রক্ষীবাহিনী, সামরিক আমলাতন্ত্র ও একটি অসফল অভ্যুত্থান’-এর কাহিনী
তিনি (মুজিব) আমার সঙ্গে ব্যাপারটা আলােচনা করলেন এবং আমাকে একমত দেখে এই বাহিনী গড়ে তােলার আদেশ দিলেন। বাহিনীর নাম দিলেন তিনি জাতীয় রক্ষীবাহিনী। আদেশ দিলেন, শুরুতে এতে ১২ হাজার অফিসার ও জওয়ান থাকবে। এর সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য একে তিনি নিজ কমান্ডের অধীনে রাখলেন।…আমাকে অনুরােধ করলেন, এ বাহিনীকে সংগঠিত, প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত করতে সাহায্য করার জন্য।… সৌভাগ্যক্রমে আমার সরকার বাংলাদেশ সরকারের এই অনুরােধ মেনে নিল এবং বাহিনীর ‘লিডার’রা আমাদের স্থাপনায় প্রশিক্ষণ লাভ করলাে।
-মেজর জেনারেল উবান ৫২২
a coup d’état is usually a violent political engineering.
-Wikipedia
মুজিব বাহিনী থেকে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি এবং তার সঙ্গে কাঠামােগতভাবে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ইতােমধ্যে ৫.খ উপ-অধ্যায়ে যেসব বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে- বলা বাহুল্য, তা ছিল নীতিগত সম্মতির ভিত্তিতেই। ভারতীয় নিয়মিত বাহিনী যেদিন বাংলাদেশ থেকে চলে যায় সেদিন থেকেই রক্ষীবাহিনী মােতায়েন করা হয়।৪২৩ যদিও তার আইনগত ভিত্তি তৈরি হয় আরও অনেক পরে। মুজিব বাহিনী সৃষ্টির পেছনে যেসব ‘উদ্দেশ্য কাজ করেছে (পূর্ববর্তী অধ্যায় ও উপ- অধ্যায়গুলােতে উল্লিখিত) তার অধিকাংশই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশেও জরুরি থাকায় মুজিব সরকার এবং অনুরােধপ্রাপ্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্বের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকে। মাত্র তিন বছরে সাতটি অফিসার ব্যাচের নিয়ােগ এবং তাদের জন্য দেশব্যাপী নিজস্ব স্থাপনার বিস্তার থেকে স্পষ্ট, নীতিনির্ধারকরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগােচ্ছিলেন। এক্ষেত্রে যখন আইনগত ভিত্তি তৈরিতে হাত দেওয়া হয় তখন দেখা গেল মৌলিক মানবাধিকার চেতনা পুরােপুরি অবজ্ঞার শিকার। অথচ যা ছিল নবীন দেশটির অন্যতম সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা।৪২৪
……………………………………………………………….
৪২২) মেজর জেনারেল উবান, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪১-১৪২।
৪২৩) en.wikipedia.org/wiki/National_Defence_Force, ১৮,০৯.২০১২ তারিখে প্রদর্শিত বিবরণী থেকে উদ্ধৃত। উইকিপিডিয়াতে এই ঠিকানায় রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে অনেক তথ্য রয়েছে- যা বাংলাদেশে আজও স্বল্প প্রচারিত ।
৪২৪) ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। প্রায় একই সময়ে রক্ষীবাহিনীকে গড়ে তােলা ও এর অপারেশনাল কার্যক্রমও চলছিল। এটা খুবই কৌতুককর যে নিদারুণ স্ববিরােধিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তাদের শাসন প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। রক্ষীবাহিনীকে যখন তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে তখনি রাষ্ট্রের সংবিধানের একেবারে প্রথম পাতায় প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, …অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে…এমন এক শােষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার…নিশ্চিত হইবে।’
Page 258
রক্ষীবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক বিস্তৃতি আরেকভাবেও স্বাধীনতার চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সামগ্রিকভাবে পুরাে দেশের জনগণ এবং বিশেষভাবে পূর্ববাংলার মানুষ সামরিক আমলাতন্ত্রকে দেখতে পাচ্ছিল গণতন্ত্র বিকাশের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। শেখ মুজিবুর রহমানকেও একাত্তর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক জীবনে সামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে বিস্তর হেনস্তা হতে হয়েছে। এই দুটি কারণে মনে করা হচ্ছিল, নবীন দেশটিতে সকল উপায়ে সামরিক আমলাতন্ত্রের সংস্কার সাধিত হবে এবং হয়তাে ভিন্ন ধাঁচের এক প্রতিরক্ষা কাঠামাে দেখা যাবে। এখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম শর্ত ছিল উৎপাদন বিচ্ছিন্ন সেনা আমলাতন্ত্রের বিলােপ বা সংস্কার। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রক্ষীবাহিনীর গঠন এবং মূল সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন উভয় ক্ষেত্রে সামরিক আমলাতন্ত্রের নির্মাণযজ্ঞ যেভাবে এগােতে থাকে তা ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিস্ময়করভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে এসব উদ্যোগের কোনাে পর্যালােচনামূলক প্রতিবাদ ছিল না; বরং সামরিক বাহিনীতে লে. কর্নেল জিয়াউদ্দীন ও লে. কর্নেল আবু তাহের প্রমুখ তাৎক্ষণিকভাবে পেশাগত ঝুঁকি নিয়ে এইরূপ প্রবণতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সূচিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিতে উপনিবেশিক ধাঁচের সামরিক আমলাতন্ত্র পুনর্গঠন নয়- চাইছিলেন এর কাঠামােগত বিকল্প । রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর হাতে এসব ভিন্নমত দমন করা হয়। ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক থাকাকালে সংবাদপত্রে ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে কর্নেল জিয়াউদ্দীনকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছিল।৪২৫ যদিও বরখাস্তের আদেশ জারি হওয়ার আগেই ব্রিগেড সদরদপ্তরে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে
………………………………………………………………..
৪২৫) নিজস্ব মননশীলতার জন্য দালাইলামা’ নামে খ্যাত জিয়াউদ্দীনের বরখাস্তের আদেশ ছিল সেই সময় সেনাবাহিনীতে ভূমিকম্পতুল্য। আপন ব্যক্তিত্বে তিনি তখনকার তরুণ সেনা অফিসারদের মােহাবিষ্ট করে তুলেছিলেন। যে লেখার জন্য তাঁকে সেনাবাহিনী ছাড়তে হয়। তার শিরােনাম ছিল ‘Hidden Prize.’ ১৯৭২ সালের ২০ আগস্ট এটি প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি ভারতের সঙ্গে মুজিব সরকারের গােপন চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তােলা ছাড়াও শেখ মুজিবুর রহমানকে ইঙ্গিত করে লিখেন, We fought without him and won, and now if need be, we will fight again, nothing can beat us. We can be destroyed but not defeated. (এই লেখার পুরাে বিবরণ দেখুন সংযুক্তি উনিশে)। সেনাবাহিনী ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই ঘনিষ্ঠ সেনা অফিসারদের একটি চিরকুটে জিয়াউদ্দীন প্রতীকী বার্তা পাঠান, ‘আমি সীমান্ত অতিক্রম করেছি।’ সৈনিক পরিমণ্ডল থেকে জলিল, জিয়াউদ্দীন ও তাহেরের বিদায় সেসময় পুরাে সেনাবাহিনীকে একটি প্রশ্নে তীব্রভাবে ভাবিয়ে তােলে, ‘দেশ চলেছে কোথায়?’ উল্লেখ্য, পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে জিয়াউদ্দীনের ছদ্মনাম ছিল ‘কমরেড হাসান।
Page 259
জিয়াউদ্দীন সেনানিবাস ছেড়ে যান। তার সেনাবাহিনী ত্যাগের কিছুদিন পরই লে. কর্নেল আবু তাহেরও একই পথ অনুসরণ করেন।৪২৬
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পাকিস্তান ধাচের এডভেঞ্চারধর্মী সেনা আমালতন্ত্রের সুশৃঙ্খল বিকল্প হিসেবে রক্ষীবাহিনী গড়ে তােলা হচ্ছিল- এমন ভাবনার পক্ষেও রক্ষীবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ায় কোনাে ধরনের বাস্তব লক্ষণ মেলেনি বরং ১৯৭৫ সালে নভেম্বরে এবং পরেও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী অভ্যুত্থানধর্মী ঘটনাবলিতে রক্ষীবাহিনী থেকে আত্মীকত কর্মকর্তাদের ব্যাপক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ এ লেখার বিভিন্ন স্থানেই তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ছাড়াও, লে. কর্নেল হাওলাদার, ক্যাপ্টেন দীপক প্রমুখ রক্ষীবাহিনী কর্মকর্তা ১৯৭৫-এর তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শেষােক্তজনই ৪ নভেম্বর সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বঙ্গভবনে ঢুকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদকে গুলী করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।৪২৭ তেসরা নভেম্বরের অসফল অভ্যুত্থান যে ভারতীয় সমর্থনপুষ্ট হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল তার পেছনে প্রধান প্রমাণ হিসেবে কাজ করে ঐ অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনী থেকে সদ্য রূপান্তরিত সেনা পদাতিক ব্যাটালিয়নগুলাের অপারেশনাল উপস্থিতি৪২৮ ঢাকার মিরপুরের ও
…………………………………………………………………
৪২৬) তবে সামরিক বাহিনী থেকে পদত্যাগ করলেও তাহের সরকারি চাকরি ছাড়েননি। সেনাবাহিনী ত্যাগের পর সরকারি ড্রেজার সংস্থার পরিচালক হন তিনি এবং এই পদে থেকেই জাসদ রাজনীতি ও গণবাহিনীর কার্যক্রমে শামিল ছিলেন ১৯৭৫-এর নভেম্বরে আটক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
৪২৭) মেজর নাসির উদ্দিন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩০-১৩২।
৪২৮) এই অভ্যুত্থান ‘বাকশাল ও ভারতীয় সমর্থনপুষ্ট হিসেবে চিত্রিত হওয়ার নিম্নোক্ত কারণসমূহ (এককভাবে বা যৌথভাবে) চিহ্নিত করা যায় :
ক. অভ্যুত্থানের পূর্বে এর সংগঠকরা বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। যার মধ্যে বাকশালও ছিল। দেখুন, মেজর নাসির উদ্দিন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৫ ও আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৭। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যে যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করবে সে বিষয়টি অক্টোবরেই নির্ধারিত ছিল। দেখুন, সিপিবি, তৃতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, ঢাকা, পৃ. ৩৫-৩৬।
খ. খালেদ মােশাররফ ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে, ‘র’-এর পাকিস্তান শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এস শংকর নায়ারের (যিনি কর্নেল মেনন ছদ্মনাম নিয়ে চলতেন) সঙ্গে মােশাররফের সত্তর-একাত্তরে যুদ্ধকালীন যােগাযােগ। অশােকা রায়নার ইনসাইড র’গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঐ সময় শংকর নায়ার বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে অবিরাম যােগাযােগের জন্য অনেক ‘নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ খােলেন। খালেদ মােশাররফকে শংকর নায়ারের একজন ‘কেন্দ্র প্রধান হিসেবে অভিহিত করেছেন রায়না। দেখুন, অশোকা রায়না, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬২। এমনকি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে যে খালেদ ও নূরুজ্জামান ভারতে পালিয়ে যাবেন তাও নির্ধারিত ছিল। (আনােয়ার উল আলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৭)
গ. তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান ‘ভারতপন্থী’ ক্ষমতা দখল প্রচেষ্টা হিসেবে চিত্রিত হওয়ার অন্তত আরও একটি সুনির্দিষ্ট কারণ ঘটিয়েছিলেন ঢাকাস্থ তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন। তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বঙ্গভবনে ক্ষমতার নাটকীয় পরিবর্তন যজ্ঞে, বিশেষ করে খালেদের সেনাপ্রধান হওয়া এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করার প্রক্রিয়ায় সমর সেন সক্রিয় ছিলেন বঙ্গভবনে। ৫ নভেম্বর সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে দেখুন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিক হিসেবে তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়টিতে বঙ্গভবনে উপস্থিত থাকার সুযােগ পেয়েছিলেন। উপরােক্ত গ্রন্থে তিনি তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
ঘ. তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের খবর প্রচারে ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরিক্ত উচ্ছাসও এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি জনমতকে প্রভাবিত করেছিল। দেখুন, অ্যান্থনী মাসকারেণহাস, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৬।
ঙ. উপরােক্ত প্রসঙ্গে আরেকটি কারণের দিকে আলােকপাত করেছেন পিটার কাস্টার্স তাঁর IRONIES OF A PALACE INTRIGUE : THE SHORT-LIVED PUTSCH STAGED ON NOTEMBER 3, 1975 শীর্ষক রিপাের্টে। এটি এখনও অপ্রকাশিত। কারাগারে থাকাবস্থায় তেসরা নভেম্বরের অভ্যুথানের সঙ্গে যুক্ত বিমানবাহিনীর সাত কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে পিটার এই রিপাের্টটি লিখেন ১৯৭৭ সালে। সেখানে তিনি বলেছেন,
… It is true that during the month of October, pro-Indian groups and political parties had started leafleting around Dhaka. And Khaled Mosharraf apparently did have indirect affiliations with the former government party, the Awami League, via members of his family.
তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক যােগাযােগ বিষয়ে অভ্যুত্থানকারী পাইলটদের থেকে পাওয়া পিটারের রিপাের্ট, মেজর নাসিরের উল্লিখিত তথ্য এবং অক্টোবরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক উদ্যোগসমূহ স্পষ্টত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
Page 260
সাভারের ৫টি রক্ষী ব্যাটালিয়নকে এই অভ্যুত্থানে সংশ্লিষ্ট করা হয়। তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান তার রক্ষীদের নিয়ে কতটা উদ্দীপনার সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন তা উপলব্ধির স্বার্থে এ পর্যায়ে মেজর নাসির উদ্দিনের ভাষ্য থেকে নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলাে। উল্লেখ্য, মেজর নাসির। ছিলেন ঐ অভ্যুত্থানের আরেকজন মূল সংগঠক ও প্রাথমিক পরিকল্পনাকারীদের একজন । তিনি লিখেছেন :
অফিসের ইন্টারকমে সিজিএস (খালেদ মােশাররফ) আমাকে ঢেকে পাঠালেন। রুমে প্রবেশ করেই দেখা আরেক আগন্তুক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের সঙ্গে ।.. কুশল বিনিময়ের পর খালেদ আমাকে বললেন, রক্ষীবাহিনীর শক্তিকে অংক থেকে (অভ্যুত্থান পরিকল্পনা থেকে) বাদ দিচ্ছ কেন? প্রয়ােজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য তারা তাে প্রস্তুত।…এবার নূরুজ্জামান যুক্ত হলেন আলােচনায়। তিনি বললেন, প্রয়ােজনে ঢাকার ৫টি ছাড়াও রক্ষীর অপর
Page 261
ব্যাটালিয়নগুলাের সহায়তা দেওয়া যাবে। তবে যা করার সহসাই করে ফেলতে হবে। কেননা, রক্ষীবাহিনীর কর্তৃত্ব একবার পুরােপুরি হাতছাড়া হলে তা ফিরে পাওয়া দুঃসাধ্য হবে। নুরুজ্জামান আরও বলেন, তিনি বিভিন্ন অজুহাতে রক্ষীবাহিনীর (সেনাবাহিনীতে) হস্তান্তর প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার চেষ্টা করবেন।…৪২৯
তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মেজর নাসিরের উপরােক্ত দীর্ঘ বর্ণনার সবচেয়ে নাটকীয় দিক হলাে, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ঐ অভ্যুত্থানের শেষলগ্নে খােদ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকেই নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে আরেকটি অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদের কাছ থেকে বলপূর্বক সেনাপ্রধান পদে নিয়ােগ লাভের পর খালেদ যখন সকল ধরনের সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিয়ে তার অভ্যুত্থানের সমাপ্তি টানতে চাচ্ছিলেন তখনি ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জানের নতুন প্রকল্পের শুরু হতে যাচ্ছিলাে, কিন্তু ৬ নভেম্বর রাতে জাসদের অধীনের সংগঠিত সাধারণ সিপাহীদের বিদ্রোহ সেই পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়। খালেদ তার অভ্যুত্থানকে স্রেফ সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরত আনার একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখতে চাইলেও নূরুজ্জামান চাইছিলেন আরও অনেককিছু। যার মধ্যে ছিল ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত অফিসার-জওয়ানদের শাস্তি, আগস্ট পূর্ববর্তী অবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন রাজনৈতিক সংস্কার ইত্যাদি। মেজর নাসিরের নিম্নোক্ত বিবরণ থেকে বিস্তারিত জানা যায়- কীভাবে তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের মূল মূল নায়কদের নিয়ে নূরুজ্জামান আরেকটি অভ্যুত্থানের পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন :
(স্থান: ঢাকা সেনানিবাস, চতুর্থ ইস্টবেঙ্গলের অস্থায়ী দফতর, সময়: ৫ নভেম্বর)…নূরুজ্জামান বলে চললেন, আমাদের করণীয় অনেককিছু এখনও অসম্পূর্ণ। বসে থাকলে চলবে না।…আমরা সবকিছু হারাতে বসেছি। চারিদিকে বিদ্রোহের আলামত পাচ্ছি। (সাতই নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে)। তােমরা (মেজর হাফিজ, মেজর নাসির ও কর্নেল গাফফারকে উদ্দেশ্য করে) যদি রাজি থাকো, খালেদকে সরিয়ে আপাতত সাভারে (রক্ষীবাহিনীর দপ্তরের কথা বলা হচ্ছে) রেখে দিই। ওই জিয়া ব্যাটাকেও ‘ঢাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের আরও শক্ত না হলে চলবে না। কি বলাে তােমরা? গাফফার ও হাফিজ দু’জনই বলে উঠলাে, শাফায়াতকে বােঝাবে কে? নূরুজ্জামান বললেন, সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এভাবেই একটা পাল্টা অভিযানের বীজ রােপিত হলাে ৫ নভেম্বর দ্বিপ্রহরের আগেই। আগামী ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে অভ্যুত্থানটি কার্যকর করতে
…………………………………………………………………
৪২৯) মেজর নাসির উদ্দিন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১০।
Page 262
হবে। এবার নূরুজ্জামান থাকবেন পুরােধা হিসেবে। আমরা সবাই আগের মতােই তা সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবাে…।”৪৩০
উল্লেখ্য, রক্ষীবাহিনী প্রধান নূরুজ্জামান তাঁর পরিকল্পিত অভ্যুত্থানে অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্ল্যাহকেও সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন।৪৩১ তবে সেনাবাহিনী ও দেশের সৌভাগ্য যে প্রচুর রক্তপাতের সম্ভাবনায় পূর্ণ তাদের পরিকল্পিত শেষােক্ত সেই অভ্যুত্থান আর ঘটেনি বা ঘটতে পারেনি। তারা কাজে নামার আগেই সিপাহি অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা নিজেদের কার্যক্রম অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। নূরুজ্জামানদের পরিকল্পনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে জাসদ ও তাহের তাদের বিপ্লবী সিপাহি সংস্থার মাধ্যমে আঘাত হানে সেনা আমলাতন্ত্রের মর্মমূলে। এ পর্যায়ে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করার বিষয়, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে এবং তার মাঝেই পরিকল্পিত দ্বিতীয় অভ্যুত্থানটিতে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের শক্তির উৎস ছিল মুজিব বাহিনীর গর্ভজাত রক্ষীবাহিনীরব্যাটালিয়নগুলাে।৪৩২ অন্যদিকে জাসদ যেভাবে আশা করেছিল- তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সিপাহিদের অভ্যুত্থান শেষে দেশব্যাপী তাদের ‘গণবাহিনী’ পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেবে- সেই গণবাহিনীরও শক্তিভিত ছিল মুজিব বাহিনী থেকে আসা যােদ্ধারা। অর্থাৎ তেসরা নভেম্বর অভ্যত্থান এবং তার বিরুদ্ধে সংঘটিত পাল্টা অভ্যুত্থান- উভয় ক্ষেত্রে চালকের আসনে দেখা যাচ্ছে মুজিব বাহিনীর দ্বিতীয় প্রজন্মের সংগঠনগুলােকে।
তবে নূরুজ্জামান এবং তাঁর সহযােগীদের মতাে জাসদের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছিল সেদিন। এটাই ছিল মুজিব বাহিনীর বহুমাত্রিক অগ্রাভিযানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে হোঁচট খাওয়া। অর্থাৎ ১৯৭৫-এর নভেম্বরে এসে মুজিব বাহিনীর প্রধান দুটি ধারাকে প্রথমবারের মতাে থমকে দাঁড়াতে হয়- ততদিনে অবশ্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ খাদের প্রায় কিনারে পৌঁছে গেছে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বড় হেঁয়ালি এই যে, সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার জন্য মুজিব বাহিনী থেকে উত্থিত কোন জাসদ-নেতাকে বড় ধরনের শাস্তি বা দায় বইতে হয়নি- ফাসিতে ঝুলতে হয়েছে কেবল লে. কর্নেল আবু তাহেরকে, যিনি দলটিতে যুক্ত হয়েছিলেন ভিন্ন এক রাজনৈতিক-সামরিক
…………………………………………………………………
৪৩০) পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৭।।
৪৩১) এ বিষয়ে অভুত্থানের দুই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক নূরুজ্জামান ও নাসির উদ্দিনের ৬ নভেম্বরের কথােপথন দেখুন, মেজর নাসির উদ্দিন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৩।
৪৩২) সেনাশৃঙ্খলা বিরােধী উল্লিখিত নানারূপ ভূমিকার কারণেই ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে পরে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। ইতােমধ্যে ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনী প্রায় পুরােটা জাতীয় সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামরিক আমলাতন্ত্রের স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে।
Page 263
ঘরানা থেকে । অন্যদিকে তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার দায়ও কেবল ব্রিগেডিয়ার খালেদকে বইতে হয়েছে- ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান বা মুজিব বাহিনী- রক্ষীবাহিনীর কাউকে নয়। লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে বরাবর এ প্রশ্নই ঘুরপাক খেয়ে থাকে, খালেদকে কারা গুলী করেছিল। কিন্তু কখনাে এ প্রশ্ন আজও খতিয়ে দেখা হয়নি যে, খালেদের জন্য মৃত্যুর পটভূমি তৈরির ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর দ্বিতীয় প্রজন্মের দুটি ধারা হিসেবে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা এবং গণবাহিনীর সৈনিকেরা কীরূপ ভূমিকা পালন করেছিল। যেমনটি আমরা দেখবাে শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ক্ষেত্রেও। তিনি ও তাঁর পরিবারকে কারা কারা গুলী করেছিল সেটা ব্যাপকভাবে আলােচনায় এসেছে- ঠিক তদ্রুপ ব্যাপকতায় আড়াল করে রাখা হয়েছে কারা (এবং কীভাবে) তাঁর মৃত্যুর রাজনৈতিক-সামরিক অনিবার্যতা তৈরি করেছিল এবং সেদিন তাকে রক্ষায় রক্ষীবাহিনীও কেন কোনাে ভূমিকা পালন করল না।৪৩৩
তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির একটি বিশেষ দিক ছিল- মূল নেতৃত্ব পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাবেন। এ বিষয়ে আনােয়ার উল আলম অভ্যুত্থানের ৭২ ঘণ্টা আগে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার বিবরণ দিয়েছেন নিজ গ্রন্থে।৪৩৪ খালেদ নিহত হওয়ায় সেই পরিকল্পনা আর সফল হয়নি তবে নরজ্জামান ঠিকই ভারতে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। এসব ঘটনাবলির আরেকটি কাকতালীয় দিক হলাে খালেদ ঢাকায় শেরেবাংলা নগরে সেনাবাহিনীর যে মিলব্যারাকে নিহত হয়েছিলেন সেটি ছিল রক্ষীবাহিনীরই প্রধান কার্যালয়- মাত্র কয়েকদিন আগে যা সেনাবাহিনীতে আত্তীকৃত হয়েছিল এবং যেখানে ইস্টবেঙ্গল। রেজিমেন্টের একটি ইউনিট অবস্থান করছিল। অন্যদিকে খালেদ মােশাররফের সঙ্গে নিহত কর্নেল নাজমুল হুদার স্ত্রী নীলুফার হুদা সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের আলােকে খালেদ, হুদা ও হায়দারের নিহত হওয়ার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যায়, ঢাকার শেরেবাংলা নগরে নিহত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে খালেদ, হুদা ও হায়দার রক্ষীবাহিনী প্রধানের ধানমণ্ডির বাসভবনে ছিলেন। মিসেস হুদার বিশাল সেই বিবরণের চুম্বক অংশ নিম্নরূপ :
…………………………………………………………………
৪৩৩) উল্লেখ্য, তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীরা বারংবার সেনাশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কথিত লক্ষ্যের কথা বললেও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সপরিবারে বিদেশে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা। করেছিলেন তারাই। বাংলাদেশ বিমানের ফকার-ফ্রেন্ডশিপ বিমানে করে তাদের বিদেশ যাওয়ার জন্য উভয়পক্ষের মাঝে যােগাযােগ ও দরকষাকষির দায়িত্ব পালন করেন তখনকার বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস-মার্শাল এম জি তওয়াব। তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থানের মূল সংগঠকদের সম্মতিতেই এই আপস মীমাংসা চলে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন Dr. Peter Custers, পূর্বোক্ত।
৪৩৪) পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৪।
Page 264
(তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে আঁচ করতে পেরে) ৬ নভেম্বর গভীর রাতে হুদা, হায়দার ও খালেদ বঙ্গভবন থেকে বের হন।…সেখান থেকে তাঁরা আসেন ধানমন্ডি ৮ নম্বর রােডে রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক নূরুজ্জামানের বাড়িতে ।…এখানে তিনজনই বেসামরিক পােশাক পরে নেন।…এরপর তারা গাড়িতে করে দশম বেঙ্গলে রওয়ানা দেন।..এরপর ভাের রাতে তারা নিহত হন।৪৩৫
খালেদ যে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে হুদা ও হায়দারকে নিয়ে নুরুজ্জামানের বাসায় গিয়েছিলেন তার স্বীকৃতি রয়েছে মেজর হায়দারকে নিয়ে লেখা সাম্প্রতিক আরেক গ্রন্থেও।৪৩৬ উপরােক্ত কোনাে গ্রন্থকার অবশ্য এটা জানাচ্ছেন না যে, (নতুন) সেনাপ্রধান খালেদ মােশাররফ এত রাতে নূরুজ্জামানের বাসায় কেন যাচ্ছেন এবং সেখান থেকে আবার যখন তারা শেরেবাংলা নগরে যাচ্ছেন তখন অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা হয়েও নূরুজ্জামান কেন যাচ্ছেন না তাদের সঙ্গে? বর্তমান অধ্যায় ও উপ-অধ্যায়ের মূল আলােচ্য বিষয় থেকে অধিক বিচ্যুতি ঘটবে বিধায় এখানে এ প্রসঙ্গে আর অধিকতর আলােচনা করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে ১৯৭৫ সালের তিনটি অভ্যুত্থানের প্রথম ও শেষটি নিয়ে বহুমুখী আলােচনা ও অনুসন্ধান হলেও বিপুল রক্তক্ষয় ও সেনাশৃঙ্খলা বিধ্বংসী তৎপরতা হওয়া সত্ত্বেও তেসরা নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থান ও তার রাজনৈতিক-সামরিক চরিত্র সম্পর্কে অনুসন্ধানের ঘাটতি রয়ে গেছে আজও। আলােচ্য অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে কীরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। মেজর জেনারেল ইব্রাহিম (অব.) তাঁর ‘মিশ্রকথন’ নামক গ্রন্থে :৪৩৭
‘একটি রক্ষীবাহিনী ব্যাটালিয়ন যেটি ২২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট হয়েছিল সেটি ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এর অভ্যুত্থানে অধিনায়কের নির্দেশে অংশগ্রহণ করেছিল। দু বছর পর বগুড়া সেনানিবাসেও শৃঙ্খলা বহির্ভূত কর্মে লিপ্ত হয়েছিল ৪৮ ঘণ্টার মতাে একটি সময়ে, যার কারণে এ ব্যাটালিয়নটিকে ডিসব্যান্ড বা ভেঙ্গে ফেলা হয় । আজ অবধি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ১ থেকে ২১ তম ব্যাটালিয়ন আছে, আবার ২৩তম থেকে পরবর্তী ব্যাটালিয়নগুলাে আছে। ২২ ইস্টবেঙ্গল বলে কোন ব্যাটালিয়ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নেই।’
তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান নিয়ে চলতি অনুসন্ধানকালে বর্তমান লেখককে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য দেন সর্বহারা পার্টির এককালের কেন্দ্রীয় নেতা
………………………………………………………………..
৪৩৫) নীলুফার হুদা, কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ, প্রথমা, ২০১১, ঢাকা, পৃ. ১৩২-৩৫।
৪৩৬) জহিরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৫।
৪৩৭) পূর্বোক্ত, পৃ. ২১১।
Page 265
রইসউদ্দিন আরিফ। ৪৩৮ তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিরাজ সিকদার জীবিত থাকাবস্থাতেই সর্বহারা পার্টি তাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা লে. কর্নেল জিয়াউদ্দীনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রচুর রাজনৈতিক সংযােগ। ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। এই সংযােগেরই একটি ফল হিসেবে সর্বহারা পার্টি সমর্থক মধ্যসারির তরুণ অফিসাররা লে. কর্নেল জিয়াউদ্দীনের নেতৃত্বে (যদিও তিনি তখন সেনাবাহিনীতে নেই) একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নিয়েছিল। কয়েক দফা বৈঠক শেষে বিশেষ রাজনৈতিক ঐকমত্যের আলােকে এই অভ্যুত্থান সংঘটনের সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছিল পঁচাত্তরের ২৮ অক্টোবর। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পায়নি। কারণ সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে জিয়াউদ্দীনকে নিয়ে তাঁর কমিউনিস্ট পরিচিতির কারণে ভীতি কাজ করেছিল। ফলে তারা এইরূপ অভ্যুত্থানে সমর্থন দিতে রাজি ছিল না। রইসউদ্দিন আরিফের মতে ঐ পরিকল্পনারই একটি সংশােধিত রূপ হলাে তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান- যদিও খালেদ মােশাররফকে নেতা হিসেবে বাছাইয়ের সিদ্ধান্তটিকে পূর্বাহ্নেই ‘ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিজস্ব সামরিক অফিসার বন্ধুদের লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউদ্দীন ও সর্বহারা পার্টি যে তেসরা নভেম্বর অভ্যুত্থান থামাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সেটা অপর এক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ-এর বক্তব্য দ্বারাও সমর্থিত হয়।৪৩৯ তিনি এও জানাচ্ছেন, পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির জিয়াউদ্দীনদের সঙ্গে তখন তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের প্রধান যােগসূত্র ছিলেন মেজর ইকবাল, মেজর হাফিজ প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে বিশ্বে মােট ৭টি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল তার মধ্যে তিনটিই ঘটে বাংলাদেশে৪৪০ যার মধ্য দিয়ে এ দেশের সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশেষ প্রচারণার বিষয় হয়ে ওঠে। তার ইমেজ খাটো করার প্রচেষ্টাও চালানাে হয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু এই সেনাবাহিনীর মাঝে রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ কখন, কীভাবে, কাদের দ্বারা রােপিত হয়েছে এবং রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর আগমন কতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষাজাত আর কতটাইবা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে রােপিত বিভেদবৃক্ষের দায়ভার ও প্রতিক্রিয়া- সেসব প্রশ্নের উত্তর চাপা পড়ে গেছে উল্লিখিত প্রচারণার আড়ালে।
………………………………………………………………
৪৩৮) বর্তমান লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রদত্ত তথ্য, ১৬ জুন ২০১৪, ধানমন্ডি, ঢাকা।
৪৩৯) মহিউদ্দিন আহমদ, ৭ নভেম্বরের সাত-সতেরাে, প্রথম আলাে ঈদ সংখ্যা, জুলাই ২০১৪, ঢাকা, পৃ. ২৪৪।
৪৪০) অন্য অভ্যুত্থানগুলাে ঘটে কমরােস, নাইজেরিয়া, চাদ ও গ্রীসে।
Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ ; আলতাফ পারভেজ