দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে এই অসন্তোষ সৃষ্টি করা হয়েছিলো আমার ডেপুটির অফিস থেকে। আমাকে সাহায্য না করে বরং সে বিষয়টাকে উসকে দিলো। এমনকি যেসব অফিসারকে আমি সেখান থেকে নিয়ে আসলাম তারাও আমাকে ভুল বুঝতে শুরু করল। তাদেরকে সেখান থেকে বদলি করে দেয়াটা আমার প্রতি তাদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ধারাবাহিকভাবে র্যাংকের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে লাগলো এবং সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিষোগদার হতে লাগলো। আমি সব সময় বঙ্গবন্ধুকে এই অস্থিরতার ব্যাপারে জানিয়েছি। সরকার বিরোধী শক্তি এবং আমার ডেপুটি সহ আশাপাশের কিছু লোক বিষয়টাকে ব্যবহার করে ইস্যু তৈরি করতে লাগলো এবং এটি আরও বাড়তে থাকলো। সমস্ত পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠলো যখন খোদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হল। মেজর শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন এ ওয়াই বি নূর এবং আরও কিছু অফিসারকে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হল এবং চিফ অব স্টাফকে অবগত করা ছাড়াই এটি করা হল। এই কাজটি ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর শোকাবহ ঘটনার অন্যতম নিয়ামক।
মেজর ডালিম একজন উশৃংখল অফিসার হলেও বাকিরা নন। উপরে উল্লেখিত অফিসারদের অপরাধ এতোটা ছিলোনা যার জন্য তাদেরকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার মত কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এদের বিরুদ্ধে অপরাধ হচ্ছে তারা তাদের কলিগ মেজর ডালিমের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো। এটা তাদের চাকরী থেকে বরখাস্ত হবার মত শাস্তিযোগ্য নয়। বরং তার পরিবর্তে তাদেরকে প্রোমোশনের জন্য সিনিয়রিটি বাতিল করা অথবা বড় রকমের ভৎসনা করা যেতো। এটা সত্য যে মেজর ডালিম একজন উশৃংখল অফিসার। বঙ্গবন্ধু সহ সবাই তার চরিত্র সম্পর্কে জানতো। তারপরেও বঙ্গবন্ধু তাকে পছন্দ করতেন। মেজর ডালিমের এই উশৃংখল রেপুটেশন তার চাকরী থেকে বরখাস্তের অন্যতম কারণ।
তাদের ভাগ্যে কি আছে তা না জেনেই এসব অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। তারা ছিলো দেশপ্রেমে পূর্ণ তারুণ্যে ভরপুর একদল যুবক। তাদেরকে একটু সহানুভূতির সাথে নিয়ন্ত্রণ করার দরকার ছিলো। আমি মনে করি এদেরকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করাটা একেবারেই অন্যায় হয়েছে। সৈন্যদের সরকার-বিরোধী মনোভাব তৈরির এটি অন্যতম কারণ। এবং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে আওয়ামী লীগ সরকার সেনাবাহিনীকে পছন্দ করেনা। আমি এখন তাদের চাকরী থেকে বরখাস্ত হবার বিস্তারিত কারণ আলোচনা করব।
সেদিন ছিলো শনিবার। তারিখটা ২২ জুন ১৯৭৫। নিউ ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে লে কর্নেল রেজার বিয়ের রিসিপশনের আয়োজন করা হয়। এই অফিসার যাকে বিয়ে করছেন সে সম্ভবত মেজর ডালিমের কাজিন। এই বিয়ে উপলক্ষে মেজর ডালিম অনেককেই দাওয়াত করেছিল। এর মধ্যে রেড ক্রসের চেয়ারম্যান গাজি গোলাম মস্তফা ও তার পরিবার ছিল। গাজি সাহেব প্রোগ্রামে থাকতে পারেন নাই। তবে তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে এসেছিল। ঐ ফাংশনে মেজর ডালিমের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এসেছিল। সে সম্ভবত সুইজারল্যান্ড বা কানাডার রেসিডেন্ট। এই ভদ্রলোকের লম্বা চুল ছিলো। অতিথিরা যখন আসন গ্রহণ করছিলো তখন গাজি সাহেবের ছেলে ও তার বন্ধুরা ঠিক তার পেছিনেই বসেছিল। এই ছেলেগুলো কিছুটা দুষ্টু ছিলো এবং অনেকটা জোরেশোরেই তারা ঐ লোকের লম্বা চুল নিয়ে নানান মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল। সেসব মন্তব্যের মধ্যে একটি যেমন, “চুল কি আসল নাকি পরচুলা?” অথবা এমন কিছু যাতে ঘা লাগে। এক পর্যায়ে একটি ছেলে লোকটির চুল উঁচু করে ধরে। ভদ্রলোক ঘুরে তাদের দিকে মুখ করে তাদেরকে সংযত হতে বলেন। কিন্তু ছেলেগুলো আরও মজা পেয়ে যায় এবং আবারো চুল উঁচু করে ধরে। এইবার লোকটি উঠে দাঁড়ান এবং ছেলেটিকে থাপ্পড় দেন। এই ছেলেটি সম্ভবত গাজি সাহেবের ছোট