You dont have javascript enabled! Please enable it!
দেওয়ানগঞ্জের যুদ্ধ
ভূমিকা
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে সফলতা সর্বস্তরের সৈনিকদের মনােবল বহুগুণে বাড়িয়ে তােলে। রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল কোম্পানি অধিনায়কের সাথে আলােচনাক্রমে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তেলঢালা বেইস ক্যাম্পে ফেরত যাওয়ার পূর্বে আরও একটি অপারেশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধ পরিকল্পনায় দেওয়ানগঞ্জ থানা শহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযােগী বাহিনীর ঘাঁটির উপর ৩১ জুলাই। রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেওয়ানগঞ্জের অবস্থান দেওয়ানগঞ্জ ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি থানা সদর ও গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন। ঢাকা-ময়মনসিংহ-জামালপুর রেললাইন। জামালপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জ হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট স্টেশনে মিলেছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট দেওয়ানগঞ্জ থানারই অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে ফেরিঘাট। দেওয়ানগঞ্জ থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটের দূরত্ব ২ কিলােমিটার। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মূল অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী। এলাকা তেলঢালা থেকে ৪৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে থানা শহর দেওয়ানগঞ্জের অবস্থান। বাংলাদেশের অন্য একটি থানা শহর রৌমারী ১২ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেওয়ানগঞ্জের গুরুত্ব
দেওয়ানগঞ্জ একটি নদীবহুল অভ্যন্তরীণ এলাকা। এ স্থানের উপর দিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সাথে রেল সংযােগ বিদ্যমান। দেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের সাথে রেল সংযােগ অক্ষুন্ন রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা এ রেলপথের উপর নির্ভরশীল ছিল। দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু শিল্পস্থাপনা ছিল। এর মধ্যে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, জিলপাক। চিনিকল, পাওয়ার হাউজ এবং বেশ কিছু পাটগুদাম উল্লেখযােগ্য। এ সময় পাট ছিল পাকিস্তানের একক বৃহত্তম রপ্তানি আয়করী পণ্য। যােগাযােগ ব্যবস্থা ও সামরিক গুরুত্বের দিক থেকে দেওয়ানগঞ্জ ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জামালপুর এলাকায়। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। সুলতান মাহমুদ। এ রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ছিল জামালপুরে। ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট ছিল ৯৩ পদাতিক বিগ্রেডের অধীন। ব্রিগেড সদর দপ্তর ছিল ময়মনসিংহ জেলা শহরে। দেওয়ানগঞ্জ থানা শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থায়ী কোনাে ইউনিটের অবস্থান ছিল না। দেওয়ানগঞ্জ এলাকার নিয়মিত। প্রতিরক্ষার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ােগপ্রাপ্ত ১ কোম্পানি রাজাকার থানা সদর এলাকায় মােতায়েন ছিল। এ ছাড়া রেল স্টেশন ও পাওয়ার হাউজ এলাকার প্রহরার জন্য স্থানীয়ভাবে নিয়ােগকৃত ও অস্ত্রসজ্জিত অবাঙালিদের একটি দল ছিল। রাজাকার বাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল সার্কিট হাউজ ও দেওয়ানগঞ্জ মাদ্রাসায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল দিবারাত্রি নিয়মিত টহলের মাধ্যমে দেওয়ানগঞ্জ থানা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, জিলপাক চিনিকল, পাওয়ার হাউজ, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ প্রভৃতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত টহলের মাধ্যমে এ নিয়ন্ত্রণ রক্ষার পিছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জামালপুরে অবস্থানরত ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর থেকে দেওয়ানগঞ্জ হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় অবস্থানরত কোম্পানির সাথে যােগাযােগ পথ উন্মুক্ত রাখা। একই সাথে ফুলছড়ি ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যকার ফেরি যােগাযােগ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করা।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
জেড ফোর্সের অধীনস্থ ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দেওয়ানগঞ্জ অপারেশন পরিচালনা করে। দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল এখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা। একই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মনােবল দুর্বল করে দেয়া। বাহাদুরাবাদ ঘাট যুদ্ধের পর এ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল হাতিবান্ধা ইউনিয়নের। তারাটিয়া স্কুল এলাকায়। ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন। মেজর শাফায়েত জামিল। এ যুদ্ধে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংগঠন ছিল। নিম্নরূপ:
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল ‘এ’ কোম্পানি অধিনায়ক
ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন  ‘ডি’ কোম্পানি অধিনায়ক লে. এস আই এম নুরুন্নবী খান।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
রেজিমেন্টের অধিনায়কের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘এ’ ও ‘ডি’ কোম্পানি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নাসির কোম্পানি নামক মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানির নাসির উদ্দিন এবং অন্যান্য স্থানীয় ব্যক্তিরা দেওয়ানগঞ্জ অপারেশন পরিচালনার জন্য গাইড ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করেন। দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণ পরিচালনার জন্য। নির্ধারিত ‘এ’ কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আনােয়ার হােসেন এবং ‘ডি’ কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খান। দেওয়ানগঞ্জ অপারেশনের পূর্ব মুহূর্তে রেজিমেন্টের আক্রমণপূর্ব সমাবেশস্থল হিসেবে দেওয়ানগঞ্জের নিকটবর্তী কাঠের বিল হাই স্কুল এলাকাকে নির্দিষ্ট করা হয়। আক্রমণের সর্বশেষ আরভি হিসেবে একদিলা বটগাছ এলাকা। নির্ধারিত হয়। আক্রমণে আকস্মিকতা অর্জনের লক্ষ্যে স্থলপথ এড়িয়ে জলপথে আরভিতে পৌছানাের পরিকল্পনা নেয়া হয়। স্থানীয় জনসাধারণ প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতেই আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সময় স্বল্পতার কারণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনাে ধরনের রেকি চালানাে সম্ভব হয়নি। | রেজিমেন্ট অধিনায়কের এ আক্রমণ পরিকল্পনায় ‘এ’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন নায়েব সুবেদার ওয়াহাবের নেতৃত্বে আরভি একদিলা বটগাছ এলাকার।
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। এ কোম্পানির অন্য ২টি প্ল্যাটুন ক্যাপ্টেন আনােয়ারের নেতৃত্বে জিলপাক চিনিকল আক্রমণ করবে। প্ল্যাটুন ২টির নেতৃত্ব প্রদান করবেন যথাক্রমে নায়েব সুবেদার মােখলেসুর রহমান ও নায়েব সুবেদার। মােহাম্মদ আলী। এ অভিযানে সুবেদার হাফিজ ছিলেন ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি উপঅধিনায়ক। ‘ডি’ কোম্পানি লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে দেওয়ানগঞ্জ থানা, পরিদর্শন বাংলাে, বাজার, পাওয়ার হাউজ, রেল স্টেশন ও মাদ্রাসা আক্রমণ করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সৈন্য বিভক্তিতে ‘ডি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন সুবেদার বােদির নেতৃত্বে থানা, পরিদর্শন বাংলা ও বাজার এলাকা আক্রমণের দায়িত্ব লাভ করে। সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে ১টি প্ল্যাটুনকে পাওয়ার হাউজ ও স্টেশন আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কোম্পানির অন্য প্ল্যাটুনটি সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মাদ্রাসা আক্রমণের দায়িত্ব লাভ করে। সুবেদার আলী নেওয়াজ ছিলেন ‘ডি’ কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত উপ-অধিনায়ক। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরসহ আরভিতে অবস্থান করবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আক্রমণের সহায়তায় কোনাে ফায়ার বেইস স্থাপন কিংবা কাট অফ পার্টি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়নি।
যুদ্ধযাত্রা
পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ৮টায় ১৩টি নৌকাযােগে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নদীপথে আরভির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ নৌকাগুলাে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির উদ্দিন স্থানীয় জনগণের সহযােগিতায় জোগাড় করেছিলেন। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও ‘ডি’ কোম্পানি রাত ১১টায় কাঠের বিল, সবুজপুর, কালাকান্দা, নয়াগ্রাম, বালুরুগ্রাম হয়ে মদনের চরে পৌছে। অপরদিকে, ক্যাপ্টেন আনােয়ারের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানি বেশ কিছু আগে মাদারের চরে পৌছে যায়। মাদারের চরে উভয় কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের মিলিত হওয়ার কথা ছিল। তখন পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও ‘ডি’ কোম্পানি মাদারের চরে এসে পৌছায়নি। মদনের চর ও মাদারের চর এলাকার মাঝে দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় মাইল। রাতের অন্ধকারে দুই দলের মাঝে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন আনােয়ার মাদারের চরে ‘ডি’ কোম্পানি ও সদর দপ্তরকে না পেয়ে এবং কোনােপ্রকার যােগাযােগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় নৌকা ঘুরিয়ে একই পথে ফেরত যেতে শুরু করে। এদিকে গন্তব্যস্থলে পৌছাতে দেরি হওয়ায় রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল একটি টহল দলকে অগ্রবর্তী বাহিনীর খোঁজ নিতে পাঠান। পথিমধ্যে ‘এ’ কোম্পানির সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। টহল দল ‘এ’ কোম্পানিকে মদনের চর ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এ যােগাযােগ সম্পন্ন করতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। অবস্থান ও পরিস্থিতির বাস্তবতা বিবেচনা করে অধিনায়ক শাফায়েত জামিল ঐ রাতে আক্রমণ স্থগিত রেখে পরবর্তী রাতে দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এলাকার জনৈক দেলােয়ার হােসেন মুক্তিবাহিনীর জন্য। দিনরাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। এ রাতে মদনের চরে আখক্ষেতে একটি অস্থায়ী হাইড আউট স্থাপন করা হয়।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট রাত ৮টায় মদনের চর থেকে মুক্তিবাহিনী আরভির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। নৌকাযােগে ২ ঘন্টা চলার পর রাত ১২টায় রেজিমেন্টের সব সৈন্য একদিলা বটগাছ এলাকায় নির্দিষ্ট আরভিতে অবস্থান নেয়। পুরাে ব্যাটালিয়নকে নৌকাযােগে গন্তব্যস্থলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির উদ্দিন। স্থানীয় জনগণের সহযােগিতায় তার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হয়েছিল। নির্দিষ্ট আরভিতে পৌছানাের পর পরিকল্পনা অনুযায়ী নায়েব সুবেদার আবদুল ওহাবের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন আরভিতে নিরাপত্তায় নিয়ােজিত হয়। ক্যাপ্টেন আনােয়ারের অধিনায়কত্বে ‘এ’ কোম্পানির অন্য প্ল্যাটুন ২টি জিলপাক চিনিকল আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। একই সময় লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানির ৩টি প্লাটুন দেওয়ানগঞ্জের পরিদর্শন বাংলাে, বাজার, রেল স্টেশন, পাওয়ার হাউজ আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
আক্রমণ
এ আক্রমণে ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেনের তত্ত্বাবধানে ‘এ’ কোম্পানির প্ল্যাটুন। ২টির নেতৃত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার মােখলেসুর রহমান ও নায়েব সুবেদার। মােহাম্মদ আলী। জিলপাক চিনিকলে উভয় প্লাটুন একসাথে আক্রমণ চালায়। হঠাৎ আক্রমণে প্রতিপক্ষ থেকে বড়াে ধরনের কোনাে বাধা আসেনি। জিলপাক চিনিকল এলাকায় পাহারারত রাজাকার ও অবাঙালি সৈন্যরা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চিনিকল এলাকার ব্যাপক ক্ষতিসাধন। করেন। মুক্তিবাহিনীর এ দলটি ২ আগস্ট আনুমানিক ভাের ৪টায় আরভিতে প্রত্যাবর্তন করে। অপরদিকে, লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানি তাদের জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলগুলােতে একযােগে আক্রমণ চালায়। ‘ডি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন সুবেদার বােদির নেতৃত্বে থানা, পরিদর্শন বাংলাে ও বাজার এলাকায়। আক্রমণ পরিচালনা করে। ‘ডি’ কোম্পানির অন্য ১টি প্লাটুন সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে পাওয়ার হাউজ ও রেল স্টেশন আক্রমণ করে। এ এলাকায়। নিয়ােজিত রাজাকার ও অবাঙালি সৈনিকেরা প্রাথমিকভাবে প্রতিরােধ সৃষ্টি করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে তারা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ প্লাটুনের সদস্যরা পাওয়ার হাউজের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ‘ডি’ কোম্পানির অন্য প্লাটুনটি সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনা করে। মাদ্রাসায় অবস্থানরত রাজাকার সদস্যরা জোর প্রতিরােধ গড়ে তােলে। ‘ডি’ কোম্পানির সৈনিকেরা দুর্বল স্থানগুলাে চিহ্নিত করে আক্রমণ জোরদার করলে প্রাথমিকভাবে ৫জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এ আত্মসমর্পণের ফলে প্রতিরােধ সৃষ্টিকারী রাজাকারদের মনােবল ভেঙে পড়ে এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে।
সফল এ আক্রমণ শেষে মুক্তিবাহিনীর সবাই ভাের নাগাদ আরভিতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় আকাশে পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টার দেখা যায়। একই সময় বাহাদুরাবাদ ঘাটে গানবােট ও লঞ্চের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী। কর্তৃক প্রচুর সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে অবস্থান সুরক্ষিত করার সংবাদ আসে। সফল অপারেশন শেষে মুক্তিবাহিনীর সমগ্র দলটি কাঠের বিল হাই স্কুল অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় ফেরত আসে। অতঃপর স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ঘাটিতে রেখে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলঢালাস্থ বেইস ক্যাম্পে ফিরে যায়।
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তা হলাে সফল অভিযান দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধটিকে সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনীর একটি সফল যুদ্ধ অভিযান হিসেবে অভিহিত করা যায়। যুদ্ধ পরিকল্পনায় গৃহীত সমস্ত লক্ষ্য এইঅভিযানে অর্জিত হয়। যুদ্ধ পরিকল্পনার সামগ্রিক বাস্তবায়নের দিক থেকে দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধ একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা।
জনগণের সার্বিক সহযােগিতা
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে জনগণের সার্বিক সহযােগিতা প্রদান। সীমান্ত থেকে অনেকটা ভিতরে গ্রামের পথ ধরে নৌপথে পাড়ি দিয়ে। অভিযান পরিচালনা ছিল অনেকটা দুঃসাধ্য কাজ। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সহযােগী ছিল গ্রামের জনসাধারণ। জনসাধারণ তাদের সার্বিকভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। বিশেষত এক দিনের বিলম্ব ঘটার বিষয়টি ছিল অনেকটা দুর্ঘটনার মতাে। এ সময় এলাকার জনগণ তাদের খাদ্য সরবরাহ করে। জনগণের সার্বিক সহায়তা ছাড়া এ যুদ্ধে জয়লাভ ছিল অনেকটা দুঃসাধ্য ব্যাপার।
স্থানীয় গাইডের নির্দেশনা
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তাদের কাছে এলাকার কোনাে ম্যাপ ছিল না। কোনাে বেতারযন্ত্র বা বাইনােকুলার তারা সাথে নিয়ে যাননি। সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় গাইডদের সহায়তায় এ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়েছে। অধিনায়ক ও সৈনিকদের ঝুকিপূর্ণ ধৈর্য আক্রমণস্থলে পৌঁছার পথে ‘এ’ ও ‘ডি’ কোম্পানির সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনভিপ্রেত হলেও স্বাভাবিক ছিল। পুনরায় ২টি কোম্পানির একত্র হতে অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার কারণে ৩১ আগস্ট রাতে আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়নি। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক পরদিন আক্রমণের সিদ্ধান্ত প্রদান করলে পুরাে ব্যাটালিয়নকে গ্রামের মাঠে আখক্ষেতের ভিতর বাকি রাত ও পরদিন অবস্থান করতে হয়। এ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে অধিনায়কেরা ও সৈনিকেরা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে অবস্থান করেন। আখক্ষেতের ভিতরে রাত ও দিনযাপন থেকে যােদ্ধাদের উচ্চতর ধৈর্য ও মনােবলের পরিচয় পাওয়া যায়।
গােপনীয়তা রক্ষা
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া, নৌকায় গমন, গ্রামের আখক্ষেতে অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় গােপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি ছিল খুবই কঠিন কাজ। অধিনায়কের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং গ্রামের জনগণের সহযােগিতায় গােপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান জানতে পারেনি। এ গােপনীয়তা রক্ষা যুদ্ধে জয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থান বিশ্লেষণ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দেওয়ানগঞ্জে কোনাে নিয়মিত সৈন্যদল ছিল না। সম্ভবত থানা সদর এলাকা হওয়ার কারণে রাজাকার ও সশস্ত্র অবাঙালির সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলাে রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত সৈন্যদল না থাকায় স্থানীয় রাজাকার ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা দল মুক্তিবাহিনীর প্রকৃত অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিল। যার ফলে। মুক্তিবাহিনীর একটি রেজিমেন্ট শক্তিসম্পন্ন আক্রমণকারী দল সীমান্তের ৩০ মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করে একাধিক অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের পর মুক্তিবাহিনী আরও ২ দিন দেশের অভ্যন্তরে। অবস্থান করে দেওয়ানগঞ্জ আক্রমণ করে। এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী। বাহাদুরাবাদ ঘাট কিংবা দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় কোনাে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাতে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু, মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে পুরাে রেজিমেন্ট সারাদিন আখক্ষেতে অবস্থান করে। এতেই ধারণা করা যায়, এ অঞ্চলে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তার সহযােগীরা মােটামুটি অন্ধকারে ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর তথ্য সংগ্রহে জনসাধারণের অসহযােগিতামূলক মনােভাব এর মূল কারণ বলে উল্লেখ করা যায়।
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা
দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. মেজর শাফায়েত জামিল
২. ক্যাপ্টেন আনােয়ার।
৩, লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী খান
৪. নায়েব সুবেদার ওয়াহাব।
৫. নায়েব সুবেদার মােখলেসুর রহমান
৬. নায়েব সুবেদার মােহাম্মদ আলী
৭. সুবেদার হাফিজ
৮, সুবেদার বােদি
৯. সুবেদার করম আলী।
১০. সুবেদার আলী আকবর
১১. সুবেদার আলী নেওয়াজ
১২. মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসির উদ্দিন।
যুদ্ধের উল্লেখযােগ্য দিক বিশ্লেষণ মুক্তিবাহিনী শুধু গ্রাম্য জনসাধারণের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতেই আক্রমণের জন্য লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করে এবং দেওয়ানগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত সৈন্যদের অবস্থান আছে ধরে নিয়েই আক্রমণ পরিচালনা করে। বাস্তবে তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল ছিল। পাকিস্তানি সেনাদলের প্রকৃত অবস্থান যাচাইয়ে নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করে আক্রমণ পরিকল্পনা করা উচিত ছিল। কেননা পাকিস্তানি বাহিনী। সচেতন থাকলে সীমান্তের প্রায় ৩০ মাইল অভ্যন্তরে নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর দীর্ঘ সময় অবস্থান নেয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য আত্মঘাতী হওয়ার আশঙ্কা ছিল। পরিশেষে বলা যায়, দেশের বেশ অভ্যন্তরে একটি সফল দুঃসাহসী আক্রমণ পরিচালনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধের সবেচয়ে উল্লেখযােগ্য দিক ছিল এলাকার জনগণের সর্বাত্মক সহযােগিতা। বেশ প্রতিকূল অবস্থায় দীর্ঘ সময় অবস্থানকালে এলাকার সাধারণ মানুষের সহযােগিতার বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠেছিল। এ অভিযানের সফলতার ভিতর দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও জনগণের সামগ্রিক একাত্মতার একটি চিত্র পাওয়া যায়।
নকশী বিওপি’র যুদ্ধ
নকশী বিওপি’র অবস্থান
নকশী বিওপি’র অবস্থান তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় । এটি ঝিনাইগাতি থানার অন্তর্গত। বর্তমানে এ থানা নতুন শেরপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত। তকালীন মহকুমা সদর জামালপুর থেকে এ অঞ্চলটির দূরত্ব প্রায়। ৩৫ কিলােমিটার। শম্ভুগঞ্জ সড়কসেতু নির্মাণের পূর্বে ঢাকা কিংবা ময়মনসিংহ থেকে এ অঞ্চলে সড়কপথে যাতায়াত জামালপুরের মধ্য দিয়ে সহজতর ছিল। জামালপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে ছিল ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা। তুরা রেঞ্জের গারাে পাহাড় অঞ্চলের দক্ষিণে নকশী অবস্থিত। এলাকাটি শালবন আচ্ছাদিত এবং সমতল ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু টিলাসংবলিত। আশপাশে টিলার মাঝখানে নিচু ভূমিতে বিওপি’র অবস্থান। বিওপি’র চারদিকে বেশ কিছুটা জায়গা সমতল ও ধানক্ষেত। এ নিচু সমতল ভূমির উপর দিয়ে। বয়ে গেছে অনেক প্রাকৃতিক নালা। পাহাড়ি এলাকা থেকে সৃষ্ট এসব নালায় বর্ষাকালে প্রবল স্রোতের সাথে পানি প্রবাহিত হয় ।
নকশী বিওপি’র চারপাশে নেওয়াকাচি, গন্দিগাঁও, হালজাতি, রাংটিয়া, নয়া রাংটিয়া প্রভৃতি গ্রামের অবস্থান। জামালপুর-শেরপুর থেকে উত্তরগামী রাস্তা ঝিনাইগাতি হয়ে নকশী বিওপি’র সন্নিকটে সীমান্ত সড়কে মিশেছে। সীমান্ত সড়কটি কাচা। এ সড়ক পশ্চিমে সাতানীপাড়া বিওপি এবং পূর্বে হলদিগ্রাম বিওপি’র দিকে গিয়েছে।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৬ অ্যাডহক ডিভিশনের ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের উপর ন্যস্ত ছিল। ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল ঢাকা এবং জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল জমশেদ খান। ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কাদের খান নিয়াজি এবং সদর দপ্তর ছিল ময়মনসিংহে। ব্রিগেডের গঠন ও অবস্থানগুলাে ছিল নিমরূপ:
৯৩ পদাতিক ব্রিগেড ব্রি. আ. কাদির খান নিয়াজি
সদর দপ্তর ময়মনসিংহ।
৮৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মর্টার ব্যাটারি। জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চল
৩৩ পাঞ্জাব ময়মনসিংহ, ফুলপুর, হালুয়াঘাট
অঞ্চল।
৩১ বালুচ জামালপুর, রাজেন্দ্রপুর, হাতিবান্ধা,
৭০ উইং রেঞ্জার্স দেওয়ানগঞ্জ, টাঙ্গাইল অঞ্চল
৭১ উইং রেঞ্জার্স ময়মনসিংহ, কিশােরগঞ্জ অঞ্চল জারিয়া, ঝাঞ্জাইল, শিবগঞ্জ, বিরিশিরি অঞ্চল।
 
নকশী বিওপি’র অবস্থান ছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকায়। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ছিল জামালপুরে। এর অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ। নকশী বিওপিতে নিয়মিত বাহিনীর ১টি প্ল্যাটুন সৈন্যের অবস্থান ছিল। এ ছাড়া সহযােগী হিসেবে প্রায় ২ প্লাটুন রাজাকার ছিল। এ মিশ্র বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন মেজর রিয়াজ। ব্যাটালিয়ন ৩ ইঞ্চি মর্টার এ প্লাটুনের সাহায্যে নিয়ােজিত ছিল। ঝিনাইগাতী-নকশী সড়কের সংযােগস্থল আহমেদ নগর ছিল পাকিস্তানি। গােলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান। নকশী এবং এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্ত এলাকা ছিল এ কামানের আওতাভুক্ত।
পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
পাকিস্তানি বাহিনী স্ট্রং পয়েন্ট দুর্গ হিসেবে প্রতিরক্ষার উপযােগী করে গড়ে তােলে বিওপিটি। চারদিকে ছিল পুরু মাটির দেয়াল। দেয়ালের কাছাকাছি বাংকারগুলাে মর্টার ও আরসিএল-এর গােলাবর্ষণ থেকে রক্ষা করার উপযােগী। করে নির্মাণ করা হয়। বিওপি’র মাঝখানে ৩০ ফুট×৩০ ফুট আকৃতির একটি বড়াে বাংকার নির্মাণ করা হয়। এটি ছিল কংক্রিটের তৈরি এবং আর্টিলারি। কামান ও মর্টার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপযােগী। পরিখার মাধ্যমে। বাইরের বাংকারগুলাের সাথে এর যােগাযােগ রক্ষিত ছিল। বিওপি’র চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রতিবন্ধকতা জোরদার করা হয়। চারদিকে ৬০০ গজ এলাকার গাছপালা কেঁটে ফিল্ড অব ফায়ার পরিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া কাঁটাতারের বেড়ার ভিতরে বিওপি’র দিকে প্রথমে অ্যান্টিপার্সোনাল মাইন ও বুবি ট্র্যাপস পাতা হয়। তারপর বিওপি’র মাটির দেয়াল পর্যন্ত মাটিতে প্রচুর কঞ্চি গেঁথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। তা ছাড়া বিওপি’র চারদিকে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নালাগুলাে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কাজ করতাে। এ বিওপিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাহায্য-সরবরাহ শেরপুর ও ঝিনাইগাতি থেকে আসতাে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে ভারত পাকিস্তানিদের অবস্থানের চারদিকে তাদের সামরিক অবস্থান জোরদার করেছিল। পাকিস্তানি সামরিক কমান্ড এ বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিল। তাই পাকিস্তানিদের যুদ্ধ পরিচালনা ও মুক্তিবাহিনীর মােকাবিলায় তাদের ভারতীয় বাহিনীর এ অবস্থান গ্রহণকে বিবেচনায় আনতে হয়। নকশী বিওপিকে একটি শক্তিশালী দুর্গ হিসেবে গড়ে তােলার পিছনে পাকিস্তানি বাহিনীর সময় ও অবস্থানগত বিবেচনায় কিছু বিষয় কাজ করছিল। প্রথমত, উত্তরে ভারত সীমান্তের মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে জামালপুরের দিকে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী বা ভারতীয় বাহিনী কিংবা সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ মােকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, সীমান্তের ওপার থেকে আসা আক্রমণ প্রতিহত করে কালক্ষেপণ করা, যাতে জামালপুরের পথে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী খুব দ্রুত আক্রমণাত্মক কিংবা রক্ষণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। তৃতীয়ত, আক্রমণকারী দলের শক্তি বহুলভাবে নষ্ট করে দেয়া, যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থানে আসতে না পারে।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
জেড ফোর্স গঠনের পর ব্রিগেডটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চলে প্রথম অপারেশনাল দায়িত্ব পালন করে। এ ব্রিগেডের অন্তর্গত ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কামালপুর বিওপি এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের দায়িত্ব লাভ করে। একই সময় ব্রিগেডটির অপর ব্যাটালিয়ন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর নকশী বিওপি আক্রমণ ও দখলের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ সময় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর এ জে এম আমিনুল হক। উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী। এর অধীন কোম্পানিগুলাের অধিনায়কগণ হলেন:
‘এ’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।
‘বি’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন সাদেক হােসেন।
‘সি’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন মােদাচ্ছের হােসেন
‘ডি’ কোম্পানি। লেফটেন্যান্ট এমদাদুল হক।
৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আক্রমণ প্রস্তুতি
নকশী বিওপি আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয় ৩ ও ৪ আগস্টের মধ্যবর্তী রাত। আক্রমণের সময় ছিল ৪ আগস্ট ৩টা ৪৫ মিনিট। আক্রমণ পরিচালনায় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রেভ ও ডেল্টা কোম্পানি অ্যাসল্ট কোম্পানি হিসেবে দায়িত্ব লাভ করে। ১ প্লাটুন ইপিআর ও ১ প্লাটুন মুজাহিদ কাট অফ পার্টির দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। কাট অফ পার্টি নির্ধারিত কাজ ছাড়াও এ গ্রুপের দায়িত্ব ছিল আক্রমণকারী বাহিনীকে কভারিং ফায়ার প্রদান এবং প্রয়ােজনে রিজার্ভ হিসেবে কাজ করা। ফায়ার বেইসের জনবলকে এইচএমজি ও আরআর গ্রুপে ভাগ করা হয়। আরআর গ্রুপ ৭৫ মিলিমিটার আরআর সজ্জিত ছিল। এ ছাড়া ছিল ব্যাটালিয়ন মর্টার গ্রুপ। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
রেকি ও পরিকল্পনা
১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই-২ আগস্ট পর্যন্ত ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী পর পর ৩ দিন নকশী বিওপি এলাকায় বিস্তারিত রেকি চালান। ইপিআর-এর সুবেদার হাকিম রেকির সময় তার সাথে। থেকে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্যাংকার ও অন্যান্য স্থাপনা দেখিয়ে দেন এবং বাংকারের প্রকৃতি, কাটাতারের বেড়ার অবস্থান, বাঁশের পাঞ্জির অবস্থান, মাইন ফিল্ড, কুক হাউজ, মসজিদ, বিওপি’র প্রবেশপথ ও প্রহরীর অবস্থান ইত্যাদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। সুবেদার হাকিম একসময় নকশী বিওপির সুবেদার। ছিলেন। নিকটবর্তী গারাে পাড়ার এক ব্যক্তি বিওপি’র বাবুর্চির কাজ করতাে। সে মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতাে। তার কাছে থেকে বিওপিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়। তার তথ্যমতে জানা যায়, এ সময় বিওপিতে ৪৫জন নিয়মিত সৈন্য অবস্থান করছে এবং আরও ৬৫জন সৈন্য আসার কথা আছে। এ ছাড়া রয়েছে ৫০-৬০জন রাজাকার। দ্বিতীয় দিন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ সব প্ল্যাটুন অধিনায়কদের নিয়ে হালজাতি গ্রাম, নালাপথ ও শালবন এলাকা রেকি করেন এবং সবাইকে এফইউপি’র। অবস্থান, ফায়ার বেইসের অবস্থান প্রভৃতি বুঝিয়ে দেন। তৃতীয় দিন ১ আগস্ট আবার তিনি সেকশন অধিনায়কদের নিয়ে গিয়ে পূর্বোল্লিখিত স্থানগুলাে দেখান। এবং ব্রিফ করেন। ফায়ার বেইসের সাপাের্টিং হাতিয়ার মেশিনগান, ১০৬। মিলিমিটার ও ৭৫ মিলিমিটার আরআর-এর বাংকার তৈরির জন্য আড়াই মণি বস্তা জোগাড় করা হয়। ২ আগস্ট জেড ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান নিজে পরিকল্পনায় নির্ধারিত বিভিন্ন অবস্থান পরিদর্শন করে চূড়ান্ত অনুমােদন দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এফইউপি নির্ধারিত হয় বিওপি থেকে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকের শালবনে। কাট অফ পার্টি অবস্থান করবে ঝিনাইগাতি থেকে আগত রাস্তা ও সীমান্ত রাস্তার মিলনস্থল রাংটিয়ায়। ফায়ার বেইসের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয় পূর্ব শালবন অর্থাৎ দুই এফইউপি’র মধ্যবর্তী স্থানে উঁচু টিলায়। ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের অবস্থান নির্ধারণ করা হয় হালজাতি গ্রামে। আক্রমণের পূর্ববর্তী দুই রাত অ্যাসল্ট বাহিনীর সৈন্যদের বিনা শব্দে পানির উপর চলার প্র্যাকটিস করানাে হয়, যেন নালার পানি অতিক্রম করার সময় কোনাে শব্দ না হয়।
দায়িত্ব বণ্টন
৪ আগস্ট ৩টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অ্যাসল্ট পার্টি ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে সরাসরি বিওপি’র উপর আক্রমণ করবে। কাট অফ পার্টি অবস্থান করবে হলদি গ্রাম বিওপি থেকে আগত সীমান্ত রাস্তা ও ঝিনাইগাতি থেকে আগত রাস্তার মিলনস্থল রাংটিয়ায়। প্রধান উদ্দেশ্য শেরপুর ঝিনাইগাতি থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কোনােপ্রকার সাহায্য আসা বাধাগ্রস্ত করা এবং নকশী থেকে পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যদের হতাহত করা। এ ছাড়া অতিরিক্ত হিসেবে এদের জন্য নির্ধারিত ছিল অ্যাসল্ট পাটিকে কভারিং ফায়ারে সহায়তা প্রদান এবং প্রয়ােজনে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন। ফায়ার বেইসের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয় দুই এফইউপি’র অবস্থানের মাঝামাঝি উচু টিলার উপর। ফায়ার বেইসে এইচএমজি ও ৭৫ মিলিমিটার আরআর ইউনিট অবস্থান গ্রহণ। করবে। তাদের কাজ ছিল আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্বে গােলাবর্ষণের মাধ্যমে শক্রর অবস্থানের ক্ষতিসাধন এবং আক্রমণ পরিচালনার পর নিজস্ব বাহিনীকে ফায়ার সহায়তা প্রদান। ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর এ টি এম আমিনুল হক। প্রথমে হালজাতি গ্রামে ও পরে আক্রমণ চলাকালে ফায়ার বেইসে অবস্থান করে যুদ্ধ তদারকি করবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
যুদ্ধ নির্দেশ ও যুদ্ধযাত্রা
অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে আক্রমণকারী সৈন্যরা খুবই সুষ্ঠুভাবে এফইউপিতে পৌছায়। মাঝপথে নালা অতিক্রম করার সময়ও কোনােপ্রকার শব্দ হয়নি। একই সময় কাট অফ পার্টির সদস্যরা রাংটিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করে। এফইউপি মার্কিং না করার কারণে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তবে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী ৮-১০জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে নিজে ফায়ার বেইস পজিশনে পৌছে দেন। উদ্দেশ্য অধিনায়কের নিজের উপস্থিতির দ্বারা সৈন্যদের মনে সাহস ও উদ্দীপনা সঞ্চার করা। রাত ১২টার সময় সমাবেশস্থল হালজাতি গ্রাম থেকে আক্রমণকারী মূল বাহিনী যাত্রা শুরু করে। সবাই রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে বিন্যাস ভূমিতে অবস্থান গ্রহণ করে। ডানে ও বামে অবস্থান গ্রহণ করে যথাক্রমে ১২ নম্বর ও ৫ নম্বর প্ল্যাটুন। একই সময় ইপিআর ও মুজাহিদ গ্রুপের ১ প্লাটুন সমন্বয়ে গঠিত কাট অফ পাটি রাংটিয়ায় অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ ৩টা ৪৫ মিনিটে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করার সংকেত দেন। সংকেত দেয়ার সাথে সাথে আর্টিলারি গর্জে ওঠে। একই সাথে গর্জে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনীর কামান ও মর্টার। একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাড়িয়ে অগ্রসর হওয়া যথেষ্ট সাহসের কাজ ছিল, বিশেষ করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানির লােকদের জন্য। কারণ তাদের দুই কোম্পানির ২০০জনের মধ্যে মাত্র ১০জন সামরিক, ৮জন ইপিআর, ২-৩জন পুলিশ এবং বাকি সবাই ৭ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রামবাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ।
চূড়ান্ত আক্রমণ
কামানের প্রচণ্ড আওয়াজে এফইউপিতে অবস্থানরত স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকেরা। প্রায় মাটির সাথে মিশে যায়। এ প্রবণতা আরও বেড়ে যায় যখন নিজেদের আর্টিলারির ৩টি গােলা এফইউপিতে এসে পড়ে। এ ফায়ারে ৮-১০জন নিজ সৈন্য হতাহত হয়। ঐ প্লাটুনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং প্লাটুনের সদস্যরা আহতদের সেবা করার নাম করে এফইউপিতেই থেকে যেতে চেষ্টা করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর ফায়ার বেইসে অবস্থানরত আরআর ইউনিট ও এমজি ইউনিটও বিওপি’র উপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু করে। এদিকে হালজাতি গ্রাম থেকে ইপিআর প্লাটুন ২টি শত্রুকে ভাওতা দেয়ার জন্য গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং আক্রমণব্যুহ রচনা করে শত্রুদের ঘাবড়িয়ে দেয়। এ সুযােগে আক্রমণকারী দল এক্সটেনডেন্ট লাইন ফরমেশন করে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে। আক্রমণকারী দল ৫০০ গজ দূরে নালার কাছে পৌছালে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী মটার গ্রুপকে নালার পাড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে ৩০০ গজ দূরে শত্রু শিবিরে গােলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের সুযােগে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় সব সৈন্যই নালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে মাথা নিচু করে অনুমানের ভিত্তিতে ফায়ার করতে থাকে। নায়েব সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর প্লাটুন ২টির বিওপি’র গেটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল। তারাও নালার ভিতর আড়াল নিয়ে মাথা নিচু করে ফায়ার করতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে সৈনিকদের উপর কমান্ড ও কন্ট্রোল শিথিল হয়ে পড়ে। তাই শত্রু শিবির নিকটবর্তী জেনেও ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদের জন্য চিকার করে। কমান্ড দেয়া ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না। চিল্কার করে এবং গায়ে ধাক্কা দিয়ে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে এগিয়ে দিতে সচেষ্ট হন। তাঁর বামে হাবিলদার নাসির অত্যন্ত সাহসিকতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ নিজেও নায়েক সিরাজকে নিয়ে ডানের বাংকারের দিকে অগ্রসর হন। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করে এবং ক্যাপ্টেন আমিন ‘চার্জ’ বলে আক্রমণের আদেশ দেন।
মুক্তিযােদ্ধারা ‘ইয়া আলী’ বলে সঙ্গিন উচু করে বিওপি আক্রমণের জন্য দৌড়াতে শুরু করেন। এ সময় সুবেদার মুসলিম নারায়ে তকবির’ বলে চিৎকার করে উঠলে মুক্তিযােদ্ধারা উচ্চকণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ প্রত্যুত্তরে রণভূমিকে প্রকম্পিত করে তােলেন। মুক্তিবাহিনী যখন শত্রু শিবিরের মাত্র ১০০ গজের মধ্যে পৌছে যায়, ঠিক তখনই শক্রর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারি শেল এসে তাদের উপর বিস্ফোরিত হয়। এতে বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। এর মধ্যে হাবিলদার নাসিরও ছিলেন। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। অধিনায়ক আমিন আহমেদের পায়ে শেলের একটি টুকরা আঘাত করে। আঘাতের গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই তিনি শত্রু শিবিরের দিকে আরও ৫০ গজ এগিয়ে যান। মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ অবস্থায়ও এগিয়ে যান এবং পলায়নরত শত্রু সৈন্যদের আঘাত করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষেও তখন হতাহতের ঘটনা ঘটছিল। কেউ কেউ মাইন বিস্ফোরণে কেউবা গুলিতে হতাহত হচ্ছিল। এ সময় অনার্সের ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা শামসুল আলম মাইনের আঘাতে শহিদ হন।  শহিদদের নিয়ে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ আরও অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। ঠিক এ সময়ই বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর এত কাছে ছিলেন যে, এক পাকিস্তানি সেনা তাকে বেয়নেট বিদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসে। অল্পবয়স্ক মুক্তিযােদ্ধা সালাম (অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং এক সুবেদার মেজরের পুত্র) গুলি করে তাকে হত্যা করে। এদিকে পিছনে নালার মধ্যে মাথা নিচু করে যারা গুলিবর্ষণ করছিল তাদের গুলিতে অনেক মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন।
আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে গিয়েও ক্যাপ্টেন আমিন সামনে ধাবমান শত্রু সৈন্যদের উপর গুলি  চালাচ্ছিলেন। তার সাথে থাকা পারসােনাল গার্ড হানিফকে (একজন অবাঙালি। ছেলে) তিনি ডান দিকের বাংকারে অবস্থানরত শত্রু সৈন্যদের গুলি করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হতাহতের কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তখন অনেকাংশেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছেন। হানিফ তখন বারবার অনুরােধ করছিল, “স্যার, আব পিছে চালে যাইয়ে, ম্যায় কভারিং দে রাহাহু।” হানিফকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেয়ার আগেই গুলিবিদ্ধ হয়ে হানিফ শাহাদতবরণ করেন। সাথে সাথে শক্রর গুলিতে ক্যাপ্টেন আমিনের পাশের মাটি উড়ে যায়। শত্রু তাকে দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে তিনি সাইড রােল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বাম দিক থেকে একটি গুলি এসে তার ডান হাতের কনুইতে আঘাত করে। তার হাতের স্টেন ছিটকে পড়ে। তিনি বা হাত দিয়ে তা তুলে নেন। আঘাতের স্থান থেকে তখন রক্ত বের হচ্ছিল। তিনি ফিল্ড ড্রেসিং বের করতে চেষ্টা করাকালীন আবার তার দিকে এক ঝাক গুলি ছুটে আসে এবং পাশের আইল উড়িয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, সেখানে থাকা আর সম্ভব নয়। চারদিকে তখন কেবল লাশ আর লাশ। মুক্তিবাহিনীর যে ৮-১০জন সদস্য শক্রর বাংকারে ঢুকে পড়েছিলেন, তারাও শহিদ হন। এর মধ্যে ছিলেন নায়েক সিরাজ ও পুলিশের ল্যান্স নায়েক সুজা মিয়া। গুরুতর আহত অবস্থায় শত্রুর আওতা থেকে বের হওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন আমিন সাইড রােল করতে করতে শালবনের দিকে অগ্রসর হন। এ সময়ই একটি অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটে। পূর্বে উল্লিখিত অল্পবয়স্ক মুক্তিযােদ্ধা সালাম পঞ্চাশ গজ হেঁটে ফিরে গিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি আবার দৌড়ে এসে পড়ে থাকা একটি এলএমজি নিয়ে জয় বাংলা’ বলে শত্রু বেষ্টনীর দিকে ছুটে যান। শত্রু তখন কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য মাটির দেয়ালের পিছনে একত্র হচ্ছিল।
“ওরে তােরা আমার মা-বাপ সবাইকে মেরেছিস, আমি ছেড়ে দেব?” চিৎকার করতে করতে সালাম শত্রু বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে পড়েন। উল্লেখ্য, সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি বলে আক্রমণে তাকে নেয়া হয়নি। তিনি চুপি চুপি পালিয়ে এসে অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় আক্রমণকারী দলে যােগ দেন। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র তখন লাশে ভরে গেছে। বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ চলছিল দুই পক্ষে। ফায়ার বেইসে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ঘন ঘন গর্জন করে পশ্চাদপসরণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের কভার দিয়ে যাচ্ছিল। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া ক্যাপ্টেন আমিন নিজেদের কভারিং ফায়ার থেকে বাঁচার জন্য ডানে অপেক্ষাকৃত নিচু ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে চলতে থাকেন। নালার কাছে পৌছে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে কোনােরকমে তিনি নালা পার হয়ে কিছুটা স্বস্তি বােধ করেন। কিন্তু এ সময় আর এক ঝাক গুলি তার পায়ের কাছের মাটি উড়িয়ে নিয়ে যায়। তিনি দেখতে পেলেন, ১০-১২জন শত্রসৈন্য তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর তিনি বুঝতে পারেন, কর্দমাক্ত মাটিতে তার আসার চিহ্ন ও রক্তের দাগ অনুসরণ করে শত্রুরা তার দিকে এগিয়ে আসছে। ধানক্ষেতের আড়ালে প্রায় ৩০০ গজ অগ্রসর হওয়ার পর ধানক্ষেত শেষ হয়ে যায়। এরপর ২০০ গজ খােলা মাঠ। মুক্তিযােদ্ধাদের দিক থেকে তখন কোনাে সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফায়ার বেইসের মেশিনগান থেকেও আর কোনাে গুলিবর্ষণ হচ্ছিল না। এফইউপি প্রহরায় যারা ছিল, তারাও ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। তাঁর অনুমান, শত্রু তখন ৫০ গজের মধ্যে চলে এসেছে।
তিনি কোনােরকমে নিজেকে টেনে নিয়ে কামানের গােলায় সৃষ্ট একটি গর্তে আশ্রয় নেন। সারা। শরীরে কাদা মেখে হেলমেট মাথার নিচে দিয়ে তিনি শুয়ে পড়েন। তখন সকাল ৮টা ১০ মিনিট। নিজস্ব বাহিনীর অ্যাকশন তখন সম্পূর্ণ বন্ধ। ঠিক এমন সময় শালবন থেকে তিনি তার কমান্ডিং অফিসার মেজর এ টি এম আমিনুল হকের গলা শুনতে পান, “আমিন, আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করাে।” ক্যাপ্টেন আমিনের নিহত অথবা নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে ব্রিগেড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক আমিনুল হককে কিছু সৈন্য নিয়ে তাকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। সৈনিকের বিপদের মুখে ক্যাপ্টেন আমিনের দিকে এগিয়ে আসতে ইতস্তত করছে দেখে মেজর আমিনুল হক নিজেই ক্রল করে অগ্রসর হন। হাবিলদার তাহেরও তাকে অনুসরণ করেন।
তারা ক্যাপ্টেন আমিনের পা ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন। অপরদিকে, পাকিস্তানি সেনারা তখন তাদের অবস্থান থেকে ২০-২৫ গজ দূরে। তারা একজন আহত মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করে সামনে এগিয়ে আসছে। শালবন থেকে। লেফটেন্যান্ট মুদাচ্ছের তখন চিল্কার করে তাড়াতাড়ি সরে আসার কথা বলছেন। নিজ পক্ষের গায়ে গুলি লাগার আশঙ্কায় তিনি শত্রুদের উপর গুলি চালাতে পারছিলেন না। তাই ২জন এলএমজি চালককে তাদের এলএমজি নিয়ে। গাছের উপর উঠে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর এলএমজি-এর গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। পাকিস্তানিরা তখন ক্যাপ্টেন আমিনের কাছাকাছি আসার আগেই মেশিনগানের গুলিতে তাদের ৬-৭জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পথপ্রদর্শক মকবুল ও অন্য এক দালাল ধরা পড়ে। ২জন পাকিস্তানি সৈন্য দৌড়ে পালায়। এ সময় শক্রর কামানের গােলা তাদের আশপাশে পড়তে থাকে। মেজর আমিনুল হক। ক্যাপ্টেন আমিনকে কাঁধে তুলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে ২জনই নালাতে পড়ে যান। হাবিলদার তাহের তখন ক্যাপ্টেন আমিনকে। কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে আসেন।
নকশী যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা
নকশী বিওপি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ২৬জন শহিদ অথবা নিখোঁজ হন। তারা হলেন:
১. হাবিলদার নাসির উদ্দিন
২. সিপাহি মােহাম্মদ আলী
৩. সিপাহি সিরাজুল হক
৪. ল্যান্স নায়েক আবুল কালাম
৫, ল্যান্স নায়েক মাে. ইউসুফ মিয়া
৬, সিপাহি মাে. সুজা মিয়া
৭. সিপাহি হুমায়ূন কবির
৮. সিপাহি শামসুজ্জামান
৯. সিপাহি আবদুস সাত্তার
১০. সিপাহি ফয়েজ আহম্মদ।
১১. সিপাহি আবদুস সালাম
১২. সিপাহি মাে. হানিফ।
১৩. প্রাক্তন ইপিআর সিপাহি আবদুস সালাম
১৪. সিপাহি সদর উদ্দিন
১৫. সিপাহি ফজলুল হক
১৬. সিপাহি আবদুস সামাদ
১৭. সিপাহি জামাল হােসেন
১৮. সিপাহি আবু ইসমাইল
১৯. নায়েক আবদুস সালাম
২০. নায়েক সৈয়দ ফুল মিয়া
২১. নায়েক সদর উদ্দিন।
২২. নায়েক হায়েত আলী।
২৩. নায়েক আবদুল কুদুস
২৪. রবিউল আলম
২৫. সিপাহি শাহজাহান আলী
২৬. সিপাহি মনসুর আলী।
যুদ্ধে পাকিস্তানি পক্ষে হতাহতের কোনাে বিবরণ পাওয়া যায় নি।
যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ
গােপনীয়তা
নকশী বিওপি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণপূর্ব সমস্ত কার্যক্রমের আকস্মিকতা সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয়। আক্রমণ এতটাই আকস্মিক ছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনী কোনাে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। সম্ভবত এ কারণেই তারা কোনাে রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাতে পারেনি। এ জন্য কাট অফ পার্টিকে কোনাে রিইনফোর্সমেন্টের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়নি। গােপনীয়তা রক্ষার জন্য ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানকে চমক্কারভাবে কাজে লাগানাে হয়েছিল। শালবনের আড়ালে ফায়ার বেইস স্থাপন, ৩ দিন ধরে সাফল্যজনক রেকি, প্লাটুন এমনকি সেকশন পর্যায়ের অধিনায়কদেরও নির্ধারিত এফইউপি, ফায়ার বেইস প্রভৃতি অবস্থানে সশরীরে নিয়ে গিয়ে ব্রিফ করা হয়। গােপনীয়তার সাথে বালির বস্তা সহযােগে বাংকার তৈরি করে ফায়ার বেইস স্থাপন করা হয়। এসবই সম্ভব হয়েছিল স্থানটির প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে বিশেষত ঘন শালবন। মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের অনুকূলে ছিল । গােয়েন্দা কার্যক্রম আক্রমণপূর্ব গােয়েন্দা কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণভাবে সফল। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের ভিতর নিজস্ব লােক প্রবেশ করানাে সম্ভব হয়। ক্যাম্পের গারাে বাবুর্চি ছিল মুক্তিবাহিনীর লােক। তিনি বিওপি’র সামগ্রিক অবস্থা, কৌশলগত অবস্থান এবং বিভিন্ন স্থাপনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি অ্যাসল্ট বাহিনীর অধিনায়ককে সবকিছু অবহিত করেন। ইপিআর-এর সুবেদার হাকিম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এ বিওপিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তাঁর সহযােগিতায় সুষ্ঠুভাবে সবকিছু রেকি করা সম্ভব হয়। অ্যাসল্ট বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ স্বয়ং ৩ দিন ধরে রেকি চালান।
জনগণের সহায়তা
বিওপি’র আশপাশের এলাকার জনগণ সম্পূর্ণভাবে সহযােগী মনােভাব প্রদর্শন করে। রেকি চলাকালে রেকি পার্টি স্থানীয় একটি গারাে মেয়ের চোখে ধরা পড়ে। গেলেও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমের কোনাে আভাস পায়নি।
ফায়ার বেই ফায়ার বেইসের অবস্থান ও সংগঠন ছিল চমৎকার। ফায়ার বেইস থেকে কার্যকর গােলাবর্ষণ শক্রর মাঝে ত্রাসের সঞ্চার করে। যুদ্ধের একপর্যায়ে। মুক্তিবাহিনী যখন পশ্চাদপসরণ করছিল, তখনাে ফায়ার বেইস কার্যকর ফায়ারিং কভার দিতে সক্ষম হয়েছিল।
উচ্চতর অধিনায়কদের পরিকল্পনাস্তরে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ
নকশী বিওপি’র যুদ্ধে ব্রিগেড অধিনায়ক জিয়া নিজে আক্রমণের জন্য যেসব স্থান চিহ্নিত করেছিলেন এবং যেসব স্থাপনা ব্যবহার করা হয়েছিল, তা পরিদর্শন করেন। তিনি নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতি যােদ্ধাদের মনােবল বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিল।
ব্যক্তিগত বীরত্ব ও কর্তব্যবােধ
এ যুদ্ধে বহু যােদ্ধা অসাধারণ ব্যক্তিগত বীরত্ব ও কর্তব্যবােধ প্রদর্শন করেন। কিশাের সালাম, অবাঙালি হানিফ, হাবিলদার নাসির, নায়েক সিরাজ ও পুলিশের ল্যান্স নায়েক সুজা মিয়া প্রমুখ বিশেষ বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তা ছাড়া অবাঙালি হানিফ, ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক আমিনুল হক, হাবিলদার হের তাদের। কর্তব্যনিষ্ঠার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আক্রমণের আকস্মিকতা যুদ্ধে, বিশেষত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আক্রমণের আকস্মিকতা। যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ সম্পর্কে সামান্যতম অনুমানও করতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত আকস্মিকভাবে এবং ক্ষিপ্তগতিতে নকশী বিওপি আক্রমণে সক্ষম হয়। তাদের আক্রমণের আকস্মিকতায় পাকিস্তানি বাহিনী অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় এ আকস্মিক আক্রমণের পরিবর্তিত গতি বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। সহযােদ্ধাদের প্রতি কর্তব্যবােধ নকশী বিওপি যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযােগ্য দিক হলাে সহযােদ্ধাদের প্রতি কর্তব্যবােধ।
যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদকে মেজর এ জে এম আমিনুল হক ও হাবিলদার তাহের শত্রু সৈন্যের অবস্থানের মাত্র ২০-২৫ গজ দূরে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সহযােদ্ধার প্রতি এ ঝুঁকিপূর্ণ কর্তব্যবােধ ও পদক্ষেপ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে চিহ্নিত। উপরিস্তরের অধিনায়কদের সচেতনতা নকশী বিওপি’র যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর উপরিস্তরের অধিনায়কদের সচেতনতা যুদ্ধে একটি নতুন মাত্রা যােগ করেছিল। বিশেষত যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ শহিদ অথবা নিখোজ হয়েছেন, এ খবর পাওয়ার পর জেড ফোর্সের ব্রিগেড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর আমিনুল হককে কমান্ডাে সাথে নিয়ে আমিন আহমদকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। উপরিস্তরের অধিনায়কদের এ দায়িত্ববােধ এবং কঠোরতা মুক্তিবাহিনীর মনােবলকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। মাঠপর্যায়ের যােদ্ধারা জিয়ার এ পদক্ষেপে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। কিন্তু এসব ইতিবাচক ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুকূলে থাকার পরও নকশী বিওপি’র যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সাফল্য লাভ করতে পারেনি। যুদ্ধে সফল না হওয়ার কারণগুলাে। নিমে বিশ্লেষণ করা হলাে:
