বিশেষ গােপন বাহিনী*
রফিকুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার
চমৎকার সফলতার সঙ্গে ‘অপারেশন জ্যাকপট’৬৬৮ সম্পন্ন করতে পেরে আমাদের মনে এই আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় হল যে, সঠিক নেতৃত্ব এবং দিক-নির্দেশনা দিতে পারলে মুক্তিযােদ্ধারা দুঃসাধ্য অভিযানেও সফলতা লাভ করবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ওরা সবাই ছিল আন্তরিক। তাছাড়া প্রয়ােজনীয় বুদ্ধিমত্তা থাকায় যে কোন সময়ে যে কোন স্থানে জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান চালিয়ে সফলতা অর্জন করাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। ওদের মানসিক উৎকর্ষতা নিঃসন্দেহে তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত পাকিস্তানি সৈন্যদের চেয়ে ছিল অনেক উন্নত। জাতি হিসাবে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, এই যুদ্ধে আমরা এমন একটা শিক্ষিত গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলতে পেরেছিলাম- যা যুদ্ধের প্রয়ােজনে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ ছিল।
এই পর্যায়ে আমরা আবার নতুনভাবে রণকৌশলকে বিশ্লেষণ করলাম। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষবস্তুগুলাের ওপর আঘাত করার জন্য আমরা নতুন নতুন বিশেষ গেরিলা দলকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেই। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে এ ধরনের প্রতিটি গেরিলা গ্রুপকে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত ব্রিফিং দেওয়া শুরু হয়। প্রতিটি দলের অভিযান পরিকল্পনা সেক্টর হেডকোয়ার্টারে করা হলেও অভিযানের জায়গায় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়ােজনীয় রদবদলের দায়িত্ব গ্রুপ-কমান্ডারদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় । তবে এই গেরিলা দলগুলাের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যােগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হই। গ্রুপ লিডার হিসেবে ট্রেনিং পাওয়ার মতাে অনেক তরুণ এবং যুবক আমাদের যুব-শিবিরগুলােতে থাকলেও তারা আমাদের সামরিক কমান্ডের আওতায় ছিল না। আসলে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু’মাসের মধ্যেই আমরা এমন সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম যা আমাদের জন্য অস্বস্তি এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জুন মাস থেকেই দেখা গেল, বিভিন্ন যুব-শিবিরে তারা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। যুবশিবিরগুলােতে নির্বাচিত কিছু তরুণ গােপন নির্দেশ পেয়ে যুব-শিবিরের বাইরে কোনাে একটা স্থানে গিয়ে মিলিত হতাে। সেখানে থেকে একটি ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার
……………………………………………………………
৬৬৮) বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় মুক্তিবাহিনীর নৌ-সেক্টর পরিচালিত গেরিলা অপারেশন। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত এই অপারেশনে চট্টগ্রাম, মংলাসহ দেশের বিভিন্ন নৌ বন্দরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন নৌযানে হামলা চালানাে হয়। এই হামলায় নৌ-গেরিলাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় কমান্ডার এম এন সামানত।
Page 431
সদস্যবৃন্দ তাদের নিয়ে যেত অন্যত্র। এই নির্বাচিত যুবকদের আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া এবং গােপনে অন্য কোনাে ধরনের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা এতই সুপরিকল্পিত এবং বিস্তৃত ছিল যে, অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ বিমানে করে কঠোর নিরাপত্তা এবং গােপনীয়তার মাধ্যমে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হতাে। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানাের ব্যাপারেও ঐ সংস্থার সদস্যরা একই ধরনের অতি-গােপনীয়তা অবলম্বন করত। পরবর্তী সময়ে ওরা যেসব সেক্টরে অবস্থান নেবে সেসব সেক্টর কমান্ডারদের পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানতে দেওয়া হয়নি।
বিষয়টা যখন আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল, তখন আমরা এই ধরনের গােপন কার্যাবলি বন্ধ করার অনেক চেষ্টা করলাম। আমাদের বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট- যেহেতু এই যােদ্ধারা আমাদের সেক্টর এলাকাতেই বিভিন্ন তৎপরতায় লিপ্ত হবে, তাদের কর্মকাণ্ড আমাদের মূল পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বিত না হলে আমরা যেসব অভিযানের পরিকল্পনা করছিলাম, সেসব নস্যাৎ হয়ে যাবে। কিছুকিছু এলাকায় আমরা সামরিক অভিযান না চালাবারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ সেই এলাকাসমূহে ছিল আমাদের অসংখ্য ‘সেইফ
