You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঠাকুরকোনা সেতু ধ্বংস

ঠাকুরকোনা ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা)। নেত্রকোনা থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। গ্রামটির অবস্থান থানা সদর থেকে ৩-৪ কিলােমিটার উত্তরে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সােমেশ্বরী নদী। গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থানে নদীর উপর সেতুটিই ঠাকুরকোনা সেতু হিসেবে এলাকায়। পরিচিত। নেত্রকোনা থেকে উত্তরে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর থানার সাথে সড়কপথে যােগাযােগ এ ঠাকুরকোনা সেতুর উপর নির্ভরশীল ছিল। এ সেতু। পাহারায় ১০জন রাজাকারের একটি দল নিয়ােজিত ছিল। ১৩ জুলাই মুক্তিযােদ্ধা আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে ৩০জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ঠাকুরকোনা সেতু আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে সেতু পাহারারত রাজাকাররা পালিয়ে যায়। সেতু এলাকা দখলের পর মুক্তিবাহিনী। ডিনামাইট দিয়ে সেতুটিকে উড়িয়ে দেয়। সেতুটি অকেজো হয়ে পড়ার ফলে। থানা থেকে উত্তর দিকের কলমাকান্দা, দুর্গাপুরের সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা । বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:

১. আবদুল জব্বার

২. আবু বকর সিদ্দিক

৩. মােহাম্মদ হাবিব।

৪. আবু আব্বাস

৫. আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।

কটিয়াদি অ্যামবুশ

কটিয়াদির অবস্থান

ময়মনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি থানা কটিয়াদি। এলাকাটি ছিল চারদিকে হাওড়, বিল, খাল ও জলাভূমি এবং রাস্তাঘাট ও যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত। চলাচলের জন্য নৌকাই ছিল প্রধান বাহন। কটিয়াদি সদরে কয়েকটি পাকা বাড়ি ছাড়া কোনাে স্থাপনা তখনাে গড়ে ওঠেনি। এলাকাটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ বয়ে গেছে। মহকুমা শহর কিশােরগঞ্জ কটিয়াদি থেকে ২৫ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। কটিয়াদি থেকে ১০-১২ কিলােমিটার দক্ষিণে কুলিয়ারচর থানা এবং ২৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভৈরব বাজার অবস্থিত। ভৈরব বাজার থেকে কুলিয়ারচর হয়ে কটিয়াদি পর্যন্ত একটি কাচা রাস্তা ছিল এবং অসংখ্য স্থান ছিল বিধ্বস্ত। বর্ষার দিনে এ সড়কের অনেকাংশ পানির নিচে তলিয়ে যেত। থানা সদরের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাের মধ্যে চরিরাকোমা, চরপুকিয়া, চড়িপাড়া, ঘগাইর, জালালপুর, মুদগা উল্লেখযােগ্য।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কটিয়াদির গুরুত্ব

সড়কপথে ও নদীপথে বাজিতপুর ও ভৈরব বাজারে যাতায়াতের পথে একটি বিশেষ স্থান কটিয়াদি। কিশােরগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজার ও আশুগঞ্জে চলাচলের জন্য কটিয়াদি ও কুলিয়ারচর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভৈরব ও কিশােরগঞ্জের মধ্যে যাতায়াতব্যবস্থা অবিচ্ছিন্ন রাখা এবং এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলমুক্ত রাখার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী কটিয়াদি ও তার আশপাশ এলাকায় একাধিক ক্যাম্প স্থাপন। করে। এ ক্যাম্প স্থাপনের প্রধান কারণ ছিল কিশােরগঞ্জ মহকুমায় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সড়ক, রেলপথ ও নদীপথের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান

কিশােরগঞ্জের কটিয়াদি থানা ছিল ৭০ উইং রেঞ্জার্সের অপারেশনাল এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযােগী রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের মাধ্যমে কটিয়াদি, মঠখােলা, কালিয়াচাপড়া, পাকুন্দিয়া, মনােহরদী, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও গচিহাটায় একাধিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ভৈরববাজার ও আশুগঞ্জেও ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। কিশােরগঞ্জের ঘাঁটিতে অবাঙালি রাজাকারদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতাে। কটিয়াদি থেকে প্রায় ২০ কিলােমিটার

উত্তরে হােসেনপুর থানা সদর এলাকায় রাজাকারদের অনুরূপ একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল। কটিয়াদিতে স্থানীয়ভাবে নিয়ােগকৃত আরও এক কোম্পানি রাজাকারের অবস্থান ছিল।

মুক্তিবাহিনীর অবস্থান

কিশােরগঞ্জ কটিয়াদি এলাকায় রেঞ্জার্স ও রাজাকারের ব্যাপক চলাচল থাকায় মুক্তিবাহিনীর এ এলাকায় কোনাে স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠেনি। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়কগণ সীমান্ত অবস্থান থেকে এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করতেন। জুন মাস নাগাদ এ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায় এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিতে চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা দলের নেতা হারুন-অর-রশিদ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। কটিয়াদির অ্যামবুশ এ যুদ্ধগুলাের মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য।

যুদ্ধের বিবরণ

১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কটিয়াদি এলাকায় অবস্থানকারী মুক্তিবাহিনীর দলনায়ক হারুন-অর-রশিদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের একটি সংবাদ আসে। তথ্য সংগ্রহে জানা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫টি সৈন্যবাহী লঞ্চ বেলাবাে থেকে এসে কটিয়াদিতে অপেক্ষা করছে। ১৫ জুলাই লঞ্চগুলাে যুদ্ধাস্ত্র, রসদ ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পরবর্তী সময় ঢাকা অথবা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার উদ্যোগ নিচ্ছে। অধিনায়ক হারুন-অর-রশিদ এ খবরের উপর ভিত্তি করে কটিয়াদি এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে কটিয়াদি থেকে কিছু দূরে সাগরদী বাজারের কাছে অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে লঞ্চের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সময় গ্রুপ অধিনায়ক মােশাররফ হােসেন কিরণের নেতৃত্বে ২০জন মুক্তিযােদ্ধার আরাে একটি দল খিদিরপুর গ্রাম থেকে অগ্রসর হয়ে সাগরদী বাজারে এসে হারুন-অর-রশিদের দলের সাথে যােগ দেয়। অধিনায়ক হারুন-অর-রশিদ সাগরদী বাজারের কাছে রামপুরা গ্রামের উত্তর প্রান্তে যেখানে ব্রহ্মপুত্র নদ বাঁক নিয়েছে, সেখানে অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযােদ্ধা দলটিকে ৩টি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে ৩টি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন, প্রথম লঞ্চটি মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ও শেষ অবস্থানে না পৌছানাে পর্যন্ত কেউ যেন গুলি না চালায়। তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন শেখ হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বাধীন মূল দল। 

১৫ জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যবাহী লঞ্চগুলাে যাত্রা না করায় অধিনায়কের নির্দেশে সবাই শক্রর অপেক্ষায় থাকে। ১৬ জুলাই সকালে সংবাদ আসে যে,লঞ্চ ৫টি কটিয়াদি থেকে রওনা করেছে। যে-কোনাে সময় রামপুরা বাক। অতিক্রম করবে। এ সংবাদে শেখ হারুন-অর-রশিদ তার দলকে পুনরায় নদের তীরে ৩টি স্থানে অবস্থান গ্রহণে নির্দেশ দেন। | ১৬ জুলাই সকাল ৮টায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম ২টি লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে প্রবেশ করে। ২টি করে লঞ্চ একসাথে বাঁধা। সবাই দলনেতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। দ্বিতীয় জোড়া লঞ্চ দুই নম্বর উপদলের সম্মুখে উপস্থিত হলে হঠাৎ করে এ দলের মুক্তিযােদ্ধা আফতাব উত্তেজিত হয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে লঞ্চের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা লঞ্চের উপর গুলি চালাতে থাকেন। ততক্ষণে প্রথম দিকের ৪টি লঞ্চ মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশ সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং ৪টি লঞ্চই আক্রান্ত হয়েছে। পিছনের লঞ্চটি সম্মুখের লঞ্চগুলাে আক্রান্ত হতে দেখে আর। সম্মুখে না এগিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে রামপুরা বাজারের কাছে নদীর পশ্চিম তীরে সৈনিকদের নামিয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী লঞ্চের ছাদে বালুর বস্তা দিয়ে পূর্বেই একাধিক মজবুত বাংকার তৈরি করে রেখেছিল। সে অবস্থান থেকে তারা এলএমজি দিয়ে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একইসাথে পিছনে স্থলপথে নেমে আসা এক সৈনিকও মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে চালাতে অগ্রসর হতে থাকে।

দলনেতা হারুন বুঝতে পারেন, এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি তার নিজের দলের এলএমজি’র ফায়ারিং কভারে ৩টি দলকেই প্রত্যাহার করে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। অধিনায়ক হারুন কটিয়াদির যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে নিজ দলসহ সাগরদী বাজার পার হয়ে চালাকচরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসেন।  অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার আড়ালিয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী মাঠে অবতরণ করে। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর এ দলটি প্রথমে ভেবেছিল, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুনভাবে সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে। পরে এলাকার জনগণের কাছ থেকে জানা যায় যে, হেলিকপ্টারটি এসেছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আহত সৈনিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য। পাকিস্তানি বাহিনীর হেলিকপ্টারটি তিনবার এ এলাকায় আসা-যাওয়া করে। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, কটিয়াদি লঞ্চ আক্রমণে ১৫-১৬জন আহত ও নিহত সৈনিককে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। কটিয়াদি অ্যামবুশে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা কটিয়াদি অ্যামবুশে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:

১. শেখ হারুন-অর-রশিদ

২. ছানােয়ার আলী।

৩, মােশাররফ হােসেন

৪. আবদুর রশিদ

৫. হায়দার আলী নান্ন

৬. আতাউর রহমান

৭. কাজী মােস্তফা।

৮. আবদুল আউয়াল

৯, আবদুল কুদ্ছ।

১০. কাজী সাইদুর রহমান

১১. জয়নাল আবেদীন

১২. মতিউর রহমান

১৩. জয়নাল

১৪. মােস্তফা

১৫, তমিজউদ্দিন

১৬. আমিনুল ইসলাম

১৭. মাে. শামসুদ্দিন

১৮. মুজিবর রহমান

১৯. আবু তাহের।

২০. রফিকুল ইসলাম

২১. আতাউর রহমান।

২২. আহম্মদ হােসেন খান

২৩. আবদুল জব্বার।

২৪. আফতাব উদ্দিন

২৫. আবদুর রশীদ।

২৬. আবদুল মালেক

২৭. আবদুল হাকিম প্রমুখ।

সামগ্রিক মূল্যায়ন কটিয়াদি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর লঞ্চ আক্রমণে মুক্তিবাহিনী সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে। কিন্তু লঞ্চে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান। সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার কারণে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের শিকার হয় এবং কটিয়াদি এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

বোরচরের যুদ্ধ
বােররচর গ্রামটির অবস্থান ময়মনসিংহ জেলার কোতােয়ালী থানায়। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ১০ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী এ গ্রামটি নিচু এলাকায় অবস্থিত। যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকার ফলে এ স্থানটি মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হয় এবং জুন মাস থেকে বােররচর গ্রামটি মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে পরিণত হয়। দালাল ও রাজাকারদের মাধ্যমে বােররচর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর এ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ১৩ জুলাই পাকিস্তানি বাহিনী নদীপথে গানবােটযােগে। বােররচর গ্রাম আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। সকাল ১০টা থেকে তিন ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী নিরাপদে অবস্থান ত্যাগ করে।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে
১. রফিক
২. মতিউল ইসলাম বেগ
৩. ডা. বাবর আলী।
৪, রফিকুল ইসলাম।
৫. সৈয়দ আলী
৬. নূরুল ইসলাম।
৭, মনজুরুল হক তােতা।
৮. নজরুল ইসলাম
৯. আহাম্মদ আলী
১০. আয়ুব আলী
১১. আমির হােসেন
১২. আবদুল গফুর
১৩. আকতার আলী
১৪. আনিছুর রহমান প্রমুখ।
নাগলা সেতুর যুদ্ধ
নাগলা সেতুর অবস্থান
ময়মনসিংহ জেলার অধীন ফুলপুর থানা ও হালুয়াঘাট থানার প্রধান সংযােগ সড়কের উপর নাগলা বাজারের অনতিদূরে ভুগাই নদীর উপর নাগলা সেতুর অবস্থান। উত্তর-দক্ষিণে ৮০-৯০ ফুট দীর্ঘ আরসিসি নির্মিত সেতুতে ৪টি বিম ও ৬টি স্ক্যান ছিল। হালুয়াঘাট থানার পূর্ব পাশ দিয়ে একটি ছােটো নদী দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নাগলা বাজার হয়ে শেরপুর মহকুমার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া ছােটো ছােটো কিছু নদী ও খাল নাগলা বাজারের আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নাগলা সেতুর গুরুত্ব
ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশের সীমান্তবর্তী থানা হালুয়াঘাট ও ধােবাউড়া থানার সাথে যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম হলাে সড়কপথ। যুদ্ধকালে এ সড়কপথের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সীমান্তে অবস্থিত বিওপি এবং অপরাপর অবস্থানে সৈন্যদের জন্য খাদ্য, রসদ, অস্ত্রশস্ত্রসহ যাবতীয় জিনিসপত্র এ সড়কপথে সরবরাহ করতাে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান নাগলা সেতুর অবস্থান ছিল ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকায়। ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল ময়মনসিংহে। নাগলা সেতুর নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত কোনাে সৈনিকের অবস্থান ছিল না। সেতুর দুই পাশে মিলিশিয়া ও রাজাকার দল নিয়মিত পাহারায় নিয়ােজিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়তাে ধারণা ছিল, সেতু আক্রান্ত হলে অনতিদূরে ফুলপুরে অবস্থানরত ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে সাথে সাথে রিইনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে শত্রুর মােকাবিলা করা সম্ভব হবে।
যুদ্ধের পরিকল্পনা
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ডালু সাব-সেক্টর অধিনায়কের কাছ থেকে নাগলা সেতু ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার নির্দেশ আসে। অধিনায়ক আবদুল হকের নেতৃত্বে ৪১জন সদস্যের একটি মুক্তিযােদ্ধা দলকে নাগলা সেতু ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ দলের মধ্যে বিস্ফোরক ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
যুদ্ধের বিবরণ
১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই রাতে ৪১ সদস্যের মুক্তিযােদ্ধা দল বিকাল ৫টায় অধিনায়ক আবদুল হকের নেতৃত্বে প্রয়ােজনীয়সংখ্যক অস্ত্র, গােলাবারুদ ও বিস্ফোরকসহ বামারী ও হাতিবান্ধা বিওপি’র মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এ দলের সাথে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রসহ প্রত্যেকের কাছে একটি করে গ্রেনেড এবং সেতু উড়ানাের জন্য ৭০০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ছিল। রাতের আধার ও বৃষ্টি থাকায় মুক্তিযােদ্ধা দলের পথচলায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। ১ রাত ও ১ দিন সমস্ত রাস্তা বৃষ্টির মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার দিকে মুক্তিযােদ্ধা দলটি কালাপাড়া গ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে খরমাকান্দা হয়ে পাটিয়াজুরি হাই স্কুল থেকে আধা মাইল উত্তরে প্রাথমিক আস্তানা সৃষ্টি করে। ১৮ জুলাই সকালবেলা কংস নদী পার হয়ে রামনগরের মধ্য দিয়ে কোদালিয়ায় পৌছে। মুক্তিযােদ্ধা দলটি পরদিন আমতলী গ্রামের মধ্য দিয়ে শিমুল গ্রামের উত্তর দিয়ে রাত ৮টা নাগাদ নাগলা বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। অধিনায়ক আবদুল হক কয়েকজনকে সাথে নিয়ে প্রথমে সেতুর কাছাকাছি পৌছে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তখন রাত আনুমানিক ১১টা। এ সময় হালুয়াঘাট থেকে একটি এবং ফুলপুর থেকে আরেকটি জিপ এসে সেতুর উপর থামে। সেতুর উপর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর জিপ ২টি আবার দুই দিকে ফিরে যায়। অনুমান করা যায়, এগুলাে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়মিত টহল গাড়ি। দলনেতা আবদুল হক পাহারারত রাজাকারদের অবস্থান পর্যবেক্ষণের পর ফিরে আসেন। এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারকারী দলকে তাদের প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর যথাযথ তদারকি করে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় তিনি দলটিকে তিন। ভাগে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করেন। গাইড ধীরে ধীরে অধিনায়কের নির্দেশে সামনে অগ্রসর হয়। গাইডের দিকে লক্ষ্য রেখে সবাই সামনে এগােতে থাকে। আনুমানিক রাত ২টার দিকে মুক্তিযােদ্ধা দলটি নাগলা বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে সেতুর ৫০০ গজ নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে।
২টি দল বিভক্ত হয়ে মূল সড়কের উপর অবস্থান নেয়। ১০জন মুক্তিযােদ্ধার অগ্রবর্তী দলটি সেতুর ১০০ গজের কাছাকাছি পৌছুলে পাহারারত মিলিশিয়া ও রাজাকার দল কারও অবস্থান টের পেয়ে শক্তিশালী টর্চলাইট দিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী দলের উপর আলাে ফেলার আগেই মুক্তিযােদ্ধা। বদিউল আলম রতন ত্বরিতগতিতে পজিশন নিয়ে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। একইসাথে অন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এমতাবস্থায় পাহারারত রাজাকার ও মিলিশিয়া দল মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান অনুমান করে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারকারী দল সেতুর উত্তর পাশে। সেতুর মুখে গর্ত খুঁড়ে এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে সেতুর দক্ষিণ পাশে এসে কর্ডেক্স তারের সাহায্যে ফিউজে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এ বিস্ফোরণে সেতুটির সামগ্রিক ক্ষতি সাধিত হয় এবং ব্যবহার অযােগ্য হয়ে পড়ে। নাগলা সেতুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা নাগলা সেতুর যুদ্ধে নিমলিখিত মুক্তিযােদ্ধাগণ অংশগ্রহণ করেন।
১, আবুল মুনসুর তরফদার
২. বাবলু মিয়া
৩. মাে. শাহজাহান
৪. ইদ্রিস আলী।
৫. আবদুর রহিম
৬. আবদুল কাদের।
৭. কাজিম উদ্দিন
৮. আইয়ুব আলী
৯. নেওয়াজ আলী
১০. ইন্তাজ আলী
১১. আবদুল কুদ্ছ।
১২. জালাল উদ্দিন
১৩. আবদুল কাদের
১৪. ফজলুল হক।
১৫. আবদুস সালাম
১৬. সুরুজ আলী
১৭. আবদুল হাই
১৮. আবদুর রাজ্জাক
১৯, আবদুল খালেক
২০. নেওয়াজ আলী
২১. সামছুদ্দিন আহমেদ
২২. ইমাম হােসেন
২৩. অরুন সরকার
২৪. রফিকুল ইসলাম
২৫. মতিউর রহমান
২৬. গিয়াস উদ্দিন
২৭, রহিম উদ্দিন
২৮. ইউনুস আলী
২৯, আব্বাস আলী
৩০. সুরুজ আলী।
৩১. নাজিম উদ্দিন।
৩২. সুলতান মিয়া।
৩৩. শরিফুল ইসলাম
৩৪. বাচ্চু মিয়া
৩৫, আলী হােসেন।
৩৬, ডা, উইলিয়াম ম্রং
৩৭. তােফাজ্জল
৩৮. আমানউল্লা
৩৯, জয়নাল আবেদীন
৪০. মােতালেব সরকার
৪১. মাে. আলাউদ্দিন
৪২. আবুল হােসেন।
৪৩. আবদুল হক প্রমুখ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন পরিকল্পনায় মুক্তিবাহিনী প্রয়ােজনীয় সঠিক তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আক্রমণের সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যুদ্ধের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা যথাযথ রণকৌশল এবং প্রয়ােজনাতিরিক্ত এক্সপ্লোসিভ বহন করে। প্রশিক্ষিত এক দল মুক্তিযােদ্ধার সফল অভিযান ছিল নাগলা সেতুর যুদ্ধ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!