীবনধারায় ঘূর্ণিঝড়ের সূচনা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কি আপন সন্তানদের তার আর্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা দেয়নি?
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫; সেইসব লেখা (২০০৮),
খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১১, ঢাকা।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