ছেলে। ছেলেটি তখন দৌড়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে যে মেজর ডালিমের শালা তাকে থাপ্পড় দিয়েছে। এতে তিনি মেজর ডালিম ও নিমন্ত্রণকারীদের উপর ক্ষুব্ধ হন। মেজর ডালিম জানতে পেরে মিসেস গাজির কাছে যান এবং তার আত্মীয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু তিনি এতে খুশি না হয়ে বরং তার ছেলেকে বলেন বাড়ীতে গিয়ে বাবার কাছে নালিশ করতে। তখন ছেলেরা বাড়ীর দিকে যায় এবং এর প্রায় ৪৫ মিনিট পরে রেড ক্রসের মাইক্রোবাসে আরও ডজনখানেক অস্ত্রধারী লোক নিয়ে গাজি সাহেব রিসিপশনে উপস্থিত হন। সশস্ত্র গার্ডরা মাইক্রোবাস থেকে নেমেই কোন প্রশ্ন করা ছাড়াই মেজর ডালিমকে ধরে টেনে মাইক্রোবাসের দিকে নিয়ে আসে। সে তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলো। তাকে কেউ সাহায্য করতে আসেনি। কারণ আর্মড গার্ডদের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা ভীতিকর ছিলো।
মেজর ডালিমের স্ত্রী যখন ঘটনাটা দেখলেন তিনি দৌড়ে এসে তার স্বামীকে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন। যখন তিনি তা করতে পারছিলেন না তখন একবারে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করছিলেন যাতে তাকে (ডালিমকে) টেনে গাড়ি পর্যন্ত নিতে না পারে। ধস্তাধস্তির ফলে তার ব্লাউজ ছিঁড়ে যায় এবং তার শরীর থেকে শাড়ীটা প্রায় খুলে যায়। তবু তিনি তার স্বামীকে ছাড়ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র দল তাদের দুইজনকেই গাড়িতে তুলতে সমর্থ হয়। গাড়িটা অতিথিদের দৃষ্টির কিছুটা আড়ালে ছিলো। গাজি সাহেব মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসা ছিলেন। বেশিরভাগ অতিথি হাইজ্যাকিং এর বিষয়টা লক্ষ্য করলেন গাড়িটা চলে যাবার পর। ঘটনাটা এতো দ্রুততার সাথে হয়েছিলো যে কেউ সাহায্য করতে সুযোগই পায়নি। যারা দেখেছে তারাও অস্ত্রবাহী দলের কারণে সামনে আসার সাহস পায়নি। একজন চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে তখন লেডিস ক্লাব থেকে ডা. রহিম (ডেন্টাল স্পেশালিষ্ট) দৃশ্যটি দেখে প্রভোস্ট মার্শাল লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ সামাদকে ফোন করেন এবং তাকে বিষয়টা জানান। লে কর্নেল সামাদ বিষয়টা ভেরিফাই করার জন্য পুলিশের আই জি (IGP) নুরুল ইসলাম সাহেবের কাছে বললে তিনি এব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানালেন।
প্রভোস্ট মার্শাল লে কর্নেল সামাদ তখন সাথে সাথে এডজুটেন্ট জেনারেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল) এই এম এরশাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পেলেন না। AG র সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তিনি ঘটনার খারাপ ফল চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে OC MP ইউনিট মেজর (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) আমিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলেন। তিনি তাকে বললেন গাজি সাহেবের বাসা থেকে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে। যখন এই ট্রুপ্স গাজি সাহেবের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো তখন রক্ষীবাহিনীর সদস্য ভর্তি আরেকটি ট্রাক তাদেরকে ফলো করতে শুরু করে। এটা জানা যায়নি যে কেন তারা তাদের ফলো করছে এবং কারণই বা কী। OC MP ইউনিটকে বিষয়টা জানানো হয় এবং সেখান থেকে নির্দেশ দেয়া হয় যে রক্ষীবাহিনী যদি অস্বাভাবিক কিছু করার চেষ্টা করে তবে যেন তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। যদিও সেরকম কিছু হয়নি। লে কর্নেল সামাদ OC MP ইউনিটকে নির্দেশনা দেবার পর কর্নেল জামিল [MS(P)] কে বিষয়টা অবগত করেন। এবং তিনি (লে কর্নেল সামাদ) কী ব্যবস্থা নিয়েছেন সেটাও জানান। মিলিটারি পুলিশের প্রতি অর্ডার ছিলো গাজি সাহেবের কাছে জিম্মি মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে নিরাপদে উদ্ধার করার।
মুহূর্তের মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে দাবানলের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল যে গাজি গোলাম মোস্তফা ও তার সশস্ত্র দল মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। এটা শুনে অনেক আর্মি অফিসার নিজ দায়িত্বে মোটর বাইক নিয়ে গাজি গোলাম মোস্তফার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এই সেনা তৎপরতায় আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যেন আর্মি অফিসাররা গাজির বাড়ি রেইড করতে যাচ্ছে। আর্মি অফিসারদের এই কাণ্ডে প্রেসিডেন্ট খুশি হননি এবং বিষয়টা নেগেটিভলি নিয়েছিলেন। অভিযোগ করা হয় যে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রীকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন মেজর ডালিম চিৎকার করে গাজিকে বলছিলেন যে তাকে মারার ধৃষ্টতা যেন না দেখানো হয় – কারণ শতশত মানুষ নিজ চোখে হাইজ্যাক করা দেখেছে। এছাড়া সে বলে, যদি তাদেরকে সে (গাজি) হত্যা করে তবে একইভাবে তাকেও নিহত হতে হবে। এটা শোনার পর গাজি গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ভিন্ন গন্তব্যে যাবার নির্দেশ দেয়। ফলে ড্রাইভার গাড়ী ঘুরিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে রওনা করে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পৌঁছে গাজি গোলাম মোস্তফা গাড়িটাকে বাড়ির সামনে পার্ক করে এবং সিঁড়ি বেয়ে নিজে উপরে উঠে বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টা অবগত করে। গাজি সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ করে যে মেজর ডালিম তার ছেলের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এবং তাকে (ছেলেকে) বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝে চড় মেরেছে। যে বিয়ের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণকারী তারাই (মেজর ডালিম)। গাজি সাহেবকে সম্ভবত তার ছেলে ভুল তথ্য দিয়েছে। কারণ মূলত মেজর ডালিমের শালাকে টিজ করার কারণে সে (ডালিমের শালা) ঐ ছেলেকে চড় মেরেছে। শুধু নাই নয়, বিষয়টা জানার পরে মেজর ডালিম তার শালার পক্ষ থেকে মিসেস গাজির কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। যাই হোক, বঙ্গবন্ধু যখন সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিলেন, তাঁর বাড়ীতে তখন ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ছিলো। কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে নিশ্চই বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠিয়েছেন, যেকারনে সে সেখানে ছিলো।
বঙ্গবন্ধুকে দেখে মেজর ডালিম জানালো যে সে নির্দোষ কিন্তু ঘটনা কি ঘটেছে সেটা ব্যাখ্যা করে নাই। কিন্তু অপরপক্ষে গাজি সাহেব বঙ্গবন্ধুকে আগে থেকে তার নিজের মত করে ব্রিফ করে এসেছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একপক্ষের কথাই জানলেন – অর্থাৎ যেটা গাজি সাহেব বলেছে। ফলে প্রেসিডেন্ট মূল ঘটনা জানতে পারলেন না। অপরদিকে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধু সামনে থাকায় অনেক সাহস পেল। এবং সে গাজি সাহেবের সাথে চিৎকার করে কথা বলছিলো এবং অনেক খারাপভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছিল। মেজর ডালিমের এহেন আচরণে বঙ্গবন্ধু সন্তুষ্ট হলেন না। অবশ্য এটাও বিবেচ্য যে, যে পরিস্থিতে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর সামনে পর্যন্ত এসেছে, তারপর যদি গাজি সাহেবের সাথে রুঢ় আচরণ করে থাকে সেটাই বা আসলে কতো বড় অপরাধ? হয়ত মেজর ডালিমের এই আচরণ এবং গাজি সাহেবের ব্রিফিংএর ফলে মেজর ডালিম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর একটি খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে। যার ফলে যখন মেজর ডালিমকে চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তখন বঙ্গবন্ধু নিশ্চই এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেছিলেন।
যখন গাজি সাহেব এবং মেজর ডালিমের এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো সেসময় কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ MS(P) প্রেসিডেন্টকে জানালেন যে গাজি সাহেবের বাড়ীতে মিলিটারি পুলিশ অবরোধ করেছে। এটা শুনেই প্রেসিডেন্ট খুব রেগে গেলেন। আমি জানিনা সেসময় প্রেসিডেন্ট আমাকে খুঁজছিলেন কিনা অথবা সেখানে আমার উপস্থিতি আশা করেছিলেন কিনা। কিন্তু ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কর্নেল শাফায়াৎ কে যে সেখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে সেটি আমার অজানা। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল প্রেসিডেন্টের বাড়ীতে যাবার আগে আমাকে কিছুই জানায়নি। এমনকি ফিরে এসেও সে এই ব্যাপারে কিছু জানায়নি। সেদিন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে সেদিন প্রেসিডেন্ট হাউজে ডেকে নেয়াটা চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গার শামিল। এর প্রভাব অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়েছিল যা পরবর্তীতে আলোচনা হবে। আমি জানিনা কেন আমার পরিবর্তে সেদিন কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে ডাকা হল। তবে পরের দিন সকালে আমি ঘটনাটা জানতে পারি।
প্রভোস্ট মার্শাল লে কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) এম এ সামাদ এডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল (পরবর্তীতে লে জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট) এইচ এম এরশাদ এর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে কিছু তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেন। এবং এরপর AG কে অবগত করেন। সেদিন AG আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে আর্মির শৃঙ্খলা দেখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কর্নেল এরশাদের। কিন্তু সেদিন সে কোন পদক্ষেপ নেয় নাই এবং প্রভোস্ট মার্শালকে কী করা যায় সেব্যাপারেও কিছু বলে নাই। পরেরদিন সে খুব স্বাভাবিক ধাঁচে এসে আমাকে বিষয়টা যখন অবগত করল ততক্ষণে পুরো আর্মি বিষয়টা জেনে অগ্নিমূর্তি ধরে আছে। ঘটনার ২ দিন পর, ২৪ জুন ১৯৭৫ তারিখে, আর্মি হেডকোয়ার্টারে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। সবাই অপেক্ষা করছিল সরকার গাজি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে কী একশন নেয় সেটার ব্যাপারে। আর্মি অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের এই মনোভাব দেখে আমি দ্রুত প্রেসিডেন্টের সাথে একটি এপয়েন্টমেন্ট করি – যাতে বিষয়গুলো তাঁকে অবগত করা যায় এবং তাঁর দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। সেসময় আমার ডেপুটি (জিয়া) কোন সাহায্য করেনি। তার বদলে সে এই ঘটনা নিয়ে অফিসারদের আরও উত্তেজিত করে তুলছিলো। যখন আমি প্রেসিডেন্টকে ঘটনাটা ব্রিফ করছিলাম তখন জেনারেল জিয়া ও শাফায়াৎ জামিল সেখানে উপস্থিত ছিল।
আমরা প্রেসিডেন্টের সাথে প্রায় ১ ঘণ্টা ছিলাম। যখন আমরা দেখা করলাম প্রেসিডেন্ট একদম রেগেমেগে ছিলেন। তিনি আমাকে চার্জ করলেন কেমন করে মিলিটারি পুলিশ কোন অথোরিটি ছাড়া সিভিলিয়ান এলাকায় যায়? আমি ব্যাখ্যা করলাম যে মিলিটারি পুলিশ সেখানে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যায় নাই। তারা সেখানে গিয়েছিলো একজন অফিসার ও তার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে যাদেরকে গাজি সাহেব ও তার সশস্ত্র দল কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। গাজি সাহেব যা করেছেন সেটি যে কোন মাপেই সঠিক হয়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আমার কথা শুনতে চাইলেন না। একসময় আমি বললাম, “স্যার, গাজি গোলাম মোস্তফা অনেক বড় একটা অন্যায় করেছে। তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিৎ। অন্যথায় এতে সৈন্যদের মনোবল নষ্ট হবে।” এই মুহুর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন।
প্রেসিডেন্ট এক সময় চিৎকার করে আমাকে বললেন, “শাফিউল্লাহ, তুমি কি ভুলে গেছে যে তুমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছ?” হয়ত আমার বলার ধরণটা অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে, তবু আমি বললাম, “স্যার, আমি জানি আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছি।” আমি প্রেসিডেন্টকে আরও বললাম, “স্যার, আমি এখানে আমার নিজের ব্যাপারে বলতে আসিনি। আমি এখানে আপনার ব্যাপারে বলতে এসেছি। শত শত লোকের চোখের সামনে গাজি গোলাম মোস্তফা যা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। সে যা করেছে তার জন্য তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। সে একজন অফিসার ও তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গেছে। এবং খুব সম্ভবত তাদের হত্যা করার জন্য। গাজি গোলাম মোস্তফা সাহেবের এই একশনে সৈনিকদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে। যেকারনেই হোক না কেন স্যার, আপনি নিজে কেন অন্যের ভুল কাজের দায় নিজের ঘাড়ে নিচ্ছেন?” যদিও প্রেসিডেন্ট সেদিন ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারেননি এবং তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না। আমি শেষ পর্যন্ত সেদিন এই আরজ করলাম যে গাজি সাহেব যা করেছেন তার শাস্তি অবশ্যই পাওয়া উচিৎ।
প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে বের হবার আগ মুহূর্তে আমি জোরালোভাবে বললাম যাতে গাজি সাহেবের বিরুদ্ধে অবশ্যই কিছু একশন নেয়া হয়। সে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার আবেদনের দুই দিন পেরিয়ে গেলেও গাজির বিরুদ্ধে কোন একশন নেয়া হয়নি। প্রচণ্ড হতাশায় মেজর ডালিম তৃতীয় দিন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন গাজি সাহেবের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। আমার মনে হচ্ছিলো দ্রুতই কোন একটা সিদ্ধান্ত আসবে। যদিও সেদিন পর্যন্ত কোন খবর না হওয়ায় মেজর ডালিম সম্পুর্ণ হতাশ হল। প্রচণ্ড ক্ষোভে এক সময় সে আমার টেবিল চাপড়ে দিল। আমি তার এই কাজের জন্য তাকে ধমক দিলাম। এবং এক্ষুনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে আদেশ দিলাম।
এই ঘটনার আরও দুই দিন পর প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন এবং প্রায় জেরা করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন মেজর ডালিম টেবিল চাপড়ানোর অপরাধে আমি তার (ডালিমের) বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছি। এই প্রশ্নে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, “স্যার, মেজর ডালিম আমার অফিসে ইমোশনাল হয়ে পরেছিল। সে তার যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশে কাজটি করেছে। আমার অফিসে সে যা করেছে তা তার সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণের কারণে করে ফেলেছে।” আমি তাকে ধমক দিয়েছি এবং আমার অফিস থেকে বের করে দিয়েছি। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা ভেবে যে সেই ঘটনাটি প্রেসিডেন্টের কান পর্যন্ত কিভাবে আসলো।
ক্ষমা চেয়ে আমি প্রেসিডেন্টকে বললাম, “স্যার, আপনি কিভাবে এটা জানলেন?” প্রেসিডেন্ট বললেন, “শফিউল্লাহ, তুমি হয়ত তোমার হেডকোয়ার্টারে যা ঘটছে তার অনেক কিছুই জানোনা। কিন্তু আমি জানতে পারি।” তিনি তখন আমার দিকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন এবং বললেন, “তুমি কি জানো তোমার কিছু অফিসার তাদের লিভিং রুমে অস্ত্র রাখে?” গাজি গোলাম মোস্তফার ঘটনার সময় যখন আমি প্রেসিডেন্ট হাইজে গিয়েছিলাম তখন আমি কিছুটা এগ্রেসিভ মুডে ছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এই ধরণের প্রশ্নে আমি কিছুটা ডিফেন্সিভ হয়ে গেলাম। তার কাছ থেকে আমি এধরনের প্রশ্ন আশা করিনি! আমাকে অফ-গার্ড করে তিনি অফেন্সিভ হলেন।
যদিও প্রেসিডেন্টের এই প্রশ্নের সাথে গাজি গোলাম মোস্তফার ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই, তবুও আমি আশ্বস্ত করলাম যে এই ব্যাপারে আমি অতি সত্বর ব্যবস্থা নেব। প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আমি আমারও স্মরণ করিয়ে অনুরোধ করলাম যাতে এই বিষয়টায় একশন নিতে বেশী দেরী করা না হয়। আমি আবারো বললাম যে, এতে করে সম্পূর্ণ আর্মির মনোবল নষ্ট হয়ে যাবে। যদি গাজি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে কোন একশন না নেয়া হয় তাহলে হয়ত পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তিনি যদিও গাজি সাহেবের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করলেন না বা আমাকে কোন ইঙ্গিত দিলেন না যে আদৌ কোন একশন নেয়া হবে কিনা। একরকম অসন্তুষ্টি নিয়েই প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আসলাম।
Source:
15th August: A national Tragedy – K M Safiullah
ভিন্ন একটি বইতে যা লেখা ছিলো
এক সন্ধ্যায় মেজর ডালিমের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীতে তােলপাড় সৃষ্টি হলাে। ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে ডালিমের এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। তাঁর বিদেশ-প্রত্যাগত লম্বা চুলধারী শ্যালক অনুষ্ঠান উপভােগ করছিল। ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গােলাম মােস্তফার পুত্র ডালিমের শ্যালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে ডালিম শ্যালকের পক্ষ নিয়ে গাজীপুত্রকে চড় মারেন। পুত্রের নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে গাজী সাহেব একটি মাইক্রোবাসে দলবল নিয়ে এসে ডালিমকে চুল ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেন। ডালিমের স্ত্রী নিম্মি স্বামীকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলে তাকেও জোর করে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। ডালিমের শাশুড়ি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ সুবাদে ডালিমেরও ৩২ নম্বরে যাতায়াত ছিল। গাজী একপর্যায়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য সস্ত্রীক ডালিমকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যান। ইতিমধ্যে ডালিমকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে খবর পেয়ে সেনানিবাসে মিলিটারি পুলিশের অফিসার কমান্ডিং মেজর আমিনুল ইসলাম গাজী গােলাম মােস্তফার বাড়িতে নিয়ে ডালিমকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চালান।
৩২ নম্বরে গিয়ে ক্রন্দনরত ডালিমের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে গাজীর বিরুদ্ধে নালিশ জানান। প্রধানমন্ত্রী উভয়কে সান্ত্বনা দেন এবং বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
পরদিন সকালে ডালিম সেনা হেডকোয়ার্টারে এসে অফিসারদের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে তার এবং তাঁর স্ত্রীর প্রতি আগের রাতের দুর্ব্যবহারের বর্ণনা দিলে সব অফিসার উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তারা এর প্রতিকারের জন্য দলবদ্ধভাবে সিনিয়র অফিসারদের কাছে ধরনা দেন। ডালিম জনা দশেক মেজর পদবির অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল হুসেইন। মুহম্মদ এরশাদের ঘরে ঢুকে তার স্ত্রীর সঙ্গে দুবৃত্তদের দুর্ব্যবহারের ঘটনা বর্ণনা করেন। এরশাদ উত্তেজিত স্বরে বলেন, “This is too much. আমি চিফকে বলেছি আপনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে শক্ত প্রতিবাদ জানান। আমরা এনশিওর করব যে আপনাকে (চিফকে) সরিয়ে দিলে কোনাে সেকেন্ড লেফটেন্যান্টও চিফের চেয়ারে বসবে না। ক্ষুব্ধ অফিসাররা এরশাদকে অনুরােধ করেন তিনি যেন তাদের ডিসিএএস এবং সিএএসের অফিসরুমে নিয়ে যান।
এরশাদ ক্ষুব্ধ অফিসারদের নিয়ে ডিসিএএস জিয়ার রুমে প্রবেশ করেন। আমিও পেছন পেছন গেলাম। ডালিম গত রাতের ঘটনা জিয়ার কাছে বর্ণনা করেন। জিয়া খুবই বিরক্ত, তার সামনে উপবিষ্ট ব্রিগেডিয়ার এরশাদকে বললেন, ‘এতে হইচই করার কী আছে। আপনি নিজে শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজি, অথচ আপনিই তাে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন। Go back to your place of work.”
এরশাদ ও অফিসাররা হতােদ্যম হয়ে যাঁর যাঁর অফিসে ফিরে গেলেন। বিমর্ষ ডালিমও সেনা সদর ত্যাগ করেন। ঘটনাটি সব সেনানিবাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং অফিসারদের মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ ডালিমের পক্ষ অবলম্বন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিকার দাবি করেন। কিন্তু কোনাে ফল হয়নি। কয়েক দিন পর মেজর ডালিম ও তাঁর বন্ধু মেজর নূর চৌধুরীকে সামরিক বাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। [1, pp. 153–154]
References:
[1] হাফিজ উদ্দিন, সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পচাত্তর [Military life, seventy one the pride, seventy five the blood bath], 1st ed. Prothoma, 2020.