বাহাদুরাবাদ ঘাটের যুদ্ধ
বাহাদুরাবাদ ঘাটের অবস্থান
বাহাদুরাবাদ ঘাট ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) দেওয়ানগঞ্জ থানায় অবস্থিত। বাহাদুরাবাদ ঘাট একটি উল্লেখযােগ্য যােগাযােগকেন্দ্র এবং যমুনা নদীর পূর্ব তীরে সর্ব-উত্তর রেলপয়েন্ট ও ঘাট স্টেশন। এ ঘাটের বিপরীত দিকে যমুনা নদীর অপর পাড়ে তকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ফুলছড়ি ঘাট। ফুলছড়ি ঘাট উত্তর অঞ্চলের মিটারগেজ রেলব্যবস্থার একটি টার্মিনাল পয়েন্ট ও ঘাট স্টেশন। বাহাদুরাবাদ ঘাট উত্তর অঞ্চলের রেল ওয়াগন পারাপারের একমাত্র যােগাযােগ মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত। যমুনা নদীর পূর্ব তীরে অন্য ঘাট স্টেশন জগন্নাথগঞ্জে ব্রডগেজ রেলব্যবস্থা থাকায় এ সুবিধা পাওয়া যায় না। এখানে উল্লেখ্য যে, যমুনার পূর্ব অঞ্চলে রেলব্যবস্থা পুরােটাই মিটার গেজ। কিন্তু যমুনার উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলে ব্রড ও মিটারগেজ উভয় লাইন চলমান। তাই পূর্ব অঞ্চলের সাথে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা রক্ষায়। বাহাদুরাবাদ ঘাটের গুরুত্ব অপরিসীম। বাহাদুরাবাদ ঘাট এবং এর নিকটবর্তী থানা সদর দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু শিল্প স্থাপনা রয়েছে। এগুলাের মধ্যে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, জিলবাংলা চিনিকল ও পাওয়ার হাউজ অন্যতম। এ ছাড়া বেশ কিছু পাটগুদাম আছে। পাট এ সময় পাকিস্তানের একক রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। রেলওয়ে ঘাট স্টেশন ছাড়াও বাহাদুরাবাদ ঘাট বাংলাদেশের একটি অন্যতম উল্লেখযােগ্য নদীবন্দর।
বাহাদুরাবাদ ঘাটের সামরিক গুরুত্ব
বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল ঢাকা থেকে উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সরঞ্জাম, অস্ত্র, গােলাবারুদ, খাদ্যসামগ্রী, জ্বালানি তেল ও জনবল প্রেরণের প্রধান মাধ্যম। একইসাথে বাহাদুরাবাদ ঘাট নৌবন্দর ছিল যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে মুক্তিবাহিনীর চলাচলের বিরুদ্ধে নৌ-টহলের অন্যতম ঘাঁটি। তাই দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তথা তৎকালীন বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রাখার বিষয়টি ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাটের উপর নির্ভরশীল। ঢাকার সাথে নদীপথ দ্বারা বিচ্ছিন্ন দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানকে শক্তিশালী রাখা এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ঘাটের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অপরদিকে, নদীপথে মেঘালয়, কুচবিহার, দার্জিলিং থেকে আগত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ৩৬ অ্যাডহক ডিভিশনের অধীনস্থ ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের উপর ন্যস্ত ছিল। জিওসি মেজর জেনারেল জমশেদের ডিভিশন সদর দপ্তর ছিল ঢাকা। ময়মনসিংহে অবস্থিত ৯৩ পদাতিক ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কাদের খান নিয়াজি। ৯৩ পদাতিক ব্রিগেড অধিনায়ক মুক্তিবাহিনীর গতিপথকে বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকা এবং বিভিন্ন রােড, জংশন, ঘাট প্রভৃতি স্থানে নিজ সৈন্যের অবস্থান নির্দিষ্ট করেন। মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমকে প্রতিরােধ করা ছাড়াও নিজ সেনাবাহিনীর চলাচলের পথকে নিরাপদ করাও ছিল একটি উল্লেখযােগ্য দায়িত্ব। কেননা এ বিষয়টির উপর নির্ভরশীল ছিল দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানের বিষয়টি। বাহাদুরাবাদ ঘাট পাকিস্তানি বাহিনীর জামালপুরে অবস্থানরত ৯৩ ব্রিগেডের অধীনস্থ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের এলাকায় অবস্থিত। এ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি সদর দপ্তর ছিল দেওয়ানগঞ্জে। কোম্পানির প্লাটুন বাহাদুরাবাদ ঘাটের নিরাপত্তায় নিয়ােজিত ছিল। বালুচ রেজিমেন্টের নিয়মিত সৈন্যদের সাথে রেঞ্জার্স, মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মিশ্রিত ছিল। এ সম্মিলিত বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন রফিক। সেনাবাহিনীর এ দলের উপর ঘাটের নিরাপত্তা রক্ষা ছাড়াও রেলে চড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে জামালপুর পর্যন্ত এলাকা নিয়মিত টহল দেয়ার বিষয়টিও তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
বাহাদুরাবাদ ঘাটের নদীর তীর এলাকায় প্রতিরক্ষার জন্য বেশ কিছু ট্রেঞ্চ তৈরি করা হয়। এখানে খালি রেল বগি সৈন্যদের বিশ্রামের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। পাকিস্তানি বাহিনী পাহারা জোরদার করার জন্য ঘাটে সার্চলাইটসহ একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে। রাতের বেলায় পাকিস্তানিরা বিভিন্ন দিকে সার্চলাইটের আলাে ফেলে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতাে। সীমান্ত থেকে অনেক অভ্যন্তরে অবস্থিত হওয়ায় এখানে বিশেষ কোনাে সতর্কতা বা অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। কাছাকাছি মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা না থাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদল তাদের অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর বড়াে ধরনের কোনাে আক্রমণের আশঙ্কা করেনি।
মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা
৩১ জুলাই রাতে বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের দিন নির্ধারিত করে ব্রিগেড থেকে রেজিমেন্টকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শাফায়েত জামিল। কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে: ‘এ’ কোম্পানি অধিনায়ক। ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন। ‘বি’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আকবর হােসেন। ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক। ক্যাপ্টেন মহসীন উদ্দিন আহমেদ ‘ডি’ কোম্পানি অধিনায়ক। লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খান ব্যাটালিয়ন সাপাের্ট প্ল্যাটুন নায়েব সুবেদার আবদুল আজিজ।
অধিনায়ক
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট এস আই এম নুরুন্নবী খানের উপর বাহাদুরাবাদ ঘাটের অপারেশনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। অপারেশন পরিচালনার সময় ‘ডি’ কোম্পানির সাহায্যকারী কোম্পানি হিসেবে ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে কোম্পানি নিয়ােজিত থাকবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রেজিমেন্ট অধিনায়ক নিজে সদর দপ্তর কোম্পানির সাথে থেকে অপারেশন পরিচালনা করবেন।
রেকি পরিকল্পনা বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর জেড ফোর্সের বিএম ক্যাপ্টেন। অলি আহমেদ ১১ নম্বর সেক্টরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মােহাম্মদ আলীকে বাহাদুরাবাদ ঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যক্তি নিয়ােগের অনুরােধ জানান। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক জহুরুল হক মুন্সি ও হাবিবুর রহমানকে প্রাথমিকভাবে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৫ জুলাই সেক্টর গােয়েন্দা সেকশনের সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল পাকিস্তানিদের রেকি বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা এবং বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিত করেন। এ তথ্য সংগ্রহে তাদের ৩ দিন ব্যয় হয়। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক জহুরুল হক মুন্সি প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ডিম বিক্রেতার ছদ্মবেশে পাকিস্তানি ক্যাম্পের ভিতর গমন করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও সৈন্যদলের অবস্থান লক্ষ্য করেন। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত সব তথ্য লিপিবদ্ধ করে রেজিমেন্ট সদর দপ্তরে পাঠানাে হয়। রেকি পার্টি প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য সংগ্রহ করে, সেগুলাে হলাে নিম্নরূপ:
১. বাহাদুরাবাদ ঘাটে ৫টি জেটি আছে।
২টি ফ্ল্যাট জেটি প্যাসেঞ্জারবাহী। স্টিমারের জন্য। ২টি ফ্ল্যাট জেটি রেলওয়ে ওয়াগন, অয়েল ট্যাংক, সামরিক-বেসামরিক যানবাহন, আর্টিলারি গান পারাপারের জন্য। বাকি ১টি জেটি আছে সি ট্রাক, লঞ্চ, স্টিমার ও সামরিক যানবাহনের ব্যবহারের জন্য।
৩.বাহাদুরাবাদ ঘাটের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি প্ল্যাটুন, ১ প্লাটুন রেঞ্জার্স এবং ৫০জনের মতাে অবাঙালি রাজাকার বাহিনীর সদস্য। বাহাদুরাবাদ ঘাটের চারদিকে রেললাইনের উঁচু স্থানে মজবুত বাংকার আছে।
৪, জেটি ঘাটের কাছে একটি উচু টাওয়ারে শক্তিশালী সার্চলাইট স্থাপন করা হয়েছে। লাইট ঘুরে ঘুরে চারদিকে আলাে দিতে পারে।
৫. একটি শান্টিং ইঞ্জিনসহ ৫টি প্রথম শ্রেণির প্যাসেঞ্জার বগি সব সময় প্রস্তুত অবস্থায় থাকে। এ বগিতে জামালপুর থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত রেললাইন দিয়ে রাতদিন প্রহরা দেয়া হয়।
৬, ৩টি শান্টিং ইঞ্জিন সব সময় ঘাটে প্রস্তুত অবস্থায় থাকে।
৭. বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছেই ২টি রেলওয়ে ওয়াগন ২টি শক্তিশালী জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে।
৮, সেনাবাহিনীর সদস্যদের থাকার জন্য ৫টি প্যাসেঞ্জার কোচ ব্যবহৃত হয়।
৯, স্থানীয় জনগণ রাজাকারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। বেশির ভাগ মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ১০. বর্তমানে বাহাদুরাবাদ ঘাটে কোনাে গানবােট নেই। তবে মাঝে মাঝে থাকে বলে জানা যায়। এ গানবােটগুলাে আরিচা, বাহাদুরাবাদ ঘাট, ফুলছড়ি ঘাট ও চিলমারী বন্দরের মধ্যে টহল দিয়ে থাকে। লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী, নায়েব সুবেদার করম আলী, নায়েব সুবেদার আলী আকবর, নায়েব সুবেদার ভুলু মিয়া, জহুরুল হক মুন্সি ও হাবিবুর রহমানকে নিয়ে চূড়ান্ত রেকি করার জন্য পুনরায় বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় আসেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান নিজেরাই পর্যবেক্ষণ করেন।
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল নিজেও বাহাদুরাবাদ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানার জন্য স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক গাজী নাসির উদ্দিনকে প্রেরণ করেন। গাজী নাসির উদ্দিন ২৫ জুলাই বাহাদুরাবাদ ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ঝালুর চরের পর আর অগ্রসর হতে না পারায় ২৭ জুলাই প্রত্যাবর্তন করেন। পরিকল্পনা ও দায়িত্ব বণ্টন অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল ২৮ জুলাই ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি অধিনায়কদের যেসব আদেশ প্রদান করেন সেগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে: ১. বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশনে মূল আক্রমণে যাবেন লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানি। ঝালুর চর এবং ঝালুর চরের ঠিক অপর পাড়ে সবুজপুর ঘাটে রিয়ার প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকবেন ক্যাপ্টেন আনােয়ারের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানি। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ঝালুর চর এবং বাহাদুরাবাদ ঘাট পাড়ের মাঝামাঝি মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থান নেবে। সেখান থেকে ‘ডি’ কোম্পানির আক্রমণে মর্টার সাপাের্ট দেবে। ‘ডি’ কোম্পানির রিইনফোর্সমেন্ট ও উইথড্রলের বিষয়ে ‘এ’ কোম্পানি পূর্ণ সহযােগিতা দেবে। রেজিমেন্টের সৈন্যদের জন্য রিয়ার অ্যাসেম্বলি এরিয়া হবে হজরত শাহ কামালের মাজার এবং ফরওয়ার্ড অ্যাসেম্বলি এরিয়া হবে। মহারানির খালের পাড়ে কাঠের বিল হাই স্কুলের মাঠ। দুপুরের খাবার ইউনিট লাইন। জুম্মার নামাজের পর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হবে।
৬, বাহাদুরাবাদ ঘাটে যাওয়ার জন্য কাঠের বিলের কাছে মহারানির খালের ঘাটে ১২টি নৌকা থাকবে। এ নৌকাগুলাে ঝালুর চর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীকে পৌছে দেবে। ‘ডি’ কোম্পানি নৌকার ব্যবস্থা করবে। যেহেতু বাংলাদেশের বেশ ভিতরে এ অপারেশন হবে, সেহেতু পর্যাপ্ত গােলাবারুদ বাহিনীর সাথে সাথে যাবে। ৮, কাঠের বিল হাই স্কুল মাঠে অপারেশনের চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হবে। ৯, বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের দিন ধার্য করা হয় ১৯৭১ সালের ৩০| ৩১ জুলাই রাতে। এইচ আওয়ার ভাের ৪টা। মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে সম্পৃক্ত আক্রমণ পরিচালনাকারী সব ব্যক্তি কর্তৃক আক্রমণের আকস্মিকতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ গােপনীয়তা রক্ষা করা হয়। শুধু মহেন্দ্রগঞ্জে অবস্থিত ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানি। অধিনায়ক গাজী নাসির উদ্দিনকে গাইড হিসেবে প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। তেলঢালাতেই ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমস্ত যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। আর্টিলারি ফিল্ড গানের বিকল্প হিসেবে ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং রিকয়েললেস রাইফেল সংযুক্ত হয়। ৩০ জুলাই বিকাল ৪টায় তেলঢালা থেকে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’, ‘ডি’ ও সদর দপ্তর কোম্পানি মহেন্দ্রগঞ্জ পৌছায়। এখান থেকে মাজারের পাশ দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাদের প্রথম গন্তব্যস্থান কাঠের বিল ছিল ২৫ কিলােমিটার দূরে। সম্পূর্ণ পথ পায়ে হেঁটে মুক্তিযােদ্ধারা রাত ১১টায় কাঠের বিল এসে পৌঁছেন। কাঠের বিল হাই স্কুল মাঠ ছিল অপারেশনের প্রথম অ্যাসেম্বলি এরিয়া। অধিনায়কের চূড়ান্ত নির্দেশ অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে তার চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করেন। এ আদেশে প্রতিটি দলের করণীয় নির্দিষ্ট করা হয়।
তার আদেশের উল্লেখযােগ্য দিকগুলাে হলাে: ১. বাহাদুরাবাদ ঘাটের মূল আক্রমণে যাবে লেফটেন্যান্ট নবীর নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানি ঘাট পাড়ের জেনারেটর ওয়াগন, লাইট টাওয়ার, শান্টিং ইঞ্জিন, সৈন্যদের থাকার কোচ, রেলওয়ে ওয়াগন বহনকারী ফেরি ও প্যাসেঞ্জার বহনকারী ফেরি ধ্বংস করবে। এ জন্য প্রয়ােজনীয় ৩.৫ ইঞ্চি লঞ্চার ও গােলা সাথে যাবে। আক্রমণের পদ্ধতি কোম্পানি অধিনায়ক নির্ধারণ করবে। তবে হাতাহাতি যুদ্ধের। জন্য বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে হবে। শত্রু সেনা ধ্বংস করে বাহিনীর। সদস্যরা ধাপে ধাপে মাদ্রাসা এলাকায় ফিরে আসবেন। ২. ক্যাপ্টেন আনােয়ারের নেতৃত্বে এ কোম্পানি রিয়ার প্রােটেকশনে থাকবে। ‘এ’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন থাকবে সবুজপুর ঘাট এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর গানবােট অথবা স্টিমার যেন ঝালুর চরের দিকে যেতে না পারে, তার দিকে নজর রাখতে হবে। এ প্লাটুনে ২টি রকেট লঞ্চার এবং একটি ১০৬ আরআর থাকবে। এ কোম্পানির ১টি প্লাটুন সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে কাট অফ পাটি হিসেবে ফারাজী পাড়া সেতু এলাকায় অবস্থান নেবে। বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকা থেকে কোনাে পাকিস্তানি সৈন্য যেন যেতে না পারে এবং দেওয়ানগঞ্জ থেকে কোনাে সৈন্য যেন আসতে না পারে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ভেরি-লাইট পিস্তলের ৪বার রেড ওভার রেড ফায়ারে এ প্লাটুন ঝালুর চরের নৌকার ঘাটে ফিরে আসবে। নাসির। কোম্পানির ১টি সেকশন গাইড হিসেবে এ দলের সাথে যাবে। নাসির কোম্পানির অপর একটি সেকশন ক্যাপ্টেন আনােয়ারের সাথে ঝালুর চর নৌকা ঘাটে অবস্থান নেবে। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর আমার (মেজর শাফায়েত জামিল) নেতৃত্বে মাদ্রাসা এলাকায় থাকবে।
৩ ইঞ্চি মর্টার আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ‘ডি’ কোম্পানির আক্রমণ ও উইথড্রলের সময় নির্দিষ্ট সিগন্যালের পর টার্গেটের উপর ফায়ার দেবে। ‘ডি’ কোম্পানির ২বার গ্রিন ওভার গ্রিন ভেরি-লাইট পিস্তলের ফায়ারের পর রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠানাে হবে। ‘ডি’ কোম্পানির ৩বার রেড ওভার গ্রিন ভেরি-লাইট সিগন্যালের পর রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠানাে হবে। ‘ডি’ কোম্পানির ৩বার রেড ওভার গ্রিন সিগন্যালের পর আমি (মেজর শাফায়েত জামিল) নিজে টার্গেটের দিকে যাব। ‘ডি’ কোম্পানি প্রথমে মুভ করবে। এরপর আমার (শাফায়েত জামিল) নেতৃত্বে সদর দপ্তর এবং সবশেষে ‘এ’ কোম্পানি অবস্থান ছেড়ে যাবে। উইথড্রলের সময় প্রথমে ‘ডি’ কোম্পানি নদী অতিক্রম করে চর এলাকায় অবস্থান নেবে। এরপর সদর দপ্তর কোম্পানি এবং সবশেষে ‘এ’ কোম্পানি অবস্থান ছেড়ে হাইড আউটে যাবে। প্রয়ােজনবােধে আমি (মেজর শাফায়েত জামিল) নদীর ওপার থেকে ‘এ’ কোম্পানির উইথড্রলের জন্য ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে কভারিং ফায়ার দেবাে। ৬. মুভ করার সময় প্রতিটি নৌকা প্রয়ােজনীয় দূরত্বে চলবে। ‘ডি’ কোম্পানি প্রথমে মুভ করবে। ‘ডি’ কোম্পানি ঘাটে নামার পর ৩বার টর্চ লাইটের আলাে জ্বালাবে। এরপর অন্য ২টি কোম্পানি ঘাটে নামবে। সন্ধ্যার পর সবাই কাঠের বিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ৮. আজকের রাতের পাসওয়ার্ড নদী তীর।
‘ডি’ কোম্পানির আক্রমণ পরিকল্পনা
আক্রমণ পরিকল্পনায় লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে ডেল্টা কোম্পানি কর্তৃক বাহাদুরাবাদ ঘাট এবং ঘাটের কাছাকাছি এলাকায় বার্জ ও রেলের বগিতে বসানাে মেশিনগান ও মটার অবস্থান ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর উপর এ আক্রমণের জন্য ‘ডি’ কোম্পানির অধীনস্থ বিভিন্ন দলের দায়িত্ব ছিল নিমরূপ: ১. নায়েব সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে ১টি প্ল্যাটুন জেনারেটরবাহী ওয়াগন এবং এর চারপাশের বাংকারগুলাে আক্রমণ করে ধ্বংস। করবে। নায়েব সুবেদার ভুলু মিয়ার নেতৃত্বে ১টি প্ল্যাটুন পাকিস্তানি সৈন্যদের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত ওয়াগনগুলাে ও শান্টিং ইঞ্জিনের উপর আক্রমণ চালিয়ে সেগুলাে ধ্বংস করবেন। ৩, কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী নিজ সৈন্যসহ নায়েব
সুবেদার করম আলীর সাথে থাকবেন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে নদীতে অবস্থানরত বার্জ, টাগবােট ও পন্টুনগুলাের ধ্বংস সাধন করবেন।
মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত যাত্রা
গাইড মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক গাজী নাসির উদ্দিনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় দ্রুততার সাথে ১২টি নৌকা সংগৃহীত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সংগৃহীত নৌকায় ঝালুর চরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ৩১ জুলাই রাত ২টায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঝালুর চরে পৌছে ঘাঁটি স্থাপন করে। অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিলের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর ১ প্লাটুন সৈন্য এ ঘাটে নৌকাগুলাের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়। অপারেশন শেষে এ নৌকাযােগেই তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে বিধায় নৌকাগুলাের অবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঝালুর চর ঘাট থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পরবর্তী ঘাটি মাদ্রাসার দিকে অগ্রসর হয়। মূল দল ঘাটিতে পৌছানাের আগে গাইড অধিনায়ক গাজী নাসির স্থানটির নিরাপত্তা বিষয়ে পুনরায় পরীক্ষা চালান। মাদ্রাসার কাছাকাছি একজন বৃদ্ধ লােককে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া অবস্থায় খুঁজে পেয়ে মাদ্রাসা এলাকায় পাকিস্তানি প্যাট্রল নেই বলে জানা যায়। গাইড নাসির উদ্দিনের সহযােগিতায় মূল দল মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থান নিয়ে দ্রুততার সাথে মর্টার ও আরআর স্থাপনার মধ্য দিয়ে ফায়ার বেইস প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ডি’ কোম্পানির মুক্তিযােদ্ধারা এখান থেকে টার্গেটের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে কাট অফ পাটি প্রথমেই যাত্রা শুরু করে। এরপর লেফটেন্যান্ট নবীর নেতৃত্বে অ্যাসল্ট পাটির যাত্রা শুরু হয়। লেফটেন্যান্ট নবীর সাথে ২ প্লাটুনের অধিক মুক্তিযােদ্ধা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হন। এদের বেশির ভাগ গ্রুপ ছিল রকেট লঞ্চারসজ্জিত। ভাের ৪টার দিকে আক্রমণকারী সমস্ত দল আক্রমণের জন্য অবস্থান গ্রহণ করে।
মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ
লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবীর নেতৃত্বে মূল আক্রমণকারী দল অখণ্ড অবস্থায় ঘাটের কাছে রেলওয়ে লাইনের জংশন পয়েন্টে পৌছে। সর্বপ্রথম নায়েব সুবেদার করম আলী তার প্ল্যাটুন নিয়ে জেনারেটর ওয়াগনের দিকে এগিয়ে যান। ওয়াগনের চারদিকের ট্রেঞ্চগুলােয় তখন পাকিস্তানি সৈন্যের কেউ ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা তখন রেললাইনের অপরদিকে স্ট্যান্ড-টুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এ সময় রেললাইনের উপর দিয়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের শান্টিং চলছিল। শান্টিং ট্রেনটি সরে যাওয়ার সাথে সাথে সুবেদার করম আলী এগিয়ে গিয়ে প্রথমে মালগাড়িতে অবস্থিত জেনারেটর এবং পর মুহূর্তে অগ্রসরমান শান্টিং ইঞ্জিনের উপর রকেট নিক্ষেপ করেন। প্রথম গােলাতেই জেনারেটর অকেজো হলে সমস্ত এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। এ গােলাবর্ষণের আওয়াজের সাথে সাথে অন্য গ্রুপগুলােও আক্রমণ শুরু করে। আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমটায় হতচকিত হয়ে পড়লেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে তারা পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। নায়েব সুবেদার ভুলু মিয়া তার প্লাটুন নিয়ে সৈন্যদের আবাসিক কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত যাত্রীবাহী ওয়াগনগুলাের দিকে এগিয়ে যান। নিকটবর্তী হয়ে তিনিও রকেট লঞ্চার থেকে গােলাবর্ষণ করেন। ৫টি গােলা নিক্ষেপ করে তিনি ৫টি ওয়াগনই ধ্বংস করেন। মুক্তিযােদ্ধারা এরপর দৌড়ে ওয়াগনগুলাের দিকে অগ্রসর হয়ে তার ভিতরে প্রচুর হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এ আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সঁতার না জানার কারণে বেশির ভাগ সৈন্য পানিতে ডুবে মারা যায়। ওয়াগন ধ্বংসের পর নায়েব সুবেদার ভুলু মিয়া শান্টিং ইঞ্জিনের দিকে এগিয়ে রকেট নিক্ষেপ করেন। ইঞ্জিনটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়।
কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী তার দলকে নিয়ে নায়েব। সুবেদার করম আলীর প্লাটুনের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন। আক্রমণের পরবর্তী পর্যায়ে তিনি নদীতে অবস্থানরত বার্জ, টাগ, পন্টুন ও লঞ্চগুলাে ধ্বংস করেন। এ সময় অন্য ২টি প্ল্যাটুনও তার সাথে যােগ দেয়। রকেট লঞ্চারের ব্যবহারে সব কয়টি নৌযান ফুটো হয়ে পানিতে ডুবে যায়। ৩১ জুলাই ভাের ৬টায় মাদ্রাসা এলাকা থেকে ফায়ার বেইস স্থাপনের সমাপ্তির সিগন্যাল দেয়া হয়। রেজিমেন্ট অধিনায়ক শাফায়েত জামিল এ ফায়ার বেইস থেকে আক্রমণের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মূল অপারেশন সমাপ্তি। সিগন্যাল প্রদানের সাথে সাথে ফায়ার বেইস থেকে টার্গেটগুলাের উপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে অবশিষ্ট শত্রুর প্রচুর ক্ষতিসাধন করা হয় । অপারেশনের একেবারে শেষ দিকে নায়েব সুবেদার ভুলু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। একটি বুলেট তার বুকের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। এ অবস্থায়ও তিনি হেঁটে চলতে চেষ্টা চালান। কোম্পানি অধিনায়কের নির্দেশে প্রায় মুমূর্ষ অবস্থায় স্ট্রেচারে করে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ যুদ্ধে একজন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করেন।
কাট অফ পার্টির কার্যক্রম
কার্ট অফ পার্টি টেলিফোনের তার কাটার কোনাে যন্ত্র সাথে না আনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে রেজিমেন্ট অধিনায়ক নিজেই বাহাদুরাবাদ ঘাটের সাথে। সংযুক্ত টেলিফোনের তার কেটে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করেন। বাহাদুরাবাদ ঘাটে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু হলে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা দেওয়ানগঞ্জের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের অনেকেই কাট অফ পার্টির অ্যাকশনে নিহত হয়। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর দেওয়ানগঞ্জ থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাটে কোনাে রি-ইনফোর্সমেন্ট আসেনি। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন সমাপ্তি অপারেশন শেষে মুক্তিবাহিনীর সব সদস্য সকাল ৯টায় পুনরায় কাঠের বিল হাই। স্কুলে অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় সমবেত হন। আক্রমণের ফলাফল বিশ্লেষণ মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণগুলাে নিচে উল্লেখ করা হলাে: পর্যাপ্ত সৈন্য সমাবেশ বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত সেনাদলের ১ প্লাটুন সৈন্যের অবস্থান ছিল। এর সাথে সামরিক বাহিনী রেঞ্জার্স ও রাজাকারের কিছু সদস্য থাকলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। এ অল্পসংখ্যক সেনার উপর বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকার দায়িত্ব ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বাহাদুরাবাদ ঘাট ও জামালপুরের মধ্যবর্তী রেলপথে নিয়মিত পাহারা দিতে হতাে। যার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদের একটি অংশকে সব সময় এ ঘাটির বাইরে। অবস্থান করতে হতাে। আক্রমণের দিন পাকিস্তানি ঘাটির ভারপ্রাপ্ত অফিসার ক্যাপ্টেন রফিক জামালপুরে কোম্পানি সদর দপ্তরে ছিলেন।
এর ফলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর ২টি নিয়মিত কোম্পানি এবং একটি মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করে। অধিক সৈন্যের সমাবেশ এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা যুদ্ধের ফল। মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে নিয়ে আসে। জনগণের সমর্থন ও লজিস্টিক সাপাের্ট মুক্তিবাহিনী জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহযােগিতা লাভ করে। আক্রমণে অগ্রসর হওয়ার জন্য তারা প্রয়ােজনীয় পরিবহন ও খাদ্য জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। প্রশিক্ষিত সেনাদল ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলঢালায় আসার পূর্বেই প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। মেজর শাফায়েত জামিল শিলিগুড়ি থেকে মালদহ পর্যন্ত প্রতিটি ক্যাম্প থেকে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য সৈন্য রিকুট করেন। প্রশিক্ষণের সাথে কিছু প্র্যাকটিক্যাল ওয়ার্কও করানাে হয়। হিলি, নওগাঁ, দিনাজপুরের বিভিন্ন পাকিস্তানি অবস্থানে প্লাটুন পর্যায়ে প্যাট্রলিং ও রেইড চালানাে হয়। তার পরই ব্যাটালিয়ন তেলঢালায় গিয়ে জেড ফোর্সের অংশ হয় এবং সেখানেও এ ব্যাটালিয়নের প্রশিক্ষণ চলে। জেড ফোর্সের অন্য ২টি ইউনিট সম্পর্কে এ রকম তথ্য জানা যায়নি। সঠিক অস্ত্রের ব্যবহার বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সঠিক অস্ত্র প্রচুর পরিমাণে ব্যবহারের সুযােগ পায়। তাদের কাছে ছিল আরআর মর্টার, রকেট লঞ্চার প্রভৃতি ভারি অস্ত্র এবং এর পরিমাণও ছিল যথেষ্ট। বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের পূর্বে ৩ বার রেকি করানাে হয়। এর মধ্যে অ্যাসল্ট কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট নবী নিজে একবার রেকি করেন। রেকির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য সঠিক আক্রমণ পরিচালনা এবং সাফল্য বয়ে আনে। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের অংশগ্রহণ আক্রমণকারী বাহিনীতে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি প্লাটুন অংশগ্রহণ করে। তারা পথপ্রদর্শক, পরিবহনের জন্য নৌযান সংগ্রহ প্রভৃতি কাজে প্রচুর সহায়তা প্রদান করে। আকস্মিকতা ও গােপনীয়তা আক্রমণের আকস্মিকতা বজায় রাখা এবং গােপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ধারণা করতে পারেনি, সীমান্তের এত ভিতরে এত বড়াে ধরনের আক্রমণ করার সক্ষমতা মুক্তিবাহিনীর আছে। তা ছাড়া আক্রমণের সংবাদ অধিনায়ক ব্যতীত অন্য কাউকে জানানাে হয়নি। ফলে। গােপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।
গৃহীত পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন আক্রমণ পরিকল্পনায় গৃহীত পদক্ষেপগুলাে সঠিক সময়ে ও সঠিক অবস্থানে বাস্তবায়িত হয়েছিল। পরিকল্পনার সাথে বাস্তবে গৃহীত পদক্ষেপের অপূর্ব সমন্বয় এ যুদ্ধে জয়লাভের অন্যতম কারণ। যে-কোনাে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয় হলাে অধিনায়কের সঠিক নির্দেশনা। এ ক্ষেত্রে অধিনায়ক শাফায়েত জামিলের সঠিক বাস্তবমুখী পরিকল্পনা, নির্দেশ, যুদ্ধ পরিচালনায় দৃঢ়তা ইত্যাদি বিষয়াবলি যুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছিল। কাট অফ কোম্পানি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অধিনায়ক শাফায়েত জামিল নিজেই এ দায়িত্ব পালন করেন। এ যুদ্ধের একটি লক্ষণীয় দিক হলাে, শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং অধিক হারে সৈনিক নিহত হওয়া। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে, এ যুদ্ধে খুবই কমসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা শহিদ ও আহত হয়েছেন। এটাও অধিনায়কের একটি বিশাল কৃতিত্ব। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি কিংবা আহত-নিহত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে বাস্তবমুখী যুদ্ধ পরিকল্পনা, সঠিক রেকি, আক্রমণে সমন্বয় এবং সৈনিকদের মনােবলের উপর। বাহাদুরাবাদ ঘাটের যুদ্ধে এ বিষয়াবলির সঠিক বাস্তবায়নের ফলেই বিশাল বিজয় অর্জন সম্ভব হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সঠিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার অভাব ছিল। তাদের জনবলও সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলার অনুকূলে ছিল না। বাহাদুরাবাদ ঘাট ও দেওয়ানগঞ্জের যৌথ প্রতিরক্ষার জন্য তাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল খুবই অল্প।
এর বিরাট অংশই ছিল আধা সামরিক বাহিনীর। তা ছাড়া এখানে এত বড়াে আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কাও তারা করেনি। সম্ভাব্য আক্রমণের রুটগুলােয় নজরদারির কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। সীমান্ত এলাকায় সব সময়ই অল্পবিস্তর যুদ্ধ চলতাে। ফলে সেখানে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনী কোনাে সময়ই তাদের প্রহরা শিথিল করেনি। কিন্তু বাহাদুরাবাদে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করলে ঘাটির ট্রেঞ্চগুলাে ফাকা দেখতে পায়। ফলে আক্রমণের সময় মুক্তিবাহিনী প্রথম দিকে কোনাে বাধা পায়নি এবং এ কারণে জেনারেটর, শান্টিং ইঞ্জিন ও পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের লিভিং কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত বগিগুলাে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। আক্রমণের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি বাহিনীর কোনােপ্রকার গােলন্দাজ প্রতিরক্ষা ছিল না। ফলে বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে যখন মুক্তিবাহিনীর অ্যাসল্ট ফোর্স প্রত্যাহার করা হয়, তখন তারা প্রতি-আক্রমণ চালাতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর ফায়ার বেইস থেকে যখন বাহাদুরাবাদের বিভিন্ন স্থাপনার উপর আক্রমণ চলছিল, তার বিরুদ্ধেও কোনাে কার্যক্রম পাকিস্তানি বাহিনী নিতে পারেনি।
পরিশেষে বলা যায় যে, মুক্তিবাহিনীর একটি বড়াে মাপের আক্রমণ। মােকাবিলা করার প্রস্তুতি পাকিস্তানি বাহিনীর ছিল না। জুলাই-আগস্ট সময়কালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল সামরিক শক্তি সীমান্ত অঞ্চলে নিয়ােজিত করা হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে বিশেষত সীমান্ত এলাকা থেকে ২৫ মাইল ভিতরে মুক্তিবাহিনীর এত বড়াে ও পরিকল্পিত আক্রমণ তাদের কাছে ছিল। অপ্রত্যাশিত। আক্রমণের আকস্মিকতায় হতবিহ্বল পাকিস্তানি বাহিনী খুব দ্রুত পাল্টা আক্রমণ করলেও মুক্তিবাহিনীর ক্ষিপ্ত আক্রমণে তাদের ডিফেন্স লাইন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ হলাে অধিনায়কের অনুপস্থিতি। যুদ্ধক্ষেত্রে অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে সৈনিকদের মনােবল বজায় রাখা খুবই দুরূহ ব্যাপার। সামগ্রিক মূল্যায়ন বাহাদুরাবাদ ঘাটের যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি মাইলফলক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। এ যুদ্ধ থেকে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। প্রথমত, পরিকল্পিত আক্রমণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাটিতে আক্রমণ করে সফলতা লাভ করা যায়। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক অবস্থান সম্পর্কে এ যুদ্ধ সম্যক ইঙ্গিত প্রদান করে। এ যুদ্ধের ভিতর দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত অঞ্চলে যত শক্তিশালী অবস্থানে আছে, দেশের অভ্যন্তরে ততটা শক্তিশালী অবস্থানে নেই। তৃতীয়ত, এ যুদ্ধে স্থানীয় জনগণ, মুক্তিযােদ্ধা ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পারস্পরিক। সহযােগিতা ও সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ যুদ্ধের চরিত্র ছিল সামগ্রিক। এ যুদ্ধ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত। বাহিনীর সাথে জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর সম্পৃক্ততা ও সমন্বয় যুদ্ধে জয়ের একটি উল্লেখযােগ্য দিক। চতুর্থত, এ যুদ্ধে জয়লাভের ভিতর দিয়ে মুক্তিবাহিনীর মনােবল বহুলভাবে বেড়ে যায়। অপরদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিশেষে বলা যায়, দেশের বেশ অভ্যন্তরে দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করার ভিতর দিয়ে আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড