সশস্ত্র যুদ্ধ (১১ মে-৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল)
ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়, যে এলাকাটা বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী ও রাজিবপুর থানা, গােটা ৯ মাস ছিল মুক্তিবাহিনীর দখলে। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা (রৌমারী ও রাজিবপুরের অন্তর্ভুক্ত) ভারতের মানকারচর ও মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে নদ অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার বিভিন্ন শত্রু অবস্থানের উপর রেইড ও শক্রর চলমান বাহন ও সেনা দলের উপর অ্যামবুশ করত। ব্রহ্মপুত্র নদের বন্যা প্রতিরােধের জন্য নদের পূর্ব পাড়ে ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ থেকে উত্তরে তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষে এ বাঁধ রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। পাকিস্তানি সৈন্যরা তিস্তা নদীর তীরে কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নদীর পূর্ব দিক থেকে আসা মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ রােধ করা। তা ছাড়া এসব ক্যাম্প থেকে এবং কুড়িগ্রাম, চিলমারী ও গাইবান্ধা থেকে শত্রু মূল ভূখণ্ডে এবং নদীপথে টহলের মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখত। তাদের ক্যাম্পগুলাে ছিল গাইবান্ধা জেলার কামারজানি নদীবন্দর, রসুলপুর, রতনপুর, কুড়িগ্রাম, ভুরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরীতে।
রংপুর থেকে সড়ক পথে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট ছাড়া বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের সব এলাকায় যাওয়া সম্ভব ছিল। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে যাওয়ার একমাত্র ব্যবস্থা ছিল রেল যােগাযােগ রংপুর থেকে রেললাইন তিস্তা নদীর উপর কাউনিয়া ব্রিজ অতিক্রম করে তিস্তা জংশনে পৌছায়। এখান থেকে ১টি রেলপথ লালমনিরহাট হয়ে উত্তরে সীমান্তবর্তী রেলপথ উত্তর-পশ্চিমে কালীগঞ্জ, হাতিবান্ধা হয়ে সীমান্ত স্টেশন পাটগ্রাম পৌছায়। তিস্তা জংশন থেকে আরেকটি রেলপথ কুড়িগ্রাম হয়ে দক্ষিণে উলিপুর ও চিলমারীকে সংযুক্ত করেছে। লালমনিরহাট থেকে অপর একটি স্টেশন মােগলহাটকে সংযুক্ত করে । রংপুর রেলপথে দিনাজপুরের সাথে সংযুক্ত। দিনাজপুর থেকে উত্তরে পঞ্চগড় ও দক্ষিণে হিলি, জয়পুরহাট, শান্তাহার ও পাবনা চলে গেছে আরও ২টি রেলপথ। মােদ্দা কথা, বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুরবাসীর জন্য প্রধান চলাচলের মাধ্যম ছিল। রেলপথ। সড়ক পথ রংপুর থেকে বগুড়া হয়ে দক্ষিণে নগরবাড়ি ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে।
রংপুরের উত্তর-পশ্চিমে পাটগ্রাম এলাকা দিয়ে তিস্তা, নীলফামাবার মােগলহাট হয়ে ধরলা এবং কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী হয়ে সংকোষ এবং দুধকুমার নদ ব্রহ্মপুত্র নদে এসে যােগ হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণে যমুনা নামধারণ করে ফুলছড়ি হয়ে আরিচার কাছে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদ। উত্তরে কামারজানি ও চিলমারীকে বাণিজ্যিক বন্দরের গুরুত্ব লাভ করেছেযােগাযােগ ব্যবস্থার কারণে। রংপুরের উত্তরে ও পশ্চিমে করতােয়া, পাথররাজ, মহানন্দা, টাঙন, আত্রাই, চাই, পুনর্ভবা এবং দক্ষিণ-পূর্বে ঘাঘট নদী নৌ যােগাযােগের জন্য উপযুক্ত নয়। উত্তরবঙ্গের হিলি-পলাশবাড়ি-গাইবান্ধা কটি রেখা ছাড়া গােটা এলাকা ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে ঘেরা, কেবল রংপুর ও গাইবান্ধা ছাড়া। এ দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে অবাধে যাতায়াত করা সম্ভব। ২৫ মার্চের পূর্বে ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অবস্থান ছিল রংপুর (ব্রিগেড সদর দপ্তর) ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে, পরেরটি অপেক্ষাকৃত বড়াে। ৩টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ১টিকে (২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহীতে । যমুনা নদীর উত্তর অংশ ছিল এ ব্রগেডের দায়িত্বপূর্ণ এলাকী। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছাড়া ১টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন অবশিষ্ট থাকে (২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, সৈয়দপুর)। ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয় দিনাজপুরের কুঠিবাড়িস্থ ইপিআর-এর সেক্টর সদর দপ্তর এবং একই সাথে অবস্থিত ৮ নম্বর উইং এবং ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থিত ৯ নম্বর উইং ইপিআর-এর সৈনিকদের হত্যা বা নিরস্ত্র করার। সৈয়দপুরে অবস্থিত ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টকে বগুড়ায় অবস্থিত ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যামুনিশন প্ল্যাটুনকে (আইএপি) নিরাপত্তা দিয়ে গােলাবারুদ সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ২ ব্যাটারি সৈনিক নিয়ে বগুড়া যান ২৬ মার্চ। ফেরার। পথে ২৮ মার্চ ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বগুড়া-রংপুর সড়কের উপর পলাশবাড়িতে এদের অ্যামবুশ করে। ২৫ মার্চের পূর্বে সামরিক শক্তির ভারসাম্যের বিচারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী হলেও সার্বিক বিবেচনায় মুক্তিযােদ্ধারাও কম শক্তিশালী ছিল না। সৈয়দপুরে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, দিনাজপুরে ইপিআরএর ৮ নম্বর উইং, ঠাকুরগাঁওয়ে ৯ নম্বর উইং এবং রংপুরে ১০ নম্বর উইং অবস্থিত ছিল। ইপিআর-এর এ উইংগুলাে কোম্পানি হিসেবে ভাগ হয়ে সীমান্তের বিভিন্ন বিওপিতে অবস্থান করত। অফিসার ছাড়া প্রায় ৯৫% সৈনিকই ছিল বাঙালি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইপিআর সৈনিকদের হত্যা বা নিরস্ত্র করা ছিল। অসম্ভব। ইপিআর সৈনিকেরা অসামরিক এলাকায় থাকাব সব শ্রেণির জনগণের সাথে মেলামেশার সুযােগে রাজনৈতিক স্থিতি :ন্ধে। সচেতন ছিলেন। এঁরা সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি : করেন। এলাকার পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও যুদ্ধের পক্ষে তৈরি থাকেন। সর্বোপরি জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদানের এবং সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। রাজনৈতিক নির্দেশনার অভাবে মুক্তিকামী সৈনিক-জনতাকে সংগঠিত করে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায় নি। ফলে প্রাথমিক প্রতিরােধে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসে নি। স্মর্তব্য, ২৫ মার্চ এবং তার পরবর্তী সময় রংপুর সেনানিবাসে কর্মরত কিছু বাঙালি অফিসার (সদর দপ্তর ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড এবং ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট) পাকিস্তান সেনাবাহিনী পক্ষ নেয় এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় থানা পর্যায়ে পৌঁছে যায়, অবশ্য প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলি ফুরিয়ে আসতে থাকে। এদের সাথে যােগ দেয় হাজার হাজার ছাত্র-যুবক। বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয় তাদের প্রতিষ্ঠিত হয় প্রশিক্ষণ শিবির।
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেঘালয়ের তেলটালায় চলে যায় মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। সেখানে ব্যাটালিয়নটি ‘জেড’ ফোর্স ব্রিগেড গঠনে যােগ দেয়। ভারতীয় বিএসএফ ও ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। অস্ত্র, গােলাবারুদ, বেতারযন্ত্র দিয়ে এবং মানবিক সাহায্য নিয়ে তারা পাশে। এসে দাঁড়ায়। প্রাথমিকভাবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বাঙালি অফিসাররা। তাঁদের মধ্যে ক্যাপটেন আনােয়ার, ক্যাপটেন নওয়াজেশ, ক্যাপটেন নজরুল হক, ক্যাপটেন আশরাফ, লেফটেন্যান্ট মােকলেস, মেজর ডা. মকসুল হােসেন চৌধুরী প্রমুখ। রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী ও জনগণ নিঃস্বার্থ ভালােবাসা এবং ত্যাগী মনােভাব নিয়ে তখন থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে দাঁড়ান। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএমই) কোরের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার লেফটেন্যান্ট ইদ্রিস, যিনি জয়পুরহাট সুগার মিলে কর্মরত ছিলেন, সশস্ত্র যুদ্ধে যােগ দেন মার্চের শেষে। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও বীরত্ব কিংবদন্তি তুল্য। জুলাই মাসে বাংলাদেশকে ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝ বরাবর ৬ নম্বর এবং ১১ নম্বর সেক্টরের সীমানা নির্ধারিত হয় পূর্ব প্রান্তে। উত্তরে ভারতীয় সীমান্ত, দক্ষিণ-পূর্বে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও, দক্ষিণে রংপুর (তদানীন্তন জেলার সীমারেখা)। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৬ নম্বর সেক্টর। শুরুতে ইপিআর (৮, ৯ ও ১০ নম্বর উইং থেকে আগত) সৈনিকদের প্রাধান্য থাকে এ সেক্টরে। এ সেক্টরে কোনাে নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ছিল না। অফিসারের সংখ্যাও ছিল সীমিত।
সেক্টর অধিনায়ক এবং ২জন সাব-সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন বিমানবাহিনীর অফিসার। সেক্টর সদর দপ্তরসহ প্রায় সব সাব-সেক্টর সদর দপ্তর বাংলাদেশের ভিতরে অবস্থিত ছিল। সেক্টর সদর দপ্তরের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ক্যাম্পগুলােয় গণযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতাে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ও যােগাযােগের জন্য একটি আলাদা সংগঠন গড়ে তােলে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ইস্টার্ন কমান্ডের অধীন সদর দপ্তরের সাথে। একটি ভিন্ন অপারেশন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় মুক্তিবাহিনীকে সঠিক সহায়তা প্রদানের জন্য। অপারেশনের নাম দেওয়া হয়। ‘অপারেশন জ্যাকপট’। এ অপারেশনের দায়িত্বে প্রথমে ছিলেন মেজর জেনারেল অঙ্কর সিং কালকট (জুন-আগস্ট) এবং পরে মেজর জেনারেল বি এন সরকার (আগস্ট-ডিসেম্বর)। এ সংগঠনের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের ৬টি সেক্টর গড়ে তােলে, প্রতিটি ১জন ব্রিগেডিয়ারের অধীন। তাদের ১টি সেক্টর বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর এক বা একাধিক সেক্টরের দায়িত্বে থাকত। ৬ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ‘এ’ (আলফা) সেক্টর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার বি কে জোশী। তার সেক্টর সদর দপ্তর ছিল ভারতের মূর্তিতে। ৬ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানার বুড়িমারীতে। সাব-সেক্টর ও সাব-সেক্টর অধিনায়কদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড