You dont have javascript enabled! Please enable it! মুজিব বাহিনীর বিভক্তির পটভূমি | সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মণি’র দ্বন্দ্ব - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিব বাহিনীর বিভক্তির পটভূমি সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মণি’র দ্বন্দ্ব

নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি।বাঁচাইয়া রাখিবার মহৎ উদ্দেশ্যেই ভারতীয় নেতৃত্ব মুজিব বাহিনী গঠন করার প্রয়ােজন বােধ করিয়াছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতা আসিলে, রাষ্ট্র ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনীর হাতে যাইতে বাধ্য, ভারতীয় নেতারা তা বুঝিতেন। আট-দশ হাজার ট্রেনিং-প্রাপ্ত সৈন্যের সঙ্গে আরও আশি-নব্বই হাজার মুক্তিফৌজ যােগ দিয়াছেন। অধিকাংশই ছাত্র। এদের মেজরিটি আবার ছাত্র ইউনিয়নের লােক। ছাত্রলীগাররা সেখানে মাইনরিটি। ছাত্র ইউনিয়নের প্রায় সবাই ন্যাপ। ন্যাপ মানেই কমিউনিস্ট।… এই বামপন্থীরা মুক্তিবাহিনী সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা দখলই সমর্থন করিবেন। এটা ভারতীয় বাহিনীর বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না।… তাই সাবধানতা হিসেবেই তারা ডেমােক্র্যোটিক পলিটিক্স ওরিয়েনটেড মুজিব বাহিনী গঠন করিয়াছিলেন।…এই রিপাের্ট আমি বিশ্বাস করিয়াছিলাম। পলিটিক্যাল মােটিভেশন হিসেবে ‘মুজিববাদ’ কথাটাও জন্ম হইয়াছিল ওখান হইতেই ।

                -আবুল মনসুর আহমেদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক১৬৭

পূর্ববর্তী অধ্যায় ও উপ-অধ্যায়গুলােতে ‘মুজিব বাহিনী গড়ে ওঠার দীর্ঘ।রাজনৈতিক, সামরিক ও আঞ্চলিক পশ্চাৎ ইতিহাসটি অতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল কিংবা বুয়েটের ক্যাফেটারিয়া থেকে

……………………………………………………………..

১৬৬) Praveen Swami, Ibid.

১৬৭) আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলি, তৃতীয় খণ্ড, বাংলাএকাডেমি, ঢাকা, ২০০১, পৃ. ৪৬২-৪৬৩।

Page 115

শুরু করে ভারতের হিমাচল প্রদেশে আশ্রয় নেয়া তিব্বতি প্রবাসী সরকার পর্যন্ত যার বিস্তৃতি ও সংশ্লিষ্টতা। এই মুজিব বাহিনীর জনবলের একাংশের সমন্বয়েই কালক্রমে গড়ে উঠেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও রক্ষীবাহিনী। এবার স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের সে অধ্যায়ের আলােচনা।

যে কোনাে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠারই আত্মগত-বস্তুগত, বহুবিধ কারণ থাকে। জাসদ-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। জাসদের উত্থানের অন্তত একটি অনিবার্যতা চিহ্নিত করা যায় এর প্রধান সংগঠক সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে মুজিব বাহিনীতে শেখ মণি’র দ্বন্দ্বকে। মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ মণি ও তাজউদ্দীন আহমদ-এর রেষারেষির মতােই (যার বিবিধ অভিব্যক্তি ইতােমধ্যে আমরা উল্লেখ করেছি) আরেক ধরনের দ্বন্দ্ব কাজ করত সিরাজুল আলম খান ও ফজলুল হক মণি’র মধ্যে প্রথম দ্বন্দ্বটি ব্যক্তিগত হলেও দ্বিতীয় দ্বন্দ্বটি ছিল একই সঙ্গে নীতিগত ও ব্যক্তিগত। এমনকি একাত্তরের নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ কোথাও কোথাও তা সশস্ত্র রূপ নেয়। শেখ মণিরা ছিলেন মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের।কট্টর ভক্ত এবং তার সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের দাবিদার। বিএলএফ-এর মাধ্যমে তাঁরা বামপন্থীদের ব্যর্থ করে দেয়া ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর ‘মুজিব অনুসারী আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে সিরাজুল আলম খানরা স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন হলেও মুজিবের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত ছিল না। তাছাড়া সত্তর ও আশির দশকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাবে এদের মাঝে সমাজতন্ত্রের আবেদন বাড়ছিল এবং বলা বাহুল্য, সিরাজুল আলম খান নিজেও ছিলেন ফজলুল হক মণি’র মতােই নেততের প্রশ্নে উচ্চাকাক্ষী।

রাজনৈতিক আদর্শের ফারাক, নেতৃত্বের প্রতিযােগিতা ছাড়াও উপরােক্ত দুই ধারার কর্মীদের মাঝে জীবনাচারের সংস্কৃতিতেও ছিল ব্যাপক অমিল। সাংস্কৃতিক এই ভিন্নতা প্রকট হয় যুদ্ধোত্তর সমাজে। অতি সংক্ষেপে এই বৈপরীত্যকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এভাবে যে, ফজলুল হক মণি ও তার অনুসারীরা যেখানে ছিলেন Pro-establisment, সিরাজপন্থীরা সেখানে ছিলেন অপেক্ষাকৃত Anti-establisment. তবে এই বৈপরীত্য ও বিরােধের আঞ্চলিক একটা ধরনও ছিল বলে জানিয়েছেন বিএলএফ-এর হাফলও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী সাহাব উদ্দীন সাথী। তাঁর ভাষায়, দেরাদুন ও হাফলঙ- দু জায়গাতেই নােয়াখালী বনাম ফরিদপুর গ্রুপে মারামারি হয়েছে। প্রধান দুই সংগঠকের গ্রামের বাড়ির পরিচয়কে ঘিরে এই দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। প্রশিক্ষকরাও এই মারামারি দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।১৬৮  প্রথম ব্যাচেরই আরেকজন প্রশিক্ষণার্থী আ

………………………………………

১৬৮) ২৩ এপ্রিল ২০১৩ সালে গৃহীত সাহাব উদ্দীন সাথীর সাক্ষাৎকার।

Page 116

ন ম শফিক উল্লাহর ভাষায়, “আমরা ছিলাম ৮০ ভাগ এবং তারা ছিল ২০ ভাগ। প্রত্যেক গ্রুপকে তাদের নেতারা গােপনে ব্রিফিং দিত।’ ‘আমরা বলতে শফিক উল্লাহ বুঝিয়েছেন নােয়াখালী গ্রুপ তথা সিরাজুল আলম খান গ্রুপের কথা।

‘মুজিব বাহিনী’র দুই ধারার এই বৈপরীত্য যে ‘৭১ সালে যুদ্ধের মাঝেই তীব্র।বৈরিতার জন্ম দেয় সেটা বলতে গিয়ে যুদ্ধকালে শেখ মণি’র অন্যতম সহযােগী অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী লিখেছেন, মুজিব বাহিনীর সিনিয়র লিডারদের তান্দুয়ায় (দেরা দুন) এবং জুনিয়রদের হাফলং (আসাম)-এ পাঠানাে হতাে। সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কমবেশি রাজনৈতিক ট্রেনিংও সবাই লাভ করে । এই রাজনৈতিক টেনিং পর্যায়ে সিরাজ গ্রুপ ও মণি গ্রুপের দর বাড়তে থাকে এবং আফটার শেখ, হু’ প্রসঙ্গ চলে আসে। মুজিব বাহিনীর সামনে মুজিবের অবর্তমানে উত্তরাধিকার নিয়ে কাল্পনিক লড়াই শুরু হয়।১৬৯

আবদুল মান্নান চৌধুরীর সূত্রে আরাে জানা যায়, মুজিব বাহিনীর প্রায় ১৬-১৭টি ব্যাচকে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা প্রশিক্ষণ দেয়। এই বাহিনীর প্রশিক্ষিত যােদ্ধা ছিল আনুমানিক ১২ হাজার।১৭০ মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান এ কে খন্দকার মনে করেন এ সংখ্যা ৯-১২ হাজার । জেনারেল উবান এই সংখ্যা ১০ হাজার বলে উল্লেখ করেছেন।১৭১ লক্ষ্যণীয়, নির্ভরযােগ্য সকল ভাষ্যে মুজিব বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৯-১২ হাজার বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু ১৯৭২-এর ৩১ জানুয়ারি মুজিব বাহিনীর সদস্যরা যখন ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রতীকী অস্ত্র সমর্পণ করছেন।

তখন তাদের সংখ্যা ৭০ হাজার’ বলে উল্লেখ করা হয়।১৭২  ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘সত্তর হাজার মুজিব বাহিনী সদস্যের অস্ত্র সমর্পণ’-এর ঐ ঘােষণাটি ছিল ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক নৈরাজ্যের এক প্রাথমিক পদক্ষেপ, কারণ মুজিব বাহিনীর ঘােষিত সদস্যদের শেখ মণি ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব তসলীম আহমদের স্বাক্ষরে

……………………………………………..

১৬৯) আবদুল মান্নান চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১-৩২।

১৭০) পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১।

১৭১) জেনারেল উবান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০। দেখুন, আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ ১৯৫৩-৯৩, ইউপিএল, ১৯৯৬, ঢাকা, পৃ. ২৭৩। দীর্ঘ চার দশক পরও মুজিব বাহিনীর প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে এই বাহিনীর সদস্যরা যে সংশয় মুক্ত হতে পারছেন না এবং তাদের কাছেও যে এই বাহিনীর সদস্যদের কোনাে তালিকা নেই- তার নজির হিসেবে দেখা যায়- ২০১৪ সালের ৩ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘বিএলএফ সদস্যদের তালিকা’ ভারত থেকে আনার জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরােজ রশীদ সেদিন সংসদে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী তা সমর্থন করেন। বিস্ময়কর হলাে, এইরূপ তালিকা ছাড়া কীভাবে মুজিব বাহিনী সদস্যদের এতদিন ‘মুক্তিযােদ্ধার সনদপত্র দেয়া হয়েছে- সে প্রশ্ন কেউ-ই সংসদে তােলেন নি সেদিন।

Page 117

সেসময় মুক্তিযােদ্ধার সনদও দেওয়া হয়। বাস্তব সংখ্যা ও ঘােষিত সংখ্যার এইরূপ দুস্তর ব্যবধান মুক্তিযােদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ চিরতরে দুঃসাধ্য করে দেয়। অন্যদিকে সনদ দানকারী দু’জনের অন্যতম তসলীম আহমদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনাে সংশ্লিষ্টতাই ছিল না।

উপরােক্ত প্রতীকী অস্ত্র সমর্পণ’ আরেকটি কারণেও প্রশাসনিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল। অস্ত্রসমর্পণ শেষে তার বিরাট অংশই আবার বিভিন্ন জেলায় মুজিব বাহিনী সদস্যদের কাছে ট্রাকে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুজিব বাহিনীর চার শীর্ষ নেতা নিজেদের মাঝে আলােচনার ভিত্তিতেই ভবিষ্যৎ প্রয়ােজন’-এর কথা বিবেচনায় রেখে এরূপ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কারণ তখনও এই বাহিনীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ স্পষ্ট ছিল না। বর্তমান লেখক অন্তত একটি জেলায় (মানিকগঞ্জ) অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্রসমর্পণ শেষে ঐ জেলায় দুই ট্রাক অস্ত্র ফেরত এসেছিল সরাসরি শেখ মণি’র নির্দেশে। পরে অবশ্য ঐ জেলা থেকে ফজলুল হক মণি সমর্থক মুজিব বাহিনী সদস্যরা তাদের নেতা মফিজুল ইসলাম খান কামালের মাধ্যমে অনেক অস্ত্র ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু মুজিব বাহিনীর জাসদমুখী অংশ (ঐ জেলায় যাদের নেতৃত্বে ছিলেন আনিসুর রহমান খান) তাদের অস্ত্র আর ফেরত দেয়নি। এভাবে প্রায় প্রতি জেলাতে মাঠ পর্যায়ে বিপুল অস্ত্র থেকে যায়- যা পরে জাসদের সশস্ত্র শাখা ‘গণবাহিনীর সঙ্গে ‘রক্ষীবাহিনী’ ও ‘লাল বাহিনীর সংঘর্ষে ব্যবহার হয়েছে ।১৭৩  কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মুজিব বাহিনী সদস্য জিয়ারুল ইসলামও সাক্ষাৎকারে কিছু কিছু অস্ত্র রেখে দেওয়ার সত্যতা স্বীকার করছেন। তবে তাঁর ভাষায়, ‘অস্ত্র রেখে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সংগঠক ও নেতৃত্ব পর্যায়ে তাদের কাছেই কেবল বাড়তি অস্ত্র ছিল। একটা করে অস্ত্র ছিল এমন সাধারণ যােদ্ধাদের সেটা জমা দিতেই

…………………………………………………

১৭৩) মুজিব সরকারের ডাকে যুদ্ধোত্তর সময়ে সব মিলে মাত্র ৩০ হাজার অস্ত্র সমর্পিত হয়েছিল- যার মধ্যে উন্নত অস্ত্রের পরিমাণ ছিল অতি কম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যশাের ব্রিগেডের কমান্ডার মঞ্জুর পরবর্তীকালে লেখক অ্যান্থনী মাসকারেণহাসকে দেয়া এক সাক্ষাত্তারে দাবি করেছেন, তাঁর অধীনস্ত ছয়টি জেলা থেকেই মুজিব শাসনামলে সেনাবাহিনী কর্তৃক অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে ৩৩ হাজার অস্ত্র উদ্ধার হয়। (দেখুন, অ্যান্থনী মাসকারেণহাস, বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, অনুবাদ: মােহাম্মদ শাহজাহান, হাক্কানী পাললিশার্স, ১৯৮৮, ঢাকা, পৃ. ৩৩ ও ৪৩)। উল্লেখ্য, অস্ত্র উদ্ধারে সফলতার লক্ষ্যেই মুজিব বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে (২৪ ফে.) প্রথমে মুক্তিবাহিনীকে এবং পরে (২৭ ফে.) মুজিব বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘােষণা করেছিলেন (দেখুন, মওদুদ আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৭)। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়। বেসামরিক এসব উন্নত অস্ত্রধারীদের মােকাবেলায় পরবর্তী বছরগুলােতে প্রশাসনকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

Page 118

হয়েছে।’ জিয়ারুল ইসলাম আরও জানিয়েছেন, ঢাকায় অস্ত্রসমর্পণের পরই মুজিব বাহিনী সদস্যদের এক শত টাকা এবং একটা করে কম্বল দিয়ে পিলখানায় থাকার ব্যবস্থা করা হয় প্রয়ােজনীয় ব্রিফিংয়ের জন্য। সেখানে ব্রিফিংকালে তােফায়েল আহমেদ বিশেষভাবে আমাদের ধন্যবাদ দেন ‘মুজিব-আদর্শ’ টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য এবং জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও একইভাবে মুজিবের আদর্শ টিকিয়ে রাখার জন্য মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আলাদা একটি এলিট বাহিনী গঠিত হবে। সেটায় অন্তর্ভুক্ত থাকার জন্যও তিনি সবাইকে আহ্বান জানান। এই আহ্বান শুনে কেউ কেউ সেখানে থেকে গেলেও অনেকে আবার নিজ দায়িত্বে বাড়ি চলে যান। এভাবেই বাহিনীতে ভাঙনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।’

জিয়ারুল ইসলাম কথিত মুজিব বাহিনীর উপরােক্ত ভাঙন প্রক্রিয়া পুরােপুরি রাজনৈতিক ছিল না। অনেকেই যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পেশায় ফিরে যান নিজ ইচ্ছায়। তবে ততদিনে বাহিনীর চার প্রধান নেতার অনুসারীদের মাঝে রাজনৈতিক মেরুকরণও শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে প্রথমােক্ত বাহিনীতে ভাঙন নতুন অনেকগুলাে বাহিনীর বীজ তৈরি করে।

উল্লেখ্য, একাত্তরে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় বিএলএফয়ে সদস্য সংখ্যার দিক থেকে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের প্রাধান্য ছিল সুস্পষ্ট। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয় মে-জুনে। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে যে ৮ জনকে প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয় তার মধ্যে সাত জনই ছিলেন সিরাজ ভাই’-এর শিষ্য। পরবর্তীকালে প্রশিক্ষকের সংখ্যা যখন ৫২-তে উন্নীত হয় তখন উক্তরূপ অনুগামীর সংখ্যা ছিল ৪৯। বিএলএফ গঠনকালে বাহ্যিকভাবে ফজলুল হক মণি গতিশালীতায় শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও (সিরাজুল আলম খান যুদ্ধের শুরুতে কিছু দিন অসুস্থ ছিলেন বিধায়) তার প্রতিপক্ষ গ্রুপ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এবং সাফল্যের সঙ্গে তাদের অনুসারীদের বাহিনী কাঠামাের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে সন্নিবেশ ঘটাতে সমর্থ হয়; বিশেষত, সিরাজুল আলম খান দেরাদুনে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জ পদে তার অনুসারী হাসানুল হক ইনুকে অভিষিক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া অন্য যারা এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন, শরীফ নুরুল আম্বিয়া১৭৪, আ ফ ম মাহবুবুল হক১৭৫- এরাও ছিলেন সিরাজুল আলম খানের অনুগত। পরে জাসদ গঠনকালেও

……………………………………………………….

১৭৩) পারিবারিকভাবে নড়াইলের অধিবাসী। জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ঢাকার বিজ্ঞান কলেজে ও বুয়েটে লেখাপড়া করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি। বর্তমানে জাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক।

১৭৫) স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্র রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার ছিলেন এই আ ফ ম মাহবুবুল হক। মূলত তার অসামান্য ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে এসময় জাসদপন্থী ছাত্রলীগ বিকশিত হচ্ছিল। ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর নােয়াখালীর চাটখিলের মােহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মাহবুবুল হক এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। প্রথমে ছাত্রলীগের সূর্যসেন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ ছাত্রলীগে প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হন। ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে বিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগ জোট (লেনিন-গামা প্যানেল) ব্যালট পেপার ছিনতাই করে তার ডাকসু ভিপি হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়। পুরাে নির্বাচনে বিপক্ষ প্যানেলের মূল শ্লোগানই ছিল, ‘লেনিন- গামা, নূরা থামা।’ প্রতিপক্ষের তরফ থেকে ‘নূরা’ (পাগলা) কথাটি শ্লেষাত্মকভাবে ব্যবহার করা হতাে মাহবুবুল হককে উদ্দেশ্য করে- কারণ তখন তার মুখ ভরা ছিল বড় বড় দাড়ি গোঁফ। শেষপর্যন্ত রা’কে থামিয়েছিল প্রতিপক্ষ। তবে তা স্বাভাবিক ভােটের হিসাবে নয়।

Page 119

এদেরই নেতৃত্বে দেখা যাবে। কেবল দেরা দুন বা হাফলঙেই নয়- একাত্তরের শুরুতে মাঠ পর্যায়ে হবু যােদ্ধাদের রিক্রুটমেন্টকালেই এইরূপ গ্রুপ চেতনা মুখ্য বিবেচনা হিসেবে কাজ করত বলে জানিয়েছেন কুমিল্লার একটি এলাকায় রিক্রুটমেন্টের দায়িত্বে থাকা সাহাবউদ্দীন সাথী। তাঁর ভাষায়, চৌদ্দগ্রামে বিএলএফ-এর ৫৪ জনকে আমরা রিক্রুটমেন্ট করি। এর মধ্যে ৫০ জন ছিল আমাদের গ্রুপ (সিরাজ গ্রুপ)-এর।’১৭৬

মণি গ্রুপকে কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের পূর্বাপর সিরাজুল আলম খান গ্রুপের এরূপ পরিকল্পিত কার্যক্রমে শেষপর্যন্ত মুজিব বাহিনী সম্পর্কে ‘র’-তে এক ধরনের গভীর সংশয় সৃষ্টি হয়। কারণ এই দুই গ্রুপের আদর্শিক ভিন্নতা তাদেরও নজর এড়ায়নি। এ ছাড়া এসময় এও লক্ষ্য করা যায়, বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের বিরাট সংখ্যকের মাঝে বিশেষত, যারা সিরাজ অনুসারী, তাদের মনােজগতে সমাজতন্ত্রের প্রতি অস্পষ্ট এক পক্ষপাত তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রতিও এদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল না।

ফলে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে দুটি ধারায়। প্রথমত, ১৯৭১-এর ২০ নভেম্বর দেরা দুনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।১৭৭ ১৬ ডিসেম্বর

………………………………………………………………

১৭৬) সাহাবউদ্দীন সাথী, অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার, এপ্রিল ২০১৩, ঢাকা

১৭৭) প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি কেন বন্ধ করে দেয়া হলাে এবং কেন প্রশিক্ষণার্থীদের বের হতে দেয়া হচ্ছে না সে সম্পর্কে কিছুই অবহিত করা হয়নি তাদের। দেখুন, হাসানুল হক ইনুর সাক্ষাৎকার, মাসুদুল হক, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭০। উল্লেখ্য, স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়ার আগেও দেরাদুনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সিরাজুল আলম খানের অনুসারী প্রশিক্ষকদের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের রাজনৈতিক বক্তৃতার কারণে ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা সাময়িকভাবে আরেকবার ক্যাম্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ভারতীয় এই কর্মকর্তাদের একাংশই পরে রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষক হন। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের ওপর আক্রমণের যেসব অভিযােগ উত্থাপিত হয় তার পটভূমি হিসেবে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ‘র’ সংশ্লিষ্ট ভারতীয় প্রশিক্ষকদের একাত্তরকালীন উপরােক্ত টানাপােড়েনের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছিল।

Page 120

পর্যন্ত সেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের একাংশকে আটকে রাখা হয় এবং শেখ মণি ও তার অনুসারীদের নিয়েই জেনারেল উবান অগ্রাভিযান শুরু করেন।১৭৮ মুক্তিযুদ্ধ শেষে

………………………………………………….

১৭৮) এই অগ্রাভিযান শুরু হয় নভেম্বরের শেষে-ডিসেম্বরের শুরুতে। অগ্রাভিযানকালে কী ঘটেছে তার বিবরণের পূর্বে তখনকার পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি। পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রশাসনিক তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে তিনজনকে সার্কেল চিফ হিসেবে নিয়ােগ দিয়েছিল। এর মধ্যে চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকারের সমর্থক ছিলেন। বান্দরবান সার্কেলের চিফ মংশুয়ে প্রু চৌধুরী নিরপেক্ষ অবস্থান নেন এবং মং সার্কেল চিফ মং প্রশ্ন সাইন মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। পুরাে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিভিন্ন নৃ-গােষ্ঠীর অনেক সদস্যও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তবে ত্রিদিব রায় এবং বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরাের ভূমিকার কারণে এই প্রচারণাই ব্যাপকতা পায় যে, স্থানীয় নৃ-গােষ্ঠীগুলাে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে।’

পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের বিশেষ অস্তিত্ব ছিল না। সত্তরের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ত্রিদিব রায় আর প্রাদেশিক পরিষদে অং শুয়ে প্রু চৌধুরী ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। এরা কেউ আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না। ফলে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরােধ ছিল অতি ক্ষীণ । ঠিক এই পটভূমিতে ডিসেম্বরে অত্র এলাকায় শুরু হয় জেনারেল উবানের মুজিব বাহিনী ও স্পেশাল ফোর্সের অভিযান। ভারতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সীমান্ত পথে মুজিব বাহিনীর সদস্য ও স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশের মুহূর্তে কী ঘটেছে তার একটি স্থানের নিম্নোক্ত বর্ণনা দিয়েছেন ঐ এলাকার বাসিন্দা প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত শরদিন্দু শেখর চাকমা: ৫ ডিসেম্বর একটি দল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পানছড়িতে প্রবেশ করে। একদল চাকমা তাদের অভ্যর্থনা জানাতে সেখানে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তারা একটি খাসিও সঙ্গে নিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধারা খাসিটি নিলেও অভ্যর্থনাকারী সবাইকে হত্যা করে। এর পর তারা পানছড়ির পাহাড়ি গ্রামগুলােতে হামলা শুরু করে। বাড়িঘরে লুটপাট চালায় এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। সামনে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে এবং মেয়েদের ধর্ষণ করে। তাদের হামলায় সেদিন পানছড়িতেই ৩২ জন উপজাতি নিহত হয়। পানছড়ি থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে তারা ১৭৬টি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় । ১৪ ডিসেম্বরও তারা ২২ জন উপজাতিকে হত্যা করে। বিস্তারিত দেখুন, মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম, অংকুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ৪৩।

নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর উল্লিখিত ধাচের আক্রমণ চলে এসময় পুরাে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে এবং তা অব্যাহত থাকে একাত্তরের ডিসেম্বর পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৭২-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি গড়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং তার প্রায় এক বছর পর গড়ে ওঠে এই দলের সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী। শান্তিবাহিনী গড়ে ওঠার অন্যতম তাৎক্ষণিক কারণ ছিল পাহাড়ি গ্রামগুলােকে মুক্তিযােদ্ধাদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা তথা ‘শান্তি স্থাপন। শান্তিবাহিনীকে মােকাবেলায় মুজিব ভারতের কাছে সুনির্দিষ্ট সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন। দেখুন, J. N. Dixit, Liberation and Beyond: Indo-bangladesh relation, UPL, 1999, Dhaka, p. 138, 158. ফল হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে অরতীয় বাহিনী চলে যাওয়ার সময় তাদের একটি ব্রিগেড রেখে দেয়া হয়েছিল কক্সবাজারে এবং ঐ ব্রিগেড ১৯৭২ সালের জুলাই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন চালিয়ে তবেই দেশে প্রত্যাবর্তন করে। এই অধ্যায়ের কৌতুককর দিক হলাে, কক্সবাজারে ভারতীয় একটি ব্রিগেডের উপস্থিতি গােপন রেখেই বাহাত্তরের ১২ মার্চ জানানাে হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে সব ভারতীয় সৈন্য চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু দিন পর মার্চের শেষে এই বিষয়টি গণমাধ্যমে নিয়ে আসেন তরুণ এক মার্কিন সাংবাদিক। সরকার প্রথমে গণমাধ্যমের ঐ প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করলেও পরে অধিকতর ব্রিত অবস্থা এড়াতে পূর্বতন ভাষ্য প্রত্যাহার করে নেয়। বিস্তারিত দেখুন, S. M. Ali, ibid, p. 156. বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে বরাবরই ১৯৭৬ সালে বাঙালিদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সংকট শুরু বলে ভুলভাবে দেখানাে হয় এবং এই সংকটের সঙ্গে এসএফএফ ও মুজিব বাহিনীর কোনাে যােগসূত্র দেখাতেও মােটদাগে ব্যর্থ তারা ।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ৭৯ বছর বয়সে পাকিস্তানে মারা যান। শেষ ইচ্ছা ও পরিবারের আগ্রহ সত্ত্বেও পুরানাে আক্রোশবশত বাংলাদেশে অনেকের বিরােধিতার কারণে তার মরদেহ পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা যায়নি।

Page 121

রক্ষীবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে যার ভিন্ন একটি বিকাশধারা দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, সিরাজুল আলম খানদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক নৈকট্য তৈরি হতে থাকে। এই নৈকট্যের ফল হয় দুটি- স্বাধীন দেশে তাজউদ্দীন আহমদ ও সিরাজুল আলম খানের সমন্বয়ে নতুন দল গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে কানাঘুষা বেড়ে যায়, এবং ফজলুল হক মণিও সতর্ক হয়ে ওঠেন হবু দলকে মােকাবেলায় । বাহাত্তরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরামাত্র তার সেহধন্য মণি যে আসন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতে সফল হয়েছিলেন। তাজউদ্দীনের প্রতি মুজিবের কঠোর মনােভাব থেকে তা আঁচ করা যাচ্ছিল।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সিরাজুল আলম খান ও তাজউদ্দীন আহমদের সমন্বয়ে বামপন্থী ধারায় নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টির গুঞ্জন শােনা গেলেও মুজিব বাহিনীতে সংশ্লিষ্টতার কারণে সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুগামীদের নিয়ে নতুন দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সন্দেহ ও অবিশ্বাসও ছিল প্রবল। বস্তুত এই গ্রুপের জন্য ঐ সংশ্লিষ্টতাই ছিল বড় এক ঐতিহাসিক দায় । ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ১৯৬২-৬৩ থেকে নিউক্লিয়াস গঠন করে জাতীয় রাজনীতির বহু কর্মসূচির কর্তৃত্ব ও প্রশংসা ভােগ করছিল এই গ্রুপ; উপরন্তু তাদের নেতৃত্ব-শক্তি ও সাংগঠনিক ব্যাপকতাও ছিল সুস্পষ্ট, কিন্তু একাত্তরে সীমান্তের ওপারে ‘র’-এর প্রকল্পে সরাসরি সংশ্লিষ্ট হয়ে সেই শক্তি ও সংগঠনের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেন তারা। জাসদ সৃষ্টির পর নানান উত্তেজক ও আত্মবিনাশী রাজনৈতিক কর্মসূচি জনগণের সেই প্রশ্নবােধক মনস্তত্ত্বকে আরও দৃঢ়তা দেয়। সেবিষয়ে পরবর্তী অধ্যায়গুলােতে বিস্তারিত আলােকপাত করা হবে।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গনবাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ আলতাফ পারভেজ (Unicoded) (Part 1)