You dont have javascript enabled! Please enable it! জাসদ গঠনে জ্বালানি : ধ্বংস ও দারিদ্র্যের মাঝে শাসক এলিটদের লুণ্ঠন প্রবণতা - সংগ্রামের নোটবুক

জাসদ গঠনে জ্বালানি : ধ্বংস ও দারিদ্র্যের মাঝে শাসক এলিটদের লুণ্ঠন প্রবণতা

আমি বাংলাদেশে কোন শ্রেণী থাকতে দেব না। এ দেশে শ্রেণী একটাই হবে। সেটা হবে বাঙালি শ্রেণী।

          – ঢাকার পিলখানায় জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী (পরবর্তীকালে রক্ষীবাহিনী)-এর ক্যাম্পে প্রদত্ত শেখ মুজিবুর           রহমানের ভাষণ।৫৬৬

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। কিন্তু একটি সামন্তবাদী এবং আধা-সামন্তবাদী সমাজ-ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার স্তর এড়িয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে সাহসিকতা, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও দূরদর্শিতার প্রয়ােজন তদানীন্তন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে তার যথেষ্ট অভাব ছিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, অসমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে দেশ এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।…অচিরেই একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হলাে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এক নতুন ধরনের শােষণযন্ত্রের উদ্ভব করা হয়েছে।

          -বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বিতীয় বার্ষিক

           সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে।

         ড. মহিউদ্দিন আলমগীরের ভাষণ, মার্চ ১৯৭৬*৫৬৭

পূর্ববর্তী উপ-অধ্যায়ে এটা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, জাসদ কর্তৃক ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের ঘটনা এবং তৎপরবর্তী গণবাহিনীর কার্যক্রম শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ও সমর্থকদের জন্য কমবেশি একটি রাজনৈতিক আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে সেসময় দেশের অর্থনীতি এত দ্রুত মুখ থুবড়ে পড়ছিল যে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনবিক্ষোভ সামাল দেওয়ার

…………………………………………………………………

৫৬৬) ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান সমর্থক অংশ স্বাধীনতা উত্তর ডাকসু’র প্রথম নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের পরিচিতিমূলক এক ও অভিন্ন নামে ৪০ পৃষ্ঠার যে পুস্তিকা প্রকাশ করে সেখানে মুজিবের এই উক্তিকে প্রধান শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বর্তমান লেখায় সেখান থেকেই উদ্ধৃত।

৫৬৭)  ড, আলমগীরের ঐ ভাষণের পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন, Political Economy, Vol. 2, No. 1. Journal of Bangladesh Economic Association, Department of Economics, DU, Dhaka, 1977, p.1-14. বর্তমানে (২০১৩] এই অর্থনীতিবিদ ইটালিতে অবস্থান করছেন বলে জানা যায় ।

Page 347

একটিই কেবল উপায় থাকত- তা হলাে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানাে- মুজিব ও মুজিববাদ সমর্থকরা কোনােভাবে যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। স্বাধীনতার প্রায় দেড় বছরের মাথায় দেখা যায়, জিডিপি ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় শতকরা প্রায় ১৪ ভাগ পড়ে গেছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত জিডিপি গড়ে প্রায় ৯ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল । জিনিসপত্রের দাম গড়ে সব দ্বিগুণ হয়ে যায় । মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে শুরু করে বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ হারে।৫৬৮ ভােগ্যপণ্যের মূল্যসূচক ১৯৭২ সালে ৫২ শতাংশ বেড়ে যায়। খাদ্য উৎপাদন কমে এক-দশমাংশ। সত্তরের নির্বাচনে মুজিব চালের দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতারােহণের পর ঘটে উল্টোটি। কিছু জেলায় চালের দাম কয়েকশ শতাংশ বেড়ে যায়। শিল্প উৎপাদনও কমে ৭০-৭১ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। কারখানায় উৎপাদন না থাকলেও ব্যাংক থেকে আগাম ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল।

যদিও ‘সমাজতন্ত্র বলতে সমগ্র সমাজের জন্য শােষণ প্রতিরােধক এক ধরনের সমাজ ব্যবস্থার কথাই বলেছেন মার্কস ও লেনিন, কিন্তু বাংলাদেশে বাহাত্তরে শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণকেই সমাজতন্ত্র হিসেবে ধরে নেয়া হয়। শ্রমিকরাও এই পদ্ধতি কায়েম রাখতে আওয়ামী লীগ নেতাদের ধরে এনে একের পর সংবর্ধনা দিয়ে যাচ্ছিল। কারণ কাজ না করেও বেতন পাওয়ার একটা সংস্কৃতি শক্তি পাচ্ছিল তাতে। সেসময় ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ও ১৯ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের ‘মঞ্চ-নেপথ্যে’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয়ের দুটি লেখায় পাটমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে জানানাে হয়, স্বাধীনতার পরপর পাটকলগুলােতে (তখন ৭৭টি) প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার ভুয়া শ্রমিক তালিকাভুক্ত হয় এবং তাদের পেছনে বছরে ছয় কোটি টাকা করে গচ্চা যাচ্ছে সরকারের। এইরূপ বাস্তবতারই তীব্র সমালােচনা করতে গিয়ে সেই সময়কার অন্যতম জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. মযহারুল হক ১৯৭৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, “গত দুই বছরে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র। দেশ হয়েও উৎসবধর্মী খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছি আমরা সেটা পাপের। সমতুল্য এবং লজ্জাকরও, কারণ একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্যরা বাংলাদেশকে রক্ষা করতে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার সহায়তা দিয়েছে।৫৬৯

বাস্তবে স্ববিরােধী এসব তৎপরতাকে অর্থনীতির সর্বগ্রাসী এক কাঠামােগত দুর্বলতার পটভূমিতে বিবেচ্য- যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ও আর্থিক

……………………………………………………………

৫৬৮) দেশের ঐ সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির বিস্তারিত চিত্র পেতে দেখুন, মুনীর উদ্দীন আহমদ [সম্পাদিত], বাংলাদেশ : ৭২ থেকে ৭৫, খােশরােজ কিতাব মহল, ১৯৮০, ঢাকা, পৃ. ১৫৩-১৭৮ এবং দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ মার্চ ১৯৭৪, ঢাকা।

৫৬৯) পুরাে ভাষণটির জন্য দেখুন, মুনির উদ্দীন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬০।

Page 348

খাতের জাতীয়করণ এবং জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানগুলােতে সীমাহীন দুর্নীতি ও অদক্ষতা। সীমান্ত উন্মুক্ত থাকায় চোরাচালান ব্যাপকতা পায়। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি তীব্র হয়ে ওঠে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে থাকে।৫৭০ জাতীয়করণ প্রকৃত ব্যবসায়ীদের আস্থাও নষ্ট করে চূড়ান্তভাবে। স্বভাবত এরা সরকারের ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল। জাসদ রাজনীতির ভিত্তি হয়ে ওঠে এই ক্ষোভ।

আবার বাহাত্তর পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চাপও আসছিল জাসদের তরফ থেকেই। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি এসময় ‘বাংলার বাণী’র মাধ্যমে শেখ মণি’র জাতীয়করণভিত্তিক সমাজতন্ত্রের প্রাত্যহিক রণধ্বনির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল দেখে পুরাে বিষয়টিকে স্পষ্টত এক ধরনের ষড়যন্ত্র হিসেবেও অভিহিত করার সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। এরূপ বিবিধ সমাজতন্ত্র’ শিগগির যখন দেশকে কেবল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাই উপহার দিল তখন তার জন্য দোষারােপের ভাগিদার হলাে স্রেফ তত্ত্ব হিসেবে মার্কসবাদ ও সাম্যবাদ। আর পুরাে আশির দশক জুড়ে এই অপপ্রচারে নেতৃত্ব দিল দৈনিক ইত্তেফাক- যে দৈনিকটি মুজিবের দ্বিতীয় বিপ্লব তথা সমাজতান্ত্রিক বাকশাল’ কর্মসূচি অনুমােদিত চারটি দৈনিকেরই একটি ছিল! এ বিষয়ে নির্মল সেন লিখেছেন, ‘সমাজতন্ত্রকে চিরতরে নির্বাসন দেওয়ার জন্যই সেদিন পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে নাম দেওয়া হয় সমাজতন্ত্র। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়া মাত্রই এক শ্রেণির সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী একে সমাজতন্ত্রের সমার্থক করে তার বিরুদ্ধে

বিষােদগার শুরু করলেন। সেই ষড়যন্ত্র আজও চলছে। রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যর্থতাকে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা হিসেবে চালানাে হলেও বেসরকারি খাতের লুটপাটের জন্য পুঁজিবাদকে কখানাে দোষারােপ করা হয়নি। সে নিয়ে তারা উদ্বিগ্নও নন।৫৭১

প্রায় অনুরূপভাবে জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলাের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের বিবরণ শেষে সেই সময়কার আওয়ামী লীগ নেতা মাে. আবদুল মােহাইমেন লিখেছেন, ‘..সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাে হলােই না, মাঝখান থেকে সমাজতন্ত্র মানে লুটপাট- এই ধারণাই সাধারণ লােকের মনে বদ্ধমূল হলাে। অবস্থা এমন হলাে যে, …. ‘৭৪-‘৭৫ এ সমাজতন্ত্রের নামে কোন কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়লাে- ফলে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন কমপক্ষে ৫০ বছর পিছিয়ে গেল।৫৭২

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে করাচির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সােসাল এন্ড ইকোনমিক রিসার্চ ও স্থানীয় স্টক একচেঞ্জ পূর্ব-পাকিস্তানে পশ্চিম

……………………………………………………………….

৫৭০) ঐ সময়ের আর্থিক অবস্থার একাডেমিক আলােচনার জন্য সম্মিলিতভাবে দেখুন, S A Karim, ibid. p. 311. and Akand Akhtar Hossain, Macroeconomic Developments, Politics and issues in Bangladesh 1972-2007, in Bangladesh Economy in the 21″ Century, Ed. Munir Quddus and Farida C. Khan, UPL, Dhaka, p. 385-432.

৫৭১) পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮৭-৮৮।

৫৭২) মাে. আবদুল মােহাইমেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪।

Page 349

পাকিস্তানীদের ‘খােয়া যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প স্থাপনার বিষয়ে এক সমীক্ষা চালায়। তার ভিত্তিতে বাহাত্তরের মার্চে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের প্রায় ৭২০ কোটি রূপির শিল্প ও ব্যবসা যুদ্ধের ফলে হাতছাড়া হয়।৫৭৩ এরূপ হাতছাড়া বা খােয়া যাওয়া তথা ‘পরিত্যক্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলাে অধিগ্রহণের লক্ষ্যে ঢাকার সরকার আইনগত কাঠামাে প্রকাশ করে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি [The Bangladesh (Taking over the control and management of Industrial and Commercial concerns) Order, 1972, Acting President’s Order No. 1; এটি সাধারণত এপিও-১ নামে নীতিনির্ধারক পরিমণ্ডলে পরিচিতি পায় তখন।]। এই আইনের লক্ষ্য ছিল ‘অনুপস্থিত মালিকদের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা। তবে এও বলে নেয়া হয়, জনস্বার্থে’ উপস্থিত কোনাে মালিকের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনাও সরকার গ্রহণ করতে পারবে!

এসময় পাকিস্তানি মালিকদের ফেলে যাওয়া সর্বমােট ৭২৫টি প্রতিষ্ঠান শনাক্ত হয়- যার সেই সময়কার মূল্য ছিল ২৮৮ কোটি টাকা। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলাে ছিল স্বাধীনতাপূর্ব পূর্ব-পাকিস্তানের সমগ্র শিল্প-বাণিজ্যের প্রায় ৪৭ ভাগ। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটা ছিল প্রায় ৭১ ভাগ।৫৭৪ এসময় পরিত্যক্ত আকারে সরকার বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৩ হাজার ৮০০ দোকান এবং ২২ হাজার ৯৪৮টি বাড়িও পেয়েছিল৫৭৫- যেগুলাে পরবর্তীকালে সরকার সমর্থকরা লীজ আকারে ভােগ করার সুযােগ পায়। কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে লীজ বা অন্য কোনােভাবে অনুমােদন না করিয়েও এসব সম্পত্তি ভোগ করেছে।

উল্লেখ্য, এপিও-১-কে সরকার পরে The Abandoned Property (control, mamagement and disposal) Order 1972 (P. 0. NO. 16 OF 1972) নামের আরেকটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এপিও-১ যেখানে ছিল সম্পত্তি দখল সংক্রান্ত পরের আইনটি সেখানে বিক্রয়ের অধিকারও দেয় সরকারকে। এসব আইন সরকারকে দখলকৃত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবস্থাপনা বাের্ড বা ‘প্রশাসক নিয়ােগের দায়িত্ব দেয়। এভাবেই বিপুল সম্পত্তিতে সরকার সমর্থকদের প্রবেশাধিকার তৈরি হয়। ঠিক এই পর্যায়েই মুজিব বাহিনীর উভয় অংশ এবং সিপিবি-ন্যাপ সকল তরফ থেকে ‘সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাপে পড়েন মুজিব এবং

……………………………………………………..

৫৭৩) আবু মাে. দেলােয়ার হােসেন, বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক : সম্পদ-বণ্টন ইস্যু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, যুক্তসংখ্যা ৮৩-৮৪, ঢাকা, পৃ. ৬২-৬৩।

৫৭৪) এই উদ্যোগের পূর্বাপর সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন, Rehman Sobhan, The Crisis of the Burgoeis Order and the Growth of Authoritarian Political Trends in।Banglaesh, South Asian Studies 2, OUP, Delhi, 1982

৫৭৫) দৈনিক মানবজমিন, ১ নভেম্বর ২০১২ এবং দৈনিক গণকণ্ঠ, ১৯ জুন ১৯৭৩, ঢাকা।

Page 350

১৯৭২-এর ২৬ মার্চ পাট-বস্ত্র-চিনি শিল্প, ব্যাংক-বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করা হয়। এভাবে পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলাে ‘রাষ্ট্রীয় খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়; পাশাপাশি বলা হলাে, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্যই এই জাতীয়করণ । কিন্তু পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য যে মানবসম্পদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের সমাজতান্ত্রিক কোনাে দীক্ষা ছিল না। ফলে ঐ জাতীয়করণ প্রথমে ‘রাষ্ট্রীয়করণ’ ও পরে লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। জাতীয়কৃত সম্পত্তির ওপর সমগ্র জাতির কর্তৃত্বের বদলে পুঁজিপতি শ্রেণি, তাদের প্রতিভূ আমলাতন্ত্র ও এক শ্রেণির কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রমিক নেতার কর্তৃত্ব তৈরি হয় এবং তাদেরই ভােগে লেগেছিল তা। এভাবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ সরকারের ঘােষিত ‘জাতীয়করণ’ থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ করে পরে দেশে অবাধ পুঁজিবাদ কায়েম করে ‘শিল্পপতি হিসেবে নিজেদের নতুন পরিচয় নির্মাণ করে। মওদুদ আহমদ তাঁর গবেষণায় ১৯৭৩ সালের ৪ঠা মার্চ ঢাকার সংবাদপত্রগুলােতে প্রকাশিত সরকারি ক্রোড়পত্র থেকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, ঐ সময় পর্যন্ত ২৩৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছিল এবং ৫২৬টি উৎপাদনমুখী শিল্প ইউনিটকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১২টি ব্যাংক এবং ৪৪টি বীমা প্রতিষ্ঠানকেও জাতীয়করণ করা হয়।৫৭৬ স্বভাবত সরকার নিযুক্ত ‘প্রশাসক ও পরিচালকদের (যাদের কারােই প্রায় শিল্প বা ব্যাংক পরিচালনার কোন পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল না) সম্পদ সংগ্রহের জন্য এ ছিল বিপুল এক ক্ষেত্রভূমি। যেমন ঢাকার তেজগাঁওয়ের পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলাের পরিচালক ছিলেন গাজী গােলাম মােস্তফা। আমরা ইতঃপূর্বেই দেখিয়েছি (৫.গ উপ-অধ্যায়ে), গাজী গােলাম মােস্তফা রাজনৈতিকভাবে তখন মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাজন হলেও মুজিব বাহিনীর সরকারি বিরােধী গ্রুপকেও আর্থিক অনুদান দিতেন তিনি। অর্থাৎ রাজনীতির পুরাে পরিমণ্ডলেই তখন জাতীয়করণের ‘সুফল পাওয়া যাচ্ছিল।

সাধারণত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে জাতীয়করণ ঘটে সেটা হয় সামাজিকীকরণ । রাষ্ট্রীয়করণ ও সামাজিকীকরণ পুরােপুরি বিপরীত চরিত্রের বিষয়।৫৭৭ পরে (৭.খ উপ-অধ্যায়ে) আমরা এও দেখবাে, তৎকালীন সরকার যে ১৯৭৫ নাগাদ একদলীয় শাসন কাঠামাে দিয়ে হলেও মরিয়াভাবে ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছিল তাতে পরােক্ষ দায় হিসেবে কাজ করেছিল মূলত ‘জাতীয়করণ থেকে সরকারের অনুসারী তথা নতুন রাজনৈতিক এলিটদের হাতে স্থানান্তরিত সম্পদ রক্ষার দায় । এইরূপ সম্পদ স্থানান্তর প্রশ্নাতীত করতে ১৯৭৩ সালে ঘােষিত ‘দ্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল লিবারেশন স্ট্রাগল (ইনডেমনিটি) অর্ডার’-এর তাৎপর্যপূর্ণ। ভূমিকাও এক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য ছিল। আবার এসব ব্যক্তি পর্যায়ে স্থানান্তরিত

…………………………………………………………….

৫৭৬) মওদুদ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল, ইউপিএল, ১৯৮৩, ঢাকা, পৃ. ৫০-৫১।

৫৭৭) দেখুন, হারুনুর রশীদ, রাজনীতিকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯, ঢাকা, পৃ. ১৩৫।

Page 351

‘সম্পদ’ তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুনর্বিনিয়ােগের সুযােগ খুঁজছিল এবং পরিণতি হিসেবে দেখা যায়, ১৯৭৪-এর জুলাইয়ে এসে সরকার বেসরকারি খাতে বিনিয়ােগ সীমা ২৫ লাখ থেকে এক লাফে ৩ কোটিতে উন্নীত করে এবং ১৮টি খাত রেখে বাকিগুলাে ওইরূপ বিনিয়ােগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে একদলীয় ব্যবস্থা হিসেবে বাকশাল কায়েমের পূর্বাপর কারণ ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে কিন্তু তাতে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ও উপরােক্ত আইনটির প্রভাবক ভূমিকা অনালােচিতই থেকে গেছে।উল্লেখ্য, মুজিব তাঁর সমাজতন্ত্র অভিমুখীন এইরূপ শহুরে জাতীয়করণ কর্মসূচি থেকে গ্রামীণ ভূমি সংস্কারের প্রসঙ্গটিকে অতিযত্নের সঙ্গে যে দূরে রেখেছিলেন সে বিষয়েও ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

মুজিবকে জাতীয়করণনির্ভর সমাজতন্ত্রের বিধ্বংসী পথে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর উভয় অংশের চাপ ও ভারত-রাশিয়ার উৎসাহের পাশাপাশি তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনই মুখ্য ভূমিকায় ছিল। পূর্বোক্ত ৩.গ উপ-অধ্যায়ে মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত আলােচনায় সাংবাদিক এনায়েতুল্লা খানের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে- যেখানে তিনি মুজিব বাহিনীর বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেন Super-autonomous সংস্থা হিসেবে। ইতােমধ্যে দেখানাে হয়েছে Super-autonomous এই বাহিনী নানান কাঠামােতে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে কী বিবিধ উপায়ে স্বাধীনতা-উত্তর সময়কে বিবাদময় করে তুলেছিল। ঠিক একই সময় মুজিব সরকারের মাঝে আরেক Supra-authority ছিল সেই সময়ের পরিকল্পনা ‘কমিশন এবং তারও শক্তিভিত তৈরি মূলত ভারতে মুক্তিযুদ্ধকালে। বর্তমান সমীক্ষায় যদিও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিপর্যয়ে কেবল মুজিব বাহিনীর ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে কিন্তু কার্যত সেই দুর্ভাগ্যের পেছনে উল্লিখিত Supra-authority-এর ভূমিকাও ছিল মােটাদাগে । মুজিব বাহিনী সৃষ্ট বিভেদের দায় মুজিব নিজ জীবন দিয়ে শােধ করেলেও পরিকল্পনা কমিশনের নীতিগত ভুল নির্দেশনার দায় শােধ করতে হয়েছে মুজিবের পাশাপাশি দেশের প্রত্যেক মানুষকে।

‘প্ল্যানিং কমিশন’ নামক চার অধ্যাপকের৫৭৮ আলােচ্য ভরকেন্দ্রের যাত্রা প্রকৃত অর্থে কলকাতায় প্রবাসী সরকারের কাঠামােতে । সেখানে এর নাম রাখা হয়েছিল ‘প্ল্যানিং সেল’ । পরে এর নাম করা হয় প্ল্যানিং বাের্ড। প্রথম থেকে এই সেল বা বাের্ড প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অধীনস্ত ছিল । মজিব বাহিনীর বিবিধ কাঠামাে থেকে মুজিব যখন সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য তীব্র চাপের শিকার তখন সেই

………………………………………………………………

৫৭৮) রেহমান সােবহান, আনিসুর রহমান, মােশাররফ হােসেন এবং নুরুল ইসলাম। এদের মধ্যে শেষােক্তজন ছাড়া অন্য তিনজনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; তবে মুজিবের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি নিবিড় ছিল চতুর্থজনের।

Page 352

‘সমাজতন্ত্র’-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের ভূমিকা পেয়ে যায় ঐ প্ল্যানিং বাের্ড। ইতােমধ্যে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে এর নাম আরেক দফা পাল্টে হয় ‘পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন সমাজতন্ত্রের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে ১০টি বিভাগের জন্ম দেয়। দু-তিনটি মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্র করে এক-একটি বিভাগ কাজ করত। এসব বিভাগের প্রধানদের পূর্ণ সচিবের মর্যাদা দেওয়া হয়। কমিশনের সদস্যরা নিজেদের জন্য প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদা অনুমােদন করিয়ে নেন। মর্যাদার এইরূপ ব্যাপকতা রাষ্ট্রীয় কাঠামােতে বিরাট ছন্দপতন ঘটায় এবং ব্যাপকভিত্তিক এক রেষারেষির জন্ম দেয় । পরিকল্পনা কমিশনের নীতি ও কৌশল মাঠপর্যায়ে যে বিপর্যয়ের জন্ম দিচ্ছিল তা দেখে ১৯৭৪ থেকে মূলধারার আমলাতন্ত্র ক্রমে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৭২-এর ২৬ মার্চ জাতীয়করণ কর্মসূচি ঘােষিত হলেও তার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি করতে কাঠামােগত নির্দেশনা এবং ৯টি কর্পোরেশন গড়ে তুলতে কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। এসব দায়িত্ব ছিল পরিকল্পনা কমিশনের। কমিশনের ভাবধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ভবিষ্যৎ রচনা করতে গিয়ে একপর্যায়ে চুয়াত্তরের এপ্রিলে সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৭ জন অর্থনীতিবিদের এক দল তাত্ত্বিককেও নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এসব আয়ােজনের সামগ্রিক ফল ছিল, দ্রুত দেশে দুর্ভিক্ষের আবির্ভাব হয়।

এ রকম পরিস্থিতিতে মূলধারার আমলাতন্ত্রের পরামর্শ মতাে মুজিব প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য আরেকটি সেল খােলেন। প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ব্যুরাে নামে আরেকটি কাঠামােও গড়ে তােলা হয় একই সময়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রমের যথার্থতা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য। মূলধারার আমলাতন্ত্রের এসব পাল্টা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তর নাগাদ পরিকল্পনা কমিশন কাগুজে বাঘে পরিণত হয় এবং এর সদস্যরাও একে একে তাদের আদি পেশায় ফিরে যান। ততদিনে দুর্ভিক্ষের অভিঘাতসহ বহু উপায়ে অর্থনীতির বিপর্যয় সম্পন্ন হয়। পরিকল্পনা কমিশনের ব্যর্থতার ওপর আলােকপাত করতে গিয়ে ঐ সময় (১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি) সাংবাদিক এনায়েতুল্লা খান সাপ্তাহিক হলিডেতে লিখেন :

All these they did in good faith as they had studied Economics in the Anglo-Saxon schools and earned that quaint radicalism that invariably goes with a lack of social consciousness. From Keynes to Galbraith or Marx to Sweezy, everyone is on their fingertips. But what they knew not are the country and the people, and the preconditions necessary for a socialist transformation.

Page 353

এ পর্যায়ে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকার ২৪ বছর পূর্ববাংলার অর্থনীতি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের মতােই ধনতান্ত্রিক। হঠাৎ করে সেখানে জাতীয়করণের অভিঘাত ছিল স্বাভাবিকভাবে ভূমিকম্পতুল্য। নানানভাবে অর্থনীতিকে বেসামাল করে তােলে তা। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তৈরির ক্ষেত্রে পাটখাত নিয়ে সরকারের আত্মঘাতি নীতি-কৌশল সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। যেখানে ১৯৭০ সালে পূর্বপাকিস্তান থেকে পাট রপ্তানি হয়েছিল ৩৫ লাখ বেল, ১৯৭৪-৭৫ সালে সেই রপ্তানির পরিমাণ নেমে আসে ১৫ লাখ বেলে।৫৭৯ এটা আবার বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তৈরি করে। ফলে সময়মতাে ইউরিয়া সার আমদানি করা যায়নি তখন। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ৬.খ উপ-অধ্যায়েও কিছুটা আলােচনা করা হয়েছে। স্বাধীনতাকালে বাংলাদেশের প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সামর্থ্য ছিল- যার মধ্যে ৮০ ভাগ হিস্যা ছিল পাট খাতের। কিন্তু ১৯৭২-৭৩ সালে পাট খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে মাত্র ১০৪ কোটি টাকার সমপরিমাণে।৫৮০

বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের জন্য জাতীয়করণ নীতিই স্পষ্টত দায়ী ছিল। কারণ এই নীতির কারণে এসময় বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বহিষ্কৃত হন। দ্বিতীয়ত, পাট রপ্তানিতে পাকিস্তান সরকার যে বাড়তি প্রণােদনামূলক সহায়তা দিত সেটা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার বন্ধ করে দেয়। সরকারি এই সিদ্ধান্তের সরাসরি সুবিধাভােগী ছিল ভারত। সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় পাটের প্রতিযােগী ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের পাট। শেষােক্তদের রপ্তানি কমে যাওয়া মাত্রই ভারত পুরাে বাজারের ওপর কর্তৃত্ব পেয়ে যায়। ফলে ভারতে পাটের চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে যায় এসময়। আর তার যােগান দিতে বাংলাদেশ থেকে স্রোতের মতাে পাটের চোরাচালান শুরু হয়। এসময় ভারতের বাজারে প্রতি বেল (১৮০ কেজি) পাটের দাম ছিল বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৩ টাকা বেশি।৫৮১ চোরাচালান, জাতীয়করণের ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলােতে সৃষ্ট দুর্নীতি, অবাঙালি ও রাজাকারদের ঘরবাড়ি দখল ইত্যাদির মাধ্যমে এসময় রাতারাতি একদল মানুষ ধনী হয়ে ওঠে। লুণ্ঠনের স্বার্থেই এরা ছিল আওয়ামী লীগপন্থী’ । অবাঙালিদের প্রায় ৬০ হাজার বাড়ি এ সময় সরকার সমর্থকরা অধিকারভুক্ত করতে পেরেছিলেন।৫৮২ ধ্বংস ও দারিদ্রের মাঝে

……………………………………………………………….

৫৭৯) দৈনিক বণিকবার্তা, পূর্বোক্ত।

৫৮০) বাংলাদেশ : ৭২ থেকে ৭৫, মুনির উদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, খােশরােজ কিতাব মহল, ১৯৮০, ঢাকা, পৃ. ৩২৯।

৫৮১) দেখুন, মােহাম্মদ সেলিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৬।

৫৮২) দেখুন, Ahmed Ilias, The Indian Emigres in Bangladesh, Shamsul Huque Foundation, Syedpur, Bangladesh, 2003, p. 139.

Page 354

সরকারি দলের একদল সমর্থকের এরূপ লুণ্ঠন প্রক্রিয়া সমাজে যে বিষক্রিয়ার জন্ম দেয় তা জাসদ গঠনে বিশেষ সামাজিক জ্বালানি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল।৫৮৩

ঐরূপ পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে সমাজের নিচুতলাতে আঘাত হেনেছিল নির্মমভাবে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছিল প্রতিদিন এবং তা ছিল বামপন্থী উত্থানের জন্য এক আদর্শ পটভূমি । মুজিব ও তাঁর দেশি-বিদেশি পরামর্শকরা পরিস্থিতির গভীরতা বুঝতে মােটেই বিলম্ব করেননি- জরুরি আইন জারি, চতুর্থসংশােধনী অনুমােদন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু, গণমাধ্যম দলন, বিচারবহির্ভূত হত্যা তীব্রতর করা সবই শুরু হয় স্বল্প সময়ের মধ্যে।৫৮৪ আর এসব শুরুর প্রয়ােজনে দোষারােপের জন্য প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া যায় জাসদের সশস্ত্র কার্যকলাপকে। যা বিশেষভাবে শুরু হয় ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের পর।

চতুর্থ সংশােধনী বিল পাস হওয়ার পরে ক্ষমতাসীন সরকার তার প্রথম প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয়ে পুলিশ প্রেরণ করে এবং পত্রিকাটির সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হয় প্রকাশনাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।৫৮৫ এইরূপ পদক্ষেপের মাধ্যমে এ পর্যায়ে জাসদের প্রতি সরকারের ‘জিরাে টলারেন্স’ নীতিরই প্রকাশ ঘটছিল। প্রশাসন ও প্যারামিলিশিয়া বাহিনীর হাতে বিশেষ ক্ষমতা আইন থাকায় সরকারের উল্লিখিত নীতি জনসমাজে এক ধরনের বন্যতা তৈরি করে। রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীকে যখন-তখন দীর্ঘ সময় ধরে আটক রাখা, নিপীড়ন কিংবা মেরে ফেলা ইত্যাদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ করে ফেলা হয়। যা পরােক্ষে স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত শাসকদের নৈতিক শক্তিকে প্রায় ধূলিসাৎ করে দেয়। কারণ এইরূপ অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তৈরি হয়েছিল।

এ সময় গণবাহিনীর মাধ্যমে জাসদ যে নতুনধারার সংগ্রাম’-এর সূচনা করে তাতে প্রধানত প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করা হতাে একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী

…………………………………………………….

৫৮৩) এ বিষয়ে বিশ্লেষণী আলােচনার জন্য দেখুন, আহমদ ছফা, পূর্বোক্ত।

৫৮৪) জরুরি অবস্থা জারি হয় চুয়াত্তরের ২৮ ডিসেম্বর। তার পর ২৮তম দিনে (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) পাস করিয়ে নেয়া হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রত্যাহারমূলক সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী। (এই সংশােধনী পাসের পর বিস্ময়করভাবে ঐদিনই সংসদ ভবনেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। প্রধান বিচারপতির বদলে স্পিকার আবদুল মালেক উকিল সেই শপথ কার্যক্রম পরিচালনা করেন-এও ছিল বিস্ময়কর।) এর ২৯ দিন পরে গঠিত হয় জাতীয় একক দল। একদলীয় এই ব্যবস্থার চার মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই পঁচাত্তরের ১৬ জুন চারটি দৈনিক ছাড়া সব দৈনিক সংবাদপত্র বন্ধের ঘােষণা আসে। এভাবে একাত্তর-উত্তর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি গণতন্ত্র বিরােধী এক অভিনব রূপে হাজির হয়। জনসমাজে।

৫৮৫) সাঈদ তারেক, ফিরে দেখা একাত্তর, সাপ্তাহিক এখন সময়, নিউ ইয়র্ক, ৮ ডিসেম্বর ২০০৯। লেখক ঐ সময় দৈনিক গণকণ্ঠে স্টাফ রিপাের্টার ছিলেন।

Page 355

রাজনৈতিক ভূমিকা মূল্যায়নের ভিত্তিতে। অতীতে এবং তখনও সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়ােজিত এতদাঞ্চলের কমিউনিস্ট পার্টিগুলাে যেভাবে ‘শ্রেণীশত্রু’ চিহ্নিত করত- গণবাহিনীর পদ্ধতি ও পদক্ষেপ ছিল তা থেকে প্রকৃতই পৃথক। মার্কসবাদী আবরণে পরিচালিত হলেও গণবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছিল মুখ্যত আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের লক্ষ্য করে। ফলে দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত জাসদ ও গণবাহিনীর পরিসরে এমন লােকও রাজনৈতিকভাবে এসে জড়াে হয় যারা স্রেফ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে বিরােধিতার জন্য একটি রাজনৈতিক মঞ্চ খুঁজছিলেন। জাসদের তাত্ত্বিক আদর্শের সঙ্গে যাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কোনাে সংস্রব ছিল না। এ সম্পর্কিত এক চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি লিখেছেন,

একাত্তরের দিনগুলােতে যারা সামরিক জান্তার দালালি করেছিল, তাদের অন্যতম ছিলেন মাওলানা মতিন। পুরানাে ঢাকার শ্রমিকদের মাঝে তার ভালাে সংগঠন ছিল । বিশেষ করে হােটেল-বেঁস্তোরা শ্রমিক ও পুস্তক বাধাই শ্রমিকদের মাঝে। মতিন এক পর্যায়ে জাসদে যােগ দিলেন এবং ঢাকা মহানগরী শাখার সভাপতি হয়ে গেলেন। এসময় ঢাকার এক পত্রিকায় একটি ছবি ছাপা হলাে, দেখা যাচ্ছে, একাত্তরের জুলাইয়ে মতিন পাকিস্তানীদের সমর্থনে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই ছবি ছাপা হওয়াতে জাসদ নেতত্ব ব্রিত হলেন। মতিনকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল পরে।৫৮৬

মাওলানা মতিনকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও জাসদের এইরূপ ‘ভুল’ কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা আকারে ঘটেনি। প্রথমত, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাৎক্ষণিক ক্রোধ; দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া এবং তৃতীয়ত ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’- এইরূপ বিবেচনা তাড়িত হয়ে অনেক এলাকাতে জাসদে এমন অনেক রাজনৈতিক চরিত্রের ঠাই হয় যারা দলটির কথিত আদর্শের সঙ্গে মানানসই অতীত বৈশিষ্ট্যের ছিলেন না। এ বিষয়ে রংপুর গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশার অলােক সরকার বলেন, হ্যা, এরূপ ঘটেছিল। ছাত্রলীগে আমাদের বিপক্ষ শক্তির প্রতি সমর্থনের পর আমাদের মাঝে মুজিবের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল । সেটা একটা কারণ ছিল। আবার ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার পর আমাদের টিকে থাকার একটা প্রশ্ন আসে। এসব বিবেচনায় জাসদে বিভিন্ন আদর্শের মানুষ ঢুকে পড়েছিল।৫৮৭ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে এরূপ ‘উদার’ সাংগঠনিক নীতি স্বাভাবিকভাবে দলটি সম্পর্কে বিভ্রান্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছিল।

……………………………………………………………

৫৮৬) মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭২।

৫৮৭) অলােক সরকার, অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার, ২৪ মার্চ ২০১৪, ঢাকা। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে তিনি আর জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নন বলে জানিয়েছিলেন।

Page 356

শুধু আওয়ামী লীগ ও মুজিব বিরােধিতার রাজনীতি জাসদের সামনে দ্বিতীয় সাংগঠনিক যে বিপদ তৈরি করে তা হলাে, ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টে মুজিবের মৃত্যুর পর গণবাহিনীর ক্যাডাররা যার যার সাংগঠনিক পরিসরে পুরােপুরি প্রতিপক্ষহীন হয়ে জনগণের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং এক জটিল ভবিষ্যতের মুখােমুখি হয়। এক্ষেত্রে আমরা আরও গভীরভাবে তখনকার পরিস্থিতি বােঝার জন্য পরবর্তী অধ্যায়ে দলটির কয়েকটি রাজনৈতিক জেলার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবাে। তবে তার আগে গণবাহিনীর সশস্ত্র কার্যক্রম সম্পর্কে বিশিষ্ট বামপন্থী তাত্ত্বিক হায়দার আকবর খান রনাের নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় :

সৈনিক সংস্থা বাদে গণবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটসমূহ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা দখল নয়, রক্ষীবাহিনী বা সরকারি কোন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করাও নয়, মুক্তাঞ্চল গঠন করাও নয়- তার কাজ ছিল গণআন্দোলনকে সশস্ত্র শক্তি দ্বারা রক্ষা করা বা সাহায্য করা; বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সশস্ত্র লােকদের হাত থেকে পাটি কর্মীদের রক্ষা করা। বিপ্লবী গণবাহিনীর কর্মকর্তাদের মত ছিল এ রকমই।

…কিন্তু যে সশস্ত্র গেরিলা সগ্রামের লক্ষ্য শুধু আত্মরক্ষা- তা সফল হতে পারে না এবং শেষপর্যন্ত চরমভাবে পরাজিত ও ধ্বংস হতে বাধ্য।…শুধু আত্মরক্ষার জন্য, তাও ব্যাপক জনগণের আত্মরক্ষা নয়-নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র তৎপরতা কখনােই সঠিক পথ নয়। এটা এক ধরনের বামপন্থী বিচ্যুতি এবং মােটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। এটা গণসংগ্রামকে সাহায্য করার চেয়ে ক্ষতি করে বেশি।

…সত্তর দশকের এই সশস্ত্র সংগ্রামগুলাে (গণবাহিনী ও অন্যান্য মাওবাদী সশস্ত্রতা) ছিল জনগণের চিন্তা চেতনার বাইরে, কিছু সংখ্যক ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত। এতে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, উদ্যোগ ও ভূমিকা ছিল না।৫৮৮ ভিন্নভাবে গণবাহিনী সম্পর্কে প্রায় অনুরূপ মূল্যায়ন জাসদ ছাত্রলীগের খ্যাতনামা সংগঠক মাহমুদুর রহমান মান্নারও। তাঁর মতে, ‘গণবাহিনী ছিল ক্রোধের ফসল। রাজনীতিপ্রসূত নয়। এটা ছিল হঠকারী। এভাবে রাজনীতি হয়।…এটা ছিল জাসদের ভুল রাজনীতি।৫৮৯

………………………………………………………..

৫৮৮) দেখুন, হায়দার আকবর খান রনাে, মাকর্সবাদ ও সশস্ত্র সগ্রাম, গণমুক্তি প্রকাশনী, ১৯৮২, ঢাকা, পৃ. ৬৯, ১৬-১৭২।

৫৮৯) মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশ প্রতিদিন, পূর্বোক্ত।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