You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.11.04 | ১৯৭২ এর সংবিধান | জাসদের ভাষায় 'বাজে সংবিধান' - সংগ্রামের নোটবুক

সংবিধান প্রণয়ন

১৯৭২ এর সংবিধান | জাসদের ভাষায় ‘বাজে সংবিধান’

‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ বলে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘গণপরিষদ আদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ’ নামক ২টি আদেশ জারি করে। প্রথমটির মাধ্যমে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদের একমাত্র দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। আইনসভা হিসেবে কাজ করার কোন ক্ষমতা গণপরিষদের ছিল। এই আদেশটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়। দ্বিতীয় আদেশ অনুযায়ী গণপরিষদের কোন সদস্য তার রাজনৈতিক দল (অর্থাৎ যে দলের মনােনয়ন পেয়ে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন) থেকে পদত্যাগ করেন, কিংবা উক্ত দল থেকে বহিষ্কৃত হন তাহলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।’ এ দুটি আদেশ জারির পরপরই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি কর্তৃক গণপরিষদের দলীয় নেতা নির্বাচিত হন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সহকারী নেতা নির্বাচন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ১০ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন উদ্বোধন করেন। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শাহ আবদুল হামিদ ও মােহাম্মদউল্লাহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গণপরিষদের যথাক্রমে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪১৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের লক্ষ্যে ১১ এপ্রিল একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ড. কামাল হােসেন। এই কমিটিতে একমাত্র বিরােধীদলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি-ন্যাপ (মােজাফর) থেকে ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কমিটিতে একজন মহিলা গণপরিষদ সদস্য (মােট মহিলা সদস্যসংখ্যা ছিল ৭ জন) অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কমিটিতে পরবর্তী ১০ জুনের (১৯৭২) মধ্যে গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া উপস্থাপন করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী কমিটি অত্যন্ত দ্রুত সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে। ১৭ এপ্রিল কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন সংবিধান বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কমিটির ঘােষিত শেষ তারিখের (৮ মে ১৯৭২) মধ্যে কমিটি ৯৮টি সুপারিশমালা লাভ করে। পূর্বনির্ধারিত ১০ জুনের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। সংবিধানটিকে পূর্ণাঙ্গ ও উত্তম করার উদ্দেশ্যে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হােসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করে সেখানকার পার্লামেন্টের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করেন। তাছাড়া সংবিধানটিকে ত্রুটিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে কমিটি একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবরের মধ্যে কমিটি সংবিধানের খসড়া চূড়ান্তভাবে প্রণয়ন করে । সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করার পূর্বে ৯ অক্টোবর তা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে উপস্থাপিত ও আলােচিত হয়েছিল। এভাবে প্রণীত চূড়ান্ত খসড়াটি কমিটির সভাপতি এবং দেশের আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন সংবিধানের বিলের আকারে গণপরিষদের অধিবেশনে উপস্থাপন করেন। ১৩ অক্টোবর গণপরিষদ নিজস্ব কার্যপ্রণালীর বিধিমালা গ্রহণ করে। ১৮ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে সংবিধান বিল সম্পর্কে সাধারণ আলােচনা শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর তা সমাপ্ত হয়। ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিংহ ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংবিধানের বিষয়ে তার পার্টির সুপারিশ উপস্থাপন করেন। ৩১ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ধারাওয়ারি আলােচনা শুরু হয়। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সে আলােচনা চলে। আলােচনাকালে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক আনীত কতিপয় সংশােধনী গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের ৭৩নং অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কর্তৃক আনীত একটি সংশােধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান বিল পাশ হয়। ১৪ ডিসেম্বর (১৯৭২) স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও গণপরিষদ সদস্যগণ সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি কপিতে স্বাক্ষর দান করেন। তবে একমাত্র বিরােধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবিধান বইতে স্বাক্ষর দানে বিরত থাকেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস থেকে সংবিধানটি কার্যকর করা হয়। এরপর গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হয়। গণপরিষদের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ মৃত্যুবরণ করায় (১২ অক্টোবর ১৯৭২) ইতােমধ্যে মােহাম্মদউল্লাহকে স্পিকার ও বায়তুল্লাহকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করা হয়েছিল। গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে ঘােষণা করেন যে, বিধিবদ্ধ সংবিধানের আওতায় দেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান প্রণয়নকালীন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও দলের প্রতিক্রিয়া ও মতামত সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠনের ঘােষণা দেওয়ার পর সরকারকে রাজনৈতিক বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়। বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলে। তাদের যুক্তি ছিল যে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন শাসন কাঠামাে আদেশবলে উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসন কাঠামাের মধ্যে ৬ দফার ভিত্তিতে একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার সাথে সাথে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ঐ নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যগণ গ্রহণযােগ্যতা হারিয়েছেন। সুতরাং তারা দাবি করেন যে বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করতে হলে একটি নতুন সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করতে হবে। এই দাবি নিয়ে ন্যাপ (ভাসানী) দলের নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একটি সরকার বিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। ১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এক জনসভায় তিনি সরকারের পদত্যাগ ও একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকায় মওলানা ভাসানীর আহ্বানে তেমন জনসমর্থন পাওয়া যায়নি।

সংবিধান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া

গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর এর বিরুদ্ধে কোন জোরালাে বিক্ষোভ বা আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কোন রাজনৈতিক দলই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির বিরুদ্ধে কোন মতামত প্রকাশ করেনি বা সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকল্প কোন প্রস্তাব উত্থাপন করেনি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ঐ সংবিধানকে একটি ‘বাজে সংবিধান’ হিসেবে অভিহিত করে। এই দলের মতে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের উপর নানা বাধা নিষেধ আরােপ করে দেশে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার কোন দিক নির্দেশনা সংবিধানে দেয়া হয়নি। তবে দলটি এই মর্মে সন্তোষ প্রকাশ করে যে দেশে কোন সংবিধান না থাকার চেয়ে একটি ‘বাজে সংবিধান’ থাকাও শ্রেয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) সংবিধানের কিছু কিছু সংশােধনীর প্রস্তাব করলেও সংবিধানকে স্বাগত জানায়। সেসময় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে নিষিদ্ধ থাকায় কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকায় সংবিধান বিষয়ে খােলাখুলি কোন মন্তব্য বা সুপারিশ পেশ করতে পারেনি।

Reference: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ১৯৭২-১৯৭৫