You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম ঘােষণাপত্র

৩১ অক্টোবর, ১৯৭২

প্রচণ্ড বিপ্লবীশক্তির অধিকারী বাঙালি জাতি আজ এক মহা অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। গত ২৫ বছরের গণআন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম বাঙালি জাতির জীবনে যে বিপ্লবী চেতনার উনুেষ ঘটিয়েছে, যে বিপ্লবী চেতনা আবহমানকাল ধরে বিরাজমান সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবে প্রভাবান্বিত ঔপনিবেশিক শােষণের ভিত্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে সমগ্র জাতির সে বিপ্লবী চেতনা আজ সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতাে স্তব্ধপ্রায় । কিন্তু কেন?

বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান শাসকশ্রেণীর সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্র, শাসনব্যবস্থার চরম অযােগ্যতার ফলে সারা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরমভাবে অনিশ্চিত। শুধু তাই নয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আজকের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা দ্রুত জটিলতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে এতটুকু পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টা করা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে সুবিধাভােগী গােষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অর্থনীতি শােষক সম্প্রদায়ের করায়ত্ত।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে দুর্বল নেতৃত্ব, স্বাধীনতা লাভের পর সশস্ত্র সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণে ব্যর্থতা ও বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে সারা দেশের অর্থনীতিতে যে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। গ্রামে গ্রামে মানুষের অন্নবস্ত্রের অভাব, নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির আবর্তে অরাজক শাসনব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের মনে যে সন্দেহ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে, তা সমগ্র জাতিকেই দুষ্ট রাহুর মতাে গ্রাস করতে উদ্যত।

অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা নির্দয়ভাবে অস্বীকৃত। সারা দেশে যুবশক্তি এমনভাবে নির্যাতিত, মনে হয় ক্ষমতাসীন দল গােটা যুবসমাজকেই তাদের চক্ষুশূল বলে ধরে নিয়েছে। তাছাড়া মেহনতী শ্রমিক সমাজ উঠতি পুঁজিপতি ও শিল্প প্রশাসকগােষ্ঠীর শােষণের যাতাকলে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে আর ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী প্রথার নিগড়ে কৃষক সমাজের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। একদিকে নির্যাতন ও শােষণের এই প্রক্রিয়ায় সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পালিত এ দেশের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক মহল, বিত্তশালী সম্প্রদায়, আমলা, পুঁজিপতি ও শিল্প প্রশাসকগােষ্ঠী সমবায়ে গঠিত সমাজের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ, যাদের সংখ্যা মাত্র ৮ ভাগ। অন্যদিকে শােষিত শ্রমিক ও কৃষক, বাস্তুহারা, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং ছাত্র সমবায়ে গঠিত দেশের গােটা জনসমষ্টির এক বৃহত্তর অংশ-যাদের সংখ্যা শতকরা ৯২ ভাগ।

Page 475

এখানেই আমাদের দেশের শােষক ও শােষিতের দ্বন্দ্ব এবং এটাই শ্রেণীদ্বন্দ্ব । যতদিন এ দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি না ঘটবে, ততদিন শােষণ অব্যাহত থাকবে এবং শােষণকে অব্যাহত রাখার প্রয়ােজনেই শােষক শ্রেণী শাসকের বেশে নির্যাতন, গুপ্তহত্যা, মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম ইত্যাদি তথাকথিত ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাবে। তাই যে পর্যন্ত এ শাসক শ্রেণী উত্থাত না হবে, যে পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিক বুদ্ধিজীবীদের সঠিক নেতত্ব অধিষ্ঠিত না হবে ততদিন সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ-শান্তির কল্পনা বিলাস মাত্র।

বিপ্লবী চিন্তার অধিকারী বাঙালি জাতির জীবনে কৃষক শ্রমিক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই কেবল একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সংঘটন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারাই সে ঈপ্সিত শ্রেণীহীন শােষণহীন সমাজ ও কৃষক শ্রমিক-রাজ কায়েম করা যেতে পারে।

শ্রেণীদ্বন্দ্ব অবসানের জন্য শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্রতর করে সামাজিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য পরিস্থিতি ও পরিবেশগত কারণে সহায়ক শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক গণসংগঠনের যে ঐতিহাসিক প্রয়ােজন, তা উপলব্ধি করেই এবং বাংলাদেশের সর্বত্র লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি লাভ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (JATIYA SAMAJITANTRIK DAL) বাংলাদেশের শােষিত-বঞ্চিত কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের নিজস্ব সংগঠন হিসেবে জনসম্মুখে প্রকাশ করছে এবং এই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল শােষকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক জনযুদ্ধ ঘােষণা করছে। ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নিম্নলিখিত আদর্শ বাস্তবায়িত করবে :

(১) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রেণীহীন শােষণহীন সমাজ ও কৃষক শ্রমিক-রাজ কায়েম।

(২) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সফল সামাজিক বিপ্লব সংঘটনে সর্বপ্রকার সহায়তা দান।

(৩) সমাজতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা ।

(৪) বাঙালি জাতীয়তাবােধের বিকাশের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লবের প্রয়ােজনে বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেওয়া ও বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তা অক্ষুন্ন রাখা এবং উপজাতীয়দের অধিকার সংরক্ষণ করা।

(৫) সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত ভেঙে ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি মনােভাবের ভিত্তিতে মেহনতী জনতার ঐক্য গড়ে তােলা।

(৬) যুদ্ধজোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদাহানিকর সকল প্রকার গােপন ও প্রকাশ্য চুক্তি বাতিল। মানব সভ্যতার দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া ও চীনসহ যে কোন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা এবং এসব দেশের যে কোন প্রকার অসৎ উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে দেশবাসীর জঙ্গী ঐক্য সৃষ্টি করা।

Page 476

(৭) বিশ্বের সর্বপ্রকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলন সমর্থন ও সক্রিয় সহযােগিতা দান, বিশ্বের মেহনতী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা।

(৮) সামাজিক বিপ্লবের প্রয়ােজনে জনমত গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে সমভাবে সকল প্রকার পন্থা অবলম্বন করা।

তাই, জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়ােজনে এবং বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়ানক ও পুতুল সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে এবং আগামী দিনের সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা শ্রেণীহীন, শােষণহীন সমাজ ও কৃষক শ্রমিকরাজ কায়েমের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রবল জনমত সৃষ্টির নিমিত্তে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পতাকাতলে জমায়েত হবার জন্য আমার দেশের ছাত্র, যুবশক্তি, মুক্তিযােদ্ধা, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বাস্তুহারা, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

আসুন, আমরা আমাদের মিলিত শক্তি নিয়ে শাসক ও শােষকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত হই। আমরা জানি, দীর্ঘদিনের শক্ত বুনিয়াদের ওপর এই শােষকগােষ্ঠী দাঁড়িয়ে। কারণ তাদের অর্থ আছে, অস্ত্র আছে, আছে সুসংগঠিত জঙ্গী কর্মী বাহিনী। কিন্তু জনতা আজ তাদের বিরুদ্ধে। প্রয়ােজন জনতার বিপ্লবী শক্তিকে সংগঠিত করে সময়ােচিত আঘাত হানা। যে আঘাতে ক্ষমতার দম্ভে স্ফীত শােষক শাসকের কায়েমী স্বার্থের ভিত্তিমূল ধসে পড়বে। আসবে জনতার বাঞ্ছিত মুক্তি।

সাথীরা, প্রতিমুহূর্তে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে আমাদের লড়াই শােষকের বিরুদ্ধে, শ্রেণীশত্রুর বিরুদ্ধে। এ লড়াই বাঁচা-মরার লড়াই। এ লড়াইয়ে জিততেই হবে।

জয় বাংলা, জয় বাংলার মেহনতী মানুষ।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!