স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক
৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ সৈন্য ছিল স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের মাত্র ২৮ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তাদের কোনাে যুদ্ধ অভিজ্ঞতা। ছিল না। ফলে কামানের গােলাবর্ষণের প্রচণ্ড শব্দে তারা ঘাবড়ে যায়। ৫ ও ৬ নম্বর প্ল্যাটুনের দায়িত্ব ছিল বিওপি’র গেটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করা। কিন্তু এ প্ল্যাটুন ২টি বিওপিতে পৌছানাের পূর্বেই নালার আড়ালে আশ্রয় নিয়ে মাথা নিচু করে আন্দাজে ফায়ার করতে থাকে। ফলে মূল অ্যাসল্টে লােকবলের ঘাটতি দেখা দেয়। শুধু তা-ই নয়, তাদের নিক্ষিপ্ত গুলিতে সামনে এগিয়ে যাওয়া। নিজেদের সৈন্যরা হতাহত হয়। যুদ্ধে সফলকাম না হওয়ার এটি অন্যতম একটি কারণ। আর্টিলারি সাপাের্ট মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আর্টিলারি সাহায্য দেয়ার কথা ছিল ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর। যুদ্ধের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায়, যখন মুক্তিবাহিনী এফইউপিতে অবস্থান করছিল, তখন আর্টিলারির ৩টি গােলা তাদের উপর এসে পড়ে। শত্রু পক্ষের বিওপি, মুক্তিবাহিনীর এফইউপি ও সাপাের্ট আর্টিলারি ব্যাটারির অবস্থান একই লাইনে হওয়ায় এরূপ দুর্ঘটনা ঘটেছিল বলে অনুমিত হয়। নিজস্ব এফইউপিতে গােলা এসে পড়ায় ৮-১০জন হতাহত হয় এবং তাদের সেবাশুশ্রুষার নামে ঐ প্লাটুন পুরােটাই এফইউপিতে থেকে যায়। এটাও মূল। অ্যাসল্টে সৈন্য কমে যাওয়ার কারণ। এর ফলে আক্রমণের তীব্রতা কমে যায়। এটি নকশী যুদ্ধে পরাজয়ের একটি মূল কারণ।
মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাস্বল্পতা
নকশী ক্যাম্পে দুর্গ প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত প্রতিরক্ষা স্থাপনায় প্রায় ১ কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা মােতায়েন ছিল। এদের বিরুদ্ধে ২ কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর সেনা পর্যাপ্ত নয়। উপরি-উক্ত শত্রু সৈন্য ছিল উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মূল যুদ্ধক্ষেত্রে এফইউপি থেকে ১ প্লাটুন সামনে অগ্রসর না হওয়ায় এবং ২ প্লাটুন। নালাতে অবস্থান নেয়ার কারণে আক্রমণকারী সেনার সংখ্যা একেবারে কমে। যায়। কোনাে রিজার্ভ রাখা হয়নি। রাংটিয়ায় যে সেনাদল কাট অফ পার্টির ভূমিকা পালন করছিল, তাদেরই রিজার্ভ হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। কাট অফ পার্টির সৈন্যসংখ্যাও ছিল মাত্র ২ প্ল্যাটুন এবং এদের ২টি অ্যাপ্রােচ থেকে সম্ভাব্য রি-ইনফোর্সমেন্ট বাধা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলে মূল আক্রমণকারী বাহিনী মাইনফিল্ড, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গড়া প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পার হয়ে বিওপি’র মূল মাটির দেয়াল পর্যন্ত পৌছে গেলেও পর্যাপ্ত সেনাবলের অভাবে বিওপি দখল করা যায় নি।
অফিসারের অভাব
২টি কোম্পানি এ আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। আক্রমণকারী বাহিনী দুই ভাগে। বিভক্ত হয়ে ২টি এফইউপিতে অবস্থান নেয়। কিন্তু অফিসার হিসেবে ছিলেন একমাত্র ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। আক্রমণকারী বাহিনীতে অফিসারস্বল্পতা, সঠিক কমান্ড ও দিকনির্দেশনার ঘাটতি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে আমিন আহমেদ আহত হয়ে পড়লে আক্রমণকারী বাহিনী যখন পশ্চাদপসরণ করছিল, তখন কমান্ড দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনাে অফিসার সমরক্ষেত্রে ছিলেন না।
পর্যাপ্ত গােলাবর্ষণের অভাব
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পর্যাপ্ত গােলাবর্ষণের অভাব দেখা দেয়। গােলাবর্ষণের। পরও বিওপি’র মাটির দেয়াল অক্ষত ছিল। পর্যাপ্ত গােলাবর্ষণের মাধ্যমে বিওপি’র মাটির দেয়াল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বাংকার ও অন্যান্য স্থাপনা ক্ষগ্রিস্ত করার পরই আক্রমণকারী বাহিনীর এফইউপি ত্যাগ করে সামনে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল। এতে তারা শত্রুপক্ষের নিবিড় গুলিবর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেত এবং তাদের লােক ক্ষয় কম হতাে। এতে করে বিওপিটি সহজেই দখল করা। যেত বলে ধারণা হয়। কিন্তু সংঘবদ্ধ আক্রমণের অভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর। শক্তি খুব একটা ক্ষয় হয়নি। পাকিস্তানি পক্ষের সাফল্যের কারণ নকশী বিওপিটি পাকিস্তানিরা দুর্গ প্রতিরক্ষার আদলে সুসজ্জিত করেছিল। স্থাপন করেছিল পর্যাপ্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বাংকার, মর্টার ও আর্টিলারি স্থাপনা। তাদের গােলাবারুদ ছিল পর্যাপ্ত। আশপাশের ৬০০ গজ এলাকার গাছপালা ও ঝােপঝাড় কেটে ফিল্ড অব ফায়ার পরিষ্কার করা হয়। বুবি ট্র্যাপস, মাইন, বাঁশের কঞ্চি ইত্যাদি ব্যবহার করে দুর্গটিকে দুর্ভেদ্য করে তােলা হয়। দুর্গের মাঝখানে শেলফ পাকা বাংকার তৈরি করা হয় সৈন্যদের আশ্রয়ের জন্য।
দুর্গটির চারপাশের পাহাড়ি নালাগুলােও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কাজ করতাে। বস্তুত নালাগুলাে যুদ্ধের গতিকে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুকূলে নিয়ে যায়। দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা ছিল। তারা ছিল । সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চ পেশাদারী মনােভাবের অধিকারী। ফলে মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পলায়নপর হলেও যে মুহূর্তে আক্রমণের। গতি স্তিমিত হয়, ঠিক তখনই তারা ঘুরে দাড়ায় এবং যুদ্ধের ফলাফল পাল্টে দেয়। বিপরীতে মুক্তিযােদ্ধারা পেশাদারিত্বের অভাব দেখায়। আহতদের শুশ্রুষা করার নামে মুক্তিবাহিনীর ১ প্যাটুন সেনা এফইউপি ত্যাগ করেন। আর ২টি প্ল্যাটুন প্রথম সুযােগেই নালার আড়ালে আশ্রয় নিয়ে মাথা নিচু করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। তারা আর বিওপি’র দিকে অগ্রসর হয়নি। তাদের গুলিতে দলের সদস্যরা হতাহত হয় এবং আক্রমণের গতি কমে যায়। ফলে। পাকিস্তানি বাহিনী সুসংহত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং ফলাফল তাদের। পক্ষে নিয়ে যায়। পরিশেষে বলা যায়, নকশী বিওপি’র যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। যুদ্ধের সামগ্রিক অবস্থানিক পরিবেশ মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। নকশী যুদ্ধের একটি দিক হলাে, স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের দিয়ে দক্ষ, পেশাধারী পাকিস্তানি সৈনিকদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে সাফল্য অর্জন অনেকটা দুরূহ। এটা যুদ্ধের একটি শিক্ষণীয় বিষয়। তবে গােপনীয়তা বজায় রেখে আকস্মিক গতিতে আক্রমণ। করে অনেক যুদ্ধেই কাক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হয়েছে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2020/05/nokshi-BOP.pdf” title=”nokshi BOP”]

Reference: ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন – আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!