জলছত্র এলাকায় অ্যামবুশ
নভেম্বরের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের ফলে শত্রু সেনাদের মনােবল একেবারে নিমস্তরে নেমে যায়। অপর পক্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের দেহমনে সৃষ্টি হয় অমিত তেজ। তাদের মনে স্পন্দিত হয় বিপুল আত্মশক্তি। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থানার জলছত্র এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশে পাকিস্তানি প্যাট্রল দলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ঐ অ্যামবুশে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযােদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। তারা হলেন:
১. হাবিবুর রহমান
২. জিয়াউল হক।
৩. এ কে এম রেজাউল করিম
৪. আ ফ ম ইয়াহিয়া খান
৫. আবদুল হাই।
৬. জাহান আলী সরকার প্রমুখ ।
এলেঙ্গার যুদ্ধ
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে উত্তরে কালিহাতি থানার মাঝপথে এলেঙ্গা নামক বেশ গুরুত্বপুর্ণ স্থানটি অবস্থিত। বর্তমানে যমুনা সেতু চালু হওয়ায় এলেঙ্গা স্থানটি উত্তরাঞ্চল ও কালিহাতিগামী রাস্তা দুটির ওয়াই জংশনে পরিণত হয়েছে। একাত্তরেও নদীবন্দর হিসেবে এলাকাটি বেশ গুরুত্ব পেত। বিশেষ করে যমুনা নদীর পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের পণ্য ও লােকজন এখান থেকেই পারাপার হতাে। তাই এখানে রাজাকারদের সমন্বয়ে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্পটি ধ্বংস করার জন্য আক্রমণের পরিকল্পনা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের এক রাতে এলেঙ্গাস্থ রাজাকার ক্যাম্পটি মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেন। আক্রমণে ২জন রাজাকার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি হয় নি।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন:
১. আব্দুল হাই
২. আহাম্মদ আলী
৩. আ, রহিম।
৪. ইব্রাহিম
৫. নায়েব আলী।
ধােপাঘাট আক্রমণ
ধােপাঘাট এলাকাটি ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার অন্তর্গত। সড়কপথে যােগাযােগ অনুন্নত হওয়ার কারণে ১৯৭১ সালে এটা ছিল একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। এ গ্রামের উপর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইন। পাকিস্তানি বাহিনী রেল ইঞ্জিনে করে এ পথে প্রায়ই টহল দিত। গফরগাঁও থানা সদরে রাজাকার বাহিনীর অবস্থান ছিল। ২৪ নভেম্বর ধােপাঘাট এলাকায় মুক্তিযােদ্ধা আবদুল হালিমের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা টহলদার পাকিস্তানি বাহিনীর উপর অতর্কিতে আক্রমণ। চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন:
১. আবদুল হালিম
২. আহাম্মদ।
৩. আবদুল কুদ্ছ
৪. আবদুল লতিফ
৫. মােজাফফর আলী
৬. শামছুল হক
৭. ফজলুল হক বেগ
৮, আমির হামজা প্রমুখ।
নাগরপুরের যুদ্ধ
টাঙ্গাইল জেলার সর্ব-দক্ষিণে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার উত্তরে নাগরপুর থানা। বাঘা সিদ্দিকী এবার নাগরপুর আক্রমণের দিন স্থির করলেন ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর। এর আগে কয়েকবার এ এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু চরম জয়লাভ সম্ভব হয় নি। তাই এবার সেরা মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলাে। মােস্তফা, সাইদুর, মালেক ও খােকার কোম্পানি গুলাের বাছাই করা ছেলেদের নিয়ে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গঠন করা হলাে। সঙ্গে ছিলেন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিদ্দিকীর ক্র্যাক সেনাদল ও সবুর খানের নির্ভীক মুক্তিযােদ্ধারা। এ অমিত বিক্রম মুক্তিবাহিনী নাগরপুর আক্রমণ করলাে। সকাল ১০টায় ২০টি এলএমজি, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ১টি রকেট লঞ্চার নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে হামলা চালানাে হলাে। নাগরপুর ঘাটিটি শক্রর জন্য বেশ সুবিধাজনক অবস্থান। সামনে সমতল ভূমি, আশপাশে বাড়িঘর। কিন্তু শক্রর প্রতিরক্ষার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে স্বয়ং বাঘা সিদ্দিকীর পরিচালনায় মুক্তিবাহিনী ‘ইয়া আলী’ ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি নিয়ে অগ্নিবর্ষণ শুরু করলাে। বাঘা সিদ্দিকী তীর বেগে। ছুটে শত্রুর ঘাটির ২০ গজের মধ্যে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। মর্টার, এলএমজি রকেটের প্রচণ্ড শব্দে জনপদ কেঁপে উঠতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের দলে ছিল এক কোম্পানি মিলিশিয়া ও শতাধিক রাজাকার। তারা বাংকারের মধ্যে থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিছুতেই শত্রুকে ঘায়েল করা যাচ্ছে না দেখে সিদ্দিকী সরে এসে ৮৩ মিলিমিটার রকেট লঞ্চার থেকে গােলাবর্ষণ শুরু করলেন। ২টি গােলার আঘাতে শত্রুর বাংকার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু সিদ্দিকী নিজেও আহত হলেন নিজের রকেটের আগুনে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইতােমধ্যে ৬জন শত্রু সেনা নিহত হলাে। মুক্তিবাহিনী এর মধ্যে আরও একটু সুবিধাজনক স্থানে এগিয়ে গেল। কিন্তু শত্রুকে কাবু করা অসম্ভব ব্যাপার মনে হলাে।
কারণ তারা মাটির তলায় কংক্রিটের বাংকারের মধ্যে নিরাপদে অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনী শত্রুর এত কাছে গিয়েছিল যে, সেখান থেকে পিছিয়ে আসাও সম্ভব ছিল না। তাই সারাদিন ধরে নিষ্ফল গােলাগুলি বিনিময় হলাে। ক্রমে রাত নেমে এলাে। শীতে মুক্তিযােদ্ধাদের কষ্ট হবে মনে করে স্থানীয় কিছু দেশপ্রেমিক লােক নিজেদের বাড়ি থেকে কথাকম্বল এনে দিল। সকালবেলা বাঘা সিদ্দিকী নতুনভাবে আক্রমণ পরিচালনা করলেন। কোম্পানি অধিনায়ক হুমায়ুন গ্রেনেড নিক্ষেপকারী রাইফেল নিয়ে শত্রু ঘাটির উপর হামলা চালালেন। সবুর ও মােস্তফা কলেজ ও বাজারের দিক থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে কলেজ ও বাজার দখলে আনলেন। অন্যদিকে হুমায়ুনের গ্রেনেড আক্রমণের তীব্রতায় শত্রুর বাংকার ভেঙে চুরমার হতে লাগলাে। এর মধ্যে শত্রুর ১টি গােলার আঘাতে হুমায়ুন, পাহাড়ি, শামসু ও অন্য ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হলেন। আক্রমণ তবুও অব্যাহত গতিতে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর মর্টার শেল ও রকেট আক্রমণে শত্রুপক্ষ পরাজয়ের সম্মুখীন। এমন সময় বিকাল সাড়ে ৩টায় সংবাদ এলাে যে, নাগরপুরের অবরুদ্ধ। হানাদারদের সাহায্যের জন্য এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সেনা টাঙ্গাইল থেকে নাগরপুরের দিকে আসছে। নতুন করে পাকিস্তানি সেনা আগমনের কথা বিবেচনা করে বাঘা সিদ্দিকী এদের পথ রােধ করার জন্য এলাসিন খেয়াঘাটে রবিউলের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা মােতায়েন করেছিলেন। কিন্তু শক্রর কথা চিন্তা করে তিনি নাগরপুর যুদ্ধের নেতৃত্বে সিনিয়র অধিনায়ক মােস্তফার উপর ন্যস্ত করে নিজের দল ও সবুরের দল নিয়ে এলাসিনের দিকে রওনা হলেন।
মােস্তফার উপর দায়িত্ব দেয়ার কারণ, তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন দক্ষ ও সাহসী সৈনিক। এর আগে তিনি প্রতিটি যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঘা সিদ্দিকী দ্রুতগতিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন এলাসিন ঘাটের কাছে পৌছালেন, তখন তার মনে হয়েছিল যে, সামনে যখন এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা আছে এবং তাদের সঙ্গে যখন এখনাে যুদ্ধ শুরু হয় নি, তখন নিশ্চয়ই পাকিস্তানি সেনারা এখনাে অনেক দূরে আছে। কিন্তু তিনি যখন ঘাটের খুব কাছে এলেন, তখন ঝাকে ঝাকে মেশিনগানের গুলি এসে তার কাছাকাছি। পড়তে লাগলাে। তিনি তখনই শুয়ে পড়লেন। কিন্তু হাজার হাজার গুলি এসে তার আশপাশে পড়তে লাগলাে। সামনে বা পাশে আড়াল করার কোনাে জায়গা নেই, কাজেই গড়িয়ে তিনি খালের মধ্যে পড়লেন। সিদ্দিকীর পাশের অবস্থানের বেনু মির্জা শক্রর গুলিতে আহত হলেন। এ বিপজ্জনক অবস্থায় বাঘা সিদ্দিকী তাকে ছেড়ে সবাইকে পিছু হটে যেতে বললেন। কিন্তু সবাই তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানালেন, অধিনায়ককে বিপদের মুখে ছেড়ে তারা কোথাও যাবেন না। সবুর। একটা টিলার আড়াল থেকে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন যে, তাঁর সর্বাধিনায়ক মহাবিপদের সম্মুখীন, তখন তিনি ডান পাশে সরে গিয়ে একটু আড়াল থেকে চাইনিজ এলএমজি দিয়ে কভারিং ফায়ার অব্যাহত রাখেন। তাঁর সঙ্গে শামসুও যােগ দিলেন তাঁর সাব-মেশিনগান নিয়ে। পাকিস্তানি সৈন্যরা নদীর ওপার থেকে এসএমজি চালাচ্ছে, একদল নদী পার হয়ে একটি চরে অবস্থান নিয়েছে এবং আর একটি দল গুলির আচ্ছাদনের মধ্যে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছে।
সবুর আক্রমণ চালাচ্ছেন দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা এবার সবুরের দিকে ধাবিত হলাে। ইতােমধ্যে বাঘা সিদ্দিকী তাঁর আহত সহযােদ্ধাকে নিয়ে একটু নিরাপদ স্থানে সরে গেলেন। শত্রু সেনাদের ২টি দল ইতােমধ্যে নদী পার হয়ে সবুরকে পাকড়াও করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। এ অবস্থায় সবুর ও শামসু পিছু হটতে বাধ্য হলেন। বাঘা সিদ্দিকী ও সবুর মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নাগরপুরে মােস্তফাকে নির্দেশ পাঠানাে হলাে যে, তারা যেন আর আক্রমণ না চালিয়ে পিছু হটে আসে। এলাসিনে রবিউলের কোম্পানিকে পাকিস্তানি সেনাদের পথরােধ করার জন্য পাঠানাে হয়েছিল, কিন্তু তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্তি উপলব্ধি করে তাদের উপর কোনােরকম আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তরুণ মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে রাজি নন, তাঁরা রবিউলকে চাপ দিতে থাকেন হামলা চালানাের জন্য, কিন্তু হামলা না করে রবিউল তার দলবল নিয়ে এলাসিন থেকে পালিয়ে যান। তরুণ মুক্তিযােদ্ধারা যদিও শত্রুকে বাধা দিয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র ২০ মিনিটের যুদ্ধে ২জন তরুণ মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। ভীরু রবিউল শহিদদের লাশ উদ্ধার না করেই পলায়ন করলেন, যা মুক্তিযােদ্ধাদের নীতিবিরােধী। কেদারপুরে অবস্থান করছিলেন বাঘা সিদ্দিকীর বড়াে ভাই লতিফ সিদ্দিকী, আনােয়ারুল আলম ও নরুন্নবী। তারা সিদ্দিকীর কোনাে খোঁজখবর না পেয়ে সারারাত জেগে কাটালেন।
রাতে রবিউলের কাছ থেকে একটা সিগন্যাল এলাে, সর্বাধিনায়ক পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার মুখে পড়েছিলেন, তার পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই মহা চিন্তায় মগ্ন । সকালবেলা সবুর ও বাঘা সিদ্দিকীর দলের ছেলেরা এসে সংবাদ দিলেন যে, সর্বাধিনায়ক বিপদমুক্ত। তিনি অন্য কোথাও নিরাপদে আছেন। বাঘা সিদ্দিকী আহত বেনু মীর্জার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তার দলের ফজলু ও অন্যদের খোঁজ নিলেন এবং জানতে পারলেন যে, সবুরসহ সবাই নিরাপদে চলে গিয়েছেন। তিনি একটু নিশ্চিন্ত হয়ে এলাসিন ঘাট থেকে ২জন শহিদের লাশ উদ্ধার করে কেদারপুরের পথে রওনা হলেন। পথে তিনি দেখতে পেলেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী নাগরপুর থেকে অবরুদ্ধ সৈন্যদের নিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে। চলেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে প্রায় ৫০জন আহত সেনা এবং কয়েকটি লাশ। সিদ্দিকীর ইচ্ছা হলাে, ওদের উপর আরেকবার আক্রমণ করবেন। কিন্তু তখন তার সঙ্গে মাত্র ৭জন মুক্তিযােদ্ধা থাকায় তিনি ইচ্ছা দমন করলেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড