You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ঢাকায় ম্যারিগেল্লার ‘মিনিম্যানুয়েল’

৬.ক.        শিবদাস ঘােষের গাইড লাইন’ :

               বিপ্লবের স্তর যখন সমাজতান্ত্রিক

বাংলাদেশের শতকরা আশি ভাগ জমির অধিকারী কৃষক। তাদের সােশ্যালিজমের প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করে তা গ্রহণ করার দাবি জানালে আমার বিশ্বাস হাতের কাস্তে নিয়ে তাড়া করে আসবে। আমি এসব কথা বলছি, তাই বলে আপনারা ভাববেন না, আমি সােশ্যালিজমের বিরুদ্ধে। সােশ্যালিজমে আসার একটা পথ আছে।…কোন দেশে সমাজতন্ত্র সামাজিক বিপ্লব ছাড়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কত্ব ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কি সােশ্যালিস্ট দল? কেন বলা হচ্ছে। সােশ্যালিজম চাই? এটা কি প্রহসন? প্রহেলিকা? না প্রবঞ্চনা?

                  —ড, মাযহারুল হক;৪৯৪ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ।

I think there is a case for strong action and intervention when there is criminality and when the leaders are corrupt or behaving in a criminal fashion.

                 -Jay weatherill, রাজনীতিবিদ, অস্ট্রেলিয়ার শ্রমিক দলের নেতৃস্থানীয় সংগঠক;

পূর্ববর্তী উপ-অধ্যায়ে মুজিব বাহিনীর একটি নবপর্যায় হিসেবে রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রমের বিবিধ অভিমুখের সুনির্দিষ্ট কিছু অভিপ্রকাশ তুলে ধরা হয়েছে কেসস্টাডি রূপে। তারও আগে পাঁচটি ধারায় মুজিব বাহিনীর পুনর্গঠন ও

…………………………………………………………………

৪৯৪) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে।সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃত। ড. হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন যারা পাকিস্তান পর্যায়ে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বঞ্চনা বিষয়ে ‘টু-ইকোনমি’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এখানে উল্লিখিত তাঁর ভাষণের পূর্ণাঙ্গ বিবরণের জন্য দেখুন, মুনীর উদ্দীন আহমদ (সম্পাদিত) : বাংলাদেশ : ৭২ থেকে ৭৫, খােশরােজ কিতাব মহল, ১৯৮০, ঢাকা, পৃ. ১৫৬। বাহাত্তরের ২২ মে ড. হক মারা যান।

Page 304

পুনর্বিন্যাস-পরবর্তী ঘটনাবলির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্রও তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, মুজিব বাহিনী ও তার বিকাশ ধারার আরও অনেক কারণ ও ফলাফল এখনও অজানা। এ সম্পর্কে আরও অনুসন্ধান বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জাতীয় সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত, সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে সামরিক প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ও টানাপােড়েন, শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়া, ১৯৭৫ সালে জাসদ ও তাহেরের দ্বিতীয় দফা অভ্যুত্থান চেষ্টার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর জিরাে টলারেন্স নীতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা ও অত্র অঞ্চলে সামরিকায়নের আধিক্য মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীর পুরানাে অবিশ্বাস ও বৈরিতারই নানামুখী ফল ও ধারাবাহিকতা মাত্র। আর এতসব বহুমুখী দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাসের কারণে ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, সর্বোচ্চ মাত্রায় যে ঐক্য প্রয়ােজন ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হলাে, দেশটি একাধারে সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতিগত প্রায় সকল প্রশ্নে ক্রমে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়েছে।।ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের চেয়ে রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগতভাবে বিভক্ত (এবং পারস্পরিক রক্তাক্ত কলহে লিপ্ত৫৯৫) বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপ করা অনেকের পক্ষে সহজ হয়েছে। বিশেষত যারা চায়নি বাংলাদেশের সাবলীল ও শক্তিশালী উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য নিপীড়িত জাতিসত্তাকে মুক্তির পথ দেখাক।৪৯৬ আর এও বিস্ময়কর নয় যে, মুক্তিযুদ্ধকালেই অনেকেই বুঝতে

………………………………………………………………..

৪৯৫) বাংলাদেশের ঐ সময়কার পরিস্থিতি আঁচ করা যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্য থেকেও।

১৯৭৩-এর জুলাইয়ে সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে তিনি জানান, ‘৭২-এর ১ জানুয়ারি থেকে ‘৭৩- এর ১৫ জুন পর্যন্ত দুষ্কৃতকারীদের হাতে ৪ হাজার ৯২৫ জন নিহত হয়েছে দেশে। এর মধ্যে ‘৭২-এর ১ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী চার মাসে গুপ্তঘাতকদের হাতে প্রাণ হারায় ২০৩৫ জন মানুষ। প্রতিদিন প্রায় ১৭ জন!! আবদুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৪। উল্লেখ্য, এ সময় নিহতদের তালিকায় সরকারের রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সংখ্যা অধিক থাকলেও আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও আততায়ীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছিলেন। পুলিশ রিপাের্ট উদ্ধৃত করে অপর এক সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৪।সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে প্রায় ১১ হাজার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০টি। বিস্তারিত দেখুন, মুনির উদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ : ৭২ থেকে ৭৫, জাতীয় গ্রন্থ বিতান, ঢাকা, ১৯৮০, পৃ. ৩৩-৩৪। উপরােক্ত সব তথ্য উক্ত সময়ে অস্ত্রের ব্যাপক ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে নির্দেশ করে। এসময় রাজনীতিবিদদের মুখের ভাষাও অস্ত্রের ভাষাকে উৎসাহ যােগাচ্ছিল। খােদ শেখ মুজিবুর রহমান পার্লামেন্টে যে ভাষণগুলাে দেন (দেখুন, জাতীয়।সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সম্পাদনা : শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮, ঢাকা) তার অনেকখানি জুড়ে ছিল বিরােধীদের প্রতি তীব্র আক্রমণ।

৪৯৬) প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের অন্যান্য নিপীড়িত জাতিগুলাের সংগ্রামে উল্টো প্রতিক্রিয়া ঘটে। বিশেষভাবে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি এবং সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধে ‘র’ ও ভারতের সংশ্লিষ্টতা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে নিপীড়িত জাতিগুলাের সংগ্রামকে যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা আরেক কৌতূহলােদ্দীপক অনুসন্ধানের বিষয়। ১৯৭১-এ ‘র’ এবং ভারতীয়দের প্রতিরােধে শােচনীয় ব্যর্থতায় পাকিস্তানিরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশােধের নানান সুযােগ খুঁজতে শুরু করেছিল। এক্ষেত্রে তারা নাগা ও মিজোদের কিছু সংগ্রামী সংগঠককে সহায়তা ছাড়াও ১৯৮০ থেকে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট হয় পাঞ্জাবের খালিস্তান আন্দোলনে। যার চূড়ান্ত পরিণতিতে এক পর্যায়ে স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালায় ভারতীয় বাহিনী এবং তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৮৪ সালে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী।।অনেক ভারতীয় নীতিনির্ধারক এখনও মনে করে, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু ছিল শিখদের মাধ্যমে আইএসআই-এর একাত্তরের প্রতিশােধ । যদিও তার স্বপক্ষে কোনাে প্রমাণ দিতে পারেনি আজও ভারতীয়রা। অন্যদিকে খালিস্তান আন্দোলনে আইএসআই-এর সংশ্লিষ্টতার প্রতিশােধ নিতে গিয়ে ‘র’ ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়ে করাচি ও বালুচিস্তানে। করাচিতে সিন্ধি, পশতু ও মােহাজিরদের ত্রিমুখী সংঘাত ও বালুচিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনে ‘র’ গভীরভাবে সম্পৃক্ত।হয় সত্তরের দশক থেকে। সিন্ধি নেতা জি এম সাঈদকে তারা সরাসরি হাত করে, আর বালুচদের হাত করার ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করে আফগান গােয়েন্দা সংস্থা ‘খাদ’ (KhAD)। এমনকি শ্রীলংকার তামিল সংকটেরও তীব্রতম অংশের সূচনা বাংলাদেশের।মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট । মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত যখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে আসা-যাওয়ার সময় তার আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ করে দেয় তখন শ্রীলংকা তাদের কাতুনায়ের বিমানবন্দরে পাকিস্তানের বিমানকে জ্বালানি সহায়তা দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বিরাগভাজন হয়। ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে সংবেদনহীনতা’র ধুয়াে তুলে এর পরই তামিলদের সহযােগিতার জন্য ‘র’কে দায়িত্ব দেন ইন্দিরা। আবার তার পুত্র রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে শান্তিরক্ষার জন্য সেখানে পাঠান ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরিণতিতে এক পর্যায়ে তামিল আত্মঘাতিদের হাতে নিহত হন তিনি। অন্যদিকে মুজিব নিহত হওয়ার ঘটনাবলীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভারতের গােয়েন্দা ও রাজনৈতিক কাঠামােতে বিবিধ মত দেখা গেলেও এক পর্যায়ে এটা লক্ষ্য করা যায়, তারা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে চাপে ফেলার নীতি নিয়েছে। কারণ এখানকার পরিস্থিতি আগের মতাে আর অবারিত ছিল না তাদের গােয়েন্দা তৎপরতার জন্য। সেই আলােকে তাৎক্ষণিকভাবে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি সংগ্রামীদের সঙ্গে সামরিকভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে; বিদ্যুৎগতিতে বিস্তৃতি পায় শান্তিবাহিনীর তৎপরতা। যার পরিণতিতে বাংলাদেশ সরকারও অত্র অঞ্চলে ব্যাপক সামরিকায়ন ঘটায়। এভাবে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ভারত-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সহিংসতা যেমন বেড়েছে তেমনি প্রকৃত জাতিগত সংগ্রামীদের জন্য স্বাধীনভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।

Page 305

পেরেছিলেন, মুজিব বাহিনী’কে দিয়ে এরূপ কোনাে বিশেষ কাজ করানাে হবে । তারই নিরুপায় স্বীকারােক্তি দিচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকার এভাবে : ‘এই বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে মনে হয়েছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বেশি আগ্রহী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ভূমিকা নিয়ে। স্বাধীন দেশে যে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা থাকবে। সে বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।…এই বাহিনী কোন কোন কাজ বা দায়িত্ব পালন করবে সে সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, মুজিব বাহিনীকে নানানভাবে ব্যবহার করা হবে ।…চূড়ান্ত যুদ্ধের সময়ও আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল, এই বাহিনীর শক্তি অটুট রাখা হচ্ছে যাতে দেশ স্বাধীন হওয়ার

Page 306

পর তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।”৪৯৭ রক্ষীবাহিনী ও যুবলীগ যে এ কে খন্দকারের অনুমানকৃত ভূমিকা পালন করেছিল তা অস্পষ্ট নয়। প্রশ্ন ওঠে, ‘জাসদও কী ঐ লক্ষ্যেই গঠিত হয়েছিল। এর কোন স্পষ্ট উত্তর দেওয়া কঠিন। লক্ষ্যণীয়, জাসদের সভাপতি করা হয় মেজর জলিলকে- যিনি যুদ্ধোত্তর দেশে ভারতীয় ভূমিকার সবচেয়ে কঠোর সমালােচক ছিলেন এবং তাঁকেই আবার সর্বাগ্রে এই দল ছাড়তে হয়েছিল। উপরন্তু জাসদের কোনাে শাখা-প্রশাখাতেই জলিলকে আর স্মরণ করা হয় না এখন।

তবে ‘মুজিব বাহিনী’র স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কাঠামােগত বিকাশকে যেভাবেই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হােক না কেন- এই সংস্থা কিংবা রক্ষীবাহিনী ও জাসদের তাবৎ সংগঠক ও কর্মীদের রাজনৈতিক-সামরিক ভূমিকাকে এক কাতারে ফেলে মূল্যায়ন করতে যাওয়া গুরুতর এক ভ্রান্তি। কর্মী’ ও ‘নেতাদের ভূমিকাকে এক্ষেত্রে পৃথকভাবে দেখার অবকাশ রয়েছে। মুজিব বাহিনী পর্যায়ে যেমন রক্ষীবাহিনী ও জাসদ পর্যায়েও তেমনি সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য-পরিকল্পনা সম্পর্কে কর্মীদের স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এসব নেতৃবৃন্দ কাদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন তাও মাঠ পর্যায়ের কম কর্মী-সংগঠকই জানতেন। এ রকম অস্পষ্টতা নিয়েও আন্তরিকতার সঙ্গে একাত্তরে যুদ্ধে যেতে মােটেই দ্বিধান্বিত ছিলেন না তাঁরা; আবার বাহাত্তরে ‘এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে থাকার মােহ ত্যাগ করেই ‘সমাজতন্ত্র’-এর ঝুঁকিপূর্ণ বীরােচিত সংগ্রামে নামতেও পিছপা হননি। সবই ঘটেছিল ‘শােষণ মুক্তির দুর্নিবার আকাক্ষা থেকে। যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তখন বিশ্বব্যাপী তরুণদের প্রধান রাজনৈতিক প্রবণতা এবং যে প্রবণতায় ব্যাপকভাবে মিশেল ঘটে গিয়েছিল আবেগ ও রােমান্টিকতারও। জাসদের কর্মীরাই প্রথমবারের মতাে সমাজতন্ত্রকে রাজনৈতিক

………………………………………………………………..

৪৯৭) বিস্তারিত দেখুন, এ কে খন্দকার ও অন্যান্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৮ ও ১২০।

৪৯৮) যে প্রবণতার স্রষ্টা এশিয়ায় গণচীন ও ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ আমেরিকায় কিউবা। তবে তাদের পাশাপাশি জাসদ বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হয় শ্রীলংকার জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’ [পিপলস্ লিবারেশন ফ্রন্ট]-এর উত্থানে। ১৯৬৫ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় পুরােপুরি জাসদের মতাে তরুণ একদল সিংহলী সংগঠকের মাধ্যমে যাদের নেতা ছিলেন রােহানা উইজেউইরা। উইজেউইরা’র জন্ম ১৯৪৩-এর ১৪ জুলাই; মৃত্যু (আটকাবস্থায় গুলিতে) ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর। উইজেউইরার নেতৃত্বে জেভিপি ১৯৭১ সালে এবং ১৯৮৭ সালে দুই দফা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিল। এর মধ্যে কেবল প্রথম ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরই তাদের ১৫ হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে আরও

দেখুন :

http://www.google.com.bd/search?q=janata+Vhimukti+peramuna+Sri+lan ka&ie=utf-8&oe=utf-8&rls=org.mozilla:en-GB:official&client=firefox-a&source=hp&channel=np&gws_rd=cr

Page 307

আদর্শ হিসেবে এ দেশের তৃণমূলে বিশেষ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন- যেটা মস্কো ও পিকিং ঘরানার সমাজতন্ত্রীরা বহু আগে কার্যক্রম শুরু করেও পারেননি।

সাধারণভাবে দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় জাসদের দুটি পদক্ষেপ ছিল বিস্ময়কর ও কৌতূহলােদ্দীপক। সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলােকপাত করা এ পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক হবে। বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধে যায় এবং যুদ্ধের পরে যখন জাসদ গঠিত হয় তখন এ দেশে মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাও সেতুংয়ের আদর্শের অনুসারী দলের সংখ্যা অনেক। কৃষক ও শ্রমিকদের মাঝে এসব দলের সাংগঠনিক ভিত্তিও ছিল উল্লেখযােগ্য। এসব বাম দল সেসময় যদিও মস্কো ও পিকিং ঘরানায় বিভক্ত ছিল। কিন্তু অধিকাংশের কর্মসূচি ছিল ‘শ্রমিক শ্রেণির পার্টির নেতৃত্বে দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব তথা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন করা । পিকিংপন্থী দলগুলাে একে ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করতাে। কিন্তু জাসদ সে সময় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর কর্মসূচি নিয়ে হাজির হয়। বাংলাদেশের সমাজ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমানের বিশ্লেষণকে দলটি এসময় তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করে। যাতে বলা হয়, এ দেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে গেছে। ফলে এখানে ‘বিপ্লবের স্তর হবে সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক নয়। চিরায়ত অর্থে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে থাকে প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, পুরানাে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিলােপ সাধন, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা, উৎপাদনের উপায়ের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। ঘােষিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী জাসদের রাজনৈতিক কর্মসূচিসমূহ এসব লক্ষ্য অর্জনের দিকেই ধাবিত হওয়ার কথা।

লক্ষ্যণীয় যে, এসময় জাসদের নেতৃত্ব, সংগঠক ও কর্মী পর্যায়ের অধিকাংশ ছিল ছাত্র কিংবা যুবক। যারা প্রধানত ছাত্রলীগ থেকে মুজিব বাহিনীতে গিয়েছিল ‘মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করতে। ইতােমধ্যে আমরা দেখেছি, কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ও শারীরিকভাবে মােকাবেলাও তাদের অপ্রকাশ্য শক্তিশালী লক্ষ্য করে তােলা হয়েছিল প্রশিক্ষণকালে কিংবা তার আগে-পরে । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেল সেই একই শক্তি বিভিন্ন নতুন নামে আবির্ভূত হয়েছে ‘সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। যুদ্ধোত্তর সমাজে যখন তরুণরা প্রকৃতই একাত্তর পূর্ব সময়ের চেয়ে ভিন্ন এক বাংলাদেশ দেখতে ইচ্ছুক এবং যখন এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে মার্কসবাদ ও মাওবাদ তরুণদের চুম্বকের মতাে আকর্ষণ করছে, সর্বোপরি যখন নকশালবাড়ির আগুনে পুড়ছে পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ- সেসময় মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের ‘জাসদ ও অন্যান্য নামে সমাজতন্ত্রের রণধ্বনি অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছেই ছিল বিস্ময়ের বিষয়। কেউ কেউ তাতে শংকিতও হয়ে ওঠেন। প্রলেতারিয়েত (যারা শ্রম বিক্রি করে চলে) আর বুর্জোয়া (যারা উৎপাদনের উপায়ের মালিক)-এর

Page 308

মাঝখানের পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণি (Petite bourgeoisie; যারা শ্রমও বিক্রি করে না, উৎপাদনের উপায়েরও মালিক নয়- মূলত মধ্যবিত্ত)-এর ‘সমাজতন্ত্র’-এর আওয়াজকে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে মার্কস-এঙ্গেলস ‘প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন৪৯৯ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদের ব্যানারে এবং ক্ষেত্র বিশেষে মুজিবপন্থী অপরাপর ছাত্র-যুবদের ‘সমাজতন্ত্র’-এর ধ্বনিকেও সেসময় একইভাবে সমালােচনা করেছিল মস্কো ও পিকিং ঘরানার বিদ্যমান বামপন্থী দল ও গ্রুপগুলাে। অনেক বাম তাত্ত্বিকের (পরােক্ষে জাসদকে উদ্দেশ্য করে উত্থাপিত) এই প্রশ্নটি বিশেষ যথার্থই প্রতীয়মান হয় যে, সমাজে সামন্ততন্ত্রের জের বা অবশেষ বিদ্যমান এমন একটি দেশে, যার আবার অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও স্বাধীনতা খুবই সীমিত, রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে দালাল চরিত্রের রাজনীতিবিদ ও আমলারা, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অশিক্ষিত, পুঁজিবাদ অননত, সাংস্কৃতিক ও কৎকৌশলগত মান বেশ নিচ এবং কষি বিপ্লব অসম্পূর্ণ সেদেশে এ মহর্তে সমাজতন্ত্রের কর্মসচি গ্রহণ আদৌ মার্কসবাদ-লেনিনবাদসম্মত কি না? এইরূপ সমালােচকদের মতে, সমাজের অর্থনৈতিক গঠনে পুঁজিবাদের প্রাধান্য দেখা দিলেই তা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি নির্দেশ করে না। কারণ পুঁজিবাদের বিকাশ আর বিকশিত পুঁজিবাদ এক বিষয় নয়। অন্যান্য অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশের মতােই এখানকার শ্রমজীবী জনগণ ভুগছে কেবল পুঁজিবাদী বিকাশের জন্য নয়। তার বিকাশের অসম্পূর্ণতার জন্যও বটে।৫০০

উল্লেখ্য, আখলাকুর রহমানের মাধ্যমে উপস্থাপিত জাসদের উপরিউক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তি আরও বিকশিত ও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে অনেক পরে জাসদ থেকে সৃষ্ট নতুন দল বাসদ (খালেক)- তাদের বাংলাদেশের উৎপাদন পদ্ধতি ও রাষ্ট্র চরিত্র শীর্ষক প্রকাশনায়। এই দলিলে (পৃ. ৭৬-৭৭) বাসদ স্পষ্টভাবে দাবি করে, বাংলাদেশ একটি জাতীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্র, এখানে উৎপাদনের চরিত্র ধনতান্ত্রিক এবং বিপ্লবের মূল প্রশ্ন হলাে বুর্জোয়া শ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ। জাসদ এবং পরে বাসদের উৎপাদন পদ্ধতি’ ও ‘বিপ্লবের স্তর সম্পর্কিত উপরিউক্ত বিশ্লেষণের সঙ্গে হুবহু মিল লক্ষ্য করা যায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এসইউসি আই’-এর তাত্ত্বিক দলিলগুলাের। বিশেষত ১৯৭০ সালের নভেম্বরে এসইউসি আই কর্তৃক পুস্তি কাকারে প্রকাশিত শিবদাস ঘােষের ‘ভারতের কৃষি সমস্যা ও চাষি আন্দোলন’-এর সঙ্গে ১৯৭৪-এর ডিসেম্বরে জাসদের তাত্ত্বিক নেতা আখলাকুর রহমানের নামে প্রচারিত ‘বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ (সমীক্ষণ

………………………………………………………..

৪৯৯) মাকর্স-এঙ্গেলস্ নির্বাচিত রচনাবলি, খণ্ড ১, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৯, পৃ. ১৭০-১৭১।

৫০০) দেখুন, এম আর চৌধুরী, বাংলাদেশ নয়া উপনিবেশিক অনুন্নত পুঁজিবাদী, প্রকাশক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রক্রিয়া, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃ. ১০৮।

৫০১) দেখুন, বাংলাদেশের উৎপাদন পদ্ধতি ও রাষ্ট্র চরিত্র, বাসদ, সেপ্টেম্বর ১৯৮৩, ঢাকা।

Page 309

পুস্তিকা, ঢাকা) শীর্ষক প্রকাশনার ছিল আশ্চর্য রকমের মিল। জাসদ চুয়াত্তরে যা বলেছে তা ‘এসইউসি আই’ নেতা শিবদাস ঘােষের এতদসংক্রান্ত প্রকাশিত বক্তব্যের অনুকরণ মাত্র। যদিও আখলাকুর রহমানের বিশ্লেষণ শিবদাস ঘােষের চেয়ে অনেক বিস্তারিত ছিল।

উল্লেখ্য, ইতােমধ্যে এটা তুলে ধরা হয়েছে (৩.গ উপ-অধ্যায়ে), তিয়াত্তরের আগস্টে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে শিবদাস ঘােষের কয়েক দফা রাজনৈতিক বৈঠক হয়েছিল এবং তা জাসদের তাত্ত্বিক কাঠামাে নির্মাণে পরবর্তীকালে স্পষ্টত প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে শিবদাস ঘােষের ‘এসইউসি-আই কেন ভারতবর্ষে একমাত্র সাম্যবাদী দল’ শীর্ষক পুস্তিকাটি এসময় জাসদ নেতৃত্বকে বিশেষভাবে চমকিত করেছিল। জাসদের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য তাত্ত্বিক দলিল তৈরির ক্ষেত্রেও শিবদাস ঘােষের বক্তব্যকে ‘গাইডলাইন হিসেবে ধরা হচ্ছিল। এক্ষেত্রে জাসদ ও গণবাহিনীর ঐ সময়কার তরুণ কর্মী মহিউদ্দিন আহমদ-এর বক্তব্য প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারে। তিনি লিখেছেন,

…জাসদের মধ্যে যে গােপন পার্টি প্রক্রিয়া চালু হয় এবং তার মধ্য থেকে যে রাজনৈতিক সাহিত্য প্রকাশিত হতে থাকে, তাতে এসইউসি আই’র রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও বক্তব্যের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট।…এসময় জাসদের পক্ষ থেকে একটি বিশ্লেষণমূলক রচনা প্রকাশিত হয়- ‘কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’। রচয়িতা হিসেবে আখলাকুর রহমানের নাম ছিল। যদিও বইটি ছিল জাসদ নেতৃত্বের সম্মিলিত চিন্তার ফসল। লেনিনের গবেষণাধর্মী রচনা রাশিয়ায় ধনতন্ত্রের বিকাশ’-এর আদলে এটা লেখা হয়।৫০৩

উপরিউক্ত অভিজ্ঞতার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিক হলাে, জাসদ যখন নিজেকে কেবল ‘গণসংগঠন হিসেবে মূল্যায়ন করছে এবং যখন সে কেবল ‘পার্টি’ গড়ে তােলার কথা ভাবছে- তার বহু আগেই সে বিপ্লবের রণনীতি নির্ধারণ করে প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়ে দেয়, বাংলাদেশে বিপ্লবের স্তর হবে ‘সমাজতান্ত্রিক’! সুতরাং সংগ্রামের এইরূপ ‘স্তর’-এ ‘পুরানাে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিলােপ সাধন’-এর জন্য তরুণদের সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কী করণীয়ের কথা বলতে পারে সে! দলীয় মুখপত্র ‘সাম্যবাদ’-এর প্রথম সংখ্যাতেই তাই জাসদ ঘােষণা করে ‘গণতান্ত্রিক পথে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করা সম্ভব নয়।৫০৩

…………………………………………………………….

৫০২) দেখুন, মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৪।

৫০৩) দেখুন, সাম্যবাদ, সংযুক্তি বারাে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!