You dont have javascript enabled! Please enable it! হরছলা সেতু ধ্বংস - দুর্গাপুর অ্যামবুশ - নাটিয়াপাড়া (ইসলামপুর) সেতু ধ্বংস - ঘােনাবাড়ির যুদ্ধ - গােপালপুর অভিযান - সংগ্রামের নোটবুক
হরছলা সেতু ধ্বংস
হরছলা সেতুটি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার অধীন কাওরাঈদ ও মশাখালী স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। এ সেতুটি ময়মনসিংহ, বাহাদুরাবাদ ঘাট ও জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে উত্তরবঙ্গের সাথে যােগাযােগ। রক্ষাকারী রেললাইনের একটি সেতু। এ সেতু পাহারায় পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা রাজাকার বাহিনী মােতায়েন ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী গফরগাঁও থানা সদর থেকে এ রেললাইন ধরে নিয়মিত টহল দিত। ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রাতে সুবেদার আবুল বাশারের নেতৃত্বে। একদল মুক্তিযােদ্ধা হরছলা রেলসেতুতে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। এ সেতু ধ্বংসের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. সুবেদার আবুল বাশার
২. ফজলুল হক।
৩. হাবিবুর রহমান
৪. আবদুস সালাম ভূইয়া
৫. আবদুল মান্নান
৬. মফিজ উদ্দিন।
৭. শাহ কামাল
৮. আশরাফ আলী
৯. সেলিম
১০. আসাদুজ্জামান প্রমুখ।
দুর্গাপুর অ্যামবুশ
দুর্গাপুর থানাটি হলাে নেত্রকোনা জেলায়। এটা একটি সীমান্তবর্তী থানা। এ থানার পাশেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। দুর্গাপুর থানা সদরে পাকিস্তানি। বাহিনীর নিয়মিত অবস্থান ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত অঞ্চলের আশপাশের এলাকাগুলােয় নিয়মিত টহল দিত। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত এ টহল দলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর থানার পার্শ্ববর্তী এলাকার। রাস্তার মােড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দলের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ঘন্টা খানেক গুলিবর্ষণের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ২জন সদস্য শহিদ হলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে নিরাপদ অবস্থানে ফিরে আসে।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. আবদুল রফিক
২. তােফাজ্জল হােসেন চুন্ন
৩. আলতাব হােসেন
৪, রিয়াজ উদ্দিন।
৫. মতিউর রহমান
৬. রফিক উদ্দিন ভূঞা
৭. আবদুল আজিজ
৮. হাবিবুর রহমান।
৯. এবাদুল ইসলাম
১০. আবদুল হাকিম।
১১. আবদুল খালেক প্রমুখ।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. সন্তোষ
২. কুদ্দুছ মিয়া।
নাটিয়াপাড়া (ইসলামপুর) সেতু ধ্বংস
টাঙ্গাইল সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে বাশাইল থানায় নাটিয়াপাড়া অবস্থিত। ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল ১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর নাটিয়াপাড়া সেতু ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পুলের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত রাজাকারদের উপর হামলা চালায়। সেতু থেকে রাজাকারদের বিতাড়িত করে ৮-১০টি রাইফেল, হাজার তিনেক গুলি, ২০টি গ্রেনেড উদ্ধার করতে পারলেও এখানে মুক্তিবাহিনীর বীরযােদ্ধা ইব্রাহীম শহিদ এবং মুক্তিযােদ্ধা ছানুসহ অন্যজন সামান্য আহত হন। শহিদ ইব্রাহীম ছিলেন ইপিআর-এর নায়েক। মর্টার থেকে গুলি ছোড়ার সময় শত্রুর একটি গুলি তার বুকে বিদ্ধ হলে তিনি সাথে সাথেই শাহাদতবরণ করেন। সেতু দখলের লড়াইয়ে ৩জন। রাজাকার নিহত হয়।
ঘােনাবাড়ির যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। বল্লার শত্রু ঘাটি মুক্তিযােদ্ধারা অবরােধ করে রেখেছেন। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক ফজলুর নেতৃত্বে ৩০০ মুক্তিযােদ্ধা ৪ দিন ধরে শত্রুর উপর চরম আঘাত হেনে চলেছেন। বল্লার দখল তাদের চাই-ই চাই। ৬ অক্টোবর দুপুরে ১৫-২০জন। মুক্তিযােদ্ধা ঘােনাবাড়ির একটি বাড়িতে খেতে বসেছেন। এ সময় ১জন দালাল শত্রুর শিবিরে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের খবর দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা কেবল পাহারা রেখে দুপুরে খাবার খেতে বসেছেন, ঠিক এমন সময় পাহারারত মুক্তিযােদ্ধাটি খবর দেন, হানাদাররা বাড়িটি ঘিরে ফেলেছে। ২০জন মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে ১৫জনই খেতে বসেছিলেন। খাওয়া রেখে অস্ত্র হাতে শত্রুর মােকাবিলায় তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে ছুটলেন। বাড়িটি ঘিরে ফেলে ১৬-১৭জন শত্রু ক্রলিং করে পশ্চিম দিক থেকে বাড়িটিতে উঠতে যাচ্ছিল। এটা লক্ষ্য করে মুক্তিযােদ্ধা মােমেন ও আবু হানিফ দৌড়ে গিয়ে তাদের উপর গুলি ছোড়া শুরু করে। সামান্য একটু আড়াল নিয়ে ১০-১২ গজ দূর থেকে শক্রর উপর এমন দুঃসাহসিক আক্রমণ খুব কমই হয়েছে। মােমেন ও আবু হানিফ এবং আরও ২জন মুক্তিযােদ্ধার অবিরাম গুলির মুখে পশ্চিম দিকে শত্রুদের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। শুধু রুদ্ধ নয়, সেখানে ৮জন শক্র নিহত ও ৪জন মারাত্মক আহত হয়। অবস্থা চরম প্রতিকূল ও ভয়াবহ দেখে হানাদাররা লাশ ফেলে পিছু হটছিল। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। তারা আড়াল থেকে বেরিয়ে আরও এগিয়ে হানাদারদের উপর গুলি চালাতে থাকেন। হঠাৎ হানাদারদের একটি গুলি এসে মােমেনের বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায় ।
তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মােমেন ও হানিফ শহিদ হলে বাড়ির পশ্চিম দিকের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেখে তা সুদৃঢ় করতে এগিয়ে আসেন রকেট ও আমীর। আমীরের নাম যদিও তাঁর পিতামাতার দেয়া, তবে রকেটের আসল নাম কী, তা মুক্তিযােদ্ধারা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। দ্রুত চলতে পারতেন বলে জুলাই মাসের শেষে সদর দপ্তরের সহকর্মীদের অনুরােধে তার নাম দেয়া হয়েছিল রকেট। সে সময় থেকে রকেট নামের নিচে তার আসল নাম চাপা পড়ে যায়। রকেট ও আমীর পশ্চিম দিকে এসে অবস্থান নেয়ায় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তুমুল যুদ্ধ চলে। মুক্তিবাহিনীর ২জন শহিদ এবং ৩জন আহত হয়েছেন।
গােপালপুর অভিযান
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে উত্তরে জামালপুর জেলার সীমান্তে গােপালপুর থানা। অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর গভীর রাতে গােপালপুরে শক্রদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলাে। অধিনায়ক হাকিম, হুমায়ুন, তারা ও বেনুর নেতৃত্বে। মুক্তিযােদ্ধারা বীর বিক্রমে সারারাত এবং ৮ অক্টোবর সারাদিন যুদ্ধ চালালেন। কিন্তু হানাদার ঘাঁটির পতন তারা ঘটাতে পারলেন না। ৭ অক্টোবর যুদ্ধ পরিকল্পনার সময় ঠিক হয়েছিল; যাকে বা যাদেরকে যে যে অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হবে, তাকে বা তাদেরকে সে অভিযানে অবশ্যই সফল হতে হবে। হানাদারদের ঘাটি দখল না করে ফেরা চলবে না। ফুলতলা সেতু ধ্বংস ও কুদুসনগর দখলের পর গােপালপুর মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে সম্মানের লড়াই হয়ে। দাঁড়ায়। তারা গােপালপুর থানা দখল না করে পিছু হটতে রাজি নন। ৮ অক্টোবর সারাদিন গােপালপুর থানার উপর নির্ভুল লক্ষ্যে প্রায় ৩০০ ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করার পরও যখন হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটল না, তখন পরবর্তী রণকৌশল কী হওয়া উচিত, অধিনায়ক হাকিমকে তা ভাবিয়ে তুলল। ইতােমধ্যে আক্রমণে সাহায্য করতে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল থেকে হানাদার বাহিনীর ৩০০জন নিয়মিত সৈন্যের একটি দল গােপালপুরে এসে পৌঁছে। তাতে গােপালপুরের হানাদারদের মনােবল অনেকটা বেড়ে গেছে। ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় গােপালপুর অভিযানের নেতা অধিনায়ক হাকিমকে। নির্দেশ পাঠানাে হলাে, “যেহেতু মুক্তিবাহিনীর প্রথম আঘাত হানাদাররা সামলে নিয়েছে; সেহেতু গােপালপুর ঘাটি দখল কষ্টসাধ্য হবে। আজ যে বিপুল পরিমাণ গােলাগুলির শ্রাদ্ধ হয়েছে; তা একেবারে নিষ্প্রয়ােজন। গােলাগুলি আর খরচ না করে গােপালপুর থানাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখে এবং সময় ও সুযােগমতাে চোরাগােপ্তা আঘাত হানাে।
মুক্তিযােদ্ধারা ঘাঁটি দখল করতে পারেনি বলে লজ্জা অথবা অপমানবােধের কোনাে কারণ নেই। গােপালপুর ঘাটি থেকে হানাদারদের অবাধে বাইরে বেরােনাে বন্ধ করে দিতে পারলেই অধিনায়ক খুশি হবে।” মুক্তিযােদ্ধারা অত্যন্ত সফলতার সাথে গােপালপুর ঘাটির হানাদারদের বলতে গেলে শিবিরবন্দি করে রাখতে সমর্থ হন। হানাদারদের অবরুদ্ধ রাখার সময় কয়েকটি অভূতপূর্ব ও চমকপ্রদ সাফল্য আসে। তার একটি হচ্ছে: অধিনায়ক হাকিমের কোম্পানির ১২-১৩ বছরের এক ক্ষুদে মুক্তিযােদ্ধা ভুলু চায়ের দোকানের কাজের ছেলের ছদ্মবেশে গােপালপুর হানাদারদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করে সেখানে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ৮জন হানাদার খতম করতে সক্ষম। হয়। গােপালপুরের হানাদারদের আরও কোণঠাসা করে ফেলার উদ্দেশ্যে অধিনায়ক হাকিমের দল টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহের দিক থেকে গােপালপুরে আসার একমাত্র পাকা রাস্তার উপর সবচেয়ে বড়াে সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। শহিদ ওরফে লালু, ভুলু ও অন্যান্য ৪-৫জন ক্ষুদে মুক্তিযােদ্ধার প্রতিরাতে ঘাটির আনাচকানাচে গ্রেনেড নিক্ষেপের ফলে শত্রুর অবস্থান বেশ দুষ্কর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, এমন কোনাে দিন যায়নি, যেদিন ওত পেতে বসে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে ২-১জন শক্র মৃত্যুবরণ করেনি। গােপালপুর থানা অবরােধে অধিনায়ক তারার কোম্পানি ব্যাপক সফলতা লাভ করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড