You dont have javascript enabled! Please enable it!
এলাসিনে শক্রর রসদ দখল
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে দক্ষিণে মানিকগঞ্জ জেলার সীমান্তে দেলদুয়ার থানাসংলগ্ন এলাসিন অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর সকালে গােয়েন্দা সূত্রে খবর পাওয়া যায় যে, টাঙ্গাইল থেকে ৩০-৪০জন রাজাকার ও মিলিশিয়া খাবার ও অন্যান্য রসদ নিয়ে এলাসিন-নাগরপুর রাস্তা ধরে যাতায়াত করে। খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা কাদের সিদ্দিকী তার দল নিয়ে। এলাসিনের পথে ফাঁদ পেতে বসে থাকেন। সকাল ৮টার দিকে ৪-৫টি গরুর গাড়ি ও ৩-৪টি রিকশায় রাজাকার ও হানাদারদের একটি দল এগিয়ে আসতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের নাগালের মধ্যে আসামাত্র হঠাৎ আক্রমণে ৩জন রাজাকার নিহত এবং ১১জন আহত হয়। বাকি রাজাকাররা ধরা পড়ে। নাগরপুর ঘাটির জন্য নিয়ে যাওয়া সমস্ত রসদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। মুক্তিযােদ্ধা সবুর, সাইদুর, কাসেম, রফিকসহ ২০জনকে নিয়ে এ সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়।
ইছাপুর সেতু ধ্বংস
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার অন্তর্গত ইছাপুর সেতু ধ্বংসের উদ্দেশ্য ছিল। শক্রর যােগাযােগ একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া, যাতে তারা ভবিষ্যতে আর কোনাে সরবরাহ না পায়। পরিকল্পনায় ঠিক করা হলাে যে, ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর একইসঙ্গে ভুয়াপুর, গােপালপুর ও ইছাপুর আক্রমণ করা হবে। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক আঙ্গুর ও হুমায়ুনের কোম্পানি ইতােমধ্যে ভুয়াপুরের কাছেই অবস্থান নিয়েছে। হাকিম ও আজুর কোম্পানি। গােপালপুরের কাছে ওত পেতে আছে। বাঘা সিদ্দিকী তখন প্রায় ৩০ মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন। ৩১ অক্টোবর রাতের আঁধারে তিনি ইছাপুরের কাছে। পৌছালেন। সঙ্গে ক্ষুদ্র একটি দল ছিল বলে আত্মগােপন করে যাওয়া তাঁর। পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তাঁর দলের মুক্তিযােদ্ধারা সুবিধামতাে জায়গায় অবস্থান। নিয়েছেন। ঠিক রাত সাড়ে ৪টায় আক্রমণ শুরু হবে, এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঘা সিদ্দিকী ভীষণ অসুবিধায় পড়লেন। রাস্তার উভয় পাশেই পানি, কাজেই সােজাসুজি সেতুর কাছে যাওয়া সম্ভব হলাে না। তার দলকে দুই ভাগে বিভক্ত করে অনেক দূর থেকে এগিয়ে এসে সড়কের উপর দুই দিক থেকেই আক্রমণ করা হয়। বারুদ ও ডিনামাইট নিয়ে পিন্টু ও তাঁর সহযােদ্ধা কাছেই এক বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন।
শক্র বাংকারের ভিতরেই। ছিল, আকস্মিক হামলার মুখে তারা টিকতে পারলাে না। এলএমজি, এসএলআর আর টিএনটি স্ল্যাবের কান ফাটানাে শব্দে দিশাহারা হয়ে ওরা বিশৃঙ্খলভাবে পলায়ন করলাে। তবে ১জন মিলিশিয়া জোয়ান বাংকার থেকে এলএমজি চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে কিছুতেই হার মানানাে যাচ্ছে না। এ সময় মুক্তাগাছার দুঃসাহসী ছেলে মকবুল সবার দৃষ্টির আড়ালে বুকে হেঁটে বাংকারের একেবারে কাছে গিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে তার উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করলেন। দেখতে দেখতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে মিলিশিয়াটির দেহ টুকরাে টুকরাে হয়ে উর্ধ্বে নিক্ষিপ্ত হলাে। উল্লসিত মকবুল অধিনায়ককে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠলেন “স্যার, শালাকে খতম করেছি।” বাঘা সিদ্দিকী দলবল নিয়ে সেতুর উপর উঠে এলেন। এরপর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বিস্ফোরক বসিয়ে ভাের ৫টার সময় বারুদে আগুন দেয়া হলাে। মাঠঘাট-জনপদ কাপিয়ে গগনবিদারী শব্দে ইছাপুর সেতু বিধ্বস্ত হলাে।ধল্লা ব্রিজে অভিযান ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর থানার ধল্লা ব্রিজ অভিযান ছিল বাতেন বাহিনীর একটি দুঃসাহসিক অভিযান। এ ব্রিজে পাহারার কাজে নিয়ােজিত ছিল রাজাকার বাহিনীর ২০জন সদস্য। তারা ব্রিজের দুই পাশে ১১জন করে অবস্থান করতাে। এ সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত হানাদার বাহিনীর ট্রাক, জিপ ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আসা-যাওয়া করতাে। ব্রিজের পাহারাদার রাজাকাররা নিরীহ পথচারীদের এবং আশপাশের গ্রামের লােকদের অত্যাচার-নির্যাতন এবং তাদের সর্বস্ব লুট করতাে। এ ধরনের অভিযোেগ শােনার পর বাতেন বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন ধল্লা ব্রিজ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অভিযান পরিচালনার জন্য ব্রিজের খুঁটিনাটি বিবরণসহ বিস্তারিত তথ্যাবলি সগ্রহ করেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে, খন্দকার আব্দুল বাতেন একটি ছিপ নৌকায় ২৫জন রেখে বাকি ২০জনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিজের দিকে অগ্রসর হন। ২০জনের সবাই ছিলেন শর্ট আর্মসে সুসজ্জিত। তারা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সবাই হাজি সাহেবদের পােশাক পরেন। ব্রিজের কাছাকাছি পৌছানাের একটু আগেই হানাদার বাহিনীর ২টি ট্রাক টাঙ্গাইলের দিকে চলে যায়। পরিকল্পনা অনুসারে অধিনায়কের নেতৃত্বে ১০জনের একটি দল অগ্রগামী হয়ে যায়। ১০জনকে পিছন থেকে অনুসরণ করে অপর ১০জনের দলটি। অগ্রগামী ১০জন ব্রিজের দক্ষিণ পাশের প্রান্ত সীমায় অবস্থানরত ১০জন রাজাকারকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেন এবং হাত-মুখ বেঁধে ফেলেন। পিছনের অনুসরণকারী দলের ১০জন ব্রিজের উত্তর পাশের রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেন এবং বন্দি করেন। ৫ মিনিটের মধ্যে ২০জন রাজাকার বন্দি করে বাতেন বাহিনীর বীর যােদ্ধারা ছিপ নৌকা নিয়ে দ্রুতগতিতে সরে পড়েন।
চারাবাড়ির যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ১৯ অক্টোবর টাঙ্গাইল সদর থানাধীন চারাবাড়ি অভিমুখে ঢাকা থেকে আগত পাকিস্তানি সেনাদের রসদবহনকারী ৩টি নৌকা মুক্তিযােদ্ধারা আটক করে ৩,৩০০ মণ গম হস্তগত করেন। গম প্রাপ্তিতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আহারের সুব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। এ অভিযানে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর মুক্তা মিয়া, নূরুল ইসলাম ও আবু বক্কর সিদ্দিকী নেতৃত্ব প্রদান করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!