You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি, আন্দোলন এবং ৬ দফার পটভূমি

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে যে কটি আন্দোলন ও কর্মসূচি পাকিস্তান সৃষ্টির পর জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা, পাকিস্তানের মােহ থেকে মুক্ত হওয়া এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরিতে সবচাইতে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন- যা চূড়ান্তভাবে ৬ দফার মহাসনদে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। তবে স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি ভাষা আন্দোলনের সফল পরিণতিতে দ্রুত পূর্ব বাংলায় জনগণের কাছে সমাদৃত হয়। বলা চলে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে উত্তরণ ঘটা সহজ হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনই স্বায়ত্তশাসনের দাবির গ্রহণযােগ্যতাকে সফল হতে সাহায্য করেছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সরকারি উদ্যোগের প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী এবং ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার বাংলাভাষার বিরুদ্ধে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল তা ছিল পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিকভাবে অধীনস্থ করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তবে এর বিরুদ্ধে দ্রুতই আন্দোলন ও সংগ্রাম দানা বেঁধে ওঠে। মুসলিম লীগের ছাত্রসংগঠন ও সরকারের পুলিশবাহিনী দমন নিপীড়ন যত
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১৯
জোরদার করতে থাকে ততই পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হতে থাকে। তখনও পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনাে ছাত্র, যুব এবং বিরােধী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেকারণে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সরকার আন্দোলন দমন নিপীড়নে বেপরােয়া মনােভাব প্রদর্শন করতে থাকে। তারা পাকিস্তান সরকারের যেকোনাে সিদ্ধান্তের বিরােধিতাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার রক্ষার সংগঠন তথা বিরােধী রাজনৈতিক শক্তির অপরিহার্যতা প্রথম উপলব্ধি করেন। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলাম। প্রায় সকল কলেজ ও স্কুলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। বিভিন্ন জেলায়ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠতে লাগল। সরকারি ছাত্র প্রতিষ্ঠানটি শুধু খবরের কাগজের মধ্যে বেঁচে রইল। ছাত্রলীগই সরকারের অন্যায় কাজের সমালােচনা করেছিল। কোনাে বিরুদ্ধ দল পাকিস্তানে না থাকায় সরকার গণতন্ত্রের পথ ছেড়ে একনায়কত্বের দিকে চলছিল। প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান সর্বময় ক্ষমতার মালিক হলেন। তিনি কোনাে সমলােচনাই সহ্য করতে পারছিলেন না।১ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিল। তারা লিখলেন, ‘On 3.3.1948, where he listed a Bengali leaflet entitled ‘An Appeal to the Eastern Pakistan Students. The leaflet explained the necessity of the formation of EPMSL after the partition of Bengal eliminating MSL which existed in un-united Bengal. It was published under the name of Sheikh Mujibur Rahman.”২
পরদিন ৪ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা করে সংগঠনটি থেকে একটি প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়। ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে শেখ
————————————————
১ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১০৯ (১০)।
২ SDIB, vol-1, page 5 (10) ।
————————————————
২০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের দাবিতে মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় গ্রেপ্তার হন। তাঁর এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গােপালগঞ্জে ১৬ই মার্চ হরতাল ডাকা হয়। পাকিস্তানের গােয়েন্দা প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার অংশগ্রহণের বিবরণ তুলে ধরা হয়।৩ পাকিস্তান সরকার তখন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রদের ওপর নির্যাতন এবং সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়ােজনীয় অভাব পূরণের প্রতি মনােযােগ না দেওয়ার প্রতিবাদে ২৯ মার্চ (১৯৪৮) তারিখে ফরিদপুরে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিব সেখানে যে বক্তব্য প্রদান করেন তা গােয়েন্দা রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ‘Rahman in is course of short speech dwelt on the scarcity of cloths, food stuffs and other daily necessities of life in East Pakistan. He describes how the poor and middle class men were passing their lives in hardship in the scarcity of these articles. He deplored that students that sacrificed for the cause of Pakistan were now tortured by police and are called ‘fifth columnist by the authority when any reasonable demand is made by them against any Govt. policy is criticised in constitutional way.’
গােয়েন্দা রিপাের্টে ওই সভায় সােহরাওয়ার্দীর প্রদত্ত ভাষণের কথা উল্লেখ করে লেখা হয়, ‘H. S. Suhurawardy during his course of speech urged the audience to maintain Hindu Muslim unity and appealed to the Hindus not to migrate from East Bengal to India.’৪
ফরিদপুরে ওই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, তখন মুসলিম লীগ এবং সরকারের উসকানিতে সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করা হচ্ছিল। সেকারণে ‘শান্তি মিশন’ হিসেবে সােহরাওয়ার্দী শেখ
—————————————-
৩ SDIB, vol-1, page 10 (11)
৪ SDIB, vol-1, page 15 (11)
—————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ২১
মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুরে জনসভা করতে আসেন। শেখ মুজিবের এই বক্তব্য থেকেই ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং পাকিস্তান সরকারের দমন নিপীড়নের চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি প্রধান নেতা সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় জনসভা অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে দিনরাত পরিশ্রম শুরু করেন। শেখ মুজিব এই সময়ে সােহরাওয়ার্দী ছাড়াও মওলানা ভাসানীসহ অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায়। জনসভায় বক্তৃতা করেন। তাদের বক্তব্যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, দরিদ্র জনগােষ্ঠীর রুটিরুজি, নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করতে থাকেন।৫ পাকিস্তানের গােয়েন্দা পুলিশ সেকারণে তাঁর প্রতি বিশেষভাবে নজরদারি রাখতে শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের এক বছরপূর্তি উপলক্ষে একটি দীর্ঘ বিবৃতি প্রদান করেছিলেন। এটি ১৯৪৮ সালের ১৩ই আগস্ট দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবৃতির কিছু অংশ দেখা যেতে পারে। বিবৃতিতে শেখ মুজিব এক স্থানে লেখেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা যে ‘আজাদী লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণ আজাদী নয়, তা গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। জাতীয় মন্ত্রিসভা’ দীর্ঘ একটি বছরে জনগণের দুইশত বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মােচনের কোনাে চেষ্টা তাে করেনই নাই, বরঞ্চ সেই বােঝার ওপর অসংখ্য শাকের আঁটি চাপাইয়াছেন। ভুখা, বিবস্ত্র, জরাগ্রস্ত ও শত অভাবের ভারে ন্যুজ জনসাধারণের ভাত, কাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য কোনাে দ্রব্যের ব্যবস্থা তারা করেন নাই, বরঞ্চ পাট, তামাক, শুপারী ইত্যাদির ওপর নয়া ট্যাক্স বসাইয়া ও বিক্রয় কর বৃদ্ধি করিয়া জনগণের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিসহ করিয়া তুলিয়াছেন।… রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে মুসলিম ছাত্র সমাজের ওপর এবং আরও কতিপয় ক্ষেত্রে জনতার ওপর লাঠি চার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি চালনা করিয়া তারা আজাদীকে কলঙ্কিত করেছে।… ১৫ই আগস্টকে ‘সংকল্প-দিবস’ হিসাবে সফল করিয়া তুলিবেন।৬
—————————————–
৫ SDIB, vol-1, page 20 (Mymensingh), 24 (Narsingdi), 34 (Gopalganj)-(12)
৬ দেখুন, দৈনিক ইত্তেহাদ, ১৩ই আগস্ট, ১৯৪৮, সুত্র: SDIB, vol-1, page 44 (12)
—————————————–
২২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
শেখ মুজিবের এই বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে যে, তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের দুঃখ, দুর্দশা, বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখ শেখ মুজিব দৌলতপুর এবং বাগেরহাট পিসি কলেজে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি সরকারের খাদ্যনীতি, প্রাথমিক শিক্ষা স্থগিতকরণ এবং প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর প্রতিনিয়ত বিমানভ্রমণের মাধ্যমে জনগণের অর্থ অপচয় সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে সমলােচনা করেন।৭ ১১ই ডিসেম্বর তারিখে দৌলতপুর কলেজে ছাত্রলীগের আয়ােজিত সভায় যােগদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশের খাদ্যসঙ্কট, শিক্ষার সঙ্কট, পুলিশি নির্যাতন, জননিরাপত্তার নামে হয়রানি করার প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্রসমাজকে প্রতিবাদ করার জন্য আহ্বান জানান।৮ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী প্রদেশের সর্বত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও ধরপাকড় কী পরিমাণ বৃদ্ধি করেছিল সেই সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন, এই সময় রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্রদের ওপর খুব অত্যাচার হল। এরা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের সভ্য ছিল। একুশজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বের করে দিল এবং রাজশাহী জেলা ত্যাগ করার জন্য সরকার হুকুম দিল। অনেক জেলায় ছাত্রদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়েছিল এবং গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরেও ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেলের ভিতর দবিরুল ইসলামকে ভীষণভাবে মারপিট করেছিল-যার ফলে জীবনের তরে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছিল। ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ পালন করার জন্য একটি কমিটি করেছিল।৯
১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে ডাকা ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়ােজিত ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের এক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ
———————————————-
৭ পুর্বোক্ত
৮ দৈনিক ইত্তেহাদ, ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৪৮, পৃ.১৩
৯ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ.১০৯-১১০ (১৩)
———————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ২৩
সৃষ্টি করতে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের জেলে বন্দি রাখা হয়েছে, তাদের মুক্ত করা, জাতীয় মেডিকেল স্কুল অধিগ্রহণ, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত থাকার ব্যবস্থা সৃষ্টি ইত্যাদি দাবি আদায় করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।১০ ছাত্রসমাজ ৮ জানুয়ারি জুলুম ও প্রতিবাদ দিবস পালনকালে প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রকে ধরপাকড় করা হয়। এই উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন ধর্মঘটকারী শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের দুশমন, কমিউনিস্ট, পঞ্চম বাহিনী ইত্যাদি নামে অভিহিত করে তাদের দমন করার কথা ব্যক্ত করেন। নুরুল আমীনের এ বিবৃতির বিরুদ্ধে কড়া সমালােচনামুলক জবাব দেন জুলুম প্রতিরােধ সাবকমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমান। বিবৃতিতে তিনি নুরুল আমীনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এবার জনসাধারণের পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন আমাদের পিছনে রহিয়াছে, এ সম্বন্ধে আমরা সুনিশ্চিত।১১
শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়ে ছাত্রদের সংগঠিত করার পাশাপাশি চাষিদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ২৮শে জানুয়ারি ১৯৪৯ তারিখে খুলনা মিউনিসিপ্যালিটি পার্কের সম্মুখে কুমিল্লা, ঢাকা ও ফরিদপুরের ধান চাষিদের এক সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা প্রদান করেন। শেখ মুজিব ধান চাষিদের ন্যায্যমূল্য এবং মজুরি আদায় করতে তাঁকে অনুসরণ করতে আহ্বান জানান।১২ ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ফরিদপুর, গােপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে জনসভা করেন। তাঁর জনসভায় মুলত শিক্ষার অধিকার ও বিস্তারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার দাবি করেন এবং সরকারের খাদ্য সরবরাহের ব্যর্থতার কঠোর সমলােচনা করেন। তিনি জনগণকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান।১৩ মার্চ মাসেও তিনি নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমাবেশে সরকারের আরবি বর্ণমালা চালু করার নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনা করে বক্তৃতা করেন। এ ছাড়া ৪ মার্চ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান ১৫০ মােগলটুলিতে
————————————-
১০ দেখুন, SDIB, vol-1, page.62 (13)
১১ দেখুন, দৈনিক জিন্দেগী, ১০.১.১৯৪৯, সুত্র: SDIB vol-1, page.75 (14)
১২ দেখুন, SDIB, vol-1, page.88 (14)
১৩ দেখুন, SDIB, vol-1, page.94 (14)
————————————-
২৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
সাবেক ছাত্রনেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।১৪ ১৭ মার্চ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিকেটিং করেছিলেন।১৫ ১৯ মার্চ ভিসির বাসভবনের সম্মুখ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ইউ/এস ৫৪ সি আর পিসি ধারাতে গ্রেপ্তার করা হয়।১৬ শেখ মুজিবকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি করে রাখা হয়। অন্যরা জামিনে মুক্তি পেলেও তাঁকে জামিন দেওয়া হয়নি। ১৮ জুন তারিখে ডিআইজি শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের সুপারিশ করলেও তা কার্যকর করতে নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হয়। তার মুক্তির দাবিতে ছাত্র-জনতার বিভিন্ন সংগঠন মিছিল-সমাবেশ করতে থাকে। অবশেষে ২৬ জুন আদেশ কার্যকর হয়। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, পিতা শেখ লুত্যর রহমানসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী শেখ মুজিব ও বাহাউদ্দিনকে বরণ করতে জেলগেটে আসেন। শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের এবং ছাত্রদের আন্দোলন দুর্বল করার ফন্দি-ফিকির প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। তবে এর প্রতিক্রিয়া প্রশাসনের ওপর নেতিবাচকভাবে পড়েছিল। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা শুধ ছাত্রছাত্রীদের কাছেই নয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও হাস পেতে থাকে । এর প্রভাব পড়েছিল ২৬শে এপ্রিল ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী ছিলেন খুররম খান পন্নী। মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবের সমর্থকদের প্রার্থী ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। নির্বাচনে শামসুল হক। বিপুল ভােটে বিজয়ী হলে তাকে টাঙ্গাইল এবং ঢাকায় ব্যাপকভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শেখ মুজিব জেলে থেকে লিখেছেন, “আমরা জেলে বসে বিজয়ের আনন্দ উপভােগ করলাম। শামসুল হক সাহেব ফিরে আসার পরেই পুরানা লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকল ঢাকায়-ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন সেই সভা আহ্বান করা হয়েছিল।১৭
——————————————-
১৪ দেখুন, SDIB, vol-1, page.116 (14)
১৫ দেখুন, SDIB, vol-1, page.122 (14)
১৬ দেখুন, SDIB, vol-1, page.126 (14)
১৭ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.১১৯ (১৫)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ২৫
এই সময় শেখ মুজিব নবগঠিত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মওলানা ভাসানী সভাপতি এবং শামসুল হক এমএলএ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বস্তুত গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য মুসলিম লীগবিরােধী একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে। যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলায় সর্বপ্রথম সরকারবিরােধী একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে তােলার মাধ্যমে রাজনীতিতে যে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারবিরােধী ধারার সুচনা করেছিলেন তারই পথ ধরে ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পুরান ঢাকার রােজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ইত্তেহাদ পত্রিকা ২৪ জুন এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত সংবাদ প্রকাশ করে :
“গতকল্য রােজ গার্ডেনে মিঃ আতাউর রহমান এডভােকেটের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘পূর্ব পাকিস্তান জনগণের মুসলিম লীগ’ নামক একটি প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগ গঠিত হইয়াছে। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে চেয়ারম্যান এবং মিঃ শামসুর রহমান (হক-লেখক) এম এল-কে সেক্রেটারী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে (নিরাপত্তা বন্দি) জয়েন্ট সেক্রেটারী করিয়া একটি সংগঠন কমিটি গঠিত হইয়াছে।”১৮
এ ছাড়া দলের সহসভাপতি পদ লাভ করেন আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আলী আহমেদ খান, আমজাদ আলী খান প্রমুখ। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এই দলের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। নবগঠিত এই দলে পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলা ও মহকুমার বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী যুক্ত হন। এই দলটি পাকিস্তানে প্রথম মুসলিম লীগ সরকারের প্রধান বিরােধী রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। দলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল জানেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনমত সৃষ্টি
————————————
১৮ ইত্তেহাদ, ২৪শে জুন, ১৯৪৯, উদ্ধৃত- SDIB, vol-1, page 201 (16)
————————————
২৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে—চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মিলিটারিতে বাঙালিদের স্থান দেওয়া হচ্ছে না-এ সম্বন্ধে আওয়ামী লীগ সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে কতগুলি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছে সমস্ত দেশে। সমস্ত পূর্ব বাংলায় গানের মারফতে গ্রাম্য কবিরা প্রচারে নেমেছেন।১৯
বস্তুত, ২৬শে জুন তারিখে নবগঠিত দলের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে মুক্তি লাভের পরপরই শেখ মুজিব দলের দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে।… একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হলাে। আমরা কাজ শুরু করলাম।২০
শেখ মুজিবুর রহমান দলকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কখনও কোথাও কোথাও মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, কোথাও কোথাও অন্য নেতৃবৃন্দসহ জেলা, মহকুমা এবং ঢাকা শহরে সাংগঠনিক সভা ও জনসভায় অংশগ্রহণ করেন। ঢাকার বাইরে প্রথম আওয়ামী মুসলিম লীগের জনসভা ১৮ জুলাই গােপালগঞ্জে আয়ােজন করা হয়। জনাব আবদুস সালামসহ শেখ মুজিব উক্ত সভায় উপস্থিত হন। সভায় বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন লক্ষ করে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। এতে জনতা উত্তেজিত হয়ে লাঠিসােটা নিয়ে পুলিশের ওপর তেড়ে আসে। পুলিশ অবস্থা বুঝতে পেরে আবদুস সালাম এবং শেখ মুজিবকে বক্তৃতা দানের অনুমতি প্রদান করে। উপস্থিত জনতা শেখ মুজিবের বক্তৃতার পর শান্ত হয়। এরপর ১৯শে জুলাই তারিখে শেখ মুজিব খুলনায় জনসভা করেন। এরপর ১০ আগস্ট মওলানা ভাসানী, শামসুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমান জামালপুর ঈদগাহ ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। ১৮ আগস্ট ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে তিন নেতা জনসভায় সরকারের খাদ্যনীতি, শিক্ষানীতি, বিরােধী দলকে দমন, নিপীড়ন, জেলে বন্দি করে রাখা নিয়ে কঠোর সমালােচনা করেন। এরপর উক্ত তিন নেতা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় ২৬শে আগস্ট বক্তৃতা করেন। এতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ যােগদান করেন। ২৭শে আগস্ট
——————————————-
১৯ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবন, পৃ.২৫৮ (১৬) ২০ পূর্বোক্ত, পৃ.১২১ (১৬)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ২৭
স্থানীয় জেএম সেন হল এবং রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে দুটি পৃথক দলীয় কর্মিসভায় তারা দলকে সুসংগঠিত করার ওপর গুরুত্বারােপ করে বক্তৃতা করেন। ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে (১৯৪৯) মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান খাদ্য, শিক্ষা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ-এই তিন বিষয়ে পূর্ব বাংলায় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তিনি ছাত্রছাত্রীদের গ্রামাঞ্চলে অশিক্ষা দূরীকরণের দাবি জানান। অক্টোবরের ১০ তারিখে পূর্ব বাংলার খাদ্য সংকটের ভয়াবহ পরস্থিতিতে ১১ অক্টোবর আরমানিটোলা মাঠে আয়ােজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা করেন এবং জনসভা শেষে খাদ্যের দাবিতে ভুখা-নাঙাদের মিছিলে নেতৃত্ব প্রদান করেন। মিছিলটি পুরান ঢাকার অলিগলি প্রদক্ষিণ করে। তাতে বিপুল সংখ্যক লােক অংশগ্রহণ করেন। এই সময়ে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে তাদের রাজনীতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে থাকে। তার ওপর গােয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে থাকে, তাকে গ্রেফতার করার জন্য কয়েকবার মােগলটুলী দলীয় অফিসে খোঁজাখুঁজি করা হয়। ১৯৪৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তারিখে কাজী দেওয়ান ঠিকানা থেকে তাকে সি/ডব্লিউ কোতােয়ালি পি.এস. কেস নং-১৯ (১০)৪৯ ইউ/এস ১৪৭ আইপিসি আর/ডব্লিউ ৭ (৩) বিএসপিও এবং ইউ/এস ১৮ (২) বিএসপিও ধারায় গ্রেফতার করা হয়।২১ পরদিন ১ জানুয়ারি ১৯৫০ তারিখে দৈনিক যুগান্তর এবং দৈনিক আজাদ আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব বাংলার জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলে সংবাদ প্রকাশ করে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই কারাবন্দিত্ব ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বহাল ছিল। ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে তিনি এবং আরও কয়েকজন বন্দি নেতা অনশন অব্যাহত রাখায় তাদের জীবন শঙ্কা সৃষ্টি হয়। তার ফলে ফরিদপুর কারাগার থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য কিছুদিন নিজ বাড়িতে বিশ্রামে ছিলেন। এরপর তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার চিঠি পেয়ে ২১ এপ্রিল তারিখ
———————————-
২১ দেখুন, SDIB, vol-1, page 325 (18)
———————————-
২৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
ঢাকায় পৌঁছান। ঢাকায় এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শেষে আবার দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী নিরাপত্তা আইনে জেলে থাকায় সিনিয়র সহসভাপতি আতাউর রহমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এমএলএও তখন জেলে।
শেখ মুজিব লেখেন, ‘ঢাকায় তখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। ভয়ে। মানুষ কোনাে কথা বলে না। কথা বললেই গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে একই অবস্থা।… দুই তিনটা জেলা ছাড়া জেলা কমিটিও গঠন করা হয় নাই। প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযােগ এসেছে। সাহস করে কাজ করে যেতে পারলে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কারণ, জনগণ এখন মুসলিম লীগবিরােধী হয়ে গেছে। আর আওয়ামী লীগ একমাত্র বিরােধী দল।২২
২৬শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক জেলে থাকায় শেখ মুজিবকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদকের। দায়িত্ব গ্রহণের পর লিখলেন, “আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যারা ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তি দাবি করলাম।২৩
২৭শে এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি আয়ােজিত এক সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। এতে বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। গােয়েন্দা প্রতিবেদনে লেখা হয় , ‘He challenged the Govt. to hold a referendum in Bengal on the language issue. He said that the demand of Bengali as the state language is the just demand of 4.5 crores of people, which can not in anyway be suppressed by sheer brutal force. He appealed to the audience to go to the villagers and make propaganda to the effect that the present Muslim League is not that
——————————————
২২ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.২১১-২১২ (১৮)
২৩ পূর্বোক্ত…পৃ.২১২ (১৮)
——————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ২৯
Muslim League. So all should unite together and stand against the Govt. Then, the Govt. will have no other alternative but to accede the demands.২৪
আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১শে মে তারিখ দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান দলের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির একটি স্মারকলিপি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রদানের জন্য করাচি যান। ‘স্মারকলিপিতে পাকিস্তান সরকারের নিকট ন্যায়সংগত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতৃবৃন্দ এবং অপরাপর রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি দাবি করা হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে।২৫
এই স্মারকলিপিটি শেখ মুজিবুর রহমান ৩০শে মে তারিখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের হাতে উপস্থাপন করেন এবং তার সঙ্গে প্রায় পূর্বনির্ধারিত ২০ মিনিটের স্থলে ১ ঘণ্টা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বন্দি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির বিষয়ে কথা বলেন।*
পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকদিন অবস্থান করে কয়েকটি স্থানে জনসভায় বক্তৃতা করেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রদত্ত স্মারকলিপির দুটো দাবিই পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার বড়াে ধরনের উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা যায়। প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে আলােচনার ২ দিন পর করাচিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠকের বিস্তারিত আলােচনা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর দাবির অনেকগুলােই স্বীকার করে নেন। জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, ‘প্রায় ত্রিশটা উপনির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যেকোনাে একটায় ইলেকশন হােক, আমরা মুসলিম লীগ প্রার্থীকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হব।২৬
———————————-
২৪ দেখুন, SDIB, vol-2, page 167 (19)
২৫ দৈনিক আজাদ, ১৫ই মে, ১৯৫২ (১৯)
*বিস্তারিত দেখুন, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.২১৩
২৬ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.২১৪ (২০)।
———————————-
৩০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
২ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঠিক চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক, শিক্ষিত সমাজ এবং জনগণ পূর্ব পাকিস্তান এবং এর জনগণ সম্পর্কে মােটামুটি অনেক কিছুই জানেন না -এটি শেখ মুজিবের কাছে স্পষ্ট হওয়ায় তিনি অনেক বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বন্ধেও প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি তাদের পাকিস্তানের ভৌগােলিক অবস্থা চিন্তা করতে অনুরােধ করেছিলাম।২৭
বস্তুত শেখ মুজিবের করাচি সফরের মাধ্যমে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারই শুধু নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সকল মহলকেই তিনি স্বায়ত্তশাসনসহ গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়ে বেশ সাড়া ফেলে দেওয়ার মতাে বক্তব্য প্রদান এবং ভূমিকা রেখেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকালে তিনি শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে আলােচনা করেন। তাকে কেন্দ্র করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসরণ করার মাধ্যমে শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত করার বিষয়ে শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁর সম্মতি লিখিতভাবে গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে বাংলা ও উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভে তিনিও সম্মত আছেন সে ব্যাপারেও তাঁর সম্মতি লিখিতভাবে গ্রহণ করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে, শহীদ সােহরাওয়ার্দী কিছুদিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে এসে সাংগঠনিক সফরে অংশগ্রহণ করবেন। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান লাহােরে আরেকটি দীর্ঘ ও সফল সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকদের বাংলাভাষা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাঙালি জাতিসত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে তাদের অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটান। পশ্চিম পাকিস্তানের সকল গণমাধ্যমে উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনের ব্যাপক প্রচার হয়। (অ, আ, পৃ.২১৬)। এরপর শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে আরও কয়েকটি সফর করে ২৪ জুন বিমানযােগে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায়
—————————-
২৭ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.২১৪ (২০)
—————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৩১
ফিরে এসেই শেখ মুজিব সিনিয়র এবং গুরত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জুলাই মাসের শুরুতেই দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করেন। সভায় পূর্ব পাকিস্তানে পাটের ন্যায্য মূল্য চাষিরা না পাওয়ায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়।২৮ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে সােহরাওয়ার্দীর বিষয়ে শেখ মুজিব লেখেন, ‘সােহরাওয়ার্দী সাহেবের মতামত সকলকে জানালাম। সকলেই এফিলিয়েশন নিতে রাজি হলেন। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নেওয়া হলাে।
ওয়ার্কিং কমিটির ওই সভায় মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের আশু কারামুক্তি দাবি করা হয় এবং পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি পরিহার করার দাবি জানানাে হয়।২৯ ওয়ার্কিং কমিটির সভার পর শেখ মুজিব সভাপতি মওলানা ভাসানীর চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন এবং তাঁকে কেবিনে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় তিনি সিনিয়র সহ-সভাপতি আতাউর রহমান এবং আবদুস সালাম খানকে নিয়ে বিভিন্ন জেলায়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটি করার জন্য সাংগঠনিক সফরে বের হন। পাবনা, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, নােয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামে জেলা কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংগঠনের জাল ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে থাকলেন। সংগঠনটি গুছিয়ে আনার কাজটি তাঁকে করতে হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। সে সময় তিনি সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই সময়ে ২ অক্টোবর থেকে পিকিংয়ে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার খবরের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল তাতে অংশ নেওয়ার নিমন্ত্রণ লাভ করে। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, ইবনে হাসান ও শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ সেপ্টেম্বর পিকিংয়ের উদ্দেশে বিমানযােগে ঢাকা ত্যাগ করেন। পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিব আবার সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে আত্মনিয়ােগ করেন। তবে এই সময়ে তাঁর ভাষায়
—————————————–
২৮ বিস্তারিত দেখুন, SDIB, vol-2, pag 242-243 (21)
২৯ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.২১৮ (২১)
—————————————–
৩২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ।
‘বন্দি মুক্তি আন্দোলন জোরদার করা কর্তব্য৩০ মনে করে তিনি পল্টন ময়দানে দলীয় জনসভার আয়ােজন করেন। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিপুল জনসমাবেশ ঘটেছিল। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতাকালে সরকারের জুলুমনীতির কঠোর সমালােচনা করেন। এই জনসভার প্রভাব বুঝতে পেরে শেখ মুজিব শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ঢাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে করাচি থেকে ঢাকায় আসার অনুরােধ করে চিঠি লেখেন। ১৫ নভেম্বর ১৯৫২ সালে শহীদ সােহরাওয়ার্দী করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকা আসার পর শেখ মুজিব তাঁকে নিয়ে সাংগঠনিক সফরে বিভিন্ন জেলায় যান। জেলাগুলাে হলােঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে দিনাজপুর, বগুড়া থেকে বরিশাল পর্যন্ত প্রায় সব জেলায়ই শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান জনসভা করেন। শেখ মুজিব লেখেন, ‘শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যােগদান করতে শুরু করেছিল।৩১
জনসভাগুলােতে শহীদ সােহরাওয়ার্দী নিরাপত্তা আইনে বন্দি নেতৃবৃন্দকে দ্রুত মুক্তি দান, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা, দ্রুত সাধারণ নির্বাচন দান এবং স্বায়ত্তশাসনকে সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা করেন।৩২ শহীদ সােহরাওয়ার্দী চলে যাওয়ার পর শেখ মুজিব বিভিন্ন জেলা ও মহকুমার নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার জন্য দলকে শক্তিশালী করে তুললেন। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি পূর্ব বাংলার জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে ছিল। তার এই সাংগঠনিক সফরের পর আওয়ামী লীগের জনসমর্থন বৃদ্ধিতে বড়াে ধরনের প্রভাব পড়েছিল। সেটিকে শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে কাজে লাগান। মুসলিম লীগ সরকার চেষ্টা করেছিল বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত সভাগুলােতে বাধা দেওয়ার কিন্তু জনােস্রোতের বিপক্ষে সরকার বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। এই অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন জেলা, মহকুমা এবং থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠনকে গড়ে তােলার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত বুঝতে পেরে সরকার ১৯৫৩ সালের শুরু থেকে
———————————-
৩০ পুর্বোক্ত, পৃ. ২৩৪ (২২)
৩১ পুর্বোক্ত, পৃ. ২৩৫ (২২)
৩২ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৫, SDIB, vol-2, pag-413-438,444,447 (22)
———————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৩৩
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে শুরু করে। শেখ মুজিব দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সেভাবেই বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা কমিটিগুলােকে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি গঠন করার কাজ সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক জেল থেকে মুক্তি পেলেও দীর্ঘদিন জেলে থাকার কারণে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ফলে শেখ মুজিবুর রহমানকেই দলের সম্মেলন অনুষ্ঠানে কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল, শােভাযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। হরতালে সকল যানবাহন ও দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। সকাল থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, নারী পুরুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী আজিমপুর কবরস্থানে নগ্নপদে শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানান। হাজার হাজার মানুষ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগ্নপদে শােভাযাত্রা করেন। তাদের মুখে ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এবং ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ স্লোগান। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শােভাযাত্রাগুলাে সমবেত হয়। সেখানে বেলা ৩টায় আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আলােচনা সভা শুরু হলে তাতে বিভিন্ন দল ও সংস্থার নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ দলে দলে যােগদান করেন। ফলে সভাটি বিশাল জনসভায় পরিণত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দীর্ঘ বক্তৃতা করেন।৩৩ বক্তৃতায় ২১শে ফেব্রুয়ারিকে তিনি কারবালা দিবস’ বলে অভিহিত করেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খােলা রহিয়াছে-হয় বাংলাকে তারা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন।৩৪
অপর বক্তা গণতন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদ আলী। বলেন, রাষ্ট্রভাষা দাবিকে ভিত্তি করিয়া প্রদেশব্যাপী যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন নয়, সামগ্রিকভাবে ইহা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলন।’৩৫
—————————————
৩৩ দৈনিক আজাদ, ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ (২৩)
৩৪ ঐ (২৩)
৩৫ ঐ (২৪)
—————————————
৩৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
নারী নেত্রী হালিমা খাতুন (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) বক্তৃতায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানবাসীর এই আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনই নয়, ইহা তাঁহাদের জীবনধারণেরও লড়াই।’৩৬
সভাপতির ভাষণে আতাউর রহমান খান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সরকারের হীননীতিকে কোনােমতেই মানিয়া লইবে না বলিয়া দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং ভাষা আন্দোলনই তার অভিব্যক্তি। ৩৭
স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে যে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং রাজনৈতিক দাবি আদায়ে রাজপথে নামার মনােভাব বৃদ্ধি পায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশনে সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মওলানা ভাসানীসহ রাজনৈতিক বন্দি নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তির অনুরােধ জানান।৩৮ আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনশন শুরু করলে ২৪শে মার্চ তারিখে তাঁর সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমান সাক্ষাৎ করেন।৩৯ শেখ মুজিব অবিলম্বে মওলানা ভাসানীর মুক্তি দাবি করেন। ১৯৫৩ সালের ৬ এপ্রিল রংপুরের রানীপুকুরে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় শেখ মুজিব এবং অন্যান্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের জেলে বন্দি রাখার সমালােচনা করেন। এ ছাড়া তিনি সরকারের এজি হাসপাতাল বিলুপ্তি করা, পাটনীতি, শিক্ষানীতি, অতিরিক্ত কর নির্ধারণ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ না করা এবং সার্বিকভাবে সরকারের বাণিজ্য সংকোচন নীতির কঠোর সমালােচনা করেন।৪০ ৭ এপ্রিল তিনি হারাগাছ এবং ৮ এপ্রিল নেতৃবৃন্দসহ জনসভায় ভাষণ দেন। ১৪ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি
—————————————
৩৬ ঐ (২৪)।
৩৭ ঐ (২৪)
৩৮ বিস্তারিত দেখুন, দৈনিক আজাদ, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ (২৪)
৩৯ দেখুন, SDIB, vol-3, page 137(24)
৪০ দেখুন, পুর্বোক্ত-১৫৫ (২৪)
—————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৩৫
রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য এক বিবৃতি প্রদান করেন যা দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর মওলানা ভাসানী জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সম্মুখে ৬ই মে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণ দেন। মূলত কারামুক্ত ভাসানীকে নিয়ে তখন শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন-পূর্ববর্তী সাংগঠনিক সফর অব্যাহত রাখেন। ১৯৫৩ সালের ৩, ৪ ও ৫ই জুলাই ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের ৩ দিনব্যাপী জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। বিভিন্ন জেলা থেকে ৭০০ জন প্রতিনিধি ও ডেলিগেট এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের সাংগঠনিক দীর্ঘ প্রতিবেদন পাঠ করেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।৪১ দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি অসাম্প্রদায়িক। রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তােলার বিষয়ে দীর্ঘ আলােচনা হয়। এ বিষয়ে অধিবেশনে সকল প্রতিনিধি একমতে না পৌঁছাতে পারায় দলের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে দুই মাসের মধ্যে করণীয় নির্ধারণ করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করার গুরুত্বারােপ করে বক্তৃতা প্রদান করেন। তবে তারা কেউই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে সকলের রাজনৈতিক সচেতনতার ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন। ৫ই জুলাই মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, আতাউর রহমান খানকে সহ-সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক এবং ইয়ার মােহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে দলের সভাপতি কার্যকরী পরিষদের ২৬ জন সদস্যকে পরে মনােনীত করবেন। ৫ই জুলাই বিকাল ৫টায় পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভার মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়। সম্মেলনে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া, সরকারি নিপীড়ন,
——————————————
৪১ দৈনিক আজাদ, ৫ই জুলাই ১৯৫৩, দেখুন, বাংলাদেশ, শেখ মুজিবুর রহমান, সম্পাদনা-আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং অন্যান্য, প্রকাশনা-বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ-২০১৭, পৃ. ১১৯-১২২ (২৫)
——————————————
৩৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
অধিকার আদায়সহ পূর্ব বাংলার জনগণের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে সংগঠনকে সর্বস্তরে সুসংগঠিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সম্মেলনের পরের পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখেছেন, মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়ােগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী গড়তে সক্ষম। হলাম।৪২
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির পর আওয়ামী লীগ শাসনতন্ত্র রচনার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং ফেডারেল শাসনতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রচার শুরু করে জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়।৪৩ ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে দলের ২য় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় একক বৃহত্তম বিরােধী রাজনৈতিক দল হিসেবে সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়ে দাড়াতে থাকে। সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্যই ছিল। পরবর্তী প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরিষদ সরকারকে হারানাে। এই লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান। প্রদেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর শুরু করেন।
১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি থেকেই সকলে জানতে পারেন প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন খুব নিকটবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। এটি জানাজানি হবার পর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক মেরুকরণ অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ঘটতে থাকে। আওয়ামী লীগের একটি বড়াে অংশ নেতাকর্মী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠনের জন্য চাপ দিতে থাকে। এই ঐক্যজোটের হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীকে সম্মুখে রেখে সব ধরনের ছােটো ছােটো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যে হিসাব নিকাশ করেছিল তাতে আদর্শের চাইতেও ব্যক্তিগত লাভক্ষতি বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান মনে করতেন যে প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বিজয়ী না হলেও গণপরিষদে বিরােধী দলের মর্যাদাজনক আসন পাবে। শহীদ সােহরাওয়ার্দীরও ধারণা অনুরূপ ছিল। মওলানা ভাসানী প্রথমদিকে
———————————————
৪২ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২৪৩ (২৬)।
৪৩ পুর্বোক্ত-ঐ (২৬)।
———————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৩৭
ঐক্যের বিরােধিতা করলেও, ডিসেম্বর মাসে আকস্মিকভাবে ‘হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী দস্তখত করে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেছেন।”৪৪ (পরিশিষ্ট-১)।
যুক্তফ্রন্টে নেজামে ইসলাম পার্টি, গণতান্ত্রিক দলসহ অনেক বাম ও ডান সাবেক মুসলিম লীগার যুক্ত হন। তবে যুক্তফ্রন্ট আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলাে দাবি মেনে নেয়।৪৫ যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মনােনয়ন নিয়ে ভেতরে নানা ধরনের জোড়াতালি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বাদ পড়ে যান। শেখ মুজিবুর রহমান মনে প্রাণে জোড়াতালি দেওয়া এই যুক্তফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন অসন্তোষ, তেমন সন্দিহানও ছিলেন। সােহরাওয়ার্দীকে চেয়ারম্যান করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বেশ জোরদার হয়, যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গণজোয়ারও তৈরি হয়।
এখানে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল তার পরিষ্কার ধারণা প্রদান করেন। তিনি তাই লিখেছেন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে, ‘একুশ দফা দাবি জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য পেশ করা হয়েছে। তা জনগণ বুঝতে পেরেছে।৪৬
তবে ২১ দফার দাবিনামায় স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে ফ্রন্টভুক্ত দলগুলাে মেনে নেয়। ২১ দফার ১৯তম দফা হচ্ছে ‘লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণকরতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।৪৭
————————————————
৪৪ পুর্বোক্ত, পৃ. ২৫১ (২৭)
৪৫ পূর্বোক্ত, ঐ (২৭)।
৪৬ পুর্বোক্ত, পৃ. ২৫৮ (২৭)
৪৭ যুক্তফ্রন্টের ২১দফা, সুত্র : যুক্তফ্রন্ট প্রচার দপ্তর, জানুয়ারি ১৯৫৪, বাংলাদেশের স্বধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র
খণ্ড-এক, পূ, ৩৭৩-৩৭৪, ১৯৮২ * টীকা : এ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পৃ. ২৫৯-২৬১-তে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। (২৭)
————————————————
৩৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
এই দফাতে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরে। অন্য কোনাে রাজনৈতিক দল পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামােতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ন্যায্যতা এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেনি, যা আওয়ামী লীগ করেছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২১ দফার পক্ষে বিপুল রায় পড়ে, মুসলিম লীগ চরম ভরাডুবি বরণ করতে বাধ্য হয়। মােট ২৩৭টি মুসলিম আসনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে, মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে এবং বাকি আসনে অন্যান্য দল বিজয় লাভ করে। এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক উত্থান স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেটিকে নস্যাৎ করতে পাকিস্তান সরকার নানাভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে এ কে ফজলুল হক নিজের দলের স্বার্থরক্ষায় পা দিয়েছিলেন। এর ফলে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ফজলুল হকের অনীহা ও দোদুল্যমানতা জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পাকিস্তান সরকার এই সুযােগটি কাজে লাগায়। ৫৬ দিনের মাথায় ফজলুল হকের সরকারকে ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারায় বরখাস্ত করে হক সাহেবকে গৃহবন্দি করা হয়। শেখ মুজিবকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের এমন স্বৈরাচারী আচরণ সম্পর্কে যুক্তফ্রন্টভুক্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতিবাদ না করা সম্পর্কে লেখেন, পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন জারি করার দিন প্রধানমন্ত্রী জনাব মােহাম্মদ আলী যে বক্তৃতা রেডিও মারফত করেন তাতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবকে রাষ্ট্রদ্রোহী এবং আমাকে দাঙ্গাকারী বলে আক্রমণ করেন। আমাদের নেতারা যারা বাইরে রইলেন, তারা এর প্রতিবাদ করারও দরকার মনে করলেন না। দেশবাসী ৬ই জুনের দিকে চেয়ে ছিল, যদি নেতারা সাহস করে প্রােগ্রাম দিত তবে দেশবাসী তা পালন করত। যেসব কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিল তারা। ছাড়াও যারা বাইরে ছিল তারাও প্রস্তুত ছিল। আওয়ামী লীগের সংগ্রামী ও ত্যাগী কর্মীরা নিজেরাই প্রতিবাদে যােগ দিতে পারত। যুক্তফ্রন্টের তথাকথিত সুবিধাবাদী নেতাদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে তাও তারা করতে পারল না।৪৮
————————————-
৪৮ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ-২৭৩ (২৮)
————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৩৯
বস্তুত যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগে শেখ মুজিবুর রহমান ফ্রন্ট গঠনের পক্ষের নেতাদের যে কথাটি বারবার বলার চেষ্টা করেছিলেন তা হলাে, ‘নেতায় নেতায় নয়, আদর্শের ঐক্য হতে হয়, আদর্শহীন ঐক্য টিকে থাকে না, এর সুফলও পাওয়া যায় না।’
শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের সে কথাই প্রমাণিত হলাে। সরকার শেখ মুজিবকে জেলে বন্দি রেখে পরিস্থিতির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। শেখ মুজিব জেলের বাইরে থাকলে পূর্ব বাংলার সরকার বরখাস্তের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে দেরি করতেন না। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই সময়েই বড়াে ধরনের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতাে। নেতৃত্বের অভাবের কারণে সে আন্দোলনটি গড়ে তােলা যায়নি। অধিকন্তু পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজু করে জেলে আটকে রাখেন। অবশেষে সরকার ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে মুক্তি দেয়। এ সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমে লেখা হয়, ১৮ই ডিসেম্বর, ১৯৫৪-যুক্তফ্রন্ট পার্টির প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান আজ মুক্তিলাভ করিয়াছেন। গত ৩০শে মে (১৯৫৪) জনাব রহমানকে গ্রেপ্তার করিয়া পূর্ববংগ নিরাপত্তা অর্ডন্যান্স বলে আটকে রাখা হইয়াছিল।৪৯
পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিনা বিচারে জেলে বন্দি রাখে। ১৮ই ডিসেম্বর তারিখে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে অসুস্থ পিতাকে দেখতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাতেই গােপালগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। অসুস্থ পিতাকে দেখে তিনি ২২ তারিখ ঢাকা পৌঁছেই ওইদিন অপরাহ্নে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের লক্ষ্যে করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।৫০ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলােচনার পর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে ১৯৫৫ সালের ১লা জানুয়ারি তারিখে এ কে ফজলুল হকের ভূমিকা সম্পর্কে এক বিবৃতি প্রদান করেন। তাতে তিনি যুক্তফ্রন্টের নীতিমালা ভঙ্গ করার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করেন।৫১ অবশ্য কৃষক শ্রমিক পার্টির একটি পাল্টা বিবৃতি ৮ই জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর ফলে যুক্তফ্রন্টের
———————————————-
৪৯ সপ্তাহিক সৈনিক, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৫৪ (২৯)
৫০ দেখুন, যুগান্তর, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৫৫, SDIB, vol-4, page. 202 (29)
৫১ বিস্তারিত দেখুন, SDIB, vol-4, page. 207 (29)
———————————————-
৪০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
ভাঙন স্পষ্ট হয়ে যায়। শেখ মুজিব ১৮ই জানুয়ারি এক বিবৃতিতে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার অন্যায়ভাবে এক হাজারের বেশি যেসব। রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে নিরাপত্তা আইনে বন্দি করে রেখেছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন।৫২ তিনি ১৮ তারিখে সদ্য কেন্দ্রীয় সচিব পদে নিয়ােগপ্রাপ্ত শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং জরুরি দলীয় কিছু বিষয় নিয়ে আলােচনার জন্য করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৫৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট নেতা হিসেবে অনাস্থা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে ১১৩ জন সদস্য স্বাক্ষর করেন। শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের প্রধান নেতা হিসেবে এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এককভাবেই পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। এরপর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দেশের সর্বত্র গণসংযােগ করেন। শেখ মুজিব বিভিন্ন জনসভায় যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে আদর্শহীন ও ক্ষমতালােভী কিছু নেতার কারণে যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাবে জনগণের ভােট পেয়েও প্রাদেশিক সরকার গঠনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়। কিন্তু নেতৃবৃন্দ জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করতে পারেনি। সেকারণেই আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে বন্দি করা হয়। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ে যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলাের ভূমিকার ওপর আস্থা রাখতে না পেরে দলগতভাবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই যুক্তফ্রন্ট থেকে বের হয়ে এসেছে। ১৭ই জুন ১৯৫৫ ঢাকার পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে ২১ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। ২১ জুন পাকিস্তান গণপরিষদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে মুসলিম ৩১ জন ও অমুসলিম ৯ জন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবে। নির্বাচনে ৩১টি মুসলিম সদস্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে ১২ জন নির্বাচিত হন। উক্ত ১২ জনের মধ্যে সােহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান,
——————————————
৫২ বিস্তারিত দেখুন, দৈনিক সংবাদ, ১৮ই জানুয়ারি ১৯৫৫, SDIB, vol-4, page. 214 (29) ।
——————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৪১
শেখ মুজিব অন্যতম ছিলেন। ২৩শে জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা হতে পদত্যাগ করবেন।৫৩
যুক্তফ্রন্ট তখন কার্যত কেএসপি, মুসলিম লীগসহ সরকারপন্থি দলগুলাের ফ্রন্টে পরিণত হয়। এর নেতৃত্ব দেন এ কে ফজলুল হক। শেখ মুজিব ৫ই জুলাই ১৯৫৫ লাহােরে একটি বিবৃতিতে ২১ দফার কর্মসূচি ও স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে বলেন, আওয়ামী লীগ শুধু সরকারি চাকরিসহ সকল বিষয়ে সংখ্যাসাম্যের দাবি সমর্থন করে নাই, অধিকন্তু আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্যও দাবি জানাইয়াছে।”৫৪
মারিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের সভায় যােগদান করে শেখ মুজিব শাসন বিভাগের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ দাবি করেন।৫৫ ২৫শে আগস্ট করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামকরণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান গণপরিষদে তীব্র প্রতিবাদ করেন।৫৬
এই ভাষণে তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা সম্পর্কেও শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। ওইদিন গণপরিষদে এক ইউনিট সম্পর্কে উত্থাপিত প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর তারিখ ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৬৭৫ জন কাউন্সিলর যােগদান করেন। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদ সােহরাওয়ার্দী ২১ তারিখ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনের প্রথম দিন দলের সাধারণ সম্পাদক দলের পক্ষ থেকে বিগত দুই বছরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহকারে একটি দীর্ঘ বিবরণ প্রদান করেন। তার এই বিবরণে ১৯৫৪-এর বন্যা, যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচন, নির্বাচনপরবর্তী পরিস্থিতি, ৯২ক ধারা, যুক্তফ্রন্ট সরকারের বরখাস্ত হওয়া এবং ফজলুল হকের ভূমিকার সমালােচনা করেন। ২য় দিন তথা ২২শে
——————————————-
৫৩ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারে রােজনামচা, বাংলা একাডেমি, ২০১৭, পৃ. ২৬৯ (৩০)
৫৪ দৈনিক আজাদ, ৬ই জুলাই ১৯৫৫, বিস্তারিত বাংলাদেশ, পৃ. ১৩৩ (৩১)
৫৫ বিস্তারিত, ঐ, ১৩ই জুলাই ১৯৫৫, পৃ. ১৩৪ (৩১)
৫৬ বিস্তারিত, বাংলাদেশ, পৃ. ১৩৬ (৩১)
——————————————-
৪২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
অক্টোবর তারিখে আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি তুলে সব জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওইদিন কেন্দ্রীয় সভাপতি সােহরাওয়ার্দীর উত্থাপিত যুক্ত নির্বাচন প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৩ তারিখ সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করা হয়। এতে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হন। সহ-সভাপতি পদে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ ও খয়রাত হােসেন, নির্বাচিত হন। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক হন অলী আহমদ, আবদুল হাই প্রচার সম্পাদক, মােহাম্মদ উল্লাহ অফিস সম্পাদক, আবদুস সামাদ শ্রম সম্পাদক, তাজউদ্দীন আহমদ সামাজিক ও তমুদ্দনিক সম্পাদক, সেলিনা বানু এমএলএ মহিলা সম্পাদক এবং মহিবুস সামাদ কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন ছাড়াও সম্মেলনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে ৮০টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। উল্লেখযােগ্য দাবিসমূহ হচ্ছে-যুক্তনির্বাচন, এক ইউনিট বিল বাতিল, জেলে আটক রাজবন্দিদের মুক্তি, যুক্তফ্রন্টের কর্মকাণ্ডের সমালােচনা, জমিদারি প্রথা বিলােপ, সামরিক চুক্তি বাতিল এবং বান্দুং সম্মেলন।৫৭ ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনপরবর্তী পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে ওঠে। একদিকে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলাের পরস্পরবিরােধী ভূমিকা, অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে এককভাবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনসহ গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সেই লড়াইতে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করতে থাকেন। ১৯৫৬ সালের ৯ই জানুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে শাসনতন্ত্র বিল উত্থাপিত হওয়ার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ গণপরিষদ দলের সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমান বিলের সমালােচনা করে বলেন, এই বিলে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান, যুক্তনির্বাচন ও সর্ববিষয়ে সমতা রক্ষার ব্যাপারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিই বিশেষভাবে খেলাপ করা হইয়াছে।”৫৮
——————————————–
৫৭ বিস্তারিত দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ১৪০-১৪১ (৩২)।
৫৮ দৈনিক আজাদ, ৯ই জানুয়ারি ১৯৫৬, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ১৪২ (৩২)
——————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৪৩
৩রা ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।৫৯
৮ই ফেব্রুয়ারি আইন পরিষদে ভাষণদানকালে শেখ মুজিব বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এমন কোনাে ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়, যা দ্বারা এই সরকার প্রাদেশিক সরকারের সকল বিষয়ে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করতে পারে। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, মুদ্রা ও পররাষ্ট্র বিষয়াবলিই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকতে পারে। সাধারণ নির্বাচনে ২১ দফা ওয়াদা পূরণের স্বার্থেই আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত।৬০
৯ তারিখের অধিবেশনে তিনি পাকিস্তানের উভয় অংশের সকল বিষয়ে সমতা বিধান করতে হবে’৬১ এমন দাবি করেন। উক্ত আইন পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অপরিহার্য বাংলা ভাষা, পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতা, বাঙালিদের চাকরির অধিকার ইত্যাদি দাবি নিয়েও ব্যাপকভাবে কথা বলেন। শেখ মুজিব অনেকটা এককভাবেই লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কৌশলগতভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান অপরিহার্য উল্লেখ করে সংবিধানে এতদসংক্রান্ত সংশােধনী অনুমােদনের আহ্বান জানান। বলা চলে পাকিস্তান রাষ্ট্রে আইন পরিষদে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। তবে তার বেশিরভাগ দাবিই পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ অগ্রাহ্য বা নাকচ করে দেন। তা সত্ত্বেও দাবিসমূহ ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন পরিষদকে কার্যকর করার অন্যতম বিষয়।
করাচি থেকে ফিরে ৮ই মার্চ তারিখ তিনি খুলনায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দলীয় এক সভায় বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব
————————————-
৫৯ কারাগারের রােজনামা, পূ, ২৭০ (৩২)।
৬০ মােনায়েম সরকার, সম্পাদক, বাঙালির কণ্ঠ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ. ৬৩ (৩২)
৬১ পূর্বোক্ত পৃ. ৬৯ (৩২)
————————————-
৪৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেতন বৈষম্য, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প এবং উন্নয়নের অসমতা সম্পর্কেও তুলে ধরেন। বক্তৃতায় তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য বগুড়ার মােহম্মদ আলী এবং চৌধুরী মােহম্মদ আলীর কঠোর সমালােচনা করেন। ৬২ শেখ মুজিবুর রহমান ৯ মার্চ (১৯৫৬) তারিখে গােপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য কিছু না করে করাচিতে রাস্তাঘাট নির্মাণে অর্থ ব্যয় করছে বলে অভিযােগ করেন। বক্তৃতায় তিনি দুর্ভিক্ষ, যুক্তনির্বাচন পদ্ধতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ব বাংলার বেকারত্ব সমস্যার বিষয়সমূহের ওপর গুরুত্বারােপ করেন।৬৩ এরপর ১৬ই মার্চ তারিখে নরসিংদীর রায়পুরে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। এখানে তিনি খাদ্য সংকটের জন্য সরকারকে দায়ী করেন। এ ছাড়া সরকার জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ধর্মের অপব্যবহার করছে বলে অভিযােগ করেন। ৬৪ পাকিস্তান গণপরিষদে ৩০শে মার্চ তারিখে তিনি পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক নীতির সমালােচনা করে বক্তব্য রাখেন।৬৫ এপ্রিল মাসের ৫ থেকে ৯ তারিখ সুইডেনের রাজধানী স্টকহােমে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তান থেকে ১০ সদস্যের এক প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে তিনি যােগদান করেন। করাচি থেকে ৬ই মে ঢাকায় ফিরে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, জোট সরকারে যােগদানের বিষয়ে তাঁর দলের কোনাে আগ্রহ নেই। কেননা তার দল জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে সেবা দেওয়া এবং রাজনীতিতে সুনির্দিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী সেকারণে তিনি এধরনের প্রস্তাব ও সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেন।৬৬ ওইদিন পত্রিকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব বলেন, দেশব্যাপী এই নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রতি উদাসীন সরকার মন্ত্রিসভার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অনশনের সংবাদ শুনিয়া অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি।৬৭
———————————————-
৬২ বিস্তারিত দেখুন, SDIB, vol-4, page 394397 (33)
৬৩ পুর্বোক্ত, page 389-391 (33)
৬৪ পুর্বোক্ত, page 399-402 (33)
৬৫ পুর্বোক্ত, page 408-410 (33)
৬৬ পুর্বোক্ত, page 413 (34)
৬৭ ইত্তেফাক, ৬ মে ১৯৫৬ (৩৪)
———————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৪৫
৯ই মে তারিখে তিনি খাদ্যের সমস্যা দূর না করতে পারা, প্রাদেশিক পরিষদের শাসনতান্ত্রিক নিয়ম ভঙ্গ করে সার্টিফিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত বাজেট পাসসহ নানা অনিয়মের জন্য পরিষদের সংখ্যালঘু আবু হােসেন সরকার এবং কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের নানা উক্তির সমালােচনা করে তিনি এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি সৃষ্ট ভয়াবহ খাদ্য পরিস্থিতি মােকাবিলা করার দাবিতে আওয়ামী লীগ প্রধান মওলানা ভাসানীর অনশন শুরু করার পরও সরকারের টনক নড়ছে না দেখে ৬৮বিস্ময় প্রকাশ করেন।৬৮ ১১ই মে তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের আয়ােজিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় খাদ্যসংকট, দুর্ভিক্ষ এবং আবু হােসেন সরকারের অপশাসনের কঠোর সমালােচনা করেন।৬৯ ১৬ই মে তারিখ শেখ মুজিব ২৫ মে ‘খাদ্য দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করেন। ওইদিন খাদ্য সরবরাহ এবং মওলানা ভাসানীর অনশন ভাঙার লক্ষ্যে প্রদেশব্যাপী জনসভা করার আহ্বান জানান। ১৬ মে তারিখ তিনি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে দেশের খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ মােকাবেলা এবং রেশন ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে বক্তৃতা করেন।৭০ ১৯শে মে ১৯৫৬ প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অসুস্থতার জন্য মওলানা ভাসানী উপস্থিত থাকতে পারেননি। লিখিত ভাষণ পাঠ করেন দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। লিখিত ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থার বিশদ বিবরণ দেন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারকে তিনি এর জন্য দায়ী করেন। ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন, “দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ, গণ-পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ সদস্যদের মতামত-এমনকি ক্ষমতাসীন চক্র যুক্তফ্রন্ট দলের পরিষদ সদস্যের সুপারিশকে পদদলিত করিয়া আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্বপাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবিসমূহকে কেন্দ্রের প্রতিক্রিয়াশীল কোটারীর হাতে তুলিয়া দিয়া তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের ভরাডুবি করিয়াছে।’৭১
————————————-
৬৮ দৈনিক ইত্তেহাদ, ৯ মে ১৯৫৬, বিস্তারিত দেখুন, পুর্বোক্ত, page 414-415 (34)
৬৯ পুর্বোক্ত, page 421-425 (34)
৭০ পুর্বোক্ত, page 429-433 (34)
৭১ নতুন দিন, ২৫ মে, ১৯৫৬, বিস্তারিত, পুর্বোক্ত, page 436-438 (35)
————————————-
৪৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
মওলানা ভাসানীর অসুস্থতার কারণে ২৫শে মে আহূত খাদ্য দাবি দিবস স্থগিত রাখা হয়। ৩০শে মে তারিখে অসুস্থ মওলানা ভাসানীকে দেখার জন্য আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিব সন্তোষে গমন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ও কোয়ালিশন সরকার রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ সভা রােধ করার জন্য ঢাকায় জুন মাসব্যাপী ১৪৪ ধারা জারি করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যে বিবৃতি প্রদান করেন তা ৩রা জুন তারিখ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।৭২ শেখ মুজিবুর রহমান ১৬ই জুন গােপালগঞ্জের কাঠি, ১৭ই জুন গােপালগঞ্জের উজানি, ১৮ই জুন গােপালগঞ্জ শহর এবং ১৯শে জুন। ফরিদপুরের চন্দ্রদীঘলে পৃথক পৃথক জনসভায় খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষ মােকাবেলায় সরকারের উদাসীনতার কঠোর সমালােচনা করেন। সরকার যদি ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থার মােকাবেলা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান যেমনি জানান তেমনি কঠোর সমালােচনাও অব্যাহত রাখেন। তিনি প্রদেশে খাদ্যসংকট দূর করতে না পারার জন্য সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতাকে দায়ী করে বক্তৃতা করেন। ৭ই জুলাই তাঁর দেওয়া বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অন্য কোনাে দলকে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সােচ্চার হতে দেখা যায়নি। এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব রাখার চিন্তাভাবনা প্রকাশিত হয়ে পড়ায় ১৪ জুলাই ১৯৫৬ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের এক সভায় শেখ মুজিব এ ধরনের উদ্যোগের বিরােধিতা করে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তা দলের সভায় গৃহীত হয়।৭৩ প্রদেশের খাদ্যসংকট, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় সরকার গভীর সংকটে পড়ে। আওয়ামী লীগ, কেএসপির একটি অংশ (সালাম খান গ্রুপ, কফিলউদ্দিন গ্রুপ), গণতন্ত্রী দল, কংগ্রেস, ইউপিপি এবং ৩ জন, স্বতন্ত্র সদস্য প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা
———————————————-
৭২ বিস্তারিত দেখুন, দৈনিক ইত্তেহাদ, ৩রা জুন ১৯৫৬ (৩৫)।
৭৩ দেখুন, রােজনামচা, পৃ. ২৭০ (৩৬)।
———————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৪৭
প্রস্তাবে একমত প্রকাশ করেন। পূর্ব বাংলার গভর্নর এ কে ফজলুল হক ১৩ই আগস্ট অধিবেশন স্থগিত করার আদেশ জারি করেন।৭৪ কিন্তু স্পিকার অধিবেশনে তা পাঠ করার আগেই শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করলে উপস্থিত দুই শতাধিক সদস্য দাঁড়িয়ে তা সমর্থন করেন। কিন্তু গভর্নর এ কে ফজলুল হকের আদেশনামা বহাল রেখে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়। এর প্রতিবাদে ১৬ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এ কে ফজলুল হক ও মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারের কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ বিবরণ পত্রিকায় বিবৃতি দানের মাধ্যমে দেশবাসীকে অবহিত করেন।৭৫ বিবৃতিতে তিনি ২৭শে আগস্ট সাধারণ ধর্মঘট, শােভাযাত্রা ও জনসভার মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান।
২৭শে আগস্ট পালন উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী প্রচার প্রচারণা চালানাে হয়। এবং ২৩শে আগস্ট পত্রপত্রিকায় বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে ২৭শে আগস্টকে পালনের দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। শেখ মুজিবের আন্দোলনের কর্মসুচি প্রদানের ফলে প্রদেশব্যাপী যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার ভীত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী এই পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক ধারা রক্ষার ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক একটি দীর্ঘ বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি কেন্দ্রীয় সরকার মুখ্যমন্ত্রী জনাব আবু হােসেন সরকারের প্রতি পরিষদের অধিকাংশ সদস্যদের সমর্থন আছে কি না, তাহা যাচাইয়ের জন্য। আগামী ৩১শে আগস্টের পূর্বে প্রাদেশিক গভর্নরকে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের পরামর্শ দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়াছেন।’
২৭শে আগস্ট ঢাকাসহ প্রদেশব্যাপী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে সভা-সমাবেশ ও শােভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। পল্টন ময়দানেও বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০শে আগস্ট আবু হােসেন সরকার পদত্যাগপত্র গভর্নর এ কে ফজলুল হকের প্রতি প্রেরণ করেন। ৩১শে
————————————-
৭৪ দেখুন, ইত্তেফাক, ১৭ই আগস্ট, ১৯৫৬ (৩৬)
৭৫ দেখুন, ইত্তেফাক, ২৪শে আগস্ট, ১৯৫৬ (৩৬)
————————————-
৪৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
আগস্ট গভর্নর উক্ত পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। ওইদিন ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব) ইস্কান্দার মির্জা এক নির্দেশবলে পূর্ব পাকিস্তান শাসনতন্ত্রের ১৯৩ ধারা প্রবর্তন মারফত প্রদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ এবং ১লা সেপ্টেম্বর হতে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রদেশের বাজেট সার্টিফাই করিয়াছেন।৭৬
আবু হােসেন সরকারের প্রাদেশিক সরকারের পতন ঘটায় সকল স্তরের মানুষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। একই সঙ্গে ১৯৩ ধারাবলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক গভর্নরের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করায় প্রদেশে যে পরিবর্তন সূচিত হয় তাতে নতুন সরকার গঠন এবং প্রদেশের খাদ্য সংকটসহ নানাবিধ সমস্যা দ্রুত সমাধান জরুরি হয়ে পড়ে। ৬ই সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে মুখ্যমন্ত্রী করে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। ওইদিন তিনি গভর্নর এ কে ফজলুল হকের কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ অনুষ্ঠানে প্রসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিসভায় ওইদিন আবুল মনসুর আহমেদ (আ লী), শেখ মুজিবুর রহমান (আ লী), কফিলউদ্দিন আহমেদ (স্বতন্ত্র) ও মাহমুদ আলী (গণতন্ত্রী দল) শপথ নেন। নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর প্রদেশে ১৯৩ ধারা বাতিল করা হয়। নতুন মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের দায়িত্ব পান। নতুন মন্ত্রিসভার দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরেই ৭ই সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার সভাপতিত্বে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, পূর্ব বাংলার গভর্নর এ কে ফজলুক হক এবং নতুন মন্ত্রিসভার উচ্চপর্যায়ের এক খাদ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিদেশ থেকে ১ কোটি ৩৭ লক্ষ মণ চাল আমদানির জরুরি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর খুলনা, যশাের, ফরিদপুর, গােপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন এবং খাদ্য সমস্যার সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। ১১ই সেপ্টেম্বর রিপাবলিকান পার্টি সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে জাতীয় পরিষদে সমর্থন দান করায় কেন্দ্রে মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান
——————————————-
৭৬ দেখুন, ইত্তেফাক, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ (৩৭)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৪৯
পার্টির নেতৃত্বে ১২ তারিখ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়। ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ পাকিস্তানের নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে যােগদান করতে ১১ই সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানসহ শেখ মুজিবুর রহমান করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগ করার প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘােষণা দেন। করাচি পৌঁছে শেখ মুজিব খাদ্য, দুর্নীতি এবং মােহাজের সমস্যার সমাধানে আওয়ামী লীগ কাজ করে যাবে বলে উপস্থিত জনতাকে স্মরণ করিয়ে দেন। ১২ই সেপ্টেম্বর সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত রিপাবলিকান সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন পাকিস্তানের প্রসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা। এতে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর মিয়া মােশতাক আহমদ গুরমানী এবং পূর্ব পাকিস্তানের নয়া মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান দলের নতুন মন্ত্রীদল। এর আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কেন্দ্রে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ৪টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। এবার পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ এবং যুক্তফ্রন্টের সরকার প্রাদেশিক পরিষদে পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার ৬ই সেপ্টেম্বর গঠিত হয়। এর মাত্র ৬ দিনের মাথায় কেন্দ্রেও অনুরূপভাবে মুসলিম লীগ শাসনের অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সমর্থ হয়। এর মাধ্যমে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে বিজয় লাভ করে এবং পাকিস্তান সােহরাওয়ার্দী এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উদারবাদী গণতান্ত্রিক ধারায় বিকশিত হওয়ার সুযােগ লাভ করে। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হওয়ার পরেই জাতির উদ্দেশে দেওয়া বেতার ভাষণে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা হচ্ছে, স্বচ্ছ রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা, দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা কায়েম করা, দুর্নীতি দমন বিভাগকে শক্তিশালী করাসহ সরকারের নীতি নির্ধারণ সম্পর্কে জনগণকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়। দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ১৫ই
৫০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাকে সংবর্ধনা প্রদান করে। ওইদিন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় নতুন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত কাজ করার আশ্বাস দেন, একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত জনগণের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকার টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানাে হয়। জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রতিটি ইউনিয়নে লঙ্গরখানা খােলার তথ্য প্রকাশ করেন। জনসভায় ভাষণদানকালে নতুন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের অভিনন্দন ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছার প্রতিদান প্রতিশ্রুতি রক্ষার মাধ্যমেই পূরণ করার কথা সবাইকে জানান।৭৭
পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র এবং প্রদেশে খাদ্যসঙ্কট দূর করা, কালােবাজারি বন্ধ করা, শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সজাগ থাকাসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে মনােযােগ দিলেও একটি গােষ্ঠী ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক বিষয়ে নানা ধরনের প্রচারণায় লিপ্ত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানাে হয় । আওয়ামী লীগ দলগতভাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় জনসভার মাধ্যমে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। ১৯৫৬ সালের ২৬শে অক্টোবর চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের আয়ােজিত জনসভায় শ্রম, দুর্নীতি দমন, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গত দেড় মাসে নতুন সরকার প্রশাসন কার্যকর করা, খাদ্যসংকট মােকাবেলা করা, দুর্নীতি দমনে উদ্যোগ নেওয়া ইত্যাদিতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার বিবরণ দেন এবং জনগণকে ধৈর্য ধারণ করে সরকারকে সহযােগিতা প্রদানের আহ্বান জানান।৭৮ জনগণের মধ্যেও মুসলিম লীগ এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তখনও জাগ্রত ছিল। এর প্রতিফলন ঘটে ১০ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ তারিখে অনুষ্ঠিত ৬টি মুসলিম আসনের উপনির্বাচনের ফলাফলে। এতে ৬টি আসনের ৫টিতেই আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। সােহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান আগে থেকেই যুক্তনির্বাচনের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। এই সময়েও
——————————————-
৭৭ বিস্তারিত দেখুন, ইত্তেফাক, ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬ (৩৯)
৭৮ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ২৮ অক্টোবর, ১৯৫৬ (৩৯)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৫১
আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের যুক্ত নির্বাচনের দাবি অব্যাহত রাখে। কেননা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্য পাকিস্তানের জনগণের ভােটাধিকার প্রয়ােগে সাম্প্রদায়িক প্রথা কোনাে অবস্থাতেই গ্রহণযােগ্য নয় বলে আওয়ামী লীগ মনে করে। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি, শিল্প, চামড়া শিল্পের উন্নতির জন্য প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্র থেকে বরাদ্দ আদায় করে নেয়। ২৪শে জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে ভারতের সঙ্গে বহুমুখী শিল্প ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যাপক আলাপ আলােচনা ও সম্ভাবনা যাচাই-বাছাই করতে বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১৭ই জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। সেখানে। শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক বিভিন্ন আলােচনা শেষে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা করে চুক্তি সম্পাদন শেষে ২৪ তারিখ তারা ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। বিমানবন্দরে তারা ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পের নানা উপকরণ আমদানি রফতানি বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য প্রদান করেন।৭৯ সরকারের এই ধারা কেন্দ্র এবং প্রদেশে যত অব্যাহত থাকে তত আগের নাজুক পরিস্থিতির অবসান ঘটতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যাভাবের কথা বিবেচনা করে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাদি ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ তারিখে গােপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিব ব্যাখ্যা করে বলেন যে, খাদ্যশস্যের শােচনীয় পরিস্থিতিকে আয়ত্তাধীনে আনয়ন করা হইলেও ভবিষ্যতে যাহাতে এইরূপ ভয়াবহ পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তজ্জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। এই অবস্থা বিবেচনা করিয়া সরকার স্থায়ীভাবে খাদ্যশস্য মজুত রাখার উদ্দেশ্যে দেশের অভ্যন্তর ভাগ হইতে ও বিদেশ হইতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছে।”৮০
৬ থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ৭ই ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলের ২য় দিনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও পাকিস্তানের জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি নিয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সিয়াটো*-সেন্টো** চুক্তি বহাল রেখে চলায় প্রতিনিধিদের একটি অংশ
————————————–
৭৯ বিস্তারিত দেখুন, ইত্তেফাক, ২৫শে জানুয়ারি ১৯৫৬ (৪০)
৮০ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭, দেখুন বাংলাদেশ, পৃ. ১৯৩-১৯৪ (৪০)
————————————–
৫২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সমালােচনা করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ দফার অন্যতম দাবি ছিল পাকিস্তানের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। মওলানা ভাসানীসহ দলের একটি অংশ সােহরাওয়ার্দীর অনুসৃত নীতির সমালােচনা করেন। এ নিয়ে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের মধ্যে আদর্শগত বিরােধ উন্মােচিত হয়। শেষ পর্যন্ত জুন মাসে অনুষ্ঠিত দলের দুদিনব্যাপী সম্মেলনের পর দলের বামঘেঁষা নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার বাস্তবতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও দলের উদারবাদী অংশ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারসহ অর্থনৈতিক বিকাশে যথাসম্ভব অবদান রাখার স্বার্থে সেই মহর্তে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানাের কৌশল গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার নীতি অনুসরণ করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীই সােহরাওয়ার্দীর সমর্থনে আওয়ামী লীগে অবস্থান করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ২৪শে ফেব্রুয়ারি তারিখে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আর্থিক অনুদান, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারভুক্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর পর্যায়ে বৈঠক শেষে ঢাকায় ফিরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, বাণিজ্য ও সম্প্রসারণে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন।৮১ প্রাদেশিক পরিষদে ১৪ই মার্চ তারিখে ১৯টি বিল অনুমােদন লাভ করে। বিলগুলাে হলাে, ‘মিউনিসিপ্যাল পূর্ব পাকিস্তান সংশােধনী বিল, বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন পূর্ব পাকিস্তান সংশােধনী বিল, বঙ্গীয় গ্রাম্য স্বায়ত্তশাসন পূর্ব পাকিস্তান সংশােধনী বিল, আসাম স্বায়ত্তশাসন পূর্ব পাকিস্তান সংশােধনী বিল, আসাম মিউনিসিপ্যাল পূর্ব পাকিস্তান সংশােধনী বিল, পূর্ব পাকিস্তান খাদ্য স্পেশাল কোর্ট সংশােধনী বিল, ইস্ট বেঙ্গল ইমারজেন্সি রিকুইজিশ্যান সংশােধনী বিল, পূর্ব পাকিস্তান খনি ও খনিজ দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন বিল, পূর্ব পাকিস্তান কুটির শিল্প করপােরশন বিল, ইস্ট পাকিস্তান
—————————————–
৮১ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭, দেখুন বাংলাদেশ, পৃ. ১৯৪-১৯৫ (৪১)
—————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৫৩
শিল্প উন্নয়ন বিল, ফৌজদারী কার্যবিধি আইন বিল, ইস্ট বেঙ্গল জুট ডিলার্স এসােসিয়েশন সংশােধনী বিল, বেঙ্গল মেডিকেল বিল, বেঙ্গল পাব্লিক ডিমান্ড বিল, পূর্ব পাকিস্তান গরু জবেহ সংশােধনী বিল, কোর্ট ফি বিল।৮২
১৯৪৭ সালের পর এই প্রথম আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকার প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ এতগুলাে বিষয়ে প্রাদেশিক পরিষদ থেকে আইনাকারে অনুমােদন করে নেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার স্বাতন্ত্রিক প্রাদেশিক মর্যাদা বৃদ্ধির সুযােগ ঘটে। ২০শে মার্চ অনুষ্ঠিত অধিবেশনে দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহার নিয়ে বিরােধীদলীয় আবু হােসেন সরকার একটি অভিযােগ উত্থাপন করলে শেখ মুজিবুর রহমান তার সকল যুক্তি খণ্ডন করেন। বরং আবু হােসেন সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে যেসব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করেন তার বিশদ বিবরণ প্রদান করেন।৮৩ অবশ্য ওইদিন থেকে বাজেটের দফাওয়ারি আলােচনাও শুরু হয়। প্রাদেশিক পরিষদ এই সময়ে নিয়মমতাে অধিবেশন বসা এবং জনস্বার্থ সংবলিত বিষয়ে আলােচনা ও বিল অনুমােদনের ব্যবস্থা করে। যেমন ২৭শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম উন্নয়ন কর্পোরেশন বিল পেশ৮৪, ২রা এপ্রিল তারিখে দুর্নীতি দমন বিল অনুমােদন৮৫, ৩রা এপ্রিল তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি গ্রহণ, ফিল্ম উন্নয়ন কর্পোরেশন ও বাংলা একাডেমি বিল গ্রহণ৮৬ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩১ ধারা বাতিল৮৭। প্রাদেশিক পরিষদে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বিল অনুমােদন হওয়ায় পাকিস্তানের
—————————————————–
৮২ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ১৫ই মার্চ ১৯৫৭, দেখুন বাংলাদেশ, পৃ. ১৯৬ (৪১)
৮৩ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ২১শে মার্চ ১৯৫৭, দেখুন বাংলাদেশ, পৃ. ১৯৬-১৯৭ (৪২)
৮৪ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ২৮শে মার্চ ১৯৫৭, দেখুন বাংলাদেশ, পৃ. ১৯৭-১৯৮ (৪২)
৮৫ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ৩রা এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ১৯৮-২০১ (৪২)
৮৬ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ৪ঠা এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২০৪-২০৬ (৪২)।
৮৭ বিস্তারিত দেখুন, ইত্তেহাদ, ৪ এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২১৩-২১২ (৪২)।
*Southeast Asia Treaty Organization (SEATO)=এটি ১৯৫৪ সালে ম্যানিলায় স্বাক্ষরিত হয়। এই সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট প্রভাব বিস্তারকে মার্কিন সহযােগিতায় যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। সংস্থাটি ন্যাটো প্রভাবাধীন ছিল। পাকিস্তান এই সংস্থার অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। **Central Treaty Organization (CENTO)=সংক্ষেপে এটিকে বাগদাদ চুক্তি বলা হতাে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালে। স্নায়ুযুদ্ধকালে ইরান, ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য এই সংস্থার সদস্যরাষ্ট্র ছিল। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সাথে যুক্ত হয়। সদস্যগুলাের সামরিক ও আর্থিক সহযােগিতা লাভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এই সংস্থায় কার্যকর ছিল।
—————————————————–
৫৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মীর গােলাম আলী তালপুর এক বিবৃতিতে ‘ইহা অযাচিত ও অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মজিবর রহমান ৫ এপ্রিল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নতুন দাবি নহে। পূর্ব পাকিস্তান পারলামেন্টের সদস্যসহ আমরা সকলেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সংবলিত ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছি।… তিনি কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আনুগত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিতে সাহস পাইলেন?… আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চয়ই পাকিস্তানের সংহতির বিরােধী নহে।৮৮
এর মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয় যে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসীন হয়েও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির কথা ভুলে যাননি কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায্য অবস্থানের বিরােধিতা করতে ভয় পাননি। ৮ই এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিল অনুমােদন প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানসহ বিভিন্ন গােষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ার উত্তরে করাচিতে এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করিয়া এক প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছে। উহাতে বলা হয়েছে যে, মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা এই ৩টি বিষয় কেন্দ্রের হস্তে রাখিয়া প্রদেশ দুইটিকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট অনুরােধ জানাইবেন।”৮৯
একই বিবৃতিতে তিনি স্বায়ত্তশাসনের ধারণাকে আরও স্পষ্ট করে লেখেন, বিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও শাসনব্যবস্থা কায়েম করা এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়িয়া তােলাই হইতেছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃত অর্থ। স্বায়ত্তশাসন বলিতে রাজনৈতিক চাল বা নির্বাচনী ধোঁকাবাজি বুঝায় না।৯০
—————————————
৮৮ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ৬ই এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২১৪ (৪২)।
৮৯ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ৯ই এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২১৪-২১৬ (৪৩)
৯০ বিস্তারিত দেখুন, ইত্তেহাদ, ৯ই এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২১৬ (৪৩)
—————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৫৫
পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, শিল্প-বাণিজ্যসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন ও সহযােগিতার বিষয়ে আলােচনা করেন এবং শহীদ সােহরাওয়ার্দী আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ সমস্ত দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন বলে ২৬শে এপ্রিল ১৯৫৭ করাচি থেকে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে প্রত্যাবর্তন করে সাংবাদিকদের বিস্তারিতভাবে জানান।৯১ ২৩শে মে তারিখ প্রাদেশিক শ্রম উপদেষ্টার এক বৈঠকে বাণিজ্য, শিল্প ও শ্রম দফতরের মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, সকলের প্রতি ন্যায়বিচার, অর্থাৎ আমরা এমন অবস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা করিতেছি, যাহাতে পুঁজি বিনিয়ােগকারীগণ নিশ্চিন্তে অর্থ বিনিয়ােগ করিতে পারে এবং নিয়ােজিত অর্থের বিনিময়ে ভালাে মুনাফা পান, শ্রমিকগণ সুখী ও তাঁহাদের পরিশ্রমের মজুরি সম্পর্কে আশ্বস্ত হইতে পারেন এবং শিল্পের উন্নতি ও শ্রমের সমৃদ্ধি লাভ হইতে পারে।”৯২
১৯৫৭ সালের ১৩-১৪ই জুন নিউ পিকচার হাউজ আরমানিটোলায় আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে দুদিনব্যাপী আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এতে ৮০০ জন ডেলিগেট অংশগ্রহণ করেন। ১৩ তারিখের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাংগঠনিক রিপাের্ট উত্থাপন করেন। এতে তিনি কাগমারি সম্মেলন সম্পর্কে বলেন, “যে কর্মধারা ও আদর্শবাদ আমাদের দেশসেবায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে, তাহার সাফল্য বা ব্যর্থতা সম্পর্কে নিজেরা সম্যক অবহিত না হইলে আমাদের চলার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হইতে পারে। এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া কাগমারি সম্মেলনের পর আমাদের বিগত চার মাসের কার্যকলাপের ক্ষুদ্র ইতিহাস আপনাদের খেদমতে পেশ করিতেছি। সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য, তাহা জানি না। কাগমারির শপথ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই, তাই বিদায় লইতে চাহিয়াও শেষ পর্যন্ত কৃতকার্য হইতে পারি নাই।”৯৩
————————————————–
৯১ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ২৭শে এপ্রিল ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২১৭ (৪৩)
৯২ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ২৪শে মে ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২১৮ (৪৩)
৯৩. বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ১৪ই জুন ১৯৫৭, দেখুন, বাংলাদেশ, পৃ. ২২২-২২৬ (৪৪)
————————————————–
৫৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
তিনি তাঁর রিপাের্টে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে উল্লেখ করেন, ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জনগণের প্রাণের দাবি। এ দাবি আমাদের আদায় না। হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই আমাদের অন্যতম নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব এইচ এস সােহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে উদাত্ত কণ্ঠে ঘােষণা করিয়াছেন যে, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখিয়া পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তাঁহার সরকার স্বীকার করেন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন না করিতে পারিলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বর্তমানে পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য একমত না হইলে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন অসম্ভব। কাজেই আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ব্যতীত আমাদের উপায়ান্তর নাই। ইতােমধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবির পশ্চাতে পশ্চিম পাকিস্তানে জনমত সৃষ্টি করিতে হইবে।”৯৪
এই অধিবেশনে হাসপাতাল থেকে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে মওলানা ভাসানী সােহরাওয়ার্দী উত্থাপিত পররাষ্ট্রনীতির সমালােচনা করে বক্তৃতা প্রদান করে আবার হাসপাতালে চলে যান। তিনি অবশ্য মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমান বরাবর একটি পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর এই পদত্যাগপত্র নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আবুল মনসুর আহমেদ হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে আসেন। সম্মেলনের ২য় দিন ১৪ই জুন মওলানা ভাসানীর পদত্যাগপত্র নিয়ে আলােচনা হলেও তা গৃহীত হয়নি। সম্মেলনে ৩টি সহ-সভাপতির এবং কোষাধ্যক্ষের পদ খালি রেখে ৩৮ সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, আবদুল হামিদ চৌধুরী সাংগঠনিক সম্পাদক, অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান প্রচার সম্পাদক, জহুর আহমদ চৌধুরী শ্ৰম সম্পাদক, তাজউদ্দীন আহমদ সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক, মিসেস মেহেরুন্নেসা মহিলা সম্পাদক, মােহাম্মদ উল্লাহকে দফতর সম্পাদক করা হয়।৯৫ আওয়ামী লীগ সম্মেলন সমাপ্ত করতে পারলেও কাগমারি সম্মেলনের
————————————–
৯৪ ঐ (৪৪)
৯৫ বিস্তারিত দেখুন, নূহ উল আলম লেনিন, ১৯শে জুলাই ১৯৫৭, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল, সময় প্রকাশনা, ঢাকা, পৃ. ৪৩ (৪৫)
————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৫৭
দ্বিধাবিভক্তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মওলানা ভাসানী ২৭শে জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। ভাসানীর পদত্যাগ এবং নতুন দল ন্যাপ গঠনের পর আওয়ামী লীগ মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করে। এই বিভক্তি অচিরেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং কোয়ালিশন সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিরােধী রাজনৈতিক দলের সহযােগিতা পাওয়া থেকে ব্যর্থ করে। আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র এবং প্রদেশে একক শক্তিতে অগ্রসর হতে হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান চীন সরকারের আমন্ত্রণে তিন সপ্তাহ চীনে সরকারি সফর শেষে ১৮ই জুলাই দেশে ফিরে আসেন। চীন সফরকালে শেখ মুজিবুর রহমান গণচীনে পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। চীনের শীর্ষ নেতা মাও সে তুং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরে তাঁর মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও পারস্পরিক সহযােগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আশ্বাস পান। তেজগাঁও বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগ ত্যাগকারী এবং সমালােচনাকারীদের কিছু প্রশ্নের উত্তর তিনি দেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকার গত ১১ মাসে শিল্প। বাণিজ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেন।৯৬ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ, পাকিস্তানি পররাষ্ট্রনীতির সমালােচনা, ২১ দফার বাস্তবায়ন না করা, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা না করাসহ বিভিন্ন অভিযােগ করে মওলানা ভাসানী কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন সেসবের উত্তর প্রদানের জন্য ২৭শে জুলাই মওলানা ভাসানী বেশ আড়ম্বরভাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদের ৩৫ জন। সদস্য ন্যাপে যােগদান করেন। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটি বড়াে ধরনের ধাক্কা লাগে। শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্যই এই বিভাজন সমস্যা তৈরি করেনি, পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে যেসব অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সেগুলােও বাধাগ্রস্ত হতে থাকে এবং পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার আওয়ামী
———————————————–
৯৬ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ১৯শে জুলাই ১৯৫৭, বাংলাদেশ, পৃ. ২২৮-২২৯ (৪৫)
———————————————–
৫৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
লীগকে প্রাদেশিক সরকার থেকে হঠিয়ে মুসলিম লীগ, কেএসপিসহ অন্য দলগুলাের মাধ্যমে একটি বড়াে ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরির পটভূমি রচনা করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ২৯ জুলাই শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান সচিবালয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি মওলানা ভাসানী উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযােগ খণ্ডন করে কোয়ালিশন সরকারের সীমিত ক্ষমতা, শাসনতন্ত্রের বাধ্যবাধকতা এবং সরকারের সর্বকালীন সময়ের বিষয় উল্লেখ করে একটি দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন।৯৭ তিনি এইসব দাবিদাওয়ার বিষয়ে নিকট ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযােগ পাওয়ার পর বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি হবে বলে সাংবাদিকদের জানান। কাগমারি সম্মেলনে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে কাজ করার কথা ঘােষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তিনি ৩০শে মে তারিখেই মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানকে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরােধে তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। নতুন পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরােধ করলে ৯ই আগস্ট মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে গভর্নর এ কে ফজলুল হক তাতে স্বাক্ষর দেন। এর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান দলকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় আয়ােজিত জনসভায় কোয়ালিশন সরকারের গৃহীত উদ্যোগসমূহ জনগণের নিকট স্পষ্ট করেন। ৯ই আগস্ট যশাের টাউন হল ময়দানে জনসভায় তিনি দেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করাসহ তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযােগেরও জবাব দেন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ৯ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান যােগদান করেন। একই সঙ্গে মুসলিম লীগের অপপ্রচার ও সমালােচনার মধ্যে আবার অন্যদিকে কেন্দ্রে সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির মতের অমিল হওয়ায় ১১ই অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন। মুলত জাতীয় সংসদের তার প্রতি সমর্থনের বিষয়টি যাচাই করতে তিনি প্রেসিডেন্টকে সংসদ অধিবেশন
——————————————-
৯৭ বিস্তারিত দেখুন, আজাদ, ৩০শে জুলাই, ১৯৫৭, বাংলাদেশ, পৃ. ২৩১-২৩২ (৪৬)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৫৯
ডাকার অনুরােধ করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তা না করায় তিনি পদত্যাগ করেন।
সােহরাওয়ার্দীর এই পদত্যাগপত্র প্রদানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৩ই অক্টোবর প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সমালােচনা করে বলেন, পাকিস্তানের জনসাধারণ ও বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কার্যের প্রশংসা করিয়াছিল। জনাব সােহরাওয়ার্দীর অতর্কিত অপসারণ দেশবাসীকে মর্মাহত করিয়াছে এবং বিদেশে বিশেষ করিয়া জাতিসংঘে যখন কাশ্মীর প্রশ্নটি আলােচিত হইতেছে তখন বিশেষ প্রতিক্রিয়া ঘটিয়াছে।”৯৮
মূলত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এবং পাকিস্তানের ক্ষমতাধর বিভিন্ন গােষ্ঠী কেন্দ্র এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকারের সিদ্ধান্তসমূহকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারছিলেন না সেকারণে সােহরাওয়ার্দীর অপসারণের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। সেই অবস্থায় সােহরাওয়ার্দী নিজ থেকে পদত্যাগ করেন। কেন্দ্রে ইস্কান্দার মির্জার সমর্থনে মুসলিম লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হয়। সােহরাওয়ার্দী সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁর সরকার বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা (ICA) ১ কোটি ডলার বিনিয়ােগ স্থগিত রেখেছিল মর্মে যে প্রচারণা চালানাে হয়েছিল তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ৪ঠা নভেম্বর পত্রপত্রিকায় একটি বিবৃতি প্রদান করেন।৯৯ বিবৃতিতে তিনি সকল অভিযােগ খণ্ডন ছাড়াও পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ববর্তী মুসলিম লীগের সরকারসমূহ প্রায় ১০ বছর ধরে শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে বিপুল বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। তার তথ্যভিত্তিক বিবরণ উপস্থাপন করেন। নভেম্বর মাসের ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান সােহরাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে সিরাজগঞ্জ এবং ফরিদপুরে ৪টি জনসভায় সসােহইরা ও মুসলিম লীগের বৈষম্যমূলক নীতি জনগণের কাছে উপস্থাপন করে বক্তৃতা প্রদান করেন। ১১ তারিখ সিরাজগঞ্জ কলেজ মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিব
————————————-
৯৮ সংবাদ, ১৪ই অক্টোবর ১৯৫৭, বাংলাদেশ, পৃ. ২৩৮ (৪৭)
৯৯ বিস্তারিত দেখুন, গ, ঘ, 8 November ১৯৫৭, SDIB, vol-4 পৃ. ৫১৪, সংবাদ,
৫ই নভেম্বর ১৯৫৭, SDIB, vol-4 পৃ. ৫১৫-৫১৮ (৪৭)
————————————-
৬০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
সােহরাওয়ার্দী সরকারের দুর্ভিক্ষ দূর করা, বিদেশনীতি এবং কাশ্মীর ইস্যুতে সফলতা তুলে ধরেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগ সরকার এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। ১২ই নভেম্বর সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনায় অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে সােহরাওয়ার্দীর ভূমিকা তুলে ধরেন। সেকারণে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধররা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সােহরাওয়ার্দীর সরকারকে অপসারণ করে বলে তিনি অভিযােগ করেন। ১৩ এবং ১৪ তারিখ সােহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুরের ভােজেশ্বর বাজার ময়দান এবং সােহরাওয়ার্দী ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন। শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ থেকে ২৬শে ডিসেম্বর কলকাতায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে দেশে ফিরে আসেন। তিনি প্রাদেশিক সরকারের থেকে আওয়ামী লীগ কৃষক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে সেগুলাে বিভিন্ন জনসভায় তুলে ধরতে থাকেন। তিনি কোনাে কোনাে মহল পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার যে দাবি করছিল তার সমালােচনা করে আওয়ামী লীগের অবস্থান যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে তা স্পষ্ট করেন। মূলত আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচন এবং তাতে দলগতভাবে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে সর্বত্র জনসভা ও প্রচার প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এককভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করার সক্ষমতা রাখে বলে দাবি করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপুলভাবে জয়লাভ এবং বিরােধীদের শােচনীয় পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণের একই ধরনের সমর্থন থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে এসে সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। কিন্তু তখন দলের অভ্যন্তরে এবং বাইরে বিরােধী রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরােধ ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। পাকিস্তানের রাজনীতি ধোয়াটে করার নানা অপকৌশল নেপথ্যের শক্তি ব্যবহার করতে থাকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অনেক নেতৃবৃন্দই এর পরিণতি আগে থেকে অনুভব করতে চেষ্টা করেনি। ফলে নানা ধরনের জটিলতা প্রাদেশিক পরিষদে তৈরি হতে থাকে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ এপ্রিল মাসের ৫ ও ৬ তারিখ
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৬১
দুদিনব্যাপী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে গভর্নর একে ফজলুল হক প্রাদেশিক সরকারের এবং প্রাদেশিক পরিষদে বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আতাউর রহমান খানকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে অপসারণ করেন। এই নিয়ে প্রাদেশিক পরিষদে তার দল কেএসপি এবং মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ওয়ার্কিং কমিটিতে দলের অভ্যন্তরে এবং বাইরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়ে আলােচনা হয়। দলের পরিষদ সদস্যদের মধ্যে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দলত্যাগ করেছেন তাদের ৫ বছরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও গভর্নর এ কে ফজলুল হক আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তের নিন্দা করা হয়। ওয়ার্কিং কমিটি সভায় একটি জুনিয়র পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন প্রয়ােজন বলে বিবেচনা করে তা বাস্তবায় হয়। এরপর ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীনসহ কয়েকটি রাষ্ট্র সফরের উদ্দেশ্যে ৭ই এপ্রিল তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ৪ঠা জুন প্রায় ২ মাস সফর শেষে ঢাকায় ফিরে এসে তিনি সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিশ্বে পাকিস্তানের কোনাে মর্যাদা নাই কারণ, দেশে স্থায়িত্ব না থাকায় কেহ আমাদের নীতিতে আস্থাশীল নহে। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন। হওয়াই এই অস্থায়িত্বের কারণ।… বিদেশে বিশেষ করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জনসাধারণ আমার নেতা জনাব সােহরাওয়ার্দীকে সম্মান। করে দেখিয়া আমি খুব আনন্দিত হইয়াছি। মার্কিন জনসাধারণ শান্তির পক্ষপাতী এবং যুদ্ধের বিরােধী বলিয়া তিনি মনে করেন। মানব সমাজকে রক্ষার জন্য যেকোনাে উপায়ে বিশ্বশান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করিতে হইবে।১০০ ১৫ই জুলাই শেখ মুজিবুর রহমান গােপালগঞ্জে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় বলেন যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে, মুসলিম লীগের কুশাসনের ফলে দেশে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, প্রদেশে শিল্পোন্নয়নের কোনাে উদ্যোগ নেয়নি এবং প্রদেশকে
————————————
১০০ আজাদ, ৫ই জুন ১৯৫৮, বাংলাদেশ, পৃ. ২৪২-২৪৩ (৪৯)
————————————
৬২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন করে রেখেছে।১০১ এরই মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদের নানা ধরনের উত্তেজনা, প্রাদেশিক সরকার নিয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি হতে থাকে। এর পেছনে কেএসপিপন্থি ও মুসলিম লীগ সদস্যদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নানা ধরনের যােগাযােগ ও তাদের ইন্ধন ছিল-যা পরবর্তী সময় স্পষ্ট হতে থাকে। প্রাদেশিক পরিষদে ২০ থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী গুরুতরভাবে আহত এবং পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। (প্রাদেশিক পরিষদের অভ্যন্তরে সংঘটিত ঘটনাবলি দেখুন, পরিশিষ্ট ২)। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পেছনে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্ধন যেমন ছিল, প্রাদেশিক পরিষদে কেএসপি ও মুসলিম লীগ সদস্যদের বাড়াবাড়ি এবং ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থানও ছিল। এর সুযােগ নিয়ে ৭ই অক্টোবর প্রসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক শাসন জারির ঘােষণায় প্রসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ‘দেশের শাসনতন্ত্র বাতিল করেন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার বরখাস্ত করেন, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়, সকল রাজনৈতিক দল ভেঙে দেওয়া হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খানকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে সামরিক আইনের প্রধান প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভার তার ওপর অর্পণ করেন।১০২
সামরিক শাসন জারির পর ১৯৫৭ সালের দুর্নীতি দমন আইন ও ১৯৫৮ সালের ৭২ নং অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাকে ১২ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখযােগ্য রাজনীতিবিদগণ হচ্ছেন-আবুল মনসুর আহমদ, হামিদুল হক চৌধুরী, আবদুল খালেক, শেখ মুজিবুর রহমান এবং কোরবান আলী। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন আসগর আলী শাহ, সিএসপি, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এম এ জব্বার এবং আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, সিএসপি। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে জেল
————————————-
১০১ দেখুন, ইত্তেফাক, ১৬ই জুলাই ১৯৫৮, বাংলাদেশ, পৃ. ২৪৩-২৪৪(৫০)
১০২ দেখুন, ইত্তেফাক, ৮ই অক্টোবর ১৯৫৮, বাংলাদেশ, পৃ. ২৫২ (৫০)।
————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৬৩
হাজতে পাঠানাে হয়। ২৭শে অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের পদ কেড়ে নেন এবং পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। কার্যত পাকিস্তানে শাসনতন্ত্রহীনভাবে দেশ পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল সেটি বাতিল হয়ে গেল। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পশ্চিম পাকিস্তান নয়, পূর্ব পাকিস্তানই চাপা পড়ে। রাজনৈতিক নির্যাতন, কারাগারে বন্দি রাখা, অধিকার হরণসহ সব ধরনের নিষ্পেষণমূলক ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। মুসলিম লীগ, কেএসপিসহ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অনুগত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কোনাে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ পরিলক্ষিত হয়নি। পাকিস্তান কার্যত ৫০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে যেটুকু শাসনতন্ত্রের ধারায় পরিচালিত হওয়ার সুযােগ লাভ করেছিল সেটিও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধর মহল গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। তা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সরকার এবং কেন্দ্রে সােহরাওয়ার্দীর সরকারকে পাকিস্তানের ক্ষমতাধর মহল তাদের অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। সেকারণেই কেন্দ্রে সােহরাওয়ার্দীর সরকারকে বরখাস্ত এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন সরকারকে নাজেহাল করার জন্য তাদের অনুগত কিছু গােষ্ঠীকে সক্রিয় করা হয়েছিল। মূলত সামরিক শাসন জারি করার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন থাকা সত্ত্বেও বারবার আইন-বহির্ভূতভাবে সাংবিধানিক সরকারকে বরখাস্ত এবং আইন-বহির্ভূতভাবে প্রাদেশিক সরকার গঠন করাসহ প্রাদেশিক পরিষদকে বহিরাগত এবং অভ্যন্তরীণ মাস্তান সদস্যদের উচ্ছল এক রণক্ষেত্রে পরিণত করা হয়। এর ইন্ধন দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধরদের পক্ষ থেকে। মূলত প্রাদেশিক পরিষদের মারামারির যে অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য মঞ্চস্থ করা হয়েছিল তা ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দশকব্যাপী স্বায়ত্তশাসন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং স্বাতন্ত্রিক গড়ে ওঠার প্রবাহকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রহীন, অধিকারহীন একটি পরাধীন অঞ্চলে পরিণত করা।
৬৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
১৯৫৮ সালের অক্টোবর থেকে পাকিস্তান সেই ধারাতেই সবকিছুকে ভেঙেচুরে তাদের স্বার্থ মােতাবেক গঠন করতে থাকে। আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের সেইসব রাজনৈতিক দল তখনই রাজনীতি করার সুযােগ পাবে যখন তারা আইয়ুব খানের নতুন সাংবিধানিক সীমিত ব্যবস্থা মেনে নেবে। যেসব রাজনৈতিক দল স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে পুনরায় আন্দোলন করার চেষ্টা করবে তাদের ‘পাকিস্তান ভাঙার অভিযােগে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হবে। সামরিক সরকার ৫৮-পূর্ববর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরার পথ রুদ্ধ করতেই মৌলিক গণতন্ত্রের নামে একটি সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা দাঁড় করায়। এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়েই আইয়ুব খানের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, ১৯৬২ সালে ৮ই জুন সংসদবিহীনভাবে একটি নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয়, মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাসহ পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র প্রদান করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন করে দাঁড়ানাের শক্তি ৬০-এর দশকে আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোনাে রাজনৈতিক দল দেখানাের সাহস পায়নি। মওলানা ভাসানী জেল থেকে মুক্তির পরে আইয়ুব খানের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেননি। অধিকন্তু চীনাপন্থি ন্যাপ নেতা হিসেবে পরিচিত হন। তাকে ছেড়ে ন্যাপের আরেকটি অংশ মস্কোপন্থি দল গঠন করে।
প্রায় ১৪ মাস নিবর্তনমূলক অর্ডিন্যান্সবলে আটক থাকার পর উচ্চতর আদালতের রায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৫৯ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হতে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু তখনও রাজনৈতিক দল গঠনের কোনাে অধিকার পাকিস্তানে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। আইয়ুব খানের প্রণীত ১৯৬২ সালের নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার প্রাক্কালে আইয়ুব খান কাউন্সিলপন্থি মুসলিম লীগ গঠন করেন। তবে শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেভাবে আইয়ুব খান তৈরি করছেন তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, জনগণের অধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি দূর করার লড়াই যতটুকু সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছিল তার সবটাই নস্যাৎ করার ফলে নতুন করে আন্দোলন সংগ্রাম এবং
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৬৫
জনগণের জাগরণ গড়ে তােলা ব্যতীত কিছুতেই অর্জন করা সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে তিনি ১৯৬০ থেকে গােপনে রাজনৈতিক সংযােগ পুনঃস্থাপন শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদনে ১৯৬০ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক যােগাযােগ ও প্রস্তুতি গ্রহণের যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।১০৩ ১৯৬০ সালের ১লা মার্চ থেকে যদিও শেখ মুজিবুর রহমান আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ একটি চাকরিতে যােগদান করেন। তারপরেও চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তিনি রাজনৈতিক সংযােগ গােপনে প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এই সময়ে শেখ মুজিবের মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তাভাবনাও নতুন করে দানা বাঁধতে থাকে। সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬২ সালে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের। উপ হাইকমিশনার শশাংক ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে লিখিত পত্রে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে তার সমর্থন জানতে চাওয়ার মধ্যে।১০৪ এ ছাড়া গােপনে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলালের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন বলে সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য পাওয়া যায়। পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র পন্থায় যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করার প্রয়ােজন ঘটলে তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে তিনি দলের গােপন নিউক্লিয়াস গঠন করেন। সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফসহ কয়েকজনকে নিউক্লিয়াসের দায়িত্ব প্রদান করেন। স্পষ্টত শেখ মুজিবের মধ্যে তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার চিন্তা-ভাবনা জোড়ালাে হতে থাকে। তা থেকেই তিনি এইসব গােপন যােগাযােগ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তবে সােহরাওয়ার্দীর ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাকেও সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। এক্ষেত্রে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন রাজনীতিতে এক বিস্ফোরণের সৃষ্টি
————————————-
১০৩ বিস্তারিত দেখুন, Gov EP Home Pol, File no-606-48PE, part-12 (1959-1960), part-13 (1955-1961), part-15 (1958-1963) (54)
১০৪ পীর হাবিবুর রহমান, ‘কারাগারে গেলে বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই পল্টনে বক্তৃতা করবি: তােফায়েল বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ই জুন ২০১৯ (৫৪)
————————————-
৬৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
করে। এর প্রভাব জনসাধারণের মধ্যেও পড়ে। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের সীমিত পরিসরকে কাজে লাগানাের উদ্যোগ ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন-উত্তর সময়ে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমান নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব, কামারুজ্জামানসহ নেতা লাহােরে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জাতীয় ফ্রন্ট গঠন করার জন্য আলােচনায় বসেন। ২৪ সেপ্টেম্বর লাহােরে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, বর্তমান শাসনতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানবাসীর গ্রহণযােগ্য নহে এবং এই প্রশ্নে তাহারা সকলে ঐক্যবদ্ধ।১০৫
বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানেও বিপুল জনসমর্থন লাভ করে। লাহােরের বৈঠকের পর সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ পাঞ্জাবের গুজরানয়ালা রেলযােগে সফর করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর সেখানে বিপুল জনসমাবেশ ঘটার ফলে কাউন্সিল মুসলিম লীগের কিছু সংখ্যক গুণ্ডা বাহিনী অতর্কিত হামলা করেছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর করাচি রেলস্টেশনে পৌঁছলে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের স্বাগত জানিয়ে স্লোগান প্রদান করে। স্পষ্টত বােঝা যাচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মনে ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের গুরত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযােগ্য নেতা ছিলেন পাঞ্জাবের জাতীয় পরিষদ সদস্য নওয়াবজাদা নসুরুল্লাহ খান, ন্যাপনেতা মাহমুদ আলী কাসুরী, প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী কর্নেল (অব) আবিদ হােসেন প্রমুখ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনৈতিক জাতীয় ঐক্য তৈরির লক্ষ্যে একমত পােষণ করেন। করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে ১লা অক্টোবর এক সাংবাদিক সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের সাংগঠনিক সফর এবং জাতীয় ঐক্য গঠনের বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বিবরণ দেন। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিতকরণে একত্রিত হয়ে কাজ করার উদ্যোগ নেন। তবে তখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার কোনাে অধিকার আইয়ুব সরকার কাউকে দেয়নি। ফলে গণতান্ত্রিক
————————————–
১০৫ ইত্তেফাক, ২৫শে সেপ্টেবর ১৯৬২ (৫৪)
————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৬৭
ঐক্যফ্রন্টের আদলে বিভিন্ন জায়গায় জনসভার আয়ােজন করা হয়। ১৯৬৩ সালের ১৭ মার্চ পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বেশকিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্টের একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, চৌধুরী ফজলে ইলাহী, মিয়া জামাল শাহ, রমিজউদ্দিন, রােকাইয়া আনােয়ার, মেজর আফসারউদ্দিন, সৈয়দ আবদুস সুলতান, মসিউর রহমান, কামারুজ্জামান, আবদুল ওয়াসেক, হােসেন মনসুর, আমজাদ হােসেন প্রমুখ উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করেন। নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালােচনা করে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বলা যায় যে ১৯৫৮ সালের পর থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকার পর এই প্রথম ঢাকায় বিশাল সমাবেশের মধ্য দিয়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ঘটে।
সমাবেশের পরে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে ৭ই এপ্রিল তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য আতাউর রহমান খান ব্যক্তিগতভাবে দল পুনরুজ্জীবনের বিপক্ষে ছিলেন। তবে নবগঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ওপর আওয়ামী লীগের আস্থা তেমন ছিল না। সেকারণেই আওয়ামী লীগ একক রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৪ই মে শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রকে অগণতান্ত্রিক বলে দাবি করেন। তিনি বিবৃতিতে পাকিস্তানের জন্য একটি খাটি শাসনতন্ত্র রচনা করার দাবি জানান।
১৯৬৩ সালের রাজনৈতিক আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্যান্য দলের বিস্তর ফারাক ছিল। তারপরও আওয়ামী লীগ আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারবে এই লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে অবস্থান করেছিল। আওয়ামী লীগ অপেক্ষায় ছিল এককভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার পরিস্থিতি সৃষ্টি করার। তবে
৬৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর আকস্মিকভাবে বৈরুতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়েনি। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা শুরু করেন। প্রদেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হলে শেখ মুজিবুর রহমান দাঙ্গার বিরুদ্ধে সােচ্চার হন।১০৬ আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ৬, ৭, ৮ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপী সম্মেলন ঢাকার আমবাগান গ্রিনরােডে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ সম্মেলন উদ্বোধন করেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। সম্মেলনে ৯৪৪ জন ডেলিগেট যােগ দেয়। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকার পর নতুন পরিবেশে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্ট উত্থাপন করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যার নেতা ও কর্মীবৃন্দ সর্বপ্রথমে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্যের প্রতি কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের এবং তার বাইরে দেশবাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে।১০৭
তিনি পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিশদ বিবরণ তার প্রতিবেদনে তুলে ধরেন। মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে সভাপতি, শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক, তাজউদ্দীন আহমদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। সম্মেলনের পর শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে। সভা সমাবেশ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলার সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্থানে আইয়ুববিরােধী মনােভাব মানুষের মধ্যে তীব্র হতে থাকে।
২রা জানুয়ারি ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে সমর্থন দেখালেও আইয়ুব খান কূটকৌশলে বিডি মেম্বার চেয়ারম্যানদের ভােটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান
——————————————————
১০৬ বিস্তারিত দেখুন, ইত্তেফাক, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৪ তারিখে প্রদত্ত বিবৃতি, বাংলাদেশ, ২৬৮-২৬৯ (৫৬)
১০৭ ইত্তেফাক, ৭ই মার্চ, ১৯৬৪, বাংলাদেশ, পৃ. ২৬৯-২৭৬ (৫৬)
——————————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৬৯
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জানুয়ারি সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, আইয়ুব খানের তথাকথিত বিজয়ে নিরাশ হওয়ার কিছুই নাই। জনসাধারণ ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিবর্তনকালের ক্রেশ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মােকাবেলা করিবেন।১০৮
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর কাউন্সিল মুসলিম লীগের সমর্থকগণ পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিসহ সারা দেশেই বিরােধীদের ওপর হামলা করায় শেখ মুজিব ৬ই জানুয়ারি (১৯৬৫) প্রদত্ত আরেক বিবৃতিতে এর তীব্র নিন্দা জানান। এই আক্রমণ গােটা জানুয়ারি মাসব্যাপী পূর্ব পাকিস্তানেও কাউন্সিল মুসলিম লীগের সমর্থকগণ চালিয়ে যায়। এতে বেশকিছু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। ২৯শে জানুয়ারি প্রদত্ত আরেক বিবৃতিতে তিনি এর কঠোর সমালােচনা করে জনগণকে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়ে আসীন। হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে দমন নিপীড়ন কঠোরভাবে অব্যাহত রাখে। ২২শে জুলাই তারিখে এক ছাত্র শােভাযাত্রা প্রেসক্লাব প্রদক্ষিণ করার সময় সরকারের পুলিশবাহিনী অতর্কিত হামলা করে। এতে অনেকে আহত হলে শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতির মাধ্যমে হামলার তদন্ত দাবি করেন। শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে প্রস্তুত করে আবার বিভিন্ন অঞ্চলে সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করেন। ১৯৬৫ সালের ১লা আগস্ট তারিখে ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় বক্তৃতাদানকালে শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাঁচিবে কি না তা লইয়াই ব্যাপক গণআন্দোলন সৃষ্টি করিতে হইবে।…আওয়ামী লীগের কর্মীগণকে অতীত সংগ্রামের চাইতে আরও কঠোরতম সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইতে হবে।…১০৯ ‘আওয়ামী লীগই প্রথম সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান, রাজবন্দিদের মুক্তি, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, লাহাের প্রস্তাবের বাস্তবায়ন, খাজনা-ট্যাক্সের বােঝা হ্রাস, ২৫ বিঘার কম জমির খাজনা আদায় মকুব প্রভৃতি দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম শুরু করে।
——————————
১০৮ ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারি ১৯৬৫ (৫৭) ১০৯ ইত্তেফাক, ৩রা আগস্ট ১৯৬৫, বাংলাদেশ ২৮৭-২৮৮ (৫৮)
——————————
৭০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
৮ই আগস্ট যশাের টাউন হলে জেলা কার্যকরী সভার সংসদে যােগদান করে তিনি বলেন, দেশের এক অঞ্চলের উপর অপর অঞ্চলের বঞ্চনা ও আন্তঃপ্রাদেশিক বৈষম্য দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানবাসী আন্দোলন বন্ধ করিবে না।… ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি দাবির উপর আওয়ামী লীগ যখন আন্দোলন শুরু করে তখন হইতেই আমরা এক শ্রেণির স্বার্থবাদী মানুষের শত্রুতে পরিণত হই।১১০
শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ যখন স্বায়ত্তশাসন ও সংবিধান সংশােধনের দাবি নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখনই পাকিস্তান এবং ভারতের। মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৯৬৫ সালের ৬ থেকে ২২শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৭ দিনের পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হলে পূর্ব পাকিস্তান অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রথমবারের মতাে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে শুরু করে। ফলে পাকিস্তানের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা মানুষের মধ্যে নতুন করে জাগার বাস্তবতা তৈরি হয়। এই অবস্থাটি শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান নিরাপত্তার দিক থেকে অরক্ষিত থাকায় জনমনে নানা আশঙ্কা ও উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সেই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। এতে তিনি অভিযােগ করেছিলেন যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ব্যবস্থা ও শক্তি দুর্বল রাখার কারণে যুদ্ধের সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সাংঘাতিক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল।… এই সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে সামরিক ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালিদের নিয়ােগ করার দাবিও তিনি জানিয়েছিলেন।… পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করার দাবিও জানিয়েছিলেন উক্ত ইশতেহারে।১১১
বুঝাই যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে তাঁর
————————————–
১১০ ইত্তেফাক, ১১ই আগস্ট ১৯৬৫, বাংলাদেশ, ২৮৮-২৮৯ (৫৮)।
১১১ এম, এ, ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ১৯৯৩, পৃ. ২৩-২৪(৫৮)
————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৭১
অবস্থান সেই সময়ে দেশে বিদেশে তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। দেশের অভ্যন্তরে তিনি স্বায়ত্তশাসনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে জনগণের সম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। পাকিস্তান সরকার অবশ্য ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে এক ধরনের ভারতবিরােধী প্রচার প্রচারণা ছড়িয়ে দিতে থাকে। এর মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া ক্ষোভ এবং সমালােচনা যেন স্তিমিত হয়ে যায়। সেজন্যই উগ্র ভারতবিরােধিতা প্রচার মাধ্যমে বৃদ্ধি করা হয়। আইয়ুব খান সরকার দ্রুত সকল রাজনৈতিক দলকে পাশে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান এই পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি জোরালাে করতে থাকেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘটার পর জাতিসংঘ এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে একটি শান্তিচুক্তির বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি। এতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী উভয় সরকারের নেতৃত্ব প্রদান। করেন। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন উক্ত বৈঠকে মধ্যস্থতা করেন। উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য সমঝােতা নীতি অনুসরণ করার পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। আইয়ুব খান তাসখন্দ থেকে দেশে ফিরেই রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে বৈঠক করার উদ্যোগ নেন। এ ছাড়া তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের বিজয় হয়েছে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইয়ুব খানকে সংবর্ধনা দেওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রচার প্রচারণায় লিপ্ত হয়। এর মাধ্যমে ভারতবিরােধী জিগির ব্যাপকভাবে পরিচালিত হতে থাকে। বিশেষত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রাতেই তাসখন্দে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করায় ভারতবিরােধী প্রচার প্রচারণা তুঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সুযােগে পাকিস্তানের কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে তাসখন্দ চুক্তিকে সম্মুখে রেখে লাহােরে একটি গােলটেবিল বৈঠকের আয়ােজন করতে থাকে। যদিও এ ধরনের একটি বৈঠকের উদ্যোগ সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধের পর নভেম্বর মাসেই অনুষ্ঠিত করার চিন্তাভাবনা ছিল, কিন্তু সেটির আয়ােজন তখন করা সম্ভব হয়নি।
৭২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
১৯৬৬ সালের ১০ই জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর নতুন বাস্তবতায় এটি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে (পরিশিষ্ট-৩, লাহাের সম্মেলন কেবল দেশবাসীকেই নয়, ক্ষমতাসীন সরকারকেও নূতন চিন্তার খােরাক যােগাইবে, বিরােধী শিবিরের আসন্ন প্রতিনিধি-সম্মেলনের কি ও কেন? রাজনৈতিক ভাষ্যকার দেখুন। পরিশিষ্ট-৩)। লাহােরে ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি উক্ত গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে অংশগ্রহণ করা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে। নানা ধরনের দ্বিধাবিভক্তি ছিল। এতে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ আমন্ত্রিত হন। ৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে লাহােরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।১১২ করাচি বিমানবন্দরে ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান, আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর শান্তিপূর্ণ সমাধান গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। করাচি আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব বলেন যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দঢ় সংকল্পবদ্ধ হইয়াই আমরা লাহাের সম্মেলনে যােগদান করিতেছি। শান্তিপ্রিয় জনগণের উদ্যোগে বিশেষ করিয়া সােভিয়েত উজিরে আজম মি, কোসিগিনের মধ্যস্থতার ফলে যে আদর্শ পুনঃস্থাপিত হইতে চলিতেছে তাহার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি নিয়াই আমরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করিতেছি।… ভবিষ্যতে শান্তির বিরুদ্ধে যে কোনাে অভিযানের প্রতি আমাদের সদা সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকিবে।১১৩
এরপর তিনি ও তাঁর প্রতিনিধি দল লাহােরের উদ্দেশে করাচি ত্যাগ করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি লাহােরে নেজামে ইসলাম নেতা চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর বাসভবনে দুই দিনব্যাপী নিখিল পাকিস্তান জাতীয় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মােহাম্মদ আফজাল। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর লে. জেনারেল মােহাম্মদ আজম খান ও চৌধুরী মােহাম্মদ আলী সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দেন। সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের পক্ষ হতে আমন্ত্রিত ৮শত ব্যক্তির মধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশ হইতে সর্বমােট ৭৪০ জন সম্মেলনে যােগদান করেন। তন্মধ্যে ১২৪ জন লাহাের, ৫৯৫ জন পশ্চিম
———————————-
১১২ ইত্তেফাক, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৬০)
১১৩ দৈনিক আজাদ, ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৬০)
———————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৭৩
পাকিস্তানের অন্যান্য স্থান এবং ২১ জন পূর্ব পাকিস্তান হইতে যােগদান করেন। সম্মেলনে যােগদানকারীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিগণ হইলেন, মওলানা আবুল আলা মওদুদী, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, সর্দার শওকত হায়াত খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মৌলভী ফরিদ আহমদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব এবিএম নূরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের বিরােধীদলীয় নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল, জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলি, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য জনাব আবদুস সােবহান, সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য মওলানা ইউসুফ, মওলানা জান মােহাম্মদ আব্বাস, মওলানা মঈন উদ্দিন, জনাব হামজা এমপিএ, চৌধুরী মােহাম্মদ হােসেন ছাত্তা, জনাব আবদুল বাকী বালুজ, জনাব শফিকুল ইসলাম, খাজা মােহাম্মদ রফিক, জনাব এম. আর. খান, মওলানা মােসলেহ উদ্দীন, মওলানা আবদুস সাত্তার নিয়াজী, সৈয়দা ওয়াহিদ খান এমপিএ, পাকিস্তানের সাবেক এটর্নী জেনারেল চৌধুরী নাজির আহমদ খান, চৌধুরী রহমত আলী, মওলানা মােহাম্মদ চিরাগ এবং জনাব ইয়াহিয়া বখতিয়ার।১১৪
লাহাের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাসখন্দ প্রস্তাব গ্রহণকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। অংশগ্রহণ করেননি। এ প্রসঙ্গে নেজামে ইসলাম নেতা মওলানা ফরিদ আহমদ জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দুই দিবসব্যাপী সম্মেলনের যে অধিবেশনে তাসখন্দ ঘােষণাবিরােধী প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়, সেই অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল যােগদান করে নাই। আওয়ামী লীগ দলের এই অধিবেশন বর্জনের কারণ জানিতে চাহিলে জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, তাসখন্দ ঘােষণাপত্র সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কোনাে সঠিক সিদ্ধান্ত না থাকায় তাহারা অধিবেশনে উপস্থিত হইতে বিরত থাকেন।১১৫
তবে ১৯৭০ সালের ৪ঠা জুন অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লাহাের সম্মেলন বর্জনের কারণ
———————————–
১১৪ ইত্তেফাক, ৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৬১)
১১৫ ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, বাংলাদেশ, ৩৮৪-৩৯০ (৬১) ৭৪
———————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
সম্পর্কে বলেন, ১৯৬৬ সালে লাহােরে এক বৈঠকে ৬ দফা দাবি পেশ করিলে মওদুদী, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, নওয়াবজাদা নসুরুল্লাহ উহা আলােচনা করিতেও অস্বীকৃতি জানান।১১৬
নিখিল পাকিস্তান লাহাের জাতীয় সম্মেলনে তাসখন্দ ঘােষণার প্রেক্ষিতে করণীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াও ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে শীঘ্রই দেশব্যাপী এক ব্যাপক আন্দোলন গড়িয়া তােলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে।১১৭
লাহােরে ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং দেশরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রশ্নটা বড়াে হইয়া দেখা দিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা বলেন যে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটাকে প্রাদেশিকতা বলিয়া চিত্রিত করা উচিত নহে। শেখ সাহেব বলেন যে, সাম্প্রতিক যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ছিল এবং পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর অকৃত্রিম ভালােবাসাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির রক্ষার ব্যাপারে দেশকে সুসংহত রাখিয়াছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানবাসী দেশরক্ষার ব্যাপারে তাহাদের প্রদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়ােজনীয়তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করিতে থাকে।… তিনি বলেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন জাতীয় সংহতির কোনাে ক্ষতি তাে করিবেই না, বরং পাকিস্তানকে আরও বেশি শক্তিশালী করিবে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদ কর্তৃক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলােচনার পূর্বে তাসখন্দ ঘােষণা সম্পর্কে এই পর্যায়ে তিনি কোনাে মতামত প্রকাশ করিবেন না।… সম্মেলনে দেশের উভয় অংশের সাড়ে সাতশত প্রতিনিধির যােগদান একটা উল্লেখযােগ্য বিষয়।১১৮
জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য থেকে যেটি বােঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে। তিনি লাহাের সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্বটি বিশেষভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। তবে এ
———————————
১১৬ ইত্তেফাক, ৫ই জুন ১৯৭০, বাংলাদেশ, ৩৮৪-৩৯০ (৬১)
১১৭ পুর্বোক্ত (৬১)
১১৮ ইত্তেফাক, ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৬১)
———————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৭৫
বিষয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে তেমন কোনাে আগ্রহ বা স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সেক্ষেত্রে পর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্বকে জনগণের মধ্যে তুলে ধরার চিন্তা অবিলম্বে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবেন। সেটি লাহােরে এই সম্মেলন পরবর্তী সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। লাহাের থেকে ঢাকায় ফেরার পর সকল মহলকে তিনি তাঁর স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে রাজনীতিতে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন সেটি বােঝা গেল ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পর। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে, লাহাের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ ছিল না। যেমন নুরুল আমিন এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ভাসানী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মুজাফফর এবং কেন্দ্রীয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ওয়ালি খান। শেখ মুজিবুর রহমান লাহাের সম্মেলনকে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দীর্ঘদিনের দাবির একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে ধরনের পরিবেশ বিরােধী দলের উক্ত সম্মেলনে দেখা যায়নি। ফলে তিনি লাহােরে সাংবাদিকদের নিকট স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরলেও এর পরিপূর্ণ প্রস্তাবনা ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে ১১ই ফেব্রুয়ারি উপস্থাপন করেন।
এটি সফল হলে পাকিস্তান একভাবে পরিচালিত হওয়ার সাংবিধানিক চিন্তা আনয়নের সুযােগ লাভ করত। এটি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বিরােধিতার সম্মুখীন হবে জেনেও তিনি সম্মেলনকেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে জনগণের মধ্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা থেকে আন্দোলনের পথে যাওয়ার সুযােগ ঘটবে বলে তিনি অনুধাবন করেছিলেন। এটি ছিল তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশের ধারণা। যা পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিকূল পরিবেশকে অতিক্রম করে আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। বস্তুত তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক মনােভাবকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেই নতুন প্রেক্ষাপট রচনায় স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার
৭৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
উপযুক্ত সময় বলে ধরে নিয়েছিলেন। প্রায় দেড় দশকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলন, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির নতুন পর্বে উন্নীত করার সুযােগ হিসেবে তিনি লাহােরে রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতেই গমন করেছিলেন। সেটিকে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে জনগণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি লাহাের-করাচি থেকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি প্রথম ৬ দফা দাবিনামা উত্থাপন করেন এবং লাহাের কনফারেন্সের বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন। কেননা লাহাের কনফারেন্সে গৃহীত সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা বিধানের কোনাে লক্ষ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি-সেটি তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে তুলে ধরেছেন। এখান থেকেই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ৬ দফার আন্দোলনে পদার্পণ করে। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরােধ ও দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ৬ দফাকে জনগণের কাছে তুলে ধরেন, সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের অবস্থান আন্দোলন সংগ্রামের মুখে যাত্রা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকে আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের শক্তিতে প্রতিহত করার নিয়মতান্ত্রিক ধারায় অগ্রসর হলেন। সরকার যত বেশি বাধা প্রদান করবে তিনি সেই বাধা অতিক্রম করার নেতৃত্ব প্রদান করলে জনগণের শক্তির মুখে সরকারের পরাজয় একদিন হবেই-এমন বিশ্বাস থেকেই তিনি ৬ দফা উপস্থাপন করেন।
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৭৭

Reference: ৬ দফা স্বাধীনতার মহাসনদ – মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!