উত্তরাঞ্চলের প্রাথমিক প্রতিরোধ
প্রাথমিক প্রতিরােধ (২৬ মার্চ-১০ মে, ১৯৭১ সাল)
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দপুরে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে প্রথমে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয় এবং পরে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গার উপক্রম হয়। বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা রােধে সে সময় শহরে সেনাবাহিনী মােতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী শহরের বৈদ্যুতিক কেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অবস্থান নেয়। একই সাথে তারা শহরের প্রধান সড়ক ও মােড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। মােতায়েনকৃত অধিকাংশ সৈন্যই ছিল ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের । কিন্তু কোনাে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে শহর থেকে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় সৈয়দপুর সেনানিবাসের অপর ১টি অবাঙালি ইউনিট ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, অবাঙালিদের পরােক্ষভাবে সহায়তা করা। সে সময় সৈয়দপুর সেনানিবাসে ৩ ইস্ট বেঙ্গল, ২৬ ফ্রন্টিয়ার। ফোর্স রেজিমেন্ট এবং ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ও এর সহযােগী বাহিনী রংপুর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। উল্লিখিত ইউনিটগুলাে ছিল রংপুরস্থ ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধীন। তা ছাড়া এ ব্রিগেডের অধীন ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল রাজশাহীতে, ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানি, ব্রিগেড ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি ও ১০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ছিল রংপুরে। অপর আরেকটি ইউনিট ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ২৩ পদাতিক ব্রিগেডের সাথে রংপুরে সংযুক্ত থাকলেও এটি ছিল ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সংগঠনের ইউনিট। ১ মার্চ থেকে অন্যান্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলাের মতাে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকেও বিচ্ছিন্ন ও নিরস্ত্র করার নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করা হয়। শেষ পর্যন্ত কৌশল হিসেবে পালটা আক্রমণের শক্তি কমিয়ে ফেলার জন্য এ ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ কোম্পানিকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি বাঙালি অফিসার দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন কোম্পানিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার নিমিত্তে এবং অনির্ধারিত সাঁতার প্রশিক্ষণের বাহানায় বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। এসবই ছিল ব্যাটালিয়নকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা। মেজর নিজাম, লেফটেন্যান্ট মােখলেস ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিকসহ ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানিকে দিনাজপুর জেলার ঘােড়াঘাট ও গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি এলাকায় পাঠানাে হয়। সাঁতার শেখার নাম করে ক্যাপটেন আশরাফকে ৪০জন সৈন্যসহ সৈয়দপুর ও দিনাজপুর রােডের মধ্যবর্তী মণ্ডলপাড়া নামক স্থানে বৈদ্যুতিক কেন্দ্র পাহারার জন্য পাঠানাে হয়, মেজর শাফায়াত হােসেন ও সুবেদার রহমতুল্লাহকে সঙ্গে দিয়ে ১ প্লাটুন সেনা পার্বতীপুর পাঠানাে হয়। মর্টার প্লাটুনের সৈনিক মর্টার রেখে শুধু রাইফেল দিয়ে শহরের অনতিদূরে পাওয়ার হাউজ পাহারার জন্য পাঠানাে হয়। ১৭ মার্চ ওয়্যারলেস সেট ও ভারী অস্ত্রগুলাে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর থেকে ব্রিগেড সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। এ সময় ক্যাপটেন আনােয়ার ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। ২৪ মার্চ তাকে এবং ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর হারিসকে ব্রিগেড অধিনায়ক তার অফিসে ডেকে নেন। ব্রিগেড অধিনায়ক আবদুল্লাহ খান মালিক ক্যাপটেন আনােয়ার ও সুবেদার মেজর হারিসকে বাইরের গুজবে কান না দিতে পরামর্শ দেন এবং শৃঙ্খলার সাথে দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর আকতারের (পাকিস্তানি) সাথে দীর্ঘক্ষণ রুদ্ধদ্বার আলাপ করেন। এতে ক্যাপটেন আনােয়ার ও সুবেদার মেজর হারিসের মনে সন্দেহ দানা বাধে। ২৮ মার্চ মণ্ডলপাড়া থেকে ক্যাপটেন আশরাফ ক্যাপটেন আনােয়ারের অফিসে এসে দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁকে বিস্তারিত জানান। এ সময় ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার লেফটেন্যান্ট সালামকেও ডাকা হয় এবং ৩জন রুদ্ধদ্বার কক্ষে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে বিশদ আলােচনা করেন। উত্তেজনায়-উৎকণ্ঠায় কেটে যায় ২ দিন।
৩১ মার্চ রাত আড়াইটার সময় ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট ও ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট অতর্কিতে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যারাকে আক্রমণ করে। কিন্তু ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা সতর্ক থাকায় তারা পাকিস্তানি আক্রমণের পালটা উত্তর দেয় এবং সকাল ১০টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। শত্রু ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যারাকে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রথম গােলা ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গাড়ির গ্যারেজ ও পেট্রোল পাম্পে এসে পড়ে। সমস্ত যানবাহন ও পেট্রোল আগুনে ভস্মীভূত হয়। শত্রু ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারপাশ প্রায় ঘিরে ফেলে এবং মাইকের মাধ্যমে । আত্মসমর্পণের ঘােষণা দিতে থাকে। কিছুক্ষণ প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়ার পর ক্যাপটেন আনােয়ার বুঝতে পারেন যে, এ অসম যুদ্ধে কেবল তার সৈন্যরা মারা যাবে, লাভ হবে না কিছুই; তখন বিলম্ব না করে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সেনানিবাস ছেড়ে ফুলবাড়ি নামক স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। সাথে সাথে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাইরে অবস্থানরত সব কোম্পানিকে এ ঘটনা অবহিত করা হয়। ১ এপ্রিল সুবেদার রহমতুল্লাহ তাঁর কোম্পানির অবাঙালি অফিসার মেজর শাফায়েত হােসেনকে হত্যা করে অধীনস্থ সব সৈন্য নিয়ে পার্বতীপুর থেকে ফুলবাড়ি চলে আসেন। ৩ এপ্রিল ঘােড়াঘাটে অবস্থানরত ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানি ফুলবাড়ি এসে পৌছে। সে সময় ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মােট জনবল ৪৫০জনের মতাে। ৪-৫ এপ্রিল ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠন করে ৩টি কোম্পানিতে ভাগ করা হয় এবং মেজর নিজামকে অধিনায়ক মনােনীত করা হয়। ক্যাপটেন আশরাফ, ক্যাপটেন আনােয়ার ও লেফটেন্যান্ট মােখলেসকে যথাক্রমে ১টি করে কোম্পানির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ক্যাপটেন আশরাফ তাঁর কোম্পানি নিয়ে। দিনাজপুরের পথে সৈয়দপুর যাবেন। লেফটেন্যান্ট মােখলেস তার কোম্পানি।
নিয়ে নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুর যাবেন। ক্যাপটেন আনােয়ার সদর দপ্তর কোম্পানি এবং তার কোম্পানি নিয়ে ফুলবাড়ি থেকে খােলাহাটি শিবির স্থাপন করেন। ৭ এপ্রিল সুবেদার রহমতুল্লাহ ১টি প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুর চলে যান। ক্যাপটেন আনােয়ার বীরবিক্রমে পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের বেষ্টনী থেকে সৈয়দপুরের সন্নিকটে খােলাহাটি গ্রামে পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হলেন এবং সেখান থেকে বদরগঞ্জ গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে সক্ষম হন। ইতােমধ্যে ক্যাপটেন আশরাফ ও লেফটেন্যান্ট মােখলেস যারা ১টি কোম্পানি নিয়ে অন্যত্র ছিলেন, তাদের সৈয়দপুর আক্রমণ করার জন্য বলা হয়। ঘােড়াঘাটে অবস্থানরত মেজর নিজামকেও খবর পাঠানাে হয় আক্রমণ করার জন্য। ৮ এপ্রিল ক্যাপটেন আশরাফ তার কোম্পানি নিয়ে আসার পথে সৈয়দপুর থেকে ৩ মাইল দূরে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩টি গাড়িসহ বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। ৯ এপ্রিল শক্র বদরগঞ্জে ক্যাপটেন আনােয়ারের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। ক্যাপটেন আনােয়ার তার কিছু সংখ্যক সৈন্য, ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য নিয়ে শত্রুর ফিল্ডগান আর্টিলারি এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের মােকাবিলা করেন। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সর্বাত্মক আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হন। এক প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে অন্য প্রতিরক্ষা অবস্থানে যাওয়ার সময় ক্যাপটেন আনােয়ার শক্রর গুলিতে মারাত্মক আহত হন।
এবং তাঁর গাড়িচালক শহিদ হন। ক্যাপটেন আনােয়ারকে চিকিৎসার জন্য ফুলবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তার কোম্পানি খােলাহাটি চলে আসে। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা খােলাহাটি আক্রমণ করে। সেখানে তাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্যাপটেন আনােয়ারের কোম্পানি ফুলবাড়িতে অবস্থান নেয়। এদিকে ক্যাপটেন আশরাফ ও লেফটেন্যান্ট মােখলেসের কোম্পানি ফুলবাড়ি চলে আসে। ১১ এপ্রিল শত্ৰু পুনরায় ফুলবাড়ি আক্রমণ করে এবং উভয় পক্ষে ভীষণ যুদ্ধ হয়। তাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পুরাে ব্যাটালিয়ন চরখাইয়ে চলে যায়। ১৩ এপ্রিল ২ কোম্পানি চরখাইয়ে রেখে ক্যাপটেন আনােয়ার তার কোম্পানি নিয়ে ঘােড়াঘাট-চরখাই রােডে প্রতিরক্ষা। অবস্থান নেন। ১৯ এপ্রিল শক্র পাঁচবিবি থেকে হিলি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে অনেক শত্রু সৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সেদিনই চরখাই থেকে ক্যাপটেন আশরাফ ও লেফটেন্যান্ট মােখলেসের কোম্পানিকে হিলি আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু পথিমধ্যে তারা নিজের সৈনিকদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে চলে যান। জানা যায়, পরবর্তী সময় বেশ। কিছুদিন পর তারা পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। | ২০ এপ্রিল সুবেদার হাফিজ, নায়েব সুবেদার করম আলী ও নায়েব সুবেদার শহিদুল্লাহ ২ কোম্পানিসহ হিলিতে ক্যাপটেন আনােয়ারের কাছে পৌছেন। সেদিন খুব ভােরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ আক্রমণ চলে। অবশেষে শত্ৰু পিছু হটতে বাধ্য হয়। এদিকে তাদের মর্টারের শেল ভারতীয় সীমান্তের অভ্যন্তরে গিয়ে পড়ে এবং কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়। ফলে ভারতীয় বিএসএফ-এর কর্নেল মুখার্জী, পশ্চিম দিনাজপুরের ডিএম এবং পুলিশ সুপারের অনুরােধে ২০ এপ্রিল গভীর রাতে ক্যাপটেন আনােয়ার তার প্রতিরক্ষা অবস্থান ভেঙে দেন এবং হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামারপাড়া নামক স্থানে কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ২৫০জনের মতাে জেসিও এবং অন্যান্য পদবির সৈনিকসহ আশ্রয় নেন। এ যুদ্ধে ৬জন সৈনিক নিহত হন। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ক্যাপটেন আনােয়ার পূর্ব চরখাই ও হিলি সরকারি গুদাম থেকে ৪০০ বস্তা চাউল সঙ্গে নিয়ে যান। ভারতে অবস্থানকালীন এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাপটেন আনােয়ার কর্তৃক কামারপাড়া, গােবরা ও আঙ্গিনাবাদে ৩টি অপারেশন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সুবেদার হাফিজকে আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প অধিনায়ক, সুবেদার নেওয়াজকে কামারপাড়া ক্যাম্প অধিনায়ক এবং জয়পুরহাট সুগার মিলের ১জন সিভিল
ইঞ্জিনিয়ারকে গােবরার ক্যাম্প অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করে ক্যাপটেন আনােয়ার উক্ত ৩টি শিবির পরিচালনা করেন। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজল করিম পাকিস্তানি হলেও তার মানসিকতা ছিল ভিন্ন ধরনের। বাঙালি সৈনিকদের বিরুদ্ধে যে পরিকল্পনা চলছে, তিনি তা সমর্থন করেন নি। বিশেষ করে তার কমান্ডের বাঙালিদের বিরুদ্ধে কোনাে কিছু করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। বাঙালিদের প্রতি তার মহানুভূতিই যে এর কারণ, তা হয়ত পুরােপুরি সঠিক নয়। তার আপত্তি হচ্ছে যে, বিদ্যমান সংকটের ব্যাপারে তার কোনাে মতামত শােনা হয় নি। বরং তাঁকে ব্রিগেড সদর দপ্তরে ডেকে নিয়ে সেখানে তাঁর অবস্থানকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করা হয়েছিল। | পাকিস্তান সেনাবহিনীর উন্মত্ত আঘাত হানা শুরু হওয়ার পর বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা ও তিস্তা নদীর উত্তর দিকের একটি বড়াে এলাকা স্থানীয় ইপিআর, পুলিশ বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকেরা মুক্ত করে। ব্রিগেডিয়ার। আবদুল্লাহ মালিক খানের অবস্থান রংপুরে সীমিত হয়ে পড়ে। | ঘােড়াঘাট এলাকার অধিনায়ক মেজর নিজাম উদ্দিন পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হন। সামরিক তৎপরতা শুরু হওয়ার পর কী ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা তিনি অনুমান করতে পারেন নি। যাহােক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। একই সময় সৈয়দপুরের চার্লি কোম্পানির ক্যাপটেন আশরাফ এবং ইউনিট কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপটেন। আনােয়ার আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন। এদিকে রংপুর ও দিনাজপুরে ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগেই বিদ্রোহ করে এবং সেখানকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করতে সমর্থ হয়। ঠাকুরগাঁওয়ের পরিস্থিতিও হয় একই ধরনের। যুদ্ধের প্রথম দিকে বাঙালি সৈন্যরা প্রতিরােধ করতে গিয়ে অবাঙালি সৈন্যদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। ২৬ মার্চ ক্যাপটেন আশরাফকে তার অবাঙালি সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআরদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য প্রেরণ করেন। ক্যাপটেন আশরাফ ইপিআর সৈন্যদের সাথে যােগাযােগের সুযােগ পেয়ে সেদিন। ঠাকুরগাঁওয়ে গমন করেন। ইপিআর বাহিনী ইতােমধ্যে সে এলাকায় তাদের। অবস্থান সুদৃঢ় করে ফেলেছে। তারা ক্যাপটেন আশরাফকে বলে দেয়, তিনি যেন তার সৈনিকদের নিয়ে ফিরে আসেন এবং তাহলেই কেবল তিনি বিশ্বাসযােগ্য হবেন। ক্যাপটেন আশরাফ সৈয়দপুরে ফিরে গিয়ে তার ইউনিটের সেকেন্ড-ইনকমান্ড মেজর ওয়াহিদ আকতারকে দলত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিষয়ে।
তার আন্তরিকতার কথা বােঝাতে সক্ষম হন এবং চার্লি কোম্পানি নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের পথে রওনা হয়ে যান। তিনি এ ব্যবস্থাও করেন, যাতে ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈনিকসহ বাঙালি পরিবারদের সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে মধ্যরাতে বাইরে নিয়ে আসা যায়। ক্যাপটেন আশরাফ ক্যাপটেন আনােয়ারের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেন। বগুড়া পাকিস্তানিদের বশ্যতা মেনে নেয় নি। ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের ২টি ব্যাটারি বগুড়ার দিকে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়ে সৈয়দপুরের দিকে ফিরে যায়। ঘােড়াঘাটে এ খবর পেয়ে মেজর নিজামের অনুগত সৈনিকেরা পলাশবাড়ি রাস্তার সংযােগ স্থলে তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালানাের সিদ্ধান্ত নেন। কথা হয়, ২টি প্ল্যাটুন একসাথে আক্রমণ করবে। প্ল্যাটুন ২টির একটি হলাে ঘােড়াঘাট এলাকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট রফিক সরকারের প্ল্যাটুন, আরেকটি গাইবান্ধাস্থ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট মােখলেসের। কিন্তু লেফটেন্যান্ট মােখলেস সঠিক সময়ে পলাশবাড়ি পৌছতে ব্যর্থ হন। সৈয়দপুর অভিমুখে গমনরত ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের ২টি ব্যাটারি রাস্তার সংযােগ স্থলে আগেই এসে পড়ে এবং মুখােমুখি হয় লেফটেন্যান্ট রফিক সরকারের। ১টি মাত্র প্লাটুন নিয়ে হামলা করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। লেফটেন্যান্ট রফিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। জানা যায়, সৈয়দপুরে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। এ সময় ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট সিরাজুল ইসলামের কাছে ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকে একটি বার্তা আসে। উক্ত বার্তায় তাকে ঘােড়াঘাট যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। বলা হয়, যাওয়ার পথে যেন রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে যাত্রাবিরতি করেন। লেফটেন্যান্ট সিরাজুল ইসলাম ১০-১২জনের ১টি সশস্ত্র দল নিয়ে (সবাই বাঙালি) ব্রিগেড সদর দপ্তর পৌছলে সবাইকে বন্দি করা হয়। ঐ রাতেই এদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং গর্ত করে পুঁতে রাখা হয় । এঁদের মধ্যে ১জন সৈনিক। আহত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন এবং গ্রামের পথ ধরে বদরগঞ্জ এলাকায় মূল ইউনিটের সাথে যােগ দেন। চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে তিনি দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করেন। মেজর নিজাম ক্যাপটেন আশরাফকে বার্তা পাঠান তার কোম্পানিসহ ফুলবাড়িতে এগিয়ে যেতে। একই বার্তা আলফা কোম্পানির কাছে প্রেরিত হয়। কোম্পানি অধিনায়ক অবাঙালি ক্যাপটেন শাফায়াত উক্ত বার্তা অগ্রাহ্য করে প্রতিরােধের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজল করিম রংপুরের বাইরে ছিলেন। ২৬-২৭ মার্চে সৈয়দপুরে ফিরে এসে ব্যাটালিয়নে না গিয়ে তিনি ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট লাইনে উপস্থিত হন। সেখান থেকে টেলিফোনে তিনি ক্যাপটেন আনােয়ারের সাথে যােগাযােগ করেন। ক্যাপটেন আনােয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা টের পেয়ে ইউনিটে ফিরে আসার জন্য কমান্ডিং অফিসারকে অনুরােধ জানান। কিন্তু লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজল করিম সে অবস্থায় ভীত হয়ে তার ইউনিটে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি)-এর ৫ নম্বর সেক্টরের (দিনাজপুর। সেক্টর) বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং সাধারণ সৈনিকদের অবদানের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল কুঠিবাড়ি ব্যারাক থেকে। তকালীন ইপিআর বাহিনীর সেক্টর সদর দপ্তর ছিল দিনাজপুরের কুঠিবাড়ি । এর অধীন ছিল ৩টি উইং – দিনাজপুরে ৮ নম্বর উইং, ঠাকুরগাঁওয়ে ৯ নম্বর উইং ও রংপুরে ১০ উইং। সেক্টর সদর ও অধীনস্থ সব উইংয়ের অধিনায়ক ছিলেন। পাঞ্জাবি অফিসার। সেক্টর মেডিক্যাল অফিসারসহ মাত্র ৩জন বাঙালি অফিসার এবং প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্য ছিল দিনাজপুর সেক্টর সদর দপ্তরে। সেক্টর সুবেদার মেজর আবদুর রব ছিলেন বাঙালি। মার্চ মাসের মাঝামাঝি এ সেক্টরে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিওপিগুলাে থেকে অবাঙালিদের সেক্টর সদর দপ্তরে নিয়ে আসা শুরু হয়। কোয়ার্টার গার্ড ডিউটিতে বাঙালিদের সরিয়ে অবাঙালিদের প্রহরায় রাখা হয়। এসব ঘটনায় বাঙালিদের মনে সন্দেহ জাগ্রত হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ১টি কোম্পানি যথাযথ সামরিক সম্ভার নিয়ে সত্তরের নির্বাচনের সময় থেকে দিনাজপুর সার্কিট হাউজে। অবস্থান করছিল। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে এ কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা বাড়ানাে হয়। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে ২৩ মার্চ সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারিক রসুল কোরাইশী সৈনিকদের মাঝে প্রীতিভােজ দেন। ঐ প্রীতিভােজে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কোম্পানির সৈনিকদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়। কথা ছিল, অসামরিক পােশাকে পরিজন নিয়ে ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা একই সাথে আহার করবে। কিন্তু সন্ধ্যায় দেখা গেল, ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কোম্পানির কিছু সৈনিক অস্ত্রসহ সামরিক পােশাকে এসেছে। বাঙালিরা এর প্রতিবাদ করলে সেক্টর অধিনায়ক সেনা সদস্যদের ইউনিফর্ম। পরিবর্তন করে আসতে বলে। ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের অফিসাররা অসামরিক পােশাকে অস্ত্রসহ রাতে আসে। ইপিআর বাঙালি সদস্যদের ধারণা ছিল, সে রাতে সবাইকে টেবিলে বসিয়ে একসাথে হত্যা করা হবে। ঐ বড়াে। খানা টেবিলে কোনাে দুর্ঘটনা না ঘটলেও বাঙালিরা সদা সতর্ক থেকে নিজেরা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।
২৫ মার্চ গভীর রাতে এবং ২৮ মার্চ সকালে সেক্টর অধিনায়ক অবাঙালিদের নিয়ে গােপন বৈঠক করেন। ২৮ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টায় কাশেম নামে সেনাবাহিনীর ১জন বাঙালি অপারেটর হাবিলদার ভুলু মিয়াকে বলেন, “আজ পাকিস্তানি সৈন্যরা ইপিআর সেক্টরে আক্রমণ করতে পারে, আমরা এখন সমস্ত ওয়্যারলেস খুলে নিচ্ছি।” সংবাদটি বিদ্যুতের মতাে সেক্টরে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালিরা সবাই মানসিক প্রস্তুতি নেন। হাবিলদার খন্দকার আবু সাইদ মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই বেশ কিছু গুলি ও অস্ত্র বাঙালিদের মধ্যে বিতরণ করেন। ২৮ মার্চেও হবিলদার আবু সাইদ বেশ কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ বাঙালিদের মাঝে বিতরণ করেন। এদিন বেলা ৩টায় দিনাজপুর সার্কিট হাউজ থেকে প্রথমে। ইপিআর সেক্টর সদর দপ্তর অর্থাৎ কুঠিবাড়ির উপর গুলি বর্ষণ শুরু হয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা এমন একটি ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আক্রমণের সাথে সাথে মর্টার প্ল্যাটুন মর্টারসহ কাঞ্চন নদীর পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। এ পরিস্থিতিতে ইপিআর সদস্যরা নিজ নিজ বাংকারে অবস্থান নেয়। হাবিলদার মুসলিম সেক্টরের বাইরে গিয়ে সাহায্যের জন্য জনতাকে আহ্বান জানান। উভয়পক্ষের ব্যাপক গােলা বিনিময় শুরু হয়। ঐ সময় ইপিআর-এর অনেক বাঙালি সদস্য আইএস (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা) ডিউটির জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিল। তারা আক্রমণের খবর পেয়ে সেক্টর সদর দপ্তরে ফিরে এসেই বাঙালিদের সাথে যােগদান করে। কিছুক্ষণের মধ্যে হাজার হাজার জনতা সেক্টর সদর দপ্তরের দিকে আসে। হাবিলদার খন্দকার আবু সাইদ অস্ত্রাগার খুলে দিলে। অস্ত্র বের করা শুরু হয়। অ্যান্টি-ট্যাংক, মর্টার, এলএমজি, রাইফেল এবং প্রচুর গােলাবারুদ কাঞ্চন নদীর অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। হাবিলদার নাজিম, সিপাহি আনােয়ার ও সিপাহি কাওসার মিয়া অ্যান্টি-ট্যাংক গান দ্বারা শত্রুর সার্কিট হাউজের উপর গােলা বর্ষণ শুরু করেন। দৃঢ়চেতা, বলিষ্ঠ মানসিকতার অধিকারী হাবিলদার ভুলু মিয়া এ অপারেশনের নেতৃত্ব দেন। আক্রমণের শুরুতে বাঙালি অফিসার কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
এমনকি সেক্টর সুবেদার মেজর আবদুর রবও খণ্ডযুদ্ধে যােগ দিতে পারেন নি। তিনি ২৯ মার্চ যােগ দেন। ক্যাপটেন নাজির ও সুবেদার আতাউল হকসহ ১টি প্ল্যাটুনকে ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁও প্রেরণ করা হয়। ২৮ মার্চ বিকালে মেজর মকসুল হােসেন চৌধুরী, ক্যাপটেন নজরুল হক ও ক্যাপটেন নাজিরের স্ত্রী পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। এদিকে ২৮ মার্চ বিকাল ৪টায় সার্কিট হাউজে সকল বাঙালি অফিসারদের কনফারেন্স আহ্বান করা হয়। সম্ভবত শত্রুর ইচ্ছা ছিল সবাইকে বন্দি করে হত্যা করা। কিন্তু তার আগেই ইপিআর সদস্যরা তাদের উপর আক্রমণ করার। কারণে পাকিস্তানি সৈন্যরা সে সুযােগ পায় নি।
২৯ মার্চ সকালে বিস্তারিত জানিয়ে সবগুলাে সীমান্ত ফাঁড়িতে বার্তা পাঠানাে হয়। বাঙালি ইপিআর-এর রিয়ার সদর দপ্তর স্থাপিত হয় কাঞ্চন জংশনে। রিয়ার সদর দপ্তরে দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার ওসমান গনি ও সুবেদার এম এ খালেক তালুকদার। রণাঙ্গনের অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মেজর আবদুর রব ও হাবিলদার ভুলু মিয়া। সুবেদার মেজর আবদুর রব চাপসার, বিরল, কামদেবপুর এবং অন্যান্য ইপিআর অবস্থানগুলাের অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে সেক্টর সদর দপ্তর দিনাজপুরে চলে আসার জন্য বাঙালি ইপিআরদের নির্দেশ দেন। ৮ নম্বর উইংয়ের বাসুদেবপুরে কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার এম। এ শুকুর। তিনি ২৮ মার্চ পিআরসি-৯ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সমগ্র দেশের খবর জেনে সিদ্ধান্ত নেন যে, অবাঙালিদের বন্দি করবেন, চরকাই শালবনে সবাই একত্র হবেন এবং সেখান থেকে ১ প্লাটুন পুলহাট এবং ২ প্লাটুন ফুলবাড়ি পাকা রাস্তার উভয় পার্শ্বে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করবেন। ঐ রাতে শত্রু ফুলবাড়ি থানা আক্রমণ করে এবং দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানি কনভয়গুলাে রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে সুবেদার শুকুরের নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা ফায়ার শুরু করেন। রাত ১০টা থেকে ভাের ৪টা পর্যন্ত গুলি বিনিময়ে শত্রু চরমভাবে মার খেয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পালিয়ে যায়। এ আক্রমণে সুবেদার শুকুর ১জন আহত শত্রু সৈন্য বন্দি এবং কয়েকটি গাড়ি, অস্ত্র, গােলাবারুদ ও রসদপত্র শক্রদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন। | ৩০ মার্চ সকাল ৭টায় সুবেদার শুকুর দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিত আক্রমণ করে। অকস্মাৎ এ আক্রমণে। ইপিআর বাহিনী বেশিক্ষণ টিকে থাকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সুবেদার শুকুর পিছনে সরে এসে বিকাল ৪টায় পুনরায় শত্রুর উপর আক্রমণ করলে তারা বেশ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে সিপাহি ফখরুল বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এদিকে পাকিস্তানি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স সদস্যরা দিনাজপুর সেক্টরের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং চেহেলগাজী মাজার হয়ে ঘুঘুডাঙার দিকে অগ্রসর হয় এবং ইপিআর-এর রিয়ার সদর দপ্তরের কাঞ্চন জংশন দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইপিআর-এর কাছে বার বার পরাস্ত হয়ে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
২৯ মার্চ রাতে সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক রসুল, মেজর জুবেরী, ক্যাপটেন জাভেদ ফিরােজ ও ক্যাপটেন ইজাজ আহমেদ চিমাসহ ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স বাহিনী এবং কিছু অবাঙালি ইপিআর ফোর্স নিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে রওনা হলে পথে ফুলবাড়ি নামক স্থানে সুবেদার শুকুরের কোম্পানির সাথে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে শত্রু পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও অবাঙালি মেজর আমিন তারিক ও মেজর সিদ্দিক নিহত হয়। এদিকে সৈয়দপুর সেনানিবাসে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হলে কিছু বাঙালি সৈন্যসহ ক্যাপটেন আশরাফ ও ক্যাপটেন আনােয়ার দিনাজপুরে বাঙালি ইপিআরদের সাথে যােগ দেন। ৩০ মার্চ সুবেদার মেজর ওসমান গনি ১০ নম্বর উইং রংপুর থেকে দিনাজপুর ইপিআর-এর সাথে যােগ দেন। | ৩১ মার্চ দিনাজপুর শহর শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু ঐ দিন ৮ নম্বর উইং অধিনায়কের বাসভবনে প্রহরারত ৫জন গার্ড বন্দি হন। এ ৫জনের মধ্যে ১জন। সিপাহি আলতাফ পালাতে সক্ষম হন। একই দিনে হাবিলদার ইদ্রিসের নেতৃত্বে টহল দল বন্দিকৃত মেজর মকসুল হােসেন চৌধুরী, ক্যাপটেন নজরুল হক এবং তাদের পরিবারকে উদ্ধার করে। এ দলটি দিনাজপুর জেলা প্রশাসক ফয়েজ উদ্দিন আহমদ, এসপি হাসেম, জেলা জজ হান্নান চৌধুরী এবং ডিসি এম এ কাশেম প্রমুখকে উদ্ধার করে। দিনাজপুর শত্রুমুক্ত হলে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। ৪ এপ্রিল ৯ নম্বর উইংয়ের (ঠাকুরগাঁও) ক্যাপটেন নজরুল ও সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপটেন আশরাফ, মেজর মকসুল হােসেন চৌধুরী (মেডিক্যাল অফিসার), অবসরপ্রাপ্ত মেজর টি হােসেন, সুবেদার মেজর ওসমান গনি প্রমুখ ভাতগাঁও সেতুর কাছে জরুরি সভায় মিলিত হন।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল বাঙালি সৈন্যদের ডিফেন্স নিতে বলা হয়। সুবেদার এ মজিদ ১টি কোম্পানি নিয়ে নীলফামারীতে, ক্যাপটেন আশরাফ ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি, সুবেদার হাফিজ ইপিআর-এর ২টি কোম্পানি এবং হাবিলদার নাজিম ২টি অ্যান্টি-ট্যাংক নিয়ে ভূষিরবন্দর নামক স্থানে ডিফেন্স নেন। ক্যাপটেন আশরাফ সার্বিকভাবে ফিল্ড অধিনায়ক মনােনীত হন। নায়েব সুবেদার কায়সার ও হাবিলদার জয়েদুল হােসেনের নেতৃত্বে ১টি কোম্পানি বদরগঞ্জ নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়। পার্বতীপুর থেকে পাকিস্তানি সেনার অগ্রাভিযানকে রােধ করার জন্য ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপটেন। আনােয়ার ২টি প্ল্যাটুন নিয়ে বদরগঞ্জে নায়েব সুবেদার কায়সারের সঙ্গে মিলিত হন। নায়েব সুবেদার লুঙ্কর রহমান ও হাবিলদার গােলাম কিবরিয়া ১টি প্ল্যাটুন। নিয়ে রাজবাড়ি রানীনগর সড়কে ডিফেন্স নেন। সুবেদার এ খালেক ১টি কোম্পানি নিয়ে ভাতগাঁও রক্ষায় থাকেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ণ সামরিক সম্ভারে ৬ ও ৭ এপ্রিল নীলফামারীতে সুবেদার মজিদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। সুবেদার মজিদ তার সৈন্য নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। নীলফামারী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ১জন ইপিআর, ২জন আনসার এবং হাবিলদার ইসহাক মারাত্মক আহত হন। অন্যদিকে, শত্রুর ৮জন নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উঁচু মনােবল নিয়ে তারা পুনরায় দেবীগঞ্জে এসে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। | ৭ ও ৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে ভূষিরবন্দরের মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। ক্যাপটেন আশরাফ তাঁর সামান্য অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হয় নি। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে দশমাইল টি জংশনে পুনরায় ডিফেন্স নেয়। ক্যাপটেন আশরাফ এ সংঘর্ষের পর নিজস্ব বাহিনী নিয়ে অন্যত্র চলে যান। দশমাইল ডিফেন্সে সুবেদার মেজর এ রব কমান্ড গ্রহণ করেন। |
পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখে ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা নীলফামারী, ভূষিরবন্দর, বদরগঞ্জ এবং অন্যান্য এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ১০ এপ্রিল শত্রু দশমাইল নামক স্থানে সর্বাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করে। ট্যাংক ও আর্টিলারির ক্রমাগত আঘাতে মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ চরম বিপর্যয়েও অ্যান্টি-ট্যাংক গান চালক ল্যান্স নায়েক মােস্তাফিজুর রহমান কিছুতেই তার গান ছেড়ে পিছু হটতে রাজি হন নি। মােস্তাফিজুর রহমান তার আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শক্রর শেলের আঘাতে ল্যান্স নায়েক মােস্তাফিজুর রহমান ও ড্রাইভার সাত্তারের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। | পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৬ এপ্রিল দিনাজপুর শহরকে সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ১২ ও ১৩ এপ্রিলের আক্রমণের পর থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ২ ভাগে ভাগ হয়ে যান। ১টি দল সুবেদার মেজর ওসমান গনির নেতৃত্বে বিরলে এবং অপরটি সুবেদার মেজর এ রবের নেতৃত্বে কুশালডাঙাকে ‘রিয়ার সদর দপ্তর করে সৈয়দপুর-দিনাজপুর সড়কের বাম ও ডান দিকে ডিফেন্স নেয়। কিন্তু শত্রুর অব্যাহত আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের কুশালডাঙা ছেড়ে বড়ােগ্রামে চলে আসতে হয়। সুবেদার মেজর রব বড়োগ্রামে বেশ কিছু ছাত্র ও কৃষককে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মূল বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেন। শেষ পর্যন্ত ২৬ এপ্রিল তার টুপস নিয়ে ভারতের শুভ্রা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন এবং সর্বাত্মক আক্রমণের জন্য ট্রপসকে পুনর্গঠিত করার কাজ শুরু করেন। অন্যদিকে, সুবেদার মেজর ওসমান গনি বিরলে ডিফেন্স নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শত্রুর সাঁজোয়া বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের বিরল ঘাটির উপর বার বার আঘাত হানতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা বিরলে টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে নাড়াবাড়ি নামক স্থানে ডিফেন্স নেন।
কিন্তু তাদের নাড়াবাড়ি থেকে আরও পিছনে সরে আসতে হয়। পিছু হটে প্রথমে কিশােরগঞ্জে শত্রুর উপর ২৪ এপ্রিল এক বড়াে হামলা চালানাে হয়। এ হামলায় শক্ররা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনবরত আর্টিলারির গােলা বর্ষণ করতে থাকলে ভারতের সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ‘ফ্ল্যাগ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাকিস্তানি সৈন্যরা বার বার ইপিআর বাহিনীকে তাদের হাতে সমর্পণ করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু বিএসএফএর (Border Security Force) মেজর বেদী ইপিআর সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানান। সভা শেষে ভারতীয় বিএসএফ-এর কর্মকর্তারা ইপিআর বাহিনীকে সুষ্ঠু আক্রমণের জন্য আপাতত বাংলাদেশের ঘাটি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বলেন। সুবেদার মেজর ওসমান গনি ও হাবিলদার ভুলু মিয়া বিএসএফ-এর ক্যাপটেন ঘােষের সঙ্গে রেকি করে স্থান নির্দিষ্ট করেন। সমগ্র বাহিনী মে মাসের প্রথমে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতীয় সীমান্তের রামপুর নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২৫ মার্চের রাতে পিলখানা থেকে প্রেরিত বার্তা এবং অন্যান্য ঘটনার কিছুই ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থিত ৯ নম্বর উইংয়ে পৌছে নি। হঠাৎ মাঝরাতে ৯ নম্বর উইংয়ের উপ-অধিনায়ক ক্যাপটেন নাবিদ আলম ১ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে দিনাজপুরে যান। সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক রসুল কোরেশীর সঙ্গে আলােচনা সেরে ২৬ মার্চ ভােরে সদলবলে উইংয়ে ফেরত আসেন। ক্যাপটেন নাবিদ আলম উইং সদর দপ্তরে এসেই সব জুনিয়র অধিনায়কদের তার অফিসে ডাকেন এবং রিজার্ভ কোম্পানিসহ সবাইকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত হতে আদেশ দেন। |
এ সময় উইং অধিনায়ক মেজর মােহাম্মদ হােসেন সীমান্ত পরিদর্শনে পঞ্চগড়ের দিকে বাইরে ছিলেন। তাকেও উইং সদর দপ্তরে ফেরত আসার জন্য সংবাদ পাঠানাে হয়। এ দিকে ঠাকুরগাঁও শহরে অসংখ্য জনতা সমবেত হয়। রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড তৈরি হতে থাকে। জনতা ইট, পাথর ও গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করে। | উইং অধিনায়ক রাত ৯টার সময় উইং সদর দপ্তরে এসেই শহরে প্যাট্রল। পাঠানাের আদেশ দেন। রাতদিন কারফিউ জারি করা হলাে। কিন্তু হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে শােভাযাত্রা বের করে। মেজর মােহাম্মদ হােসেন ও ক্যাপটেন নাবিদ আলম সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনকে নিয়ে শহরে যান এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেন। সেদিন সকাল ১০টার সময় মিছিলে গুলি বর্ষণ করা হয় এবং রিকশাচালক মাে. আলী ঘটনাস্থলে নিহত হন। ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে (২৭ মার্চ) বাঙালি ক্যাপটেন নাজিম আহাম্মদ, যিনি সেক্টর সদর দপ্তর কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন, সুবেদার আতাউল। হকসহ ৩০জনের ১টি প্ল্যাটুন সেক্টর সদর দপ্তর দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও এসে হাজির হন। এ প্ল্যাটুনে প্রায় ১৫জন অবাঙালি ছিল। ২৮ মার্চ ঠাকুরগাঁও শহর আবার বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হলাে। ইপিআর-এর গুলিতে একটি নিস্পাপ শিশু নিহত হয়। শিশুটি ইপিআর টহল গাড়ি দেখে ‘জয় বাংলা’ বলে উচ্চৈঃস্বরে। আওয়াজ তুলেছিল। হলপাড়ার পান দোকানদার সন্তকী চৌহানের শিশুপুত্র নরেশ চৌহান। কিছুক্ষণ আগেও আর কয়েকটি শিশুর সাথে পাশের রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করছিল। বড়াে ভাই ফণী চৌহান সবেমাত্র মিছিল থেকে ফিরে এসে ভাইকে ধমক দিয়ে কুঁড়েঘরের মধ্যে উঠেছেন, এর মধ্যেই এ ঘটনা। ঠাকুরগাঁওয়ের দ্বিতীয় শহিদ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিল শিশু নরেশ চৌহান। ঘটনার পর টহল গাড়ি ২টি দ্রুত চলে গেল দক্ষিণ দিকে। টহল গাড়ি ২টিতে ২০-২২জন। ইপিআর সদস্য ছিল, তারমধ্যে ৮জনের মতাে ছিল অবাঙালি। নিস্পাপ শিশু নরেশ চৌহান শহিদ হওয়ার খবর পৌছে গেল কন্ট্রোল রুমে। গুলিতে নিহত হওয়ার খবর শুনে অনেকে ছুটে গেল নিরাপদ আশ্রয়ে। ভীত হয়ে পড়ে এলাকার মানুষ। পর পর ২ দিনে ২টি হত্যাকাণ্ড সবাইকে গভীরভাবে ভাবিয়ে। তােলে। হাতের কাছে যে যা পায়, তাই নিয়েই গ্রামের দিকে কোনাে পরিচিত আশ্রয়স্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এদিকে অস্থিতিশীল ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ধর্মীয় মতে নরেশ চৌহানের সকার করারও সাহস পেল না আত্মীয়স্বজন। বাড়ির সামনেই রাস্তার পূর্ব পাশে নরেশ চৌহানকে সমাধিস্থ করা হলাে। এ সময় আশপাশের কয়েকজন লােক ছাড়া আর কেউই এগিয়ে আসে নি বলে নরেশ চৌহানের। বড়াে ভাই ফণী চৌহান আফসােস করেন। | ২৮ মার্চ বিকালের এ বর্বরােচিত ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। তারা তাদের অভিপ্রায়ের কথা নিজেদের মধ্যে আলােচনা করে। আওয়ামী লীগের নেতারা বার বার লােক পাঠিয়েছেন সুবেদার । মেজর কাজিম উদ্দিনের কাছে তাদের পরিকল্পনা জানার জন্য। বার্তাবাহক খবর নিয়ে আসে সুযােগ এলেই তা করা হবে’।
২৮ মার্চ ভােরেও বিশেষ কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী অবাঙালি ইপিআরএর উপর আক্রমণ করা সম্ভব হলাে না। সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। খােদা না করুন, যদি পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় তবে পরিণাম ভয়াবহ হবে। এদিকে মেজর মােহাম্মদ হােসেন ও ক্যাপটেন নাবিদ আলমের তৎপরতা বেশ বেড়ে গেল। রিজার্ভ সুবেদার হাফিজ শহরে ডিউটি করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ বিছানায় শুয়ে চিন্তামগ্ন। প্রােগ্রাম অনুযায়ী পরের দিন (২৯ মার্চ) তার ডিউটি ছিল সকাল সাড়ে ৭টায় । কিন্তু সেদিন হঠাৎ বিকাল ৫টায় তাকে জরুরি প্যাট্রলে পাঠানাে হলাে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর মহাসড়ক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে। | মেজর মােহাম্মদ হােসেন নিজে তাঁকে প্যাট্রল সম্বন্ধে বিস্তারিত বুঝিয়ে দেন। পথিমধ্যে দিনাজপুর থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের কাছে জানতে পারেন, সেদিন দুপুরেই দিনাজপুর সেক্টর সদর দপ্তর কুঠিবাড়িতে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ইপিআর-এর তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। নিমেষেই মনে মনে তিনি নিজ কর্তব্য স্থির করে তাড়াতাড়ি উইং সদরে ফিরে আসেন। | মাগরিবের নামাজের সময় মসজিদে সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সুবেদার হাফিজের। জানা যায়, রাত পৌনে ১১টায় উইংয়ের শেষ। প্যাট্রল পার্টি লাইনে ফিরে আসার সাথে সাথে বাঙালিদের উপর হামলা এবং সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে সৈয়দপুর সেনা সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেজর হােসেনের উপর নির্দেশ এসেছে। এমন অবস্থায় সুবেদার। মেজর কাজিম উদ্দিনের বাসায় ৮ নম্বর উইংয়ের সুবেদার আতাউল হক, নায়েব সুবেদার মতিউর রহমানসহ কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে গােপন বৈঠক হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, অবাঙালি ইপিআর এবং পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা। হামলার আগেই বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ ঘােষণা করে অকস্মাৎ অবাঙালি সেনাদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং মরণপণ লড়াই করে তাদের যেভাবেই হােক হত্যা করতে হবে। এ সময় নায়েব সুবেদার আহম্মদ হােসেন শহরে প্যাট্রল ডিউটিতে ছিলেন। তিনি ফিরে এলেন সাড়ে ৭টায় । প্যাট্রল পার্টি হাবিলদার দীন মােহাম্মদের নেতৃত্বে সবাইকে রেখে শহরের পরিস্থিতি অবহিত করতে তিনি উইং অধিনায়কের বাংলােয় যান। খবর পেয়ে ভিতর থেকে বের হয়ে আসেন ক্যাপটেন নাবিদ আলম। তখন তারা উইং অধিনায়কের সাথে গোপনে বৈঠক করছিল। নাবিদ আলম বেরিয়ে এলে তিনি সালাম দিয়ে বলেন, “টাউনের পরিস্থিতি ভালাে। কোনাে লােকজন রাস্তায় চলাচল করতে দেখা যায় নি।” উত্তরে ক্যাপটেন নাবিদ তার পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, “সাবাস আহম্মদ হােসেন সাহাব, হাম বহুত খুশ হ্যায় । আপকো মােবারক হাে। বেশাক আপ আপকা পাটিসমেত হাতিয়ার কোথমে (অস্ত্রাগারে) জমা করকে আরাম করাে। কালছে আপকা অউর কোই ডিউটি নেহি হােগা। যাও আরাম করাে।” ক্যাপ্টেনের শেষ কথাটা।
সুবেদার আহম্মদের অন্তরে শেলের মতাে বিধে গেল। বাংলাের গেটের বাইরে এসে কেবল ভাবতে থাকলেন – যে সারা বাংলায় যেখানে রক্তের স্রোত বইছে, সেখানে তার ডিউটি হবে না। ব্যাপার কী? তাদের ডিউটি বন্ধ করে তাহলে কী কেবল অবাঙালিদের দ্বারাই ডিউটি করাবে? আর প্রতিদিন এভাবে লােক মারতে থাকবে? সুবেদার আহম্মদ সৈনিক ব্যারাকের গেটের সামনে এসে দেখেন, ১জন সৈনিক ছাড়া আর কেউ সেখানে নেই। ১জনের সামনে সব অস্ত্র জমা পড়ে আছে। তখন সবাই খাবার খেতে গিয়েছে। পাহারাদার ইপিআর সৈন্যের মুখ মলিন। তিনি দ্রুত ছুটে গেলেন জেসিও মেসে। রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলেন, নায়েব সুবেদার বজল আহম্মেদ। সে সুবেদার আহম্মদের হাতে একটা খোচা দিয়ে বললাে, এত দেরি করে এলেন কেন? তাড়াতাড়ি হাফিজ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। একটু পরেই পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের উপর আক্রমণ। চালাবে। হয় হত্যা করবে, অন্যথায় বন্দি। তখন অধিনায়ক বাংলােতে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের ঐ শেষ কথার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। | মেসের বাইরে আসতেই তিনি হাফিজ সাহেবের মুখােমুখি হলেন। সালাম দিতেই বললেন, “সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনার অপেক্ষায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। বেশি কিছু বলতে পারছি না। মরতে প্রস্তুত আছেন তাে? তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে আরও কিছু কথা বললেন।” প্রত্যুত্তরে সুবেদার আহম্মদ বললেন, তাহলে তাে আমাদের পরামর্শ করে অন্তত জেসিওদের এক একটা এলাকা ভাগ করে কাজ শুরু করা উচিত। নইলে সেমসাইড হয়ে নিজেদের গুলিতে নিজেরাই মারা পড়ব। তিনি দ্রুত ছুটে গেলেন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন সাহেবের বাংলােয়। অন্ধকার বারান্দায় স্টেনগান নিয়ে একাকী বসে আছেন তিনি। এর মধ্যেই সবাই পরিবারবর্গ সরিয়ে দিয়েছিল ক্যাম্পের বাইরে। আরও ২জন জেসিও এসে হাজির হলেন। গােপনে কথা বলতে সেখানে দৌড়ে এসে হাজির হলেন হাবিলদার আবু তালেব। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “স্যার আপনারা কী করছেন? আমাদের কোনাে হুকুমও দিচ্ছেন না, আবার নিজেরাও কোনাে কিছু করছেন না। নানান দিকের খবর শুনে নিজেরা অধৈর্য হয়ে পড়েছি। আমরা লােকদের থামিয়ে রাখতে পারছি না। ক্যাপটেন নজীরকে বাংলাে থেকে বের। করে আনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। উনি বাইরে আসবেন না। সবচেয়ে বড়াে। কথা হলাে, মেজর সাহেবের আরদালি এখন বলে গেল যে, মেজর সাহেব বাংলাের হাবিলদার আলীজানকে ডেকে অর্ডার দিয়েছেন, তার পছন্দমতাে ৩৪জন পাঞ্জাবি সেনা নিয়ে এখনই সুবেদার মেজর সাহেবকে বেঁধে নিয়ে যেতে। আলীজান তার লােকজন নিয়ে আসছেন আর আপনারা এখনাে পরামর্শ করতে দাঁড়িয়ে আছেন?” এ কথা শুনে সুবেদার মেজর এবং সুবেদার আহম্মদের অবস্থা
শােচনীয় হয়ে গেল। যেটুকু পরামর্শ হয়েছিল, তার উপর ভিত্তি করেই তারা যার যার অবস্থান নিয়ে নিলেন।
মাগরিবের পর সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের সাথে গােপন পরামর্শ। মােতাবেক বেশ কয়েক জায়গায় বাঙালি ইপিআর সদস্যরা গােপনে তাদের অবস্থান ঠিক করে নেন। সন্ধ্যার পর উইং অধিনায়ক নির্দেশ দিয়েছিলেন, সব হাতিয়ার ম্যাগাজিনে জমা দিতে এবং এতেই সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন। সম্ভাব্য পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। দ্রুত বাংলাে থেকে বের হয়ে গােপনে যতদূর সম্ভব ম্যাগাজিনের অস্ত্র বের করে দিলেন হাতে হাতে এবং সুবেদার হাফিজ, সুবেদার আতাউল হক, নায়েব সুবেদার মতিউর রহমান, হাবিলদার আবু তালেব ও নায়েক আবদুল হাকিমসহ বেশ কয়েকজন সিপাহিকে দিয়ে যতদূর সম্ভব সব বাঙালিকে অস্ত্র জমা না দেওয়ার নির্দেশ জানিয়ে দেন এবং সুবেদার হাফিজকে পরিস্থিতি বুঝে প্রথমে ফায়ার শুরু করার নির্দেশ দেন। সুবেদার হাফিজই ছিলেন এসব ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও তিনি সমন্বয় রেখে চলছিলেন এবং ইপিআর সেনাদের বেশ প্রিয় মানুষ ছিলেন। | নায়েব সুবেদার আহম্মদ হােসেন সেখান থেকে বের হয়ে ১জন সিপাহিকে দিয়ে খবর পাঠালেন হাবিলদার হাবীবের কাছে এমআই রুমের পিছনে যেতে, যেখানে অন্ধকারে তিনি অপেক্ষা করবেন বলে জানান। গন্তব্যস্থলে যেতে যেতে সামনে পেলেন ২জন রাইফেলম্যানকে। তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলাে অফিসার বাংলাের পিছনে বাঁশতলায়। সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হলাে নায়েব সুবেদার বজল আহম্মেদকে। তারপর সেখানে আসলেন সিপাহি মােজাহেরুল হক। তার কাছে ছিল ১টি স্টেনগান ও গুলিসহ ৬টি ম্যাগাজিন। তাকেও বাঁশতলায় পাঠানাে হলাে। সিপাহি আবদুস সামাদ ১টি স্টেনগান ও ৩ ম্যাগাজিন গুলি নিয়ে দৌড়ে এলে তাকে নিয়ে নায়েব সুবেদার আহম্মদ হােসেন সৈনিক ব্যারাকের পিছন দিয়ে অতিক্রম করে ফয়েজ ডাক্তারের কলাবাগানের কাছে গিয়ে অবস্থান নেন। রাত ১০টা ১৮ মিনিট, চারদিকে অন্ধকার, থমথমে ভাব। সুবেদার। হাফিজের হাতের ছােটো স্টেনগানটা হঠাৎ গর্জে ওঠে। মেজর মােহাম্মদ হােসেনের বাংলাের গার্ড অধিনায়ক পাঞ্জাবি হাবিলদার মাে. জামানের বুকেই প্রথম ফায়ার করা হয়। মেজর মােহাম্মদ হােসেন ও ক্যাপটেন আলমের সমস্ত চক্রান্ত ও পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিয়ে সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন ও সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বের শুভসূচনা শুরু হয়ে যায়।
পরক্ষণেই আরম্ভ হয় বৃষ্টির মতাে গুলি বর্ষণ। টার্গেট অনুসারে বাঙালি। সদস্যরা তাদের কাজ করে যেতে থাকেন। মেজর মােহাম্মদ হােসেনের চিৎকার
শােনা যায় দোতলা বাংলাে থেকে। হাবিলদার মােহাম্মদ জামান ও হাবিলদার। আলীজানের নাম ধরে ডাকতে থাকেন। কিন্তু তখন তারা ২জনেই মৃত্যুপথযাত্রী। গার্ড রুমের অন্য সব পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে হত্যা করা হয়। | প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে অবিরাম গুলি বর্ষণ হতে থাকে। যেখানে যেখানে অস্ত্র নিয়ে অবাঙালি ইপিআর ছিল, তারাও এক সময় একেবারে শান্ত হয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পর মেজর মােহাম্মদ হােসেনের বাংলাের পিছনের বাংকার থেকে ৎিকার ভেসে আসে, “ফায়ার বন্ধ করাে।” এ নির্দেশ ছিল সুবেদার হাফিজের। অন্ধকারে পার্শ্ববর্তী বাংকার থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের পরিচয় দিতে দিতে নায়েব সুবেদার আহম্মদ হােসেন সুবেদার হাফিজের কাছে এসে পৌঁছান। সুবেদার হাফিজ বললেন, “কোনাে দিকেরই কোনাে খবর পাচ্ছি না। সুবেদার মেজরের কী অবস্থা হয়েছে, তাও জানি না। তাই আপনারা এখানে থাকেন। ডানের দুই বাংলাে থেকে সৈনিক ব্যারাকের উত্তরপশ্চিম কোণ পর্যন্ত পুরাে এলাকা আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকল। আমি সুবেদার মেজরের খবর নিয়ে সম্ভব। হলে দ্রুত ফিরে আসব।” সুবেদার হাফিজ চলে যাওয়ার পর নায়েব সুবেদার আহম্মদ হােসেন একে একে প্রায় সবার সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেন। দিনের বেলায় সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনের সঙ্গে যে-সকল সৈনিক ও কর্মকর্তাদের পরামর্শ হয়েছে, তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন বলেই মাত্র ঘণ্টাখানেকের সাহসী বিদ্রোহে গােটা সদর দপ্তর বাঙালিদের দখলে চলে আসার অবস্থা হয়। তারপরও বিভিন্ন এলাকা থেকে চিৎকার, মিনিটে মিনিটে কয়েকটা গুলি এবং স্লোগান ভেসে আসতে থাকে। একে তাে অন্ধকার, তার উপর বিভিন্ন বাংকার থেকে গুলির ভয়। সর্বোপরি ইপিআর সদস্যরা কোথায় কোন অবস্থায় লুকিয়ে আছে, তাও অজানা। বিশেষ করে মেজর ও ক্যাপ্টেনের বাংলাে এবং অবাঙালিদের কয়েকজনের বাসাবাড়িতে তাে তারা ছিলই। | কয়েকজন বাঙালি ইপিআর সদস্য ছুটে এসেছিল শহরে। বিভিন্ন স্থানে। চিৎকার করে তাদের দ্রিাহের কথা প্রচার করেছিলেন এবং দ্রুত জনগণকে ঘর। থেকে বের হয়ে এসে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার আবেদন জানাচ্ছিলেন। এ ক্ষেত্রে নায়েক ইলিয়াস হােসেন সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি ঠাকুরগাঁও থানায় গিয়ে খবর পৌছান এবং অবাঙালি পুলিশদের হত্যা করতে বলেন। শহরবাসী নেমে আসে রাস্তায়। রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ‘জনতা ইপিআর ভাই ভাই, শক্রর রক্ত চাই’ এবং ইপিআর এগিয়ে চলাে, আমরা আছি ভয় নাই’ স্লোগানে চারদিক আলােড়িত হলাে। সবার লক্ষ্য হলাে। ইপিআর ক্যাম্প। মিছিলের পর মিছিল নিয়ে জনতা কালীবাড়ি হয়ে ইপিআর
ক্যাম্পের পূর্ব পাশে জমা হলাে। তখন পর্যন্ত মেজরের বাংলাে থেকে মাঝে মাঝে ২-১টি গুলি ছােড়া হচ্ছিল এবং বাঙালি ইপিআরদের পক্ষ থেকে ঝাঁকে ঝকে গুলি তার জবাব দিচ্ছিল। | আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আবদুর রশিদ মােক্তার ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আকবর হােসেন যােগাযােগ করেন মির্জা তাসমিমুল ইসলাম (বাবলু মির্জা) ও ঠাকুরগাঁও পাওয়ার স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজার সাথে । রেজা তার জিপ নিয়ে ছুটে আসেন এবং আবদুর রশিদ মােক্তার ও আকবর হােসেনকে নিয়ে চৌরাস্তায় চলে আসেন। চৌরাস্তায় এসে রশিদ সাহেব সমস্ত মিষ্টির দোকান খুলে দিতে বললেন। জনগণ পর পর ২ দিন অভুক্ত ইপিআরদের জন্য সব মিষ্টি ও খাবার নিয়ে গেল এবং রশিদ মােক্তারের নির্দেশে যার বাড়িতে যে খাবারই তৈরি ছিল, সে খাবার নিয়েই জনগণ ছুটে চলল ইপিআর ক্যাম্পের দিকে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করলেন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন। প্রায় আধ ঘণ্টা বৈঠক হলাে ওয়াপদা মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপের এক কক্ষে। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ইপিআর সদস্যরা জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি অনুসরণ করে একে একে জড়াে হতে লাগলেন ওয়ার্কশপ এলাকায়। সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় একে একে সিদ্ধান্ত নিতে থাকলেন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নিয়ে। তখন সামনে ২টি ভয়াবহ সমস্যার মােকাবিলা করার প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। যেমন: ১. তখন পর্যন্ত ইপিআর ক্যাম্পে মেজর ও ক্যাপ্টেনের বাংলাের ভিতর
কয়েকজন অবাঙালি ইপিআর ছিল এবং তারাই মাঝে মাঝে গুলি ছুড়ে তাদের অস্তিত্বের কথা জানাচ্ছিল, কারণ তাদের হাতে দিনের বেলায়ই বেশ কিছু অস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানকার বাঙালি সেনাদের অভ্যুত্থানের খবর এতক্ষণে হয়ত সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে পৌছে গিয়েছে। খবর প্রাপ্তির সাথে সাথেই পাকিস্তানি সৈন্য যে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে ছুটে আসবে, তাতে কোনাে
সন্দেহ ছিল না। ঐ সকল সৈন্যদের প্রতিরােধের ব্যবস্থা করা। সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন নির্দেশ দিলেন, বর্ডার (সীমান্ত) কোম্পানিগুলােয় যেখানে যেখানে অবাঙালি ইপিআর আছে, তাদের হত্যা করে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের শহরে চলে আসতে। খবর জানাতে কয়েকজন রওনা হয়ে গেল সীমান্ত এলাকায়। মুক্তিকামী হাজারাে জনতা করাত ও কুড়াল এনে রাস্তার পাশে বড়াে বড়াে গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে করতে এগিয়ে চলল। এ সময় অভুক্ত ইপিআর সদস্যদেরকে ডিফেন্স নিতে সামনে
এগিয়ে যাওয়ার সময় খাবার জোগান দেওয়ার সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিল। স্থানীয় নেতাদের দ্বারা এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সামনে ডিফেন্স ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য এগিয়ে যেতে প্রস্তুত হলাে ইপিআর সদস্যরা। মেজর মােহাম্মদ হােসেন ও ক্যাপটেন নাবিদ আলমসহ তাদের বাংলােয় জীবিত পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রহরায় ১ প্লাটুনকে মােতায়েন রেখে বাকি সবাই প্রস্তুত হলাে সৈয়দপুর সেনানিবাসে অথবা দিনাজপুরে শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। এদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে আসার পথে। ক্যাম্পের বাকি সমস্ত অস্ত্র ও গােলাবারুদ বের করে এনে জমা করা হলাে ওয়াপদা মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে। এতদিন যারা প্রত্যক্ষভাবে রাইফেল চালনা শিক্ষা নিয়েছে, আগ্রহ করে তারা রাইফেল ও গুলি নিয়ে গেল। এদিকে বিভিন্ন বাড়ি থেকে খাবার তৈরি করে জনতা ওয়াপদা ওয়ার্কশপ এলাকায় নিয়ে আসতে লাগলাে। খাবার খেয়ে প্রতিরােধ গড়তে এগিয়ে গেল ২টি দল। এক দল অস্ত্র হাতে ডিফেন্স গড়তে, আরেক দল জনতাসহ। মির্জা বাবুল, মির্জা আলমগীর ও আনিসুরের নেতৃত্বে রাস্তার পাশের বড়াে বড়াে গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে লাগলাে, যেন সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে সহজে শত্রু চলে আসতে না পারে। সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থেকে গেলেন ওয়াপদা এলাকায় । এ সময় তাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন প্রকৌশলী রেজা, আবদুর রশিদ মােক্তার ও আকবর হােসেন। ২৯ মার্চ সােমবার সকাল। রাতে যারা ঘর থেকে বের হতে সাহস পায় নি। তারাও ছুটে এল ক্যাম্প এলাকায়। ক্যাম্প এরিয়ায় প্রবেশ করলেন সুবেদার মেজর। এখানে অবস্থানরত প্ল্যাটুনের সদস্যদের সহায়তায় অবলােকন করলেন, দেখলেন বিভিন্ন এলাকায় পড়ে আছে বাঙালি সেনাদের লাশ। ইপিআর নায়েক ইসমাইল, সিপাহি সারাফত আলী, ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন এবং দিনাজপুর থেকে আগত দলের সুবেদার আতাউল হকের লাশ পাওয়া গেল। ১টি বাংকারের পাশে আহত অবস্থায় পড়ে ছিলেন সিপাহি আবু তাহের। নিহত ইপিআর সৈন্যদের যথাযথ মর্যাদায় দাফন করা হলাে। এখানে ১০৪জন অবাঙালি ইপিআর, সেনাবাহিনীর ৮জন এবং বিমানবাহিনীর ৩জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। | সকাল ৮টার দিকে খবর পাওয়া গেল যে, খােচাবাড়ি এলাকায় ৪জন অপরিচিত লােককে অস্ত্রসহ জনতা ঘিরে রেখেছে। তাদের ১জন মহিলা। অগ্রগামী ডিফেন্স থেকে ১টি দল পাঠানাে হলাে খােচাবাড়িতে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা দেখেই চিনতে পারল তাদেরকে। ১জন পাঞ্জাবি ক্যাপটেন নাবিদ
আলম, মহিলাটি তার স্ত্রী, অন্যজন দিনাজপুর থেকে আসা ক্যাপটেন নজীর আহমদ এবং চতুর্থজন তাদের অবাঙালি পথপ্রদর্শক। কয়েকজন বাঙালি ইপিআর ক্যাপটেন নজীর আহমদকে জীবিত গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন, কিন্তু উত্তেজিত জনতা এবং অপর ইপিআরদের জন্য তা সম্ভব হয় নি। দুই ক্যাপটেনের সাথে ২টি চাইনিজ এসএমজি থাকা সত্ত্বেও তারা তা ব্যবহারের সুযােগ পায় নি। তাদের নিরস্ত্র করে ফেলা হলাে। জানা গেল, আগের রাতে তুমুল গুলি বর্ষণের মধ্যেও অন্ধকারে ক্যাম্পের সীমানা পেরিয়ে তারা বের হয়ে এসেছে এবং হেঁটেই রওনা দিয়েছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে। ভাের হয়ে যাওয়ার কারণে তারা কোথাও লুকিয়ে যেতে পারেন নি। তারা জনগণের কাছে ধরা পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ৪জনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে আরও কিছুক্ষণ পর অপর এক জনতার দল খাকি পােশাক পরিহিত অবস্থায় স্টেনগানসহ ধরে নিয়ে এল পাঞ্জাবি নায়েব সুবেদার সুলতান মাহমুদকে। আগের রাতে এ সুলতান মাহমুদই নায়েব সুবেদার আহমদ হােসেনের পর প্যাট্রল ডিউটিতে শহরে বেরিয়েছিল। গােলাগুলির শব্দ শুনে সে স্টেনগানটি নিয়ে অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ে বাঁচতে চেয়েছিল এবং পালিয়ে যেতে চেয়েছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে, তাকেও মেরে ফেলা হলাে। বিকালের দিকে বেশ কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করলেন নেতারা ও সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন। যেমন: ১. সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা মাত্র কয়েক’শ ইপিআর সদস্য ও আধা শিক্ষিত জনতা কীভাবে প্রতিরােধ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারবে, কারণ সৈয়দপুর থেকে বীরগঞ্জের ভাতগাঁও ব্রিজ পার হয়ে মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে শত্রুর এগিয়ে আসা কোনাে কঠিন ব্যাপার নয়। দশমাইল ও ভূষিরবন্দর ছাড়াও অন্য এলাকা দিয়ে শত্রু এখানে চলে আসতে পারে। যেহেতু শহর ও লােকালয়ই হবে তাদের টার্গেট, সেহেতু সাধারণ জনগণের জন্য শহরে অবস্থান করাটা নিরাপদ হবে কি না? ৪. শিবগঞ্জ বিমানবন্দরের মাধ্যমেও পাকিস্তানি সৈন্যরা সরাসরি ঠাকুরগাঁও এসে যেতে পারে। বাঙালিদের এ জয়যাত্রা স্থানীয় অবাঙালিরা কোনােভাবেই সহ্য করতে পারে নি। শােনা গেল, সকালে বেশ কয়েকজন অবাঙালি সাইকেল নিয়ে সৈয়দপুরে চলে গেছে খবরাখবর জানতে। এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও শুরু হয় রাইফেল চালনা প্রশিক্ষণ। এবার আর ডামি রাইফেল নয়, আসল রাইফেল। একই সাথে ২টি লঙ্গরখানা খােলা হয়। ১টি ইপিআর ক্যাম্পের কাছাকাছি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে আর অন্যটি সিরাজুদ্দৌলা রােডের বেলতলায়। প্রথমটির দায়িত্বে থাকলেন নূরুল ইসলাম ছুটু এবং শেষেরটির দায়িত্বে ফণী ভূষণ পালিত। বালিকা বিদ্যালয় থেকে রান্না করা খাবার প্রধানত ইপিআর সদস্যদের সরবরাহ করা হতাে এবং সিরাজুদ্দৌলা। সড়কে প্রস্তুতকৃত খাবার খেত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক ও জনতা, যারা রাইফেল চালনা প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ কাজে জড়িত ছিল। মহকুমা আনসার অ্যাডজুট্যান্ট কবির তাঁর আনসার বাহিনীকে সীমান্তবর্তী ফাড়িগুলােয় নিয়ােগ ও অপেক্ষাকৃত চৌকস আনসারদের সরাসরি ডিফেন্স। এরিয়ার ইপিআরদের সঙ্গে যােগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ইপিআর ক্যাম্প বাঙালিদের দখলে আসার সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা ইপিআর, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগদান করতে থাকেন। | ৩০ মার্চ মঙ্গলবার ভােররাতেই নায়েব সুবেদার মতিউর রহমান ১টি প্লাটুন নিয়ে উইং সদর দপ্তরে কমান্ডিং অফিসার মেজর মােহাম্মদ হােসেনের ৩ তলা বাংলাে আক্রমণ করেন। ৩০ মার্চ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ক্যাম্প এরিয়ার অভ্যন্তরে যে-সব জায়গা অবাঙালিরা তখন পর্যন্ত দখল করে আছে এবং জীবিত আছে, তাদের উপর আক্রমণ করা হবে। সুবেদার আহম্মদ হােসেনের উপর মেজর মােহাম্মদ হােসেন ও ক্যাপটেন নাবিদ আলমের বাংলাে মুক্ত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। নায়েব সুবেদার বজল আহম্মেদ চৌধুরী এবং ২৫-৩০জন সৈন্য একত্র বসে অভিযান সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা করেন। বিনা বাধায় বাংলার চার দেয়ালের গােড়ায় পৌছে দুই বাংলাে ঘেরাও করে সব দরজা-জানালায়। জোড়া প্রহরা (ডবল ফোর্স) মােতায়েন করা হয়। প্রথমে ক্যাপটেনের বাংলাের দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে যাবতীয় দ্রব্যাদি এলােমেলাে অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। উইং অধিনায়ক মেজর মােহাম্মদ হােসেনের বাংলাের সব দরজা-জানালা বন্ধ, তবে ভিতরে লোেক চলাচলের ছায়া দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর বারান্দার দরজার আড়াল থেকে মেজর মােহাম্মদ হােসেন সুবেদার আহম্মদ হােসেনকে। উদ্দেশ্য করে নিজেকে সারেন্ডারের কথা বলতে থাকেন। কিন্তু উপস্থিত অন্যান্য সৈন্যরা বাঙালি হত্যার প্রতিশােধ নিতে অটল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরূপ চরম উত্তেজনার মুহূর্তে সুবেদার হােসেনের হুকুমের অপেক্ষায় ইপিআর সৈন্যরা প্রহর। গুণছে। ওদিকে জানালার সানশেডের নিচে সুযােগের অপেক্ষায় বসে আছেন। নায়েব সুবেদার বজল আহম্মেদ। মেজর মােহাম্মদ হােসেনের স্ত্রীর হাতে ১টি রিভলভার দেখতে পেয়ে সুবেদার বজল আহম্মেদ সতর্ক হয়ে যান। ইপিআর জেসিওরা তখন উপলব্ধি করতে লাগলেন যে, পাকা দালানের মধ্যে উইং অধিনায়ক ও তার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র থাকা বিচিত্র নয়। বেগম সাহেবাকে। রিভলভার ফেলে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। দেরি দেখে ১জন সৈনিককে একটি বােমা এনে চার্জ করতে নির্দেশ দিলেন সুবেদার হােসেন। এতে কাজ হলাে । মেজর মােহাম্মদ হােসেনের স্ত্রী রিভলভার ফেলে দিলেন। রিভলভারটি নায়েব সুবেদার বজল হাতে নিলেন। এমন সময় দেখা গেল, মেজর মােহাম্মদ হােসেন রান্নাঘর থেকে শােবার ঘরে যাচ্ছেন। নায়েব সুবেদার বজল সুযােগ হাতছাড়া করলেন না। রিভলভারের গুলি মেজরের মাথায় আঘাত করল। মেজর সাহেবের স্ত্রী ৮-৯ বছরের একটি ছেলেকে কোলে করে দৌড়ে মেজরের কাছে আসতেই তাদের উপর ফায়ার করা হলাে। ৩টি লাশ একত্রে পড়ে রইল। অন্যদিকে, উত্তেজিত ও উৎসুক জনতা ওয়াপদা এলাকায় ভিড় করে। আছে। মেজর ও তার স্ত্রীর লাশ নিয়ে জনতা মিছিল বের করে। তা ছিল এক উন্মত্ত উল্লাস। পরবর্তী সময় নেতাদের হস্তক্ষেপে মিছিল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মােতাবেক আকবর হােসেন ও জগন্নাথ গুহ ঠাকুরতা কন্ট্রাক্টর রফিউল এহসানের মােটরসাইকেল নিয়ে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা। সীমান্ত হয়ে ভারতের শিলিগুড়িতে রওনা হয়ে যান। তারা শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে বাংলাবান্ধার অপর পারে ফুলবাড়িয়া নামক স্থানে কংগ্রেস নেতা চণ্ডীবাবুর বাড়িতে যান। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের নেতাদ্বয় শিলিগুড়িতে অবস্থানরত তৎকালীন মন্ত্রী অরুণ কুমার মৈত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের, বিশেষ করে ঠাকুরগাঁওয়ের তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে ইপিআর সৈনিকদের জন্য খাদ্যসামগ্রী সহায়তার অনুরােধ জানান। সে সময় মন্ত্রীর বাসায় উপস্থিত ছিলেন তেঁতুলিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কামরুল হােসেন। নেতারা ২ দিন শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়িতে ছিলেন। তারা সেখানে। সাংবাদিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সাহায্যের আবেদন জানান। ভারতীয় নেতারা স্থানীয় জনগণের সহায়তায়। স্থানীয়ভাবে প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’ গঠন করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১ ট্রাক লবণ, কয়েক ড্রাম তেল, কয়েক বস্তা চিনি, প্রচুর পরিমাণ সিগারেট, ব্যাটারি ও চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সাহায্য হিসেবে মঞ্জুর করেন। যার সংবাদ পরদিন রাজ্যভিত্তিক সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাহায্য প্রাপ্ত মালামাল বালিকা বিদ্যালয়ের রন্ধনশালা বা লঙ্গরখানায় জমা দেওয়া হয়। ৩১ মার্চ বুধবার।
সকাল ১০টার মধ্যেই সীমান্ত ফাঁড়িগুলাে থেকে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা শহরে এসে গেল। ফাড়িতে কর্তব্যরত অবাঙালিদের সঠিক সময়েই সদর দপ্তরের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে। এদিন সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন নিজে কমান্ড গ্রহণ করলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে সেক্টর সদর দপ্তরের অধীন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও রংপুর যথাক্রমে ৮, ৯ ও ১০ নম্বর উইংগুলাের সর্বত্রই বাঙালি ইপিআরদের সাথে অবাঙালি ইপিআর ও পাঞ্জাবিদের সশস্ত্র সংগ্রামে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও উইং সদর দপ্তর বাঙালি ইপিআরদের দ্বারা শত্রুমুক্ত হয়েছে। কেবল প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান রেজিমেন্টের সৈন্যদের সার্বিক সহায়তায় রংপুর উইং শক্রর দখলে চলে যায়। কারণ তখন রংপুর সেনানিবাসে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড সদর দপ্তর। এ ব্রিগেডের অধীনস্থ ৩টি ইউনিট তথা ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট সৈয়দপুরে। অপর ইউনিটগুলােসহ ১৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের অধীনস্থ ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট ছিল রংপুরে। পুরাে ব্রিগেডটি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। ব্রিগেডটি কমান্ড করছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ মালিক। সুসজ্জিত এ ব্রিগেডের সঙ্গে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত ইপিআর বাহিনীর প্রতিরােধ ব্যবস্থা কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে নি। ঐদিন দিনাজপুর ও রংপুর এলাকা থেকে ইপিআর, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যে-সকল লােকজন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল এবং এসব এলাকায় সামরিক ও আধা সামরিকবাহিনীর যে-সকল লােকজন ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন তারা ঠাকুরগাঁও এসে কন্ট্রোলরুমে রিপাের্ট করেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এসকল সৈন্য মিলিয়ে সংখ্যার দিক থেকে প্রায় ১টি ব্যাটালিয়নে পরিণত হলাে। যেহেতু সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন কমান্ড করেছেন, কাজেই তিনি সবাইকে শপথ করালেন। শপথবাক্য ছিল – “বাংলার এই ঘনায়মান দুর্যোগে আমরা শপথ নিচ্ছি যে, যতদিন পর্যন্ত বাংলার মাটিতে বর্বর ইয়াহিয়ার একটি মাত্র সৈন্য থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদেশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করব। জয় বাংলা।” ২৮ মার্চ থেকেই ঠাকুরগাঁও ইপিআর বাহিনীর সাথে অন্য সব এলাকার স্বাভাবিক যােগাযােগ এমনকি ওয়্যারলেস যােগাযােগও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দিনাজপুর সেক্টর সদর দপ্তর ও রংপুরের কোথায় কী ঘটছিল, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানার কোনােই উপায় ছিল না। বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে রানার বা বাহকের মাধ্যমে যােগাযােগ বা সংবাদ আদান-প্রদান হচ্ছিল, তাও স্বাভাবিক
নিয়মে নয়। একই দিনে দিনাজপুর শহর শত্রুমুক্ত হয়। হাবিলদার ইদ্রিসের নেতৃত্বে ১টি টহল দল বন্দি মেজর মকসুল হােসেন চৌধুরী, ক্যাপটেন নজরুল এবং তাদের পরিজনকে উদ্ধার করেন। অফিসারদ্বয় তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঙালিদের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে যােগদান করেন। এঁদের পরিজনদের সঙ্গে আরও একটি পরিবার বেরিয়ে আসে, তা হচ্ছে ক্যাপটেন নজীরের পরিবার, ক্যাপটেন নজীর ২৯ মার্চ সকালে খােচাবাড়িতে ধরা পড়ে ক্যাপটেন নাবিদ আলম ও তার স্ত্রীর সাথে নিহত হয়েছিলেন। ক্যাপটেন নজীরের স্ত্রী-পরিজন তখন পর্যন্ত। জানতে পারে নি, ক্যাপটেনের মর্মান্তিক পরিণতির কথা। জানা যায়, ক্যাপটেন নজীর প্রকৃতপক্ষেই দেশপ্রেমিক বাঙালি ছিলেন। কেবল একই র্যাংকের বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে তাকে এ অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল। মানবতা ও বন্ধুত্বের খাতিরে ক্যাপটেন নাবিদ আলম ও তার পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজে জনতার হাতে প্রাণবিসর্জন দিলেন। | যাহােক, হাবিলদার ইদ্রিসের নেতৃত্বে গঠিত দলটি দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক ফয়েজউদ্দিন আহমেদ, পুলিশ প্রশাসক আবুল হাসেম, জেলা জজ হান্নান চৌধুরী, এডিসি এম এ কাশেম প্রমুখকেও উদ্ধার করেন। অন্যদিকে, দিনাজপুর থেকে সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারিক রসুল কোরাইশী, মেজর জুবেরী, ক্যাপটেন জাভেদ ফিরােজ ও ক্যাপটেন চিমা প্রমুখকে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কিছু সৈন্য এবং কিছু অবাঙালি ইপিআর সৈন্য নিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসে পালিয়ে যাওয়ার পথে ফুলবাড়ি এলাকায় সুবেদার শুকুরের কোম্পানির সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা পলায়ন করে। | রংপুরে ছিল ইপিআর বাহিনীর ১০ নম্বর উইং সদর দপ্তর। এ উইংয়ের উইং অধিনায়ক এবং ২জন সহকারি উইং অধিনায়কের ১জন ছিলেন অবাঙালি। বাঙালি অফিসার বলতে ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিন সহকারী উইং অধিনায়কের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ উইংয়ের অধীন ৫টি কোম্পানি এবং ১টি সাপাের্ট প্ল্যাটুন ছিল। কোম্পানিগুলাের অবস্থান ছিল নিমরূপ: চিলমারীতে ১টি কোম্পানি, কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আবদুল মান্নান। মােগলহাটে ১টি কোম্পানি, কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আরব আলী। পাটগ্রামে ১টি কোম্পানি, কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার ববারহান উদ্দিন। জয়মনিরহাটে ১টি কোম্পানি
সদর দপ্তর উইংয়ে ১টি কোম্পানি • উইং সদর দপ্তরের সাপাের্ট প্ল্যাটুনটির অধিনায়ক ছিলেন নায়েব। সুবেদার নূর মােহাম্মদ। | ২৩ মার্চ লেফটেন্যান্ট আব্বাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রংপুরে আরও দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সেনাবাহিনী ও অবাঙালিদের অত্যাচার দ্বিগুণ। বৃদ্ধি পায়। ২৫ মার্চ দুপুরে লেফটেন্যান্ট আব্বাসের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় রংপুর সেনানিবাসে। সেদিন সকাল ১১টায় হেলিকপটারযােগে ঢাকা থেকে জেনারেল জানজুয়া, জেনারেল মিঠঠা, জেনারেল নজর হােসেন শাহসহ বেশ কয়েকজন। ব্রিগেডিয়ার এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার রংপুর সেনানিবাসে আসেন। শােনা গেল, তারা লেফটেন্যান্ট আব্বাসের জানাজায় শরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছেন। | সামরিক কর্মকর্তারা সরাসরি ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মালিকের বাসায় পৌছে এক সভায় মিলিত হন এবং সভা শেষে তারা জানাজায় উপস্থিত হয়ে সরাসরি হেলিকপ্টারযােগে ঢাকা রওনা হয়ে যান। তবে ঢাকা থেকে আগত কয়েকজন সামরিক অফিসার জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিনের সভায় সম্ভবত ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হামলার নীল নকশা নিয়ে ব্যাপকভাবে আলােচনা করা হয়। ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহ মালিক ২৫ মার্চ দুপুর ১টায় কনফারেন্স আহ্বান করেন। কনফারেন্সে সহকারী উইং অধিনায়ক ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিনেরও উপস্থিত থাকার কথা ছিল। দুপুর ১টায় ক্যাপটেন নওয়াজেশ কনফারেন্স কক্ষে প্রবেশ করলে ব্রিগেডিয়ার মালিক তাকে শহরে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজ তদারকির জন্য পাঠিয়ে দেয়। কনফারেন্স কক্ষে কমান্ডিং অফিসারদেরও দেখা যায়। বলা বাহুল্য, অফিসাররা সবাই ছিলেন অবাঙালি। এ দিন সেনানিবাসের চারদিকে বেশ কিছু শত্রুকে ট্রেঞ্চ করে অস্ত্রসহ প্রস্তুত থাকতে দেখা যায়। পাকিস্তানি জেনারেলদের রংপুর ত্যাগের পর পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায়। ২৫ মার্চ বেলা ৩টা-৫টা পর্যন্ত রংপুর শহরে সান্ধ্য আইন জারি থাকে। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুরস্থ বাঙালি ইপিআর এবং নিরস্ত্র জনতার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। সারারাত ক্রমাগত বৃষ্টির মতাে গােলা বর্ষণ করতে থাকে। সেনাবাহিনীর গুলিতে বেশ কিছু লােক নিহত ও আহত হয়। | ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিন সম্ভবত অবস্থার গুরুত্ব আগে থেকেই আঁচ। করতে পেরেছিলেন। আর তাই ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি ইপিআর গার্ড নিয়ে শহর ছেড়ে তিস্তা নদীর অপর পাড়ে টগরাইহাট নামক স্থানে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ক্যাপটেন নওয়াজেশ চিলমারী, মােগলহাট এবং অন্যান্য স্থানের ইপিআর কোম্পানিগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন।
২৮ মার্চ ক্যাপটেন নওয়াজেশ বাঙালি কোম্পানি অধিনায়ক এবং অন্যান্যদের ডেকে এক সভায় মিলিত হন। সভায় সুবেদার আকবর আলী, হাবিলদার আবুল হােসেন ভূইয়া, মহকুমা প্রশাসক মামুনুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে কোম্পানিগুলার মধ্যে অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআরদের বন্দি করে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়। | ২৯ মার্চ জয়মনিরহাট কোম্পানি থেকে পলায়নমান সশস্ত্র ৮জন অবাঙালি ইপিআর-এর সাথে গঙ্গারহাট ও বালারহাট বিওপি’র বাঙালি ইপিআরদের লালমনিরহাট শহরের সন্নিকটে এক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ৮জন অবাঙালি ইপিআর নিহত হয়। অবশ্য বাঙালি নির্ভীক সৈনিক লুৎফর রহমানও এ সংঘর্ষে শহিদ হন। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩০ মার্চ ‘বি’ কোম্পানিকে তিস্তা নদীর পাড়ে, ‘এ’ কোম্পানিকে কুড়িগ্রামকে পিছনে রেখে, ‘ডি’ কোম্পানিকে লালমনিরহাট বিমানবন্দরের কাছে এবং ‘সি’ কোম্পানিকে সাপটানাচর এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে বলা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘সি’ কোম্পানি সাপটানাচর এলাকায় পৌছতে না পারায় ‘ডি’ কোম্পানি থেকে ১টি প্লাটুন সেখানে পাঠানাে রংপুর উইং সদর দপ্তর থেকে যে-সকল বাঙালি ইপিআর পালাতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা শত্রুর হাতে বন্দি হয় এবং অনেকে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। ক্যাপটেন নওয়াজেশ কুড়িগ্রামে ইপিআর বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করেন। আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র এবং অন্যরা তার সাথে যােগাযােগ করে। ১ এপ্রিল পাকিস্তানি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ১টি প্ল্যাটুন মেজর এজাজ মােস্তফার নেতৃত্বে কাউনিয়ার ওসিকে নিয়ে তিস্তা নদীর পাড়ে রেকি করতে যায়। উল্লেখ্য, সে সময়ে ঐ ওসি রাজাকারদের সহযােগিতা করতেন। তিনি এলাকায় লােকজনের উপর অমানুষিক অত্যাচার করতেন। তাঁর সহযােগিতায় সে সময় শত্রু সৈন্য ও রাজাকাররা বালাপাড়ার সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ মিয়া, মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যকারী ফুলু মিয়া, উসমান গনি মুন্সি, ভুলা মিয়া এবং আরও অনেককে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা তিস্তা সেতুর উপর ব্যারিকেড দিয়ে ওত পেতে শত্রুদের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। শত্রু ১০০ গজের মধ্যে এলে হাবিলদার আবদুল ওহাব প্রথম গুলি বর্ষণ শুরু করেন।
উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে মেজর এজাজ মােস্তফা ও তার ১৫জন সৈন্য এবং কাউনিয়ার ওসি মৃত্যুবরণ করে। অবশিষ্ট শত্রু ইতস্ততবিক্ষিপ্তভাবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে তারা তিস্তা সেতুর নাম শহিদ মেজর এজাজ মােস্তফার নামানুসারে এজাজ ব্রিজ’ রেখেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর এ প্রথম সাফল্যে বিশেষ করে ১জন পাকিস্তানি মেজর নিহত হওয়ার খবরে ইপিআর বাহিনীর মনােবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, শত্রু ২ এপ্রিল তিস্তা সেতুতে পুনরায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর বেপরােয়া শেলিং শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা পালটা কোনাে জবাব না। দেওয়ায় শত্রু বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এটাই চেয়েছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরােপুরি মুক্তিযােদ্ধাদের আওতায় এলে তাদের অস্ত্রগুলাে একই সঙ্গে গর্জে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের অব্যর্থ গ্রেনেড ও গােলার আঘাতে বেশ কয়েকজন শত্ৰু নিহত হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে তিস্তা সেতুতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের উপর ব্যাপক হামলা চালায়। এ হামলায় ইপিআর বাহিনীর ২জন সিপাহি এরশাদ আলী ও আতাহার আলী মল্লিক শহিদ হন। প্রবল গােলা বর্ষণের কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের বাধ্য হয়ে ৩০০ গজের মতাে পিছনে সরে আসতে হয়। ৪ এপ্রিল পাকিস্তানি ১টি রেজিমেন্ট প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালিদের সহায়তায় হারাগাছ নামক এলাকা হয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বাঙালি দালালদের সহায়তা না পেলে হারাগাছ এলাকা। দিয়ে শত্রু তিস্তা অতিক্রম করতে পারত না। ঐ দিনই বেলা ৩টায় তারা বিমানবন্দরে ডিফেন্স নেয়। লালমনিরহাট বিমানবন্দরের সঙ্গে শক্রর অন্যান্য বিমানবন্দরের যােগাযােগ স্থাপিত হয়। ফলে এ সময় থেকেই ঢাকা থেকে সামরিক সম্ভার এবং অন্যান্য সব ধরনের সাহায্য লালমনিরহাট এসে পৌছতে থাকে। তাদের অপর দল সরাসরি তিস্তা নদী অতিক্রম করে অগ্রসর হতে থাকে। শক্রর সঙ্গে সব অবাঙালি পূর্ণ সহযােগিতাও শুরু করে। তাদের এ ঝটিকা অভিযানের ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হয়। ৪ এপ্রিল রাতে মুক্তিযােদ্ধাদের এ কোম্পানি কুলারঘাটে, ‘বি’ কোম্পানি। রাজারহাটে, ‘ডি’ কোম্পানি সাপটিবাড়ি বাজার এবং ‘সি’ কোম্পানি কালিগঞ্জ থানা এলাকায় ডিফেন্স নেয়। এ’, ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানির কমান্ড নেন। সুবেদার আরব আলী এবং ‘সি’ কোম্পানির কমান্ড নেন সুবেদার বােরহানউদ্দিন। সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপটেন নওয়াজেশ। ৭ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি প্ল্যাটুন কুলারঘাট থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত এলাকায় শত্রুর সহযােগী সশস্ত্র অবাঙালিদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ২১জনকে হত্যা করে।
৮ এপ্রিল কুড়িগ্রাম এলাকার অধিনায়ক ক্যাপটেন নওয়াজেশের আহ্বানে একটি কনফারেন্স হয়। কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুসারে এমসিএ রিয়াজ উদ্দিন আহমদ এবং মহকুমা প্রশাসক মামুনুর রশীদকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সাহায্যের প্রশ্নে যােগাযােগ করতে বলা হয়। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, কুড়িগ্রাম মহকুমার অধীন পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ি, কুড়িগ্রাম, রৌমারী, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী এলাকা যে-কোনাে ত্যাগের বিনিময়ে মুক্ত রাখতে হবে। এ সময় থেকে এ এলাকাকেই রংপুর সেক্টর হিসেবে ঘােষণা করা হয়। রংপুর সেক্টরটিকে ২টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। একটি পাটগ্রামে এবং অধিনায়ক হলেন সুবেদার বুরহানউদ্দিন। অপরটি ভুরুঙ্গামারীতে এবং অধিনায়ক হলেন সুবেদার আরব আলী। সেক্টরের দায়িত্বে রইলেন ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিন। এ সময় ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র মিলে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারে দাঁড়ায়। ১১ এপ্রিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং ২টি মেশিনগান দিয়ে সাহায্য করে। ১২ এপ্রিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের ৪টি কোম্পানি ও ১টি সাপাের্ট প্লাটুন সম্মিলিতভাবে লালমনিরহাট বিমানবন্দর এলাকায় শত্রু অবস্থানের উপর বড়াে রকমের হামলা চালায়। এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক ছিলেন সাপাের্ট প্ল্যাটুনের নায়েব সুবেদার নূর মােহাম্মদ, ‘এ’ কোম্পানিতে হাবিলদার মজহারুল হক, ‘বি’ কোম্পানিতে নায়েব সুবেদার সামসুল হক, ‘সি’ কোম্পানিতে হাবিলদার আবদুল ওহাব এবং ‘ডি’ কোম্পানিতে সুবেদার বােরহান উদ্দিন ও হাবিলদার আবদুল ওহাব। সেদিন ফিল্ড অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আরব আলী। কয়েক ঘণ্টার সংঘর্ষে বেশ কিছু শত্রু সেনা নিহত হলেও শেষ পর্যন্ত শত্রু বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। | ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান রাজারহাট ও কুলারঘাটে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। শক্রর সর্বাত্মক আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা স্থান ২টি ছেড়ে পিছনে সরে আসে এবং ১৫ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর ‘এ’ কোম্পানি কাকিনা নামক স্থানে, ‘বি’ কোম্পানি পাটেশ্বরীঘাটে, ‘সি’ কোম্পানি আটেরঘাটের বাম দিকে রৌমারী সড়কে এবং ‘ডি’ কোম্পানি ফুলবাড়ি থানায় পুনরায় ডিফেন্স নেয়। ইতােমধ্যে রিয়ার সদর দপ্তর কুড়িগ্রাম থেকে সরিয়ে ভুরুঙ্গামারীতে স্থানান্তরিত হয়। কুড়িগ্রাম ব্যাংকের যাবতীয় অর্থ ভুরুঙ্গামারীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৮ এপ্রিল সমুদয় অর্থ কুচবিহারের এক | নিরাপদ স্থানে রাখা হয়। শক্রর চাপ অব্যাহত থাকে। তাদের সর্বাত্মক আক্রমণ।
সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থানগুলােয় টিকে থাকার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ২৬ এপ্রিল কুড়িগ্রাম এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি টহল দলের সঙ্গে শত্রুর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর বেশ ক্ষতিসাধন করে নিরাপদে ঘাটিতে ফিরে আসেন। ঐ দিন গভীর রাতে কুলারঘাট নামক স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের রেকি দলের সঙ্গে শত্রুর সম্মুখ সংঘর্ষ বাধলে ৩জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২৮ এপ্রিল সুবেদার আরব আলী ১০জনের ১টি সেকশন নিয়ে মােগলহাট এলাকায় রেকি করতে গেলে শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে পাকিস্তানি সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১০ মে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। ভুরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গত লালমনিরহাট ডাকবাংলাের সামনে কর্নেল ওসমানীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। কর্নেল ওসমানী সেখানে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, “আমি আজ গর্বিত যে বাংলাদেশের মাটিতে থেকে আমার লােকের সামনে কথা বলতে পারছি।” তারপর কর্নেল ওসমানী অন্যান্য এলাকা পরিদর্শনে যান। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী বালুরঘাট আসেন এবং ক্যাপটেন আনােয়ারকে হিলি সেক্টর অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ক্যাপটেন আনােয়ার ১৩ মে পর্যন্ত হিলি সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সেক্টর অধিনায়ক থাকা অবস্থায় আরও ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করেন। যথা: মালঞ্চ ক্যাম্প, তরঙ্গপুর ক্যাম্প ও তপন ক্যাম্প। এ সময় মেজর নাজমুল হক ক্যাপটেন আনােয়ারের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন এবং মেজর শাফায়াত জামিল ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ক্যাপটেন আনােয়ার আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ। করেন। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলের পথে অ্যামবুশ করে তাদের হয়রানি ও ক্ষতিসাধন করা হয়। তারমধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে জয়পুরহাট রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন। শত্রুকে প্রতিহত করে সেখান থেকে ২ ট্রাক ওষুধ, ৬০ বস্তা চিনি ও কিছু কাপড় নিয়ে আসা হয়। | ২৯ মে গােপন সূত্রে খবর পেয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১টি কোম্পানি ও ইপিআর-এর সৈনিক নিয়ে হরকতিডাঙ্গা নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিপথে ক্যাপটেন আনােয়ার অ্যামবুশ করেন। সে সময় শক্রর ১টি কনভয় ঐ
পথ দিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ১জন অফিসারসহ প্রায়। ৩০জন শত্রু নিহত হয় এবং ১টি জিপ ধ্বংস হয়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি। বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হলেও মুক্তিবাহিনীর ইপিআর সৈনিক জলিল। শাহাদতবরণ করেন। সেখানে ১টি পিআরসি-১০ ওয়্যারলেস সেট ও ১টি এসএমজি উদ্ধার করা হয়। | ২৮ মে দিনাজপুর-ফুলবাড়ি রােডে মােহনপুর ব্রিজ এক্সপ্লোসিভ দ্বারা উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানেই অ্যামবুশ বসানাে হয়। ২৯ মে ১০টা ১০ মিনিটে পাকিস্তানি ১ কোম্পানি সৈন্য ঐ পথে অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করে। প্রায় ৪ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর ১১জন। শক্র নিহত এবং ২০জন আহত হয়। পক্ষান্তরে, ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং ১জন আহত হন। লক্ষ্য করা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুড়িগ্রামে ব্যাপকভাবে সৈন্যসমাবেশ করে এবং বিকাল থেকে ট্যাংকসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানগুলাের উপর ব্যাপকভাবে শেলিং শুরু করে। ২৬ মে বিকাল থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলাের উপর ব্যাপক গােলা বর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারাও গােলা বর্ষণের পালটা জবাব দিতে। থাকেন। শত্রুর চাপ অব্যাহত থাকায় শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাটেশ্বরীতে টিকে থাকা সম্ভব হয় নি। ২৭ মে শত্রুরা ধরলা নদী অতিক্রম করে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের পাটগ্রাম ডিফেন্স ছেড়ে পিছনে সরে যেতে হয়। ঐ দিন বিকাল ৪টায় অপরিচিত এক মৌলবির পরামর্শক্রমে ক্যাপটেন। নওয়াজেশ ও সুবেদার গােলাম মােস্তফা পাটেশ্বরী ডিফেন্সে পুনরায় প্রায় ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা পাঠান। আসলে পাকিস্তানি সৈন্যরা অজ্ঞাত মৌলবিকে পাঠিয়ে অ্যামবুশ করে মুক্তিযােদ্ধাদের অপেক্ষায় ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা সেখানে। অগ্রসর হলে শক্র চারদিক থেকে আকস্মাৎ আক্রমণ করার ফলে সংঘর্ষ বাধে। মৌলভির বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা এ যুদ্ধে প্রাণ হারান। এ যুদ্ধে যারা শহিদ হন তাঁরা হলেন:
১. সিপাহি আবুল কাশেম
২. সিপাহি সেকান্দার আলী
৩. সিপাহি আবুল কালাম মুজাহিদ
৪. ক্যাপটেন তমিজ উদ্দিন।
৫. ড্রাইভার আফজাল হােসেন
৬. ড্রাইভার গােলাম রব্বানী
৭. বাবুর্চি আতিকুর রহমান
৮. বাবুর্চি আবদুল আলী
৯. বাবুর্চি মােজাম্মেল হক
১০. দেলােয়ার হােসেন
১১. রমিজউদ্দিন ভূইয়া
১২. আবুল কাশেম
১৩. আবদুল্লাহ
১৪. আব্দুল ওহাব।
পাটেশ্বরী ডিফেন্সে পতন ঘটলে মুক্তিযােদ্ধারা ভুরুঙ্গামারী রিয়ার সদর দপ্তরের চারদিকে ডিফেন্স নেয়। ক্যাপটেন নওয়াজেশ পুনরায় তার বাহিনী। পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন এবং ৩০ মে বিভিন্ন স্থানে তার বাহিনীকে ডিফেন্সে নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। | সুবেদার আরব আলীকে ২টি কোম্পানি নিয়ে ফুলকুমার নদীর পাড়ে, ১টি প্লাটুন ফুলবাড়ি থানা এলাকায়, প্রায় ২টি কোম্পানি নিয়ে সুবেদার। বােরহানউদ্দিনকে দুধকুমার নদী এবং জয়মনিরহাটের বিপরীতে, সুবেদার ফজলুর রহমানকে ১টি কোম্পানি নিয়ে পাটগ্রাম এলাকায় নায়েব সুবেদার কলিমউদ্দিনের সঙ্গে মিলিত হতে বলেন। কিন্তু শক্রর প্রবল আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা উল্লিখিত ডিফেন্সে টিকে থাকতে পারেন নি। পরে মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকাংশ ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে সাহেবগঞ্জে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী। পর্যায়ে সাহেবগঞ্জেই মুক্তিযােদ্ধাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে যুদ্ধ পরিচালনা করা রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ (ঠাকুরগাঁও মহকুমা) নিয়ে গঠিত হয় ৬ নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরের বৈশিষ্ট্য ছিল সেক্টর ও সাব-সেক্টরের অবস্থানগুলাে বাংলাদেশের মাটিতেই গড়ে ওঠে। প্রায় ৬০০ বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ এলাকা ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে ছিল। জুন মাসেই উইং কমান্ডার এম কে বাশারকে ৬ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সেক্টর অধিনায়ক তার সেক্টরকে ৫টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন। ভজনপুর সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন ক্যাপটেন নজরুল, স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন এবং পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপটেন শাহরিয়ার। পাটগ্রাম সাব-সেক্টর প্রাথমিকভাবে ইপিআর-এর জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার ও এনসিওরাই কমান্ড করেছেন। পরবর্তী সময় ক্যাপটেন মতিউর রহমান এ সাবসেক্টরের দায়িত্ব নেন। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিন, মােগলহাট সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন ক্যাপটেন দেলােয়ার এবং চিলাহাটি সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল। উইং কমান্ডার বাশার যখন সেক্টরের দায়িত্ব নেন তখন সেক্টরের সৈন্য সংখ্যা ছিল৭০০-এর মতাে এবং প্রায় সবাই ছিল ইপিআর বাহিনীর সদস্য। ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজারের মতাে। মােট সৈন্য সংখ্যার মধ্যে ১,০০০ ছিল। ইপিআর বাহিনীর সদস্য এবং ৭০০-এর মতাে আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ আর অবশিষ্ট গণবাহিনী। | এদের অস্ত্র বলতে ছিল শুধু সামান্য কিছু রাইফেল, এলএমজি, মর্টার এবং ১টি মেশিনগান। গােলাবারুদও খুব কম ছিল। সেক্টর অধিনায়ক বিমানবাহিনীর অফিসার হওয়ায় সেক্টরের সৈনিক এবং জনগণ সঠিকভাবে তাকে গ্রহণ করবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। অস্ত্রশস্ত্র কম থাকায় আরও বেশি অস্ত্র সগ্রহের জন্য সেক্টর অধিনায়ক মনােনিবেশ করেন। যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা তাদের পরিবার নিয়ে এসেছিলেন তাদের জন্য রেশন সরবরাহ করাও কষ্টকর ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে পােশাক ছিল না, লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে তারা যুদ্ধ করছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের খােলা মাঠে থাকতে হতাে এবং টাকাপয়সারও যথেষ্ট অভাব ছিল। যে টাকাপয়সা কুড়িগ্রাম ও ঠাকুরগাঁও ব্যাংক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা নিয়ে এসেছিলেন সেগুলাে সিলমােহর করা বাক্সে ‘মুজিবনগর সরকার’-এর কাছে। অর্পণ করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী শরণার্থীশিবির থেকে যুবকদের মুক্তিবাহিনীতে নিয়ােগ করে প্রশিক্ষণ প্রদান করত। শরণার্থী শিবিরগুলােয় ছিল অধিকাংশ হিন্দু। তারা তাদের অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাত। এ ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর কোনাে দায়িত্ব ছিল না। উইং কমান্ডার বাশার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলােচনা করে ট্রেনিং ও অপারেশনে পাঠানাের কর্তৃত্ব মুক্তিবাহিনীর হাতে নিয়ে নেন। সে সময় মুক্তিযােদ্ধাদের যে প্রশিক্ষণ শিবির ছিল, সেখানকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেনগুপ্ত ছিলেন ১জন বাঙালি। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ব্রিগেডিয়ার জোশী ঐ মুক্তিযােদ্ধাদের যথেষ্ট সাহায্য ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন। | সমগ্র সেক্টর এলাকায় ৩৫টির মতাে গেরিলা বেইস গড়ে ওঠে। তা ছাড়া পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কিছু সংখ্যক সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য এ সেক্টরে যােগদান করেছিল। সেক্টর সদর দপ্তর ছিল পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারীতে।
৬ নম্বর সেক্টরে ইপিআর বাহিনীর প্রাধান্য ছিল ব্যাপক। রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর সেক্টরের ইপিআর ট্রপস যথাক্রমে সাহেবগঞ্জে এবং ভজনপুরে মজবুত প্রতিরক্ষা ঘাটি গড়ে তােলে। মুক্তিবাহিনী প্রথমেই সাব-সেক্টর গড়ে তােলে সাহেবগঞ্জ ও ভজনপুরে। রংপুর ১০ নম্বর উইংয়ের ইপিআর সৈনিকেরা সাহেবগঞ্জে অবস্থান নেয় এবং ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিন অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ৯ উইং ইপিআর বাহিনী প্রথমে তেঁতুলিয়া এবং পরে ভজনপুরে প্রতিরক্ষা ঘাটি প্রস্তুত করে। এ ঘাটিতে প্রাথমিক পর্যায়ে ইপিআর-এর জুনিয়র কমিশন্ড অফিসাররাই কমান্ড করেন। উইং কমান্ডার এম কে বাশার সেক্টরের দায়িত্ব নেয়ার পর পুরাে সেক্টর এলাকা পরিদর্শন করে যুদ্ধের বিভিন্ন সুবিধাঅসুবিধাগুলাে বিশ্লেষণ করেন এবং সেক্টরকে একটি সুসংগঠিত ও কার্যকর। সুদক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। জুলাই মাসের প্রথম দিকে স্কোয়াড্রন লিডার সদর উদ্দিন এ সেক্টরে যােগদান করলে তাকে ভজনপুর এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৫ জুলাই উইং কমান্ডার বাশার ক্যাপটেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে সঙ্গে নিয়ে সাব-সেক্টর সদর দপ্তর দেবনগর আসেন এবং তাকে সাব-সেক্টরের দায়িত্ব দেন। উল্লেখ্য, ক্যাপটেন শাহরিয়ার পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। এ সেক্টরের ৫টি সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির উপর ক্রমাগত আক্রমণ, অ্যামবুশ করে সড়ক ও সেতু ধ্বংসের কাজ অব্যাহত রাখে। | পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান পাড়া, ডাঙা পাড়া এবং নুনিয়া পাড়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর হঠাৎ আক্রমণ করে। ঐ এলাকায় সুবেদার হাফিজ তার কোম্পানি নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের অকস্মাৎ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ চালিয়ে তাদের চাওই নদীর তীরে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসে। ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টর এলাকার প্রধান প্রধান যুদ্ধগুলাে সংঘটিত হয়েছে অমরখানা, জগদল ও মাগুরমারীতে। তা ছাড়া বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল, হরিপুর ও পীরগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকাসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ ও পালটা আক্রমণ চলেছে। |
পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ শুরু হয় সেপটেম্বর মাস থেকে। ৭ সেপ্টেম্বর জগদলহাট আক্রমণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রাভিযান শুরু হয়। মুক্তিযােদ্ধারা জগদলহাট আক্রমণ করেন কিন্তু শত্রুর তােপের মুখে টিকে থাকতে পারেন নি। তবে শক্রর মধ্যে ভাঙন শুরু হয়। এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির থেকে সদ্য ও স্বল্প প্রশিক্ষিত ২০০-৩০০ করে মুক্তিযােদ্ধা যােগদান করতে থাকেন। ফলে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্যাডেট দলের সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবদুল মতিন চৌধুরী ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মাসুদুর রহমান সাব-সেক্টরে যােগদান করার পর
মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও উদ্যম অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। প্রায় প্রতিদিনই শুরু হয়। আক্রমণ ও পালটা আক্রমণ। চাওই নদী পার হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা যতই অগ্রসর হচ্ছিলেন শক্র ততই ভীত হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। এক সময় মূল সড়ক মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ২১ নভেম্বর থেকে পুরােদমে আক্রমণ ও অগ্রাভিযান শুরু হয়। সাড়াশি আক্রমণের আওতায় এদিন থেকে। পুরাে সেক্টরই বিজয়ের নেশায় মেতে উঠতে থাকে। ২২ নভেম্বর ১২ রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টের এ কোম্পানির সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একত্র হয়ে হামলা ও অগ্রাভিযানে অংশ নেয়। সেদিন প্রায় ৮২টি ভারতীয় ট্যাংক এসে তেঁতুলিয়া বন্দরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে থাকে এবং এর সাথে ভারতীয় ৭ মারাঠা রেজিমেন্ট অবস্থান গ্রহণ করে। | ২৩ নভেম্বর ইদুলফিতরের রাতেই সম্মিলিত বাহিনী অমরখানা ও জগদলহাট দখল করে নেয়। তারপর পঞ্চগড় অভিমুখে যাত্রাকালীন শত্রুর মরণকামড়ে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয় সম্মিলিত বাহিনী। পঞ্চগড় থেকে ১ মাইল। উত্তরে থাকার সময় প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। এখানে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবদুল মতিন চৌধুরী গুরুতর আহত হন। পঞ্চগড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মজবুত ঘাঁটি ছিল। এখানে তাদের ৩ ব্যাটালিয়ন সৈন্য অবস্থান করত। মূল সড়কের উভয় পাশেই ছিল পাকা বাংকার ও মজবুত ট্রেঞ্চ। ২৬ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর ১ ব্যাটালিয়ন ও ভারতীয় রাইফেলস রেজিমেন্টের ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য যৌথভাবে পঞ্চগড় আক্রমণ করেও বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হয়। এখানে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ১০০জন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ২২জন হতাহত হয়।
২৭ নভেম্বর দিনব্যাপী উভয় পক্ষ তাদের নিজ অবস্থানে থেকে তুমুল গােলা বর্ষণ করে। বিকাল থেকেই শুরু হয় ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ। স্থলপথেও সে রাত থেকে ট্যাংকগুলােও অগ্রযাত্রা শুরু করে। ২৮ নভেম্বর রাতে ভারতীয় মারাঠা রেজিমেন্টের ৩ ব্যাটালিয়ন, ১ ব্যাটালিয়ন প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধা এবং ৩০০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায়। একই সাথে ভারতীয় আর্টিলারি রেজিমেন্ট ৬০টি গান থেকে শেলিং শুরু করে। এ রাতে প্রায় ৬ হাজার গােলা বর্ষণ করা হয় শত্রুর শক্ত ডিফেন্সের উপর। ফলে রাতেই শত্রু পঞ্চগড় থেকে পিছু হটে ময়দানদিঘিতে ডিফেন্স নেয়। এ রাতে সম্মিলিত বাহিনীর প্রায় ২৫০জন এবং শক্রর ২৫০জনের মতাে হতাহত হয়। ২৭জন শত্রু সৈন্যকে বন্দি করা হয়। প্রচুর গােলাবারুদ ও ৮টি গাড়ি রেখে শত্রু পঞ্চগড় থেকে তাদের ডিফেন্স তুলে নিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যতগুলাে কঠিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তারমধ্যে পঞ্চগড় এলাকার এ যুদ্ধটা ছিল অন্যতম।
মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনী ৩০ নভেম্বর বােদা থানা এলাকায় শক্র ডিফেন্সের উপর হামলা চালায়। তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করে। যার ফলে ময়দানদিঘিতে শক্ত ডিফেন্স নিয়ে সম্মিলিত বাহিনীকে এক দিন অপেক্ষা করতে হয়। ভারতীয় আর্টিলারি ক্যাপটেন সুধীর এখানে শহিদ। হন। ১ ডিসেম্বর বােদা থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং সম্মিলিত বাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। ভারতীয় বাহিনী বােদায় এসে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঠাকুরগাঁওয়ের অদূরে ভুল্লীর কাছে মুক্তিবাহিনী পুনরায় বাধাগ্রস্ত হয়। সেখানে ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর তােপের মুখে টিকতে না পেরে ভুল্লীর পুল মাইন দিয়ে উড়িয়ে শত্ৰু পিছনে হটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সৈন্য ভুল্লীর ব্রিজ রাতারাতি মেরামত করে ফেলে। সমরাস্ত্র বােঝাই সাঁজোয়া বাহিনীও এগিয়ে আসতে থাকে। ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগে শত্রু ঠাকুরগাঁও শহরের শক্ত ডিফেন্স ও তাদের রিয়ার সদর দপ্তর ইপিআর ক্যাম্পের ঘাটি ছেড়ে পীরগঞ্জের দিকে পিছু হটে যায় এবং ভাতগাঁওয়ের পুলের কাছে তাদের ডিফেন্স নেয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ২ ডিসেম্বর রাতেই ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। সম্মিলিত বাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরাট ১টি দল ৩ ডিসেম্বর সকালে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে বিজয়ােল্লাস করতে থাকে। চৌরাস্তায় বিজয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এমপি অ্যাডভােকেট সিরাজুল ইসলাম মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অগ্রযাত্রায় শামিল ছিলেন এবং ৩ ডিসেম্বর সকালে ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের স্বাগত জানান। | একদিকে তেঁতুলিয়া, ভজনপুর, অমরখানা, জগদল, পঞ্চগড়, ময়দানদিঘি, বােদা ও ভুল্লী হয়ে আগত সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রযাত্রা, অপর দিকে আটোয়ারী থানা হয়ে রুহিয়া দিয়ে ১টি দল এবং লাহিড়ীরহাট হয়ে বালিয়াডাঙ্গী ও আখানগর দিয়ে মুক্তিবাহিনীর অপর ১টি দলও আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি ও রাজাকার, আল-বদরদের পরাস্ত করে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে আসে, তাদের সম্মিলিত দল ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে এসে হাজির হয় এবং বিজয়। পতাকা উড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। ৩ ডিসেম্বর সকালে ঠাকুরগাঁওয়ে আগত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন:
১. আবদুল গােফরান
২. বজলার রহমান।
৩. আসগর আলী
৪. আনােয়ার হােসেন
৫. মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
এখানে একটি কথা বলে রাখা একান্ত দরকার যে, ঐতিহাসিক দিক দিয়ে ঠাকুরগাঁও আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। কারণ ২৫ মার্চ শক্র ঢাকা শহর দখল করে পরবর্তী পর্যায়ে গােটা দেশের বিভিন্ন এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও ঠাকুরগাঁও শহরের পতন হয় ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ ঢাকার প্রায় ২১ দিন পর। আবার পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে গােটা দেশ মুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর, কোথাও বা তারও বেশ কয়েকদিন পর। কিন্তু ২ ডিসেম্বর রাতেই ঠাকুরগাঁও শহরে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে এলাকার বীর মুক্তিযােদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঠাকুরগাঁওকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। | সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিনও তার এলাকায় তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। ৮ আগস্ট ফুলবাড়ি, ১৩ আগস্ট ভুরুঙ্গামারী ও ১৫ আগস্ট উলিপুর থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনী ক্রমাগত আঘাত হানে। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপটেন নওয়াজেশ উদ্দিন ৯ মাসে যে তৎপরতা দেখিয়েছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর ব্যাপকভাবে হামলা চালিয়ে তাদের দারুণভাবে নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। | ৪ সেপ্টেম্বর সুবেদার মেজর আলীর কমান্ডে মুক্তিবাহিনী নাগেশ্বরীতে শত্রুর উপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ৫জনকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী উল্লেখযােগ্য অস্ত্রের মধ্যে এ সংঘর্ষে ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার করে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ জানা যায় নি। এ সেক্টরের ৫টি সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর আক্রমণ, অ্যামবুশ, সড়ক ও সেতু ধ্বংসের কাজ অব্যাহত রাখলেও তারা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। অক্টোবর মাসের গোড়া থেকেই এ সেক্টরের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে বড়াে রকমের আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হলে কৌশলগত পন্থাও কিছুটা পরিবর্তিত হয়। ১৪ অক্টোবর নওয়াজেশ উদ্দিনের কমান্ডে একই সঙ্গে ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাটে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার আবদুল ওহাবকে তার বাহিনী নিয়ে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি সাপাের্টে শক্রর সম্মুখভাগ সরাসরি চার্জ করতে বলা হয়। হাবিলদার সােনা মিয়াকে ১ প্লাটুনের কিছু বেশি সৈন্য নিয়ে সম্মুখভাগে থাকতে বলা হয়। ফাইটিং প্যাট্রল পার্টি হিসেবে সুবেদার সামছুল হককে ৭০জন মুক্তিযােদ্ধা দিয়ে সুবেদার ওহাবের পিছনে রাখা হয় রিয়ার পার্টি হিসেবে। জয়মনিরহাট ও রায়গঞ্জের মাঝে সিঅ্যান্ডবি সড়কে কাট অফ পার্টি হিসেবে ২০জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধার দলকে রাখা হয় নায়েক আজহার আলীর নেতৃত্বে। মুজাহিদ অধিনায়ক আজিজের নেতৃত্বে ১টি পাটুন সিঅ্যান্ডবি সড়কে রায়গঞ্জ ও নাগেশ্বরীর মধ্যস্থলে কাট অফ পার্টি হিসেবে ডিফেন্স নিলাে। প্রায় ২০০ মুক্তিবাহিনীর সদস্য নিয়ে সুবেদার মাজহারুল হককে জয়মনিরহাট আক্রমণ করতে বলা হয়। সুবেদার আরব আলীকে রাখা হয় মাজহারুল হকের সাহায্যের জন্য। পরিকল্পনা মাফিক মুক্তিবাহিনী ১৩ অক্টোবর রাত ১২টার দিকে যথাযথ স্থানে পৌছে যায়। ১৪ অক্টোবর রাত ১টার দিকে মুক্তিবাহিনী ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাটে ব্যাপকভাবে হামলা চালায় পাকিস্তানি অবস্থানের উপর । মিত্র বাহিনীর আর্টিলারির ফায়ার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ ১৫ অক্টোবর সকাল ৭টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। উভয় স্থানেই চরম মার খায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার ছাড়াও ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৮জন সৈন্যসহ ১জন। আর্টিলারির ক্যাপটেন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। মেজর নওয়াজেশের সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং যােগ্য পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর এ সাফল্য ঘটে। তারপর শত্রু পালিয়ে রায়গঞ্জে পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। মুক্তিবাহিনীর এ বিজয়ের পর এ সেক্টরের ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত বলে ঘােষণা করা হয়। | অন্যদিকে, ভজনপুর সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী চাওই নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রথম কমিশন্ডপ্রাপ্ত অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবদুল মতিন চৌধুরী ও লেফটেন্যান্ট মাসুদুর রহমান এ সাব-সেক্টরে যােগদান করেন।
এ এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচল অচিরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা মুক্তিবাহিনীকে রীতিমতাে ভয় করতে থাকে। এ সাব-সেক্টর বাহিনী তেঁতুলিয়া, ঠাকুরগাঁও ও সৈয়দপুর পাকা সড়ককে অক্ষরেখা ধরে অমরখানা পাকিস্তানি ঘাটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটে পঞ্চগড়ে ডিফেন্স নেয়। | ৬ নম্বর সেক্টরে নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী বেশ কিছু অপারেশন পরিচালনা । করে। মুক্তিবাহিনী আক্রমণ অব্যাহত রেখে ২৭ নভেম্বর পঞ্চগড় থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে বিতাড়িত করে পঞ্চগড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পাটগ্রাম সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপটেন রহমানের নির্দেশে ১৯ নভেম্বর সাব-সেক্টর ট্রপস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সুদৃঢ় ঘাঁটি বড়খাতা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে তারা ডিফেন্স ছেড়ে হাতিবান্ধা নামক স্থানে। পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর ৩টি কোম্পানি তিন দিক থেকে একযােগে হাতিবান্ধা আক্রমণ করে। ৩টি কোম্পানির ২টিতে ২জন ইপিআর জেসিও এবং অপরটিতে অধিনায়ক ক্যাডেট ফারুক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেশিক্ষণ টিকতে পারে নি। তারা পিছনে সরে ভুরুঙ্গামারী হয়ে পাকাপাকিভাবে লালমনিরহাটে অবস্থান নেয়। চিলাহাটি সাব-সেক্টর অধিনায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। তিনি নভেম্বর মাসেই ডিমলা নামক স্থান পর্যন্ত দখল করতে সমর্থ হন। পাকিস্তানি সেনারা। ডিমলা ছেড়ে নীলফামারীতে এসে অবস্থান নেয়। তাদের এ ঘাঁটি থেকে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল মাত্র ৪-৫ মাইল দূরে।
