You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাম্যবাদ

প্রথম সংখ্যা

১৭ই মার্চের বিপ্লবী শিক্ষা

সাম্রাজ্যবাদের দালাল, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৭ই মার্চ ঢাকার বুকে উদযাপন করেছে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ । এ হত্যাকাণ্ড বর্বর ইয়াহিয়া সরকারের একাত্তরের ২৫শে মার্চের নারকীয় হত্যা থেকেও ঘৃণ্য। ইয়াহিয়া সরকার ছিল বিজাতীয় ঔপনিবেশিক দস্যদের প্রতিনিধি। তারা নরহত্যা শুরু করেছিল রাতের অন্ধকারে। মুজিব সরকার এ হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছে দিনের আলােতে জনতার গণদাবর জবাবরূপে ।

গণবিরােধী আওয়ামী লীগ সরকারের আড়াই বছরের দুঃশাসনে বাংলার আপাময় জনসাধারণ আজ চরম নির্যাতন আর দুর্দশার শেষসীমায় উপনীত। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, সামাজিক দুরাচার ও বিশৃঙ্খলা জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চিয়তার নাগপাশে তারা অহরহ জর্জরিত। সমগ্র বাংলাদেশ আজ অনিবার্য ধ্বংসের পথে।

শােষিত, নিষ্পেষিত জনসাধারণের মুক্তির ২২টি দাবির ভিত্তিতে গণআন্দোলন চালু করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থনে এ আন্দোলন হয়ে উঠছিল দুর্বার শক্তিশালী। তারই এক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভা থেকে লক্ষাধিক জনতার অনুমােদনে জাসদ নেতাদের নেতৃত্বে শােভাযাত্রা করে গিয়েছিল ত্রিশ সহস্রাধিক জনতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষের পক্ষ থেকে সরাসরি গণদাবি পেশ করা। দুর্ভিক্ষ বন্ধ কর, মুদ্রাস্ফীতি রােধ কর, ন্যায্যমূল্যে ভাত-কাপড়ের বন্দোবস্ত কর, চোরাচালান, কালােবাজারী, মওজুদদারী, লাইসেন্স-পারমিটধারী খতম কর; দুনীতি-স্বজনপ্রীতি বন্ধ কর; পাটের গুদাম, শিল্প গুদাম পােড়ানাে বন্ধ কর; রেল দুর্ঘটনা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রশমন কর; ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, গুমখুন ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন বন্ধ কর- এ সব ছিল ‘গণদাবি’র সারমর্ম ।

গণদাবির জবাব দিয়েছে খুনী মুজিব সরকার নিরস্ত্র জনতার উপর অবিরাম গুলিবর্ষণের মাধ্যমে। সম্পূর্ণরূপে শান্ত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জনতার উপর অকারণে এবং অঘােষিতভাবে গুলি চালিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক নিষ্পেষণযন্ত্র ঘৃণিত রক্ষীবাহিনী। ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন, ছাত্র, যুবক ও শ্রমিকসহ মেহনতী জনতার ৫০ জন মানুষ; আহত হয়েছেন জাসদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ হাজার জনেরও বেশি লােক। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে জলিল-রবসহ শতাধিক লােককে। আওয়ামী লীগ সরকারের এ ঘূণ্য ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সমগ্র বাংলাদেশে। হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও জনসভার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের পথে এগিয়ে যায় সংগ্রামী জনতা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর নেমে আসে নিদারুণ রাজনৈতিক নির্যাতন।

Page 485

দেশব্যাপী প্রায় এক হাজারেরও বেশি জাসদ নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত শত জাসদ নেতা ও কর্মীর নামে বের করা হয়েছে হুলিয়া। অসংখ্য নেতা ও কমরি বাড়ি হামলা করে অত্যাচার করা হয়েছে তাদের আত্মীয়স্বজনদের ওপর। রক্ষীবাহিনী ও সশস্ত্র পুলিশের প্রহরায় ও আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে ভস্মীভূত করা হয়েছে জাসদের কেন্দ্রীয় অফিস; অগ্নিসংযােগ করা হয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে; হামলা করা হয়েছে শােষিত মানুষের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ-এর’ মুদ্রনালয়ে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে তার সম্পাদক, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি আল-মাহমুদকে। এক কথায় সমগ্র দেশে চালু করা হয়েছে আবার শ্বেতসন্ত্রাস।

এ হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক নির্যাতনের নিন্দা করে বক্তব্য রেখেছেন দেশের প্রবীণতম জননেতা মৌলানা ভাসানী, প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খানসহ ৭টি বিরােধী দলের ১৪ জন নেতা, শতাধিক শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক। শ্রমিক, কৃষক ও সর্বশ্রেণীর মেহনতী জনতার পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন ও প্রতিরােধের জন্য উঠেছে সােচ্চার দাবি। সমগ্র দেশ আজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে দু’টি শিবিরে । একদিকে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমর্থক সকল সংগ্রামী শােষিত শ্ৰেণীসহ সমগ্র মেহনতী জনতা, অন্যদিকে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার সমর্থক ধনিক কম্প্রডর (মুৎসুদ্দি) সামাজিক ও রাজনৈতিক গুণ্ডাশ্রেণীসমূহ। সারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপনীতি হয়েছে এক যুগসন্ধিক্ষণে, যার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য উপলব্ধির উপর নির্ভর করবে বিপ্লবী রাজনীতির সঠিক কর্মকৌশল। এতে সামান্যতম ভুলও হয়ে ওঠবে বিপ্লব সাফল্যের পরিপন্থী এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের বিজয়ের ভিত্তি।

দুই

১৭ই মার্চের হত্যাকাণ্ডের মূল্যায়ন ও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যের বিশ্লেষণ অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশের বিপ্লবের ‘আত্মমুখী’ (সাংগঠনিক) শক্তিকে সংহত ও বলীয়ান করে তােলার জন্য এ মূল্যায়ন আজ অতি প্রয়ােজনীয়। কারণ, এক দিকে যেমন সকল প্রগতিশীল দল এবং মুক্তিকামী জনতা সরকারের এ হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন, আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থক গুণ্ডাগােষ্ঠির ফ্যাসিষ্ট কার্যকলাপের নিন্দা ও প্রতিবাদ করেছে, অন্যদিকে তেমনি কিছু সংখ্যক তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী

ও কতিপয় পাতিবর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ১৭ মার্চের ঘটনাকে জাসদের অনভিজ্ঞ নেতৃত্বের হঠকারী এবং অতিবিপ্লবী পদক্ষেপ রূপে সমালােচনা করেছেন। এরূপ সমালােচনা স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে সন্দেহ, সংশয় ও বিভ্রান্তির সূচনা করতে পারে, ফলে বিপ্লবের আত্মমুখী শক্তি সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

লেনিন [১] বলেছেন, প্রত্যেকটি বিপ্লবী ঘটনা আমাদের শিক্ষা ও অনুধাবনকে ত্বরান্বিত করে এবং বিপ্লবী ঐক্য ও সংহতিকে দ্রুততর করে। বিকাশের পথে বিপ্লবের প্রত্যেকটি ধাপ জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে এবং দুর্বার শক্তিতে বিপ্লবী কর্মসূচির পক্ষে আকর্ষণ করে কারণ কেবল বিপ্লবী কর্মসূচিই তাদের সত্যিকারের স্বার্থ প্রকাশ ও সংরক্ষণ করে। লেনিনদের এ উক্তি অভ্রান্ত। ১৭ই মার্চের প্রতিক্রিয়া এ সত্যকে যথাসময়ে প্রতিপন্ন করতে বাধ্য তবুও নির্ভুল বিশ্লেষণের মাধ্যমে ১৭ মার্চের বিপ্লবী শিক্ষাকে পরিষ্কারভাবে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে হবে।

Page 486

সঠিক মার্কসবাদী বিশ্লেষণে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক জগতে কোন ঘটনাই আকস্মিক নয়। প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনে থাকে তার নিজস্ব পরিস্থিতির বিকাশের মৌলিক কারণসমূহ অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ বিরােধের প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের বহিঃপ্রকাশ কখন এবং কেমন করে কোন ঘটনা ঘটবে- তা নির্ভর করে পরিস্থিতির তখনকার বাহ্যিক কারণসমূহের ওপর। কিন্তু এসব বাহ্যিক কারণসমূহকেও সক্রিয় করে তােলে অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ।

১৭ই মার্চের ঘটনার অভ্যন্তরীণ কারণ খুঁজতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট- সমস্যাপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অপ্রতিরােধ্য দ্রুত অবনতির মূল কারণসমূহের মধ্যে। এ সব কারণের ব্যাপক ব্যাখ্যা অন্যত্র করা হয়েছে [২]। এখানে আমরা শুধু কয়েকটি প্রাথমিক বিরােধের নাতিদীর্ঘ আলােচনার মাধ্যমে তার সারমর্ম বােঝার চেষ্টা করব।

প্রথমত, বাংলাদেশে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসম্পূর্ণতা ও ক্ষমতাসীন সরকারের সার্বভৌমত্বের আস্ফালনের মধ্যকার বিরােধ। ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে গুপ্তচুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতি এবং উন্নয়নমূলক কাজেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সীমিত। প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কখনও সরকারকে সঠিক সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ এবং কার্যকরী করতে দেবে না।

দ্বিতীয়ত, মুখে সমাজতন্ত্রের বুলী এবং কার্যত দেশী-বিদেশী পুঁজিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠির সঙ্গে আঁতাতের প্রাণপণ প্রচেষ্টা।

তৃতীয়ত, বৃহৎ শিল্প রাষ্ট্রীয়করণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র বিরােধী আমলা ও টাউটদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সত্যিকারের সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার মধ্যকার বিরােধ। এ বিরােধের ফলে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে; সমাজতন্ত্র অপদস্থ হচ্ছে অথচ সমাজতন্ত্রের নামে চালানাে হচ্ছে শ্রমিক কৃষকের উপর ধনবাদী শােষণ ও ফ্যাসিবাদী নির্যাতন। এক দিকে চলছে উৎপাদন বাড়ানাের আহ্বান, অন্যদিকে সরকারি তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিল্পকেন্দ্রে ও শিল্প গুদামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।

চতুর্থত, সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ, অথচ আমদানি ও আমদানিকৃত পণ্য বণ্টনের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে শহরে ও নগরে সরকার ও সরকারি দলের তাবেদাররূপে এক নতুন ও উঠতি পুঁজিবাদী শ্রেণী। ক্ষমতাসীন গােষ্ঠির পৃষ্ঠপােষকতায় চালু করা হয়েছে অবাধ চোরাচালান। সমাজতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদী তাবেদার সৃষ্টির এ প্রচেষ্টা দ্রব্যসংকট, চোরাচালান, চোরা আমদানি, দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতিকে ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি করে চলেছে।

পঞ্চমত, সমাজতান্ত্রিক কৃষি উন্নয়ন এবং সবুজ বিপ্লবের নামে কতিপয় ধনিক কৃষককে পুঁজিবাদী কৃষকে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টার মধ্যকার বিরােধ। এ বিরােধের ফলে ভূমি মালিকানার ধরনের কোন পরিবর্তনের প্রয়ােজন আওয়ামী লীগ সরকার করছে না। ধনবাদী কায়দায় ফসল বাড়ানাের প্রচেষ্টা, ভ্রান্ত মুদ্রা ও মূল্যনীতি শুধু কৃষি উৎপাদনের সরঞ্জামের দামই বাড়াচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না। ফসলের ঘাটতি তীব্রতর হয়ে উঠছে; সারা দেশে দুর্ভিক্ষ ও অনাহারে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে আপাময় জনসাধারণ।

Page 487

ষষ্ঠত, ক্ষমতাসীন সরকারের ভ্রান্তনীতি, চরিত্রহীনতা ও দুঃশ্চরিত্রতার পৃষ্ঠপােষকতা একদিকে দারুণ দুর্ভিক্ষ; মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মাধ্যমে বাড়িয়ে দিয়েছে। জনসাধারণের দারিদ্র্য, অন্যদিকে সরকার দলীয় ও সরকারি পৃষ্ঠপােষিত মুষ্ঠিমেয় লােকের হাতে পুঞ্জিভূত হচ্ছে সীমাহীন সম্পদ। ফলে গড়ে উঠছে এক উঠতি বুর্জোয়া ধনিকশ্রেণী এবং পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল শ্রেণী। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পরিস্থিতি জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সূচনা করতে বাধ্য। এরূপ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম অনিবার্য ফল সামাজিক নৈরাজ্য। শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, ব্যাংক লুট, বাজার লুট, হত্যা ও গুপ্তহত্যা এরই স্বাভাবিক পরাকাষ্ঠা। ক্ষমতাসীন গােষ্ঠির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরূপ নৈরাজ্যবাদী সামাজিক দুষ্কৃতকারীদের সহায়ক হয়েছে। ফলে সামাজিক নৈরাজ্য সূচনা করছে আইন প্রবর্তক, আইনরক্ষাকারী ও আইন প্রয়ােগকারীদের মধ্যে এক ধ্বংসাত্মক পারস্পরিক বিরােধ। এসবের প্রতিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল, আওয়ামী লীগের দালাল ও রিলিফ চোরদের হত্যা, কৃষকদের দলবেঁধে ধান কেটে নেয়া, থানার উপর হামলা ও থানা লুট, আপসপন্থী, মতাদর্শহীন রাজনৈতিক দলের প্রতি জনসাধারণের ঘৃণা, সরকারি দলের প্রতি অনাস্থা এবং অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বলিষ্ঠ ও বিপ্লবী নেতত্ত্বের প্রতি আস্থার মাধ্যমে।

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এসেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে। বহু নির্যাতনের সম্মুখে জাসদ নেতা ও কর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টায় জনসাধারণ এগিয়ে যায় আন্দোলনের পথে। ভয়ে কম্পিত হয়ে ওঠে শাসক শ্রেণী ও তাদের বৈদেশিক প্রভাব। ২০ জানুয়ারির প্রতিবাদ সভাকে পণ্ড করার জন্য হঠকারী নীতির আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ সরকার ও তার দলীয় তাঁবেদাররা। ভুয়া অজুহাতে ঢাকায় জারী করা হয় ১৪৪ ধারা। জাসদ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের বহু অনুরােধেও সরকার ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে রাজি হয়নি। ফলে জাসদ এ ধারা অমান্য করতে বাধ্য হয়। ১৮ জানুয়ারি নেমে আসে জাসদের ওপর নির্যাতন। স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদে সমগ্র দেশে পালিত হয় ১৯ ও ২০ জানুয়ারি এবং ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে সার্বিক সাধারণ ধর্মঘট। ঢাকার সরকারি অফিস থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরের বাজার পর্যন্ত এমন ব্যাপক হরতাল বাংলাদেশে এর আগে পালিত হয়নি।

ভীত সন্ত্রস্ত সরকার ও তার রাজনৈতিক তাঁবেদাররা সরকারি ও দলীয় গুণ্ডা এবং রক্ষীবাহিনীর জুলুম তীব্র করে তােলে। জাসদ নেতাদের হত্যা করার জন্য স্কোয়াড নিযুক্ত করে। জাসদ নেতা ও কর্মী এবং অন্যান্য বামপন্থী বিরােধীদলের কর্মীদের ওপর চাল করে দানবীয় নির্যাতনের স্টিম রােলার। তীব্র হয়ে ওঠে জনতার বিক্ষোভ। নির্যাতনের মুখে বাধ্য হয় জাসদ তার গণআন্দোলনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে। সর্বসাধারণের সমর্থিত গণদাবিসমূহ মেনে নিয়ে কার্যকরী করার জন্য সরকারের ওপর জোরদার চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক ঘেরাও আন্দোলনের ডাক দেয় জাসদ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জাসদের এ আহ্বান ছিল সর্বোতভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পদ্ধতি। এ ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি জাসদ ঘােষণা করেছিল ঐতিহাসিক পল্টনে ১৭ ‘মার্চ লক্ষাধিক সংগ্রামী জনতার বিশাল সমাবেশে।

Page 488

১৭ মার্চের ঘটনা তাই আকস্মিক অথবা বিচ্ছিন্ন ছিল না, তা বাংলাদেশের বিগত আড়াই বছরের রাজনৈতিক বিকাশেরই এক অনিবার্য ধাপ। একে জাসদের হঠকারিতা বলে আখ্যায়িত করতে পারে কেবল তারাই যারা মুখে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বিপ্লবের বুলি আওড়ায়, অন্যের কাধে বন্দুক রেখে বিপ্লব সমাধা করতে চায়; অবস্থা বিশেষে সমস্ত দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে নিজের সাফাই বজায় রাখতে চায়; অথবা যারা জনসাধারণের সমর্থন ও সহায়তায় তােয়াক্কা না করে মুষ্টিমেয় অস্ত্রধারী ক্যাডারের মাধ্যমে বিপ্লব সম্পন্ন করার অতি বামপন্থী আত্মমুখীবাদ ও আত্মক্রিয়াবাদের ব্যাধিতে পীড়িত।

১৭ মার্চ তারিখে যদি কেউ হঠকারিতার প্রশ্রয় নিয়ে থাকে তবে তা নিয়েছে ক্ষমতাসীন অপদার্থ আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার ইচ্ছা করলেই জাসদ নেতৃবৃন্দকে ১৭ মার্চের আগে গ্রেফতার করতে পারত; ১৭ মার্চের শান্তিপূর্ণ শােভাযাত্রায় বাধা দান করতে পারতাে, লাঠিচার্জ করে জনতার সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করতে পারতাে। এমনকি সরকার কিছু না করলেও জনতা যথাসময়ে চলে যেতাে। সবই সরকার জানতাে। তবু এ সব না করে সরকার রক্ষীবাহিনীর অতি আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা উদ্যাপন করল এক নরমেধযজ্ঞ। এ কখনও আকস্মিক হতে পারে না। এ সম্পূর্ণরূপে পূর্বপরিকল্পিত ও পূর্বনির্ধারিত। ব্যাপক নরহত্যা, ধরপাকড় ও পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক গুণ্ডামীসুলভ নির্যাতনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট কায়দায় গণআন্দোলনকে ধূলিস্যাৎ করাই ছিল ধূর্ত সরকারের আসল হঠকারী উদ্দেশ্য।

সরকারের এ হঠকারিতা জনসাধারণের চোখে ধরা পড়তে বাধ্য। এ নরহত্যা ও রাজনৈতিক নির্যাতনের তােড়জোড় সরকারি শক্তির বাহ্যিক রূপ মাত্র। ক্ষমতাসীন সরকার, রাজনৈতিক দল ও তাদের তাঁবেদার গােষ্ঠীর অন্তর্মুখী শক্তি আসলে অত্যন্ত দুর্বল- যে দুর্বলতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপরে বর্ণিত অবনতির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া রূপে।

তাই চিরাচরিত ফ্যাসিস্ট কায়দায় সরকার তার আত্মমুখী শক্তির দুর্বলতা ঢাকার অপচেষ্টা করছে হঠকারী নরহত্যা ও নির্যাতনের ঢংকানিনাদের মাধ্যমে। একাত্তর সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির অন্ধকারে ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সরকারও করেছিল অনুরূপ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল ইয়াহিয়া; তার হঠকারিতা খনন করেছিল তার নিজের কবর। ২৫ মার্চ তাই উন্নীত করেছিল বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ স্তরে ।

প্রত্যেকটি রাজনৈতিক ঘটনা রাজনৈতিক আন্দোলনকে নতুন ও উন্নততর পর্যায়ে ঠেলে দেয়। এর অনেক নজির বাংলাদেশ তথা বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে লেখা হয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। ১৯৪৮ সালে শুরু হয়েছিল যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫২ সালে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি তাকে উন্নীত করেছিল বাংলার জাতিত্বের আন্দোলনে; ১৯৬২ সালের আন্দোলন তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ১৯৬৬ সালে রূপান্তরিত করেছিল সরাসরি স্বাধিকার আন্দোলনে; ১৯৬৯ সালের আন্দোলন গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনকে মতাদর্শগত আন্দোলনের দিকে মােড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনকে সজোর, ব্যাপক ও তীব্র করে তুলেছিল শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর ব্যাপক ঘেরাও অভ্যুত্থান। ১৯৭১ সালের ১ মার্চের ঘটনা বাঙালি জাতিকে উন্নীত করেছিল জাতীয়তাবােধের সর্বোচ্চ স্তরে যা রূপান্তরিত হয়েছিল ২৫ মার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে।

Page 489

১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের ঘটনার গুরুত্ব আরও বেশি, গুণগতভাবে আরও উন্নততর। এ ঘটনার বাংলাদেশের রাজনীতিকে এমন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করেছে যা ইতঃপূর্বে সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের অবশ্যম্ভাবী সমাজ বিপ্লবে ১৭ মার্চের ভূমিকা রাশিয়ার ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির প্রায় সমতুল্য। যে ঘটনাকে লেনিন (১, পৃ. ৪৮১] আখ্যায়িত করেছিলেন “বিপ্লবের আরম্ভ রূপে। যে সমস্ত স্ফুলিঙ্গ বিজয়ী বিপ্লবের লেলিহান দাবানল প্রজ্জ্বলিত করেছিল, তার মধ্যে ১৯০৫ এর মস্কো অভ্যর্থন [৩], চীনের ১৯১৯ এর ৪ঠা মে’র আন্দোলন ও ১৯২৫ এর ৩০ মে’র হত্যাকাণ্ড [৪] এবং কিউবার ১৯৫৩ এর ২৬ জুলাইয়ের [৫] মনকাড়া দুর্গ আক্রমণ তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন। অবশ্য শেষােক্ত ঘটনাসমূহ এবং ঢাকার ১৭ মার্চের ঘটনার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে।

১৭ মার্চ রক্ষীবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে গণদাবি পেশকারী নিরস্ত্র ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও মেহনতী জনতাকে। জনতা মৃত্যুবরণ করেছে, পাল্টা আক্রমণ করেনি, যেমন করেছিল রাশিয়া, চীন ও কিউবায়। সরাসরি সংগ্রাম জনতার উদ্দেশ্য ছিল না; পাল্টা আক্রমণের জন্য তারা তৈরিও ছিল না। তবুও তাদের উপর গুলি করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে তাদের ৫০ জনকে। ১৭ মার্চ তাই উৎপাদন করতে বাধ্য সে ‘ফুলিঙ্গ যা। বিরাটাকার অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে।

তিন

১৭ মার্চের ঘটনা সত্যিই সেই স্ফুলিঙ্গ যা বাংলাদেশে বিজয়ী বিপ্লবের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করতে বাধ্য। কারণ ১৭ মার্চের শিক্ষা সর্বোতভাবে বিপ্লবী। প্রথমত, ১৭ মার্চ প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সাধারণ হরতাল সংগ্রামের স্বাধীন ও প্রধান ধরন হিসাবে প্রায় অচল। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি বিপ্লবী ক্রিয়াই অনিবার্যভাবে জন্ম দেয় প্রতিবিপ্লবী প্রতিক্রিয়া; শত্ৰু আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় তার সবচেয়ে উগ্র এবং সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হতে। তৃতীয়ত, প্রতিক্রিয়ার একটি শেষসীমা আছে, যেখানে জনতা তার জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হতে বাধ্য সম্পূর্ণ বিপ্লবী পদ্ধতিতে আক্রমণের মাধ্যমে।

কেবল প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল ও সাধারণ হরতালের মাধ্যমে যে শােষিত জনগণের মুক্তি আসতে পারে না তা নতুন কথা নয়, নতুন শিক্ষাও নয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের গােড়ার কথা- দুনিয়ার প্রত্যেকটি বিপ্লবের মূল শিক্ষা। তবুও এ শিক্ষা বার বার গ্রহণ করতে হয়; এবং কেবল তাদের নিজেদের সংগ্রামী অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই জনগণ এ শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগ্রাম থেকে আপামর জনসাধারণের সত্যিকারের শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। ১৭ মার্চের শিক্ষা প্রত্যক্ষ সংগ্রামী শিক্ষা- নির্ভুল বিপ্লবী শিক্ষা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সত্যকে প্রত্যেকটি সচেতন বিপ্লবীর সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে, অথচ যা বাংলাদেশের অনেক বিপ্লবী এখনও উপলব্ধি করতে পারেননি, তা-ই জনতা উপলব্ধি করেছে ১৭ মার্চ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিক নীতি অনুযায়ী সমাজতন্ত্র কায়েমের সংগ্রাম চালানাে যায় দুটি উপায়ে; এক. বৈধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে এবং দুই. বিপ্লবী

Page 490

কর্ম পদ্ধতিতে [4]। প্রথম পদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানাে সম্ভব শুধু বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিকাশের উন্নততর পর্যায়ে। অর্থাৎ যে সমস্ত ধনবাদী দেশ আজ সাম্রাজ্যবাদের পর্যায়ে, সে সমস্ত দেশে পার্লামেন্ট, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদির সহায়তায় পুঁজিবাদের চূড়ান্ত উচ্ছেদের জন্য শ্রমিক ও অন্যান্য শােষিত শ্রেণীকে শিক্ষা দেওয়া ও প্রস্তুত করা সম্ভব। কিন্তু যে সব দেশে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এখনও সম্পূর্ণ হয়নি অর্থাৎ বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে জাতীয় স্বাধীনতা সীমিত এবং পার্লামেন্ট, ট্রেড ইউনিয়ন জাতীয় বিভিন্ন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারের সুযােগ নেই অথবা সে সুযােগ কার্যত অত্যন্ত সীমিত, সে সমস্ত দেশে দ্বিতীয় পদ্ধতি ছাড়া আর কোনাে উপায় থাকতে পারে না। সঠিক বিশ্লেষণে বাংলাদেশে আজ বিপ্লবের দ্বিতীয় কার্যপদ্ধতিই যথােপযুক্ত।

