You dont have javascript enabled! Please enable it!
ঘােষগাঁও ক্যাম্প আক্রমণ
ঘােষগাঁও ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ধােবাউড়া থানার একটি গ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে এ গ্রামে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। নভেম্বরের শেষের দিকে ঘােষগাঁও ক্যাম্পের ১০-১২জন রাজাকার অস্ত্রসহ টহলে বের হলে শিববাড়ি এলাকায় মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। এ আক্রমণে ঘটনাস্থলে ৪জন রাজাকার নিহত এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। এ আক্রমণে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন:
১. রজব আলী
২. আবদুল হামিদ
৩, এনামুল হক
৪. শামছুর রহমান
৫. আলতাবুর রহমান
৬. নেওয়াজ খান
৭. আবদুল হান্নান
৮. আবদুল হালিম
৯, মতিউর রহমান বেগ
১০. তােফাজ্জল হােসেন চুনু প্রমুখ।
পুংলীতে ভারতীয় ছত্রীসেনার অবতরণ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তদানীন্তন পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তে মিত্রবাহিনীর বিপুল সৈন্য সমাবেশের যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মাত্র ১টি পাঞ্জাব ও ১টি বালুচ রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত ১টি ব্রিগেডকে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও জামালপুর-টাঙ্গাইল অক্ষ প্রতিরােধের দায়িত্বভার দেওয়া হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্বল অবস্থান এবং স্বল্পতম সময়ে ঢাকা পৌছানাের প্রয়ােজনে ১০১ কমিউনিকেশন জোন দুর্গাপুর-ময়মনসিংহটাঙ্গাইল এবং জামালপুর-টাঙ্গাইল অক্ষে অগ্রাভিযানের পরিকল্পনা নেয়। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সহযােগিতায় পুংলী এলাকায় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১টি প্যারা ব্যাটালিয়ন সফল অবতরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্লকিং পজিশন তৈরির মাধ্যমে পাকিস্তানিদের পশ্চাদপসরণে বাধা প্রদান করা। তাই পুংলী এলাকায় সফল ছত্রীসেনা অবতরণ স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা।  ছত্রীসেনার অগ্রগামী দল হিসেবে নভেম্বরের শেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর তদানীন্তন ক্যাপ্টেন পিটার। পিটার ছিল তার ছদ্মনাম, আসলে তিনি বাঙালি এবং নাম ক্যাপ্টেন ঘােষ। ছত্রীসেনা অবতরণের প্রায় ১৫ দিন পূর্বে টাঙ্গাইলে এসেছিলেন ছদ্মনামধারী পিটার। উদ্দেশ্য, ছত্রীসেনারা যাতে সফল ও নিরাপদভাবে রণকৌশলগত সুবিধাজনক স্থানে অবতরণ করতে পারে তার জন্য টাঙ্গাইলে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী, বিশেষ করে টাঙ্গাইল জেলার মুক্তিবাহিনীর সাথে সমন্বয় সাধন। 
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে ধলেশ্বরী নদীর মােহনায় নৌকায় বসে তার সাথে কাদের সিদ্দিকীর আলােচনা হয়। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়, ছত্রীসেনা অবতরণের জন্য ৩টি ড্রপজোন নির্বাচন করা, যার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর উপর। প্রথম ড্রপজোনটি ছিল ঘাটাইল থানার ব্রাহ্মণশাসন-মােঘলপাড়ার পশ্চিমে ৩ বর্গমাইল আয়তনের গৌরাঙ্গির চক, যা বিমান অবতরণের উপযােগী এবং নিরাপত্তা বিধান সহজতর । দ্বিতীয় ড্রপজোনটি ছিল কালিহাতি থানার ইছাপুর-সাহাদেবপুরের দক্ষিণে পাঠানপাড়ার উত্তর-পূর্বের ১ বর্গমাইল আয়তনের মাঠ, যার নিরাপত্তা বিধানও সহজতর । তৃতীয় স্থানটি কালিহাতি থানার বাংড়া-শেলাকুড়ার উত্তরে বিশাল মাঠ, যার নিরাপত্তা বিধান ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। পিটার বিস্তারিত তথ্য যথাযথ নিরাপত্তার মাধ্যমে তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
আসলে উল্লিখিত ৩টি স্থানে ছত্রীসেনা অবতরণের কথা মুক্তিবাহিনীকে বললেও কখন ও কোন অবস্থানে ছত্রীসেনা নামবে, তা মুক্তিযােদ্ধাদের জানা ছিল না। তবে ৭ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং বেতারযােগে কাদের সিদ্দিকীকে ছত্রীসেনা অবতরণের বিষয়টি অবহিত করেন। ময়মনসিংহ-জামালপুর-টাঙ্গাইল অক্ষে চাপ বৃদ্ধির ফলে পাকিস্তানিরা পশ্চাদপসরণ অবধারিত মনে করেই রােড ব্লক দিয়ে তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্যই ১০ ডিসেম্বর বিকালে ছত্রীসেনা অবতরণের পরিকল্পনা করা হয়।
পাকিস্তানিদের পশ্চাদপসরণ টের পেয়ে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহটাঙ্গাইল সড়কের উপর অবস্থিত এলেঙ্গা এলাকায় সমবেত হয় এবং শত্রুর উপস্থিতির খবর পাওয়া মাত্রই তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কালিহাতির পুংলী এলাকায় ১১ ডিসেম্বর ২ প্যারা ব্যাটালিয়ন দ্বারা ছত্রীসেনা অবতরণের প্রথম পর্যায়ে ২টি পর্যবেক্ষণ বিমান অত্যন্ত নিচুতে উড়ে যায়। এরপর একাধিক মিগ যুদ্ধবিমান জামালপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পুংলী ব্রিজের আশপাশে চক্কর দিতে থাকে। মিগ যুদ্ধবিমানের এ কার্যক্রমকে সংক্ষেপে CAP অর্থাৎ Combat Air Patrolling বলে । ঐ সময় আনুমানিক বিকাল ৪টায় গৌরাঙ্গি মাঠে ১+১ বর্গকিলােমিটার এলাকাজুড়ে ছত্রীসেনা অবতরণ করে। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে এক ব্যাটালিয়ন ছত্রীসেনা অবতরণ করে। সন্ধ্যার পূর্বেই পুংলীতে রােড ব্লক স্থাপন করা হয়। ছত্রীসেনা অবতরণ-প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০-১২জন ছত্রীসেনা মৃত্যুবরণ করে। কিছু ছত্রীসেনা বাতাসের কারণে পাকিস্তানি। সেনাদের অবস্থানের কাছে অবতরণ করে এবং শক্রর গুলিতে আহত-নিহত হয়। ১টি পিক-আপের ছত্রীসেনারা অবতরণের সময় প্যারাসুট না খােলার কারণে ৩জন ছত্রীসেনা মৃত্যুবরণ করেন। ভারতীয় মিগ বিমানের গােলাবর্ষণে পাকিস্তানি বাহিনীর চলন্ত জিপ, পিকআপ ও বাস শত্রুসহ লৌহজং নদীতে ছিটকে পড়ে। যুদ্ধে এত অল্প সময়ে এত অধিক ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তানি বাহিনীর আর কোথাও হয় নি। ১২ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়কের নেতৃত্বে আনুমানিক ২০০জনের একটি দল সমর্পণ করে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ ও গােলাবর্ষণের কারণে পশ্চাদপসরণরত ৩ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
টাঙ্গাইল জেলা শহর শত্রুমুক্ত
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল শত্রুমুক্ত হয়। ঐদিন রাতেই টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে পুঁতে রাখা অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন অপসারণ করতে শুরু করেন। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে মাইন অপসারণে যারা নেতৃত্ব দেন তারা হলেন: বায়েজিদ, সােলেমান, শামসুল হক, গাজী লুৎফর রহমান ও নায়েক আলম। মাইন অপসারণ করতে গিয়ে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ২জন সদস্য মাত্মক আহত হন। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক বিপদমুক্ত হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী ঢাকা অভিযানের জন্য অগ্রসর হয়। যৌথ বাহিনীর বিনা বাধায় সকাল ৮টায় মির্জাপুর এবং দুপুর ১২টায় কালিয়াকৈর উপস্থিত হয়। ১২ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী সারাদিন কালিয়াকৈরে অবস্থান করে। ১৩ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার ক্লের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর ৫ হাজার সদস্য বাড্ডায় উপস্থিত হয়। ইতােমধ্যে ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং-এর (বাবাজি) নেতৃত্বে তার বাহিনী হালুয়াঘাট, ফুলপুর, ময়মনসিংহ মুক্ত করে টাঙ্গাইল এসে উপস্থিত হয়। সামান্য বিশ্রাম নেয়ার পর রাত ১০টায় ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং কালিয়াকৈর উপস্থিত হন।
১৩ ডিসেম্বর রাত ৯টার সময় জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল উপস্থিত হন। তিনি ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনার জন্য আলােচনায় বসেন। জেনারেল নাগরা আলােচনার শুরুতেই টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রশংসা করে ধন্যবাদ জানান। তিনি আন্তরিকভাবে বলেন, “টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিনা বাধায় অতটা পথ পাড়ি দিতে যদি সাহায্য না করতেন, তাহলে মিত্রবাহিনী দীর্ঘপথ যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাে। পথেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।” ১৪ ডিসেম্বর সকালে মৌচাকের ঠেঙ্গার বান্দ্রের কাছে ৩১জন শত্রু সেনাসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাদের খান যৌথ বাহিনীর কাছে বন্দি হয়। শত্রু সেনাসহ কাদের খানকে কয়েক দিন টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর হেফাজতে রাখা হলাে। ব্রিগেডিয়ার ক্লের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীকে কড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করতে হয়। কড়া নদীর দক্ষিণ পাশে পাকিস্তানিদের অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান ছিল। এখানে ঢাকা থেকে এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সেনা আগেই অবস্থান নিয়ে বসেছিল।
এর মধ্যে আবার ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল থেকে পলায়নপর প্রায় ২ হাজার সৈন্য কড়া পর্যন্ত এসে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তােলে। ১৪ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর এক মরণপণ যুদ্ধ হলাে। ব্রিগেডিয়ার ক্রের হাতে ভারি অস্ত্র না থাকায় প্রথম দিকে যৌথ বাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। ব্রিগেডিয়ার ক্লের এ যুদ্ধে তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে রাজি ছিলেন তিনি সম্মুখযুদ্ধে বেশি জোর না দিয়ে তার বাহিনীকে ডানে-বামে ভাগ করে দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্যে ছােটো ছােটো নৌকায় প্রায় অর্ধেক সৈন্যকে নদী পার করে দিতে সক্ষম হন। নৌকা সংগ্রহ ও নদী পারাপারের ব্যাপারে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!