মােগলহাট সাব-সেক্টরে ক্যাপটেন দেলওয়ারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১টি দল নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি লালমনিরহাট থেকে মাত্র ৪ মাইল দূরে অবস্থান করতে থাকে। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর বাহিনীর মেজর নওয়াজেশ উদ্দিনের কমান্ডে ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর রায়গঞ্জস্থ অবস্থানে আক্রমণ করা হয়। প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্যে রায়গঞ্জ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এলেও মুক্তিবাহিনীর তরুণ অফিসার লেফটেন্যান্ট আবদুস সামাদসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ। হন। অন্যদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা সঠিক জানা না গেলেও তাদের নিহতের সংখ্যা ২০জনের কম ছিল না। এ বাহিনী ৩০ নভেম্বর নাগেশ্বরী ও পাটেশ্বরীর ধরলা নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরলা নদীর অপর পাড়ে কুড়িগ্রামকে দখলে রাখার চেষ্টা ৬ নম্বর সেক্টর ট্রপস ডিসেম্বরের গােড়াতেই দ্রুতগতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনী ৫ ডিসেম্বর ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রামে পৌছে। শত্রু কুড়িগ্রাম ছেড়ে লালমনিরহাট চলে যায়। সাব-সেক্টর অধিনায়ক মেজর নওয়াজেশ ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে অসামরিক প্রশাসন চালু করার নির্দেশ দেন। ১০ ডিসেম্বর এ সাব-সেক্টরের সৈন্যরা আরও অগ্রসর হয়ে তিস্তা নদীর পাড়ে অবস্থান নেয়। পাটগ্রাম সাব-সেক্টর ট্রপসও সেদিনই তিস্তা নদীর পাড়ে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী আরও অগ্রসর হয়ে বীরগঞ্জ, ভাঁতগাও ইত্যাদি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পাকিস্তানি সৈন্যরা খানসামা নামক স্থান থেকে ৯-১০ ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনীর উপর মরিয়া হয়ে চড়াও হয়। মিত্র বাহিনীর ৩৩ কোরের সৈন্যরা ৬০টি মাঝারি কামান, জঙ্গিবিমান, ট্যাংক। বহর, হেলিকপটার ইত্যাদি সহযােগে ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়। যৌথ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে নিদারুণ ক্ষতি স্বীকার করে পিছনে সরতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারা পিছনে সরে নীলফামারীতে চলে যায়। এদিকে তারা ভাতগাঁও থেকেও পিছু হটে সৈয়দপুরে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে তিস্তার পাড়ে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সাহেবগঞ্জ ও পাটগ্রাম সাব-সেক্টর ট্রপস এবং মােগলহাট সাব-সেক্টর বাহিনী সম্মিলিতভাবে লালমনিরহাট আক্রমণ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
চিলাহাটি সাবসেক্টর ট্রপস ডােমার-নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে একমাত্র রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র সেক্টরটি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। | ৭ নম্বর সেক্টর এলাকা ছিল রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ও দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে। ইপিআর বাহিনীর বনগাঁতে অবস্থানরত ৭ নম্বর উইং, চাঁপাই নবাবগঞ্জে অবস্থানরত ৬ নম্বর উইং, দিনাজপুরে অবস্থানরত ৮ নম্বর উইং এবং দিনাজপুর ও রাজশাহী সেক্টর সদর দপ্তরের অধিকাংশ ট্রপস এ সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপটেন আনােয়ার সেক্টরটির পুনর্গঠনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নির্দেশে ইপিআর-এর ৭ নম্বর উইংয়ের মেজর নাজমুল হক তার সেক্টরের দায়িত্ব নেন। প্রবীণ সুবেদার মেজর এ রবও কিছুদিন সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মেজর নাজমুল হক একটি কনফারেন্স শেষে ফেরার পথে রাতে এক মােটর দুর্ঘটনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মােটরগাড়িটি মেজর নাজমুল হক নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। মেজর নাজমুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয় অবসরপ্রাপ্ত মেজর কাজী নূরুজ্জামানকে। যুদ্ধকালীন মেজর জামানকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত করা হয় এবং তিনিই ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। | প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৪ জুন বাংলাদেশের উর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেজর শাফায়াত জামিল এ সেক্টরে এলেন সৈন্য সংগ্রহের জন্য। শাফায়াত জামিল ইপিআর বাহিনীর ৫ শতাধিক সদস্যকে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত করে পুরােপুরি ১ ব্যাটালিয়নে রূপান্তরিত করেন। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টই ‘জেড’ ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। | ৭ নম্বর সেক্টরের বিস্তৃত এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। মালঞ্চ সাব-সেক্টর বস্তুত ইপিআর জেসিওরাই কমান্ড করেন, তপন সাবসেক্টরের প্রাথমিক পর্যায়ে সেক্টর অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক দায়িত্বে
ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ইপিআর জেসিওদের কমান্ডে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ পরিচালিত হয়, মহােদীপুর সাব-সেক্টর প্রাথমিক পর্যায়ে সুবেদার ইলিয়াস কমান্ড করেন। পরবর্তী সময় এর দায়িত্ব নেন ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ভােলাহাট সাব-সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট রফিকুল ইসলাম, হামজাপুর সাব-সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন ইদ্রিস। ক্যাপটেন ইদ্রিস পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দালালদের কাছে টেরর হিসেবে পরিচিত ছিলেন, আঙ্গিনাবাদ সাব-সেক্টর জনৈক গণবাহিনীর সদস্য মিত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে কমান্ড করেছেন, ঠোকরাবাড়ি সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মােয়াজ্জেম। লালগােলা সাব-সেক্টরের ক্যাপটেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এবং শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ড করেছেন। ক্যাপটেন আবদুর রশিদ। তা ছাড়া ভােলাহাট, ছােবরা ও হিলিতে মুক্তিবাহিনীর পকেট’ ছিল। সেক্টর সদর দপ্তর ছিল তরঙ্গপুরে। প্রায় ১৫ হাজার মুক্তিযােদ্ধা এ সেক্টরে যুদ্ধ করেন। মােট বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২,৫০০ এবং অবশিষ্ট সাড়ে ১২ হাজার ছিল গণবাহিনী। উল্লেখ্য, নিয়মিত বাহিনী বলতে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, সেনা ও বিমানবাহিনীর সম্মিলিত সদস্যকে ধরা। হয়েছে। এ সেক্টরটি মিত্র বাহিনীর ব্রেভাে সেক্টরের তত্ত্বাবধানে ছিল। মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংহ এবং ব্রিগেড মেজর ছিলেন। বি বি ব্যানার্জি। | ২৫-৩১ মার্চের মাঝামাঝি সময় দিনাজপুর জেলার বিরল থানার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর গ্রামের সম্মুখে মুলুক দেওয়ানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের সামনাসামনি যুদ্ধ হয়। মুলুক দেওয়ান যুদ্ধে মেজর আমিনুল ইসলাম নেতৃত্ব প্রদান করেন। লেফটেন্যান্ট ইদ্রিসুর রহমান ইপিআর-এর। অধিনায়ক হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট ইদ্রিস ইএমই অফিসার। ১৯৭১ সালের মার্চের পূর্বেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি জয়পুরহাট সুগার মিলে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে ইপিআর-এর সাথে যােগ দেন। পরবর্তী সময় তিনি ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যােগদান করেন। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘জেড’ ফোর্সে যােগ দেওয়ার জন্য মেঘালয়ের তুরা এলাকায় চলে গেলেও তিনি দিনাজপুর এলাকায় ইপিআর ও গণযােদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীনতা পর্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। ঐ সময় ইপিআর-এর সাবেক সিপাহি জর্জ ও ইপিআর-এর অন্যান্য সদস্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তারা সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে ট্যাংক ও গােলন্দাজের সহযােগিতায় ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি ১জন মেজরের নেতৃত্বে দিনাজপুর। শহর পুনর্দখলের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। পথে তারা চম্পাতলী, ভূষিরবন্দর ও দশমাইল টি জংশনে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। এ সময় শত্রু রাস্তার দুই পাশের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং কামান ও ট্যাংক থেকে গােলা নিক্ষেপ করতে করতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। এভাবে তারা চেহেল। গাজীর মাজারের কাছে এলে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। ইপিআর বাহিনী তাদের অস্ত্র নিয়ে গর্জে ওঠে। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক ও কামানের গােলার মুখে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইপিআর-এর কোম্পানি সদর দপ্তর ছিল বিরলে এবং বিরল থানার মুল্লুক দেওয়ানে ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংকার। তাদের টার্গেট ছিল পার্শ্বস্থ বিষ্ণুপুর অঞ্চল, এনায়েতপুর ও ডুংডুংগী এলাকা। হামজাপুর ছিল ইপিআর-এর ৭ নম্বর সাব-সেক্টর। মেজর মাে. আমিনুল ইসলাম আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীসহ হামজাপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ধর্মজান হয়ে বিষ্ণুপুর গ্রামে সমাবেশ করে। পরবর্তী সময় বিষ্ণুপুর গ্রামকে সম্মুখ (FUP) করে মুলুক দেওয়ানে পাকিস্তানি কোম্পানির উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ আক্রমণে শত্রু পর্যুদস্ত হয় এবং পিছু হটে রিয়ার সদর দপ্তর বিরলে অবস্থান নেয়। তাদের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জাবেদ আলী খান ও ক্যাপটেন গুল। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ ও ক্যাপটেন লেফটেন্যান্ট ইদ্রিসুর রহমান গুরুতর আহত হন।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিনাজপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত খানপুর এলাকায় অপারেশন সংঘটিত হয়। খানপুর যুদ্ধে সিপাহি আবদুল ওয়াদুদ নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং তার সাথে ৮ নম্বর ইপিআর উইংয়ের সাবেক হাবিলদার মাে. আবুল হাশেম অধিনায়ক হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। ঐ সময়। ইপিআর-এর হাবিলদার আবদুর রহমান, সিপাহি আবদুল ওয়াদুদ, সিপাহি শাহাদাত হােসেনসহ অন্য সদস্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন খানপুর বিওপি’র ইপিআর সৈনিকেরা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দিনাজপুর-কুঠিবাড়ি ও সার্কিট হাউজে ইপিআরদের বিদ্রোহের খবর জানার পর। তাদের মনেও প্রতিশােধের আগুন জ্বলে ওঠে। ইপিআর-এর সিপাহি আবদুল ওয়াদুদ ও হাবিলদার আবুল হাসেমের নেতৃত্বে খানপুর শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সংঘটিত হয়। সিনিয়র ওয়্যারলেস অপারেটর সিপাহি মাে. শাহাদাত হােসেন খানপুর এলাকার জনগণের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। ফলে ৫০০-৭০০ মুক্তিকামী জনগণ ইপিআর-এর সাথে একাত্ম হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এ যুদ্ধে ইপিআর-এর কিছু সৈনিক ও ৩জন গ্রামবাসী শহিদ হন। শত্রুর , ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ জানা সম্ভব হয় নি, তবে কিছু সৈনিক হতাহত হয়েছিল, এটা। নিশ্চিত জানা যায় । শক্রর ১টি ট্রাক এ যুদ্ধে ক্ষগ্রিস্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬-২৯ মার্চ পর্যন্ত দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি থানার হাসপাতাল এলাকার পিছনে ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে ফুলবাড়ির প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে অবস্থানরত ইপিআর সদস্যরা প্রাথমিকভাবে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। সেখান থেকে ইপিআর সদস্যরা অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন দিকে রওনা হয়। নায়েব সুবেদার মাে. আনােয়ার হােসেন ৭-৮জন ইপিআর সদস্যসহ ফুলবাড়িতে এসে ফুলবাড়ি থানা হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ঐ সময় ফুলবাড়ি তৎকালীন সার্কেল অফিসারের অফিস শত্রুর ঘাঁটি ছিল এবং বর্তমান উপজেলা প্রশাসন অফিসের পিছনে নদীর পার্শ্বে তারা বাংকার তৈরি করে অবস্থান নিয়েছিল। শত্রুর জনবল আনুমানিক ১ কোম্পানির মতাে ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা ২৮ মার্চ দক্ষিণ দিক থেকে শত্রুর ঘাটির উপর আক্রমণ করে। কিন্তু তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদের পরিমাণ কম থাকায় তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে গােলাগুলিতে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায় এবং পুনরায় ২৯ মার্চ সকাল ৮টায় তারা শত্রুর উপর আক্রমণ করেন। ঐ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহত হয় এবং ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। অতঃপর তারা অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য নায়েব সুবেদার আনােয়ার হােসেনসহ রুদ্রানী-আমড়া ক্যাম্পের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে তরঙ্গপুর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে চলে যায়। রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া থানায় হারাগাছ অবস্থিত। সুবেদার আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে রংপুর ইপিআর উইং সদর দপ্তর থেকে বের হয়ে আসা দলটি ৪ এপ্রিল হারাগাছের কাছে শত্রুর আক্রমণের শিকার হয়। এখানে স্বল্পসংখ্যক ইপিআর সদস্যের সাথে তাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। যুদ্ধে সুবেদার আলাউদ্দিনসহ ১০জন ইপিআর সদস্য শক্রর হাতে ধরা পড়ে। হারাগাছের দক্ষিণে মীরবাগের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যরা ১০জন বাঙালিকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ফেলে রেখে যায়। সুবেদার আলাউদ্দিন মারাত্মক আহত অবস্থায় বেদীগঞ্জ গ্রামের এক বাড়িতে ওঠেন এবং সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেদীগঞ্জে সুবেদার আলাউদ্দিনকে এবং হারাগাছের কাছের গ্রামে বাকি ৯জন শহিদকে সমাহিত করা হয়।
৫ এপ্রিল ৮ নম্বর উইংয়ের সুবেদার আবদুল মজিদ ১টি ইপিআর কোম্পানি এবং ৯ নম্বর উইং ঠাকুরগাঁওয়ের ১ প্লাটুন ইপিআর নিয়ে সৈয়দপুর-নীলফামারী সড়কে সৈয়দপুরের অদূরে দারােয়ানীর কাছে ডিফেন্স নেন। ৫ এপ্রিল ভূষিরবন্দরে শক্রর সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর ছােটোখাটো সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে পালিয়ে যায়। ইপিআর বাহিনীর এ দলটি দশ মাইল অগ্রসর হয়ে রাত ১১টায় চম্পাতলী এসে ডিফেন্স নেয় । ৬ এপ্রিল ভােরে শক্ররা গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযােদ্ধাদের এ দলটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, আনসার ও মুজাহিদ নিয়ে ক্যাপটেন আশরাফ পালটা আঘাত হানেন। বেশ কিছুক্ষণের তুমুল সংঘর্ষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে যায়। তারপর ক্যাপটেন আশরাফ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে জরুরি সভা করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ নিঃশেষ প্রায়, তাই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সন্ধ্যা ৬টার দিকে তারা পিছু হটবেন। কিন্তু সভা শেষ করতে না করতেই সেদিন দুপুর আড়াইটায় পাকিস্তানি সৈন্যরা গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় ব্যাপকভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর পুনরায় আক্রমণ করে। শক্রর ট্যাংক ও ৮১ মি.মি, মর্টারসহ অন্যান্য আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে। এ সংঘর্ষে। মুক্তিযােদ্ধারা বেশিক্ষণ টিকতে ব্যর্থ হন এবং বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সন্ধ্যা ৬টার দিকে পিছু হটতে থাকেন। মুক্তিযোেদ্ধার দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ১টি ভূষিরবন্দর, অপরটি সুবেদার হাফিজের নেতৃত্বে দেবীগঞ্জ হয়ে খানসামা নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। পলাশবাড়ির যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট রফিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মেজর নিজাম তার অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর পাকিস্তানি ঘাটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুসারে হলদিবাড়িতে ১টি প্লাটুন ডিফেন্সে রেখে ৭ এপ্রিল পার্বতীপুরের পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করেন। পার্বতীপুর যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা চরমভাবে মার খান এবং বহু মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। অনেকের। ধারণা, মেজর নিজামের ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই ট্রপস চরমভাবে মার খায়। মেজর নিজাম পার্বতীপুরে মজবুত ঘাটির উপর সামান্য কয়েকটি মর্টার শেল। নিক্ষেপ করেই সৈন্যদের চার্জের নির্দেশ দেন। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা শেলের আঘাতেও কোনাে শব্দ না করে চুপ করে বসে ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা চার্জ করতে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গানগুলাে একসঙ্গে গর্জে ওঠে। বহু মুক্তিযােদ্ধা সেদিন প্রাণ হারান। মুক্তিযােদ্ধারা পার্বতীপুর জয়ের আশা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। শােনা যায়, যুদ্ধে পরাজয়ের পর মেজর নিজাম তার। সৈন্যদের ত্যাগ করে পালানাের পথে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হন।
তিস্তা ব্রিজে শত্রু অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পর তারা শক্তিবৃদ্ধি করে মুক্তিবাহিনীর উপর প্রচণ্ড গােলা বর্ষণ করতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে কুড়িগ্রামে ডিফেন্স নেয়। ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুড়িগ্রাম আক্রমণ করলে মুক্তিযােদ্ধারা কুড়িগ্রাম সদর থানার টোগরাইহাট নামক স্থানে। ডিফেন্স নেয়। ছাত্র-জনতা মিলে টোগরাইহাট থেকে তিস্তা পর্যন্ত ১০ মাইল রেললাইন তুলে ফেলে। শত্রু রেললাইন মেরামত করতে করতে যখন টোগরাইহাটের কাছে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ফায়ার রেঞ্জের মধ্যে এসে পড়ে তখন মুক্তিবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করে। এ যুদ্ধ প্রায় ১৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং বহু শত্ৰু নিহত হয়। লেফটেন্যান্ট সালাম এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ৮ এপ্রিল রাত ১টার সময় সুবেদার বােরহানের (১০ নম্বর উইং রংপুর) নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি কোম্পানি লালমনিরহাট থানা সদরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এ আক্রমণের পরই সুবেদার বােরহান তার কোম্পানি সরিয়ে কুড়িগ্রাম শহরের দিকে নিয়ে যান। ক্যাপটেন আনােয়ার সাহসের সাথে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে তাদের বেষ্টনী থেকে সৈয়দপুরের সন্নিকটে খােলাহাটি গ্রামে পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হন। এবং সেখান থেকে বদরগঞ্জ গিয়ে ডিফেন্স নেন। ইতােমধ্যে ক্যাপটেন আশরাফ ও লেফটেন্যান্ট মােখলেস, যারা ১টি কোম্পানি নিয়ে ঠাকুরগাঁও ছিলেন তাঁদের সৈয়দপুর আক্রমণ করার জন্য বলা হয়। | ৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী বদরগঞ্জে ক্যাপটেন আনােয়ারের ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করে। ক্যাপটেন আনােয়ার তার কিছু সংখ্যক সৈন্য, ইপিআর সদস্য, কিছু আনসার ও মুজাহিদ নিয়ে শত্রুর ফিল্ড গান আর্টিলারি এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের মােকাবিলা করেন। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর সর্বাত্মক আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হন। এক ডিফেন্স থেকে অন্য ডিফেন্সে যাওয়ার সময় ক্যাপটেন আনােয়ার শক্রর গুলিতে মারাত্মক আহত হন এবং তার গাড়িচালক শহিদ হন। ক্যাপটেন আনােয়ারকে ফুলবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তার কোম্পানি খােলাহাটি চলে যায়। ১২ এপ্রিল দিনাজপুর জেলার কোতােয়ালি থানার অন্তর্গত ভূষিরবন্দর এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে ভূষিরবন্দর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভূষিরবন্দর যুদ্ধে ক্যাপটেন আশরাফ নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাঁর সাথে ৮ নম্বর ইপিআর উইংয়ের ক্যাপটেন নজরুল, সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন, সুবেদার। ওসমান গনি, হাবিলদার মােহাম্মদ মিয়া, ল্যান্স নায়েক মােস্তাফিজুর রহমান ও অন্যান্য সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন।
দিনাজপুর কোতােয়ালি থানার অন্তর্গত ভূষিরবন্দর এলাকার সুন্দরবন গ্রামে ১-১২ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর উইং, মুক্তিবাহিনী, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। শত্রু সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনীর সমন্বয়ে অগ্রসর হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রথমে তারা পিছু হটে। একই দিন আবার ৮ নম্বর ইপিআর উইংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। আক্রমণের তীব্রতার মুখে সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ঘুঘুডাঙায় অবস্থান নেয় এবং শত্রু খােরা নদীর তীরে অবস্থান নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় ইপিআর-এর হাবিলদার মােহাম্মদ মিয়া ও ল্যান্স নায়েক মােস্তাফিজ পালটা আক্রমণের এক পর্যায়ে গুলি চালাতে চালাতে শাহাদতবরণ করেন। তাদের সমাধি দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে আজও বিদ্যমান। ২৮ মার্চ দিনাজপুর সার্কিট হাউজে শত্রু ইপিআর বাহিনীর উপর আঘাত। হানার পর ইপিআর বাহিনী খণ্ড খণ্ড দলে বিভক্ত হয়ে বিরল ও কাঞ্চন নদীর তীরে অবস্থান নেয় এবং পর্যায়ক্রমে শিকদারগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ১০ এপ্রিল শিকদারগঞ্জ হতে ঘুঘুডাঙা ক্যাম্প স্থানান্তর করে এবং ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘুঘুডাঙ্গা ইপিআর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে ইপিআর বাহিনী পিছু হটে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের প্রাণসাগরণ, সর্বমঙ্গলা, ধলদিঘি, হামজাপুর, গঙ্গারহাট, কুমারগঞ্জ, চানগঞ্জ, চালান সাফনগার প্রভৃতি এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। ৪ মে ৯ নম্বর উইং ইপিআর-এর ক্যাপটেন নজরুল ও সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন, ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। ক্যাপটেন আশরাফ, মেজর মকসুল হােসেন চৌধুরী (এএমসি), অবসরপ্রাপ্ত মেজর টি হােসেন, সুবেদার ওসমান গনি প্রমুখ ভাতগাঁওয়ের কাছে এক জরুরি সভায় সমবেত হন এবং সকল বাঙালি সৈনিকদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার। জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। ১২ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধাদের ৪টি কোম্পানি ও ১টি সাপাের্ট প্ল্যাটুন। সম্মিলিতভাবে লালমনিরহাট বিমানবন্দর এলাকায় শত্রু অবস্থানের উপর ব্যাপক হামলা চালায়। এ আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের অধিনায়ক ছিলেন সাপাের্ট প্ল্যাটুনের নায়েব সুবেদার নূর মােহাম্মদ, ‘এ’ কোম্পানিতে হাবিলদার মাযহারুল হক, ‘বি’ কোম্পানিতে নায়েব সুবেদার শামছুল হক, ‘সি’ কোম্পানিতে হাবিলদার আবদুল। ওহাব এবং ‘ডি’ কোম্পানিতে সুবেদার বােরহানউদ্দিন। সেদিন ফিল্ড অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আরব আলী। কয়েক ঘণ্টার সংঘর্ষে বেশ কিছু শত্রু নিহত হলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের মূল ঘাটিতে ফিরে আসতে বাধ্য হতে হয়।
১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় পাকিস্তানি ২টি কোম্পানিকে খানসামাতে নদী পার হতে দেখা যায়। সুবেদার হাফিজ তার বাহিনী নিয়ে শত্রু যখন নদী পার হচ্ছিল, তখন অতর্কিত হামলা চালান। এ আক্রমণে শত্রুর ২টি কোম্পানি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ৯ নম্বর উইংয়ের সুবেদার হাফিজ শক্রর এ দলটির কাছ থেকে বহু রসদ, গাড়ি, বিছানা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করেন। কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পালিয়ে যায়। তারা বিপর্যস্ত হলেও ১৪ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধাদের ভাতগাঁও ডিফেন্সের উপর পুনরায় ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। নায়েব সুবেদার খালেক তার ঘাটিতে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ভাতগাঁওয়ের মূল ঘাটি শক্রর দখলে চলে যায়। ফলে সুবেদার হাফিজ খানসামা ছাড়েন। অন্যদিকে, শত্রুর ক্রমাগত আক্রমণে মুক্তিযোেদ্ধারা সব অবস্থান থেকে পিছু হটতে থাকেন। ক্রমশ জয়গঞ্জ, ঝাড়বাড়ি এবং দেবীগঞ্জের ছােটো ছােটো ডিফেন্সগুলাে ছাড়তে হয়। বিচ্ছিন্নভাবে সমগ্র এলাকায় ইপিআর বাহিনী ১৬ এপ্রিলের মধ্যে পঞ্চগড় নামক স্থানে সমবেত হয় এবং কাঞ্চন নদীর পাড়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। | ঠাকুরগাঁও-ভাতগাঁওয়ের পুলের কাছে মুক্তিযােদ্ধারা শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করেন। মেজর টি হােসেন ও সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন ভারতীয় অফিসার কর্নেল ব্যানার্জির সাথে যােগাযােগ করেন। কর্নেল ব্যানার্জি মুক্তিযােদ্ধাদের কিছু গােলাবারুদ দেন, যা পরিমাণে খুবই সামান্য। সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিন কর্নেল ব্যানার্জিকে বলেন যে, যদি ভাতগাঁওয়ের পতন হয়, তবে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ভেঙে যাবে এবং ঠাকুরগাঁও শহর রক্ষা করা যাবে না। অনুরােধে কোনাে কাজ হলাে না। তেমন কোনাে ভারী অস্ত্র ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে পাওয়া যায় নি। | ১৩ এপ্রিল ভাতগাঁওয়ের সম্মুখসমরে না এসে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তা ধরে। পিছন দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা। করে। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুদের পরিকল্পনা বুঝতে পারে। শক্ররা ভাের ৫টার সময় প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ করে। তারা প্রথমে কান্তমন্দিরের পাশ দিয়ে ঢুকে সােজা বীরগঞ্জ দখল করার চেষ্টা করে। নায়েব সুবেদার আবদুল খালেকের নেতৃত্বে মুক্তিযোেদ্ধাদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। প্রায় ৫ ঘণ্টা তুমুল। সংঘর্ষের পর মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে যান। এখানে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এবং শত্রুপক্ষের ২৫-৩০জন নিহত ও ১৫-২০জন আহত হয়। আহত অবস্থায় শত্রুদের হাতে বন্দি হন সিপাহি আব্দুল মান্নান। শক্ররা তার উপর অত্যাচার করে পুকুরে ফেলে দিয়ে যায়। স্থানীয় জনসাধারণের সহযােগিতায় তাকে পুকুর | থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা হয়। পরে অক্টোবর মাসের। মাঝামাঝি তিনি তেঁতুলিয়ায় মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগ দেন।
১ এপ্রিল থেকেই ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে নিজেদের পুনর্গঠন করার চেষ্টা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালায় এ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে। ফলে বিভিন্ন স্থানে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ রকম অবস্থায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্লাটুন আকারের ১টি দল সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে পলাশবাড়ির উত্তরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পরিদর্শন বাংলাের পূর্ব পার্শ্বের গ্রামে ঢাকা-রংপুর সড়কের উপর রংপুরের দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। আগে থেকেই গাইবান্ধার প্রায় শতাধিক ছাত্র-জনতা আনসারদের জন্য রক্ষিত অস্ত্র ট্রেজারি থেকে কর্তৃপক্ষের সহায়তায় নিয়ে প্রশিক্ষণরত ছিল। তারাও সুবেদার আফতাবের দলে যােগ দিয়ে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হন। এ ব্যাপারে। স্থানীয় ব্যক্তিত্ব অ্যাডভােকেট হাসান ইমাম (টুলু) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রংপুর সেনানিবাস থেকে শক্রর বড়ােদরগা-সাদুল্লাপুর-গাইবান্ধা সড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়ে গাইবান্ধা শহর দখলের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে সুবেদার আফতাবের দল এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় বড়ােদরগা-সাদুল্লাপুর-গাইবান্ধা সড়কের সাদুল্লাপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। তাদের সঙ্গে ছিল ১টি ৩.৫ ইঞ্চি ব্লেন্ডিসাইড। এটি মূলত ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র এবং ল্যান্স নায়েক মজিদ এটি চালাতেন। চাইনিজ এলএমজি ছিল সিপাহি তাহেরের কাছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ট্যাংক নিয়ে এ রাস্তা ধরে গাইবান্ধা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাদুল্লাপুর এলাকায় পৌছলে সুবেদার আফতাবের দল আচমকা শত্রুর উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে এবং ল্যান্স। নায়েক মজিদ তার ব্লেন্ডিসাইড থেকে পর পর ৩টি গােল নিক্ষেপ করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এ পরিস্থিতির জন্য মােটেও তৈরি ছিল না। গ্রাম এলাকায়। ঘন গাছপালার কারণে দৃষ্টিসীমা সীমিত থাকে। ব্লেন্ডিসাইডের ফায়ার ট্যাংক। ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। ট্যাংক হারানাের ভয়ে শত্রু অগ্রাভিযান থামিয়ে দেয়। মুক্তিবাহিনীও কল্পনা করে নি, শত্ৰু ট্যাংকসহ এত বিপুল শক্তি নিয়ে এ পথে আসবে। বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলার পর তারা পিছু হটে এবং রংপুর-ঢাকা সড়ক ধরে পুনরায় গাইবান্ধার দিকে অগ্রসর হয়। অল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব হবে না, এ চিন্তা করে সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা গাইবান্ধা হয়ে পূর্ব দিকে চর এলাকায়। পশ্চাদপসরণ করে। ১৭ এপ্রিলে মুক্তিযােদ্ধারা গাইবান্ধা শহর ত্যাগের ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। সাদুল্লাপুরের যুদ্ধে নূরুল আমিন নামে ১জন সৈনিক গুরুতর আহত হন। তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে হাসপাতাল থেকে পাকিস্তানি
সৈন্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করে। এই যুদ্ধে শত্রুর নিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে সংখ্যা নিরূপণ করা যায় নি। মার্চ মাসের অসহযােগ আন্দোলনে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার জনসাধারণ, স্বাধীনতার পক্ষের সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এখানেও মিছিল ও সভাসমাবেশের মাধ্যমে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা, কর্মী ও এলাকার যুবকেরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে চলে যায়। অনেকে এখানে থেকেই কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। | এপ্রিলের মাঝামাঝি তঙ্কালীন থানা সার্কেল অফিসার আবদুস শহিদ চৌধুরীর সহযােগিতায় বিভিন্ন স্তরের জনগণকে নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির মাধ্যমে উলিপুর বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, ব্রিজ, পথঘাট, বন্দর ইত্যাদি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সময় শত্রু অর্থাৎ পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের হত্যা করে তাদের অস্ত্র সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত অস্ত্রগুলাে তিস্তা নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র ও জনগণের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিরােধ বাহিনী ঐ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তিস্তা ব্রিজ পাহারা দেওয়া শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম এলাকায় ঢুকতে না দেওয়া। উলিপুর, কুড়িগ্রামসহ অন্যান্য এলাকার মুক্তিযােদ্ধারাও পাহারার কাজে অংশ নেন। বেশ কিছুদিন পাহারা দিয়ে শত্রুর অগ্রগতি প্রতিহত করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শত্রুর বিমান থেকে বােমা বর্ষণের মুখে ঐ প্রতিরােধ আর ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। ঐ সময় ঢাকার শান্তিবাগের মুক্তিযােদ্ধা খায়রুল আলম এখানে আসেন। তিনি স্থানীয় সহজলভ্য কিছু মশলা দিয়ে ছােটো ছােটো বােমা তৈরি করেন। এ ক্ষুদে অস্ত্রগুলােও শত্রুকে আঘাত হানার কাজে ব্যবহার করা হয়। তখন পর্যন্ত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা এ অঞ্চলে আসে নি। খায়রুল আলমের নেতৃত্বে যুবসমাজের ১টি দল প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে চলে যায়। সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। গ্রহণ শেষে জুন মাসের শেষের দিকে ঐ মুক্তিযােদ্ধাদের নেতৃত্বে ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় ১টি ছােটো কোম্পানি গঠিত হয়। ঐ কোম্পানির সদর দপ্তর ছিল ঘুঘুমার চরে। ঐ কোম্পানি বেশ কিছু দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড ও অপারেশন। পরিচালনা করে। পরবর্তীকালে কোম্পানিতে আরও অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা যােগদান করেন। ফলে শক্তিবৃদ্ধির কারণে তারা অনেক দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করেন। উল্লেখযােগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল পাকিস্তানি সেনা। অঞ্চলের অস্থায়ী মেজর সাহাবুদ্দিনের গৃহে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করা ।
চৌমুহনি বাজারের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যদের ১টি কনভয়ে হামলা করে। ক্ষগ্রিস্ত করা এবং সড়ক পথে শত্রুর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে এ কোম্পানির মুক্তিযােদ্ধারা ধরণিবাড়ি ইউনিয়নের মুনশিবাড়ি ব্রিজ, উলিপুর ইউনিয়নের মাঠের পাড়ের রেলসেতু, দুর্গাপুর ইউনিয়নের নাপিতের হাটের ব্রিজসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর হাতিয়ায় সবচেয়ে ভয়াবহ ও পৈশাচিক। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ইতােমধ্যেই শক্রর সদর দপ্তরে খবর পৌছে ছিল যে, উলিপুর থানার পূর্বাঞ্চলে নদীর ধারের এলাকাগুলােয় মুক্তিযােদ্ধারা ঘাটি গেড়েছেন। তাদের এ ঘাঁটিগুলাে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কম্বিং অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ রাতে ট্রেনযােগে রংপুর থেকে আগত শত্রু ২টি দলে বিভক্ত হয়। ১টি দল দুর্গাপুর রেল স্টেশনে নামে এবং হাতিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। অপর দলটি উলিপুর রেল স্টেশনে নামে এবং উলিপুর বাজারের পূর্ব রাস্তা ধরে হাতিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। তাদের স্থানীয় দালাল, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস্ বাহিনীর নেতারা প্রয়ােজনীয় তথ্য, খবরাখবর, কাগজপত্র ও দিক নির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করে। তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র। ও গােলাবারুদ দিয়ে সেদিন নিরীহ নিরস্ত্র হাতিয়া ইউনিয়নের অধিবাসীদের আক্রমণ করে। তাদের প্রথম দলটি মণ্ডলেরহাটের রাস্তা ধরে হাতিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। এলাকায় প্রবেশের পথেই তারা কতিপয় সাহসী মুক্তিযােদ্ধার প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। শুরু হয় এলােপাতাড়ি গােলাগুলি । সামান্য অস্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত শত্রুর আক্রমণে সেদিন স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা বেশিক্ষণ টিকতে পারেন নি। তাদের মধ্যে ৬জন শহিদ হন। অন্য সঙ্গীরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। ঐ সম্মুখযুদ্ধে শহিদ হন নওয়াব আলী, আবুল কাশেম কাচু,সদেরােয়ার, মােন্তাজ আলী, জীতেন্দ্র নাথ ও গােলজার হােসেন। রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আক্রান্ত হওয়া পাকিস্তানি সৈন্যরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং তাদের উভয় গ্রুপ এলােপাতাড়ি গুলি করতে করতে যুদ্ধের ময়দান হাতিয়া ইউনিয়নে প্রবেশ করে। তারা সে রাতে পথেঘাটে, হাটবাজারে, গৃহে, আঙিনায় যেখানে যাকে পেয়েছিল গুলি করে হত্যা করেছে। প্রায় ৭০০জন নরনারীকে হত্যা করা হয় সে রাতে। অসংখ্য বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয় ও লুটতরাজ করে। বহু নারী নির্যাতিত হন। আজও এ মর্মান্তিক ঘটনার কাহিনী উলিপুরবাসীর কাছে এক করুণ ইতিহাস হয়ে আছে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অত্র থানাধীন বাকরের হাট এলাকায় মাদ্রাসার কাছে রাজাকার বাহিনী জনৈক মুক্তিযােদ্ধা সাহেব আলীকে ধরে ফেলে। তারা তাকে বেধে নিয়ে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। শত্রুরা নির্মমভাবে পেটানাের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঐ মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করেছে। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ থানা এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম আগমন করে ১৭ এপ্রিল অর্থাৎ ঠাকুরগাঁও দখল করার ২ দিন পর। দিনাজপুর থেকে বীরগঞ্জ হয়ে পীরগঞ্জ যাওয়ার আলাদা পাকা রাস্তা রয়েছে। ঠাকুরগাঁও এলাকা থেকে যােগাযােগের চেয়ে দিনাজপুরের সঙ্গে পীরগঞ্জের যােগাযােগ অপেক্ষাকৃত ভালাে ছিল এবং আজও আছে। ১৭ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পীরগঞ্জ থানা সদরে প্রবেশ করে। ঠাকুরগাও ও দিনাজপুরের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে পীরগঞ্জেও বড়াে বড়াে গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। এদিন ৭টি ট্রাক বােঝাই করে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা এসে ব্যারিকেড সরিয়ে পীরগঞ্জে হাজির হয়। ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর শহরের পতন হওয়ার পর অনেকেই সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। অসহযােগ আন্দোলনের সময় সব বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতর্কিত আগমনে এসব পতাকা নামিয়ে প্রতিটি বাড়িতে দ্রুত পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শক্রর ট্রাক বহর প্রথমে পীরগঞ্জ বাজারের পূর্ব প্রান্তের চৌরাস্তায় অবস্থান নেয়। তারপর আস্তে আস্তে পশ্চিম চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানেও বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে চলে যাওয়ার সময় তারা অধ্যাপক গােলাম মােস্তফা, আব্দুল জব্বার, ডাক্তার সুজাউদ্দিন, মােজাফফর বানিয়া ও সেলিমসহ আরও ২-৩জনকে ট্রাকে উঠিয়ে নেয় এবং ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে জামালপুর ভাতারমারি ফার্মের পাশে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। পীরগঞ্জ ত্যাগ করার সময় শত্রু বাজার ও রাস্তার উভয় পাশের দোকানপাটে অগ্নিসংযােগ করেছিল। শত্রু ও অবাঙালিরা মিলে এখানে ৭-৮জনকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর এলাকায় মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক গােলাম মােস্তফা নিহত হওয়ার ঘটনা সাধারণ মানুষকে গৃহত্যাগী হতে বাধ্য করে। | পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের দোসরদের সহযােগিতায় পীরগঞ্জ কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করে। সাছের আলী, মােবারক আলী, আবদুস সামাদ, কাজী ইব্রাহিম ও আব্দুল বারী প্রমুখ স্বাধীনতাবিরােধী দালাল ও রাজাকারদের সহযােগিতায় শত্রু সৈন্যরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে যারা মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে ভারতে গিয়েছিলেন, তাদের বাড়িঘর ও পরিবার-পরিজনদের চিনিয়ে দেওয়া, ঘরবাড়ি লুট করাসহ সর্বত্র অগ্নিসংযােগ করার কাজে এসব দোসররা জড়িত ছিল বলে জানা যায় ।
রাজাকাররা ঠাকুরগাঁও কলেজের ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা সালাহউদ্দিনকে ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা পরবর্তী সময় সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করে এবং সালাহউদ্দিন বাঘের খাদ্যে পরিনত হন।
কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করার পর প্রতি রাতেই তারা নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে আটকে রেখে নানা উপায়ে নির্যাতনের পর কখনাে গুলি করে আবার কখনাে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে পীরগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সামনের পুকুরে ফেলে দিত। জানা যায়, এখানে ৯জনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখান থেকে অসংখ্য কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের। পরিচয় পাওয়া যায় নি। এ পুকুরটি মুক্তিযােদ্ধা পুকুর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পীরগঞ্জ থানা ভূমি অফিসের সামনে শহিদ আবু ইসহাকের কবর এবং আজাদ স্পাের্টিং ক্লাবের সামনে যে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, সেখানেও বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা। তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হাজি মােহাম্মদ দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তীর জন্মস্থান ও কর্মক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই অবাঙালি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রোশের কারণ হয়েছিল। তা ছাড়া শহিদুল্লাহ শহিদ, মাে. মােখলেছুর রহমান, কমরেড মনসুরুল আলম, ডা. সুজাউদ্দিন, ডা. আব্দুল মালেক, ডা. আবদুর রাজ্জাক, সাবেক এমপি মােখলেছুর রহমান, খলিলুর রহমান ও এমপিএ একরামুল হকের নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় শত্রু একদিকে যেমন ভীত ছিল, অন্যদিকে সুযােগ পেলেই বাঙালি হত্যায় মেতে উঠত মালঞ্চ সাব-সেক্টরে। পীরগঞ্জ থানা ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন এবং সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নূরুজ্জামান। ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (বীরশ্রেষ্ঠ) কিছুদিনের জন্য পীরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। এলাকার স্বাধীনতাকামী মুক্তিযােদ্ধারা সীমান্তবর্তী গােদাগাড়িতে অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প স্থাপন করে ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে গােদাগাড়ি, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে আক্রমণ চালান। অন্যদিকে, শত্রু ও তাদের দোসরেরা মিলে নিরীহ বাঙালিদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় ও তাদের হত্যা করে। | ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে বালিয়াডাঙ্গী থানার অবস্থান। তেভাগা আন্দোলনের বীর সেনানী কম্পম সিং, ডােমারাম সিং ও টেপু মােহাম্মদের এলাকা বালিয়াডাঙ্গীতে ১৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রবেশ করে। তারা ঠাকুরগাঁও থেকে বালিয়াডাঙ্গী যাওয়ার পথে রাস্তার উভয় পাশের দোকানপাট ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
সীমান্তবর্তী থানা হওয়ার কারণে এলাকার অনেকেই প্রথমত ভাবতে পারে। নি যে সহসা পাকিস্তান সেনাবাহিনী বালিয়াডাঙ্গী আসতে পারে। কিন্তু প্রথম দিনই ৫টি ট্রাক বােঝাই পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা বালিয়াডাঙ্গী গিয়ে থানা এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে। তারপর স্থানীয় দালালদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ করতে থাকে। রফিক ব্যাপারী, বদিউজ্জামান, ওয়াহিদ বক্স, ডা. ইদ্রিস আলী, আকবর আলী, ইয়াসিন চৌধুরী, মওলানা আবদুর রহমান, নাসিরুল হক, মােহাম্মদ ও আবদুল আজিজ প্রমুখ স্বাধীনতা বিরােধীদের সহযােগিতায় প্রথম দিকেই শ্যামল বাবুকে হত্যা করে। তারপর থেকে তারা প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে টহল দেওয়া শুরু করে এবং ছােটো পলাশবাড়ি, হাওলা, বেলবাড়ি, লাহিড়ী, বেলহারা, সনগাঁও, ধনতলা, কালন্দা, বাটুনিয়া, বড়াে পলাশবাড়ি ৪-৫ কলােনি, কাশায়া, খাদেমগঞ্জ, আমজানখাের, কাঁদুসা ও পাড়িয়াসহ সমস্ত এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালাতে থাকে। এলাকার মানুষের প্রিয়জন ডা. হামিদুর রহমান, বাবু ভােলানাথ চ্যাটার্জি, অমরেশ চন্দ্র রায়, দবিরুল ইসলাম, কাজী ফাহিম উদ্দিন, ফজলুল করিম এমপি। এবং নূরুল হক সে সময়ের নেতৃত্বে যেভাবে অসহযােগ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তেমনিভাবে সলেমান আলী, আবু তােয়াব, কফিলউদ্দিন, রেশালউদ্দিন, সাখাওয়াত হােসেন, তাজিমুল ইসলাম, তৈয়ব আলী, আবদুর রাজ্জাক, মাে. আফাজুল হক, মাে. ইব্রাহিম, আবদুল মজিদ, মতিউর রহমান, বিজয় কুমার সিংহ, আব্দুস সােবহান, নুর মােহাম্মদ ও শফিকুল ইসলাম প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ ও আক্রমণে পাকিস্তান সেনা বাহিনী ও তাদের দোসর স্থানীয় দালাল ও রাজাকাররা ভীত হয়ে পড়ে। তবুও তারা লাহিড়ীরহাট, বালিয়াডাঙ্গী বাজার, হরিণমারী, খােচাবাড়ি, দোলুয়া ও পাড়িয়া নামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। এসব ক্যাম্পে মূলত শত্রু ছিল না। তারা মাঝেমধ্যে টহল দিতে আসত। আসা-যাওয়ার পথে যাকে সামনে পেত, তাকেই গুলি করে হত্যা করত, নয় তাে অমানবিক নির্যাতন চালাত। অবাঙালি ও স্থানীয় দালালেরা বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘর থেকে যাবতীয় মালামাল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এমনকি ঘরের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে আসত। এখানে শক্রর দোসরেরা বৃদ্ধা ও শিশুকন্যার উপরও নির্যাতন চালিয়েছে বলে জানা গেছে। দালালেরা ভুবন মণ্ডল সিংহ, সমরেন্দ্রনাথ রায়, জন্টু মােহাম্মদ, মাে. হােসেন আলী, দিলু মােহাম্মদ ও মােহাম্মদ খতিবউদ্দিনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সংসদ সদস্য মাে. দবিরুল ইসলামের পিতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আকবর আলীকে শত্রুরা কোথায় তুলে নিয়ে গেছে বা তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা আজও জানা যায় নি। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ণোদ্যমে ট্যাংক ও গােলন্দাজ বাহিনী নিয়ে পঞ্চগড়ের উপর আক্রমণ করে। তুমুল সংঘর্ষে
মুক্তিবাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। সংঘর্ষে সুবেদার হাশেম গুরুতর আহত হন এবং তাঁকে ভারতীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানাে হয়। শত্রুর ব্যাপক ও ক্রমাগত আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। নায়েব সুবেদার খালেক ও সুবেদার হাফিজ ২০ এপ্রিল ভজনপুর পেীছেন এবং সেখানে। ডিফেন্স নেন। | অবস্থানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিলি এলাকা যাতে শত্রু দখল করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপটেন আনােয়ারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-জনতা মিলে বাংলা হিলি এবং দক্ষিণে বাসুদেবপুর এলাকায় ডিফেন্স নেয়। সীমান্তবর্তী হিলি এলাকা দখলের উদ্দেশ্যে শক্ররা ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা পাঁচবিবি, ঘােড়াঘাট ও বিরামপুর – এ তিন দিক দিয়ে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৮ এপ্রিল হিলি এলাকায় আক্রমণ চালায়। ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-জনতা মিলে ক্যাপটেন আনােয়ারের নেতৃত্বে বাংলা হিলি এবং দক্ষিণ বাসুদেবপুর এলাকায় প্রায় ২০০-২৫০জনের ১টি ডিফেন্স নেয়া হয় হিলিকে মুক্ত রাখার জন্য। পাকিস্তান সেনা বাহিনী হিলি আক্রমণের জন্য পাঁচবিবি, ঘােড়াঘাট ও বিরামপুর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ১৮ এপ্রিল তারা হিলি এলাকায় মুক্তিযােদ্ধা প্রতিরক্ষার উপর ত্রিমুখী আক্রমণ করে। ২ দিন প্রচুর গােলাগুলি এবং শত্রুর ভারী অস্ত্রের আক্রমণে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাের লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ১৯ এপ্রিল ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। এ যুদ্ধে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি মালেক, ড্রাইভার খালেক এবং কিছু ছাত্র-জনতা। শহিদ হন। বাংলা হিলি যুদ্ধে ইপিআর-এর ৬০-৭০জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। সুবেদার শুকুর ইপিআর-এর অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন হাবিলদার ভুট্ট, হাবিলদার খলিল, নায়েক এরফান, ল্যান্স নায়েক (সিগন্যাল) আজিজ, সিপাহি আলী আকবর ও সিপাহি আমজাদ। এ যুদ্ধে ইপিআর-এর নায়েক এরফান আহত হন। এ যুদ্ধে শত্রুর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পঞ্চগড় জেলার সদর থানার উত্তরে একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম অমরখানা। অমরখানার উত্তরে ভারতের জলপাইগুড়ি ও ভাটপাড়ায় ছিল বিএসএফ ক্যাম্প। ভাটপাড়ার কাছে স্থাপিত হয় মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির। অমরখানা সড়ক পথে পঞ্চগড়ের মাধ্যমে দিনাজপুর শহরের সাথে যুক্ত। অমরখানা দিনাজপুর শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে ইপিআর-এর বিওপি। থাকায় যুদ্ধের আগে থেকেই গ্রামের উত্তর দিক ছিল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা। সুরক্ষিত। তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড় পাকা সড়ক ছাড়াও গ্রামের কিছু মেঠো পথ ছিল।
অমরখানায় ইপিআর-এর ৯ নম্বর উইংয়ের ১টি বিওপি ছিল । এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান সেনা বাহিনী এটি দখল করে এবং ১টি শক্তিশালী ঘাটিতে পরিণত করে। এটি ছিল তাদের সর্ব উত্তরের অগ্রবর্তী ঘাটি। তেতুলিয়া অঞ্চল মুক্ত রাখার জন্য মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত বাহিনী (প্রধানত ৯ নম্বর উইংয়ের ইপিআর) অমরখানার বিপরীত দিকে (পশ্চিমে) ভজনপুর-দেবনগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে, সীমান্তের উত্তরে ভারতীয় বাহিনী ও গণবাহিনী গেরিলা ক্যাম্প স্থাপন করে। স্বাধীনতার ডাকে অন্যান্য অঞ্চলের মতাে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও এলাকার সেক্টর এবং উইং সদর দপ্তরের বাঙালি ইপিআর সদস্যরাও বিদ্রোহ করেন। অবাঙালি অফিসার এবং সদস্যদের দ্বারা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়ে তারা তাদের বন্দি ও নিরস্ত্র করে ফেলে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ইপিআর-এর বাঙালি সৈন্যরা অমরখানা দখল করেন। এপ্রিলের গােড়ার দিক থেকে রংপুর ও সৈয়দপুর সেনাছাউনি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মুক্তাঞ্চল দখলের জন্য ব্যাপক অভিযান শুরু করে। মুক্তিবাহিনী শক্রর অগ্রাভিযান বন্ধ করতে প্রচণ্ড প্রতিরােধ যুদ্ধ করে দশমাইল, পঞ্চগড়, অমরখানা এবং সর্বশেষ ভজনপুর ব্রিজ ভেঙে ফেলে। পাকিস্তানি সৈন্যরা অমরখানা ব্রিজের উপর পরিত্যক্ত ইপিআর ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে তাদের উত্তরাঞ্চলের শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে গড়ে তােলে। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় পাকিস্তানি সৈন্যরা দখল করলে মুক্তিবাহিনী ভজনপুর এসে মরণপণ লড়াই করে শুক্রকে (২০ এপ্রিল) অমরখানায় আটকে রেখে তেঁতুলিয়া থানাকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। অমরখানার সাবেক ইপিআর ভবনটিকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর প্রায় ২ কোম্পানি সৈন্য বিওপিটিকে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থানে পরিণত করে। অসংখ্য বাংকার, ট্রেঞ্চ, পিলবক্স ট্রেঞ্চ, মাইন ফিল্ড নিয়ে অমরখানা পরিণত হয় দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে। ভারতীয় বাহিনীর শেলিং, অগ্রবর্তী বিএসএফ বাহিনীর মেশিনগানের গুলি বর্ষণ এবং নিয়মিত গণবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অসংখ্য আক্রমণের মুখেও অমরখানায় শত্ৰু নিজ অবস্থানে অনড় থাকে। অমরখানা ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুদ্ধের। প্রাথমিক দিনগুলােতে ইপিআর-এর সঙ্গে যুক্ত হয় আনসার, মুজাহিদ, সাবেক সৈনিক ও ছাত্র-জনতা। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে নায়েব সুবেদার কাজী মুরাদ আলীর নেতৃত্বে অমরখানার সন্নিকটে (‘সি’ কোম্পানি) প্রতিরক্ষা ঘাটি নির্মাণ করে। ২ মে থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ তারা সেখানে। অবস্থান করে এবং শক্রদের ক্ষতিসাধন করে। এ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক।
ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন। নিয়মিত ও গণবাহিনী অমরখানার উত্তরে ভজনপুর থেকে দেবনগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ক্যাপটেন সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ভজনপুর-দেবনগর প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে সম্মিলিত মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে অমরখানা-জগদলহাটে অবস্থিত শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এ সাব-সেক্টরে তল্কালীন ছাত্র মাহাবুব আলমের নেতৃত্বাধীন গণবাহিনীর ১টি গণযােদ্ধা দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। জুন-জুলাই মাসে তারা অমরখানা এলাকা এবং এর পার্শ্ববর্তী শালমারা ব্রিজ, সর্দার পাড়া, তালমা ব্রিজ ও টোকাপাড়া অঞ্চলে গেরিলা অভিযান চালিয়ে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখের। আগস্ট মাস থেকে মাহাবুব আলমের গেরিলা দলটি শত্রু কবলিত বাংলাদেশের ভিতরে হাইড আউট করে। অমরখানা এলাকার পূর্বে অবস্থিত বদলুপাড়া, বিসমনি, বেরুবাড়ি, মধুপাড়া ও সাদারপাড়া এলাকায় গেরিলা অভিযান চালায়। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দলটি অমরখানা এলাকার উত্তরে অবস্থিত ঘঁটি থেকে অমরখানা ও পার্শ্ববর্তী। এলাকায় গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে শক্রর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রথম কমিশন প্রাপ্ত অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মতিন চৌধুরী ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মাসুদুর রহমান এ সাব-সেক্টরে যােগদান করেন। অমরখানার উত্তরে চাউলহাটি বিএসএফ ক্যাম্পে ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের ১ গার্ড রেজিমেন্ট প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অমরখানা দখলের পর নিয়মিত বাহিনী, গণবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী অমরখানা আক্রমণ করতে থাকে। সেপটেম্বর মাসের দ্বিতীয়। সপ্তাহে শক্রর ঘাটিতে ২ কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ করা হয়। মূল আক্রমণের ৩-৪ দিন পূর্ব থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর অধিনায়করা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রেকি করেন। তাঁরা লুঙ্গি পরে কৃষকের পােশাকে সীমান্তবর্তী গাছের উপর স্থাপিত অবজারভেশন পােস্ট থেকে পাকিস্তানি ঘাটির বিস্তারিত অবস্থান শনাক্ত করেন। রেকিতে স্থানীয় জনগণ ও গণবাহিনীর গেরিলা সদস্যরা বিশেষ সহায়তা প্রদান করেন। বিস্তারিত রেকির পর। অধিনায়করা আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। আর্টিলারির সহায়তায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু বা দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বণ্টন ও দুই বাহিনীর সমন্বয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। অক্টোবর মাসে পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ব্যর্থতার কারণে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারির সহায়তায় অমরখানা আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ২২ নভেম্বর রাতে চাওই নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ৩ কোম্পানি সৈন্য পূর্ব তীরে আক্রমণ স্থানে সমবেত হয়। ভারতের ৭ মারাঠা রেজিমেন্ট মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উত্তরে আক্রমণের জন্য সমবেত হয়। আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পর্কে অধিনায়ক পর্যায়ে সর্বশেষ সমন্বয় করার পর রাত ২টায় আক্রমণ শুরু হয়। সাহসী মুক্তিযােদ্ধারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতার সাথে গুলি বর্ষণ শুরু করেন। আক্রমণের সাথে সাথে পাকিস্তানি আর্টিলারি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুরক্ষিত ও শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে আক্রমণকারীদের প্রতি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী ক্রমবর্ধমান আর্টিলারি সহায়তা ও আক্রমণকারীদের চাপে শত্রু ঘাটি ছেড়ে পশ্চাদপসরণের পরিকল্পনা করে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা। ভােরের কিছু আগে প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা অমরখানা ছেড়ে জগদলহাট ঘাটিতে অপরিকল্পিতভাবে পালিয়ে যায়। অমরখানায় উড্ডীন হয় বাংলাদেশের পতাকা। ২৪ এপ্রিল দিনাজপুর জেলার বিরল থানার অন্তর্গত বহবল এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বহবল যুদ্ধে ৮ নম্বর ইপিআর উইংয়ের সুবেদার মেজর আবদুর রব নেতৃত্ব প্রদান করেন। তার সাথে ইপিআর সুবেদার ওসমান গনি, সুবেদার আবদুল খালেক, সুবেদার আমির আলী, হাবিলদার ভুলু মিয়া ও অন্যান্য সদস্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরলে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটির উপর বার বার আক্রমণ করতে থাকলে, প্রথমত মুক্তিবাহিনী পিছু হটে নাড়াবাড়ি এবং সেখান থেকে আরও পিছু হটে কিশােরীগঞ্জ ও পাঁচপাড়া এলাকায় ডিফেন্স নেয়। ২৪ এপ্রিল তারা বহবল এলাকায় শত্রুর উপর বড়াে ধরনের হামলা চালায়। এ আক্রমণে শত্রু দিশেহারা হয়ে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখণ্ডে অনবরত আর্টিলারি গােলা নিক্ষেপ করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে শত্রু বার বার ইপিআর বাহিনীকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বিএসএফ-এর উপর চাপ প্রয়ােগ করে। বিএসএফএর মেজর বেদী ইপিআর সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানান। বৈঠক শেষে বিএসএফ বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সুষ্ঠু আক্রমণের জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে। পরামর্শ দেয় এবং ভারতের রামপুর নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে শত্রুর উপর হামলা চালানাে হয়। এদিকে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা বিরল রেল স্টেশন থেকে মুক্তিবাহিনীর উপর আর্টিলারি গােলা নিক্ষেপ করে। ২৯ মার্চ সকালে বিস্তারিত জানিয়ে সব সীমান্ত ফাঁড়িতে বার্তা পাঠানাে হয়। বাঙালি ইপিআরদের রিয়ার সদর দপ্তর ছিল কাঞ্চন জংশন। রিয়ার সদর দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন। সুবেদার ওসমান গনি ও সুবেদার এম এ খালেক তালুকদার এবং রণাঙ্গনের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার মেজর আব্দুর রব ও হাবিলদার ভুলু মিয়া। সুবেদার মেজর আব্দুর রব চাপসার, বিরল, কামদেবপুর এবং অন্যান্য ইপিআর অবস্থানগুলাের অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে নিয়ে সেক্টর সদর দপ্তর। দিনাজপুরে চলে আসার জন্য বাঙালি ইপিআরদের নির্দেশ দেন। বর্তমান লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত কাকিনা রেল স্টেশন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ইপিআর কোম্পানির প্রধান সুবেদার বােরহানউদ্দিন বাঙালি ইপিআরদের সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের অগ্রাভিযান প্রতিরােধের জন্য কাকিনা রেল স্টেশনের কাছে ডিফেন্স নেন। এদিকে অধিনায়ক নুরুজ্জামান দ্রুত মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি কোম্পানি গড়ে তােলেন। কোম্পানি ২টির অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে মুজাহিদ বাহিনীর তমিজ উদ্দিন ও আনসার অধিনায়ক রিয়াজ উদ্দিন। মুজাহিদ ক্যাপটেন তমিজ উদ্দিন পরে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে শহিদ হন। মুজাহিদ ক্যাপটেন তমিজ উদ্দিনকে তার কোম্পানিসহ সুবেদার বােরহানের কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অধিনায়ক রিয়াজ উদ্দিনকে তার কোম্পানিসহ গঙ্গাচড়া ও কালীগঞ্জ থানার তিস্তা নদীর ৩টি ঘাট পাহারায় নিয়ােজিত করা হয়েছিল।
৮ এপ্রিল রাত ১টার দিকে সুবেদার বােরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের। ১টি কোম্পানি লালমনিরহাট থানা সদর দপ্তরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের পর পরই সুবেদার বােরহান তার কোম্পানিকে সরিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের দিকে নিয়ে যান। ৯ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা কালীবাজারের কাছাকাছি এসে পড়লে মুক্তিযােদ্ধারা সবাই সরে পড়েন। তাঁরা ১৪ এপ্রিল ফুলবাড়ি থানায় উপস্থিত হন। ফুলবাড়ি থানাতেই ক্যাপটেন নওয়াজেশের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের দেখা হয়। ক্যাপটেন নওয়াজেশের সাথে ঐ সময় দ্বিতীয় কোনাে অফিসার ছিলেন । তিনি নূরুজ্জামানকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী থানা ভুরুঙ্গামারীতে নিয়ে যান। নূরুজ্জামান ক্যাপটেন নওয়াজেশের সহকারী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ভুরুঙ্গামারী থানা সদর ঐ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি পুরাে সেক্টরে পরিণত হয়েছিল। রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার এবং বিভিন্ন বয়সী ছাত্ররা দলে দলে ভুরুঙ্গামারী থানায় আসতে থাকেন। তাদের নিয়ে ৬টি কোম্পানি গঠন করা হয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভুরুঙ্গামারী থানা সদরেই প্রদান করা হয়। সুবেদার বােরহান পাঁচগাছি থেকে কাউয়াহাগা পর্যন্ত ধরলা নদীতীরবর্তী বিস্তৃত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি কোম্পানি মােতায়েন করেন। অন্যদিকে, ইপিআর সুবেদার আরব আলী কাউয়াহাগা থেকে গােরক মঞ্জিল পর্যন্ত অঞ্চলব্যাপী ২টি কোম্পানি মােতায়েন করেন। কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করার পর ভুরুঙ্গামারী থানার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা যােদ্ধাদের পাঠানাে হয়। তারা অধিকৃত
কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী উলিপুরে সাফল্যের সাথে গেরিলা আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এপ্রিল মাসে ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি। থানার অন্তর্গত পাগলা দেওয়ান সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইঞ্জিনিয়ার ইদ্রিস খান পাগলা দেওয়ান যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ঐ যুদ্ধে ইপিআর-এর ৬০-৭০জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। ইপিআর নায়েব সুবেদার ভুলু মিয়া অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তার সাথে ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার সালেক এবং হাবিলদার মকবুল হােসেন ছিলেন। পাগলা দেওয়ান বিওপিতে অবস্থান গ্রহণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর হ্যারাসিং ফায়ার দিয়ে শত্রুর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করে এবং তাদের মনােবলকে ধ্বংস করে জনসাধারণের মনে মুক্তিবাহিনীর আস্থা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ভারতের গােবরা প্রশিক্ষণ শিবিরের ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপটেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা এপ্রিল মাসের কোনাে এক রাতে আনুমানিক ১২টায় পাগলা দেওয়ানের ঘাগড়া নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বগুড়ার পর জয়পুরহাট দখল করে কৌশলগতভাবে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিজেদের আয়ত্তে রাখার উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী বিওপিগুলাে দখলে রেখে শত্রু বেশ দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। এ প্রেক্ষিতে তারা জয়পুরহাট ও পার্শ্ববর্তী জেলার বিভিন্ন এলাকা তাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন জয়পুরহাটের বিভিন্ন এলাকা নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। সীমান্তবর্তী বিওপি পাগলা। দেওয়ান তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ভারতের গােবরা ক্যাম্পে অবস্থানরত ইপিআর গণবাহিনীকে সাথে নিয়ে শত্রুর পাগলা দেওয়ান ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নায়েব সুবেদার সালেক, হাবিলদার মকবুল হােসেনসহ আরও অনেক ইপিআর সৈনিক এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাত আনুমানিক ১২টায় ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপটেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে পাগলা দেওয়ানের ঘাগড়া নদীর পাড়ে অ্যামবুশ করেন। সকাল আনুমানিক ৭টার দিকে পাগলা দেওয়ান ক্যাম্পের উপর মর্টার হামলা চালানাে হয়। দুই পক্ষে প্রচুর গােলাগুলির এক পর্যায়ে শত্রু। মুক্তিযােদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। তখন সম্মুখযুদ্ধে ইপিআর বেশ সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে এবং ৩জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে অক্ষত অবস্থায় ভারতে ফেরত যেতে সক্ষম হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড