You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৩১শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, বুধবার, ১৭ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

শান্তির ললিত বাণীর অন্তরালে

ভিয়েতনাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর সেখান থেকে মার্কিন সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে আসছে। আর যুদ্ধ নয়—এবারে শান্তি—এ বক্তব্যের সমর্থনে নিক্সন সরকার ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। খবরে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হয়েছে বলে জোর করে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির তলব প্রথা অবিলম্বে তুলে নেয়া হবে। নিজের ইচ্ছায় যারা সেনাবাহিনীতে আসতে চাইবেন, এখন থেকে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীতে কেবলমাত্র তাঁদেরকেই ভর্তি করা হবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীতে লোক ভর্তির নিয়মটি বাধ্যতামূলক হিসেবে চালু করেছিলো। আগামী জুনের পর থেকে এ নিয়ম তুলে নেয়া হবে।
ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির প্রথা বিলোপ এ দুই-ই শান্তির স্বপক্ষে। উদ্দেশ্যও মহৎ এতে কোন সন্দেহ নেই। এ জন্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আমরা অভিনন্দন জানাতে পারতাম যদি না দেখা যেতো যে, নিক্সন সরকার কথা ও কাজের সমন্বয় সাধন করে চলেছেন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
কথা ও কাজের গরমিল স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের উপর। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী বাজেটে সর্বাধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বাজেট। আগামী ১লা জুলাই হতে যুক্তরাষ্ট্রের যে নয়া বাজেট কার্যকরী হবে তাতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ৮ হাজার ১১০ কোটি ডলার দেশরক্ষা খাতে বরাদ্দ করার দাবী করেছেন। উল্লেখ্য যে, যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৪৫ সালে ইতিপূর্বে সর্বাধিক পরিমাণ অর্থ দেশরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিলো। উক্ত বছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিলো ৭ হাজার ৯শ’ ১০ কোটি ডলার।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনীর ব্যয়ে এবং ন্যাটোর জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বাবদ প্রেসিডেন্ট নিক্সন কংগ্রেসের কাছে আরো ২শ’ ১০ কোটি ডলার দাবী করেছেন। এই অংকের একটা বিরাট অংশ দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষা বাবদ ব্যয় করা হবে।
বাজেটে মিত্র দেশগুলোর জন্য মোট ৭৯ কোটি ১০ লাখ ডলার সামরিক সাহায্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এই সামরিক সাহায্যের অতিরিক্ত বরাদ্দ হিসেবে যেসব মিত্রদেশ নিজেদের বিরাট প্রতিরক্ষা ব্যয় নির্বাহে সক্ষম নয়—তাদের জন্য ৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সাহায্যের একটা বিরাট অংশ দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও গ্রীসের জন্য বরাদ্দ করা হবে। একথা বুঝতে আজ আর কারো অসুবিধা হবেনা যে, নিক্সন সরকার ঘরে-বাইরের জনমত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের গতি প্রকৃতির ফলে বাধ্য হলে শান্তির ললিত বাণী আওড়ালেও সবই আজ ব্যর্থ পরিহাসের মতই শোনাচ্ছে। শান্তির অন্তরালে যুদ্ধের পাঁয়তারা করে যাচ্ছেন নিক্সন সরকার। যদি তাই না হবে তাহলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণের চেয়ে অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করার অন্তর্র্নিহিত তাৎপর্য কোথায়?
ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভিয়েতনাম সমস্যাই ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ একটি সমস্যা। সে সমস্যার সমাধান হবার পর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়াই তো উচিত ছিলো। তাছাড়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং ও মস্কো সফরের পর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক। পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের স্বপক্ষেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আজ একমত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এতদসত্ত্বেও প্রতিরক্ষা খাতে অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ যে আদৌ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবেনা তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
নিক্সন সরকার আগামীতে ঝোপ বুঝে কোপ যে মারবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার আগেই প্রেসিডেন্ট নিক্সন চুক্তিটিকে ‘ফ্যাজাইল’ বা ‘ভঙ্গুর’ বলেছেন। মিঃ নিক্সন চুক্তি সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে উদ্দেশ্যটা বিশেষ মহৎ নয়। আবার যে কোন সময়ে ভিয়েতনামের মাটিতে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠতে পারে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের আগুনকে জিইয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হলে বিশ্বের অন্য কোন অঞ্চলে নতুন করে সংঘর্ষের সূত্রপাতও হতে পারে। আর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারই মদদ যুগিয়ে যাবেন নিক্সন সরকার।
কথায় বলে কেউ দেখে শিখে আবার কেউ ঠেকে শিখে—কিন্তু যারা দেখে বা ঠেকেও শেখে না তাদের সর্বশেষ পরিণতি হয় অত্যন্ত করুণ ও মর্মান্তিক। ইতিহাস সে কথাই বলে। নিক্সন সরকার ইতিহাস থেকে এ শিক্ষা যত শীঘ্র গ্রহণ করেন ততই মঙ্গল।
০০০

বিনষ্টির থেকে কেনা পাট রক্ষা করতেই হবে

সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় দেশের তিনটি জেলার পাট কেন্দ্রে দশ কোটি টাকার পাট পড়ে রয়েছে বলে দারুণ উদ্বেগজনক এক সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে জানা গেছে—রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার তিনটি পাট কেন্দ্রে অন্যূন দশ কোটি টাকার পাট পড়ে রয়েছে। এর পরিমাণ হবে প্রায় পনের লক্ষ মণ। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ওয়াগন সরবরাহ করতে পারছেন না বলেই স্থলপথে পাট রফতানী সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে জলপথেও পাট রফতানী করার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। বাংলাদেশ জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন, জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন ও আরো কয়েকটি সরকারী-বেসরকারী পাট ক্রয় সংস্থা কর্তৃক উক্ত পাট ক্রয় করা হয়েছে। বর্তমানে ঐ সকল কেনা পাট উন্মুক্ত স্থানে পড়ে রয়েছে। সংবাদে আরও বলা হয়েছে—দেশের বিভিন্ন স্থানেও পাট পড়ে রয়েছে। এসকল জমাকৃত পাটের মধ্যে ১৯৭১ সালের পাটও রয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি বিভিন্ন স্থানে যে সকল পাট কেনা রয়েছে ওয়াগনের অভাবে তা রফতানী কেন্দ্রেও পৌঁছুতে পারেনি। আশঙ্কা করে সংবাদে বলা হয়েছে—যদি অনতিবিলম্বে পাট ক্রয় কেন্দ্রে জমাকৃত পাট রফতানী কেন্দ্রে পৌঁছানো না হয় তাহলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্যে দেশের এই বিরাট আর্থিক ক্ষতি গোটা জাতীয় জীবনেও মারাত্মক আঘাত হানবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এ আঘাত অনেকটা অনতিক্রম্য। যথেষ্ট পরিমাণ যানবাহনের অভাবে বিভিন্ন স্থানের যে সকল কেনা পাট পড়ে রয়েছে অবিলম্বে তা রফতানীর ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। তবু কর্তৃপক্ষ এই আবশ্যক কাজের সমাধান করে উঠতে পারছেন না। পেছনে রয়েছে পাট বহন করার মতো প্রয়োজনীয় যানের অভাবের কারণ। পাট আমাদের জাতীয় আর্থিক কাঠামো মজবুত করার জন্যে সর্বপ্রধান ফসল। এর উপর ভিত্তি করেই আমাদের জাতীয় আর্থিক মেরুদন্ড গড়ে উঠবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্যে এটাই একমাত্র ফসল। এর জন্যে কর্তৃপক্ষ পাটকে অগ্রাধিকার দিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিবেচনা করে উৎপাদন ও তার যথাযথ রফতানী নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশ্ববাজারে পাটের গুরুত্ব ও চাহিদা বৃদ্ধির জন্যে সরকার সর্বদাই সচেষ্ট। বিগত দু’বছরে নানা কারণে পাট উৎপাদন যথেষ্ট ভাবে হতে পারেনি। যুদ্ধকালীন অবস্থার নানা প্রতিকূল কারণ ছাড়াও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন প্রকার অসুবিধার দরুণ সর্বাত্মকভাবে পাট উৎপাদন করতে পারেনি। যে পাট উৎপাদিত হয়েছে তা যথাযোগ্যভাবে রফতানী করা সরকারের দায়িত্ব। এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই সরকার সে দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছিলো এবং মাল বহনকারী স্থল ও নৌ-যানের যে অপ্রতুলতা বর্তমানে রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যে সামান্য পরিমাণ যান রয়েছে তা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রফতানী কেন্দ্রেও পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ যে করেই হোক পাট বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। কেননা এর সঙ্গে একদিকে যেমন জড়িত রয়েছে দেশের বহু পাট উৎপাদনকারী কৃষকের অবহেলিত জীবন অন্যদিকে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রশ্ন। সরকার যে করেই হোক বিনষ্টির হাত থেকে পাট রক্ষা করবেন বলে আমরা আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!