You dont have javascript enabled! Please enable it! কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটের যুদ্ধ - সূত্রাপুর সেতু ধ্বংস - সংগ্রামের নোটবুক
কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটের যুদ্ধ
যুদ্ধকালে নিরাপদ যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলার বিষয়টি ছিল অপরিহার্য। ১৯৭১ সালের মে মাস নাগাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সমর্থ হয়। মুক্তিবাহিনী যেন সহজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ এবং জনগণ যেন দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারত সীমান্ত বরাবর টহল চৌকি স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এসব চৌকিতে অবস্থানকারী সৈন্যদের যুদ্ধসরঞ্জাম, খাদ্য, চিকিৎসাসহ প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরবরাহের জন্য যােগাযোেগ ব্যবস্থা রক্ষা করার বিষয়টি অপরিহার্য ছিল। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেতু, কালভাট, ফেরিঘাট ও ফেরিবােট ধ্বংসের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটের অবস্থান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অধীন শেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) সদর থেকে একটি সড়ক নালিতাবাড়ি থানা হয়ে ময়মনসিংহ জেলা সদর পৌঁছেছে। নালিতাবাড়ি থানার পূর্ব পাশ দিয়ে বাঘাই নদী ভারতের অভ্যন্তর থেকে সােজা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রে এসে মিশেছে। আরও একটি ছােটো নদী বা খাল নালিতাবাড়ি থানার পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে সােজা দক্ষিণ দিকে নকলা থানার অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত। নালিতাবাড়ি থানা সদরের পশ্চিমে খালের উপর তিনআনি ফেরি এবং পূর্ব দিকে বাঘাই নদীর উপর কাটাখালী সেতুর অবস্থান। তিনআনি ফেরি সে সময় ইঞ্জিনচালিত ছিল না। মােটা শক্ত রশির সাহায্যে পন্টুনের উপর হাত দিয়ে হাতল ঘুরিয়ে ফেরি পারাপার করতে হতাে। তিনআনি ফেরি থেকে নালিতাবাড়ির দূরত্ব ৪ কিলােমিটার। নালিতাবাড়ি থানা শেরপুর মহকুমা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলােমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। নালিতাবাড়ি থেকে সােজা ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণে নকলা থানার অবস্থান। পূর্ব দিকে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ও ফুলপুর থানা। উত্তর দিকের সীমান্তে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটের গুরুত্ব ময়মনসিংহ সদর থেকে শেরপুর, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাটসহ বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত অনেক বিওপি’র সাথে সড়কপথে যােগাযােগের জন্য এ তিনআনি ফেরিঘাট ও কাটাখালী সেতুর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তে অবস্থানের কারণে এ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল বাধ্যগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর সীমান্তের অবস্থানগুলােকে দুর্বল করার লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা সীমান্তের অবস্থানের সাথে পাকিস্তান সৈন্যদের সড়কপথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটে পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর কোনাে স্থানীয় অবস্থান ছিল না। এটা ছিল ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকায়। ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ছিল ময়মনসিংহে। হালুয়াঘাটে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যের অবস্থান ছিল। একই সাথে রেঞ্জার্স ও রাজাকার বাহিনীর একটি করে কোম্পানি নিয়ােজিত ছিল। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকেরা রাস্তার চলাচল নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ফেরিঘাট ও সেতু এলাকায় নিয়মিত টহল দিতে এবং প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই সৈনিকেরা। হালুয়াঘাট ক্যাম্পে ফিরে যেত। এ ছাড়া কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরি পাহারা দেয়ার জন্য ১ প্লাটুন রাজাকারের সার্বক্ষণিক অবস্থান ছিল। ফেরিঘাট ও সেতু এলাকার নিরাপত্তা রক্ষা করাই ছিল তাদের প্রধান দায়িত্ব। যুদ্ধের পরিকল্পনা ও বিবরণ জুন মাসে ডালু সাব-সেক্টর অধিনায়কের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দায়িত্ব অর্পিত হয় । ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নাজমুল আহসান গ্রুপ অধিনায়ক হিসেবে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে কাটাখালী সেতু এবং তিনআনি ফেরিঘাট ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
৪ জুলাই কোম্পানি অধিনায়ক নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে ৫৪জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল ডালু অপারেশন ক্যাম্প থেকে নালিতাবাড়ি থানাধীন কাটাখালী সেতু এবং তিনআনি ফেরিঘাট ধ্বংস করার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ দলের সাথে ফেরিবােট ও সেতু ধ্বংসের জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্রসহ ৩০০ প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ যুক্ত করা হয়। বৃষ্টির মধ্যে গাইডের সহায়তায় রাতের অন্ধকারে মুক্তিযােদ্ধা দলটি বড়ামারীর পশ্চিম পাশ দিয়ে রাত ১টায় নালিতাবাড়ির উত্তরে শিমুলতলী গ্রামে হাইড আউট স্থাপন করে। অধিনায়ক নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে এ দলের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল দুটি। একটি কাটাখালী সেতু অপরটি তিনআনি ফেরি। নাজমুল আহসানের নির্দেশে হাইড আউটে দলকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়। মুক্তিযােদ্ধা আবদুল গনির নেতৃত্বে ২৪জনের একটি দলের উপর তিনআনি ফেরিঘাটের ফেরি ধ্বংস করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ দলের সাথে ১৫০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভসহ বিস্ফোরণ ঘটানাের জন্য প্রয়ােজনীয় ডেটনেটর, কর্ডেক্স, সেফটি ফিউজ দেয়া হয় গ্রুপ।
অধিনায়ক নাজমুল আহসান নিজে অপর ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ দলের সাথেও সেতু ধ্বংস করার জন্য প্রয়ােজনীয় এক্সপ্লোসিভ দেয়া হয়। উভয় দল একই সময় কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়। রাত ৩টা নাগাদ উভয় দল নির্দিষ্ট টার্গেটের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। সেতু এলাকায় শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ২জন মুক্তিযােদ্ধাকে সেতুর কাছাকাছি পাঠানাে হয়। এ সময় প্রবল বর্ষণের কারণে রাজাকাররা। নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ত্যাগ করে বাংকারের ভিতরে অবস্থান করছিল। পর্যবেক্ষণ দল ফিরে এসে এ অবস্থা জানানাের সাথে সাথে ত্বরিতগতিতে মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের তাবু আক্রমণ করে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। নিরাপত্তার কারণে রাজাকারদের বেঁধে রেখে তাদের অস্ত্রগুলাে সংগ্রহ। করা হয়। অধিনায়ক নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে একরকম বিনা প্রতিরােধে সেতুটি সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়ার পর নিজের দল নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে। অপর দলের অপেক্ষায় থাকেন। তিনআনি ফেরিঘাটে রাজাকারদের অবস্থান ছিল ঘাট থেকে একটু দূরে। বৃষ্টির কারণে এখানেও রাজাকাররা ঘরের মধ্যে অবস্থান করছিল। আবদুল গনির নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা দলটি সহজেই ফেরিতে এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ফেরিটি ধ্বংস করেন। রাজাকারদের আক্রমণের পূর্বে দলটি নির্দিষ্ট অবস্থানে ফিরে। আসে। শেষ রাত নাগাদ উভয় দল নিরাপদে নির্দিষ্ট স্থানে পুনরায় মিলিত হয়। গ্রুপ অধিনায়ক নাজমুল আহসান দলের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অবস্থান। পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আশ্রয়স্থলে বিপত্তি
পর পর ২টি অপারেশনের পর দিনের বেলায় অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কঠিন হয়ে দাড়ায়। অনেক সাবধানতায় অধিনায়ক নাজমুল আহসান নালিতাবাড়ি থানার অধীন রাঙামাটি গ্রামে জনৈক নঈমুদ্দিনের বাড়িতে দলসহ আশ্রয় গ্রহণ করেন। ৬ জুলাই রাত ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে নঈমুদ্দিনের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধা দলকে ঘিরে ফেলে। সে সময় ক্লান্ত মুক্তিযােদ্ধারা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন। শুধু পাহারার দায়িত্বে নিয়ােজিত দুজন মুক্তিযােদ্ধা সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে, তারা পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। বিষয়টি জানিয়ে দেন। গ্রুপ অধিনায়ক নাজমুল আহসান এগিয়ে দেখেন, উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এগিয়ে আসছে। প্রস্তুতি নেয়ার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে, মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের রাইফেল নিয়ে প্রতিরােধ করতে চেষ্টা চালান। অধিনায়ক নাজমুল পাকিস্তানি বাহিনীর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করে সবাইকে যে করেই হােক অবস্থান ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে জব্বার, আবু সাঈদসহ আরও ২জন আহত এবং ১জন শহিদ হন। নাজমুল এ অবস্থায় অস্থির হয়ে দলকে বিলের মধ্য দিয়ে সাঁতরিয়ে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। দাড়িয়ে নির্দেশ দেয়ার সময় নাজমুল গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েন। নাজমুল হকের উদ্ধারের চেষ্টায় মােফাজ্জল হােসেন আলী হােসেন শক্রর গুলিতে শহিদ হন। অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা আহতদের নিয়ে বিলের পূর্ব পাড়ে আশ্রয় নেন এবং পরবর্তীতে ডালু অপারেশন ক্যাম্পে ফেরত আসেন। কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরি ধ্বংসে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা কাটাখালী সেতু ও তিনআনি ফেরি ধ্বংস অভিযানে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে:
১. নাজমুল আহসান
২. আবদুল হামিদ
৩. আবদুল গনি
৪.আবদুল খালেক
৫. জিয়াউল হক
৬. শহিদুল ইসলাম
৭. রফিজ উদ্দিন
৮, জবেদ আলী
৯. নূরুল ইসলাম
১০. হাসান আলী
১১. ইব্রাহীম আলী
১২. মাসুদ আলী
১৩. হুরুমুজ আলী ফরাজী
১৪. কেরামত আলী
১৫. হাবিবুর রহমান (চানু)
১৬, মােসলেম উদ্দিন।
১৭. হযরত আলী।
১৮. আবদুল কাদের।
১৯. ইছব আলী
২০. আবদুস সালাম
২১. ইউনুছ আলী
২২. মােহাম্মদ আলী আকন্দ
২৩. সুলতান আহম্মদ
২৪. ইব্রাহীম হােসেন প্রমুখ।
মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ
মুক্তিবাহিনীর এটি ছিল একটি সফল অভিযান। পরিকল্পিত এ অভিযানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সাহসিকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হন। কিন্তু ফেরার পথে দিনের আলােয় চলাচল নিরাপদ মনে না করে তারা দূরবর্তী রাঙামাটি গ্রামে বিশ্রাম এবং দিন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনআনি ফেরিঘাটে অবস্থানকারী রাজাকারদের মুক্তিবাহিনী হত্যা না করে রাইফেল নিয়ে ছেড়ে দেয়। এদেরই একজন মুক্তিযােদ্ধাদের প্রত্যাবর্তনকালে পিছু নিয়ে তাদের অবস্থান জেনে নিকটবর্তী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে সংবাদ পৌছে দেয়। মুক্তিবাহিনীর সঠিক অবস্থান জেনে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে তাদের ঘিরে ফেলে এবং আক্রমণ করে। অতর্কিত এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনী অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শত্রুকে ছছাটো ভেবে কিংবা দয়াপরবশ হয়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌছানাের পূর্বেই তাদের চলে যাওয়ার সুযােগ দেওয়া যুদ্ধের ইতিহাসে একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এজন্য মুক্তিযােদ্ধা দলকে চরম মূল্য দিতে হয়।

কালির বাজার আক্রমণ

কালির বাজার ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী একটি গ্রাম্য বাজার। গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ। এ গ্রামটির বর্তমান নাম ফাতেমানগর। এ বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযােগী। দল রাজাকার বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। রাজাকারদের এ ক্যাম্প স্থানীয় জনগণকে হয়রানিসহ মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তােলে। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা অনািয়কের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এ ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মেঘালয়ের ডালু ক্যাম্প থেকে জুন মাসের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর। ১২০জনের একটি দল ময়মনসিংহের উদ্দেশে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গ্রুপ। অধিনায়ক জবেদ আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এ দল হালুয়াঘাট থানার পশ্চিম। অংশ দিয়ে নালিতাবাড়ি হয়ে ময়মনসিংহ শহরের প্রায় ১০ মাইল পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে মুক্তাগাছা থানার কাছাকাছি অবস্থান গ্রহণ করে। অধিনায়ক জবেদ আলীর নির্দেশমতাে কালির বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। অপারেশন অধিনায়কের নির্দেশমতাে গ্রুপ অধিনায়ক মমতাজ উদ্দিন তার দল নিয়ে ত্রিশাল থানার পূর্ব দিক দিয়ে নৌকাযােগে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে মরিচার চর গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন। ২ দিন রেকি করার মাধ্যমে নদী পার হয়ে কালির বাজারের দক্ষিণে রেলপথের কাছাকাছি হাই স্কুলে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্পে চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ জুন মুক্তিবাহিনী তিন দিক দিয়ে এ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। কিন্তু আক্রমণের পূর্বে রেল স্টেশনের টেলিফোন সংযােগ নষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ায় কালির বাজারে আক্রমণের সংবাদ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌছায়। পাকিস্তানি। বাহিনীর একটি দল তুরিতগতিতে রেলযােগে রাজাকারদের সাহায্যে এগিয়ে। আসে এবং মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী আক্রমণ তীব্রতর করলেও পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে অবস্থান পরিবর্তন করে। নিরাপদ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। কালির বাজার আক্রমণে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা কালির বাজার আক্রমণে নিমােক্ত মুক্তিযােদ্ধাগণ অংশগ্রহণ করেন:

১. আবদুস সালাম।

 ২. জবেদ আলী।

৩. রফিকুল ইসলাম
৪, মমতাজ উদ্দিন।
৫. আবদুস সাত্তার
৬, রফিজ উদ্দিন।
৭. শামছুল আলম
৮, জিয়াউল হক।
৯, তােফাজ্জল হােসেন চুন্ন
১০. রবিউল ইসলাম
১১. শামছুল হক
১২. মােজাহার হােসেন
১৩. আবদুল হেকিম
১৪, আয়নাল হক।
১৫. রফিকুল ইসলাম
১৬, জালাল উদ্দিন
১৭. মাহবুব আলম
১৮, আবুল কাশেম।
১৯. লােকমান আসকর
২০. ফজলুল হক
২১. ইদ্রিস আলী
২২. শাহাব উদ্দিন
২৩. ওয়াহেদ আলী
২৪. আবদুল মান্নান।
২৫. আজিজ উদ্দিন
২৬, আবদুল গনি।
২৭. আবদুর রহমান
২৮. হাবিবুল্লাহ ।
২৯, হযরত আলী।
৩০, হাবিবুর রহমান
৩১. মােসলেম উদ্দিন
৩২. ইছব আলী প্রমুখ।
মন্তব্য
কালির বাজার আক্রমণটি ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি সংগঠিত পরিকল্পিত আক্রমণ। এ সময় থেকে মুক্তিবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা জোরদার করে।
সূত্রাপুর সেতু ধ্বংস
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানায় সূত্রাপুর সেতু অবস্থিত। সুলতান ও রঞ্জুর দল গজারিয়া পাড়ার সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওখান থেকে আরও আধমাইল টাঙ্গাইলের দিকে এসে সূত্রাপুর সেতু দখল নেন। এখানে রাজাকাররা সামান্য গুলি ছুঁড়লেও পার্শ্ববর্তী পুলে বিস্ফোরণ ঘটায় তারা এমনিতেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সুরক্ষার চিন্তায় অস্থির ছিল। মুক্তিবাহিনীর খুব বেশি গােলাগুলি ছুড়তে হলাে না । অতি সহজেই ৩০জন রাজাকারকে বন্দি করে মুক্তিবাহিনী সেতুটি দখল করে নেয়। উল্লেখ্য, ২৯ জুন আবদুল গফুর ও খােরশেদ আলমের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযােদ্ধা এ সেতুটিতে সর্বপ্রথম বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সেটাই ছিল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রথম সেতু ধ্বংস। এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন জগন্নাথগঞ্জের বারী মাস্টার ও রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হাজরাবাড়ির আবদুল হাই। সেবার সেতুটি পুরােপুরি ধ্বংস হয়নি। আগের চেয়ে আরও অধিক সুসংহত ও শক্তিশালী মুক্তিযােদ্ধারা এবার সেতুটির চিহ্ন রাখতে চাননি। শত্রুপক্ষের। ব্যাপক আক্রমণের তেমন আশঙ্কা ছিল না। তাই মুক্তিবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি ধীরস্থিরভাবে সেতুতে বিস্ফোরণের ব্যবস্থা করে। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে পুলের দুই দিকে ৫-৬ ফুট খুঁড়ে বিরাট গর্তে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আঘাতে সেতুটি টুকরাে টুকরাে হয়ে ভেঙে নিচে পড়ে যায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড