You dont have javascript enabled! Please enable it! ফুলতলা সেতুতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষায় আঘাত - মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানা আক্রমণ - ধরমপাশা থানা আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
ফুলতলা সেতুতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষায় আঘাত
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানায় ফুলতলা সেতু অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর শবেবরাতের রাতের শেষ দিকে মুক্তিযােদ্ধা কাদের সিদ্দিকী তাঁর সহযােদ্ধাদের নিয়ে এবাদত-বন্দেগি করার পর সেতু আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন। রাত ২টার দিকে ফুলতলা গ্রামের ভিতর দিয়ে হেঁটে দলটি ফুলতলা ব্রিজের কাছে পৌছে যায়। উত্তর দিক থেকে রাস্তার উপর উঠে দলটি সােজা পুলে আঘাত হানে। প্রায় ১৫ মিনিটের একতরফা ফায়ারের ফলে ফুলতলা সেতুর এক অংশের পতন ঘটে। কিন্তু দক্ষিণ অংশে শত্রু বাংকার থেকে এলএমজি ফায়ার করতে থাকে। এমন সময় মুক্তিযােদ্ধা মকবুল হােসেন বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গিয়ে ঐ বাংকারটিতে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারেন। সাথে সাথে এলএমজি-এর ফায়ার বন্ধ হয়ে যায়। শত্রুর দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে সেতু মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে চলে আসে। অতঃপর ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ বিস্ফোরক লাগিয়ে সেতুটি ধ্বংস করে।
মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানা আক্রমণ
মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানার অবস্থান – বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি থানা মােহনগঞ্জ। এ থানাটি মহকুমার পূর্ব সীমান্তে সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) গা ঘেঁষে অবস্থিত। নেত্রকোনা থেকে একটি রেললাইন মােহনগঞ্জ এসে মিশেছে। একটি পাকা রাস্তা মােহনগঞ্জ থেকে ৬-৭ কিলােমিটার উত্তরে বারহাট্টা পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা দুই জেলার দুই থানা হলেও অবস্থান ছিল পাশাপাশি। দুই থানার সীমানা নির্দেশ করে সুরমা নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। মােহনগঞ্জ থানা। ভারতের আসাম সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ কিলােমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। আর ধরমপাশা থেকে সীমান্তের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলােমিটার।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশার গুরুত্ব
ভারত সীমান্ত থেকে বেশ অভ্যন্তরে হলেও মােহনগঞ্জ হয়ে ভৈরবের সাথে রেল যােগাযােগ ছিল, যা বর্তমানেও আছে। পাশাপাশি সুরমা নদী পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীপথেও এ অঞ্চলে শত্রু সৈন্যদের যাতায়াতের সুবিধা ছিল। এ অঞ্চলটি নদী, হাওড়, বিল, ঝিল, খাল ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ একটি দুর্গম এলাকা। ফলে মুক্তিবাহিনীর আত্মগােপন করা, গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ। পরিচালনা, এ পথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য এলাকাটি ছিল উপযােগী ও নিরাপদ। আবার উভয় বাহিনীর জন্য এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, নদীপথ ও রেলপথ উভয় দিক দিয়ে যােগাযােগের জন্য মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানার বিশেষ গুরুত্ব ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
ময়মনসিংহ জেলার অধীন নেত্রকোনা মহকুমা (বর্তমানে জেলা) এলাকার নিয়ন্ত্রণভার রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল ৭১ উইং রেঞ্জার্স ফোর্স। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি থানায় পুলিশ ও রাজাকারসহ রেঞ্জার্স ফোর্সের অবস্থান ছিল। ধরমপাশা সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) হওয়াতে এতদঞ্চলের নিয়ন্ত্রণভার রক্ষার দায়িত্বে ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ৯১ মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের উপর। ধরমপাশা থানায় ৯১ মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের ১ কোম্পানি সৈন্য এবং রাজাকার ও পুলিশ সদস্য নিয়ােজিত ছিল। ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকা ছিল ছাতক, জৈন্তাপুর ও সিলেট । রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ছিল সিলেটে। আর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ৯১ মুজাহিদ ছিল ১৪তম পদাতিক ডিভিশনের অধীন।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
এলাকায় অসংখ্য রাজাকার ক্যাম্প এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান থাকায় এ এলাকায় মুক্তিবাহিনী কোনাে ক্যাম্প স্থাপন করতে পারেনি। নেত্রকোনা মহকুমার মােহনগঞ্জ ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন এবং সুনামগঞ্জ মহকুমার ধরমপাশা ছিল ৫ নম্বর সেক্টরের অধীন। মহিষখােলা সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান এ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কিশােরগঞ্জ এলাকায় অবস্থান নিতে প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনী। কিশােরগঞ্জ থানা এলাকায় পৌছানাের পূর্বে পথিমধ্যে মােহনগঞ্জ ও ধরমপাশা থানা দখল করে।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান একটি বড়াে আকারের মুক্তিযােদ্ধা দল এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ কিশােরগঞ্জ অঞ্চলে ঘাটি স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভারতের মহিষখােলা সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে ধরমপাশা ও মােহনগঞ্জ থানার উপর দিয়েই কিশােরগঞ্জ যাওয়ার পথ। শক্রকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান কৌশলগত কারণেই যাত্রাপথে শত্রুর অবস্থানগুলাে দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ পরিকল্পনার অধীন প্রথমে তিনি ধরমপাশা থানা এবং পরে মােহনগঞ্জ থানার। উপর আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
যুদ্ধের বিবরণ
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও সুবেদার মুসলেহ উদ্দিন নেত্রকোনা ও কিশােরগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ২ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাসহ ভারতের মহেষখােলা সীমান্ত অতিক্রম করে। বাংলাদেশের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমা এলাকায় প্রবেশ করেন। তিনি পুরাে মুক্তিযােদ্ধা দলটিকে কয়েক ভাগে ভাগ করে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। মােহনগঞ্জ থানা আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে দলটি অগ্রসর হলেও ভৌগােলিক ও অবস্থানগত কারণে তাদের জন্য সুনামগঞ্জ জেলার অধীন ধরমপাশা থানা শত্রুমুক্ত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, ধরমপাশাকে এড়িয়ে মােহনগঞ্জ যেতে হলে পাকিস্তানি বাহিনীর এ অবস্থানের সম্মুখীন হতে হবে। আর ধরমপাশা থানাকে এড়িয়ে অগ্রসর হতে হলে পথের দূরত্ব প্রায় দেড় গুণ বেড়ে যায়। এ সময় নদীপথে আক্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
পরিকল্পনার এ পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মতিউর প্রথমে ধরমপাশা থানা শত্রুমুক্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে এলাকার যাদুকাটা খাল ধরে মুক্তিবাহিনীর নৌকা অগ্রসর হতে থাকে। চলার পথে তার সিদ্ধান্ত ছিল, অগ্রবর্তী। দল সম্মুখে পৌছে ক্লিয়ারেন্স দিলে মূল দল পিছন থেকে অগ্রসর হবে। এভাবে ৭ অক্টোবর রাতে মুক্তিযােদ্ধা দলটি সােমেশ্বরী নদীর ঘাটে এসে পৌছায়। পরবর্তী রাতের অন্ধকারে নদী অতিক্রম করে ৮ অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধা দলটি ধরমপাশা থানার উত্তরে সেলবােরাস নামক গ্রামে এসে অবস্থান গ্রহণ করে।
ধরমপাশা থানা আক্রমণ
ধরমপাশা থানা এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য থানার চারপাশে বাংকার ও ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মুজাহিদ ও রাজাকার বাহিনী সার্বক্ষণিক পাহারায় নিয়ােজিত ছিল। এ সময় ছাতক ও সুনামগঞ্জ থেকে সুরমা নদীতে পাকিস্তানি গানবােট টহল দিত। স্থানীয় অবস্থা এবং মুজাহিদ ও রাজাকার বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন মতিউর ধরমপাশা থানার উপর আক্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তিনি ২টি কোম্পানিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিন দিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। ৩টি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান, সুবেদার মুসলেহ উদ্দিন ইপিআর-এর নায়েক আবদুর রহমান। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ৩টি গ্রুপের সাথে সংযােগ রক্ষা। করা হয়। সন্ধ্যার পর পরই রাজাকার ও মুজাহিদ সৈন্যরা ট্রেঞ্চে অবস্থান গ্রহণের পূর্বেই তিন দিকের আক্রমণে তারা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। মটারের গােলা সরাসরি থানার উপর গিয়ে পড়ে । বড়াে ধরনের বিপর্যয়ের ভয়ে রাজাকার ও মুজাহিদ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে পিছন দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী থানা দখলের পর বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন শত্রু সৈন্যের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা মােয়াজ্জেম হােসেন শাহাদতবরণ করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড