You dont have javascript enabled! Please enable it!
পাকুল্লা সেতুর পতন
মুক্তিযােদ্ধারা বেশ কয়েকবার মির্জাপুর থানাধীন পাকুল্লা সেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন। প্রথম অভিযানের সময় তারা পাকুল্লা সেতুর তিন দিক থেকে আঘাত হেনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অধিনায়ক হাবিব পরিকল্পনা করলেন, মাত্র এক দিক থেকে আক্রমণ করা হবে এবং পাকিস্তানি সেনাদের বাংকারে গিয়ে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। অধিনায়ক হাবিব তার কোম্পানির বাছাই করা ২০জন যােদ্ধাসহ শুধু গ্রেনেড নিয়ে ক্রলিং করে পুলের উপর উঠে পড়েন। ভারি অস্ত্র নিয়ে অন্য মুক্তিযােদ্ধারা সেতুটির উত্তর ও পশ্চিম দিক আগলে রাখেন। ২০জন মুক্তিযােদ্ধা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি সেনাদের বাংকারগুলাের নিকটবর্তী হয়ে একের পর এক গ্রেনেড ছুঁড়লেন। সেতু পাহারায় ৩০জন পাকিস্তানি সেনা ও ৫০জন রাজাকারের মধ্যে ২০জনের দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অবশেষে তারা আসমর্পণ করলাে। এভাবে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর পাকুল্লা সেতু হানাদারমুক্ত হলাে। এ যুদ্ধে ১জন মুক্তিযােদ্ধা গুরুতর আহত হন।
বসুর বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ
বসুর বাজার ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়া থানার অন্তর্গত। কেন্দুয়া-নেত্রকোনা রাস্তার উপর কেন্দুয়া থানার উত্তরে নােয়াপাড়া ও সান্দিকোনার মাঝামাঝি এলাকায় বাজারটির অবস্থান। বাজারের পাশেই পূর্ব-পশ্চিমে বয়ে গেছে একটি ছােটো নদী। এ নদীর উপর সেতুর নিরাপত্তায় ছিল একটি রাজাকার ক্যাম্প। ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর দিবাগত রাতে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক গােলাম জিলানীর নেতৃত্বে ২৫জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল বসুর বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে রাজাকাররা প্রাথমিক প্রতিরােধ দিলেও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে নি। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্পটি দখল করেন এবং বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করেন। বেশ কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হন এবং একজন শাহাদতবরণ করেন।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন
১. গােলাম জিলানী
২. ইলিয়াস চৌধুরী
৩. মােখলেছুজ্জামান প্রমুখ।
বাশাইল থানার চূড়ান্ত অভিযান
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাশাইল দখলের জন্য ইতোপূর্বে পর পর ৩টি হামলা চালায় এবং প্রতিবারই তারা পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। শত্রু শেষবারের আক্রমণ চালাতে গিয়ে কামুটিয়ায় এসে দারুণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে। যায়। এ পরাজয়ের প্রতিশােধ নেয়ার জন্য শত্রু বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা। নিয়মিত বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ অগ্রসর হতে থাকে। শক্র কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে কামুটিয়ায় এসে ঘাটি স্থাপন করে। এখানেই শক্র চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। কাজেই এ স্থান থেকেই মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তারা শত্রু বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য বাশাইল থানা থেকে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে বাথুলী এলাকায় অবস্থান নিতে থাকেন। কিন্তু পরে বােঝা গেল যে, এ এলাকাটা শত্রু প্রতিরােধ করার জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। বরং এ অবস্থানটি পাকিস্তানি সেনাদের হামলার অনুকূলে যেতে পারে। সে জন্য অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা। পরিবর্তন করতে হলাে। মুক্তিযােদ্ধারা আরও কিছু দূর পিছিয়ে গিয়ে অবস্থান নিলেন।
ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী করটিয়া বাজার এলাকা থেকে ১২০ মিলিমিটার কামান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে বাশাইল থানায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে গােলাবর্ষণ শুরু করেছে। ভারি কামান ও মর্টারের গােলার ছত্রচ্ছায়ায় শত্রু সেনারা থানার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর হাতে দূরপাল্লার ভারি অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় তারা শত্রুকে তাদের অস্ত্রের নিশানার আয়ত্তের মধ্যে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। হানাদারদের অগ্রবর্তী দল কাছে এগিয়ে এলেই মুক্তিবাহিনী হামলা শুরু করবে, এ আশায় তারা প্রহর গুনতে থাকে, কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের এগিয়ে আসার পরিবর্তে আসতে লাগলাে তাদের কামানের গােলা তীব্র থেকে তীব্রতর গতিতে। সকাল ৮টা থেকে শত্রুর গােলাবর্ষণ শুরু হয়। তার আগে থেকেই মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাস্তার বাধের আড়ালে অবস্থান নিয়ে বসেছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গােলা ও শেল বর্ষণের পর দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে শত্রুর একটি দল থানার কাছাকাছি এসে গেল। আত্মগােপনকারী মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালালাে। পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছােটাছুটি করতে লাগলাে। ততক্ষণে ওদের ১৩জন সৈন্য ধরাশায়ী হলাে। আরও ৬জন জখম হয়ে পিছু হটে গেল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তীব্রভাবে পাল্টা আক্রমণ শুরু করলাে। এ আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে থানায় গিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। বিকাল তখন প্রায় ৪টা। অবস্থান পরিবর্তনের মুহূর্তে শত্রুর একটি ৩ ইঞ্চি মর্টারের শেল মুক্তিযােদ্ধা খােকার বাংকারের সামনে এসে পড়ে। ফলে শেলের স্প্রিন্টারের আঘাতে খােকার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
তিনি বাংকারের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। খােকা টাঙ্গাইল ছাত্রলীগের একজন নেতা এবং নির্ভীক মুক্তিযােদ্ধা। শত্রুর শেলের আর একটি স্পিন্টার মুক্তিযােদ্ধা আনসারের একটি পা ভেঙে চুরমার করে দেয়। ওদের অজ্ঞান অবস্থায় রণাঙ্গন থেকে অপসারণ করা হলাে। যুদ্ধ তখনাে চলছে। অধিনায়ক নির্দেশ দেন, যেমন করে হােক, সন্ধ্যা পর্যন্ত। আক্রমণ প্রতিহত করে শক্রর অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে হবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত সন্ধ্যার পর গ্রহণ করা হবে। | সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হলাে, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর চাপের। মুখে তাদের ঠেকিয়ে রাখা আর সম্ভবপর হচ্ছে না। যদি প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিত ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হবে। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনীর ভারি অস্ত্রশস্ত্রের মােকাবিলায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। যুদ্ধের বর্তমান অবস্থায় একজন মুক্তিযােদ্ধাকে হারানাের অর্থ হবে বাহিনীকে শক্তিহীন করা। ইতােমধ্যে বাঘা সিদ্দিকী সংবাদ পাঠালেন, “বাশাইল থানা ছেড়ে পিছু হটে আসবে।” সন্ধ্যার পর মুক্তিবাহিনী থানা পরিত্যাগ করে পিছু হটে গেল। অজ্ঞান অবস্থায় খােকা ও আনসারকে সঙ্গে নিয়ে তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!