You dont have javascript enabled! Please enable it!

২৩ জুলাই ১৯৭২; মুজিব ও সিরাজুল আলম খান দু’দিকে

আমরা ইতিহাসকে নতুন করে গড়তে পারি না, কিন্তু মাঝে-মধ্যে ইতিহাসকে পুনরায় মূল্যায়ন করা ভবিষ্যতের পথ নিরূপণে অবশ্যই সহায়ক হতে পারে ।

               -অশােক মিত্র, মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ; ১৯৭৭-৮৭ সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী ছিলেন;৩১০

ফেব্রুয়ারি মাসে (১৯৭২) একটা প্রস্তাব এসেছিল, খুব সম্ভব কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে; তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রাম কর্মীবাহিনী হিসেবে গ্রাম উন্নয়ন প্রচেষ্টায় নিয়ােগ করার। এই পরিকল্পনা পাশ হয়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বাইরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতালব্ধ এবং জনগণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত এ রকম একটি বাহিনীর হাতে কখনও গ্রামকে ছেড়ে দেওয়া যায় না!… দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্রের স্তম্ভ ছাড়াই রানীকেও সপ্তাহে একটিমাত্র ডিম খেতে দেওয়া হতাে। আমাদের নেতৃবৃন্দ এটুকুও পারলেন না। খুব শিগগির স্পষ্ট হয়ে যায়, কোন আশা নেই।

            -আনিসুর রহমান, অর্থনীতিবিদ, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য৩১১

রাশিয়া কিংবা চীনে তাে বটেই, প্রথাগতভাবে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও এবং সুনির্দিষ্টভাবে দক্ষিণ এশিয়াতেও সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম শ্রমিক ও কষক অঙ্গনেই প্রথম প্রস্ফুটিত হলেও জাসদের রাজনীতির প্রাথমিক চারণভূমি ছিল দেশের শিক্ষাঙ্গন। ছাত্র সংগঠকদের আহ্বান ও কার্যক্রমকে তখন স্রেফ অনুসরণ করছিল তাদের সমর্থক শ্রমিক ও কৃষক সংগঠকরা। শ্রমিক লীগের ভাঙন কিংবা কৃষক লীগের বিনা বাক্যব্যয়ে জাসদকে অনুসরণকে তাই অভিহিত করা যায় ছাত্রলীগের তৎপরতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে। পূর্ববর্তী উপ-অধ্যায়ে ইতােমধ্যে বিস্তারিত রূপে সে বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

সিরাজপন্থী তিন নেতা (আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া) যখন জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠন, জরুরি অবস্থা ঘােষণা, গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা বাতিলসহ অন্যান্য দাবিসমূহ উত্থাপন করছিলেন তখন তাদের পেছনে সমর্থনের শক্তি দেখাতেই শ্রমিক লীগ নেতাদের দিয়েও বিবৃতি দেওয়ানাে হলাে। সিরাজপন্থীদের বিবৃতিতে উপস্থাপিত উপরােক্ত বক্তব্যকে ঘিরে

………………………………………………………………..

৩১০) বিভাজনের পশ্চাৎপট: বঙ্গভঙ্গ ১৯৪৭, ভূমিকা, সম্পাদনা: দেব্রত মুখােপাধ্যায়, রিডার্স সার্ভিস, কলকাতা, ২০১৩।

৩১১) উন্নয়ন জিজ্ঞাসা, কেন হলাে না, ব্র্যাক, ১৯৯২, ঢাকা, পৃ. ৪, ৮।

Page 199

শ্রমিক পরিমণ্ডলে বেশি মনােযােগ সৃষ্টি না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। শেখ মণি ‘বাংলার বাণী’তে নিজ কলামে এসব বিবৃতির পেছনের শক্তিকে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী’ হিসেবে অভিহিত করে সরাসরি রাজনৈতিক মেরুকরণে অংশ নেন। এবং বলেন, “যারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ভেঙে নতুন সরকার গঠনের প্রস্তাব করছেন তাদের আসল উদ্দেশ্য হলাে :

ক. দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি;

খ. বঙ্গবন্ধুকে ডিক্টেটর করে তােলা;

গ, সংবিধান রচনার পথে বাধা সৃষ্টি করা এবং

ঘ. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান নষ্ট করা।৩১২

ছাত্রলীগ বা মুজিববাদপন্থীদের মাঝে এরূপ মতদ্বৈততার মাঝেই ঢাকায় এসময় ছােট একটি ঘটনা ঘটে যা মুজিব বাহিনীর ভবিষ্যৎ।রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে মূলধারার বামপন্থীদের অতীত আশঙ্কা বাড়িয়ে তােলে। বর্তমানে ঢাকায় বারডেম হাসপাতালের পাশে যেখানে পিজি হাসপাতাল রয়েছে সেখানেই স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে শাহবাগ’ নামে একটি হােটেল ছিল। এই হােটেল ভবনকে পিজি হাসপাতালের একাংশে পরিণত করার বিরুদ্ধে সেসময় হােটেল শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলন করে যাচ্ছিল। এই হােটেল শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠিত করত তখন বামপন্থী রাজনীতিবিদ, বিশেষত শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের কমিউনিস্টরা। একাত্তরের ষােল ডিসেম্বরের পরও এই আন্দোলনের রেশ জারি ছিল। কোনােভাবে যখন ঐ হােটেল শ্রমিকদের আন্দোলন দমানাে যাচ্ছিল না তখন সরকারের একটি অংশ সেটা মােকাবেলার জন্য মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করে। এক পর্যায়ে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা আন্দোলনরত শ্রমিকদের

………………………………………………………………..

