You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব বাহিনীর অন্তর্বিরােধ যখন সংবাদপত্র শিল্পে :

        বাংলার বাণী বনাম গণকণ্ঠ

One cannot wage war under present conditions without the support of public opinion, which is tremendously molded by the press and other forms of propaganda.

         – General Douglas MacArthur

           (26 January 1880 -5 April 1964)

The media-stenographers to power.

           – Amy Goodman (born April 13, 1957) is an American broadcast journalist

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলােতে ইতােমধ্যে আমরা দেখেছি যে, স্বাধীনতা-উত্তর মাত্র ১২ মাসের মধ্যে পাঁচটি ধারায় মুজিব বাহিনীর নব আঙ্গিকে বিকাশ ধারার সূচনা ঘটে। সাংগঠনিক এই বিস্তৃতির গুরুত্বপূর্ণ এক নতুন উপাদান ছিল সংবাদপত্র শিল্পে মুজিব বাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা দৈনিক হিসেবে প্রকাশ শুরু করেন। তিনিই এর সম্পাদক-প্রকাশক-মুদ্রাকর ছিলেন। যদিও ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি যখন বাংলার বাণী সাপ্তাহিক হিসেবে প্রথম প্রকাশ শুরু হয় তখন তার মালিক-সম্পাদক ছিলেন

…………………………………………………………….

৪০২) দেখুন, Kamruddin Ahmad, Labour Movement in Bangladesh, Inside Library, Dhaka, 1978, p. 117.

৪০৩) দৈনিক গণকণ্ঠ, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩, ঢাকা।

Page 248

জনৈক হাফেজ হাবিবুর রহমান।৪০৪ স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা যায়- মধ্যবর্তী কোনাে এক সময়ে এর মালিকানা পরিবর্তন হয়। যুদ্ধকালে এই পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশের দায়িত্বে ছিলেন আমির হােসেন৪০৫ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মালিকানা পরিবর্তন হয়ে নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রকাশের শুরু থেকে ( বাহিনী’র শেখ মণি গ্রুপের স্বাধীনতা-উত্তর মুখপাত্র হয়ে ওঠে বাংলার বাণী। পরে তা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই তাত্ত্বিক মুখপত্র হয়ে ওঠে। ফজলুল হক মণি ১৯৭৪ সালের ৭ মে বাংলাদেশ টাইমস-এরও সম্পাদক হন। সিনেমা নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি ১৯৭৩ সালের আগস্টে। এভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র ২০ মাসে তিনি সংবাদপত্র শিল্পের এক বিশাল ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তাঁর লেখনিও ছিল ক্ষুরধার ও সাহসী। বিপরীতে সিরাজুল আলম খানকে ঐ সময়ে লিখতে দেখা যায়নি। তবে বাংলার বাণীর পাল্টা হিসেবে মুজিব বাহিনীর সিরাজুল আলম খান গ্রুপ প্রকাশ করেছিল দৈনিক গণকণ্ঠ।

মুজিব বাহিনীর উভয় পক্ষই তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে গণমাধ্যমের গুরুত্ব বুঝে ছিলেন চটজলদি। কিন্তু প্রচার সাম্রাজ্যে তাদের সূচনা মুখ্যত জবরদস্তিমূলকই ছিল বলা যায়। স্বাধীনতার পর সিরাজুল আলম খান গ্রুপের পক্ষ থেকে আফতাব আহমাদ অবস্থান নেন ৩১/এ র্যাংকিন স্ট্রিটে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ‘সংগ্রাম’-এর প্রেসে,৪০৬ যার নাম ছিল জনতা প্রিন্টিংপ্রেস এন্ড প্যাকেজিং। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বরের পর ‘সংগ্রাম কর্তৃপক্ষ তাদের কাগজটির প্রকাশনা বন্ধ রেখে নিজেরা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সেখান থেকে সিরাজপন্থীরা ‘গণকণ্ঠ’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করে। ঐ দিনই শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ বন্দিজীবন শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসছিলেন আর গণকণ্ঠের প্রথম পাতায় যে দুটি ছবি ছাপা হয়েছিল উভয়ই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আর সম্পাদক আল মাহমুদ মুজিবকে নিয়ে আবেগে উদ্বেল যে সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন তার শিরােনাম ছিল ‘অন্তরে তার পদধ্বনি বাজে। ঠিক একবছর পর ১৯৭৩ সালের ১০ জানুয়ারি গণকণ্ঠ পরিবার যখন বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে তাদের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করে সেখানেও ক্রোড়পত্রের প্রথম পাতায় ছিলেন কেবল মুজিব ও তাজউদ্দীন; ছবিতে দেখা যাচ্ছে দু’জনই তারা গণকণ্ঠ পড়ছেন।

…………………………………………………………………

৪০৪) Mahfuz Ullah, ibid, p. 90.

৪০৫) এই আমির হােসেনের ভাষ্য (বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০৯, ঢাকা, পূ. ১৮) থেকে জানা যায়, যুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর চার নেতা ভবানীপুরে রাজেন্দ্র স্ট্রিটের যে বাড়িতে অবস্থান করতেন সেখান থেকেই বাংলার বাণী প্রকাশিত হতাে। উল্লেখ্য, ভবানীপুরের এই বিশেষ বাড়িটি সম্পর্কে ২.ক ও ৩.খ উপ-অধ্যায়ের আলােচনায় বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।

৪০৬) এই পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি ১৯৭০; সম্পাদক ছিলেন আখতার ফারুক।

Page 249

এমনকি ঐ ক্রোড়পত্রের জন্য মুজিব নিম্নোক্ত বাণীও দেন : “তােমরা গণকণ্ঠে নির্যাতিত মেহনতী মানুষের কথা বলবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। আমি তােমাদের এ ইচ্ছা ও ঐকান্তিকতাকে অভিনন্দন জানাই। জয়বাংলা।

গণকণ্ঠ প্রথম দিকে ‘সাপ্তাহিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। সাপ্তাহিক রূপে গণকণ্ঠ সরকারি কোন অনুমতি ছাড়াই প্রকাশিত হতাে। এভাবে চার সপ্তাহ চলার পরে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে তা দৈনিকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে পাঁচজনের (আফতাব আহমাদ, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাসুদ আহমেদ রুমী, রায়হান। ফেরদৌস মধু, শাজাহান সিরাজ) সম্মিলিত এক আবেদনে তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসনিক সহায়তা দেন; ফলে দৈনিক হিসেবে গণকণ্ঠ প্রকাশনার অনুমতি মেলে।৪০৭ এর চট্টগ্রামেও ব্যুরাে ছিল- যার প্রধান ছিলেন ইমামুল ইসলাম লতিফী।

প্রকাশনার শুরুতে গণকণ্ঠ তার সম্পাদক হিসেবে নাম ঘােষণা করে কবি আল মাহমুদের- যদিও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা শেষে তখনও কলকাতা থেকে দেশে ফেরেননি তিনি। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কবির মুখ’-এ আল মাহমুদ জানিয়েছেন,৪০৮ মূলত আফতাব আহমাদের অনুরােধে দেশে ফেরার পর তিনি এই কাগজের সঙ্গে যুক্ত হন; এতে জাসদের অন্যান্য প্রধান সংগঠকদেরও বিশেষ আগ্রহ ও অনুমােদন ছিল। সম্পাদক থাকাকালে আল মাহমুদ জাসদপন্থী ছাত্রলীগের অনেক জনসভাতেও আলােচক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। যুদ্ধের আগে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করতেন। আল মাহমুদকে সম্পাদক করার পাশাপাশি আফতাব আহমাদ নিজেও গণকণ্ঠের কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। মনিরুল ইসলাম মার্শাল ছিলেন প্রকাশক। আল মাহমুদ গ্রেফতার হওয়ার পর প্রিন্টার্স লাইনে কাজী আরেফ আহমেদের নাম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দেখা যায়। উল্লেখ্য, পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে জনতা প্রিন্টিং প্রেসের ‘প্রশাসক হয়েছিলেন মার্শাল মনিরুল ইসলাম। আর ‘গণকণ্ঠে’র ‘ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মার্শাল মণি’র কাছ থেকেই ‘ভাড়ায় সেই দপ্তরটি ব্যবহারের অনুমতি নেন!!৪০৯

…………………………………………………………..

৪০৭) 673, Mahfuz Ullah, ibid. p. 79.

৪০৮) আল মাহমুদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫১।

৪০৯) উল্লেখ্য, ১৬ ডিসেম্বরের পরপর পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন বা সরকার সমর্থকদের মালিকানাধীন বা অবাঙালিদের মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতােই অনেক গণমাধ্যম ‘পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাহাত্তরের ২ জানুয়ারিতে সেগুলােতে প্রশাসক নিয়ােগের একটি নির্দেশ জারি হয়। তারও তিন দিন পর এ বিষয়ক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অর্ডার ১’ ঘােষণা করা হয়।

Page 250

সিরাজপন্থীদের সংগ্রাম কার্যালয়ে অবস্থান গ্রহণের মতােই ডিসেম্বরে ফজলুল হক মণিও অবস্থান নেন তেজগাঁওয়ে উর্দু দৈনিক পাসবান’-এর প্রেসে। সেখান থেকে নবউদ্যোমে প্রকাশ শুরু হয় দৈনিক বাংলার বাণী’র আগে যেটি সাপ্তাহিক হিসেবে ঢাকার হাটখােলা থেকে প্রকাশ হতাে। নতুন পর্যায়ে সরকারি সাহায্যও মিলল৪১০ ফজলুল হক মণি’র লক্ষ্য ছিল দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বাধা ছিল প্রবল। ফলে ‘পাসবান’ প্রেস পেয়ে তাকে সন্তুষ্ট হতে হয়। আগেই বলা হয়েছে, এসব সম্পত্তি সরকার’ ততদিনে ‘পরিত্যক্ত হিসেবে অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল।৪১১

বাংলার বাণী দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশকালে আদর্শ হিসেবে নিয়েছিল ‘মুজিববাদ’কে। অন্যদিকে ‘গণকণ্ঠ’ প্রকাশের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করে কিউবার বিপ্লবীদের পত্রিকা ‘গ্রাণমা’। সংবাদপত্র শিল্পে মুজিব বাহিনীর প্রধান দুই ধারার এই শক্ত অবস্থানকে ঘিরে এসময় বুদ্ধিজীবী পরিমণ্ডলেও মেরুকরণ লক্ষ্য করা যায় । আহমদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ লেখক ও কবিরা গণকণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আল-মাহমুদ,

……………………………………………………………….

৪১০) বাংলার বাণীর প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার গুরুত্বপূর্ণ এক নজির ছিল এর সর্বোচ্চ সরকারি বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি। সেসময় সংসদে দেয়া (২২ জুন ১৯৭৩) তথ্যমন্ত্রীর হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৩ সালের মে পর্যন্ত বাংলার বাণী দৈনিক গণকণ্ঠের চেয়ে চার গুণ বেশি বিজ্ঞাপন পেয়েছে এবং তা দেশের অন্য সব দৈনিকের চেয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ। সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার ক্ষেত্রে সেসময় বাংলার বাণী ছিল প্রথম স্থানে এবং গণকণ্ঠ ছিল দশম স্থানে। দেখুন, Mahfuz Ullah, ibid, p. 89 এবং দৈনিক গণকণ্ঠ, ২৩ জুন ১৯৭৩, ঢাকা।

৪১১) উল্লেখ্য, পাসবান পত্রিকাটির প্রকাশ শুরু হয় ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বন্ধ হয়েছিল শ্রমিক-কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে। বন্ধ হওয়ার পরও এর মতিঝিল অফিস ও তেজগাঁওয়ের প্রেস যথারীতি বহাল ছিল। এর সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মােস্তফা হাসান। ১৯৬৫ সালে ঢাকায় পত্রিকা শিল্পে প্রথম অফসেট-প্রিন্টিং প্রেসের সংযােজন ঘটিয়েছিল এই কাগজের মালিকরাই। পাসনে যারা সাংবাদিক হিসেবে তখন কাজ করেছেন তাদের একজন আহমেদ ইলিয়াস। ঢাকার উর্দুভাষী বিশিষ্ট কবি ও গবেষক জনাব ইলিয়াসের সঙ্গে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলাপচারিতার সূত্রে জানা যায়, পাসবানের মালিক ছিল বগুড়ার জামিল গ্রুপ। এই গ্রুপেরই সুপরিচিত ব্র্যান্ড ছিল রমনা সিগারেট । আলফা ইস্যুরেন্সেরও মালিক ছিল এই শিল্প গােষ্ঠী। প্রথমে ঢাকার পুরানাে কোর্ট হাউস এলাকা থেকে প্রকাশিত হলেও পরে ১৯৬০ সালের দিকে সরকার এই কাগজের মালিকদের তেজগাঁওয়ে ও মতিঝিলে একটি শিল্প ও একটি বাণিজ্যিক প্লট দিয়েছিল। ফলে পত্রিকার নিউজ সেকশন মতিঝিলে এবং প্রেস সেকশন তেজগাঁওয়ে চলে আসে। মালিকপক্ষ এসময় উন্নত প্রেস আমদানি করেছিল বিদেশ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর মতিঝিলের কার্যালয়টি জামিল গ্রুপেরই একজন কর্মকর্তা দখল করে নেন। আর প্রেসের বিষয়টি ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। পাসবানের পাশাপাশি এসময় ঢাকায় আরও যেসব উর্দু দৈনিকের অপমৃত্যু ঘটে তার মধ্যে ছিল মাশরাকি পাকিস্তান, সরফরাজ ও ওয়াতান।

