You dont have javascript enabled! Please enable it!
সরারচর রেলস্টেশনের যুদ্ধ
সরারচরের অবস্থান
সরারচর রেল স্টেশন হলাে ময়মনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বাজিতপুর থানার অন্তর্গত রেল স্টেশন। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে বাজিতপুরও একটি সমতল এলাকা। বাজিতপুরের অধিকাংশ এলাকা হাওড়, বিল-ঝিল, নদীনালায় বেষ্টিত। যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত। বর্ষাকালে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা। থানা সদরের ৩ কিলােমিটার পূর্ব দিয়ে মেঘনার শাখা ঘােড়াউত্রা নদী উত্তর-দক্ষিণ বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। ৫-৬ কিলােমিটার পশ্চিমে ভৈরব থেকে কিশােরগঞ্জ রেললাইনের মধ্যবর্তী স্থানে সরারচর রেল স্টেশন। দক্ষিণে কুলিয়ারচর থানা, দূরত্ব ৭ কিলােমিটার। উত্তরে নিকলী থানার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলােমিটার। এর ৬ কিলােমিটার উত্তরে হিলােছিয়া গ্রাম অবস্থিত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সরারচরের গুরুত্ব
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভৈরব-কিশােরগঞ্জের মধ্যে রেল যােগাযােগের জন্য সরারচর রেল স্টেশনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনীকে ঢাকা থেকে কিশােরগঞ্জ পাঠানাের জন্য ভৈরব ও বাজিতপুর থানার উপর দিয়ে কিশােরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে যেতে হতাে। বাজিতপুর থানা সদর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ স্থল। ভৈরব ও আশুগঞ্জ নদীর উভয় তীর ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড়াে ঘাঁটি ছিল। কিশােরগঞ্জ ও ভৈরব বাজারের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল রেলপথ। মেঘনা নদীকে ঘিরে ভৈরব ও কিশােরগঞ্জের মধ্যে রেলপথে যােগাযােগের অন্যতম স্টেশন ছিল সরারচর। নদীপথ, রেলপথ, সড়কপথ সব দিক থেকেই যােগাযােগের জন্য সরারচর রেল স্টেশনটি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
বাজিতপুর ছিল ৭০ উইং রেঞ্জার্স ফোর্সের অপারেশনাল এলাকায়। বাজিতপুর থেকে ৫-৬ কিলােমিটার পশ্চিমে সরারচর রেল স্টেশনের নিকটবর্তী শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর রেঞ্জার্স ফোর্সের ঘাটি। এর সাথে ছিল প্রায় ৩ শতাধিক স্থানীয় রাজাকার। এ ছাড়া ভৈরবে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর গানবােটের অবস্থান ছিল। এ গানবােটগুলাে পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিয়মিত টহল দিত। এ ছাড়া গচিহাটা ও কুলিয়ারচর রেল স্টেশনে অবস্থিত ছিল রাজাকার। ক্যাম্প। এখান থেকে রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের চারপাশ এবং রেলসেতু পাহারা দিত। সরারচর রেল স্টেশনে একটি রেল ইঞ্জিন সার্বক্ষণিক চালু অবস্থায় রাখার ব্যবস্থা ছিল। কোথাও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পাওয়া গেলে সাথে সাথে রি-ইনফোর্সমেন্টের জন্য এ রেল ইঞ্জিনকে ব্যবহার করা হতাে। রেল ইঞ্জিনের সম্মুখভাগে বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার বানানাে ছিল। এ বাংকারে সব সময় মিলিশিয়া অথবা রাজাকার পাহারায় রাখা হতাে।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রাথমিক অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল ভৈরব ও আশুগঞ্জ এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান পরিবর্তনের পর। জনগণের মধ্যে প্রতিরােধ গড়ে তােলার লক্ষ্যে স্থানীয় তরুণদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মে মাসের মধ্যে বাজিতপুর এলাকায়। মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিশালী অবস্থান গড়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী কুলিয়ারচর থানার অধীন কাশিমনগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমপি ইউনিট থেকে পালিয়ে আসা। হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খান যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে স্থায়ীভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে একটি মুক্তিবাহিনী দল গঠন করেন। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত এবং কারাবরণকারী রাজনীতিবিদ ইন্দু ভূষণ এলাকার মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়ােজিত ছিলেন। বেলাবাে গ্রামের আবদুল হাইয়ের বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের আরও একটি গােপন ঘাঁটি এবং প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
বাজিতপুর থানার অবস্থান বাংলাদেশের অনেক অভ্যন্তরে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। এখানে বড়াে ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করা কৌশলগত কারণেই কষ্টকর ছিল। হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে বাজিতপুর অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধগুলাের মধ্যে সরারচর রেল স্টেশনের যুদ্ধ অন্যতম।
যুদ্ধ পরিচালনা
বাজিতপুর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের মূল অবস্থান ছিল বেলাবাে ও হিলােছিয়া গ্রামে। সরারচর রেল স্টেশন আক্রমণের জন্য স্থানীয় অধিনায়ক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযােদ্ধা দল সংগঠিত হয়।
আক্রমণের পূর্বে গ্রুপ অধিনায়ক হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খান কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে দিয়ে এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান যাচাই করেন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রাজাকারের একটি দল সরারচর রেল স্টেশনে পাহারায় নিয়ােজিত আছে এবং মূল দল স্টেশনের নিকটবর্তী শিবনাথ স্কুলে অবস্থানরত। পরিকল্পনামতাে ২০ অক্টোবর মধ্যরাতে সরারচর রেল স্টেশন ধ্বংসের লক্ষ্যে আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয়। গ্রুপ অধিনায়ক হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খান তাঁর দলকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। আফাজ উদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে প্রথম দল পূর্ব দিক থেকে, ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় দল পশ্চিম দিক থেকে এবং মেজবাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে তৃতীয় দল দক্ষিণ দিক থেকে সরারচর রেল স্টেশনের নিকটবর্তী শিবনাথ বিদ্যালয়ে অবস্থানকারী মূল ঘাঁটির উপর সরাসরি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। আক্রমণের সময় নির্ধারিত করা হয়েছিল রাত ৩টা ৩০ মিনিট।
দলের অধিনায়কদের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা সন্ধ্যার পর পরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রবর্তী লক্ষ্মীপুর ও ডুমরাকান্দা গ্রামে সমবেত হন। রাত ১২টা ৩০ মিনিটে পুনরায় যাত্রা করে মুক্তিযােদ্ধা দলটি আক্রমণ স্থলের নিকটবর্তী গ্রাম রামদিতে অবস্থান গ্রহণ করে। অধিনায়ক হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খান তিন ভাগে বিভক্ত দলনেতাদের রাত ৩টার মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে ৩টা ৩০ মিনিটে চূড়ান্ত আক্রমণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। আক্রমণের ধারাবাহিকতা হিসেবে বলা হয়, ঘড়ির কাটায় ৩টা ৩০ মিনিট বাজার সাথে সাথে নিকটবর্তী ঝুমাপুর সেতু আক্রমণ করা হবে। এ সেতু ধ্বংসের শব্দ শােনার সাথে সাথে সরারচর রেল স্টেশনে অবস্থানরত রাজাকারদের উপর আক্রমণ রচনা এবং তাদের নিষ্ক্রিয় করতে হবে। একই। সময় দলের অধিনায়ক মেজবাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী দল শিবনাথ বিদ্যালয়ে অবস্থানকারী মূল শত্রু ঘাটির উপর আক্রমণ পরিচালনা করবে।
পরিকল্পিত এ আক্রমণের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে সরারচর রেল স্টেশনে ২জন রাজাকার নিহত হয় এবং অনেকে আহত অবস্থায় পালিয়ে যায়। অধিনায়ক হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন পূর্ব ও পশ্চিম দিকের ২টি দলকে আরও নিকটবর্তী অবস্থানে এগিয়ে নিয়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর মূল ঘাঁটি স্কুলগৃহের উপর আক্রমণ চালান। মুক্তিবাহিনীর নিক্ষেপিত রকেট লঞ্চার স্কুলগৃহের টিনের চাল ভেদ করে ভিতরে বিস্ফোরিত হলে বেশ কয়েকজন রাজাকার আহত হয় এবং ১জন রেঞ্জার্স মারা যায়। স্কুলগৃহের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি বড় আকারের নালা ছিল। অধিনায়ক। মেজবাহ উদ্দিনের দল নালা দিয়ে ছাত্রাবাসের ভিতর প্রবেশের চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধারা নালার অভ্যন্তরে ছড়ানাে-ছিটানাে ও পুতে রাখা বাঁশের কঞ্চির আঘাতে আহত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। দিনভর যুদ্ধে শত্রু অবস্থানে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে গিয়ে অধিনায়ক আফাজ উদ্দিন ভূঁইয়া গুলিবিদ্ধ হন। আবদুল খালেক নামের আরও একজন মুক্তিযােদ্ধা মুখে গুলিবিদ্ধ হলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সাময়িক হতাশা পরিলক্ষিত হয়। মুক্তিবাহিনী পরের দিন। ও সারারাত পাকিস্তানি রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের অবরােধ করে রাখে। শেষ রাতে রেঞ্জার্সরা রাজাকারদের দিয়ে জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে দিতে রেললাইন ধরে পালিয়ে কিশােরগঞ্জ চলে যায়। ২২ অক্টোবর সকালে মুক্তিবাহিনী শিবনাথ স্কুলে প্রবেশ করে।
সরারচর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা সরারচর রেল স্টেশন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খান
২. নূরুল হক।
৩. আবদুল হক
৪. সালাহ উদ্দিন
৫. মইনুল হক।
৬, আশরাফ উদ্দিন
৭. ইব্রাহিম
৮. আতর আলী
৯, হামিদ উদ্দিন
১০. সেলিম
১১, সাহেব আলী
১২. দুদু মিয়া
১৩. হাজি জুলমত নূর
১৪. আবদুর রহিম
১৫. রইচ উদ্দিন।
১৬. আজিজুর রহমান
১৭. শাহজাহান
১৮. নূরুল আমিন মােল্লা
১৯. আবদুল মান্নান-১ ২০. কামাল
২১. আবদুল মান্নান-২
মুক্তিযােদ্ধারা নালার অভ্যন্তরে ছড়ানাে-ছিটানাে ও পুতে রাখা বাঁশের কঞ্চির আঘাতে আহত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। দিনভর যুদ্ধে শত্রু অবস্থানে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে গিয়ে অধিনায়ক আফাজ উদ্দিন ভূঁইয়া গুলিবিদ্ধ হন। আবদুল খালেক নামের আরও একজন মুক্তিযােদ্ধা মুখে গুলিবিদ্ধ হলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সাময়িক হতাশা পরিলক্ষিত হয়। মুক্তিবাহিনী পরের দিন। ও সারারাত পাকিস্তানি রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের অবরােধ করে রাখে। শেষ রাতে রেঞ্জার্সরা রাজাকারদের দিয়ে জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে দিতে রেললাইন ধরে পালিয়ে কিশােরগঞ্জ চলে যায়। ২২ অক্টোবর সকালে মুক্তিবাহিনী শিবনাথ স্কুলে প্রবেশ করে। সরারচর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা সরারচর রেল স্টেশন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. হাবিলদার মেজবাহ উদ্দিন খান
২. নূরুল হক।
৩. আবদুল হক
৪. সালাহ উদ্দিন
৫. মইনুল হক।
৬, আশরাফ উদ্দিন
৭. ইব্রাহিম
৮. আতর আলী
৯, হামিদ উদ্দিন
১০. সেলিম
১১, সাহেব আলী
১২. দুদু মিয়া
১৩. হাজি জুলমত নূর
১৪. আবদুর রহিম
১৫. রইচ উদ্দিন।
১৬. আজিজুর রহমান
১৭. শাহজাহান
১৮. নূরুল আমিন মােল্লা
১৯. আবদুল মান্নান-১ ২০. কামাল
২১. আবদুল মান্নান-২

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!