You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাসদ ও গণবাহিনী যেভাবে প্রতিপক্ষের হাতকে শক্তিশালী করে চলেছিল

যারা গণতান্ত্রিক আদর্শ ও ব্যবস্থায় বিশ্বাসী কেবল সাময়িকভাবেই তাদের কণ্ঠরােধ করা যায়। অত্যাচার নিপীড়ন যদি বন্ধ না হয়, গণতন্ত্র যদি পুনরুজ্জীবিত করা না হয়, যদি কর্তৃপক্ষ গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলতে না দেন তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত তেমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বেছে নিতে পারে। আর যদি তেমনটিই ঘটে তাহলে সেটা হবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।

– শেখ মুজিবুর রহমানের বিবৃতি, দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ৪ এপ্রিল ১৯৬৪। মুজিব উপরােক্ত বিবৃতিটি দিয়েছিলেন শেখ। মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখকে ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কারের প্রতিবাদে।

শেখ মুজিবুর রহমানের উপরােক্ত বিবৃতিটি বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের এক করুণ স্ববিরােধিতাকে সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে । ‘গণতন্ত্র’-এর অনুপস্থিতিতে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কী দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হয় সেটাই মুজিব বলছিলেন ১৯৬৪ সালে। ঠিক ছয় বছর পর একবার এবং দশ বছর

……………………………………………………………

৬৩১) বর্তমান লেখকের সঙ্গে ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকায় আনােয়ারুল ইসলাম বাবু’র সাক্ষাৎকার। জনাব ইসলাম এখনও জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত।

Page 399

পর আরেকবার তাই ঘটেছিল বাংলাদেশে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ঘটেছিল তারই হাত ধরে, তারই কারণে এবং শেখ মণিই ছিল তখনাে তাঁর পাশে মূলত যাকে উপলক্ষ করে তিনি উপরােক্ত বৃিবতিটি দিয়েছিলেন।

ইতঃপূর্বে আমরা দেখিয়েছি, কীভাবে জাসদ তিয়াত্তর-চুয়াত্তর-পঁচাত্তরে দ্রুতগতিতে গণবাহিনী গঠন করে দেশব্যাপী সশস্ত্র প্রতিরােধ’ কার্যক্রম শুরু করে এবং এও বলা হয়েছে, জাসদের এইরূপ ভূমিকার প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের অন্যতম প্রতিপক্ষ শেখ মণি’র হাতকে শক্তি যােগাচ্ছিল। বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদ অপসারিত হওয়ার পর শেখ মণি এককভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রভাবিত করছিলেন।৬৩২ এ পর্যায়ে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরা

……………………………………………………………….

৬৩২) শেখ মণি এসময় আওয়ামী লীগের বাইরে সিপিবি ও ন্যাপ (মাে) থেকেও আরেক ধরনের রাজনৈতিক সমর্থন পাচ্ছিলেন। তাজউদ্দীন সক্রিয় থাকাবস্থায় সিপিবি আওয়ামী লীগে বিশেষভাবে তার ওপর নির্ভর করত। কিন্তু তাজউদ্দীন দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হওয়া মাত্র কমিউনিস্ট পার্টি তাদের মনােযােগ ফেলে মণি’র ওপর। একদিকে দৈনিক বাংলার বাণীতে মণির লেখনিতে সমাজতান্ত্রিক পক্ষপাত অন্যদিকে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মণির বােঝাপড়া (যে বিষয়ে ইতঃপূর্বে আলােকপাত করা হয়েছে) সিপিবি ও ন্যাপকে বিভ্রান্ত করে থাকবে। মণি যে ছাত্রলীগে ও মুজিব বাহিনীতে তার সমর্থকদের আদর্শিকভাবে জাসদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন সিপিবি ও ন্যাপ তা না বুঝেই তার হাতকে শক্তিশালী করার নীতি নেয়। দেশের বিদ্যমান বামপন্থী শক্তিসমূহ থেকে সিরাজুল আলম খানদের বিচ্ছিন্ন রাখার কাজে সিপিবিকে ভালােভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মণি। ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপ (মাে) মিলে ‘দেশপ্রেমিক’ ত্রিদলীয় ‘গণ-ঐক্যজোট গড়ে ওঠায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর মণির প্রভাব আরও বেড়ে যায় এবং জাসদের সামনেও প্রতিপক্ষের আয়তন সম্প্রসারিত হয়। ১৪ অক্টোবর ত্রিদলীয় এই ঐক্যজোটের কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য ১৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও গড়ে উঠেছিল। তিয়াত্তরের জানুয়ারিতে ঢাকায় এবং মার্চে গােপালগঞ্জে শাসকদের হাতে নিজ কর্মী ও সংগঠকদের নির্মমভাবে হত্যার পরও সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের শর্তহীন লাগাতার সমর্থন মুজিবকে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিল। এ সম্পর্কে সেই সময়কার রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার বিবরণ দেখুন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, অনন্যা, ২০০০, ঢাকা।

সিপিবি ও ন্যাপ ফজলুল হক মণিকে মন্ত্রী করার জন্য, আরও বিশেষভাবে বললে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত করার জন্য, মস্কোর সঙ্গে মিলে মুজিবকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম তার গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। যা থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্থানীয় সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের তৎকালীন ভূমিকা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। দেখুন, বাংলাদেশ : জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা, ইউপিএল, ২০০৭, ঢাকা, পৃ. ১০৩।

১৯৭৩ সালের মে মাসে মাওলানা ভাসানীর অনশনকে কেন্দ্র করে পল্টনে আয়ােজিত সর্বদলীয় সমাবেশ পণ্ড করার জন্য যে সশস্ত্র হামলা হয় তাতেও সিপিবি ও ন্যাপ ক্যাডাররা সরকারি দলের আক্রমণকারীদের সঙ্গে ছিলেন। দেখুন, হায়দার আকবর খান রনাে,।পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৯-২০। উল্লেখ্য, তিয়াত্তরের সেপ্টেম্বরে ত্রিদলীয় এই জোট গড়ে ওঠার মাত্র ছয় মাস আগে নির্বাচন সম্পর্কিত সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ন্যাপ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও মােজাফফর আহমদ তিয়াত্তরের ৭ মার্চের নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ আখ্যায়িত করেছিলেন । দৈনিক বাংলা, ৯ মার্চ ১৯৭৩।

বাংলাদেশে সিপিবি’র রাজনীতির বিশিষ্ট গবেষক ড. মােস্তাফিজুর রহমান দলটির এসময়কার (‘৭৪-৭৫) রাজনীতি নিয়ে আলােকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন : দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর (ডিসেম্বর ১৯৭৩) মােহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে শেখ মণির বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বিষয়ে শেখ মণি সিপিবিতে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। ফলে এই দলে মনি সিংহের অবস্থান গৌণ হয়ে যায়। সিপিবি’র আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটানাে হয়। পার্টির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।’ দেখুন, বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতিধারা : ১৯৭২-৭৫, ইতিহাস: সমকালীন ঐতিহাসিকদের কলমে…০৬, সম্পাদক : অধ্যাপক সামিনা সুলতানা, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৭, ঢাকা, পৃ. ৫৪।

Page 400

প্রাসঙ্গিক হবে । এই উদাহরণ থেকে স্পর্শকাতর ঐ সময়ে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মােড় পরিবর্তনে মুজিব বাহিনী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ভূমিকাও পাঠক লক্ষ্য করবেন- যা আমাদের ইতিহাসবিদের খুব বেশি মনােযােগ পায়নি এতদিন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অন্যতম বড় রাজনৈতিক ঘটনা হলাে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর কর্মসূচি ঘােষণা। যার মূল বিষয় ছিল দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন। একদলীয় ঐ ব্যবস্থার মৌলিক রূপটি ইতােমধ্যে পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের এই সংশােধনী বিল আকারে সংসদে পেশ করা হয় এবং প্রায় বিতর্কহীন পরিবেশে তা অনুমােদিতও হয়ে যায়। বিলটির পক্ষে ২৯২ ভােট পড়ে এবং বিপক্ষে কেউ ভােট দেননি। ঐ সংসদে তখন জীবিত সদস্য ছিলেন ২৯৯ জন। তার মধ্যে ২৯২ জন ছিলেন সরকার দলীয় । এর বাইরে স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের ছিলেন সাত জন সদস্য।৬৩৩ এরা সবাই মিলে বিরােধী দল নয়- “বিরােধী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যার নেতৃত্ব দিতেন আতাউর রহমান খান। যেহেতু অধিবেশনের শুরুতে ঐদিন স্পিকার আবদুল মালেক উকিল বলে দিয়েছিলেন, ‘চতুর্থ সংশােধনী বিলটির ওপর কোনাে আলােচনা হবে না- তাই বিরােধী গ্রুপের নেতা আতাউর রহমান খান কিছু বলে উঠে চলে যান। জাসদের তিন সদস্য আবদুল্লাহ সরকার৬৩৪, মাইনুদ্দিন

……………………………………………………………….

৬৩৩) এরা ছিলেন : আতাউর রহমান খান (ঢাকা), ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম সালাউদ্দিন (ফরিদপুর), মাইনুদ্দিন আহমেদ মানিক (রাজশাহী), আবদুস সাত্তার (টাঙ্গাইল), আবদুল্লাহ সরকার (চাঁদপুর), মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (রাঙ্গামটি ও খাগড়াছড়ি) ও ছাই রােয়াজা (বান্দরবান)।

৬৩৪) আবদুল্লাহ সরকার সম্প্রতি মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী তাহেরা বেগম জলি বর্তমান লেখককে জানিয়েছেন, জনাব সরকার বহুবার পারিবারিক পরিবেশে আলাপচারিতায় বলেছেন- চতুর্থ সংশােধনী সংসদে উত্থাপনের আগে মুজিব একদিন সংসদ থেকে গাড়িতে করে তাকে নিজের কার্যালয়ে নিয়ে যান এবং সংবিধানের আসন্ন চতুর্থ সংশােধনী বিষয়ে সংসদে নীরব থাকার জন্য বলেন, যা ছিল কার্যত এক ধরনের হুকুমের মতাে। উল্লেখ্য, আবদুল্লাহ সরকার ১৯৭৩-এর নির্বাচনে চাদপুর (হাইমচর) থেকে প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে ১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি জাসদে যােগ দেন এবং দলটির সহ-সভাপতি হন। নির্বাচনের পূর্বে ছিলেন চাঁদপুরে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক। বাকশালে যােগদান না করায় ১৯৭৫ সালের ২৮ এপ্রিল তার সংসদ সদস্যপদ স্থগিত করা হয় । এরপর গ্রেফতার ও অনানুষ্ঠানিক মৃত্যুপরােয়ানা এড়াতে বৃহত্তর কুমিল্লায় আত্মগােপনে চলে যান।

Page 401

মানিক, আবদুল ছাত্তার বিলের ওপর আলােচনার দাবি জানান। স্পিকার সেটা অগ্রাহ্য করেন। প্রতিবাদে ঐ তিনজন এবং বাকি স্বতন্ত্র সদস্যরাও ওয়াকআউট করেন। এরপর স্পিকার বিলটি ভােটে দিলেন এবং বিরােধিতাহীনভাবে তা পাস হয়ে গেল । এভাবেই বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে সমাজতন্ত্র’-এ প্রবেশ করে।

বিলটি গৃহীত হওয়ার পরপর শেখ মুজিবুর রহমান দেড় ঘণ্টাব্যাপী ভাষণে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের পটভূমি ব্যাখ্যা করেন এবং প্রধানত তাতে জাসদ কর্তৃক সৃষ্ট ‘নৈরাজ্যকর তৎপরতাকে গণতন্ত্র বিনাশের জন্য দায়ী করেন। বিশেষত তিনি কুষ্টিয়ায় ঈদুল আযহার জামাতে গণবাহিনী কর্তৃক সংসদ সদস্য গােলাম কিবরিয়া হত্যার বিষয় উল্লেখ করেন। গণবাহিনীর এইরূপ অভিযানকে শেখ মণি কীভাবে ব্যবহার করেছিলেন সেটা তুলে ধরতে এবার আমরা একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরবাে। শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা, শেখ হাসিনার স্বামী, আণবিক শক্তি কমিশনের কর্মকর্তা প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ইতিহাসের ঐ সময়টিতে প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে প্রধানমন্ত্রীর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে যেতেন। নিয়মিত রাতের খাবারও খেতেন তিনি সেখানে। ১৯৭৫ সালে তেমনি এক সময়ের বিবরণ দিচ্ছেন তিনি আত্মজৈবনিক গ্রন্থে৬৩৫ এভাবে :

“জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আমার নিশান গাড়িটি বিক্রির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়ােজন ছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী তখন খন্দকার মােশতাক আহমদ।…আগামসি লেনে তাঁর বাসায় গেলাম।…খন্দকার মােশতাক আহমদ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তােমার শশুর সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করছেন, সে সম্পর্কে তুমি কিছু জান কি না? এটা মারাত্মক ভুল হবে। বিস্তারিত জানতে চাইলে বলেন, মন্ত্রী হিসেবে সব কিছু প্রকাশ করা সঠিক হবে না। তুমি নিজে খোঁজ-খবর নাও। কিছুদিন পর আবার তার বাসায় গেলে তিনি আবারও সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়টি উত্থাপন করেন। আমি বললাম, কাকা, শেখ

…………………………………………………………..

৬৩৫) এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, এপ্রিল ২০০০, ঢাকা, পৃ. ২৩৪-৩৫।

Page 402

মণি’র সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন না কেন। তিনি বললেন, লাভ হবে না। সে তােমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।

… ২৪ জানুয়ারি বিকেল পাঁচটায় অফিস ছেড়ে গাড়ি চালিয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাই। গেটের কাছে পৌছে দেখি দরজা বন্ধ। লক্ষ্য করলাম, ঐদিন থেকে বাসায় পুলিশের অতিরিক্ত হিসেবে কিছু সেনা সদস্যও ডিউটিতে নিয়ােজিত।… পকেট গেটের কাছে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে গেটের নিকটস্থ আম গাছটির নিকটে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, বাবা ওয়াজেদ, আগামীকাল তােমার শশুর সংবিধানে যে পরিবর্তন ঘটাতে চাচ্ছেন তা করা হলে সেটা শুধু একটা মারাত্মক ভুলই হবে না, দেশে-বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তিরও অপূরণীয় ক্ষতি হবে। তেতলার বৈঠকখানায় গিয়ে তাকে একটু বােঝাও।… মােশতাক সাহেবকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিলাে। সম্ভবত ঝগড়াঝাটি হয়েছে।…সােজা তিনতলায় যাই। বঙ্গবন্ধু বৈঠকখানায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করছেন। পায়চারি করতে লাগলাম কখন ওনারা যাবেন তার অপেক্ষায়। কিন্তু তা না ঘটায় স্থির করলাম রাতের খাবারের পর দেখা করবাে। রাত এগারােটায় হাসিনা, আমি ও বঙ্গবন্ধু খেতে বসি। সে সময় বঙ্গবন্ধু কোন কথা না বলে শয়নকক্ষে চলে যান। ঠিক ঐ মুহূর্তে শেখ মণি সেখানে ঢুকেই ছিটকানি লাগিয়ে দেন। আমার শাশুড়িকে বাইরে রেখে মণিকে ইতঃপূর্বে কখানাে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে দেখিনি। রাত পৌনে একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। ততক্ষণেও তাদের আলাপ শেষ হলাে না।…পর দিন সংসদে পেশ হলাে চতুর্থ সংশােধনী বিল। …

ড. ওয়াজেদ মিয়ার দীর্ঘ ব্যক্তিগত বিবরণকে উপরে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলাে। আগ্রহী পাঠক মূল বইয়ে উপরােক্ত উদ্ধৃতিটির বিস্তারিত ভাষ্য দেখলে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারবেন কীভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তখন মুজিব বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তি কর্তৃক প্রভাবিত হচ্ছিলেন। পাঠক এও আবিষ্কার করবেন, মিসেস মুজিব তার স্বামীর একদলীয় ব্যবস্থাকে কীভাবে অপছন্দ করতেন৬৩৬ এবং ড. ওয়াজেদ মিয়া যে ছিটকানির কাহিনী বলেছেন তা ঐ অপছন্দের কারণেই। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারির ছিটকানির এই ব্যবহারকে যদি প্রতীকীভাবে গ্রহণ। করা যায় তাহলে উপলব্ধি করা সহজ হয়, মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব কীভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল তার স্ত্রীর কাছ থেকে নয়- গৌরবজনক রাজনৈতিক ৬৩৬ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৯-৪০।

Page 403

অতীত থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল।৬৩৭ ড. ওয়াজেদ মিয়া এ সম্পর্কে তাঁর (পূর্বোক্ত) আত্মজৈবনিক গ্রন্থে অন্যত্র দেখিয়েছেন৬৩৮ কীভাবে সরকার প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে যােগদানে রাজি করাতে লাগাতার প্রভাবিত করছিলেন শেখ মণি । মিসেস মুজিব বরাবর স্বামীর পাকিস্তান সফরের বিরােধী ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ লাহাের সফরকে (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) বরাবরই তৎকালীন সরকারের বড় ধরনের নীতিগত মােড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হয়। মুজিবের লাহাের সফরকে এখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে দেখেছিল নতুন করে সক্রিয় হওয়ার সবুজ সংকেত হিসেবে। এভাবেই তারা একাত্তরের ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। রক্ষীবাহিনীর আক্রমণের মুখে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে কমিউনিস্টদের দিশেহারে অবস্থার পাশাপাশি ইতিহাসের এ সময়টিতে নেজামে ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের প্রতি রাষ্ট্রীয় এই পরােক্ষ আনুকূল্য বিশেষ তাৎপর্যময়।

এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তান সফর বিষয়ে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর-এর পর্যবেক্ষণটি তুলে ধরা যেতে পারে । ১৯৭৪ সালে মার্চ মাসের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেটা ছাপা হয় ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়। তাতে তিনি বলেন, ভুট্টো ও তিনি পুরানাে বন্ধু এবং ভুট্টোকে তার সাহায্য করা দরকার। এ সময় লাহােরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলনে তাঁর প্রতি পাকিস্তান সরকার, বিশেষ করে ভুট্টোর আতিথেয়তার কথা বলতে গিয়ে মুজিব আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, জনগণের উচিত পাকিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়া। সেই সময় স্টেটসম্যান-এ প্রকাশিত কুলদীপ নায়ারের এই বহুল আলােচিত

…………………………………………………………….

৬৩৭) কিছু দিন পরই, ১৬ জুন সরকার চারটি ব্যতীত বাকি সব জাতীয় পত্রিকা বিলুপ্ত ঘােষণা করে। ফলে দেশে ভিন্নমতের বাহন শেষ হয়ে যায়। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ’-এ সরকার এতটাই আপসহীন ছিল যে, বাকশালের শরিক দল সিপিবি’র ‘একতা’ নামের কাগজটিও বন্ধ করে দেয়া হয়। এসবই মুজিবের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে তােলে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি কাগজের (ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস) মাধ্যমে জনসমাজের কোনাে প্রকৃত চিত্র পাচ্ছিলেন না তিনি। প্রশাসনিক কাজেও এই অবস্থা সংকট তৈরি করে। সাংবাদিকদের কাজের সুযােগ সীমিত হয়ে যাওয়ায় প্রশাসনের পক্ষে দেশের দূরবর্তী অঞ্চলের প্রয়ােজন সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার সুযােগ বন্ধ হয়ে যায়। উপরােক্ত চারটি কাগজে এমন চার ব্যক্তিকে সম্পাদক হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয় (যথাক্রমে নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, ওবায়দুল হক, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও ফজলুল হক মণি) যারা নিজ নিজ ভূমিকার মাধ্যমে মুজিবের উপরােক্ত জনবিচ্ছিন্নতাকে গতিশীল করেছিলেন মাত্র।

৬৩৮) ড. ওয়াজেদ মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৯।

Page 404

সাক্ষাৎকার প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোন প্রতিবাদ জানায়নি । এর আগে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহােরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলনে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমার পুরানাে বন্ধু’ বলে আলিঙ্গন করেন এবং তার গালে চুমু খান।৬৩৯ মুজিব এসময় বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য করার পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ ইসলামি ফাউন্ডেশনকেও পুনর্জীবিত করেন। এসব নীতিগত পরিবর্তন ক্ষমতাসীন শাসক মহলে মেরুকরণও ঘটাচ্ছিল দ্রুতলয়ে। বিশেষ করে লাহাের যাত্রার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী মুজিবকে তাজউদ্দীনের তরফ থেকে শক্ত বিরােধিতা মােকাবেলা করতে হয়। সেই সময়কার মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদারের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে সাংবাদিক আমির হােসেন ঐ বিরােধিতার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এভাবে :

লাহাের যাত্রার প্রাক্কালে মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে ইসলামী সম্মেলনে যােগদানের প্রশ্নে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তাজউদ্দীন এই সম্মেলনে যাওয়ার তীব্র বিরােধিতা করেন। তার যুক্তি ছিল বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাছাড়া এই সম্মেলনে যােগদানকারীরা প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী ছিল। এই সম্মেলনে যােগ দিলে বন্ধুরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ ভারত অসন্তুষ্ট হবে।…বঙ্গবন্ধু এসব যুক্তি নাকচ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষে মুসলিম দেশগুলাের কাছ থেকে দূরে থাকা উচিত হবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করেছে তারা আজ যদি বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেয় তাহলে আমাদের মুখ ফিরিয়ে রাখা উচিত নয়। আর ভারত অসন্তুষ্ট হবে এই ভয়ে যদি সম্মেলনে যেতে না পারি তাহলে আমাদের স্বাধীনতার মূল্য কি? অন্যের ইচছা-অনিচ্ছায় নয়, আমাদের চলতে হবে আমাদের ভালাে-মন্দ বিবেচনা করে।৬৪০

ক্যাবিনেটের উপরােক্ত বিতর্ক ছিল একটি সিদ্ধান্তসূচক ঘটনা। মুজিবের পাকিস্তান সফরের মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ভারতে আটকে থাকা সর্বশেষ ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনাপত্তির কথা ভারত-পাকিস্তান উভয়কে জানানাে হয়।৬৪১ উপরন্তু মাত্র চার মাসের মধ্যে (২৬ জুন ১৯৭৪) খােদ

…………………………………………………………….

৬৩৯) বদরুদ্দীন উমর, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত, ২০১০, ঢাকা, পৃ. ৩-৪।

৬৪০) আমির হােসেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮।

৬৪১) এসব যুদ্ধবন্দিদের বিচারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি খােদ সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতও নিরুৎসাহিত ছিল। তার প্রমাণ মেলে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জবানিতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভাষ্যে। আনিসুজ্জামান যুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে প্ল্যানিং সেলে কাজ করতেন। আলােচ্য বিষয়ে তার দেয়া বিবরণ দেখুন, আমার একাত্তর, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭, ঢাকা, পৃ. ১৮৩।

Page 405

ভুট্টো ঢাকা আসেন রাষ্ট্রীয় সফরে। ভুট্টো ঢাকায় আসার পর দেখা গেল তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছাস। এই উচ্ছ্বাসের মাঝেই এক দল মানুষ ভারতীয় হাইকমিশনের গাড়ি থেকে পতাকা ছিনিয়ে নেয়। জনতাকে রুখতে লাঠিচার্জ করতে হয়েছিল সেদিন।

অভাবনীয় এই ঘটনাকে ভারত কীভাবে দেখছিল সেটা এ পর্যায়ে বিশেষ তাৎপর্যময় এবং মনােযােগ যােগ্য। ভুট্টোর সফরের তারিখ নির্ধারিত হওয়া মাত্রই ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার সুবিমল দত্ত তার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। তখনও তার চুক্তিভিত্তিক নিয়ােগের এক বছর বাকি ছিল। তিনি ছিলেন ঢাকায় প্রথম ভারতীয় হাইকমিশনার। পদত্যাগের কারণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘(বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে) ভুট্টোকে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বাগতম জানানাে এবং তার সঙ্গে করমর্দন করতে আমি প্রস্তুত নই।৬৪২ ভুট্টোর সফরের বিষয়টি পুরােপুরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও ভারতের নীতিনির্ধারক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের এসব ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ কতটা তােলপাড় সৃষ্টি করছিল তার চূড়ান্ত এক প্রমাণ রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্তের পদত্যাগকালীন উপরােক্ত বক্তব্য। এসময় ঢাকায় ভারতের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হন মিশনের ডেপুটি কমিশনার জে এন দীক্ষিত। ভুট্টোর আবির্ভাব-উত্তর ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন :

বিমানবন্দর থেকে যখন ফিরছিলাম, তখন রাজনৈতিক ও আবেগগত দিক থেকে আমি খুব বিক্ষুব্ধ ও বিশৃঙ্খল। (ভুট্টোকে নিয়ে) মােটর শােভাযাত্রা যখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অভিমুখে। শহরের দিকে আসছিল রাস্তার দু ধারে সারি সারি জনতা তখন উৎসাহের আতিশর্যে রীতিমত উম্মাদগ্রস্ত। তারা ভুট্টো ও পাকিস্তানের

……………………………………………………………….

৬৪২) J. N. Dixit, Liberation and Beyond : Indo-Bangladesh relation, UPL, 1999, Dhaka, p. 189, উল্লেখ্য, সুবিমল দত্ত (১৯০৩-১৯৯২) ছিলেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কানুনগাে পাড়ার সন্তান। জীবনের প্রথম ১৭ বছর তিনি পূর্ববাংলাতেই কাটান। বাংলাদেশে প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার নিয়ােগ (১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি) ভারতের তরফ থেকে অত্যন্ত পরিণত কূটনীতির বহিঃপ্রকাশ ছিল। এই নিয়ােগের অন্তত ১৫ বছর পূর্বে জনাব দত্ত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। খোদ ইন্দিরা গান্ধী তাকে ‘আংকেল’ বলতেন। ভারত সেসময় বাংলাদেশকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছিল বয়ােজ্যেষ্ঠ একজন কূটনীতিবিদের এই নিয়ােগ থেকে তা বােঝা যায়। ফলে তাঁর আকস্মিক পদত্যাগ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কঠিন এক বাস্তবতার উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। অন্যদিকে ভারতীয় কূটনীতিবিদদের জন্য এ ঘটনার পরবর্তী অধ্যায় ছিল আরও তিক্ত। সুবিমল দত্ত- এর পরে যিনি বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন সেই সমর সেন ১৯৭৬-এর জুনে খােদ দূতাবাসেই শারীরিকভাবে আক্রান্ত হন। এতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আরও টানাপােড়েনে পড়ে। সমর সেন সম্পর্কে আরও দেখুন : তথ্যসূত্র ৪২৮ ও ৫৪৮।

Page 406

পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছিলাে। এর মাঝে নতুনত্ব এবং বিস্ময়কর হিসেবে যা দেখলাম অনেক শ্লোগানই ছিল আওয়ামী লীগ ও মুজিবের সমালােচনায় মুখর।…পতাকা লাগানাে গাড়িতে আসছিলাম আমি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের সামনে গাড়ির সারি ধীরলয়ে এগােনের মুহূর্তে সেটা ভাঙ্গচুর হলাে। উত্তেজিত জনতা ছিন্নভিন্ন করলাে ভারতীয় পতাকাও। ভারত সরকার এবং স্থানীয় ভারতীয় হাইকমিশনের বিরুদ্ধে গালাগালপূর্ণ শ্লোগান শুনতে হলাে। বলতে দ্বিধা নেই- অফিসে এসে যখন পৌছালাম, ক্ষোভে আমার চোখে তখন জল নেমেছে। টেবিলে বসেই ভুট্টোর আগমন অধ্যায় এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে দিল্লিতে টেলিগ্রাম লিখতে বসলাম।৬৪৩

জে এন দীক্ষিতের টেলিগ্রামে কী ছিল সেটা অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয় । স্বাধীনতার পরপর ভুট্টোকে ঘিরে ঢাকায় এ রকম অভিজ্ঞতা ছিল বিস্ময়কর। এসময় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তার দায়ে আটক প্রায় ৪০ হাজার ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়ারও নির্দেশ দেন মুজিব, অথচ ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে এ বিষয়ে একটি আইনও তৈরি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইতােমধ্যে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীও পাল্টে নিয়েছিলেন । এক্ষেত্রে আবদুস সামাদ আজাদের স্থলে ড. কামাল হােসেনের নিয়ােগ ছিল সুস্পষ্ট বার্তাসূচক এবং ভারতের জন্য আরেক কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা। মুজিবের স্বদেশে আগমনের আগে ভারতীয় আগ্রহে এবং প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে ডি পি ধরের সফরকালে (২৩-২৯। ডিসেম্বর) তাজউদ্দীন আহমদ তাড়াহুড়াে করে খন্দকার মােশতাককে সরিয়ে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন।

সুবিমল দত্তের পদত্যাগের পর যিনি ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন সেই সমর সেনও ভুট্টোর সফরকে অবহিত করেছেন। disenchantment বা মােহমুক্তি হিসেবে। তিনি বলেন, Zulfikar Ali Bhutto’s visit to Bangladesh in August 1974 meant that there was, if not a growing hostility, at least disenchantment with India.৬৪৪

সেসময় এবং এখনও বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক সাহিত্যে শেখ মুজিবুর রহমানের লাহাের যাত্রা, ভুট্টোর আগমন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আটককৃতদের ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি নাটকীয় সিদ্ধান্তের জন্য তৎকালীন সরকারের মােশতাক আহমদ প্রভাবিত অংশকে দায়ী করা হলেও আসলে

…………………………………………………………………

৬৪৩) পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯০। ইংরেজি থেকে অনুবাদ বর্তমান লেখকের।

৬৪৪) Samar Sen. An envoy remembers, Frontline, Vol. 15, No. 24, Nov. 21-Dec. 04, 1998, India.

Page 407

বিষয়গুলাে ঘটেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন তরফ থেকে। অন্তত ড. ওয়াজেদ মিয়ার উপরে বর্ণিত অন্তরঙ্গ অবলােকন থেকে আমরা তার কিছু ইঙ্গিত পাই। উপরােক্ত বাস্তবতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের অপসারণের৬৪৫ মিলিত ফল হয়েছিল এই যে, ঐতিহাসিক সেই চুয়াত্তরেই ড. হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাজউদ্দীন আহমদ অপসারিত হন ২৬ অক্টোবর, হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসেন ২৯ অক্টোবর; আর মাঝের ৪৮ ঘণ্টাতেই বিশ্বব্যাংক প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশকে ২৭৫ মিলিয়ন ‘সাহায্য দানের ঘােষণা দেয়। আর ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ঋণ ও অনুদান সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায় ৩৩৭.৫১০ মিলিয়ন ডলার- যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি ছিল। ৬৪৬

উল্লেখ্য, জবরদস্তিমূলক পদত্যাগের আগে ঢাকার দৈনিকগুলােতে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বড় বড় ছবি ছাপা হলেও তাতে মুজিবের সিদ্ধান্তের কোনাে ব্যাঘাত ঘটেনি। তাজউদ্দীনের অপসারণ যতটা না ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রেষারেষি তার চেয়ে বেশি ছিল নীতিগত- সরকারি ভাষায় যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে।’ তবে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডাযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি ছিল এটা। রাজনীতি বিজ্ঞানের বড় কৌতুক এই, যে হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে কৌতুকের ছলে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে তলাবিহীন ঝুড়ি হতে যাচ্ছে (Bangladesh an international basket case৬৪৭) এবং আমাদের

………………………………………………………………..

৬৪৫) অপসারিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ স্থানীয় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্তের মাধ্যমে। সর্বোচ্চ ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে গঠনমূলক কিছু করার জন্য যে অনুরােধ জানিয়েছিলেন তার প্রমাণ মেলে ঢাকায় তখনকার ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিতের ভাষ্যে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেই আহ্বানে সাড়া দেননি। বিস্তারিত দেখুন, J. N. Dixit, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬২।

৬৪৬) Flow of External Resources into Bangladesh, Ibid, p. 109.

৬৪৭) কিসিঞ্জারের বিখ্যাত এই মন্তব্যটি সম্পর্কে কিছুটা ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ম্যাগাজিন ‘টাইম’-এ প্রকাশিত ‘Foreigen relation; The kissinger Tilt’ শীর্ষক লেখা থেকে জানা যায় ‘৭১-এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওয়াশিংটনে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মার্কিন নীতিনির্ধারকের এক আলােচনায় Maurice Willium নামের এক ব্যক্তি বাংলাদেশে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়টি উত্থাপন করলে রাষ্ট্রদূত U, Alexis Johnson ও Henry Kissinger এ বিষয়ক এক কথােপকথনে জড়িয়ে পড়েন । যার শেষ পর্যায়ে Alexis Johnson বলে উঠেন, ‘They (Bangladesh) will be an international basket case.’ উত্তরে কিসিঞ্জার বলে উঠেন, ‘But not necessarily our basket case,’ এর পর থেকে কিসিঞ্জারের জবানিতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলার উপকথাটি বিশ্বজুড়ে চালু হয়ে পড়ে। কিসিঞ্জার নিজে কখনােই অস্বীকার করেননি যে, তিনি ঐরূপ কিছু বলেননি। ২০০৯ সালে কেবল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি একবার বলেছিলেন, প্রকৃত মন্তব্যটি কী ছিল তা তিনি মনে করতে পারছেন না।

Page 408

(যুক্তরাষ্ট্রের) তাতে দায়-দায়িত্বের কিছু নেই’- সে-ই তিনিই ‘৭৪-এ উনিশ ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশে এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ শেষে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠেন, ‘A man of vast conception. I had rarely met a man who was the father of his nation and this was a particularly unique experience for me.৬৪৮

ড. কিসিঞ্জারের এই উচ্ছাসের নিশ্চিতভাবে কিছু কারণ ঘটেছিল ইতােমধ্যে । তার উচ্ছাস সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধকালে দেরাদুন প্রকল্পে তারা স্রেফ অবকাঠামােগত সহযােগী হিসেবে থাকলেও ভারতীয় বিশেষ সংস্থার সঙ্গে তাদের সেই দূরবর্তী উদ্যোগ পরবর্তী চার বছরে এমনসব জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে নবীন দেশটিতে- যার সহজ ফল হয়েছে এই, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিসরে আবার চালকের আসনে উপনীত হতে সক্ষম হয় ওয়াশিংটন। ইতােমধ্যে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে ২৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি বহুজাতিক সাহায্যদাতা কনসাের্টিয়ামের অধীনে নিজেকে সঁপে দিতে সম্মত হয় বাংলাদেশ। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই ১৯৭২-এ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারাকে যথাযথ প্রটোকল দিতেও আপত্তি তুলেছিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। এমনকি দিল্লিতে ম্যাকনামারার সঙ্গে সৌজন্য বৈঠকে বসতেও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ম্যাকনামারার অভিবাদনও গ্রহণ করেননি তিনি।৬৪৯ আর তাজউদ্দীনের পদত্যাগের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সদ্যস্বাধীন দেশটিতে সফরের আমন্ত্রণ জানানাে হয়।

তাজউদ্দীন আহমদকে অপসারণ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানাে ছাড়াও হেনরি কিসিঞ্জারের সফরের আগে-পরে এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে নাটকীয় আরও অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। গণবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে ত্রিমুখী হানাহানিতে নকশাল ধারার প্রায় সবগুলাে সংগঠন তখন

……………………………………………………………..

৬৪৮) এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৩।

৬৪৯) নূরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮। অর্থমন্ত্রীর অনাগ্রহ সত্ত্বেও রবার্ট এস ম্যাকনামারা শেষপর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ম্যাকনামারার ঐ সফরকালে তাকে নানানভাবে অপমান করে বাংলাদেশ। ম্যাকনামারা যখন অর্থনৈতিক পুনর্বাসনে তাদের তরফ থেকে করণীয় সম্পর্কে জানতে চান তখন তার কাছে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হালের বলদ, গােয়াল ঘর ও দড়ির প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেন তাজউদ্দীন! প্রতিউত্তরে ম্যাকনামারা জবাব দিয়েছিলেন, এসব জরুরি বিষয় (!) বাংলাদেশকে তার মিত্র ভারতই সরবরাহ করতে পারবে। তবে তাজউদ্দীনের এরূপ অশােভন একরােখা অবস্থান ও অপদস্থমূলক আচরণ সত্ত্বেও মুজিব ম্যাকনামারাকে সহৃদয়তার সঙ্গেই গ্রহণ করেছিলেন।

Page 409

ক্ষয় আর পশ্চাৎপসারণের শেষ অধ্যায়ে । গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী সংগঠকরা (সিপিবি ব্যতীত) প্রায় সবাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে কারাগারে আটক অথবা আত্মগােপনে অথবা নিহত। সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র পুরােপুরি মুক্তিযুদ্ধের পর তৈরি মূল সংবিধানের মৌল বৈশিষ্ট্যের বিপরীতমুখী অভিমুখ নিয়েছে। এই সময় প্রথম বিপ্লবের পর দ্বিতীয় বিপ্লব’ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার চেয়ে বরং উল্টোটিই ঘটিয়েছিল।

আর ভারতের বাংলাদেশ নীতি তখন আঁচ করা যায় ‘র’-এর খ্যাতনামা কর্মকর্তা বি. রমনের (যিনি তখন প্যারিসে কর্মরত) নিম্নোক্ত বয়ানে :

“১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা এবং এরপর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাতে গােয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ‘র’ ভাবমূর্তি ও উজ্জ্বলতা হারায়। ‘৭৫-এর ঘটনার পর বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যাতে দেশটির ওপর ভারতের প্রভাব কমে যায়। ভারতীয়দের মধ্যে ‘র’-এর সমালােচকরা এটাকে ভয়ংকর গােয়েন্দা বিপর্যয় হিসেবে সমালােচনা করেন। প্যারিসে ভারতের রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে সমালােচনা মুখর হয়ে উঠেন।…আমি কাওকে (‘র’ প্রধান) একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখে সমালােচনার কথা জানাই। মুজিব হত্যার কয়েক সপ্তাহ পরে কাও জেনেভা সফর করেন। তিনি মুজিব হত্যা সম্পর্কে আমাকে জেনেভা ডেকে পাঠান এবং বলেন, বাংলাদেশে ‘র’ কোনভাবেই ব্যর্থ হয়নি।…”৬৫০

এসময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়াও ছিল কৌতূহলােদ্দীপক। জরুরি অবস্থা জারি করে দেশ চালাচ্ছিলেন তিনি । স্বভাবত বিরােধী দল ও মতের তখন খুবই নিষ্পেষিত অবস্থা ভারতে। ইন্দিরা গান্ধী সেই নিষ্পেষণকে যৌক্তিকতা দিতে বাংলাদেশের মুজিব হত্যাকাণ্ডকে কাজে লাগিয়ে বললেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলি ভারতে জরুরি অবস্থা ঘােষণার প্রয়ােজনীয়তার নবতর প্রমাণ।’৬৫১

মুজিবের মৃত্যুতে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াও ছিল ভীষণরকমে গতানুগতিক- ‘গভীরভাবে শােক ও আঘাত পেলেও তারা এটাও জানাল যে, ‘নতুন সরকারের নীতি ও মনােভাব লক্ষ্য করেই তারাই পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।৬৫২ অর্থাৎ পক্ষান্তরে তারা পনেরাে আগস্ট পরবর্তী সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃতিই দেয়। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন ১৫ আগস্ট দিল্লি

………………………………………………………………

৬৫০) বি, রমন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯-৫০।

৬৫১) আসফাক আলম স্বপন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১।

৬৫২) J. N. Dixit, Ibid, p.212.

Page 410

থাকলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি কলকাতা হয়ে ঢাকা পৌঁছেন। ১৮ ডিসেম্বর তিনি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গেও দেখা করেন এবং তাঁকে জানান, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন না করতে যায় তাহলে যা ঘটেছে তাকে দিল্লি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবেই দেখবে।৬৫৩ এসময় দিল্লিস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান খুব সহজেই দেশটিতে জরুরি অবস্থার মাঝেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতে সমর্থ হন। শামসুর রহমানের সঙ্গে এসময় আরেক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় তথ্যমন্ত্রী ভি সি শুক্লা (যিনি এসময় ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন) এও আশ্বাস দেন যে, ভারতে বসে কেউ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে- এমনটি তারা হতে দেবেন না। মােশতাকের স্বল্পকালীন শাসনামলের প্রথম কিছুদিন এই আশ্বাস অনেকাংশে রক্ষিত হয়। তবে দ্রুত ভারত তার কৌশল পাল্টে নেয় এবং বিশেষভাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরপর আওয়ামী লীগের বিরাট সংখ্যক তরুণ কর্মী সীমান্ত অতিক্রম করে এবং ওপার থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ময়মনসিংহ-শেরপুর-নেত্রকোণা সীমান্তজুড়ে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে এইরূপ তৎপরতা শুরু হয় এবং চলে তা ১৯৭৭ সালে জনতা দলের হাতে ইন্দিরা গান্ধীর পতন পর্যন্ত। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তখনকার ভাষ্য অনুযায়ী এইরূপ তৎপরতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম এবং ১৯৭৭-এর ২৭ জানুয়ারিতে বিডিআর-এর তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল গােলাম দস্তগীর আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, পূর্ববর্তী ১১ মাসে ভারতীয় ভূমি থেকে ১ হাজার ৩১৬ বার সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা ঘটেছে, আর তাতে মারা গেছে ৫৬ ব্যক্তি।৬৫৪ অন্যদিকে

……………………………………………………………

৬৫৩) বিস্তারিত দেখুন, Manash Ghosh, Breaking fiels- So aach for Bangladesh, The Statesman, 15 Sep. 2011, India.

http://www.thestatesman.net/index.php?option=com_content&view=article&show=archive&id=383426&catid=35&year=2011&month=09&day=16&Itemid=66 (পর্যবেক্ষণ ২০-০৮-২০১৩]। ঐ সময়কার ঘটনায় ভারত ও তার ভূমিকা সম্পর্কে সমর সেন নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে :

After the assassination, I took the view that we should wait and watch, but at the same time, we should establish contacts with the new regime. We did so, though there were elements in the Indian Government who did not like it. Our attitude then was that we would keep all channels open, we would try to do the fairest and the most practical things. But we would not give up on our vital interests, like Farakka or the territories that were supposed to be ceded to Bangladesh. Samar Sen, Ibid.

৬৫৪) এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত দেখুন, মােহাম্মদ সেলিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৬-১৩৯ এবং

http://en.wikipedia.org/wiki/Kader_Siddique;

http://www.ecoi.net/local_link/170025/271377_en.html. (পর্যবেক্ষণ ২০-০৮-২০১৩)।

উল্লেখ্য, কাদের সিদ্দিকীর অনুপস্থিতিতেই ১৯৭৮ সালের ২৪ জুলাই সামরিক আদালতে তার সাজা হয় উপরােক্ত তৎপরতার অভিযােগে । এসময় তিনি ভারতে অবস্থান করছিলেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকালে ১৫ বছর পর তিনি কলকাতা থেকে বাংলাদেশে আসেন। ১৭ জানুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। শিগগির তিনি ছাড়াও পান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

Page 411

কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আলােচনার ভিত্তিতে লিখিত সাম্প্রতিক এক গণমাধ্যম প্রতিবেদন৪৫৫-এ দেখা যায়, তাদের ঐ তৎপরতায় অন্তত ১০৪ জন সহযােদ্ধা প্রাণ হারিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার কারণে যে বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায় তাতে ৬২ জন নির্ধারিত জেলা গভর্নরের একজন ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী।

সাধারণভাবে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর উপরােক্ত সময়কার হামলার মূল বিস্তৃতি ময়মনসিংহ থেকে সিলেট পর্যন্ত সীমান্তজুড়ে থাকলেও এক পর্যায়ে তাদের এই বাহিনী পাবনা-সিরাজগঞ্জ সংলগ্ন নিশ্চিন্তপুরে যমুনার চরাঞ্চলে একটি মুক্তাঞ্চল গড়ে তােলার মরিয়া প্রচেষ্টাও নিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তীব্র পাল্টা হামলায় (১৯৭৫ সালের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে) অন্তত দু’দিনের যুদ্ধ শেষে মুক্তাঞ্চল গঠনের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৭৬-৭৭ জুড়ে সীমান্তবর্তী কিছু জেলাতে কয়েকটি ব্রিজও ধ্বংস করে এই বাহিনী।

টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহে কাদের সিদ্দিকীর সরাসরি অনুসারী ছাড়াও ঢাকা ও বিভিন্ন শহর থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একদল তরুণ কর্মী-সমর্থককে এই যুদ্ধে সামিল করা হচ্ছিল পদ্ধতিগতভাবে। যে প্রক্রিয়ায় এই লড়াইয়ে সামিল হয়ে বাহিনীর নেতৃস্থানীয় কমান্ডার হন আবদুল খালেক খসরু (বগুড়া), সৈয়দ নুরু

(ঢাকা), দীপংকর তালুকদার (রাঙ্গামাটি), সুলতান মুহাম্মদ মনসুর (মৌলভীবাজার) প্রমুখ। ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ২২ মাসের উপরােক্ত তৎপরতাকালে, বিশেষ করে ১৯৭৬ সালের ১৯ জানুয়ারি আক্রমণকারীরা নেত্রকোণার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা থানা দুটি কিছু সময়ের জন্য পুরােপুরি দখল করে নিয়েছিল। এটা ছিল একাত্তরের ‘অপারেশন মাউন্ট ঈগল’ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীকেন্দ্রিক covert operation৬৫৬-এর পর ভারতীয় তরফ থেকে অনুরূপ কার্যক্রমের তৃতীয় সংস্করণ। স্বাভাবিকভাবেই হামলাকারীরা যে ভূমি থেকে তৎপরতা চালাচ্ছিল সেখানকার রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সহযােগিতাই ছিল এইরূপ কার্যক্রমের প্রধান শক্তিভিত। যার প্রমাণ মেলে- দিল্লিতে ইন্দিরা। গান্ধী ক্ষমতা হারানাে মাত্র এইরূপ তৎপরতা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে- যেহেতু বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান সরকার ভারতের মােরারজি দেশাইয়ের

……………………………………………………………

৬৫৫) প্রতিরােধ যুদ্ধে নিহত ১০৪’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ আগস্ট ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ১।

৬৫৬) covert operation সম্পর্কে আলােচনার জন্য দেখুন: ৩.ঘ উপ-অধ্যায়।

Page 412

নেতৃত্বাধীন জনতা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল।*৬৫৭ ১৯৭৭-এর ১০ জুন দেশাইর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সফল বৈঠকটি এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বিরাট স্বস্তির কারণ ঘটিয়েছিল। এরপরই বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে কাদেরের গেরিলাদের জন্য রেশন বিতরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রায় ৯০০ গেরিলাকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কাদের সিদ্দিকী অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে হস্তান্তরকৃত গেরিলাদের সংখ্যা ৬ হাজার বলে দাবি করেছেন।৬৫৮ এসব গেরিলাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ঢাকার কাছে। কলাকোপা-বান্দুরা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল অভ্যন্তরে (শ্রীবর্দী- হালুয়াঘাটের বিপরীতে) বনাঞ্চল ও চা বাগিচাপ্রধান আসামের চান্দুভুই নামক জায়গায় এই বাহিনীর সদরদপ্তর ছিল বলে জানা যায়।৬৫৯ স্থানটি মেঘালয়েরও নিকটবর্তী। কাদের সিদ্দিকী এক লেখায় এও জানান, ১৯৭৫-এর আগস্ট পরবর্তী তাদের এই তৎপরতায় ভারতে কংগ্রেস সরকারের সহযােগিতা ছাড়াও রাজনৈতিক দল হিসেবে সেখানকার সিপিএমও সদয় ও সহযােগী ছিল।৬৬০ উল্লেখ্য, পুরাে তৎপরতা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও ঢাকাকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের যেসব যােদ্ধা সেখানে ছিলেন তারা ১৯৭৬-এর বর্ষায় একবার বিদ্রোহও করেছিলেন অধিনায়কের বিপক্ষে। সেই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করেন কাদের

…………………………………………………………………

৬৫৭) দেশাই ছিলেন ভারতের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী এবং প্রথম অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯- মাত্র দু’বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এর মাঝেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চমৎকার মােড় নিয়েছিল; বিশেষভাবে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানিচুক্তি ছিল উল্লেখ্যযােগ্য বড় অগ্রগতি। আলােচ্য তিন বছরে দেশাইর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তিনদফা বৈঠক হয়। যার মধ্যে প্রথম বৈঠক হয় লন্ডনে (১৯৭৭]। এই বৈঠকেই সীমান্তে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন যােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ভারত সম্মতি দিয়েছিল। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি মােরারজি দেশাই গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বাজেট কমিয়ে দিতে শুরু করেন এবং এর কার্যক্রমও সীমিত করার নির্দেশ দেন। তিনি মনে করতেন সংস্থাটি ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক ইচ্ছা পূরণের একটি হাতিয়ার হয়ে পড়েছিল।

দেখুন, http://en.wikipedia.org/wiki/Morarji_Desai (পর্যবেক্ষণ ২২.০৮.২০১৩)

৬৫৮) দেখুন, http://ns.bdnews24.com/details.php?id=147425&cid=35 (পর্যবেক্ষণ ২০.০৮.২০১৩]

৬৫৯) দেখুন, http://dnewsbd.com/single.php?id=41284 এবং

http://www.bostonbanglanews.com/index.php?option=com_content&view=article&

id=25723:2013-08-15-01-48-02&catid=86:2011-03-28-17-55-11&Itemid=70।(পর্যবেক্ষণ ২০-০৮-২০১৩)।

৬৬০) কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, এক মহাবিপর্যয়ের দিন’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ আগস্ট ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ১।

Page 413

সিদ্দিকী- তবে ভারতীয় গােয়েন্দাদের হস্তক্ষেপে বিদ্রোহীদের প্রাণভিক্ষা পায়।৬৬১ পঁচাত্তরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পরবর্তী ২২ মাসের উপরােক্ত তৎপরতা প্রতিরােধকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশের হাতে নিহত বিদ্রোহীদের একটি তালিকা দেখুন সংযুক্তি পঁচিশ-এ।

উল্লেখ্য, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক কিছু করার জন্য সিপিবি’র তখনকার নেতৃবৃন্দের একটি দলও ভারত গিয়েছিলেন- তবে তারা কোনাে তৎপরতা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন বলে জানা যায় না। ঐ দলে সিপিবির বর্তমান সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও ছিলেন। দেশে ফিরেই পরের বছর তিনি গ্রেফতারবরণ করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, সিপিআই ও সােভিয়েত পার্টির কাছ থেকে সিপিবি এ বিষয়ে উৎসাহব্যঞ্জক কোনাে সাড়া পায়নি সেসময় ।

……………………………………………………………..

৬৬১) উল্লিখিত বাহিনীর অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দল সম্পর্কে দেখুন,

http://www.somewhereinblog.net/blog/Shahnawaz/29770077 (পর্যবেক্ষণ ২০-০৮-২০১৩)

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!