You dont have javascript enabled! Please enable it! পাথরঘাটায় পাকিস্তানি মেজর নিহত - নাগরপুর থানা আক্রমণ - নাগবাড়ি চৌধুরীবাড়ি অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
পাথরঘাটায় পাকিস্তানি মেজর নিহত
পাকিস্তানি বাহিনীর বালুচ রেজিমেন্টের জনৈক মেজর টাঙ্গাইলে এসে কাদের সিদ্দিকীকে জীবন্ত পাকড়াও করার ঘােষণা দেন। এ ছাড়া পাথরঘাটায় মুক্তিবাহিনীর সব ছেলেকেই গ্রেপ্তার করা হবে বলেও জানান। এ মেজর তার। বাহিনী নিয়ে রাতের অন্ধকারে মির্জাপুর থেকে পাথরঘাটার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তারা মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটি ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়। এখানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডে ছিলেন আজাদ কামাল। অবরুদ্ধ অবস্থায় তার। বাহিনী যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল, তা অকুণ্ঠ প্রশংসার যােগ্য। পাকিস্তানি সেনাদের এ আকস্মিক অভিযানের কিছুমাত্র আভাসও মুক্তিবাহিনী পায় নি। অকস্মাৎ ৩জন শক্র মুক্তিবাহিনীর ২জন প্রহরারত যােদ্ধাকে যখন ‘হ্যান্ডস আপ’ করতে বললাে, তখন অকস্মাৎ একজন মুক্তিযােদ্ধা শত্রুর উপর ব্রাশ ফায়ার করেন। সঙ্গে সঙ্গে ৩জন শত্রুই মাটিতে লুটিয়ে পড়লাে। এরপর শুরু হলাে রীতিমতাে গােলাগুলি বিনিময়। শত্রুর মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বললাে, “ইমাম জখম হাে গিয়া।” সঙ্গে সঙ্গে ওদের সাহায্যের জন্য আর একদল। পাকিস্তানি সেনা এগিয়ে আসে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব রণকৌশল ও ক্ষিপ্রগতি আক্রমণের মুখে শত্রু সেনারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করে। নিহত শত্রু সেনাদের মধ্যে একজন ছিল সেই মেজর, যে কাদের সিদ্দিকীকে জীবন্ত পাকড়াও করার হুমকি দিয়েছিলেন। পরে জানা যায়, উক্ত মেজর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এসএসজি কমান্ডাে ছিলেন। এ যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এবং ৪জন জখম হন। পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে ১০জন সৈন্য ও ১৫জন। রাজাকার নিহত হয় এবং ৩জন রাজাকার বন্দি হয়।
নাগরপুর থানা আক্রমণ
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানা দখল বাতেন বাহিনীর একটি ঐতিহাসিক অভিযান। ঐদিন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধারা নাগরপুর থানার চারদিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন সুবেদার আবু তাহের ও সুবেদার আব্দুল বারী। দীর্ঘ সময় । সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। প্রথম দিকে শত্রু বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ ও হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করার ফলে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা। কোণঠাসা হয়ে পড়েন। কিন্তু কয়েকজন দূরদর্শী যােদ্ধার অসীম সাহসিকতাপূর্ণ আক্রমণ ও গুলিবর্ষণের ফলে পাকিস্তানিদের হেলিকপ্টার চলে যেতে বাধ্য হয়। হেলিকপ্টার চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরাও পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময়। তারা বহু নিহত ও আহত সৈন্যকে রেখে যায়। শত্রু বাহিনীর সৈন্যরা পালিয়ে । যাওয়ার পর বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা নাগরপুর দখল করে নেয়। | ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে। বাতেন বাহিনীর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার কনােড়া গ্রামে। পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা টাঙ্গাইল থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইল জেলা সদরের প্রায় ১৫ মাইল দক্ষিণে কনােড়া গ্রামে পৌছাল সেখানে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা আক্রমণ করেন। এখানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রচুর। জীবনহানি ঘটান। যুদ্ধের একপর্যায়ে গভীর রাতে বহু লাশ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে শত্রু সৈন্যরা ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
নাগবাড়ি চৌধুরীবাড়ি অপারেশন
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার দক্ষিণ-পূর্বে নাগবাড়ি গ্রাম অবস্থিত। দেওপাড়ায় কাদের সিদ্দিকীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা নাগবাড়ির দিকে পিছু হটতে শুরু করে। কালিহাতি ফিরে যাওয়ার পথ তখন কাদের সিদ্দিকী একদল মুক্তিযােদ্ধা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। নাগবাড়ির দিকে পিছু হটে যাওয়া শত্রুর পিছু ধাওয়া করেন টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা। ডুবাইলের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নাগবাড়ি উপস্থিত হয়ে চৌধুরীবাড়িতে লুটপাটরত শত্রুর উপর আক্রমণ চালান। শত্রু চৌধুরীবাড়ির কেয়ারটেকার মুচু মিয়াকে হত্যা করে, অন্যান্য লােকজনের উপর নির্যাতন চালিয়ে চৌধুরীবাড়িতে অগ্নিসংযােগের চেষ্টার সময় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। শত্রু কাদের সিদ্দিকী বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে নাগবাড়ি পৌছায়। তারা বুঝতে পারে যে, আর বিলম্ব করলে ওরা মুক্তিবাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়বে। তাই তারা ২টি কলাম একত্র হয়ে নাগবাড়ি ছেড়ে কালিহাতির দিকে পলায়ন করে। ওদিকে বল্লা থেকে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল চারান হয়ে নাগবাড়ির পথে রওনা হয়। শত্রু চারানের ভিতর দিয়ে কালিহাতিতে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা ঠিক সময় চারানে পৌছতে পারলে শত্রুর ভাগ্যে চরম বিপর্যয় ঘটত। কাদের সিদ্দিকী চৌধুরীবাড়িতে প্রবেশ করে দেখেন যে, চৌধুরীবাড়ির কেয়ারটেকার মুচু মিয়ার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে, জিনিসপত্র তছনছ হয়ে আছে, অন্য লােকজন আহত আর বাড়ির উপর শেলের গােলার বড়াে বড়াে। ক্ষতচিহ্ন। কাদের সিদ্দিকী আহতদের চিকিৎসার দ্রুত ব্যবস্থা এবং শহিদ মুচু মিয়ার লাশ দাফনের বন্দোবস্ত করেন। | মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহসিকতা ও অপূর্ব দেশপ্রেমের জন্য ঐতিহ্যবাহী চৌধুরীবাড়ি রক্ষা পায়। শিক্ষা, সেবা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক চৌধুরী সাহেবের এ ভবনটি মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের ও দেশের সম্পদ মনে করেছিলেন বলেই মাত্র ১টি লাইট মেশিনগান ও বাকি ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তারা দুর্ধর্ষ শত্রুর মােকাবিলা করে তাদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।
যুদ্ধের মূল্যায়ন
মিত্রবাহিনী পুংলীতে ছত্রীসেনা অবতরণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর জেনারেল নিয়াজির উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়ােগে সমর্থ হয়। জেনারেল নিয়াজি ১টি ব্রিগেড অবতরণ করেছে মনে করে ঢাকা প্রতিরক্ষার জন্য ৯৩ ব্রিগেডকে দ্রুত পশ্চাদপসরণের আদেশ দেন এবং জরুরি সাহায্যের জন্য সেনাপ্রধানের কাছে তারবার্তা পাঠান। ছত্রীসেনারা পুংলীতে সফল রােড ব্লক স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় ৩০০জন পাকিস্তানি সেনাদের হতাহত করতে সমর্থ হয়। পক্ষান্তরে, ছত্রীসেনাদের পক্ষে ১০-১৫জন হতাহত হয়। মিত্রবাহিনী বিমান আধিপত্যের সুযােগে বিকালের পরিবর্তে সকালে ছত্রীসেনা অবতরণ করলে শক্রর মূল দলের পশ্চাদপসরণে বাধা প্রদান সম্ভব হতাে। পুংলীতে এক ব্যাটালিয়নের পরিবর্তে এক ব্রিগেড ছত্রীসেনা নামালে তারা নিজেরাই ১০১ কমিউনিকেশন জোনের সাহায্য ছাড়াই অগ্রাভিযানে সমর্থ হতাে। তাতে তখন পর্যন্ত অরক্ষিত ঢাকার পতন আরও আসন্ন হতাে। এ ব্যাপারে জেনারেল নিয়াজির বক্তব্য উল্লেখযােগ্য: “The dropping of Para Brigade at Tangail failed because its timing was wrong and thus could not block the withdrawal of my troops from Mymensingh area. General Arora says that they dropped only one battalion, which in even worse – for the final objective one has to put in maximum effort to obtain the required results. Nagra’s troops were held up near Tangail because there was on transport for them. All this happened due to lack of coordination and forethought.”

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড