You dont have javascript enabled! Please enable it!
মাটিকাটায় পাকিস্তানি বাহিনীর জাহাজ দখল
ভূমিকা
টাঙ্গাইল জেলার উত্তরাংশে ভুয়াপুর থানা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ মুক্তিবাহিনী জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিবাহিনীর এ সদস্যদের অধিকাংশই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে এবং থানা থেকে সংগৃহীত অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সশস্ত্র করা হয়। টাঙ্গাইল জেলার একটি বিরাট অংশ জঙ্গলাকীর্ণ। হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে থাকতে বেগ পেতে হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধির উপর লক্ষ্য রেখে বারবার তাদের উপর অভিযান চালানাে সহজতর ছিল। তা ছাড়া টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনী নিয়মিতভাবে যমুনা নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের উপর নজর রাখতে চেষ্টা চালায়। এ সময় দেশের অভ্যন্তরে রাস্তা এবং রেলপথের যােগাযােগ অনিশ্চিত থাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ সরবরাহের জন্য নদীপথ ব্যবহার শুরু করে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে এসব অস্ত্র ও গােলাবারুদ যমুনা নদী দিয়ে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলে সরবরাহ করা হতাে। এক গােপন সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল জেলার মাটিকাটা এলাকায় যমুনা নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রবােঝাই জাহাজ আক্রমণ করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ জাহাজ আক্রমণ একটি মাইলফলক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।
মাটিকাটার অবস্থান
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে একটি প্রধান সড়ক মধুপুর পৌছে দুই ভাগ হয়, একটি ময়মনসিংহ আর একটি জামালপুর জেলা সদরে পৌছেছে। টাঙ্গাইলময়মনসিংহ সড়কের মধ্যবর্তী অবস্থান ঘাটাইল থেকে একটি সড়ক পৃথক হয়ে সােজা পশ্চিম দিকে যমুনার তীরবর্তী ভুয়াপুর থানা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। ভুয়াপুর থানা সদরের দক্ষিণে ছােটো মাটিকাটা বাজারের অবস্থান। এলাকাটি যমুনার তীরবর্তী হওয়ায় এখানে বড়াে ধরনের কোনাে স্থাপনা বা শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। মাটিকাটা বাজারের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাের মধ্যে নিকবাইল, বীরহাটী, গােবিন্দদাসী, গাবমারা, ফালদা উল্লেখযােগ্য। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কাছে গােপনসূত্রে সংবাদ আসে যে, নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে ৭টি জাহাজে অস্ত্র ও গােলাবারুদ দেশের উত্তরাংশে অবস্থিত সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাঠানাের জন্য ভর্তি করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে অবস্থানরত ইপিআর সদস্য এনায়েত করিম এ সংবাদটি তার এক আত্মীয় নবী নেওয়াজের মাধ্যমে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌছে দেন। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা হলেও পরিকল্পনা স্তরে খুব গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি বিবেচিত হয়নি।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট অস্ত্র ও গােলাবারুদবাহী ৭টি জাহাজ ভুয়াপুরের। দক্ষিণে সিরাজকান্দি ঘাটে নােঙর করে। এর মধ্য দিয়ে ইপিআর সদস্য। এনায়েত করিমের দেয়া সংবাদ সঠিক প্রমাণিত হয়। ৭টি জাহাজের মধ্যে ২টি বৃহদাকার এবং বাকি ৫টি মাঝারি ধরনের । বড়াে ২টি জাহাজের নাম ছিল S.U. Engineers LC-3 এবং S.T. Rajon। এখানে উল্লেখ্য যে, S.T. Rajon জাহাজের ক্যাপ্টেনের (সারেং) নাম মহর আলী। তার বাড়ি মির্জাপুর থানার উয়াসী পাইকপাড়া এবং s.U, Engineers LC-3 জাহাজের ক্যাপ্টেনের নাম মােহাম্মদ মােস্তফা এবং বাড়ি চট্টগ্রাম। সারেং মােস্তফার গ্রামের বাড়ি পাকিস্তানি। বাহিনী জ্বালিয়ে দেয় এবং তার এক ভ্রাতুস্পুত্রকে গুলি করে হত্যা করে। মােস্তফার এক ভাই মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। সে অপরাধে পাকিস্তানি বাহিনী মােস্তফাকে ৪ মাস আটকে রাখে। সৈয়দপুর সেনানিবাসে এ যুদ্ধাস্ত্রভর্তি জাহাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কারণ, সে সময় যথেষ্টসংখ্যক বাঙালি সারেং কর্মরত ছিল না। মুক্তি পাওয়ার পর সারেং মােস্তফাই ইপিআর এনায়েত করিমকে গােপনে এ সংবাদটি দেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৭টি জাহাজ পাশাপাশি অবস্থান নেয়ায় তীরবর্তী লােকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে দূরবর্তী অবস্থানে পরিবার-পরিজনসহ আশ্রয় নিতে শুরু করে।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
অস্ত্রবাহী এ জাহাজের খবর মুক্তিযােদ্ধাদের জানা ছিল বিধায় স্থানীয় গ্রুপ অধিনায়ক হাবিব এ জাহাজ আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। জাহাজের বর্তমান। অবস্থান ও পাহারাপদ্ধতি বিষয়ে খোঁজ নেয়ার প্রচেষ্টা গৃহীত হয়। প্রাথমিক তথ্যে জানা যায়, নদীতে প্রবল স্রোত থাকায় জাহাজগুলাে শুধু জোয়ারের সময় অগ্রসর হতাে। বাকি সময় নিরাপদ অবস্থান দেখে নােঙর করা অবস্থায় থাকতাে। একই সময় পুরাখাসিয়া সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মাস্টার শামছুল আলম ৫০জন সহযােদ্ধাসহ পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাটিকাটা এলাকায় আসেন। তার কাছেও এ অস্ত্রবাহী। পাকিস্তানি জাহাজের আগমন সংবাদ পৌছায়। তিনিও এ জাহাজ আক্রমণের লক্ষ্যে সহযােদ্ধাসহ ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট মাটিকাটা বাজার এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১০ আগস্ট অস্ত্র-গােলাবারুদবাহী জাহাজগুলাে আরও অগ্রসর হয়ে যমুনা নদীতে প্রবেশ করে এবং মাটিকাটা বাজার থেকে কিছুটা দক্ষিণে নদীর মাঝ বরাবর পুনরায় নােঙর ফেলে। তথ্য সংগ্রহকারী দল স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জানতে পারে, বিশাল এ জাহাজগুলােকে উত্তর দিকে যেতে হলে মাটিকাটা বাজারের তীরবর্তী কোলঘেঁষে যেতে হবে; কারণ এদিকে নদীর পানির গভীরতা বেশি। পশ্চিম দিক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বালুর চরায় জাহাজ আটকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
অধিনায়ক হাবিব তার কোম্পানিসহ মাটিকাটার কিছুটা দক্ষিণে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার ঝাকি জাল নিয়ে জাহাজের নিকটবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে জাহাজের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সৈনিকদের চলাচল প্রত্যক্ষ করেন। বৃহদাকার জাহাজ ২টি ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। এর সম্মুখ ভাগে মেশিনগান বসানাে দেখে তিনি অনুমান করেন, এ ২টি জাহাজে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র থাকার সম্ভাবনা বেশি। জাহাজ ২টির নিরাপত্তা বিধানে অতিরিক্ত শক্তি নিয়ােগ করা হয়েছে। তিনি প্রয়ােজনীয় রেকি শেষে সহযােদ্ধাদের এ বিষয়ে ব্রিফিং করেন এবং আক্রমণে ব্যক্তির অবস্থান নির্দিষ্ট করেন। আক্রমণ পরিকল্পনায় নির্দেশ ছিল, তিনি গুলি না চালানাে পর্যন্ত কেউ যাতে গুলি না ছোড়ে। | যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অধিনায়ক হাবিব মাটিকাটা বাজারের দক্ষিণ দিক থেকে মাটিকাটা বাজার পর্যন্ত এলাকায় নিজ সহযােদ্ধাসহ অবস্থান গ্রহণ করেন। সহযােদ্ধাদের মধ্যে জামশেদ, মোতাহার, জিয়া, ভােলা ও লুঙ্করের নাম উল্লেখযােগ্য। মুক্তিবাহিনীর অপর দল গ্রুপ অধিনায়ক মাস্টার শামছুল আলমের নেতৃত্বে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে সব দিক বিচার করে নদীর পূর্ব তীরে ট্রেঞ্চ খননের নির্দেশ দেন। যেখানে নদীর গভীরতা বেশি এবং পাড়ের কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সহযােদ্ধাদের নিয়ে তিনি সে এলাকায় ট্রেঞ্চ খুঁড়ে জাহাজের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন। ফলে পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই পৃথক ২টি কোম্পানির অবস্থান পাশাপাশি এসে যাওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি ও মনােবল বেড়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট সকাল ১০টায় জাহাজগুলাে কিছুটা এগিয়ে আবার থেমে নােঙর করে। একটি ছােটো আকৃতির লঞ্চ পানি মাপতে মাপতে সম্মুখে এগিয়ে আসে। এ ছােটো জাহাজটি সংকেত দেয়ার পর দুপুর ১২টায় পুনরায় জাহাজগুলাে যাত্রা শুরু করে। এ সময় অধিনায়ক শামছুল আলমের দল।
অবস্থানে ছিল না। খাবারের জন্য পাশের গ্রামে ছিল। হঠাৎ জাহাজ চলাচলের সংবাদে অধিনায়ক শামছুল আলম তার দল নিয়ে পূর্বের অবস্থানে যখন ফিরে আসেন তখন দুপুর ২টা। ইতােমধ্যে কয়েকটি জাহাজ তাঁর অবস্থানের স্থান অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গিয়েছে। অধিনায়ক হাবিব তার পরিকল্পনামতাে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা জাহাজের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করলে সহযােদ্ধারাও একসাথে ২টি জাহাজের উপর প্রচণ্ড গুলি। ছুড়তে শুরু করেন। শামছুল আলমের যােদ্ধারাও একইসাথে আক্রমণ করেন। অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ২টি জাহাজ আত্মরক্ষার জন্য বাম দিকে ঘুরিয়ে পালানাের চেষ্টা করলে বড়াে ২টি জাহাজ S.U. Engineers LC-3 এবং S.T. Rajon বালুর চরায় আটকে যায়। বাকি ৫টি জাহাজ দ্রুতগতিতে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ২টি জাহাজ ক্ষতবিক্ষত হয়। অধিকাংশ সৈন্য নিহত কিংবা আহত হয়। বাকিরা জাহাজের সাথে থাকা ছােটো ছােটো স্পিডবােটে যমুনা অতিক্রম করে জামালপুর অভিমুখে চলে যায়। সন্ধ্যায় ২টি জাহাজের ক্যাপ্টেন হাত উঁচু করে জাহাজের উপর এসে বাঁচাও-বাচাও বলে। চিৎকার করতে থাকে। | সন্ধ্যার পর মুক্তিযােদ্ধারা জাহাজের উপর উঠে ৫০জন পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ দেখতে পান। একটি জাহাজে ছিল যুদ্ধাস্ত্র। অপরটিতে ছিল জ্বালানি তেল, ডিজেল ইত্যাদি। মুক্তিবাহিনী ত্বরিত নৌকা সংগ্রহ করে ১৭ নৌকা অস্ত্র ও গােলাবারুদ নামিয়ে শক্রর পুনঃআক্রমণের আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগের পূর্বে জাহাজ ২টিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার আধঘণ্টা পর থেকেই প্রচণ্ড আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলতে শুরু করে এবং বিস্ফোরণ শুরু হয়। ২টি জাহাজই আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে যথাসম্ভব নিরাপদ দূরত্বে সরে পড়ে।
মাটিকাটা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা
মাটিকাটা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন:
১. অধিনায়ক হাবিব
২. রেজাউল করিম
৩. জমসেদ মিয়া
৪, এনায়েত করিম
৫, মােতাহার হােসেন
৬. জিয়াউল হক
৭. ভােলা মিয়া।
৮. লুৎফর রহমান (অধিনায়ক)
৯, মঞ্জুরুল হক
১০. হাসান।
১১. আবদুস সামাদ
১২. ফজলুর রহমান
১৩, গােলাম নবী
১৪. ফজলুল হক
১৫. আলী আকবর
১৬. আবদুস সালাম
১৭. নবী নেওয়াজ
১৮. মােস্তফা।
১৯. মুক্তা (অধিনায়ক)
২০. শামছুল আলম (অধিনায়ক)
২১. এম এ বারী তরফদার (অধিনায়ক) প্রমুখ।
উপসংহার
১৯৭১ সালে টাঙ্গাইলে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে মাটিকাটায় জাহাজ ধ্বংস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেবল S.U. Engineers জাহাজের লগ ও মুভমেন্ট অর্ডার পাওয়া যায়। সেই অনুসারে জানা যায়, কেবল এ জাহাজে ২১ কোটি টাকা। মূল্যের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ও রসদ ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশালকায় জাহাজ ২টি ধ্বংস হওয়ায় শত্রুপক্ষের প্রচুর অস্ত্র সম্ভার মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে। আসে। বিশাল বিপর্যয়ে শত্রুর মনােবল অনেক ভেঙে যায়। অপর দিকে মুক্তিবাহিনীর মনােবল অনেক বৃদ্ধি পায়। বিদেশি প্রচারমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনেক গুরুত্ব লাভ করে।
করটিয়ার যুদ্ধ
ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যেতে সড়কপথে করটিয়ার উপর দিয়েই যেতে হয়। বিখ্যাত জমিদার চান মিয়ার বাড়ি এ করটিয়াতেই। দেশখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সা’দত কলেজ তারই প্রতিষ্ঠিত। বীর মুক্তিযােদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী এ কলেজের ছাত্র। ১২ আগস্ট শুরু হলাে করটিয়া দখলের অভিযান। করটিয়ায় তখনাে ৩০০-৪০০ রাজাকার, শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও মিলিশিয়া অবস্থান করছিল। প্রায় ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা রাস্তার উভয় দিকে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে সমান্তরালভাবে একই গতিতে এগিয়ে চলেছেন। ৬-৭জন সহযােদ্ধাসহ কাদের সিদ্দিকী রাস্তার উপর দিয়ে আস্তে আস্তে করটিয়ার দিকে এগােচ্ছেন। মর্টার প্ল্যাটুন নিয়ে সামাদ গামা তাকে অনুসরণ করছেন। সামাদ গামা মাঝেমাঝে তার ৩ ইঞ্চি মর্টার রাস্তার উপর বসাচ্ছেন আর করটিয়াকে লক্ষ্য করে ২০-২৫ রাউন্ড গােলা ছুঁড়ছেন, আবার মূল দলকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলছেন। একটা ভারি মর্টার নিয়ে এত ক্ষিপ্রতার সাথে গিয়ে বারবার একই লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে গােলা নিক্ষেপ এক অভাবনীয় ও অসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু সামাদ গামা মর্টার চালনায় এ অসাধ্য ও অভাবনীয় কাজটি অনায়াসেই করে চলেছেন। কাদের সিদ্দিকীর ডান পাশে চকের মাঝে বেনু, ভােম্বল, দুরমুজ খাঁ, জাহাঙ্গীর, আজহার; বাম পাশে মান্নান, আব্দুল্লাহ, মালেক, মকবুল, কাশেম, তমছের আলী, রাস্তার উপর দিয়ে ফজলুল হক, দুলাল, শামসু, বজলু, পিন্টু ও জাহাঙ্গীরের ভাই বাবলু।
মুক্তিযােদ্ধারা করটিয়ার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছেন । ৩ এপ্রিল ঠিক এমনিভাবে হানাদারবাহিনী অবিশ্রান্ত ধারায় গােলাগুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে টাঙ্গাইল দখল করেছিল। আজ মুক্তিযােদ্ধারা ঠিক তেমনিভাবে হানাদারদের পিছু ধাওয়া করে চলেছেন। মটরা থেকে করাতিপাড়া পর্যন্ত নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও করটিয়ার সন্নিকটে করাতিপাড়া গ্রাম নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা একটু অসুবিধায় পড়লেন। হানাদারদের পক্ষে গ্রামটিতে অবস্থান নেয়া যেমন সুবিধাজনক, তেমনি মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে গ্রামটির দখল নেয়া বিপজ্জনক ও কষ্টকর। মুক্তিযােদ্ধারা নির্বিচারে গ্রামের উপর গুলি চালাতে পারছিল না। তাই করাতিপাড়াকে সামনে রেখে অল্প সময়ের জন্য বিরতি দিতে হলাে। এ সময় পুনরায় স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য নিতে হলাে। ৮-১০জন স্বেচ্ছাসেবক অনেকটা ডানে ঘুরে গ্রামের পিছন দিয়ে ঢুকে খবর সংগ্রহ করতে গেল। তবে সামাদ গামা একইভাবে করটিয়ার উপর গােলাবর্ষণ করে চলেছেন। অবস্থায় মুক্তিবাহিনী যখন মটরা সেতু দখল করে করটিয়ার দিকে এগােতে থাকে, তখন হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর গতিরােধ করতে বা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে ভরসা পায়নি। মুক্তিবাহিনীর চাপের মুখে টিকতে না পেরে তারা করাতিপাড়া থেকে করটিয়া এবং করটিয়া থেকে কিছুটা পূর্ব দিকে সরে গিয়ে বাংড়া ও পৌলির কাছাকাছি আশ্রয় নেয়। শত্রু এতই ভীত ও আতঙ্কের শিকার হয়েছিল যে, করটিয়া ঘাঁটি থেকে পিছিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যেতেও সাহস পায়নি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!