You dont have javascript enabled! Please enable it! কালিহাতি রাস্তায় পাকিস্তানি সেনা ট্রাকে গাছ থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ - কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
কালিহাতি রাস্তায় পাকিস্তানি সেনা ট্রাকে গাছ থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ
১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই হায়দার ও বাচ্চু নামে ১৪-১৫ বছরের দুই ক্ষুদে মুক্তিযােদ্ধা টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানায় এক অভাবনীয় অ্যামবুশের পরিকল্পনা করেন। কালিহাতি স্কুলের মাঠে ছিল রাজাকারদের প্রশিক্ষিণ শিবির। প্রতিদিন সকালে কালিহাতি থেকে শােলাকুড়া পর্যন্ত প্রতিটি পুলে রাজাকারদের পাহারা বদলি হতাে। বিষয়টি বাচ্চু ও হায়দার ৭ দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেন। ৩০ জুলাই ভােররাতে তারা কালিহাতি রাস্তার উপর ২টি বিশাল বটগাছের উপর উঠে বসে থাকেন। ২টি ট্রাকের উপর ৪জন করে মােট ৮জন শত্রু বসেছিল। ট্রাক ২টি বটগাছের নিচে আসতেই মুক্তিযােদ্ধারা একসাথে ২টি করে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। মুহূর্তে ট্রাক ২টির উপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং ৩জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয়। সবাই কম-বেশি আহত হয়। ক্ষুদে মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর পরই পাকা সড়কের পূর্ব পার্শ্বে জেলে ও কামার পাড়ার মাঝ দিয়ে কস্তুরী পাড়ার দিকে নিরাপদে সরে পড়েন।
কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধ
কামালপুর বিওপি’র অবস্থান
ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমানে জামালপুর জেলার) বকশীগঞ্জ থানার ধানুয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর। কামালপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী অন্য। গ্রামগুলাের মধ্যে ধানুয়া, উঠানীপাড়া, ঘাষিরগাঁও, পশ্চিম কামালপুর, পালবাড়ি, ব্রাহ্মণপাড়া, মাঝির চর ও বালুর গ্রাম প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। কামালপুর গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় ইপিআর সীমান্ত ফাড়ি (বিওপি) অবস্থিত। বাংলাদেশভারত সীমান্ত রেখা থেকে দেড় কিলােমিটার অভ্যন্তরে সীমান্ত পিলার ১০৮৪ ও ১০৮৫-এর মাঝামাঝি স্থানে এবং বকশীগঞ্জ থানা সদর থেকে ৪ কিলােমিটার দূরত্বে কামালপুর বিওপি’র অবস্থান। কামালপুর স্থানটি জামালপুর জেলা সদর থেকে ৪০ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। সীমান্তের অপরদিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। কামালপুরের কাছাকাছি সীমানা চিহ্নিতকরণ এলাকার সীমান্ত রেখাটি সরল রৈখিক নয়, আঁকা-বাঁকা ও অসমতল। সীমান্তের উপরের অঞ্চলটি বাংলাদেশের সমতল ভূমি থেকে উঁচু। এ রাজ্যের সীমান্তবর্তী শহর মহেন্দ্রগঞ্জ এলাকায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর।
যােগাযােগ ব্যবস্থা
সীমান্ত এলাকা থেকে আগত শেরপুর-ময়মনসিংহ সড়কটি এ বিওপি’র পূর্ব পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছে। এ রাস্তাটি বকশীগঞ্জ, গােসাইপুর হয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা শহর শেরপুরের সাথে পুরাে অঞ্চলকে যুক্ত করেছে এবং এ এলাকার সাথে সড়কপথে এটিই একমাত্র যােগাযােগমাধ্যম। মাটির তৈরি এ রাস্তাটি শুকনাে। মৌসুমে সব ধরনের যানবাহন চলাচলের উপযােগী। তবে বর্ষার সময় গরুর গাড়ি ব্যতীত অন্য কোনাে যানবাহন চলাচলের উপযােগী নয়। কামালপুর থেকে সদর বকশীগঞ্জ পর্যন্ত একটি রাস্তা রয়েছে। এ রাস্তাটি দিয়ে জেলা সদর জামালপুর পর্যন্ত যাওয়া যায়। কামালপুর থেকে একটি রাস্তা ভারত-বাংলাদেশ। সীমান্তকে বাঁয়ে রেখে ঝিনাইগাতির ভিতর দিয়ে পূর্ব দিকে চলে গিয়েছে। কামালপুর ও চারপাশের এলাকা সমতলভূমি। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া উল্লেখযােগ্য কোনাে নদী এ অঞ্চলে নেই। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের ছােটো ছােটো শাখা এ এলাকাটিকে বিভক্ত করে রেখেছে। কামালপুর এলাকাটি যমুনা অববাহিকায় অবস্থিত। বর্ষাকালে পুরাে অঞ্চল পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। রাস্তাঘাটের বেশির ভাগ তলিয়ে যায় পানিতে। পুরাে বর্ষা মৌসুমে এ এলাকায় যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম হলাে নৌকা।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ৩৬ অ্যাডহক ডিভিশনের অধীনস্থ ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের উপর ন্যস্ত ছিল। জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদের ডিভিশন সদর দপ্তর ছিল ঢাকা। ময়মনসিংহে অবস্থিত | ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার কাদের খান নিয়াজি। ১৮৫ কিলােমিটার দীর্ঘ সীমান্ত প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত এ ব্রিগেডের প্রধান দায়িত্ব ছিল মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকে যথাসম্ভব প্রতিহত করার মাধ্যমে কালক্ষেপণ করা। সামরিক অবস্থানের দিক থেকে কামালপুর পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত এলাকা থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া কোনাে বড়াে বাধা ছিল না। তাই মেঘালয় অঞ্চল থেকে ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও ঢাকা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী। আগমনের এটি ছিল একটি বড়াে পথ। আবার পশ্চিমে যমুনা নদীর অবস্থানের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। মুক্তিবাহিনীর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে সহজভাবে ঢাকা পৌছার বিষয়টিকে মূল্যায়ন করে ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য ২টি গতিপথকে বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য মােতায়েন করা হয়। এ গতিপথ ২টি হলাে নিম্নরূপ ১, কামালপুর-জামালপুর এক্সিস: ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনের জন্য কামালপুর-জামালপুর এক্সিস একটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পথ হিসেবে বিবেচিত ছিল। জামালপুর জেলার ভিতর দিয়ে গ্রামের পায়ে চলা পথে কিংবা খালবিলের ভিতর দিয়ে নৌকাযােগে জামালপুর, ময়মনসিংহ তথা শেরপুর, শ্রীবর্দী, নকলা, ময়মনসিংহ হয়ে ফুলবাড়িয়া, মধুপুর, ঘাটাইল, ত্রিশাল, ভালুকা পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা আগমন করতাে। এ পথেই ছিল টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর যােগাযােগ। হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ এক্সিস: ১১ নম্বর সেক্টরের অপর একটি এক্সিস ছিল হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ এক্সিস। এ পথে জারিয়া, বারহাট্টা, মােহনগঞ্জ, নেত্রকোনা, গৌরীপুর, কেন্দুয়া, ঈশ্বরগঞ্জ, গফরগাঁও, পাকুন্দিয়া, মনােহরদী, শ্রীপুর হয়ে মুক্তিবাহিনী ঢাকার পথে আগমন করতাে। ৯৩ ব্রিগেড অধিনায়ক কামালপুর-জামালপুর পথে মুক্তিবাহিনীর গতিপথকে বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকা এবং বিভিন্ন রােড জংশনগুলােয় নিজ সৈন্যের অবস্থান নির্দিষ্ট করেন। কামালপুর বিওপি ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের অধীনস্থ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের যুদ্ধ এলাকার আওতাভুক্ত। এ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ। সীমান্ত মহকুমা শহর।
জামালপুর ছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সদর দপ্তর। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানির অবস্থান ছিল থানা সদর বকশীগঞ্জ এলাকায় এবং কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন মেজর আইয়ুব। তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ছিল কামালপুর বিওপি’র অবস্থান। কামালপুর বিওপিতে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১ প্লাটুনের অধিক নিয়মিত সৈন্য ছাড়াও ৭০ উইং রেঞ্জার্স ইউনিটের ১টি প্লাটুন এবং রাজাকার বাহিনীর ১টি প্লাটুন দায়িত্বরত ছিল। এ সৈন্যদলের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদে বকশীগঞ্জ কোম্পানি সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন সময় রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠিয়ে বিওপি’র সৈন্যদলের শক্তি বৃদ্ধি করা হতাে।
কামালপুর বিওপিতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
ভারতের মেঘালয় সীমান্ত থেকে ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের প্রবেশপথ হলাে কামালপুর। এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার লক্ষ্যে যেসব সীমান্ত বিওপিগুলােকে শক্তিশালী করা হয় কামালপুর বিওপি, সেগুলাের মধ্যে অন্যতম। বিওপি’র চারপাশে মােটা গাছের গুড়ি ও শক্তিশালী কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে আর্টিলারি শেল প্রতিহত করার ক্ষমতাসম্পন্ন বাংকার তৈরি। করা হয়। বাংকার তৈরির প্রথম স্তরে মাটি তারপর টিনের দেয়াল, তারপর ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট ব্যবধানে লােহার বিম ব্যবহৃত হয়। এলাকার উপর নজরদারি করার লক্ষ্যে বাংকারগুলাে সমতল ভূমি থেকে উঁচু অবস্থানে ছিল। বিওপি ঘিরে তৈরি করা প্রতিটি বাংকার অভ্যন্তরীণ টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। বিওপি’র বাহ্যিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় মাইন, কাঁটাতারের বেড়া, বুবি ট্র্যাপ ও বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করা হয়। বিওপি’র চারপাশে ৫০০ থেকে ৭০০ গজ দূরত্ব পর্যন্ত গাছপালা কেটে ফিল্ড অব ফায়ারের এলাকা তৈরি করা হয়েছিল। বিওপি’র কাছাকাছি পশ্চিম দিকে সরকারি ডাকবাংলাে ও গুদামঘর থাকায় আউটার পেরিমিটারে স্ট্যান্ডিং প্যাট্রলের ব্যবস্থা ছিল। বিওপি’র পূর্ব-উত্তর কোণায় ৬০০ গজ দূরত্বে একটি খাদ্য গুদামঘর ও বিশাল বটগাছের উপর নিয়মিত লিসনিং পােস্টের অবস্থান ছিল। এ ছাড়া প্রতি রাতে মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য প্রবেশ এলাকাগুলােয় নিয়মিত প্যাট্রল পার্টি পাঠানাে হতাে।
কামালপুর বিওপিতে অবস্থানরত সৈন্যদের সাহাযার্থে প্রয়ােজনীয় ফায়ার সাপাের্ট দেয়ার জন্য ব্যাটালিয়ন সাপাের্ট প্লাটুনের ২টি এমজি এবং ৩টি ৮১ মিমি মর্টার এ বিওপিতে মােতায়েন ছিল। এ ছাড়া কামালপুর বিওপি বকশীগঞ্জে অবস্থানরত ৮৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মর্টার ব্যাটারির ফায়ার সাপাের্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কামালপুর বিওপিকে ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনীর সামগ্রিক বিন্যাস পর্যালােচনা করলে কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত কামালপুর। বিওপিকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বিবেচনা করেছিল ওপারের জামালপুর ছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সদর দপ্তর। ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানির অবস্থান ছিল থানা সদর বকশীগঞ্জ এলাকায় এবং কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন মেজর আইয়ুব। তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ছিল কামালপুর বিওপি’র অবস্থান। কামালপুর বিওপিতে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১ প্লাটুনের অধিক নিয়মিত সৈন্য ছাড়াও ৭০ উইং রেঞ্জার্স ইউনিটের ১টি প্ল্যাটুন এবং রাজাকার বাহিনীর ১টি প্লাটুন দায়িত্বরত ছিল। এ সৈন্যদলের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদে বকশীগঞ্জ কোম্পানি সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন সময় রি-ইনফোর্সমেন্ট পাঠিয়ে বিওপি’র সৈন্যদলের শক্তি বৃদ্ধি করা হতাে। কামালপুর বিওপিতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভারতের মেঘালয় সীমান্ত থেকে ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের প্রবেশপথ হলাে কামালপুর । এ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার লক্ষ্যে যেসব সীমান্ত বিওপিগুলােকে শক্তিশালী করা হয় কামালপুর বিওপি, সেগুলাের মধ্যে অন্যতম। বিওপি’র চারপাশে মােটা গাছের গুড়ি ও শক্তিশালী কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে আর্টিলারি শেল প্রতিহত করার ক্ষমতাসম্পন্ন বাংকার তৈরি করা হয়। বাংকার তৈরির প্রথম স্তরে মাটি তারপর টিনের দেয়াল, তারপর ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট ব্যবধানে লােহার বিম ব্যবহৃত হয়।
এলাকার উপর নজরদারি করার লক্ষ্যে বাংকারগুলাে সমতল ভূমি থেকে উঁচু অবস্থানে ছিল। বিওপি ঘিরে তৈরি করা প্রতিটি বাংকার অভ্যন্তরীণ টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। বিওপি’র বাহ্যিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় মাইন, কাটাতারের বেড়া, বুবি ট্র্যাপ ও বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করা হয়। বিওপি’র চারপাশে ৫০০ থেকে ৭০০ গজ দূরত্ব পর্যন্ত গাছপালা কেটে ফিল্ড অব ফায়ারের এলাকা তৈরি করা হয়েছিল। বিওপি’র কাছাকাছি পশ্চিম দিকে সরকারি ডাকবাংলাে ও গুদামঘর থাকায় আউটার পেরিমিটারে স্ট্যান্ডিং প্যাট্রলের ব্যবস্থা ছিল। বিওপি’র পূর্ব-উত্তর কোণায় ৬০০ গজ দূরত্বে একটি খাদ্য গুদামঘর ও বিশাল বটগাছের উপর নিয়মিত লিসনিং পােস্টের অবস্থান ছিল। এ ছাড়া প্রতি রাতে মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য প্রবেশ এলাকাগুলােয় নিয়মিত প্যাট্রল পাটি পাঠানাে হতাে। কামালপুর বিওপিতে অবস্থানরত সৈন্যদের সাহাযার্থে প্রয়ােজনীয় ফায়ার সাপাের্ট দেয়ার জন্য ব্যাটালিয়ন সাপাের্ট প্লাটুনের ২টি এমজি এবং ৩টি ৮১ মিমি মর্টার এ বিওপিতে মােতায়েন ছিল। এ ছাড়া কামালপুর বিওপি বকশীগঞ্জে অবস্থানরত ৮৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মটার ব্যাটারির ফায়ার সাপাের্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কামালপুর বিওপিকে ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনীর সামগ্রিক বিন্যাস পর্যালােচনা করলে কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত কামালপুর বিওপিকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বিবেচনা করেছিল ওপারের মেঘালয় থেকে নেমে আসা মুক্তিবাহিনীকে মােকাবিলা করার একটি শক্তিশালী অগ্রবর্তী ঘাঁটি হিসেবে। দ্বিতীয়ত তাদের লক্ষ্য ছিল, সীমান্ত অঞ্চলটির উপর যে-কোনাে মূল্যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। তৃতীয়ত কামালপুরকে ঘিরে শক্তিশালী অবস্থান তৈরির ভিতর দিয়ে তাদের লক্ষ্য ছিল, যমুনার পূর্ব তীরের উত্তর সীমান্তের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতাকে রােধ করে দেয়া।
চতুর্থত পশ্চিমে যমুনা নদী থাকায় তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, কামালপুরে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করলে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এ প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে না। পঞ্চমত একটি বিওপিকে ঘিরে নিয়মিত বাহিনীর ১টি প্ল্যাটুন। মােতায়েন সমর্থন হিসেবে রেঞ্জার্স ও রাজাকার ইউনিট নিয়ােগ এবং সর্বোপরি ১জন ক্যাপ্টেনকে বিওপি’র দায়িত্ব প্রদান থেকে বােঝা যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনী কামালপুরের প্রতিরক্ষার দিকে সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছিল। মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনা, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা বাহিনী প্রেরণ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়ার বিষয়টি মেঘালয় সীমান্তে অবস্থানরত নিয়মিত বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্স ব্রিগেড গঠনের পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ শেষে জেড ফোর্সের ব্রিগেড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে সৈন্যদের যুদ্ধক্ষমতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি যুদ্ধ পরিকল্পনা গৃহীত হয়। জেড ফোর্স ব্রিগেডের অধীনস্থ ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য একই সময় ভিন্ন ভিন্ন অপারেশন পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করা হয়। ব্রিগেডের এ যুদ্ধ পরিকল্পনায় ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কামালপুর বিওপি আক্রমণ ও দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। ব্রিগেড কমান্ডের পরিকল্পনায় ৩০ জুলাই রাতে আক্রমণের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আক্রমণের প্রস্তুতি
১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুনঃসংগঠনের পর এটাই ছিল প্রথম আক্রমণ পরিকল্পনা। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরী। এ সময় রেজিমেন্টের অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে ছিলেন: ক. ‘এ’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান খ, ‘বি’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন। গ. ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান। ঘ, ‘ডি’ কোম্পানি অধিনায়ক। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ঙ. অ্যাডজুটেন্ট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত হােসেন। চ, মেডিক্যাল অফিসার লেফটেন্যান্ট মুজিবুর রহমান ফকির। ব্রিগেড সদর দপ্তরের অপারেশন নির্দেশনায় অধিনায়ক মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরী আক্রমণ পরিকল্পনা বিষয়ে অন্য অফিসারদের সাথে মতবিনিময়ের পর যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে-সব নিদের্শনা প্রদান হলাে: ক. অ্যাসল্ট পার্টি ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানি খ, কাট অফ পার্টি ‘এ’ কোম্পানি। গ, এফইউ প্রটেকশন ও গাইড কোম্পানি। ‘সি’ কোম্পানি ঘ, আক্রমণের তারিখ ও সময়। ৩০-৩১ জুলাই, রাত ৩টা ৩০ মিনিট। রেকি ও পরিকল্পনা ২৮ জুলাই বিকালে ‘বি’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন তার। কোম্পানির প্ল্যাটুন অধিনায়ক সুবেদার আলী হােসেন, সুবেদার ফয়েজ ও সুবেদার সিদ্দিককে সাথে নিয়ে কৃষকের ছদ্মবেশে কামালপুর বিওপি’র কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরনে লুঙ্গি, মাথায় গামছা এবং খালি গায়ে। সবাই হাল চাষির বেশে বিওপি’র চারপাশের শক্রর অবস্থান পর্যবেক্ষণের চেষ্টা চালান। এ সময় ব্যক্তি নিরাপত্তার জন্য সবার কাছে শুধু একটি করে পিস্তল ছিল। মাঠে কর্মরত অন্য কৃষকদের মাঝে তাদের আলাদা করা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য ছিল কষ্টকর ব্যাপার। কাছ থেকে বিওপি’র পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ, তাদের গতিবিধি, টহল পজিশন, নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড প্রভৃতি বিষয়াবলি সম্পর্কে পুরাে তথ্য ও খবরাখবর সংগ্রহ করে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন নিরাপদে ফিরে আসেন। 
একই দিন রাতে, এফইউপি’র রাত্রিকালীন বাস্তব অবস্থা নিরীক্ষণের জন্য ‘ডি’ কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ‘সি’ কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান, সুবেদার হাই, সুবেদার টি জে হাশেম ও ল্যান্স নায়েক ইউসুফ পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করেন। রাতের অন্ধকারে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তানি বাহিনীর লিসনিং পােস্টের কাছাকাছি পৌছালে একজন পাকিস্তানি সৈনিক হল্ট বলে চিল্কার করে ওঠে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তানি সৈনিককে পরবর্তী কর্মকাণ্ডের কোনাে সুযােগ না দিয়েই জড়িয়ে ধরে মাটিতে ধরাশায়ী করেন। এ সময় সুবেদার হাই কাছ থেকে সুযােগমতাে পাকিস্তানি সৈন্যের উপর গুলি চালান। ফলে দায়িত্ব পালনরত ২জন পাকিস্তানি সৈন্য ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এ দুই সৈন্যের মাথার ক্যাপ এবং ২টি রাইফেল নিয়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও তার দল নিরাপদে ঘাটিতে ফিরে আসেন। একইভাবে ‘এ’ কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর বকশীগঞ্জ অথবা জামালপুর থেকে রিইনফোর্সমেন্ট বন্ধ করার লক্ষ্যে কাট অফ পার্টির সম্ভাব্য অবস্থান নির্ধারণের জন্য প্রচেষ্টা চালান।
২৯ জুলাইয়ের মধ্যে রেকি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সব কোম্পানি অধিনায়কগণ নিজ নিজ পরিকল্পনার প্রয়ােজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরীর কাছে চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য সংগৃহীত সব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। আক্রমণের চূড়ান্ত নির্দেশ ও দায়িত্ব বণ্টন। ৩০ জুলাই বিকালে মডেলের উপর সামরিক কায়দায় অধিনায়ক কর্তৃক যুদ্ধের চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। আক্রমণের দিক নিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় অনেকের মতভেদ ছিল। তাই বিওপি’র সরাসরি সামনের দিক থেকে আক্রমণ করার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিওপি’র পূর্ব দিকে বিওপি’র কাছাকাছি ডাকবাংলাে ও গুদামঘর থাকায় আক্রমণের মােমেনটাম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে বেশি পরিমাণ বাংকার। থাকায় আক্রমণের জন্য উত্তর দিক বেছে নেয়া হয়। অধিনায়কের এ নির্দেশের মধ্যে উল্লেখযােগ্য বিষয়গুলাে হলাে: ১. টার্গেট – কামালপুর বিওপি ।। ২. চূড়ান্ত আক্রমণের সময় (এইচ আওয়ার) – ৩১ জুলাই ভাের ৩টা ৩০ মিনিট। অ্যাসেম্বলি এরিয়া – মহেন্দ্রগঞ্জ। এফইউপি – কামালপুর বিওপি’র ১০০০ গজ সামনে খােলা মাঠ। এফইউপি নিরাপত্তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি প্রয়ােজনীয় মার্কিং ও। গাইড প্রদান করবে। আক্রমণকারী কোম্পানি – ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানি। ৬. এফইউপি মার্কিং’নিরাপত্তা এবং গাইড প্রদান – ‘সি’ কোম্পানি। কাট অফ পার্টি – ‘এ’ কোম্পানি কামালপুর বিওপি থেকে ১ মাইল পিছনে কামালপুর-শ্রীবর্দী রােড জংশন উঠানীপাড়া এলাকা। আর্টিলারি সাপাের্ট – ভারতীয় আর্টিলারি ব্রিগেড। টাইম প্রােগ্রাম (প্রি এইচ আওয়ার সাপাের্ট)। ৯, ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক – চূড়ান্ত করণ। ১০. গ্রুপ-অধিনায়ক ও অ্যাডজুটেন্টের এফইউপি এলাকায় অবস্থান। ব্রিগেড অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানেরও গ্রুপের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত।
মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা
৩১ জুলাই সন্ধ্যার পর অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে নির্দিষ্ট পথে কোম্পানি। অধিনায়কদের নিজ নিজ সৈন্যসহ কামালপুরের দিকে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে নামা বৃষ্টিতে সৈন্যদের চলার গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। একই সাথে বৃষ্টির কারণে ঘাের অন্ধকার থাকায় গাইড এফইউপি’র পথ অনেকটা হারিয়ে ফেলেন, যার ফলে আক্রমণকারী সৈন্যদলের এফইউপিতে পৌছাতে বেশ কিছুটা অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়ে যায়। এ অতিরিক্ত সময় যুদ্ধ আদেশে পরিকল্পনার মধ্যে না থাকায় অ্যাসল্ট ফরমেশন তৈরির আগেই সৈন্যদল নিজেদের প্রি-এইচ আওয়ার বােমবার্ডমেন্টের শিকারে পরিণত হয়। নিজ পক্ষের গােলার আঘাতের সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারও তাদের উপর এসে পড়তে থাকে। ফলে কোম্পানি অধিনায়কদের পক্ষে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য ফর্মিং আপ করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়ায়। এ সময় প্রাকৃতিক কারণে ওয়্যারলেস সিস্টেম জ্যাম হয়ে যাওয়ায় নিজ পক্ষের আর্টিলারির ফায়ার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। একই সাথে অভ্যন্তরীণ যােগাযােগ রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে শুধু চিকার ও ব্যক্তিগত যােগাযােগের মাধ্যমে নির্দেশ প্রদান ব্যাতিরেকে অন্য কোনাে উপায় তাদের সামনে ছিল না।
মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ
এমনই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানির মুক্তিযােদ্ধারা ভিন্ন ভিন্ন দিক দিয়ে এফইউপিতে পৌছাতে চেষ্টা করেন এবং এ অবস্থাতেই ফর্ম আপ করার চেষ্টা চালান। কিন্তু অধিকাংশ মুক্তিযােদ্ধা অল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ব্যাটল প্রসিডিউর সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ গাইডের সুষ্ঠু দিকনির্দেশনার অভাবে তারা একে অন্যের স্থানে উপস্থিত হন। এ ভুল বােঝাবুঝির কারণে ফর্মিং আপ করার আগেই নিজেদের ও শত্রুপক্ষের ক্রসফায়ারে বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন। আক্রমণ সাময়িক হলেও এ সময় বেশ কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়ে। এমনই একটি পরিস্থিতিতে মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু অধিনায়করা এ পর্যায়ে কোনােরকম দুর্বলতা না দেখিয়ে আক্রমণ এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল জুগিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলার নির্দেশ দিতে থাকেন। বিওপি’র কাছাকাছি পৌছে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মেগাফোনে চিকার করে শত্রুদের উদ্দেশ্যে উর্দুতে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। এ সময় অধিনায়কদের প্রেরণায় মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বেড়ে যায় এবং তারা সবাই বিপুল বিক্রমে শত্রু ঘাটি ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হন। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফাটল দেখা দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রাথমিক অবস্থায় যে আউটার ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি ডিফেন্সের এ আউটার প্যারামিটার দখল করে নেন। তখন পাকিস্তানি বাহিনী আউটার প্যারামিটার ডিফেন্স ছেড়ে বিওপি’র অভ্যন্তরে শেলপ্রুফ বাংকার থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
মুক্তিবাহিনীর ২০-২৫জন সদস্য কমিউনিটি সেন্টার এলাকায় প্রবেশ করেন এবং একপ্রকার হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হন। আক্রমণের এক পর্যায়ে আর্টিলারির একটি গােলা ক্যাপ্টেন হাফিজের সামনে এসে পড়ে এবং তাঁর হাতের স্টেনগান উড়ে যায়। গােলার আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। অত্যন্ত সাবধানতায় তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হলে ক্যাপ্টেন হাফিজের কোম্পানি একপ্রকার নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। বি’ কোম্পানির অধিকাংশ মুক্তিযােদ্ধা এ হাতাহাতির যুদ্ধে শহিদ হন। এ সময় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের গতি আরও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে ‘বি’ কোম্পানি বিওপি’র ডান দিকে কামালপুর-ঝিনাইগাতি রাস্তার উত্তরে কাঁচা রাস্তা পার হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের। আউটার প্যারামিটার ডিফেন্সে প্রবেশ করলে ক্যাম্পের উত্তর-পশ্চিম পার্শ্ব থেকে মেশিনগানের ফায়ারের সম্মুখীন হয়। আর্টিলারি সাপাের্টের অভাবে কোনােভাবেই এ এমজি নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিবাহিনীর প্রবল চাপে পাকিস্তানি সেনারা তখন আউটার প্যারামিটার ছেড়ে বিওপি’র ভিতরের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন চলমান অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে মারাত্মক আহত হন। মাটিতে লুটিয়ে পড়েও তিনি সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অধিক রক্তক্ষরণের ফলে অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি শহিদ হন। সহযােদ্ধা কর্তৃক তার মৃতদেহ উদ্ধারের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
বিকল্প অধিনায়ক থাকায় ‘এ’ কোম্পানিতেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে কোম্পানি আক্রমণের শেষপর্যায়ে এসেও অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়। আক্রমণের ফলােআপ কোম্পানি ‘ডি’ কোম্পানির নেতৃত্বদানকারী অফিসার লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান আক্রমণের সূচনায় পায়ে গুলিবদ্ধ হয়ে আহত হন। আক্রমণ পরিচালনাকারী অধিনায়কদের হতাহতের কারণে আক্রমণের নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দেয় এবং মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে খণ্ড খণ্ড উপদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর মধ্যে ভােরের আলাে ফুটে উঠে এবং বাংকারের ভিতর অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা লক্ষ্যস্থির করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
মুক্তিবাহিনীর রােড ব্লক
ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানি ৩১ জুলাই রাতে সীমান্ত অতিক্রম। করে কামালপুর বকশীগঞ্জ রাস্তায় কামালপুরের এক মাইল দক্ষিণে কামালপুর-শ্রীবর্দী রােড জংশন ও উঠানীপাড়া এলাকায় রােড ব্লক করে । কাট অফ পাটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ির বহরকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আধা পাকা রাস্তার। উপর অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন স্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে মূল দল প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ দলের সদস্য ছিলেন ৬০জন।
দলের সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি বিধ্বস্ত হলে গুলি করে পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করা। মূল দলের ৩০০ গজ দক্ষিণে একটি ছােটো দল অবস্থান গ্রহণ করে। এদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য সাহায্যকারী দলের আগমনের সংকেত প্রদান করা এবং মূল দলের ফায়ার শুরু হলে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংস করা। কাট অফ পাটির আরও একটি দল মূল দলের ২০০ গজ উত্তরে অবস্থান গ্রহণ করে। এ দলের দায়িত্ব ছিল সাহায্যকারী পাকিস্তানি সেনাদের কামালপুর বিওপিতে পৌছানােতে বাধা দেয়া এবং পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংস সাধন করা।
রােড ব্লকের সাফল্য কামালপুর যুদ্ধের জন্য স্থাপিত রােড ব্লক সামগ্রিকভাবে কার্যকর হয়েছিল। কামালপুর বিওপিতে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সংবাদে বকশীগঞ্জ কোম্পানি সদর দপ্তর থেকে ২-৩টি ট্রাক সাহায্যকারী হিসেবে কামালপুর বিওপি’র উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। রাত ৪টা ৩০ মিনিটে উঠানীপাড়া এলাকায় রাস্তায় স্থাপন করা মাইনের বিস্ফোরণে গাড়ি ২টি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একইসাথে কাট অফ পাটির সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্যরা দলের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা ভূমিতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণের সূচনা করে। প্রায় আধা ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা এদিক-সেদিক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে হতাহত হয়। এ সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ৮-১০জন নিহত এবং ১২-১৪জন আহত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ১জন সদস্য শহিদ হন।
কামালপুর বিওপি আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের হতাহতের সংখ্যা
কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ ২৯জন মুক্তিবাহিনীর সদস্য শহিদ হন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন, লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান এবং ৩জন জেসিওসহ ৬৭জন আহত হন।
কামালপুর বিওপি আক্রমণের ফলাফল বিশ্লেষণ
মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের পর কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নিয়মিত যুদ্ধ। এলাকা শত্রুমুক্ত করা ছাড়াও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের মান, ব্যক্তিগত মনােবল, সামরিক কমান্ডের প্রতি আনুগত্য এবং নবগঠিত রেজিমেন্টগুলাের অধিনায়কদের যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতা যাচাই করা ছিল এ আক্রমণ পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য। কামালপুর বিওপি আক্রমণের সার্বিক সফলতা অর্জিত না হওয়ার পিছনে কিছু বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয়।
পরিকল্পনার গােপনীয়তা যে-কোনাে যুদ্ধের কৌশলগত পরিকল্পনায় গােপনীয়তা রক্ষা করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিবাহিনীর কামালপুর আক্রমণ পরিকল্পনার জন্য পরিচালিত রেকি দলগুলাে তাদের গােপনীয়তা রক্ষা করতে পারেনি। রেকি করার সময় একটি দল শত্রুর প্যাট্রলের সাথে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এর ফলে রেকির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণের আশঙ্কায় সচেতন। হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে বিওপি আউটার প্যারামিটার বেষ্টনী শক্তিশালী করে তােলে। যার ফলে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানিগুলাে আক্রমণের সূচনাতেই শক্তিশালী এ আউটার প্যারামিটার বেষ্টনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যুদ্ধের মােমেনটাম হারিয়ে ফেলে। অতএব, মূল আক্রমণের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার গােপনীয়তা রক্ষার জন্য এবং যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, আক্রমণের পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ও সফলতা অর্জনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কামালপুর আক্রমণের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রেকি করতে গিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি বাহিনী। সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পড়ে।
একই সঙ্গে আক্রমণ মােকাবিলায়। প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আক্রমণের দিক নির্বাচন কামালপুর বিওপি’র এ আক্রমণ উত্তর দিক তথা সরাসরি সামনের দিক থেকে পরিচালিত হয়। বিওপি’র উত্তর দিকে এক হাজার গজ পর থেকে মাঝির চর। গ্রাম পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকা ছিল নিচু জলাশয়। বর্ষার মৌসুমে এ জলাশয়ে তখন প্রায় দুই থেকে আড়াই ফুট পানি। এ দিকের সমগ্র এলাকায় কোনাে বাড়িঘর। কিংবা গাছপালা ছিল না। পানির ভিতর দিয়ে প্রায় ৫০০ গজ জলাশয় অতিক্রম করায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে। আক্রমণের গতি তীব্রতা লাভ করতে পারেনি।  ছিল। ফলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকারী ২টি কোম্পানিই উত্তর দিক থেকে আসায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ক্যাম্পের দুই পাশে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা কার্যকরভাবে। আক্রমণকারীদের উপর একই সাথে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। ক্যাম্পের। উত্তর-পশ্চিমে স্থাপিত এমজি দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণকারী মুক্তিবাহিনীর পূর্ব পার্শ্ব পর্যন্ত কার্যকরভাবে গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর কাছে বাংকার ধ্বংস করার মতাে কোনাে অস্ত্র না থাকায় এমজি পােস্ট এবং অন্যান্য অবস্থান মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এত প্রতিবন্ধকতার পরও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকারী ২টি কোম্পানিই শত্রুর আউটার প্যারামিটার ভেদ।
করে মূল ঘাঁটিতে আঘাত করতে সক্ষম হয়। অবস্থানগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে শুধু বাংকারবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হলে যুদ্ধের গতি ও পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারতাে। উপরন্তু, সরাসরি সামনের দিক থেকে আক্রমণ করার ফলে মুক্তিবাহিনীর শক্তি ক্ষয় হয় এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর কমান্ড দুর্বলতা
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনায় কোম্পানি অধিনায়কদের অবর্তমানে অন্য কোনাে অফিসার রাখা হয়নি, যার ফলে আক্রমণ পরিচালনাকারী কোম্পানি অধিনায়কদের হতাহতের পর বিকল্প নেতৃত্বের অভাবে আক্রমণ তার গতি হারিয়ে ফেলে। বিশেষত ক্যাপ্টেন হাফিজের আহত হওয়া এবং ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের শাহাদতবরণ যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়। কিন্তু অধিনায়ক না থাকার ফলে আক্রমণের গতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর প্রভাব যােদ্ধাদের মনােবলকে প্রভাবিত করে। রেজিমেন্ট অধিনায়কের অবস্থান ফলােআপ কোম্পানি ‘ডি’ কোম্পানির সাথে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সময়মতাে উপস্থিত না থাকায় ‘ডি’ কোম্পানি এফইউপি ছেড়ে সামনে অগ্রসর হয়ে পড়ে। ফলে রেজিমেন্ট অধিনায়ক প্রয়ােজনীয় মুহূর্তে তার পরিবর্তিত নির্দেশ কার্যকর করতে পারেন নি। 
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব
কামালপুর আক্রমণ পরিকল্পনায় বিওপিতে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যের বাস্তব অবস্থানের সংখ্যাগত দিক মূল্যায়ন করা হয়নি। কামালপুর বিওপিতে এ সময় ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট, রেঞ্জার্স ও রাজাকার সমন্বয়ে এক কোম্পানির অধিক সৈন্যের অবস্থান ছিল। এ বিওপিকে একটি স্ট্রং ডিফেন্স পয়েন্ট হিসেবে গড়ে তােলা হয়েছিল, যার ফলে যুদ্ধ পরিকল্পনায় দুই কোম্পানি স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী দিয়ে সরাসরি সামনের দিক থেকে আক্রমণ একপ্রকার আত্মঘাতী। আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কামালপুর বিওপি আক্রমণ পরিকল্পনায় কোনাে রিজার্ভ ফোর্স রাখা হয়নি। ‘ডি’ কোম্পানি ফলােআপ কোম্পানি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও নির্দিষ্টভাবে তাদের পরিবর্তিত দায়িত্ব বণ্টন করা হয়নি, যার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র গােলাগুলিতে আক্রমণকারী কোম্পানি ২টির বহু সৈন্য হতাহত হওয়ার পর আক্রমণের তীব্রতা কমে গেলেও ‘এ’ কোম্পানির সৈন্যরা গুরুত্বপূর্ণ কোনাে  ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। আক্রমণের এ পর্যায়ে রিজার্ভ সৈন্যদলের পক্ষে আক্রমণের দায়িত্ব তুলে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর এ ঘাঁটির পতন ঘটানাে সম্ভব ছিল।
মুক্তিবাহিনীর ফায়ার সাপাের্ট প্ল্যানিং
মুক্তিবাহিনীর এ আক্রমণের আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিডিয়াম আর্টিলারির উপর নির্ভরশীল। টাইম প্রোগ্রামের মাধ্যমে এ ফায়ার প্ল্যান নির্দিষ্ট করা হয়, যার ফলে আক্রমণ চলাকালে যেসব নতুন লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করা হয়েছিল, তা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে আক্রমণকারী দলের সাথে অবজারভার না থাকায় নিজ সৈন্যের উপর। গােলাবর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। চূড়ান্ত আক্রমণ পর্যায়ে মূল লক্ষ্যবস্তুর উপর আটিলারি ফায়ার দেয়া সম্ভব হলে আক্রমণের ফলাফল ভিন্ন হতে পারতাে।
আক্রমণ পরিকল্পনায় সমন্বয়ের অভাব
আক্রমণের মূল পরিকল্পনায় সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা যায়। আক্রমণকারী দল এফইউপিতে বিলম্বে পৌছায়। টাইম প্রােগ্রাম অনুযায়ী গােলাবর্ষণের সাথে মূল আক্রমণের সমন্বয় ঘটেনি। উপরন্তু, গােলাবর্ষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনাে অবজারভারও ছিল না। প্রয়ােজনীয় রিজার্ভ পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। সবচেয়ে বড়াে দিক হলাে আক্রমণের গােপনীয়তা রক্ষা করা যায়নি। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের উচ্চস্তরের মনােবল থাকা সত্ত্বেও শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে এ আক্রমণ সফলতা লাভ করতে পারেনি। প্রতিকূল আবহাওয়া কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য লাভ না করার একটি অন্যতম কারণ হলাে প্রতিকূল আবহাওয়া। জুলাই মাসের ভরা বর্ষায় প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সেনাদলকে আক্রমণ বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হয়। বৃষ্টি ও কর্দমাক্ত রাস্তার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে নির্দিষ্ট টাইম প্ল্যান রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ফলে পথিমধ্যে ঘন অন্ধকারে মুক্তিবাহিনী সহায়তাকারী ভারতীয় বাহিনীর মিডিয়াম আটিলারির কভারিং ফায়ারের মধ্যে পড়ে যায়। অধিকন্তু, পাকিস্তানি বাহিনীর। বিরুদ্ধে ফায়ার ওপেন করার পর শত্রুপক্ষ থেকে মুক্তিবাহিনীর উপর ফায়ারিং হতে থাকে। খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুক্তিবাহিনীকে শত্রু ও মিত্র উভয় বাহিনীর গােলার শিকার হতে হয়। এ প্রতিকূল পরিস্থিতি মােকাবিলা করে কামালপুর বিওপি আক্রমণ ছিল মুক্তিবাহিনী ও সেনা অধিনায়কদের এক অসমসাহসী পদক্ষেপ।
পাকিস্তানি বাহিনীর সাফল্যের কারণ
কামালপুর বিওপি পূর্ব থেকেই ইপিআর-এর একটি সীমান্ত ঘাঁটি ছিল। এ স্থানের অবস্থান, পারিপার্শ্বিকতা, যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি মেঘালয় সীমান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ডিফেন্সিভ ব্যাটলের পরিকল্পনায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। ক্যাম্পের মধ্যে অবস্থিত সব বাংকার পাকা কংক্রিটে তৈরি ছিল। একই সঙ্গে মাইন, বাঁশের কঞ্চি,
কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘাঁটিটিকে আরও সুরক্ষিত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য প্রবেশপথ হিসেবে চিহ্নিত করে কামালপুর বিওপিকে একটি স্ট্রং পয়েন্ট ঘাটি হিসেবে গড়ে তােলা হয়েছিল। পাকিস্তানিদের সাফল্যের সবচেয়ে বড়াে কারণটি ছিল ফায়ার পাওয়ারের সমন্বয়সাধন। মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমের উপর নিয়মিত নজরদারির ব্যবস্থা ছিল। প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতির ফলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে সহজতর হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণপূর্ব রেকি করার সময় সংঘর্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী সম্ভাব্য মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে যায় এবং দ্রুত রক্ষণাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এছাড়াও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে গেলেও পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অনুকূলে ছিল। কেননা কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ছিল রক্ষণাত্মক এবং মুক্তিবাহিনী ছিল। আক্রমণাত্মক অবস্থানে। সর্বোপরি বলা যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে অস্ত্রের ভারসাম্য ছিল না। পাকিস্তানিদের হাতে ছিল ভারি অস্ত্র, মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল অপেক্ষাকৃত হালকা অস্ত্র ।
কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনীর ৩৭জন বীর সদস্য শহিদ হন। সামগ্রিক মূল্যায়ন কামালপুর বিওপি’র যুদ্ধকে সামগ্রিক মূল্যায়নের পর বলা যায় যে, এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সাফল্য লাভ করতে না পারলেও অদম্য মনােবল ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। এ যুদ্ধ ছিল এক অর্থে একটি পরীক্ষামূলক যুদ্ধ। ব্রিগেড কমান্ড মুক্তিবাহিনীর মনােবল, অধিনায়কের প্রতি আনুগত্য, প্রশিক্ষণের মান প্রভৃতি বিষয়াবলি যাচাই করতে চেয়েছিল। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করতে না পারলেও ব্রিগেড কমান্ডের যাচাইয়ের বিষয়গুলাে সফল হয়েছিল। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন অকুতােভয়, অসমসাহসী এবং অধিনায়কের প্রতি আনুগত্য ছিল অবর্ণনীয়। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিষয়টি হলাে, সম্মুখযুদ্ধে জীবনকে উৎসর্গ করা। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের শাহাদতবরণ দেশমাতৃকার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের গভীর নিষ্ঠা, আস্থা ও অসাধারণ দেশপ্রেম প্রমাণিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে চরম প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করে মুক্তিযােদ্ধারা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। এটা সত্যিকার অর্থে আমাদের মহান বিজয়ের আগাম বার্তা প্রদান করেছিল। স্বাধীনতার জন্য যে জাতির সন্তানরা যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন উৎসর্গ করতে পারে, সে জাতির স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখা যায় না, তারই প্রমাণ আমাদের স্বাধীনতা।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড