‘জাতীয় মিলিশিয়া’ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা
বাংলাদেশ সরকার, দেশরক্ষা বিভাগ
গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের সমগ্র জনসাধারণ ও সরকারের পক্ষ হইতে মুক্তিবাহিনীর (নিয়মিত ও গণবাহিনী) সকল সদস্যকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও মােবারকবাদ জ্ঞাপন করিতেছেন। সগ্রামী শক্তিগুলির সদস্যবর্গ সম্মিলিত ও এককভাবে যে দেশপ্রেম, সাহস ও তেজস্বিতা প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা অতুলনীয়। আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মত্যাগ এবং মুক্তিযুদ্ধে যাহারা লড়াই করিয়াছেন তাহাদের রক্ত বৃথা যায় নাই।
স্বাধীনতার সংগ্রাম জয়যুক্ত হইয়াছে। কিন্তু আমরা এক্ষণে তদপেক্ষা গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আমাদিগকে এখন দেশের পুনর্গঠনের জন্য সংগ্রাম করিতে হইবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে অর্থনীতিকে দ্রুততার সহিত পুনর্গঠন করিলে এবং স্বাভাবিকতা ফিরাইয়া আনিলেই কেবল চলিবে না, জাতির ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া অবিলম্বে নবযুগের সূত্রপাত করিতে হইবে। আমাদিগকে এখনই গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করিতে হইবে। ইহা একটি দুরূহ কার্য। যে দেশপ্রেম, আন্তরিকতা, উৎসর্গ (উৎসাহ) ও কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ আমরা সকলে, বিশেষ করিয়া মুক্তিযােদ্ধারা, মুক্তিযুদ্ধে প্রদর্শন করিয়াছি, তাহার মাধ্যমই কেবল ইহা সম্পন্ন করা যাইতে পারে ।
কাজেই গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নতুন সমাজ গঠনকল্পে মুক্তিবাহিনীর সকল সদস্যকে তাহাদের শক্তি ও প্রয়াসকে সঠিক খাতে প্রয়ােগের আবেদন জানাইতেছেন। এই সকল উদ্দেশ্য সাধনকল্পে সরকার অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করিবেন : দেশের স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা সংরক্ষণের জন্য আমাদের নিয়মিত সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রয়ােজন আছে। আমাদের যে সমস্ত অফিসার এবং জওয়ানরা মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীরূপে অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি। কিন্তু তাহাদের সংখ্যা পর্যাপ্ত নহে। নিয়মিত ব্যাটালিয়নের জন্য আমাদের আরও অফিসার ও জওয়ান প্রয়ােজন রহিয়াছে। গণবাহিনীর মধ্যেই জনশক্তির এক উত্তম অংশ নিহিত রহিয়াছে। তাহারা ইতােমধ্যেই যুদ্ধে পারদর্শিতা অর্জন করিয়াছেন। তথাপি তাঁহাদের আনুষ্ঠানিক ট্রেনিং-এর প্রয়ােজন আছে। গণবাহিনী হইতে অফিসার ও জওয়ান নিয়ােগের ব্যবস্থা গৃহীত হইতেছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর নতুন অফিসার ক্যাডার এবং অন্যান্যদের ট্রেনিং দিবার জন্য অচিরেই জাতীয় প্রতিরক্ষা।।একাডেমী স্থাপিত হইবে। কমিশন্ড ও নন-কমিশন্ড অফিসার মনােনয়নের উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে সিলেকশন বাের্ডসমূহ গঠন করা হইবে। মুক্তিসংগ্রামের বীর সেনানীরা বাংলাদেশের নবগঠিত স্থলবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীতে নেতৃত্ব প্রদান করিবেন বলিয়া সরকার আন্তরিকতার সহিত আশা পােষণ করেন।
নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার আশু প্রয়ােজন। শান্তি ও শৃঙ্খলা ছাড়া আমরা একটা নতুন সমাজ পুনর্গঠন করিতে পারি না। আমরা গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করিবার জন্যই সংগ্রাম করিয়াছি। গণতন্ত্রের মূলনীতি বজায় রাখার জন্য শহীদেরা আত্মদান করিয়াছেন এবং আমরা যদি নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করিতে না পারি তবে গণতন্ত্র নিরর্থক। আমাদের আচরণ এখন অবশ্যই সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক হইতে হইবে এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখিতে হইবে। আইনের শাসন মানিয়া চলে এইরূপ সকল নাগরিককে রক্ষা করিতে হইবে। দোষীকে শাস্তি দিতে হইবে; তবে উহা উপযুক্ত আইন-সম্মতভাবেই করিতে হইবে। আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাহারা যুদ্ধ করিয়াছিল এবং আমাদের লােকদের উপর নৃশংসতা চালাইয়াছিল তাহাদেরও শাস্তি পাইতে হইবে। তাহাদের বিচার হইবে। সুতরাং আমাদের প্রয়ােজন একটি বিচার পদ্ধতি, একটি প্রশাসন- যন্ত্র ও জনসাধারণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার্থে একটি পুলিশ বাহিনী।
গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। উহা জনগণেরই পুলিশ বাহিনী হইবে এবং পূর্বের মতাে জনগণের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাইবার হাতিয়ার হইবে না। এইরূপ গণ-পুলিশ বাহিনী আমাদের বীর গণ-বাহিনীর লােক দ্বারাই উপযুক্তভাবে সংগঠন করিতে হইবে। সুতরাং সরকার পুলিশ অফিসার ও পুলিশ গণ-বাহিনীর সদস্যগণ হইতে নির্বাচন করিতে মনস্থ করিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যে অবিলম্বে নির্বাচন বাের্ড গঠন করা হইবে।
আমাদের প্রিয় দেশকে অতি দ্রুত পুনর্গঠনের জন্য এবং জাতীয় উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত সকল প্রাপ্য সম্পদ (মাল-মসলা ও জনশক্তি) কাজে লাগাইবার জন্য আমাদের প্রয়ােজনীয় দক্ষতা অবশ্যই বাড়াইতে হইবে। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নক্সা তৈরির জন্য.আমাদের বহুসংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, ডাক্তার, কারিগর এবং সর্বপ্রকার দক্ষ জনশক্তি প্রয়ােজন। বর্বর শত্রু আমাদের সমাজের.রত্নস্বরূপ বুদ্ধিজীবীদিগকে- যাহারা আমাদের উন্নতির সােপানে পৌছাইতে পারিতেন-ধ্বংস করিতে চাহিয়াছিল। আমরা বহু অমূল্য জীবন হারাইয়াছি। আমাদের শুধু এই ক্ষতিই পূরণ করিতে হইবে না বরং উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে আমাদের নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করিতে হইবে। যুদ্ধের ধ্বংসাবলি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের মুছিয়া ফেলিতে হইবে যাহাতে আমরা নতুন সমাজ গঠনের কাজ অবিলম্বে আরম্ভ করিতে পারি। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করেন যে, মুক্তিবাহিনী প্রতিভাসমূহের এক অপূর্ব ভাণ্ডার- যাহারা দেশ পুনর্গঠন, উহার অর্থনৈতিক কাঠামাে পুনরুদ্ধার এবং যথাশীঘ্র সম্ভব উন্নতি লাভের জন্য এক নতুন নেতৃত্ব দান করিতে সক্ষম। সরকার আশা করেন যে, মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ, বিশেষ করিয়া যাঁহারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য লেখাপড়াnছাড়িয়াছিলেন, তাঁহাদের জাতীয় উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করা উচিত। এই সমস্ত বিষয় স্মরণে রাখিয়া সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, যেসমস্ত মুক্তিযােদ্ধা তাহাদের শিক্ষা ও ট্রেনিং সমাপ্ত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, পলিটেকনিক শিক্ষালয় ও অন্যান্য কারিগরি কেন্দ্রে ভর্তি হইতে আগ্রহী সরকার তাঁহাদিগকে সকল প্রকার সুযােগ দিবেন। সরকার দেশের সকল স্থানে নতুন নতুন কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও চিন্তা করিতেছেন। যাহারা শিক্ষা সমাপ্ত করিয়াছেন তাহাদিগকে অচিরেই উপযুক্ত পদে নিয়ােগ করা হইবে। উপরােক্ত নীতিগুলি কার্যকরী করার জন্য সমস্ত মুক্তিযােদ্ধাকে, তাহারা তালিকাভুক্ত হইয়া থাকুন বা না-ই থাকুন, একটি জাতীয় মিলিশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়ােজন।
জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা নিমরূপ হইবে :
( ১) অনতিবিলম্বে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হইবে এবং তালিকাভুক্ত হউক বা না হউক, সমস্ত মুক্তিযােদ্ধাকে ইহার আওতায় আনা হইবে।
(২) প্রত্যেক মহকুমায় সেই এলাকার গেরিলাবাহিনীর জন্য শিবির প্রতিষ্ঠা করা হইবে। শিবিরগুলির পরিচালনা ব্যবস্থা এমনিভাবে করা হইবে যেন এসব যুবককে পুনর্গঠন কাজের উপযােগী করিয়া প্রয়ােজনীয়।ট্রেনিং দেওয়া সম্ভবপর হয়।
(৩) মহকুমা-ভিত্তিক শিবিরগুলি সেই এলাকার সমস্ত গেরিলাবাহিনীর মিলন-কেন্দ্র হইবে।
(৪) উর্ধ্বপক্ষে এগারােজন সদস্য লইয়া জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় বাের্ড গঠন করা হইবে। বাের্ডের সদস্যগণকে সরকার মনােনয়ন দান করিবেন।
(৫) প্রত্যেক মহকুমা-শহরে জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য মহকুমা বাের্ড থাকিবে। মহকুমা বাের্ডের সদস্য সংখ্যা অনধিক এগারােজন হইবেন।
(৬) প্রতিটি শিবিরে অস্ত্রশস্ত্র কার্যোপযােগী অবস্থায় রাখা, গুদামজাত করা ও হিসাবপত্র রাখার জন্য একটি করিয়া অস্ত্রাগার থাকিবে।
(৭) ট্রেনিং-এর কার্যসূচি এমনভাবে প্রস্তুত করা হইবে যেন এসব যুবককে নিম্নেবর্ণিত ভূমিকা পালনের উপযােগী করিয়া ভােলা যায় : কি যেন তাঁহারা দেশের দ্বিতীয় রক্ষাব্যুহ হইতে পারেন; [খ] যখনই নির্দিষ্টভাবে প্রয়ােজন হইবে তখনই যেন তাহারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও পুনর্বহালে উপযােগী হইতে পারেন; [গ] দেশের পুনর্গঠন কার্যে সরাসরি সহায়তা হয় এমন বিভিন্ন কাজের উপযােগী হন।
(৮) অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অপুষ্টিকর খাদ্য এবং অপর্যাপ্ত বেতন ও ভাতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গেরিলাদের এক বিরাট অংশ কষ্ট ভােগ করিয়াছেন। সেজন্যই, তাঁহাদের খাদ্য, বাসস্থান ও ভাতার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হইবে।
………………………………….
বিজিপি-১০৭৩এ-৭১/৭২-৫ হাজার।
উৎসঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দেশরক্ষা বিভাগ কর্তৃক প্রচারিত ও সরকারি মুদ্রাণালয় মুদ্রিত। সংগ্রহঃ কামাল হােসেন, তাজউদ্দীন আহমদ : বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর, পূর্বোক্ত।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