৩১২) একইরূপ বক্তব্য নিয়ে মণি’র একাধিক ক্ষুরধার কলাম (৩ জুন ১৯৭২, ৬ অক্টোবর ১৯৭২ ইত্যাদি) প্রকাশিত হয় এই সময় দৈনিক বাংলার বাণীতে। মণি এ সময় তার লেখনির মাধ্যমে সিরাজুল আলম খানদের রাজনৈতিক অবস্থানের মােকাবেলার পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের কাজেরও তীব্র সমালােচনা করতেন (দেখুন, বাংলার বাণী, ৩১ আগস্ট ১৯৭২)। তাজউদ্দীনকে ‘সমাজতন্ত্রের শত্রু হিসেবেও অভিহিত করা হতাে। মণি’র এরূপ ভূমিকায় তাজউদ্দীন আহমদ শেষপর্যন্ত দলে প্রভাবের জায়গা ধরে রাখতে পারেননি। এতে সিরাজুল আলম খান ও তার অনুসারীদের মাঝে এই ধারণাই জোরালাে হয়, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ থেকে তাদের আজ কিংবা কাল বের হতেই হবে। সেক্ষেত্রে তাজউদ্দীনের মতাে নিঃসঙ্গ অবস্থার শিকার না হয়ে ভিন্ন আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে বের হওয়াই উত্তম। এরূপ উপলব্ধি জাসদ গঠন প্রক্রিয়াকে তীব্রতা দেয়। আগ্রহী পাঠক শেখ ফজলুল হক মণি’র কলামগুলাে একসঙ্গে দেখতে পারেন নিম্নোক্ত সংকলনে: দূরবীণে দূরদর্শী, গ্রন্থণা ও সম্পাদনা, ফকীর আবদুর রাজ্জাক ও বিমল কর, আগামী প্রকাশনী, ২০১১, ঢাকা।

Page 200

মিছিলে গুলি চালায়। এরপর হােটেলকে হাসপাতালে পরিণত করতে বেগ পেতে হয়নি সংশ্লিষ্ট আগ্রহীদের। অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিক ইউনিয়নেও এই ঘটনা নীরব এক আশঙ্কাজনক বার্তা পৌছে দিয়েছিল দ্রুত।২১৩

এসব কার্যক্রম সত্ত্বেও এসময় ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খান ও শেখ মণি গ্রুপের দ্বন্দ্বও ছিল বহমান। ফল হিসেবে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (ডাকসু)-এর স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত না হয়েও ছাত্রলীগের তরফ থেকে দুটি প্যানেল জমা পড়ে এবং নির্বাচনে উভয় প্যানেল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলের কাছে পরাস্ত হয়।৩১৪

…………………………………………………………………

৩১৩) তবে শ্রমিক সংগঠনগুলাের ওপর পদ্ধতিগতভাবে দীর্ঘস্থায়ী আক্রমণ আসে আরও পরে- আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ‘শ্রমিক লীগ’-এর তরফ থেকে। এরূপ সংঘাতের বড় এক কেন্দ্র ছিল টঙ্গী। দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চল তখন এটি। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে এখানে শ্রমিকদের মাঝে প্রভাবশালী সংগঠক ছিলেন শফিকুর রহমান মজুমদার, কাজী জাফর আহমেদ ও হায়দার আকবর খান রনাে। ঐ সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে শেষােক্তজন লিখেছেন, টঙ্গীর পরিস্থিতি তখন অন্যরকম। মালিকরা চলে গেছে, যেহেতু অধিকাংশ ছিল পাকিস্তানি। সরকার মিলে মিলে প্রশাসক নিয়ােগ দিয়েছে।..রাতারাতি সেখানে শ্রমিক লীগ গজিয়ে উঠল। গায়ের জোরে টঙ্গী দখল করবে- এটাই ছিল লক্ষ্য। একবার টঙ্গী থানার সামনে মেশিনগান বসিয়ে তারা মন্ন টেক্সটাইল মিলের কলােনি লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জিনাত টেক্সটাইলের শ্রমিকরা নদীতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। বন্দুকধারীরা নদীতেও গুলি চালায়।’

উল্লেখ্য, টঙ্গীতে শ্রমিক লীগের কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কাজী মােজাম্মেল। একপর্যায়ে সেখানে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে, অসহায় শত শত শ্রমিক স্বতঃস্ফুর্ত মিছিল করে ঢাকায় এসে পড়ে। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে এসে তারা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অফিসের সামনে অবস্থান নেয়। পরে সেখান থেকে তারা পল্টন ময়দানে যায় এবং তিন রাত-তিন দিন সেখানে অবস্থান করে। এ ঘটনা শিল্পাঞ্চলের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রতি জাতীয় মনােযােগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে নাটকীয় ভূমিকা রেখেছিল। পরে সরকারি তরফ থেকে টঙ্গীর শিল্প ইউনিটগুলােতে শ্রমিক প্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। তাতে জাফর ও রনােদের বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন’ প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জয়লাভ করে। কিন্তু ১৯৭৩-এর মার্চে জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় শ্রমিক লীগ

জাফর ও রনােদের সব সংগঠককে এই বলে টঙ্গী থেকে তাড়িয়ে দেয় যে, জাতীয় নির্বাচনে যেহেতু আওয়ামী লীগ জিতেছে- তাই টঙ্গীসহ সব এলাকা আমাদের দখলে থাকবে। বিস্তারিত দেখুন, হায়দার আকবর খান রনাে’র আত্মজৈবনিক গ্রন্থ, শতাব্দী পেরিয়ে, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৩১০-১২। টঙ্গী ছাড়া অন্যত্রও তখন সরকার বিরােধী শ্রমিক সংগঠনগুলাের কার্যক্রমের কোনাে সুযােগ ছিল না। প্রধানত ‘লাল বাহিনী’র কারণে। এ বিষয়ে অন্যত্র বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে।

৩১৪) ডাকসুতে ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থীদের ভিপি প্রার্থী ছিলেন মাে. জিনাত আলী। ‘মুজিববাদ ও মণি সমর্থকরা প্রার্থী করে শেখ শহিদুল ইসলামকে, যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নিকটাত্মীয়ও ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। নির্বাচনে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম-মাহবুব জামান পরিষদ অধিকাংশ পদে জয়লাভ করে। মুজিববাদ’ সমর্থক প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী। আর সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের প্যানেলে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হন মােয়াজ্জেম হােসেন খান মজলিশ। এই প্যানেলের অন্যান্য প্রার্থী ছিলেন সামাজিক আপ্যায়ন সম্পাদক পদে আসলাম ভুঞা, ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদক পদে ঝীলু সামসুন নাহার ইকো, মিলনায়তন সম্পাদক পদে মাে. হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। এই প্যানেল থেকে কেবল সদস্য পদে মমতাজ বেগম জয়লাভ করেন। উল্লেখ্য, এই প্যানেলের পরিচিতিমূলক যে পুস্তিকা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল তাতে বিভিন্ন সময় দেয়া শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের সর্বমােট ছয়টি উদ্ধৃতি ছিল! পুস্তিকাটির নাম দেয়া হয়েছিল এক ও অভিন্ন!’

Page 201

এসময় ছাত্রলীগ অনানুষ্ঠানিকভাবে দু’ভাগ হয়ে যায়। সিরাজুল আলম খান গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ আগের পদেই থাকলেন। একইভাবে বিপরীত শিবিরে সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী আগের পদে থাকেন, আর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করা হয় ইসমাত কাদির গামাকে। মনিরুল ইসলাম দাবি করেছেন৩১৫, নূরে আলম সিদ্দিকীরাই প্রথম ছাত্রলীগে ভাঙন প্রক্রিয়ার সূচনা করে শাজাহান সিরাজসহ সিরাজুল আলম খানের অনুসারী প্রভাবশালী সকলকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে। পরে অবশ্য শেষােক্তরাও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে।

পারস্পরিক এই বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের পরপর ‘৭২-এর জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে দুই গ্রুপ ঢাকার বুকে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় সমাবেশ ডেকে । সেই সময় উভয় গ্রুপই ভাবছিল সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যাপকতা ও সমাবেশশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমেই তারা মুজিবকে জয় করবেন এবং কাছে রাখবেন। বস্তুত সেটাই (সমাবেশশক্তি) তখন ছিল কার্যত রাজনীতিতে সঠিকতা ও বেঠিকতার মানদণ্ড। বাহাত্তরের মে-জুনে ছাত্রলীগের ঠান্ডাযুদ্ধকালীন এই পরিবেশে মুজিব প্রাথমিকভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন। যদিও যুদ্ধের মেঠো উপাদান ছিল ‘মুজিববাদ’-এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ । একপর্যায়ে মুজিব সিরাজুল আলম খান বিরােধীদের সম্মেলনস্থল সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অতিথি হিসেবে হাজির হয়ে উপরিউক্ত ঠান্ডাযুদ্ধের অবসান ঘটান এবং ছাত্রলীগের বিভক্তিকে পূর্ণতা দেন । এভাবেই ভাঙে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীও।

ছাত্রলীগের একাংশের সম্মেলনে মুজিবের এই উপস্থিতির প্রতীকী মূল্য ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বিপুল হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে তার তাৎপর্য নিয়ে কমই আলােকপাত করা হয়েছে। ছাত্রলীগের ঐ সময়কার বিভক্তি প্রক্রিয়া থেকে স্পষ্ট ছিল, সংগঠনটির অধিকতর সংগ্রামী ও মেধাবী অংশই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়ে এগােচ্ছে এবং সংখ্যায়ও তারা শেখ মণি ও তােফায়েল সমর্থকদের চেয়ে বেশি ছিল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থীরা, যাদের

…………………………………………………………………

৩১৫) মনিরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৯।

Page 202

সম্মেলন হচ্ছিল পল্টন ময়দানে- ভেবেছিলেন দুটি স্থানে সম্মেলন হলেও মুজিব নিশ্চয়ই কোনােটাতেই যাবেন না। কিন্তু মণি, রাজ্জাক ও তােফায়েল সমর্থকদের মাঝে হাজির হয়ে মুজিব কার্যত সিরাজুল আলম খান অনুসারীদের বাধ্য করলেন নতুন একটি দল গঠনে এগিয়ে যেতে। ‘বাইশে জুলাই গণকণ্ঠ প্রথম পাতায় দুই সম্মেলনের সচিত্র সংবাদ ছাপা হলাে, দুই কলাম করে। বায়ে শেখ মুজিবের ছবি। হেডিং ছিল গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র হবে। ডানে আ স ম রবের ছবি। হেডিং ছিল, গণতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। মুজিব আর আ স ম রব সমান বরাদ্দ পেলেন।৩১৬ মুজিবের সেদিনের রাজনৈতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতির পুরাে ছক পাল্টে দিয়েছিল।৩১৭ সিরাজুল আলম খান ও তার সহযােগীদের সামনে তখন এক রূঢ় বাস্তবতা।

জুলাইয়ের দ্বিধাবিভক্তির পর থেকে সিরাজ গ্রুপ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলা বন্ধ করে দেন। মনিরুল ইসলামের বিবরণ থেকে দেখা যায়, ‘মুজিবের নীরবতা ও নিরপেক্ষতা ভঙ্গ’-এর আকস্মিকতায় সিরাজপন্থীরা তখন ‘হতবিহ্বল।’৩১৮ তবে মুজিবের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সিরাজ ও রবপন্থীদের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে গণকণ্ঠের সম্পাদক আল মাহমুদ যে প্রবন্ধ পড়েছিলেন তা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রশংসায় ঠাসা।৩১৯

…………………………………………………………………

৩১৬) মহিউদ্দিন আহমদ, এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল, সিডিএল, ২০০৬, ঢাকা, পৃ. ১৫২।

৩১৭) ছাত্রলীগের এই অংশের তরফ থেকে তখন নতুন একটি শ্লোগানও শােনা যেত, কমরেড শেখ মুজিব লও লও লও সালাম। ছাত্রলীগে থেকে তারা যেভাবে নানান কর্মসূচির মাধ্যমে একাত্তর পূর্ববর্তীকালে মুজিবকে ক্রমাগত স্বাধীনতার ধারণার দিকে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন এবারও মুজিবকে নতুন ধারার শ্লোগানের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে- এমনি বিবেচনাবােধ দ্বারা তাড়িত হচ্ছিল ছাত্রলীগের এই অংশ তখন। তাদের মাঝে এসময় আরেকটি পরিকল্পনাও কাজ করেছে। যেভাবে তারা একাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে স্বাধীনতার দাবি তুলে গতানুগতিক বামপন্থীদের রাজনীতি কেড়ে নিতে পেরেছিল, এবারও সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের আওয়াজ তুলে এবং মুজিবকে ‘কমরেড’ বানিয়ে মাঠ পর্যায়ের প্রথাগত কমিউনিস্টদের রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যাবে। কিন্তু মুজিব তার শ্রেণী অবস্থানেই রয়ে গেলেন- দ্বিধাবিভক্ত ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থীদের সম্মেলনস্থলে গেলেন না তিনি। মুজিবের ঐতিহাসিক ঐ সিদ্ধান্তে সিরাজ অনুসারীদের ‘কমরেড শেখ মুজিব লও লও-লও সালাম’ শ্লোগানের করুণ সমাপ্তি ঘটল।

উল্লেখ্য, ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী এই অংশ একাত্তরের পূর্বে প্রথাগত কমিউনিস্টদের নানানভাবে হেয় করার চেষ্টা করত- যার মধ্যে তাদের প্রিয় একটি শ্লোগান ছিল: ‘হাে হাে মাও মাও – চীন যাও ব্যাঙ খাও।’ সেই স্মৃতির কারণে একাত্তরের পর একই তরুণরা যখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর ধারণা উত্থাপন করলেন তখন সবাই বিষয়টি অস্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিল।

৩১৮) মনিরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৮।

৩১৯) আল মাহমুদ, কবির মুখ, আদর্শ, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৬০।

Page 203

এ পর্যায়ের সামগ্রিক ঘটনাবলি যে মুজিব ও সিরাজের পারস্পরিক বােঝাপড়ার একেবারে বাইরে ঘটেনি সেরকম সাক্ষ্যও মেলে। মুজিব ও সিরাজ উভয়ে একটি বিষয়ে এ সময় একমত ছিলেন, সমাজতন্ত্রের শ্লোগানধারী জঙ্গী একটি দলের জন্য ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর উত্তাল এই তারুণ্যকে সর্বহারা পার্টি, মাওবাদী নকশাল, সিপিবি বা ন্যাপ থেকে সরিয়ে রাখার আর কোনাে উপায় নেই।৩২০

এই দৃষ্টিভঙ্গি যে কতটা সঠিক তার প্রমাণ মেলে মাঠ পর্যায়ের তাৎক্ষণিক চিত্র থেকে। ১৬ ডিসেম্বরের পরপর বাহাত্তরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে যত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সব কয়টিতে ছাত্র ইউনিয়ন জয়লাভ করে । মূলত তাদের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিই তরুণদের আকর্ষিত করে। কিন্তু পরের বছর যখন দেখা যায় সিপিবির অঙ্গসংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ক্রমে মুজিবকে অন্ধভাবে সমর্থন দিচ্ছে আর ছাত্রলীগেরই একটি ধারা মুজিবের বিরােধিতা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বনি দিয়ে জঙ্গী অবস্থান নিয়েছে তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একচেটিয়াভাবে জাসদপন্থী ছাত্রলীগ জয়লাভ করতে শুরু করে । জাসদপন্থী ছাত্রলীগ তখন ছাত্র ইউনিয়নকে বলত “বি-টিম’। আর ছাত্র ইউনিয়নের কাছে প্রথমােক্তরা ছিল ‘বিভ্রান্ত মাওবাদী।’

……………………………………………………………..

৩২০) ৯৩ নং ফুটনােটে উল্লিখিত সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ সূত্রটির তরফ থেকেই এই মন্তব্যটি পাওয়া। এ ধরনের বিশ্লেষণ বর্তমান লেখক মাঠপর্যায়ে অনেক জাসদ নেতার তরফ থেকেই পেয়েছেন। যেমন সিরাজগঞ্জের জাসদ নেতা আবদুর রউফ পাতা বলেন, “আমি জেলে। থাকতে জাসদ গঠন ও এর রাজনীতি নিয়ে নিজের মধ্যে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। আমি সেখান থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আট পাতার একটা চিঠি লিখি। আমার ভেতরে প্রশ্ন ছিল- জাসদ কি স্বাধীনতা-উত্তর তারুণ্যের সমাজতান্ত্রিক আকাক্ষা ধারণ করার জন্য তৈরি হয়েছে? না-কি সেই আকাঙক্ষাধারী তরুণদের একটি জালে আটকানাে হয়েছে? আমার চিঠির উত্তরে আ ফ ম মাহবুবুল হক ১৩ পাতার উত্তর পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি সেদিন। আবদুর রউফ পাতার সাক্ষাৎকার, পূর্বোক্ত। ২০১৪ সালে মারা গেছেন আবদুর রউফ পাতা।

Page 204

উল্লেখ্য, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ ও ‘মুজিববাদ’পন্থী৩২১ উভয় অংশ তাদের ঐতািসিক সেই দ্বিধাবিভক্ত সম্মেলনের শেষ দিন ২৩ জুলাই দুপুরে ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এভাবেই কার্যত স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব বাহিনীর প্রথম দফা ভাঙন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রায় একই সময় কৃষক লীগ ও শ্রমিক লীগেও৩২২ উপরিউক্ত দুই ধারার অনুসারীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যান। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ শেষে মুজিববাদপন্থী ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয় শেখ

…………………………………………………………

৩২১) এ সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘মুজিববাদ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হয়। শেখ মণি তাঁর সম্পাদিত ‘বাংলার বাণীতে এবং তােফায়েল আহমেদ বিভিন্ন জনসভায় এ বিষয়ে প্রায়ই গুরুত্বের সঙ্গে আলােকপাত করতেন। সাংবাদিক আশরাফ কায়সারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমেদ প্রথম শাসক দলের দর্শন হিসেবে ‘মুজিববাদ’-এর উল্লেখ করেন। তিনি মুজিববাদকে বিশ্বের তৃতীয় মতবাদ হিসেবে উল্লেখ করেন। (দেখুন, আশরাফ কায়সার, বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৫, ঢাকা, পূ, ৩৮)। মুজিববাদ বলতে আর্থসামাজিকভাবে কী বােঝানাে হচ্ছে সে বিষয়ে মুজিবুর রহমান নিজে আলােকপাত করেছেন কমই। এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তাঁর মতামত চাইলে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছিলেন তিনি :

একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শােষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শােষিত হয়েছে কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীসহ মেহনতী মানুষ। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোন কোন সহযােগী শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলেন। আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। আমি।বলি যার যার ধর্ম তার তার। এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। সেইসঙ্গে বলি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ। দেখুন, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, মুজিববাদ, ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ১৯৭২।

উল্লিখিত গ্রন্থের একেবারে শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারটি মুত্রিত হয়েছে। উল্লেখ্য, শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘বাকশাল’-এ আওয়ামী লীগের বাইরে যে ১০ ব্যক্তি স্থান পেয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন উপরােক্ত ‘মুজিববাদ’ গ্রন্থের লেখক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস। লক্ষ্যণীয়, মুজিব নিজে ‘গণতন্ত্রকে মুজিববাদের প্রথম স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করলেও বাস্তবে তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ঐ একদলীয় ব্যবস্থার পক্ষে জাতীয় সংসদে ২৯২ জন সদস্য সমর্থন জানিয়েছিলেন। না সূচক কোনাে ভােট পড়েনি তাতে। মুজিববাদকে প্রথম বিপ্লব’- এর তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে নিয়ে মুজিব বাকশাল’কে অভিহিত করেন দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে। দেখুন, ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী অনুমােদন কালে প্রদত্ত তাঁর ভাষণ।

৩২২) শ্রমিক লীগের ভাঙন প্রক্রিয়াটিও ছিল উত্তেজনা বহুল। এই সংগঠনটি বরাবর আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু তার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা রুহুল আমীন ভূইয়া যখন সিরাজুল আলম খানদের পক্ষাবলম্বন করতে শুরু করেন তখন ১৯৭২-এর ৬।ডিসেম্বর তাকে আটক করা হয়। তবে হাজার হাজার উত্তেজিত শ্রমিক তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকার রমনা থানা ঘেরাও করে ছাড়িয়ে নিয়ে যান তাঁকে।

Page 205

শহিদুল ইসলামকে, সাধারণ সম্পাদক হন এম এ রশিদ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হন শফিউল আলম প্রধান। অপরদিকে, পল্টনের সমাবেশ থেকে সিরাজুল আলম খান সমর্থক ছাত্রলীগের নতুন যে কমিটি ঘােষণা করা হয় তাতে সভাপতি পদে শরীফ নুরুল আম্বিয়াই রইলেন, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক আর সাংগঠনিক সম্পাদক হলেন বদিউল আলম। তবে শেষােক্তদের রাজনীতি তখন আর শিক্ষাঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকলাে না। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে নতুন দল গড়ার কর্মযজ্ঞ। প্রায় দু মাস পরে ১৭ সেপ্টেম্বর পল্টনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের পরবর্তী এক জনসভায় আ স ম আব্দুর রব নতুন দল প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন। এসময় শেখ মণি চেষ্টা করছিলেন গণমাধ্যমে শেষােক্তদের প্রচার যেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রচার কৌশলের মাধ্যমে সিরাজ অনুসারীরা দেশে নতুন একটি শ্লোগান ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন : ‘আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ইতােমধ্যে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ও লে. কর্নেল তাহেরের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের যােগাযােগ ঘটে গেছে।৩২৩ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামে পার্টির নামও ঠিক হয়ে গেছে। ১৯৭২-এর ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে দলটি গঠিত হলেও ১৭ নভেম্বর বায়তুল মােকাররমে এর প্রথম জনসভা হয়; আর বড় আকারে প্রকাশ্য সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৩ ডিসেম্বর । ১৯৭৩-এর ১১ মে জাসদের প্রথম জাতীয় সম্মেলন বসে পল্টনে। ঐ সম্মেলন চলে তিন দিনব্যাপী । দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ। যদিও সাধারণ্যে তখনও এরা ছাত্রলীগের ‘রব গ্রুপ’ বা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী গ্রুপ মাত্র। কিন্তু ইতােমধ্যে

………………………………………………………..

৩২৩) এই যােগাযােগ ঘটে উভয়ে সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থাতে। মুক্তিযুদ্ধের পরপর যশাের- খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে ভারতীয় বাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায়। মেজর জলিলের সঙ্গে তৎকালীন কর্তৃপক্ষের দূরত্ব তৈরি হয় এবং আটক হন তিনি। পরে সামরিক আদালতে তাঁর বিচার হয়- যে আদালতের বিচারক ছিলেন লে. কর্নেল আবু তাহের। বিচার শেষে জলিল অভিযােগ থেকে নিষ্কৃতি পেলেও সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে আসেন। জলিলের বিচার শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই ১৯৭২ সালের আগস্টে আবু তাহের এডজুটেন্ট জেনারেলের পদ থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসে বদলী হন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে। সেখানে থাকাবস্থাতে এক মাস পর ২২ সেপ্টেম্বর তিনিও সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। জলিলের মাধ্যমেই সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আবু তাহেরের পরিচয় হয় বলে দাবি করেছেন গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ, ‘তাহের-জিয়া ও ৭ নভেম্বর, প্রথম আলাে, ২ জুন ২০১৩, ঢাকা। উল্লেখ্য, বিচারকালে সেক্টর কমান্ডার জলিলের বিরুদ্ধে বিজয়ােত্তর খুলনায় অন্তত দু’জন বিহারি নারীকে লাঞ্ছনারও অভিযােগ আনা হয়েছিল। তবে এসব অভিযােগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থানীয় জেলা প্রশাসককে সাক্ষ্য হিসেবে হাজির করা হয়নি সামরিক আদালতে ।

Page 206

সদম্ভেই জাসদ তার কেন্দ্রীয় কমিটির ৩২৪ সদস্যদের নাম ঘােষণা করে, যার পাঁচ জন সহ-সভাপতির একজন হন লে. কর্নেল আবু তাহের৩২৫-যদিও তাঁর নামটি

……………………………………………………………..

৩২৪) কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে ছিলেন, সভাপতি: মেজর এম এ জলিল, সাধারণ সম্পাদক: আ স ম আবদুর রব, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক: শাজাহান সিরাজ, সাংগঠনিক সম্পাদক: নূর আলম জিকু প্রমুখ। লক্ষ্যণীয়, দলটির মূল উদ্যোক্তা ও তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান নিজেকে কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কোনাে দায়িত্বে সম্পৃক্ত করেননি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পূর্বে শ্রমিক লীগের সদস্য হওয়া ছাড়া সিরাজুল আলম খান আর কখনাে কোনাে সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। শ্রমিক লীগ ভেঙে গেলে ঐ সংগঠনের সদস্যপদও ত্যাগ করেছিলেন তিনি।

৩২৫) তাহেরের জাসদে যােগদান ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, তাহের শুধুই একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন ১১ ভাই-বােন, যারা সবাই ছিলেন কমবেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাদের পুরাে পরিবার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং সাহসী ভূমিকা রেখেছিল । আবু তাহের ছাড়াও এ পরিবারের আরও তিন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছিলেন। তাহেরের সঙ্গে তাঁর এই ব্রাদার্স প্লাটুন’ও জাসদে সক্রিয় হয়। জাসদে যােগ না দিলে এই পরিবার যে তাহেরের নেতৃত্বে অন্যকোন বামপন্থী দলে যােগ দিত তাও নিশ্চিত। কারণ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের পরই তাহের বদরুদ্দীন উমর, আবুল বাশার, সিরাজুল হােসেন খান প্রমুখ তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বলে জানা যায়। দেখুন, আলতাফ পারভেজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯০। কেবল সামরিক দিক থেকেই নয়, তাহেরদের এই ব্রাদার্স প্লাটুন রাজনৈতিকভাবেও ছিল শিক্ষিত। তাহের নিজে সামরিক বাহিনীতে যােগদানের পূর্বে চট্টগ্রামের ফতেহবাদে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। ঐ স্কুলে ছিলেন মাস্টার দা সূর্যসেনের কয়েকজন অনুসারী। তাহের এদের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে বিশেষ অনুপ্রাণিত ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিতদের সামরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ধারণাটি তিনি এরূপ উৎস থেকে পেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাহেরের অন্য ভাইয়েরাও জাসদের মূলশক্তিভিত মুজিব বাহিনীর রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার একেবারে উল্টো ঘরানার অরিন্টেশন প্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর দুই ভাই আনােয়ার হােসেন ও আবু সাঈদ তরুণ বয়সে সিরাজ সিকদারের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ১৯৬৭ থেকে। এদের মাধ্যমেই স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৯ সালে তাহেরের পরিচয় ঘটেছিল সিরাজ সিকদারের সঙ্গে। তাহের ও সিরাজ সিকদার ঢাকায় ‘৬৯-এর জুলাইয়ে যৌথভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করেছিলেন। পরে সিরাজ সিকদার ও তাহেরের মাঝে নেতৃত্বজনিত বিবাদ ও আস্থাজনিত সংকটে সেই প্রকল্প ভেঙে যায়। আনােয়ার হােসেনের মাধ্যমে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে পরিচয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফরিদপুর হাউজ’-এ (বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা আবু ইউসুফ বীরবিক্রমের বাসা) দু’নেতার একাধিক বৈঠক শেষে জাসদে যােগ দেন তাহের। তবে জাসদেও তাহের ও তার পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শ এক ধরনের স্বাতন্ত্র নিয়ে যে ভিন্নভাবে প্রবাহমান ছিল তার প্রমাণ দেখা যায়, পঁচাত্তরে গণবাহিনী ও সিপাহী অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক কার্যক্রমে। কেবল সাতই নভেম্বরই নয়, ২৬ নভেম্বর তাহেরের ভাইয়েরা প্রায় নিজস্ব সিদ্ধান্তে, পার্টিকে অবহিত না করেই, ঢাকস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে অপহরণের চেষ্টার মধ্য দিয়ে জাসদ রাজনীতিতে তাদের পরিবারের স্বাতন্ত্রমূলক কার্যক্রমের আরেক ঝুঁকিপূর্ণ নজির রাখেন। ঐ অপারেশনে তাহেরের এক ভাই মারা যান। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে তাহের ছিলেন কোয়েটায় । পালিয়ে এসে যুদ্ধে যােগ দেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বালুচ রেজিমেন্টে থাকার কারণে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তার বন্ধুত্বের পরিধি ছিল সীমিত- যার উল্টোটি আমরা দেখবাে তাদের ক্ষেত্রে যারা ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন। সম্পর্কের এই দিকগুলাে পরবর্তীকালে তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত সিপাহী অভ্যুত্থানের সাফল্য-ব্যর্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

Page 207

প্রকাশ্যে ঘােষণা করা হয়নি তখন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৮০৫ জন কাউন্সিলর যােগ দিয়েছেন জাসদের প্রথম সম্মেলনে যা ছিল দলটির দেশব্যাপী দ্রুত সাংগঠনিক বিস্তৃতির প্রাথমিক এক লক্ষণ।

প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর নতুন দলের নীতিনির্ধারকরা কয়েকটি অঙ্গ সংগঠন গড়ে তােলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও কার্যত তাদের শক্তিভিত হয়ে থাকলাে ছাত্রলীগই। তেহাত্তরের জুনে পরের সম্মেলনে জাসদ-ছাত্রলীগের নেতা হয়ে এলেন সভাপতি হিসেবে আ ফ ম মাহবুবুল হক এবং সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্না।৩২৬ ইতােমধ্যে দেশের প্রধান প্রধান ক্যাম্পাসে এই ‘জাসদ ছাত্রলীগ’ই প্রধান সংগঠন হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিহাত্তরের আগস্টে যখন কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচন এল দেখা গেল এদের ঠেকাতে ছাত্রলীগের মুজিববাদপন্থী গ্রুপ ও ছাত্র ইউনিয়ন একজোট হয়ে গেছে। এই জোটের তরফ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল-আলম লেনিনকে ভিপি এবং ছাত্রলীগের ইসমাত কাদির গামাকে জিএস প্রার্থী করে একক প্যানেল দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বিজয়৩২৭ যখন রােখা যাচ্ছিল না এবং

……………………………………………………………

৩২৬) আ ফ ম মাহবুবুল হকের পর মাহমুদুর রহমান মান্নাকে স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্রলীগের (জাসদপন্থী) বড় চমক বলা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষার্থী ছিলেন। জন্ম ১৯৫০-এ। স্বাধীনতাত্তোর প্রথম চাকসু নির্বাচনে (১৯৭২) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঐ নির্বাচনে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা; সংসদের ২৭টি পদের মধ্যে ২৫টিতে ছাত্র ইউনিয়ন জয়লাভ করে, কিন্তু মান্নার জনপ্রিয়তার কাছে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মােহাম্মদ আবদুল্লাহ হেরে যান।

বাগ্মীতার জন্য খ্যাতিমান ছিলেন মান্না। তাঁর সাংগঠনিক সম্ভাবনাকে শনাক্ত করেই সিরাজুল আলম খান ও আ স ম রব যৌথসিদ্ধান্তে তাকে চাকসু নির্বাচনের পরই ঢাকা নিয়ে আসেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করে- যা ছিল তখন খুবই ব্যতিক্রমী এক সিদ্ধান্ত। কারণ জাসদ-ছাত্রলীগে তখন সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঢাকাকেন্দ্রিক অন্তত ছয় নেতা (বদিউল আলম, রেজাউল হক মােশতাক, জেড আই খান পান্না, রায়হান ফেরদৌস মধু, একরামুল হক, জালাল উদ্দীন শােয়েব প্রমুখ)। তাছাড়া মান্না তখনও স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন শুরু করেননি। এ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন গণিতশাস্ত্রে। পরে ডাকসু নির্বাচনে পরপর দু’বার (‘৭৯-৮০ এবং ‘৮০-‘৮১) ভিপি পদে বিজয়ী হন। প্রথমবার জাসদ ছাত্রলীগ থেকে পরে বাসদ ছাত্রলীগ থেকে।

৩২৭) ডাকসুতে তিহাত্তরে জাসদপন্থী ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী আ ফ ম মাহবুবুল হক ছিলেন ক্যাম্পাসে ব্যাপক জনপ্রিয়। পুরাে নির্বাচনে জাসদ তাঁকেই সামনে নিয়ে এসেছিল। ফলে ভােট গণনার সময় দেখা গেল ডাকসুসহ সব হলে (শুধু জগন্নাথ হল ব্যতীত) মাহবুবুল হক- জহুর প্যানেলের প্রার্থীরা এগিয়ে আছে। আ ফ ম মাহবুবুল হক সম্পর্কে আরও তথ্য দেখুন ১৭৫ নং তথ্যসূত্রে ।

Page 208

ভােট গণনাকালে যখন দেখা গেল, ছাত্র ইউনিয়ন ও আওয়ামী ছাত্রলীগের যৌথ প্যানেলের চেয়ে জাসদ-ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর প্যানেল সকল পদে ব্যাপক ভােটে এগিয়ে আছে তখনি এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে ছাত্রলীগের শেখ মণি গ্রুপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে যৌথভাবে ভােট গণনা কার্যক্রম বানচালের জন্য সন্ধ্যার আঁধারে ভােট গণনাস্থলে এসে সশস্ত্র হামলা চালায়।৩২৮ এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্র-ছাত্রী সংসদের প্রথম নির্বাচন ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে পণ্ড হয়ে গিয়েছিল। সেখানেও আক্রান্ত ও আক্রমণকারী।উভয়ে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার অনুরূপ। দেশের প্রধান দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের এইরূপ অভিজ্ঞতার পরপরই দেশজুড়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু হয় মুজিব বাহিনীর সশস্ত্র সক্রিয়তার নতুন আরেক তরঙ্গ। আর তাতে শুরুর বলী হয় ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র রাজনীতিতে মূল দ্বন্দ্বের জায়গা থেকে ছিটকে পড়ে পুরানাে এই সমাজতন্ত্রীরা। মুজিববাদী ছাত্রলীগের ‘মুখােমুখি দাড়ায় তখন জাসদ-ছাত্রলীগ। রাজনীতিমুখী সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সংখ্যাগরিষ্ঠই এভাবে মেরুকৃত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের মাঝে এইরূপে মেরুকরণ ঘটানােই ছিল এই উদ্যোগের লক্ষ্য।

…………………………………………………………………

৩২৮) সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন (তিনি ভােট গণনা প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন):…নির্বাচনের ফল আসার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছিল সব হলে বিরােধীরা জয়ী হয়েছে। অথচ সারা দিন এলাকাজুড়ে শােনা গিয়েছিল শুধু লেনিন-গামা’, ‘লেনিন-গামা’ ।…আসলে ব্যালট বিপ্লব হচ্ছিল নীরবে । …হলগুলােতেই গণনা হয়েছে’ প্রথমে। ডাকসুরটা গণনা হওয়ার কথা শেষে। সন্ধ্যার পরে, যখন ডাকসুর নির্দিষ্ট ব্যালট বাক্সগুলাে নির্দিষ্ট স্থানে নেয়া হবে।…হলের ফল দেখেই সন্দেহ রইল না ডাকসুতে ফল কী হবে।… কলাভবনের চারতলায় গণনার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে, হঠাৎ সব বাতি নিভে গেল। পেছনের সিড়ি দিয়ে কে বা কারা এসে ব্যালট বাক্সগুলাে নামিয়ে নিয়ে চলে গেল ।..বােমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল ওরা। প্রতিরােধের মতাে কেউ ছিল না। …চারতলা থেকে আমরা নিচে এলাম। উপাচার্যও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কলাভবনের সামনে দেখলাম চিফ রিটার্নিং অফিসার প্রফেসর ওদুদুর রহমান গাড়িতে চড়ছেন। তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন জানার কৌতুহল ছিল। কে যেন বলল বত্রিশ নম্বরে। ঐ যাত্রায় সত্য-মিথ্যা জানা হয়নি।

দেখুন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আত্মজীবনী: দুই যাত্রায় এক যাত্রী, সাপ্তাহিক। http://www.shaptahik.com/v2/print_publication/index.php?DetailsId=4128 (৮জুন ২০১৩ তারিখে সংগৃহীত)। ১৯৭৩-এ উপরােক্ত ঘটনার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ছিলেন ড. আবদুল মতিন চৌধুরী এবং শিক্ষকদের তরফ থেকে এ বিষয়ে উল্লেখযােগ্য কোনাে প্রতিবাদ দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, মতিন চৌধুরী ছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর দ্বিতীয় উপাচার্য।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!