বেইজ বা গােপন আস্তানা। আমাদের শতশত গেরিলা আসা-যাওয়ার পথে সেখানে আশ্রয় নিত। কাজেই এসব এলাকায় কোনাে তৎপরতা না চালালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেদিকে মনােযােগ দেবে না এবং আমাদের ‘বেইজগুলাে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু ঐ বিশেষ গােপন-বাহিনীর সদস্যরা এসব এলাকা এবং আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানত না। ফলে তারা ঐসব এলাকায় তাদের ইচ্ছেমতাে তৎপরতা চালাত। অনেকক্ষেত্রে এগুলাে ছিল নিজ দলের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, কখনাে বা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে। পরিণামে, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে সবাই সবকিছু জেনে ফেলত এবং সমস্ত এলাকা জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের তল্লাশি অভিযান শুরু হয়ে যেত। তখন সেসব বেইজ ব্যবহার করার আর কোনাে উপায়ই থাকত না এবং ঐ ‘বেইজ’সমূহ থেকে আমাদের সব যােদ্ধাই অন্যত্র সরে পড়তে বাধ্য হতাে।
আমাদের মানবসম্পদ থেকে বাছাই করা কয়েকশ বা কয়েক হাজার সদস্য দিয়ে এ ধরনের একটা বিশেষ গােপন বাহিনী গঠন করার ফলে আমরা পড়ে গেলাম মহাসমস্যায়। গেরিলা গ্রুপগুলাের নেতৃত্ব দেওয়ার মতাে প্রয়ােজনীয় উপযুক্ত যােদ্ধা আর পাওয়া যাচ্ছিল না। যােগ্য নেতৃত্বদানের গুণাবলি থাকায় কি কোনাে সরকার সব অফিসারদের দিয়েই একটা ডিভিশন তৈরি করবে, এবং বাকি পুরাে সেনাবাহিনী চালানাের ভার ছেড়ে দেবে সুবেদার মেজর বা হাবিলদার মেজরদের ওপর? আমাদের গেরিলাবাহিনী গঠনে এ ধরনের ব্যাপারে ঘটেছিল। সেক্টর কমান্ডাররা সবাই এতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন।।আর, এ ধরনের একটা বাহিনী এত লুকোচুরির মাধ্যমে গােপনে সৃষ্টি করার ফলে স্বভাবত আমরা সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমরা ভাবতে বাধ্য হলাম, কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনাে একটা ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই ধরনের একটা বিশেষ গােপনবাহিনী যেন গড়া হয় সেজন্য কর্তৃপক্ষকে যুক্তি দিয়ে বােঝাতে চেষ্টা করেও আমরা সফল হতে পারিনি। আবেগহীন, ঠান্ডা গলায় আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, এ ব্যাপারে নাক গলাবে না । সেখানে নাক গলাবার অধিকার ছিল ভারত সরকারের কেবিনেট ডিভিশনের রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস্ উইং (র)-এর। পরে জানতে পেরেছিলাম, আমাদের না জানিয়ে
Page 432
গােপনে একটা ভিন্ন বাহিনী সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিল ‘র’ । তারাই ছিল এর মূল উদ্যোক্তা এবং এ ব্যাপারে তারা ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সমর্থন লাভ করেছিল।
‘র’-এর পরিকল্পনায় নির্বাচিত তরুণ ও যুবকরা বিশেষ ধরনের ট্রেনিং, উন্নত ও আধুনিক অস্ত্র এবং যােগাযােগের অত্যাধুনিক এমন সব সরঞ্জামের সরবরাহ পেত যা আমাদের অনেকে কখনাে দেখেনি। তাদের দেওয়া হতাে বিস্তর সুযােগ সুবিধা। ‘র’-এর পরিকল্পনা বাস্তবে ছিল এক ব্যর্থতার ইতিহাস এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক সর্বনাশী সিদ্ধান্ত। এ ধরনের গােপন পরিকল্পনার ফলে যুদ্ধের সময়েই মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে মারাত্মক ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার এত বছর পরেও এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের রাজনৈতিক জীবনে এখনও বিদ্যমান। আগামী দিনগুলােতের এই পরিকল্পনা-উদ্ভূত সমস্যা এবং ভুল বােঝাবুঝির সহজ নিরসন হবে কি না এ ব্যাপারে কেউই নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারবে না।
এই বিশেষ বাহিনীর সবাই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সম্পূর্ণ আন্তরিক এবং উৎসর্গীকৃত প্রাণ, এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তাদের দেশপ্রেম নিঃসন্দেহে প্রশ্নাতীত। বস্তুত, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে এরাই ছিল মূলধারা। দেশপ্রেমের আদর্শে তারা ছিল উজ্জীবিত। বাংলাদেশের স্বার্থ এবং স্বাধীনতা তাদের কাছে ছিল সবার ঊর্ধ্বে। আমরা আপত্তি তুলেছিলাম অন্য কারণে সেটা ছিল, এ ধরনের গােপন পরিকল্পনার মাধ্যমে অন্যেরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ আমাদের তরুণদের অপব্যবহার করতে পারবে। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের বিশাল মানবসম্পদের পুরােটাই সমন্বিতভাবে, একীভূত নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হােক, তার বাইরে অন্য কোনাে উদ্দেশ্যে নয়- যুদ্ধের সময়ে, এমনকি যুদ্ধের পরেও নয়।
আমরা জানতে পেরেছিলাম, কিছু সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হয়েছিল। তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি এ বিশেষ বাহিনী গঠনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত হয়েছিল, যদিও এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ সরকারের কোনাে অনুমতি তার ছিল না। শেখ ফজলুল হক মণি বাংলাদেশ সরকারকে এই বাহিনী এবং তাদের গােপন তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই অবহিত করতেন না। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের মতাে আমিও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাজউদ্দীন আহমদ এ বিষয়ে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করে আমাকে বাংলাদেশ বাহিনীর সিএনসি কর্নেল (অব.) এম. এ. জি. ওসমানীর সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। আমি দেখলাম যে, কর্ণেল ওসমানীও বিষয়টি নিয়ে অসন্তুষ্ট। আমাদের সরকার বা ভারত সরকারের কাছ থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন।
প্রথমদিকে এ বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছিল বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স)। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কিছুদিন পরেই এদের ‘মুজিব বাহিনী’ নামে অবহিত করতে শুরু করে। ভারতে মিজো এবং নাগা বিদ্রোহীদের নাশকতামূলক তৎপরতা প্রতিরােধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানকে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা ভারতের গােপন সামরিক ঘাঁটিতে বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ লাভ করে। এরপর ওদের দেওয়া হয় । উন্নতমানের রেডিও যন্ত্রপাতি ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং তারপর গােপন কর্মতৎপরতা
Page 433
চালানাের ব্রিফিং দিয়ে তাদের পাঠানাে হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব ‘মিশনের বিস্তারিত তথ্য আমরা জানতে পারতাম না।
বাংলাদেশ সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ) সদস্যবৃন্দ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডারগণ কেউই এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানতেন না । কী জন্য এই ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতরে এসে তাদের কী ধরনের কাজ করতে বলা হয়েছে, এবং তারা যেসব অস্ত্র ও যােগাযােগ-যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে আসছে ঐ সমস্ত বিষয়ে কোনাে কিছুই আমাদের জানানাে হতাে না। শুধু শেখ ফজলুল হক মণি এবং ভারত সরকারের অল্প কিছু লােক এই বাহিনী সম্পর্কে জানতেন- তাও পুরােটা নয়। আমরা শুধু এতটুকু জানতে পেরেছিলাম, এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের এমনভাবে ‘মােটিভেট করা হয়েছে যে, ওদের আনুগত্য ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। যেহেতু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি, তাই এই ধরনের আনুগত্যের অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে কোনাে এক পর্যায়ে তারা শেখ ফজলুল হক মণি’র কাছ থেকেই সমস্ত নির্দেশ নেবে এবং তার আদেশ মেনে চলবে। এই সব তরুণ ও যুবকরা সবাই ছিল অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ এবং দেশপ্রেমিক। কিন্তু আমরা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম যে, এরা সবাই রাজনীতির দাবা-খেলায়’ গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই যে পুরাে ব্যাপারটায় সন্তুষ্ট ছিল, তা-ও নয়। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কর্মরত ভারতীয় অন্যান্য সংস্থা ও বাহিনীসমূহের সবাই বিএলএফ বাহিনীর গঠন এবং এদের কার্যক্রমে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু আমরা সবাই ছিলাম অত্যন্ত অসহায়।
এই বাহিনীর সদস্যরা কখন, কোথায় কী ধরনের কাজ করবে এটা আমরা কেউই জানতাম না। তবে আমরা অনুভব করছিলাম, তাদের কার্যকলাপ এবং ভুমিকা সম্পর্কে সবার মনে যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে তার নিরসন অত্যন্ত প্রয়ােজন। সার্বিক যুদ্ধ প্রচেষ্টায় জড়িত সবাই জানতে চাইছিল, বিএলএফ কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে এবং সেটা তারা কীভাবে বাস্তবায়িত করবে। আমরা আরও বলতে চেয়েছিলাম, আমাদের জাতির চরম দুঃসময়ে ভারত পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাদের সাহায্য ও সহযােগিতা কোনােদিন ভুলে যাওয়ার মতাে নয়। ভারত এবং ভারতের জনগণ আমাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কঠিন ত্যাগ স্বীকার কররেছে সেজন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। এই বাহিনী সম্পর্কে সৃষ্ট ভুল বােঝাবুঝি নিরসনের মাধ্যমে আমাদের দু’দেশের মধ্যে সে সম্পর্ক আরাে দৃঢ় ও শক্তিশালী করা যায়।
কিন্তু কার্যত ‘র’-এর এই পরিকল্পনার মাধ্যমে অদৃশ্য এবং কাল্পনিক কোনাে এক শক্তির বিরুদ্ধে নতুন একটা ফ্রন্ট খােলা হলাে। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সেই চিরাচরিত প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল আবার। কিন্তু পরিকল্পনা প্রণেতারা কি তা বুঝতে পারছিলেন না যে, রাজনীতির এই সব জটিলতা নিয়ে ঐ সময় জনগণের কোনাে উৎসাহ ছিল না। যুদ্ধের ঐ দিনগুলােতে আমাদের জনগণ পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে শুধু তাই নিয়ে চিন্তিত ছিল। জনগণকে সেই নির্যাতনের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করে স্বাধীনতা তুরান্বিত করা যায়- সেই লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়ােগ করাই ছিল আমাদের জন্য
Page 434
সেই মুহূর্তের প্রধান কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক বিবেচনাসমূহ তখন হঠাৎ করে ততধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল অনেকের কাছে এবং সে কারণেই আমাদের বিশাল জনশক্তির একটা বড় অংশ এই বিশেষ বাহিনী গড়ে তােলার জন্য অপব্যবহৃত হয়। অথচ সে সময় এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে কোনাে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। কারণ, ওরা ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল প্রথম থেকে।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ভারতে এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের জন্য উচ্চ পর্যায়ের এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। বিএলএফ বাহিনী সৃষ্টির ব্যাপারে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের অনুমােদন ছিল না বিধায় এ নিয়ে বেশ উত্তেজিত আলােচনা হয়। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি মি. ডি. পি. ধর তার স্বভাবসুলভ কূটনৈতিক চালে বিতর্কিত ইস্যুতে বিস্তারিত সব আলােচনাই এড়িয়ে যান। তিনি বরং যুক্তি দিয়ে এটা বুঝাতে চাইলেন, এই বিশেষ বাহিনীর ব্যাপারে এ ধরনের ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ওরা আপনাদেরই সন্তান এবং একই মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। আমরা বিশেষ কতগুলাে অভিযানের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি মাত্র’, মি. ধর বললেন। এভাবে বিশেষ এই বাহিনী সম্পর্কে কোনাে ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই ঐ কনফারেন্স’ শেষ হয়ে যায়। তবে ‘র’-এর পরিকল্পনার অধীনে বিশেষ বাহিনী গড়ার প্রক্রিয়া পুরাপুরি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশের সরকার কোনােমতে সম্মানজনক একটা আপস ফর্মুলায় রাজি হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, বিশেষ বাহিনীর এসব। সদস্যরা যখনই কোনাে একটা সেক্টরে অপারেশনের জন্য যাবে তখন নিজেদের কর্মতৎপরতা ও গতিবিধি সংক্রান্ত সব ব্যাপার ওরা সেক্টর-কমান্ডারদের অবহিত করবে। নিঃসন্দেহে মি. ডি. পি, ধরের জন্য এটা এক ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য। কারণ, এ ধরনের সম্মতি আদায় করতে পেরে বাস্তবে এই বিশেষ গােপন বাহিনীর ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিই আদায় করে নিলেন। অবশ্য এটা ছাড়া সে সময়কার বিপাকে-পড়া বাংলাদেশ সরকার আর বেশি কিছু করতেও পারত না।
(সংক্ষেপিত)
————————
* বিস্তারিত দেখুন, রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা, ঢাকা, ১৯৯৬। এখানে মূল লেখাকে সংক্ষিপ্ত করে প্রকাশ করা হয়েছে।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