Page 251

নির্মলেন্দু গুণ ছাড়াও আবু করিম, আবু কায়সার, অসীম সাহাসহ অন্তত ৫-৬ জন কবি এ কাগজে কাজ করতেন- যা বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পে এক অনন্য ঘটনা। বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও মাঝে মাঝে এ পত্রিকায় লিখতেন। এ কাগজে কখনাে শেখ মজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু। ব্যবহার করা হতাে না। অন্যদিকে গণকণ্ঠের মতােই বাংলার বাণীর সম্পাদকীয় বিভাগেও আবদুল গাফফার চৌধুরী, কামাল লােহানী প্রমুখ রাজনৈতিক লেখকের সমাবেশ ঘটেছিল। শেষােক্তজন বাংলার বাণীতে বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাহাত্তরের ১৭ মার্চ মুজিবের জন্মদিনে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এলে ‘বাংলার বাণী এবং ‘গণকণ্ঠ’ উভয় কাগজেই এই উপলক্ষ্যে বিশাল ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়।

পুরাে দেশের সংবাদপত্র শিল্প ১৯৭২-এ বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়লেও মুজিব বাহিনীর হাতে ছিল তখন কয়েকটি তরতাজা কাগজ। তবে বিস্ময়কর হলাে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই বাহিনীর দুই ধারা নানানভাবে দেশের রাজনীতির মঞ্চের প্রভাবশালী কুশীলব হলেও কেউ তাদের উল্লিখিত কাগজ দুটি টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল বাংলার বাণী’ চূড়ান্ত রূপে বন্ধ হয়ে যায়। দৈনিক গণকণ্ঠ বন্ধ হয় তারও বহু আগে।

১৯৭৩ সালের মার্চে থেকে ‘গণকণ্ঠ’কে তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়। জাসদ ও জাসদসংশ্লিষ্টদের ওপর সরকারের ব্যাপক বৈরি আচরণের মুখে পত্রিকাটির প্রকাশনা একদফা বন্ধ হয়ে যায় তিয়াত্তরের মার্চের শেষ সপ্তাহে। এসময় সরকারের তরফ থেকে মনিরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীর নেতা হাশিমুদ্দিন হায়দার পাহাড়িকে ‘জনতা প্রিন্টিং প্রেস’ নামক পরিত্যক্ত সম্পত্তিটির প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে র্যাংকিন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পত্রিকাটি উৎখাত হয়। নিউজপ্রিন্টের কোটা কমিয়ে দিয়েও পত্রিকাটিকে জব্দ করার চেষ্টা হয়েছিল। শুরুতে এই কাগজকে মাসে ৪৫ টন নিউজপ্রিন্ট সরবরাহ করা হতাে। পরে তা ২৫ টন এবং ১৯৭৪-এর আগস্টে তা ৭ টনে নামিয়ে আনা হয়।৪১২ এসময় সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও গণকণ্ঠের প্রতি সরকারি বৈরিতার নিন্দা জানায়। প্রায় ১৫ দিন পর ১৩ এপ্রিল থেকে এটি আবার প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে কে জি মুস্তফার মধ্যস্থতায় খােদ গণভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দরকষাকষিমূলক দীর্ঘ বৈঠক হয়েছিল গণকণ্ঠ-এর উদ্যোক্তাদের।৪১৩ প্রথম দিকে গণকণ্ঠের প্রকাশনায়

……………………………………………………………..

৪১২) দেখুন, দৈনিক গণকণ্ঠ, ৯ আগস্ট ১৯৭৪, ঢাকা।

৪১৩) উল্লেখ্য, কে জি মােস্তফা ছিলেন মুজিবাদ’ নামক গ্রন্থের লেখক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস-এর ভাই। শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত বাকশাল’-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বাইরে যে ১০ ব্যক্তি স্থান পেয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস।

Page 252

আর্থিক সহায়তা প্রদানকারীদের অন্যতম ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ঐ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সহযােগী গাজি গােলাম মােস্তফা।৪১৪ যদিও ১৯৭২ সালের ২৫ জুন গণকণ্ঠ কার্যালয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরকারের সমালােচক লেখক- শিল্পীদের সংগঠন বাংলাদেশ শিল্পী সংসদ’– আল মাহমুদ ছিলেন যার আহ্বায়ক । এই ‘সংসদ’-এ কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখও সদস্য ছিলেন।

চুয়াত্তরের মার্চে এসে চূড়ান্তভাবে সরকারি রােষানলে পড়ে গণকণ্ঠ দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই আঘাতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের আইয়ুব খান সরকারের তৈরি কুখ্যাত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স’কেই ব্যবহার করেছিল। যদিও তার নামটি ততদিনে পাল্টে নেয়া হয় মুদ্রণ ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৩’ নামে। ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এই আইন সংসদে যেদিন আলােচনার জন্য উত্থাপিত হয় সেদিনই তা পাস হয়ে যায়। মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংক্রান্ত এই আইনে গণমাধ্যমের ওপর চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরােপ করা হয়। নবীন দেশে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এই আইনে অনুমােদন দিয়েছিলেন। যে আইনটি ছিল বস্তুত পাকিস্তান শাসনামলের অনুরূপ আইনেরই নবসংস্করণ মাত্র এবং এইরূপ আইনকে ‘কালাে আইন’ হিসেবে অভিহিত করেই যুদ্ধ-পূর্ব সময়ে ওই সংসদ সদস্যরা পূর্ব- পাকিস্তানের সংবাদকর্মীদের অধিকতর গণতান্ত্রিক এক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সংবাদপত্র দলনের জন্য তিয়াত্তরের এই আইনকেও অবশ্য সরকার যথেষ্ট মনে করছিল না- যার জন্য কয়েক মাস পর ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার যে বিশেষ ক্ষমতা আইন তৈরি করে তাতেও প্রধান এক বিষয় হয়ে উঠেছিল গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ । আবার, চুয়াত্তরের নভেম্বরে তিয়াত্তরের মুদ্রণ ও প্রকাশনা আইনের আরেক দফা সংশােধন করে নেয়া হয় জাতীয় সংসদে। বলা বাহুল্য, আইনটিকে কঠোরতর করার জন্যই ছিল এইরূপ সংশােধনী। পরের মাসেই আরও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেশে আবির্ভূত হয় জরুরি অবস্থা।

মূলত মুজিব বাহিনী ও আওয়ামী লীগের যুদ্ধোত্তর তৎপরতার সমালােচনা করার কারণেই এসময় গণকণ্ঠের পাশাপাশি ‘গণশক্তি (মােহাম্মদ তােয়াহা সম্পাদিত), ‘লাল পতাকা, ‘হক কথা’ (মাওলানা ভাসানী প্রকাশিত), মুত্রপত্র, ‘স্পােকসম্যান’ (ইংরেজি সাপ্তাহিক; ফয়জুর রহমান সম্পাদিত), নয়াযুগ’, “দেশবাংলা’ (চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত) বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ ঘােষিত পত্রিকার নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকদের আটক করা হয়েছিল। চুয়াত্তরের ১৯

………………………………………………………………..

৪১৪) দেখুন, Press Under Mujib Regime, Mahfuz Ullah, Kakali Prakashani, 2002, Dhaka, p. 79.

Page 253

মার্চ রক্ষীবাহিনী গণকণ্ঠ-এর প্রেসের যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যায়- যা ছিল গণমাধ্যমের প্রকাশনা বন্ধে ঐ সময়কার এক অভিনব নজির। এভাবে, যে ধরনের মুক্ত গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা বিলুপ্ত হয় পঁচাত্তরে এসে। গণকণ্ঠ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে সরকারি ভাষ্যের বিকল্প উৎস বহুলাংশে নিঃশেষ হয়ে যায়। দৈনিক হিসেবে এটাই ছিল তখন বিকল্প কণ্ঠস্বর । মুজিব শাসনামলে গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ যেসব কারণে সরকারের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে একটি ছিল রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম। বস্তুত গণমাধ্যমকে মুক্ত অবস্থায় রেখে দিলে রক্ষীবাহিনীকে কোনভাবেই এতটা ‘মুক্তহস্তে তাদের কার্যক্রম চালাতে দেওয়া সম্ভব হতাে না। রক্ষীবাহিনীর ‘অবাধ’ ভূমিকার স্বার্থেই গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়া হয়েছিল।

গণকণ্ঠ বন্ধের দীর্ঘ পরে জাসদ পরিবার থেকে ‘লড়াই’ নামে আরেকটি কাগজ বের হয়।৪১৫ ‘লড়াই’-এর আগে-পরে জাসদের পক্ষ থেকে অপর তিনটি প্রকাশনা ছিল ‘মশাল’, ‘লাল ইশতেহার এবং সাম্যবাদ’। শেষােক্ত দুটি মূলত অভ্যন্তরীণ প্রচারের জন্য প্রকাশিত হতাে। তবে এই দুই পত্রিকাকে ঘিরেই জাসদ রাজনীতিতে গুরুত্ত্বপূর্ণ এক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটে ‘৭৩-৭৪ পর্যায়ে ।