প্রথমত, আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট। কিন্তু কার্যত বৈদেশিক নীতি সম্পৰ্কীয় ব্যাপারে তার স্বাধীনতা অত্যন্ত সীমিত। বাংলাদেশে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসম্পূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে সনাতন সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত। কৃষি ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক, কিন্তু অনুন্নত। জোতদারী ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থারই এক রূপ; মহাজনী লগ্নির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যও মূলত ধনতান্ত্রিক। পশ্চাৎপদ অনুন্নত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মহাজনী লগ্নি অনেকদিন প্রচলিত থাকে, যেমন থাকে সামন্ততান্ত্রিক আচার ব্যবহার ও শােষণের অবশেষ।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বৃহৎ শিল্প-কারখানা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশ রাষ্ট্রীয়কৃত। এখানে ব্যক্তিগত ধনতন্ত্রকে রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রে এবং তারই ছত্রছায়ায় অপচেষ্টা চলছে সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষুদে পুঁজিপতি সৃষ্টি করে ধনতন্ত্রের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাকে সুদৃঢ় করার। ধনিক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল সরকার কখনাে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে পারে না।

চতুর্থত, বাংলাদেশের ভাওতাবাজ সরকারের বাহ্যিক রূপ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। এখানে পার্লামেন্ট আছে; রাজনৈতিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মঘট এবং নির্বাচন ইত্যাদির সাংবিধানিক অধিকার আছে। বাহ্যত এখানে আরও আছে ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা। কিন্তু কার্যত এই সবই অত্যন্ত সীমিত এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এ দেশে অত্যন্ত সুচতুরভাবে চালানাে হচ্ছে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসন ও শােষণ।এ সত্য প্রায় সর্বজনবিদিত।

বাংলাদেশে পার্লামেন্ট আছে, কিন্তু সেখানে বিরােধী দল নেই বললেই চলে। যে পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা চালু থাকলে পার্লামেন্টে কোনােদিন বিরােধী দলের অভ্যুদয় হবে কি না তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিগত প্রত্যেকটি উপনির্বাচনই তার প্রমাণ। জনসাধারণ ভােট দেয় একজনকে, জিতে যায় আরেকজন। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিরােধী দলীয় প্রার্থীর কোনাে লােককে নির্বাচনকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয় না; বেগতিক অবস্থায় ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। নির্বাচন জয় করা হয় টাকা, গুণ্ডামী ও অস্ত্রের মাধ্যমে। এ হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তথাকথিত ‘মুজিববাদী গণতন্ত্রের ধরন।

শুধু জাতীয় সংসদের নির্বাচনই অস্ত্রবলে জেতা হয়নি, এ পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিকাংশ কলেজের ছাত্র পরিষদ নির্বাচনে। এর একটু ব্যতিক্রম হয়েছে বিগত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে। তার প্রধান কারণ ছিল আওয়ামী

Page 491

লীগ ও তার তাঁবেদার রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। ফলে আওয়ামী লীগ সরাসরি কোনাে প্রতিনিধি নির্বাচনে মনােনয়ন দান করতে পারেনি। পূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে বিরােধী দলের পক্ষেও দলগতভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সরাসরি প্রতিনিধি । খাড়া না করানাের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল জাতীয় পরিষদের তুলনায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচনী কেন্দ্র অনেক বেশি। এত কেন্দ্রে বলপ্রয়ােগে নির্বাচন জেতা বাস্তবিক পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং আওয়ামী লীগ তা সমীচীনও মনে করেনি। কারণ সে। চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের পদ্ধতি ও রহস্য জনসমক্ষে অরও নগ্ন হয়ে পড়ত। তাই আইয়বখানী কায়দায় নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের ওপর কার্যত কর্তত করার আশা ও সম্ভাবনায় আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি দলগতভাবে অংশগ্রহণ করেনি। তার ফল অত্যন্ত প্রণিধানযােগ্য। শতকরা দশ-বারােটি কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগের লােক জয়ী হতে পারেনি (তা সত্ত্বেও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগ গুণ্ডামী ও অস্ত্রের খেলা কম খেলেনি।)

আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র, ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি যেমন প্রহসন তেমনি আওয়ামী লীগ সরকারের অনুষ্ঠিত নির্বাচনও একটি প্রহসনমাত্র। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রতিহত করার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার ও রাজনৈতিক গােষ্ঠী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক নিষ্পেষণ ও নিধন চালিয়ে যাচ্ছে। দলীয় গুণ্ডাবাহিনীকে মারাত্মক আধুনিক ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মী নিধনে। তদুপরি গঠন করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনী- কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী। এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে বিদেশিদের পরামর্শে, বিদেশিদের সাহায্যে এবং বিদেশি উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। এদের প্রদান করা হয়েছে অশ্রুতপূর্ব ব্যাপক ক্ষমতা। এরা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারও কাছে জবাবদিহি করে না। এরা যে কোনাে জায়গায় যে কোনাে সময়ে যে কোনাে

মানুষকে বিনা ঘােষণায় বিনা কারণে গ্রেফতার করতে পারে, গুলি করে হত্যা করতে পারে, কোন লােকের মালামাল ছিনতাই ও ধ্বংস করতে পারে। হিটলারের গেষ্টাপােদের এরূপ ক্ষমতা ছিল কি না সন্দেহ।

অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত আওয়ামী লীগের দলীয় গুণ্ডাবাহিনী ও জনসাধারণের টাকায় পুষ্ট রক্ষীবাহিনী শহরে-নগরে গ্রামে-গঞ্জে দুষ্কৃতকারী দমনের নামে চালিয়ে যাচ্ছে নিদারুণ রাজনৈতিক নিষ্পেষণ । তারা বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের গুম করে ফেলে তাদের আতীয় নারী-পুরুষের ওপর চালায় অশ্রুতপূর্ব নির্যাতন। এক থানার যুবকের মাথা কেটে ফেলে আসে অন্য থানায়। একাত্তরের অধিকাংশ বীর মুক্তিযােদ্ধা দিবারাত্র আত্মগােপন করে থাকে তাদের ভয়ে। কারণ এদের নির্মূল করা রক্ষীবাহিনীর অন্যতম দায়িত্ব। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকই আজ মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে পেরেছে, কেবল জনসভায় প্রতিবাদ করে ও বিক্ষোভ মিছিল করে রক্ষীবাহিনীর রাজনৈতিক ও সামাজিক নির্যাতনের মােকাবেলা করা সম্ভব নয়।

যে পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কথা বলে এবং আন্দোলন করে অস্ত্রের মাধ্যমে; যে দেশে ক্ষমতাসীন সরকার বিশেষ রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে চালায় দমননীতি; যে দেশে অস্ত্রের ঝংকারে ছিনতাই, রাহাজানি, রাজনৈতিক হত্যা, গুপ্ত খুন।

Page 492

ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে দেশের সরকার সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ায় অথচ সমাজতন্ত্রের শত্রুদের আশ্রয় দেয় এবং পরিতুষ্ট করে অথচ সরকারি নিষ্পেষণযন্ত্রের মাধ্যমে নির্বিচারে হত্যা করে শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনতা ও তাদের রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের, সে পরিস্থিতি ও সে দেশে তথাকথিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।

বাংলাদেশের জনসাধারণের সার্বিক মুক্তি আসতে পারে কেবল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে, পরিষদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। এ সত্য প্রত্যেকটি বিপ্লবী কর্মীকে অনুধাবন করতে হবে এবং বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক ও মেহনতী জনতাকে অনুধাবন করাতে হবে। এই হচ্ছে ১৭ মার্চের বিপ্লবী শিক্ষা।

চার

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্ভব নয়; বিপ্লবী অন্তর্মুখী শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এ সত্য ১৭ মার্চের মহান শিক্ষার একটি দিক মাত্র। শুধু বাহ্যিক অভিব্যক্তি দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তির বিচার করা যেমন অবৈজ্ঞানিক তেমনি ১৭ মার্চের ঘটনা থেকে বিপ্লবের অন্তর্মুখী শক্তির বিচার করাও অযৌক্তিক। ১৭ মার্চ একদিকে যেমন প্রমাণ করেছে বিপ্লবের অনিবার্যতা, তেমনি অপরদিকে তা প্রমাণ করেছে বিপ্লবীদের সংগঠনের দুর্বলতা। একথা অতি সত্য যে বিপ্লবী পরিস্থিতিতেও বিপ্লবীরা এখনও ১৭ মার্চের শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেনি।

বিপ্লবীদের এ সাংগঠনিক দুর্বলতাকে যথাসম্ভব সতর্কতার সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। ১৭ মার্চের বিপ্লবী শিক্ষার তাৎপর্য জনসাধারণকে সম্যক ও ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করাতে হবে। যেহেতু আন্দোলন এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমেই জনতার শিক্ষা ও উপলব্ধি গভীরতর ও ব্যাপকতর হয়, সেহেতু বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করে তােলার জন্য এবং জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বৈপ্লবিক কর্মপদ্ধতির পাশাপাশি শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও মেহনতী জনতার নিজস্ব সংগঠনসমূহের মাধ্যমে গণআন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে এবং তাকে প্রতিদিন বলিষ্ঠ ও তীক্ষ করে তুলতে হবে। বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রয়ােজনীয়তা জনসাধারণের কাছে থেকে গুপ্ত রাখা এবং বিপ্লবীদের আত্মপ্রতারণা একই কথা।

মার্কস আমাদের এ শিক্ষা দিয়েছেন, বিপ্লবী অভ্যুত্থান একটি আর্ট; তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাহসী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আক্রমণ। প্রতিক্রিয়াশীলদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবীদের বিপ্লবী রণকৌশলের কথা প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখতে হবে এবং তার জন্য সাংগঠনিক শক্তি দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। বিপ্লবের আত্মমুখি শক্তি সম্পর্কীয় এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করার অক্ষমতা হবে মহান ১৭ মার্চের মহান মূল্যায়নের ব্যর্থতা।

বিপ্লব অনিবার্য।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।

Page 493

টীকা

১. ভ, ই, লেনিন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সােশ্যাল ডিমােক্রেসির দুটি কর্মকৌশল, সিলেকটেড ওয়ার্কস, ভলিউম ১, মস্কো, ১৯৬০, পৃ. ৫২৩।

২. জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল; ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের ভিত্তি ও কর্মসূচি।

৩. ভ. ই. লেনিন; ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে বক্তৃতা, কালেকটেড ওয়াকর্স, ভলিউম ৩০, পৃ. ২৭৭।

৪. মাও সে তুঙ; যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা, বিদেশি ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, ১৯৭০

৫. একটি ফুলিঙ্গই বিরাটাকারের অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে, বিদেশি ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, ১৯৬৮।

৬. গ্রানমা ২৬ জুলাই, ১৯৭৩।

রক্তাক্ত রবিবার : ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারি রবিবার দিবসে’ সেন্ট পিটার্সবার্গে স্বৈরাচারী জার

হাজার হাজার নিরপরাধ নিরস্ত্র শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে । লেনিন এই ঘটনাকে রাশিয়ার বিপ্লবের আরম্ভ বলে আখ্যায়িত করেন এবং ইতিহাসে ঐ দিনটি ‘রক্তাক্ত রবিবার’ বলে পরিচিত হয়। ঐ দিনে ধর্মভীরু যাজক গেপনের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক ইউনটারপ্যালেশ-এর সম্মুখে সমবেত হয়েছিল রুশ সম্রাট জাবের নিকট এক গণদরখাস্ত পেশ করতে। জার গণদরখাস্ত পেশকারী শ্রমিকদের দর্শন না দিয়ে তার সেনাবাহিনী ও ভাড়াটিয়া কজাক গুণ্ডাদের দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে।

মস্কো অভ্যুত্থান : ১৯০৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর মস্কোতে স্টিল শ্রমিকদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে শ্রমিক ও জারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে এক সংঘর্ষ বাধে। ৯ দিনব্যাপি প্রায় ৮ হাজার শ্রমিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্রোহী দল জারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম করে। পরিস্থিতি এরূপ দাঁড়িয়েছিল যে জার তার মস্কো গ্যারিসনকে বিশ্বাস করতে পারেনি, ইহাকে তালাবদ্ধ করে রাখে এবং বিদ্রোহকে দমন করার জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সেমিওনভস্কি রেজিমেন্টকে আনয়ন করে। লেনিনের মতে ‘মস্কো অভ্যুত্থান ছিল সেই লাখ লাখ ফুলিঙ্গের একটি যা বিপ্লবের লেলিহান দাবানল প্রজ্জ্বলিত করে।

চীনের ৪ ঠা মে’র আন্দোলন : এ আন্দোলনটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বিপ্লবী আন্দোলন, যা ১৯১৯ সালের ৪ মে তারিখে শুরু হয়েছিল। সেই বছরের প্রথমার্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ীরা প্যারিসে এক বৈঠকে চীনের শানতােং প্রদেশে আগের দিনে জার্মানি যে সব সুযােগ সুবিধা ভােগ করত সেগুলাে জাপান পাবে বলে স্থির করেছিল। ৪ মে তারিখে পিকিংয়ের ছাত্ররা সর্বপ্রথম সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল আয়ােজন করে দৃঢ়ভাবে তার প্রতিবাদ করেছিল। উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধবাজ সরকার অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে। প্রতিবাদে পিকিং-এ এবং অন্যান্য অঞ্চলে ছাত্ররা সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করে। জুন মাসে এ আন্দোলন সাংহাইসহ অন্যান্য বড় শহরে শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট ও সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত হয়ে ছাত্র আন্দোলনকে দেশব্যাপী স্বদেশপ্রেমী আন্দোলনে রূপান্তরিত করে।

চীনে ৩০ মে’র হত্যাকাণ্ড : এই দিনে সাংহাই-এ ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক চীনা জনগণকে হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য সারা দেশের জনগণ এক সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলন চালিয়েছিল। ১৫ মে সাংহাইয়ে জাপানী সুতাকলের মালিক কুচেং-হােং নামক একজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে এবং ১০ জনের বেশি শ্রমিক আহত হয়। ২৮ তারিখে ছিং তাউ-এ সরকার ৮ জন শ্রমিককে হত্যা করে। ৩০ মে সাংহাই-এ দু’হাজারের বেশি ছাত্র বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বিদেশীদের এলাকাগুলােতে শ্রমিকদের পক্ষে প্রচার চালায় এবং এলাকা ফিরিয়ে আনার জন্য আহ্বান জানায়। ব্রিটিশ এলাকার পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সম্মুখে দশ হাজারের অধিক লােক

Page 494

সমবেত হয় এবং বজ্র নিনাদে আওয়াজ তােলে সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালায়; ফলে শত শত ছাত্র আহত হয়। এই ঘটনাই ৩০ মে’র হত্যাকাণ্ড বলে পরিচিত।

২৬ শে জুলাই : মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শােষণ ও তাবেদার বাতিস্তার গণনিষ্পেষণে কিউবার প্রতিটি মানুষ তখন অতিষ্ঠ। গণতান্ত্রিক বা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাতিস্তা ও তার মার্কিন প্রভুদের কবল থেকে দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনা অসম্ভব একথা বুঝতে পেরে, সশস্ত্র বিপ্লবের সূচনা হিসেবে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে ১৬৫ জন তরুণ বিপ্লবী ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই মনকাড়া দুর্গ আক্রমণ করে। দক্ষিণাঞ্চলীয় সেন্টিয়াগাে দ্য কিউবা শহরে অবস্থিত মনকাড়া দুর্গ ছিল কিউবার দ্বিতীয় প্রধান সামরিক ঘাটি এবং ১ নম্বর এন্টোনিওম্যাসি ও রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টার্স। এই আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং বিপ্লবীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন থেকে শুরু হয় বিপ্লবীদের হেঁকে তােলার কাজ। ওই মনকাড়া দুর্গের মধ্যেই ৫০ জন বিপ্লবী এবং কয়েকজন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পয়লা আগস্ট তারিখে সিয়েরা মায়েস্ত্রায় পালিয়ে যাওয়ার পথে ফিডেল ক্যাস্ট্রোও দুজন সঙ্গীসহ ধরা পড়েন। বিচারে তার জেল হয় এবং তাঁকে পাইনস দ্বীপের কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়।

আপাতদৃষ্টিতে মনকাড়া দুর্গ আক্রমণ ছিল হঠকারী। কিন্তু তার সাড়ে পাঁচ বছর পর ১৯৫৯ সালের পয়লা জানুয়ারি যেদিন বাতিস্তার পতন ও বিপ্লবী জনতার বিজয় সূচিত হয় সেদিনই সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণিত হয়- মনকাড়া দুর্গের বিপ্লবী ঘটনা তাৎপর্যহীন নয়। এই দুর্গে আক্রমণের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত ফিদেল আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস আমাকে মুক্ত করবে’ শীর্ষক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘তৎকালীন বাস্তব ও সাংগঠনিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের চরম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ একমাত্র এই উপায়েই সম্ভবপর ছিল।

হুবহু উদ্ধৃত

Page 495

তেরাে

সাম্যবাদদ্বিতীয় সংখ্যা

বিপ্লবীদের মুখপত্র

বিপ্লবী গণবাহিনী সম্পর্কে

১. গণবাহিনীর প্রয়ােজনীয়তা

শ্রেণী বিরােধ ও শ্রেণী সংঘর্ষ শ্রেণীভিত্তিক সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। শ্রেণী সংগ্রামই ইতিহাসের প্রধান চালিকা শক্তি। বিকাশের পথে সামাজিক বিবর্তন ঘটে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে। শ্রেণী বিরােধ এবং শ্রেণী সংঘর্ষ এমন এক পর্যায়ে উপস্থিত হতে পারে যেখানে শ্ৰেণীযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই লেনিন বলেছেন, যারা শ্রেণী সংগ্রাম স্বীকার করে তারা গৃহযুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করতে পারে না, কারণ শ্রেণী বিভক্ত সমাজে গৃহযুদ্ধ শ্রেণী সংগ্রামেরই একটি স্বাভাবিক এবং কোনাে কোনাে পরিস্থিতিতে অনিবার্য পরিণতি (১, পৃ. ৭৮)। মাও সেতুঙ বলেছেন, যুদ্ধ হচ্ছে বিরােধ মীমাংসার জন্য সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ (২, পৃ. ১৮০)।

যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, তাদের কাছে সমাজ বিপ্লব একটি সুনিশ্চিত এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য। স্মরণ রাখতে হবে, রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম এবং রাষ্ট্র হচ্ছে ক্ষমতাসীন শ্রেণীগুলাের আধিপত্য প্রয়ােগ করার অপরিহার্য হাতিয়ার। সমাজে যতদিন শ্রেণী বিভেদ ও শ্রেণী দ্বন্দ্ব থাকবে, ততদিন রাষ্ট্র থাকবে, আর থাকবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম।

রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম সর্বতােভাবে শ্রেণী সংগ্রাম। সময় সময় এ সংগ্রাম শ্ৰেণীযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। শ্ৰেণীযুদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রাম। সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ক্ষমতা ধ্বংস করা যেত না; পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতাে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে; সমাজ বিপ্লব ছাড়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র এবং সমাজ বিপ্লব অবিচ্ছেদ্য।

পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন থাকে পুঁজিপতি তথা বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিরা। রাষ্ট্রের সংগঠিত (সৈন্য ও পুলিশ বাহিনীসমূহের সাহায্যে তারা নিজেদের কর্তৃত্ব, শাসন ও শােষণ টিকিয়ে রাখে। শােষিত শ্রেণীগুলাের একাংশকে তারা ছল, বল, কৌশল এবং ঘুষের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে শােষিত শ্রেণীসমূহকে প্রতারণা করার যন্ত্র। কারণ শােষিত জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিরা বুর্জোয়া সংসদে নির্বাচিত হতে পারে না। তাই শােষিত জনসাধারণের রাজনৈতিক আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই বুর্জোয়া মেকী গণতন্ত্রের ভিতকে আক্রমণ করে। এরূপ আক্রমণের উন্নততর পর্যায়ে এসবকে রক্ষা করে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের

Page 496

সশস্ত্র বাহিনীসমূহ। এই হচ্ছে সকল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শােষিত শ্ৰেণীসমূহের চিরন্তন অভিজ্ঞতা।

আজকের দুনিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বহারার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এ যুগ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগ। পুঁজিবাদ আজ মুমূর্ষ। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা আজ প্রতিক্রিয়াশীল ও অচল । পুঁজিবাদের ধ্বংস তাই অনিবার্য। পুঁজিবাদী সমাজে শােষিত শ্রেণীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে বুর্জোয়া শ্ৰেণীগুলাের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া এবং ক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়া শ্রেণীগুলােকে ধ্বংস করা ।

রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে শােষিত শ্রেণীসমূহের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম হচেছ শ্রেণী সংগ্রাম। এ সংগ্রামের পুরােভাগে থাকবে সর্বহারার অগ্রণী; অর্থাৎ সর্বহারা ও শােষিত শ্রেণীসমূহের রাজনৈতিক পার্টি। এ পার্টি নির্ধারণ করবে সংগ্রামের রাজনৈতিক লাইন, রণনীতি এবং রণকৌশল ।

অতি উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বহারার রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতা দখলের শেষ সংগ্রাম সশস্ত্র হতে বাধ্য। অনেক অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী এবং আধা-পুঁজিবাদী দেশের শােষিত জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু থেকেই সশস্ত্র হতে বাধ্য। কারণ এসব দেশের বুর্জোয়াশ্রেণী ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর এক অংশ রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আঁতাত করে; সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় নিজেদের অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধি করে, সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশ ও পরামর্শে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে এবং তাদের ওপর চালায় অমানুষিক রাজনৈতিক নিষ্পেষণ; নিদারুণ দমন নীতির মাধ্যমে শােষিত জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং তাদের রাজনৈতিক দলকে নিঃশেষ ও নির্মূল করার চেষ্টা করে।

তাই এসব দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও শ্রেণীসংগ্রাম চালনা করার জন্য চাই সর্বহারার অগ্রণী নেতৃত্বে শােষিত শ্ৰেণীগুলাের সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী। এমনকি সর্বহারার অগ্রণীকেও হতে হবে সর্বতােভাবে একটি সামরিক পাটি (৩, পৃ. ২৫)। লেনিন বলেছেন, বিপ্লবী সেনাবাহিনীর প্রয়ােজন এজন্য যে, কেবল শক্তিবলেই বৃহত্তর ঐতিহাসিক সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং.আধুনিক সংগ্রামে শক্তিবল সংগঠনের অর্থই হচ্ছে সামরিক সংগঠন (৪. পৃ. ৫৬৫)। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে যুদ্ধ অনিবার্য ও অপরিহার্য। যুদ্ধ বিরােধ মীমাংসার জন্য সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ। পুঁজিবাদী সমাজে জনগণের শােষণকারী ও নির্যাতনকারী শ্রেণীসমূহকে নির্মূল করার যুদ্ধই হচ্ছে একমাত্র আইনসঙ্গত যুদ্ধ (4, পৃ. ৫৬৫)।

২. গণবাহিনীর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য

বিপ্লবী গণবাহিনীর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে গণবাহিনী ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাড়াটিয়া বাহিনীর প্রভেদ বােঝা প্রয়ােজন। শােষক শ্রেণী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তােলে। এসব ভাড়াটিয়া বাহিনী। এদের ব্যবহার করা হয় জনগণের আন্দোলনকে রােধ করার জন্য। শােষক শ্রেণীর সঙ্গে এ বাহিনীগুলাের কোনাে আদর্শগত যােগাযােগ নেই।

Page 497

তাই শােষক শ্রেণী একটি বাহিনীর উপর নির্ভর করতে পারে না। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা গঠন করে বিভিন্ন বিকল্প বাহিনী। এরূপ বাহিনীগুলােকে সযত্নে জনগণের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এরা ব্যারাকে থাকে; উৎপাদনের সঙ্গে তারা কোনােভাবেই জড়িত নয়, রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। শােষক শ্রেণী দেশরক্ষা, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভাওতা দিয়ে তাদের ভুলিয়ে রাখে।

গণবাহিনী হচ্ছে শােষিত শ্ৰেণীসমূহের রাজনৈতিক আন্দোলন ও শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার, গণবিপ্লবের বাহক। গণবাহিনী সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শােষিত জনগণের অধিকার রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা এবং রক্ষা করাই এই বাহিনীর একমাত্র কর্তব্য। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিবিড়। বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জনগণের সঙ্গে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। জনগণের রাজনীতির সঙ্গে তারা সুপরিচিত এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা জনগণের রাজনৈতিক চেতনা তীব্র ও তীক্ষ করে, নিজেদের রাজনৈতিক সচেতনতা অব্যাহতভাবে বিকশিত করে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহকে ধ্বংস করাই গণবাহিনীর সামরিক কর্তব্য।

৩. গণবাহিনী ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ

গণবাহিনী গড়ে ওঠে জনগণের সামগ্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনগুলাে একসময় এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যখন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া জনগণের সামনে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর কোনাে পথ থাকে না- সে পর্যায়ে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। জনগণের এই সশস্ত্র সংগ্রামকে সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক রূপ দিলেই গড়ে ওঠে গণবাহিনী। গণবাহিনী বিকাশের জন্য তাই প্রয়ােজন পার্টি পরিচালিত বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন।

রাজনীতিকে সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা অবৈজ্ঞানিক। গণবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম শুধু সামরিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নয়, জনগণের বিপ্লবী রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তার প্রধান উদ্দেশ্য। যদি শুধু আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার জন্যই গণবাহিনী ব্যবহার করা হয় তবে তার বিকাশ ব্যাহত হবে, তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং সামরিক লক্ষ্য অর্জিত হলেও তারা পরিণামে একটি প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে।

অস্ত্র হাতে নিয়ে গণবাহিনীর সদস্য হওয়ার অর্থ রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত হওয়া নয়। পক্ষান্তরে গণবাহিনীর সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে আরাে ব্যাপকভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। কারণ গণবাহিনীর প্রত্যেকটি কার্যকলাপ জনগণ সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে। অনাদিকাল থেকে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা নানাভাবে জনগণকে উৎপীড়ন করেছে। তারা উৎপীড়িত হয়েছে অস্ত্রধারী ডাকাতের হাতে, উৎপীড়িত হয়েছে অস্ত্রধারী পুলিশের হাতে, উৎপীড়িত হয়েছে অস্ত্রধারী বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর হাতে। তারা সেই উৎপীড়নকে ভয় করে। তারা অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের ভয় করে।

তাই গণবাহিনীর প্রত্যেকটি সদস্যকে সম্পূর্ণভাবে সচেতন হতে হবে যেন তাদের কোনাে কার্যকলাপ জনগণের মনে ভয়ের উদ্রেক না করে। প্রত্যেকটি এলাকায় তাই প্রয়ােজন গণবাহিনীর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততার। সেই সম্পৃক্ততা আসবে শক্র এবং

Page 498

জনগণের ভিতরকার দ্বন্দ্বগুলাের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক সচেতনতা ও মতাদর্শগত বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে।

মাও সেতুঙ বলেছেন, সৈন্যরা সামরিক বাহিনীর ভিত্তি, কিন্তু তারা যদি প্রগতিশীল রাজনৈতিক অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ না হয় এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে যদি তাদের মধ্যে এরূপ অনুপ্রেরণার উন্মেষ না হয়, তবে অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে সত্যিকার ঐক্য গড়ে উঠবে না; সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ করার উৎসাহ ও উদ্দীপনা জাগিয়ে তােলা সম্ভব হবে না (৫, পৃ. ১৮৫)। মাও সেতুঙ আরাে বলেছেন, যুদ্ধ পরিচালনা করার শক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস হচ্ছে জনসাধারণ (৯৫, পৃ. ১৮৬)। জনসাধারণের সঙ্গে মতাদর্শগত ঐক্য, জনসাধারণের সর্ববৃহৎ স্বার্থের সঙ্গে একাত্মবােধই হবে বিপ্লবী গণবাহিনীর গঠন, বিকাশ, সামর্থ্য, শক্তি ও বিজয়ের প্রাথমিক শর্ত।

৪. রাজনৈতিক কার্যকলাপের মূল নীতিমালা

মাও সেতুঙ বিপ্লবী গণবাহিনীর রাজনৈতিক কার্যকলাপের তিনটি নীতি (5, পৃ. ৫৩, ১৮৬) নির্ধারণ করেছেন। এসব নীতি সার্বজনীন এবং যে কোনাে দেশের গণবাহিনীর বেলায়ও অবশ্যই প্রযােজ্য।

এক, অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে ঐক্য : এ ঐক্য গড়ে তােলার জন্য আবশ্যিক শর্তাবলি হচ্ছে : সেনাবাহিনীর পরিচালনা থেকে সকল প্রকারের সামন্তবাদী আচরণের উৎখাত, সচেতন শৃঙ্খলা গড়ে তােলা, বাহিনীর সকল সভ্যদের মধ্যে সুখ ও দুঃখ-দুর্দশায় অংশগ্রহণ করার মনােভাব ও অভ্যাসের প্রবর্তন করা।

দুই. গণবাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে ঐক্য : এ ঐক্য গড়ে তােলার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে- গণবাহিনীর সভ্যদের মধ্যে এমন শৃঙ্খলা গড়ে তােলা, যার ফলে গণস্বার্থের সামান্যতম ক্ষতিসাধন করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব; জনগণের মধ্যে মতাদর্শগত প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া; তাদের সংগঠিত ও সশস্ত্র করা; তাদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা; তাদের আর্থিক ভার কমানাে; তাদের উৎপাদন এবং অন্যান্য সামাজিকভাবে প্রয়ােজনীয় কাজে সহায়তা করা; জনগণের শত্রুদের নিপাত করা।

তিন, শত্রু বাহিনীতে ভাঙন ধরানাে এবং যুদ্ধবন্দিদের প্রতি অমায়িক হওয়া :

বুর্জোয়া সেনাবাহিনী ভাড়াটিয়া বাহিনী। কিন্তু সে বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের সন্তান। জনগণের সঙ্গে, জনগণের স্বার্থের সঙ্গে তাদের স্বার্থের বিরােধ নেই। শত্রুবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে তাই মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে তাদের জনসাধারণের পক্ষে; গণবাহিনীর পক্ষে টেনে আনতে হবে। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি অমায়িক ব্যবহার, ধৃত ও আহত শত্রু সৈন্যের যথােপযুক্ত চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রুষা এবং তাদের সঙ্গে অবিরাম মতাদর্শগত আলােচনা তাদের রাজনৈতিক সচেতনতাকে তীক্ষ করে, বিপ্লবী সৈন্যে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে।

বলা বাহুল্য, গণবাহিনীর মতাদর্শগত দীক্ষা ও শিক্ষা, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করা, এসব আন্দোলনের বিভিন্ন গণসংগঠনের কাজে সহায়তা করা, জনসাধারণের সঙ্গে এবং জনসাধারণের স্বার্থে কাজ করা, জনসাধারণের সঙ্গে সর্বতােভাবে একাত্ম হওয়াই হচ্ছে বিপ্লবী গণবাহিনীর জীবনী শক্তি।

Page 499

গণবাহিনীর রাজনৈতিক দীক্ষা, শিক্ষা ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা কেবল তখনই সম্ভব যখন তারা সর্বহারার অগ্রণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, যখন তারা সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় এবং যখন তারা এরূপ রাজনৈতিক দলের প্রভাব, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে চলে। স্মরণ রাখতে হবে, রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হচ্ছে বন্দুকের নল, কিন্তু বন্দুক অবশ্যই থাকবে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বে। পার্টি বন্দুককে পরিচালনা করে, বন্দুককে কোনাে মতে পার্টির ওপর পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না।’ (৬, পৃ. ১৬)।

৫. শৃঙ্খলা ও আচরণের আবশ্যিক নীতিমালা

বিপ্লবী গণবাহিনীর উপরে বর্ণিত চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং সামরিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ তখনই সম্ভব যখন গণবাহিনী কয়েকটি অপরিহার্য নীতির ভিত্তিতে তার শৃঙ্খলা ও আচরণ গড়ে তােলে। মাও সেতুঙ বর্ণিত (৬, পৃ. ১৫৫) নীতিগুলাে প্রায় সার্বজনীন এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর জন্য অবশ্য করণীয়।

শৃঙ্খলা নীতি

১। সকল কাজে আদেশ মেনে চলা;

২। জনসাধারণের একটি সূচও আত্মসাৎ না করা;

৩। ধৃত অথবা সংগৃহীত সবকিছু জমা দেওয়া।

আচরণের নীতি

১। নম্রভাবে কথা বলা;

২। খরিদে যথােপযুক্ত মূল্য প্রদান করা;

৩। কর্জ ফেরত দেওয়া;

৪। নিজে কোনাে ক্ষতি সাধন করলে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া;

৫। জনসাধারণকে আঘাত না করা;

৬। ফসল নষ্ট না করা;

৭। নারীর প্রতি অনাচার না করা; এবং

৮। বন্দিদের প্রতি অগ্ন্যবহার না করা।

৬. বাংলাদেশ ও বিপ্লবী যুদ্ধ ।

‘বিপ্লবের কেন্দ্রীয় কর্তব্য ও সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে সশস্ত্র শক্তির দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল; যুদ্ধের দ্বারা সমস্যার সমাধান’- মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এই বিপ্লবী নীতি সর্বত্রই প্রযােজ্য। কিন্তু নীতি এক হলেও সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি ভিন্ন পরিবেশে একে ভিন্নভাবেই প্রয়ােগ করে’ (৬, পৃ. ১)। মাও সেতুঙ বর্ণিত এ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতি বাংলাদেশে আজ শুধু প্রযােজ্যই নয়, কার্যকরীও বটে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন অথর্ব, প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদ, সংশােধনবাদ ও আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে আঁতাতকারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্তভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম চলে আসছে বিগত তিন বছর ধরে। অথচ এ বাস্তব সত্য থেকে সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা অধিকাংশ মার্কসবাদী সংগঠনই গ্রহণ করতে পারেনি। তার কারণও সুস্পষ্ট।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মার্কসবাদী দল এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিপ্লবের স্তর সম্বন্ধে সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারেনি। কারণ তারা কেতাবী মার্কসবাদী। বাস্তবের

Page 500

সঙ্গে তাদের সম্পর্কও কেতাবী। ফলে তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের সংগঠন গণভিত্তিক নয়। তাই জনসাধারণ তাদের শক্তির উৎস নয়। কিছু সংখ্যক মার্কসবাদী সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন চালনা করার চেষ্টা করেছেন অথবা করছেন। তাদের প্রয়াসও বিক্ষিপ্ত। যেহেতু তাদের রাজনৈতিক লাইন ভ্রান্ত সেহেতু তাদের রণনীতি ও রণকৌশলও ভ্রান্ত। তাদের প্রয়াস জনগণকে সক্রিয়ভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি, জনতাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে পারেনি, সংগঠিত করতে পারেনি। স্থানে স্থানে তারা জনগণের নেতিবাচক সমর্থন পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের প্রয়াস সন্ত্রাসবাদী দুঃসাহসিকতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এরূপ পেটি বুর্জোয়া অতি বিপ্লবী কার্যকলাপ সব সময় বিপ্লবের পরিপন্থী হয়ে ওঠে, প্রতিবিপ্লবীদের শক্তিশালী করার সহায়ক হয়; সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের দালালদের চক্রান্তকে কার্যকরী করতে সাহায্য করে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাকে এ দেশের উঠতি পুঁজিপতি ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধীরা সাম্রাজ্যবাদ, সংশােধনবাদ ও আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। বহিঃশক্তির সহায়তায় তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করে এবং নিজেদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে তারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অসম্পূর্ণ রেখে দেয়। সাম্রাজ্যবাদী যুগে সকল দেশের বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়ারা তাই করতে বাধ্য। এ যুগে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ করতে পারে কেবল সর্বহারা এবং অন্যান্য শােষিত শ্রেণীসমূহ তাদের অগ্রণীর নেতৃত্বে।

বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসম্পূর্ণ রেখেই ক্ষান্ত হয়নি, বুর্জোয়া ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের ক্ষমতা পাকাপােক্ত করে সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় এ দেশে পুঁজিবাদের বিকাশকে নিশ্চিত করার সুচতুর নীতি-কৌশল ও কর্মকৌশলও তারা গ্রহণ করেছে। তারা সমাজতন্ত্রের নামে বৃহৎ শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত করেছে; কষি ও শিল্পে ছােট ও মধ্যম ব্যক্তিমালিকানাকে সুদঢ় করার চেষ্টা করেছে; রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতায় নব্য পুঁজিপতি শ্ৰেণী তৈরি করে পুঁজিবাদের অপ্রতিহত ও ত্বরান্বিত বিকাশের পূর্বশর্তসমূহ তৈরি করার চেষ্টা করছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কায়দায় সংবিধান প্রণয়ন করে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছে। বাস্তবে তারা এসব করেছে ফ্যাসিস্টসুলভ রাজনৈতিক কার্যকলাপের। মাধ্যমে, সরকারি এবং দলীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সহায়তায়।

এসব ধোঁকাবাজী প্রবর্তন করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে আশ্রয় নিতে হয়েছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক দুর্নীতিপরায়ণতার ছত্রছায়ায়। তার প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাসীন দলের জন্য আত্মঘাতি হতে বাধ্য ছিল এবং হয়েছেও তা-ই। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রায় ভেঙে পড়েছে। উৎপাদনে এসেছে নৈরাজ্য ও দুর্নীতি, উৎপাদন কমেছে; মূদ্রাস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ৫-৬ গুণ; খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষে লক্ষ জনতা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, বাস্তুহারা হয়েছে, দেশ দেউলিয়া হয়েছে; সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশকে বিক্রয় করা হচ্ছে। সামাজিক নৈরাজ্য অবর্ণনীয়, দেশে আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই- নেই জানমালের নিরাপত্তা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চলছে অশ্রুতপূর্ব অনিশ্চয়তা ও নৈরাজ্য। আওয়ামী লীগ জনতা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। ক্ষমতাসীন গােষ্ঠী এরূপ পরিস্থিতির মােকাবেলা করছে নিদারুণ দমননীতির

Page 501

মাধ্যমে। এ দমন নীতি চালানাে হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি সশস্ত্রবাহিনীর সহায়তায়। ভ্রান্ত রাজনীতি ও সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য অধিকাংশ বিরােধী দল অবতীর্ণ হয়েছে। সুবিধাবাদী ভূমিকায়। ফলে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট গােষ্ঠি তার সুযােগ ওঠাচ্ছে রাজনৈতিক নিষ্পেষণকে আরাে তীব্র ও ব্যাপক করে।

প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল ও সরকার যখন দুর্বল ও দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়ে তখন তারা স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য তারা দমন নীতিকে আরও তীব্র করে তােলে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করে। বিগত তিনবছরে অপদার্থ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে খুন করেছে, হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে জেলে পুরেছে; বিদেশি শক্তির সহায়তায় ঘূণ্য রক্ষীবাহিনী ও গুপ্তঘাতক বাহিনী গঠন করে জনসাধারণের ওপর চালিয়েছে অমানুষিক অত্যাচার ও নিষ্পেষণ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসাধারণ এ দমননীতির মােকাবেলা করে আসছে।

আজ সামগ্রিক পরিস্থিতি এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। পতনােন্মুখ আওয়ামী লীগ সরকার রাজননৈতিক ক্ষমতা বহাল রাখার জন্য মরিয়া হয়ে চালাচ্ছে শেষ প্রচেষ্টা। জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে তারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র খতম করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় একদলীয় একনায়কত্ব কায়েম করার ষড়যন্ত্র করছে। অস্ত্রবলে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও প্রতিরােধকে ভেঙে চুরমার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

এসব করা হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে। মুজিব। সরকার বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রকে প্রতিহত করে ধনতন্ত্র স্থাপনে বিশ্বাসী। এ সরকারের বড় বড় আমলারা সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় এ ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে বদ্ধপরিকর। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে তারা। স্বৈরাচারী আইয়ুবতন্ত্র’-এর কায়দায় বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযােগিতা সুনিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। এ প্রচেষ্টায় পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবীরাও তাদের সহায়তা করতে পারে।

বিপ্লবীদের আজ অবশ্যই এরূপ পরিস্থিতির মােকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনসাধারণ আজ মৌলিক পরিবর্তন চায়- চায় কার্যকরী পরিবর্তন। জনসাধারণের এ মনােভাবকে বিপ্লবের সপক্ষে টেনে আনতে হবে। তার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তনকে প্রতিরােধ করতে হবে। যেখানে তথাকথিত গণতান্ত্রিক

আন্দোলনের অধিকার নেই, যেখানে জনগণের প্রত্যেকটি প্রতিবাদকে নিঃশব্দ করে দেওয়া হয় অস্ত্রের ঝংকারে, সেখানে অস্ত্রই হবে ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র রূপ। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই আমাদের সংগ্রামের প্রধান রূপ হচ্ছে যুদ্ধ আর সংগঠনের প্রধান রূপ হচ্ছে সৈন্যবাহিনী। গণসংগঠন ও গণসংগ্রামের মতাে অন্যান্য সমস্ত কিছুও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত অপরিহার্য; কোনাে অবস্থাতেই এদের উপেক্ষা করা উচিত নয়; কিন্তু এগুলাে সবই যুদ্ধের জন্য। (৬, পৃ. ৫)।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীর কর্তব্য হচ্ছে বিপ্লবী গণবাহিনীতে যােগ দেওয়া, এ বাহিনীকে গঠন করা, সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করা। বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির কর্তব্য হচ্ছে নিজেকে

Page 502

সশস্ত্র করা; সশস্ত্র সংগ্রামের সম্মুখীন হওয়া; জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে সপক্ষে টেনে এনে সশস্ত্র যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করানাে; বিপ্লবী গণবাহিনীকে সংগঠিত ও পরিচালনা করা। বিপ্লবী গণবাহিনীর কর্তব্য হচ্ছে নিজেকে সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির অংশ হিসেবে গড়ে তােলা, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যােগ দেওয়া, জনসাধারণকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সংগঠিত করা, নিজেদের মতাদর্শ, সংগঠন, চরিত্র, রণকৌশল ও সামরিক শক্তির জোরে বিপ্লবী যুদ্ধে জয়ী হওয়া, বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উত্তরণের এ সংগ্রামে বিপ্লবী সরকারের প্রধানভিত্তি রূপে কাজ করা।

দুনিয়ার মজদুর এক হও

বিপ্লব অনিবার্য

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হােক।

টীকা

১. ভ. ই. লেনিন, সর্বহারা বিপ্লবের সামরিক কর্মসূচি, কালেটেড ওয়ার্কস, খণ্ড ২৩, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।

২. মাও সেতুঙ, চীনের বিপ্লবী যুদ্ধে রণনীতির সমস্যা, নির্বাচিত রচনাবলি, খণ্ড ১, পিকিং ১৯৬৫।

৩. ভ. ই. লেনিন, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান, কালেটেড ওয়ার্কস, খণ্ড ২৬, মস্কো, ১৯৬৪।

৪. ভ. ই. লেনিন, বিপ্লবী সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী সরকার’, কালেটেড ওয়ার্কস, খণ্ড ৮, মস্কো ১৯৬৫।

৫, মাও সেতুঙ, ‘দীর্ঘায়িত যুদ্ধ সম্পর্কে, নির্বাচিত রচনাবলি, খণ্ড ২, পিকিং ১৯৬৫।

৬. মাও সেতুঙ, ‘যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা’, পিকিং, ১৯৭০।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!