You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.10 | নিউ স্টেটসম্যান, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে - সংগ্রামের নোটবুক

নিউ স্টেটসম্যান, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে

পিটার শোর কতৃক লিখিত প্রতিবেদন যিনি সদ্যই ভারত সফর করে ফিরেছেন যার মধ্যে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনও ছিলো।

বাঙলার গুরুতর সঙ্কটকালের মূলে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন। যেটি জিন্নাহ তাঁর ধর্মান্ধ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গঠন করেছিলেন ১৯৪৭ সালে এখন সেটি চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইয়াহিয়া খানের নির্বুদ্ধিতা এবং তাঁর সেনাপতিদের হিংস্রতার ফলে।

স্বভাবতই, একক রাষ্ট্র হিসেবে ২৪ বছরের অস্তিত্বের কোনো পর্যায়েই একে একত্রে ধরে রাখা এবং একক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল হিসেবে জুড়ে রাখা সহজ ছিল না, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ কোটি মানুষ এবং সুদূর পূর্ব বাঙলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে। কিন্তু যে সম্ভাবনাই থেকে থাকুক না কেনো, জিন্নাহর উত্তরসূরিরা তা হেলায় হারিয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত বছরের নির্বাচন, যেটিতে বাঙলা-ভিত্তিক আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয় এবং এর পরবর্তীকালে সুদুর-পরাহত স্বায়ত্তশাসন নিয়ে শেখ মুজিব এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যকার আলোচনা, একক পাকিস্তান রক্ষার একটি শেষ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এই সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায় শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য নয়, বরং এর আগেই প্রেসিডেন্টের তাঁর সামরিক বাহিনীকে দেয়া আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার এবং যা তারা জীবনেও ভুলতে পারবে না বাঙালীদেরকে এমন শিক্ষা দেয়ার নির্দেশের কারণে।

তিনি যতই লুকানোর চেষ্টা করুন না কেন, পরিস্থিতি এখন আর প্রেসিডেন্টের হাতের নাগালে নেই। টিক্কা খানের সৈন্যদের হিংস্রতা এমন এক শক্তিকে মুক্ত করেছে যা আজ হোক বা কাল শুধু ওদেরকেই নয় বরং পাকিস্তানকেই ধ্বংস করে দেবে। এখন বিশ্বের কাছে মূল প্রশ্ন, এটা নয় যে পাকিস্তান কিভাবে টিকে থাকবে বরং কিভাবে, অন্যান্য পরাশক্তির সাথে বিরোধের ইন্ধন না জুগিয়ে এবং বাঙলার উপর আরো অসহ্য দুর্দশা না হেনে, বাঙলায় তার শাসনের অবসান ঘটাবে। এক্ষেত্রে বাস্তবিকই সমূহ বিপদ রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিড়ম্বনাকর ফলাফলের কারণে হিংস্র দমনপীড়ন মানবজাতির ইতিহাসে অজ্ঞাত নয়, যদি মার্চে শুরু হওয়া দমনপীড়ন শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, বিশ্বমত হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও তা মেনে নিত, কিন্তু দমনপীড়ন এমন নিষ্ঠুরতার সাথে এবং এতো দীর্ঘ সময় ধরে চালানো হয়েছে যে মানুষ পালিয়ে গেছে, শুধুমাত্র তাদের বাড়িঘর থেকে নয় বরং তাদের দেশ থেকে অবিশ্বাস্য হারে গত ৫ মাস ধরে প্রতিমাসে ১৫ লক্ষ করে – এবং এখনো যা কমার কোনো লক্ষন নেই – ইংগিত দেয় দমন শক্তির অপব্যবহারে প্রায়োন্মাদনার। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, তাহলে, যে পাকিস্তানের সীমান্তের অনেক বাইরেও এক ক্রমবর্ধমান চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বিশেষ করে ভারত, অপেক্ষা করছে এবং নজর রাখছে অস্বাভাবিক নিবিড়তার সাথে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধিত বোধ করছে।

এটা স্বভাবতই, পাকিস্তানের শাসকদের জন্য একটি মরিয়া চেষ্টা হবে যদি তারা এখন ভারতের উপর সামরিক আক্রমন পরিচালনা করে। কিন্তু ভারত এই হুমকিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে ঠিক কাজই করছে। পূর্ব বাঙলাকে ধরে রাখার জন্য পাকিস্তানের জান্তার কাছে সামান্যই আশা রয়েছে যদি তারা গণতন্ত্র এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদের সাথে তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধকে মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রুপান্তর, এবং সে থেকে ভারতের সাথে এক বাহ্যিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখাতে পারে।

এসব গত কয়েক মাসের অত্যাধিক দমনপীড়নের পেছনের উদ্ভট যুক্তি। যেখানে প্রথম শরণার্থীদের ঢলটি ছিল মুসলমান আওয়ামী লীগের সমর্থকদের, পরবর্তী ঢেউগুলো – অতিসম্প্রতি পর্যন্ত যখন মুসলমান শরণার্থীর সংখ্যা আবারো বাড়তে থাকে – ব্যাপকভাবে হিন্দু অধ্যুষিত ছিল কেননা সেনাবাহিনী এবং রাজাকাররা, বা বিশেষ পুলিশবাহিনী, উদ্দীপিত করেছে এবং, কিছু ক্ষেত্রে, বাধ্য করেছে বেসামরিক জনগণকে তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যেতে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে পাকিস্তানের সরকারী প্রচারণা বাঙলার পুরো সমস্যাটিকে গুটিকয়েক বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের অপচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। হিন্দুদের অর্থ এবং ভারতীয় মদদ। যতক্ষণ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান এই ব্যপারে বিশ্বাসযোগ্য থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর আশা আছে গড়ে তোলার, তাঁর সরকারের পক্ষে বাঙলার ভেতরেই বাঙালী মতবাদ, পাঞ্জাবে জনপ্রিয়তা অর্জন এবং বাইরের দেশগুলোকে দেখাতে, সবসময়ের মতোই আভ্যন্তরীণ ব্যপারে স্পর্শকাতর থেকে, কিছু অজুহাত নিয়ে, যতই দুর্বল হোক না কেনো, তাদের নিজেদের লজ্জাজনক নীরবতার জন্য।

ঠিক একই কারণে, কেননা ভারত জানে যে এটাই পাকিস্তানের উদ্দেশ্য এবং কেননা ভারত চায় যে বিশ্ব দেখুক সঙ্কটটির আসল রূপ, পাকিস্তানের সমস্যার জন্য ভারতীয় সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অটলভাবে দাবী করে যাচ্ছে যে এটা পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীণ” সমস্যা, বাঙলায় দমনপীড়নের সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে আড়াল করে, নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে, ভারতের অবস্থান আপোষহীনভাবে প্রতিরক্ষামূলক।

ইতোমধ্যে ভারতকে নজিরবিহীন সংখ্যক শরণার্থী আগমনের কষ্ট এবং খরচ এবং অসংহতি মেনে নিতে হচ্ছে, যা প্লাবিত করছে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম এবং পুরো ভারতীয় অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে ম্লান করে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে এরকম মনে হচ্ছে যেন তারা ভয়াবহ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এটাই প্রতিষ্ঠা করতে যে পাকিস্তানের যন্ত্রণা হানার ক্ষমতা ভারতের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি না কম। এখন পর্যন্ত ভারত নিজেকে রক্ষা করে আসছে – এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সরাসরি আক্রমণের আশঙ্কা কিছুটা কমে গেছে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর।

কিন্তু প্রতিযোগিতা এখনও শেষ হয়নি। যে ৮০ লক্ষ মানুষ প্লাবিত করেছে পশ্চিম বঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশকে তারা দুর্ভিক্ষের শরণার্থী নয় বরং তারা দমন এবং আতঙ্কের শরণার্থী। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যখন পূর্ব বঙ্গে খাদ্যাভাব ছড়িয়ে পড়বে তখন মানুষের দ্বিতীয় ঢল, এবার দুর্ভিক্ষের শরণার্থীরা, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এমন সংখ্যায় আসতে পারে যা কল্পনা করাও কঠিন। এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে হলে, ভারতের আশা করার অধিকার আছে ত্রাণ এবং উৎসাহ আসবে যুক্তরাজ্য, এবং পশ্চিম এবং পূর্বের অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারতের জন্য তার বিপুল দায়ের যথোপযুক্ত পরিমাণ সাহায্য আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা তাদের ভার কিছুটা লাঘব করার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কারণ সমস্যা আসলে ভারত নয় বরং পাকিস্তান, এবং তাহলে নীতি বাতিল করার উদ্দেশ্য হবে যত দ্রুত সম্ভব পাকিস্তানকে বাধ্য করা পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে।

ইয়াহিয়া খানকে একমুহূর্তের জন্যও এটা বিশ্বাস করার সুযোগ দেয়া যাবে না যে এই সপ্তাহে গদাইলস্করি চালে চালু করা কূটনৈতিক শান্তি-প্রচেষ্টা, সফল হবার সামান্যতম আশা আছে। যখন মিঃ ভুট্টো টিক্কা খানের অপসারণ এবং একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে বাঙলার প্রশাসক নিয়োগ দেয়াকে “অভিযোগ দূর করার চেষ্টা” হিসেবে বর্ণনা করেন এবং যেদিন যুক্তরাজ্যের দুতবাস পাকিস্তানে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র বিতরণ স্থগিত করে ঐ একই দিনে যখন পাকিস্তানের সরকার ঘোষণা দেয় প্রচারমাধ্যমের নিরীক্ষণ শিথিল করার তাতে কারো উদ্বিগ্ন হওয়া হয়তো অসঙ্গত। কিন্তু এটাও স্বীকার করা উচিত যে এগুলো এবং পাকিস্তান সরকারের অন্যান্য চাল গুলো পরিকল্পিত হয়েছে পূর্ব বঙ্গে তাদের শাসনের দায়িত্বের নিদর্শন দেয়া এবং এভাবে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য পুনরায় আসা শুরু করার পথ করে দেয়া।

এটা অপরিহার্য যে এই চাল গুলো যাতে সফল না হয়। এই অক্টোবরে পাকিস্তানের জন্য সঙ্গবদ্ধ সাহায্য যাতে কিছুতেই পুনরারম্ভ না হয়। এই সিদ্ধান্তে, যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে মতপ্রকাশের এবং আমাদের বিশেষ উদ্দেশ্য থাকবে এই অস্থিরমতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করা, শুধুমাত্র সঙ্গবদ্ধ সাহায্য নয় বরং অন্যান্য অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য কার্যক্রমও। পাকিস্তানের অর্থনীতি বস্তুত চলমান অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের কারণে অরক্ষিত কিন্তু, অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে এব্যপারে একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত গুঁড়িয়ে দিতে পারবে তাদের আত্মপ্রসাদ এবং “পার পেয়ে যাবার” ব্যপারে আত্ম-নির্ধারণকে যা ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

সবশেষে, একটি কূটনৈতিক ভুমিকাও রয়েছে। এটা খুবই আশ্চর্যজনক হবে যদি প্রধান পরাশক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বীকৃত ভিত্তি না পায়, অন্তত পাকিস্তানের ভেঙে পড়ার আসন্ন পূর্বাভাষ এবং হয়তো পূর্ব বঙ্গ এলাকায় স্থায়িত্ব পরিমাপ করার প্রয়োজনীয়তার ব্যপারে ……