১৯৭২ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদ প্রতিষ্ঠা হলেও এক সময়, বিশেষ করে ১৯৭৩ সাল নাগাদ এই দলের নেতৃবৃন্দ একে ‘পার্টি’ না বলে একটি ‘মাল্টিক্লাস সংগঠন হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করেন এবং পাশাপাশি তাদের এই ‘সংগঠন’-এর মধ্যেই একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার প্রক্রিয়া শুরু করেন। আরও সহজভাবে বললে, তাঁদের মতে জাসদ হলাে একটা গণসংগঠন এবং সেখান থেকে তারা একটি বিপ্লবী পার্টির কর্মী সংগ্রহ করবেন। এই উদ্যোগের তাত্ত্বিকভিত্তি হিসেবে এসময় বলা হতাে, শ্রমিক শ্রেণির পার্টি কখনাে গঠন করা যায় না- এইরূপ পার্টি গড়ে ওঠে।৪১৬ সেই গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া’র (১৯৬২

………………………………………………………………..

৪১৫) ‘লড়াই’ প্রথম জাসদের ভেতরকার ‘পার্টি প্রক্রিয়া’র মুখপত্র হিসেবেই প্রকাশিত হতাে। এভাবে অল্প কিছু দিন পর প্রকাশিত হওয়ার পর এটা বন্ধ হয়ে যায়। জাসদ বিভক্ত হওয়ার পর আ ফ ম মাহবুবুল হক অনুসারীরা (বাসদ) আবারও ‘লড়াই’ প্রকাশ করে কিছু দিন। এর পর ১৯৮৭ সালে এই কাগজের প্রকাশক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নেন শাজাহান সিরাজ। এসময় কাগজটির সম্পাদক ছিলেন সুমন মাহমুদ। তাঁর মতে, “৮৭-৮৮ সালে লড়াই শেষবার যখন প্রকাশিত হতাে তখন কোনাে পার্টি-কাগজ হিসেবে নয়, পেশাদার একটি সাপ্তাহিক কাগজ হিসেবেই এটি প্রকাশিত হতাে। তবে এ পর্যায়েও মাত্র এক বছর পত্রিকাটি টিকে ছিল। উল্লেখ্য, শাজাহান ‘লড়াই’-এর প্রকাশক হওয়ার পর মাহবুবুল হক’রা তাঁদের তরফ থেকে আর ‘লড়াই’ প্রকাশ করেননি।

৪১৬) সাঈদ তারেক, বীরােত্তম কর্নেল তাহের-লাল নভেম্বর এবং বামপন্থী রাজনীতি, ঝর্ণাধারা সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ. ৫৭। এসময় এও বলা হয়, জাসদ গঠনের উদ্দেশ্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা নয়- সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সহায়তা করা।’ পৃ. ৫৮।

Page 254

সালের নিউক্লিয়াস থেকে যার শুরু) অভিব্যক্তি হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে এসময় ‘লাল ইশতেহার’ নামের পত্রিকাটি। এতে প্রথম দিকে মূলত ভারতের এসইউসি-আই এর বিভিন্ন দলিলপত্রের আলােকে এই বক্তব্যই প্রচার পাচ্ছিল যে, কীভাবে বাংলাদেশে একটি নতুন ধারার সর্বহারা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলা যায়। বিশেষ করে এসইউসিআই নেতা শিবদাস ঘােষের ‘কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এসইউসিআই একমাত্র সাম্যবাদী দল’-এর মূল অংশ ছাপা হয় তাতে। শিবদাস ঘােষের চিন্তার আলােকে পার্টি গড়বার প্রচেষ্টা এবং তার প্রয়ােগ ও অনুশীলনের প্রশ্ন থেকেই এসময় জাসদ সংগঠকদের মাঝে বিতর্ক, বিভেদ, বিভ্রান্তি, বিচ্যুতি দেখা দিতে থাকে।৪১৭

১৫ দিন পরপর প্রকাশের কথা থাকলেও ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর ‘লাল ইশতেহার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জাসদ প্রকাশ করে সাম্যবাদ’। লাল ইশতেহার বন্ধ হওয়া এবং সাম্যবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল ঘটনাবহুল। কেন আগেরটি বন্ধ করে নতুন নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করা হচ্ছে তার ব্যাখ্যা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হলেও সেই সময়কার জাসদ সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে৪১৮ নিম্নোক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় : ‘লাল ইশতেহার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাসদের অনেক ‘গণচরিত্রের নেতা’- যেমন রব, জলিল প্রমুখকে যুক্ত করা হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও তার কাছে নির্ভরযােগ্য হিসেবে বিবেচ্য ১২ তরুণ নেতা- যেমন আ ফ ম মাহবুবুল হক, হাসানুল হক ইনু, মনিরুল ইসলাম, কাজী আরেফ আহমেদ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ। মূলত ‘দোদুল্যমান’ ও ‘পেটিবুর্জোয়া বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘গণচরিত্রের নেতাদের ঐ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। ফলে এক পর্যায়ে শেষােক্তরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সেই ক্ষোভের মুখে সিরাজুল আলম খান পূর্বোক্ত প্রক্রিয়া’ ভেঙে নতুন একটি প্রক্রিয়া চালু করেন– যার অভিপ্রকাশ হিসেবে দেখা দেয় ‘সাম্যবাদ।’ ‘নির্ভরযােগ্য সংগঠকরাই সাম্যবাদের কপি পেতেন। তবে সাম্যবাদও ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে নীরব হয়ে যায়।

………………………………………………………………..

৪১৭) মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের অথরিটি ও মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘােষ’, পূর্বোক্ত। উল্লেখ্য, পার্টি গড়বার প্রশ্নে শিবদাস ঘােষের চিন্তার বিশেষ দিক ছিল একটি বিপ্লবী পার্টির সংগঠকদের কেবল পার্টি জীবন নয়- ব্যক্তি জীবনকেও মার্কসবাদের আলােকে পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ও পারিবারিক জীবনের প্রচলিত ধারণা ত্যাগ করতে হবে। দলকেই পরিবার মনে করতে হবে। সংগঠকরা দলের অভ্যন্তরে যৌথভাবে জীবন-যাপন করবেন এবং যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তুলবেন। শিবদাস ঘােষের জন্ম ১৯২৩ সালে ঢাকায় এবং মৃত্যু ১৯৭৬ সালে কলকাতায়।

৪১৮) বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, আ ও ম শফিক উল্লা ও অন্যান্য, জাসদ-বাসদের ভ্রান্ত দোদুল্যমান ও বিভ্রান্তিকর রাজনীতি প্রসঙ্গে, লক্ষীপুর খােলাচিঠি গ্রুপ, ১৬.০৭.১৯৮১। পুস্তিকার সাত লেখকের সবাই জাসদের সংগঠক ছিলেন।

Page 255

১৯৭৪ সালের এপ্রিল-মে-জুন নাগাদ শুরু হওয়া ওই পার্টি গঠন প্রক্রিয়ায় জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ইত্যাদি সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল (ইতঃপূর্বে যাদের দোদুল্যমান ও ‘পেটিবুর্জোয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদেরসহ)। এই প্রক্রিয়া থেকে এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্টরা ‘সিওসি’ (সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি) নামে বৃহত্তর একটি কাঠামাে গড়ে তােলেন এবং এর সদস্য সংখ্যা কারাবন্দি পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ ৩২ পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। সিওসি’র পুরাে নাম ছিল ‘সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি অব দ্য কমিউনিস্ট রেভলুশনারিজ। সাত সদস্যের একটি স্ট্যান্ডিং কমিটিও ছিল এর। বৃহত্তর এই সাংগঠনিক কাঠামােকেই এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ফোরাম হিসেবে অভিহিত করা শুরু হয় জাসদ পরিবারে।

সাংগঠনিক এসব নিরীক্ষার মাঝেই এ সময় জাসদের অভ্যন্তরে তীব্র এক মতাদর্শিক বিতর্ক চলছিল। যেসব বিষয়কে ঘিরে বিতর্ক আবর্তিত হচ্ছিল তার মধ্যে রয়েছে : গণবাহিনীর ভূমিকা যাচাই, গণবাহিনীর সঙ্গে অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের সম্পর্ক নির্দিষ্ট করা, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা, মার্কসবাদ ও মার্কসবাদী পার্টি গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করা ইত্যাদি। এসব বিতর্ককালে দেখা যায়- জাসদের অভ্যন্তরে এরূপ প্রতিটি বিষয়ে ব্যাপকতর অস্পষ্টতা ও মতভিন্নতা বিদ্যমান। সিরাজুল আলম খানকে ঘিরে এসময় গণবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ চার নেতা ইনু-আম্বিয়া-আরেফ-মনি’র একটি শক্তিশালী বলয় দলটির একটি নতুন সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে।৪১৯ শেষপর্যন্ত সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে ‘সিওসি’ কিংবা সিরাজুল আলম খান উপরােক্ত বিতর্কের কোনাে সারসংকলনে আসতে পারেননি সে সময়। ফলে ‘পার্টি’ গঠনের কাজে হাত না দিয়ে সিওসি’র তরফ থেকে সে দায়িত্ব ১৯৭৬ সালে এসে ‘এক ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় নিশ্চিতভাবেই সেই ব্যক্তিটি ছিলেন সিরাজুল আলম খান।

সিওসি ভেঙে দেওয়ার সময় তার তরফ থেকে একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় এবং তাতে বলা হয়, অস্থিরতা, দোদুল্যমানতা,…ও পেটিবুর্জোয়া ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে এবং আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি চালু না

…………………………………………………………….

৪১৯) এ বিষয়ে ৬.খ উপ-অধ্যায়েও আলােকপাত করা হয়েছে। জাসদের অভ্যন্তরে এসময় কেউ কেউ ক্রুদ্ধ হয়ে সিরাজুল আলম খানকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন এই বলয়কে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে ১৯৬৬ থেকে পরবর্তী দশকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে মাও-এর স্ত্রী চিয়াং ছিং [Jiang Qing]-এর নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠা ‘চার কুচক্রী বা ‘Gang of Four’-এর সঙ্গেও তুলনা করতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, চীনে ‘চার কুচক্রী’র অন্য তিন সদস্য ছিলেন চাং দুনছিয়াও, ইয়াও ওয়েনহউয়ান Gute CROCA (Zang Chunqiao, Yao Wenyuan, Wang Hongwen).

Page 256

থাকায় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি ভেঙে দেওয়া হলাে।৪২০ উল্লেখ্য, সিওসি ভেঙে দেওয়ার স্বল্প কিছুদিন পরই ‘পার্টি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি আকস্মিকভাবে। সরকারের গােয়েন্দা বিভাগের হাতে আটক হয়ে যান। এভাবে জাসদের অভ্যন্তরে বিপ্লবী পার্টি গঠন প্রক্রিয়াটির সমাপ্তি ঘটেছে বলে ধরে নেয়া হয৪২১় এবং পরে আর কখনও জাসদের অভ্যন্তরে পার্টি প্রক্রিয়া নামক কাঠামাের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবে কার্যত দলটির নেতৃত্ব সচেতনভাবে তাদের কর্মী বাহিনীকে যাদের অনেকেই, তখনও মাঠ পর্যায়ে সশস্ত্র অবস্থায় ছিল, অপ্রস্তুত ও প্রতিরক্ষাবিহীন অবস্থায় বিলােপবাদী স্বতঃস্ফূর্ততার হাতে সঁপে দেন। এর দীর্ঘ পর, ১৯৮১ সালে সিরাজুল আলম খান যখন কারাগার থেকে মুক্তি পান তখন জাসদে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার প্রক্রিয়ার পরিবর্তে মুখ্য হয়ে উঠেছিল ভাঙনের শুরু । যে বিবরণ এ পর্যায়ে আর প্রাসঙ্গিক নয় ।

……………………………………………………………….

৪২০) সর্বহারা শ্রেণির দল গঠনের সমস্যা প্রসঙ্গে ও সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য, খালেকুজ্জামান ভূইয়া ও অন্যান্য, ১২.০৩.১৯৮১, ঢাকা, পৃ. ৭।

৪২১) সিরাজুল আলম খান আটক হয়েছিলেন ১৯৭৬-এর সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার এলাকা থেকে। আটকের দিন একটি মােটর সাইকেলে করে নিজস্ব গােপন সেল্টারে যাচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে তাঁর ভাই পিয়ারু ছিলেন। গােয়েন্দা সংস্থার বিপুল উপস্থিতি দেখে তার ভাই পালাতে সক্ষম হলেও সিরাজুল আলম খান ধরা পড়েন। তার আটক সম্পর্কে এ পর্যায়ে জাসদের অভ্যন্তরে ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি হয়। যার ছাপ মিলে নিম্নোক্ত বক্তব্যে :

সিরাজুল আলম খানের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে সংগঠনের অভ্যন্তরে নেতা-কর্মীদের মাঝে বিভিন্ন জল্পনা, কল্পনা ও মন্তব্য শুরু হয়ে যায়। কেউ বলছেন, সিরাজ ভাইকে অমুক চক্র ধরিয়ে দিয়েছে, কেউ বলেছেন, তমুক চক্র ধরিয়ে দিয়েছে। আবার কেউ বলছেন, সংগঠনের চরম বিপর্যয়ের দায়-দায়িত্ব উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং কর্মীদের হাজারাে প্রশ্নকে ধামাচাপা দেওয়া ও পাশ কাটানাের উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেকে ধরিয়ে দিয়েছেন ।…পরবর্তী পর্যায়ে ভাওয়াল গড়ে অনুষ্ঠিত জাসদের গােপন বর্ধিতসভায় বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিরা সিরাজ ভাইয়ের গ্রেফতার সংক্রান্ত বিণী প্রকাশের জোর দাবি জানান।…’ দেখুন, লক্ষ্মীপুর খােলাচিঠি গ্রুপ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭-২৮।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ; আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!