বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও অস্ত্র সাহায্য দিতে হবে
লােকসভায় দশরথ দেবের দাবি
বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রশ্নে গত ২৫ মে লােকসভায় যে আলােচনা হয় তাতে অংশগ্রহণ করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দলের সহকারী নেতা কমরেড দশরথ দেব যে ভাষণ দেন তা নিম্নে দেওয়া হলাে:
বাংলাদেশে কী ঘটছে তা বিশ্ববাসী জানেন, আমরা সেই সমস্যা সম্পর্কেই আলােচনা করছি। প্রথমত কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করা যায় তা এখান থেকেই স্থির করতে হবে। ভারত সরকার বর্তমানে এ ব্যাপারে কী করছেন তা জনগণ লক্ষ করছেন। গত সংসদ অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থনে সর্বসম্মত প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার এখনাে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানাতে ইতস্তত করছেন এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপন হয়নি। এই দেরি করার ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বরং সরকার এ রকম বিবৃতি দিচ্ছেন যে, ছিন্নমূলরা যাতে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারেন সে পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশগুলাের কাছে ইয়াহিয়া সরকারকে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাপ সৃষ্টি করার আবেদন জানিয়েছেন কিন্তু পাক সৈন্যদের পরাস্ত করা ছাড়া এ রকম কোনাে ব্যবস্থা হতে পারে না। প্রস্তাব পাস করে রাজনৈতিক সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কোনাে সাহায্য হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বপ্রকার প্রয়ােজনীয় সাহায্য না দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত বিবতি অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৩৫ লক্ষ উদ্বাস্তু এসেছেন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ত্রিপুরায় ৯ লক্ষ এসেছেন। এতে ত্রিপুরায় শশাচনীয় সংকট দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এরা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবেন না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে যত দেরি হবে ততােই উদ্বাস্তু আগমন বেড়ে যাবে। তাই আমি অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব রাখছি। এখনাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের বিরাট ক্ষতি সাধন করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি অন্যায় হয়েছে পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বলতে পারতেন যে, সরকার লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে তার প্রতিনিধিকে স্থান দেওয়া হবে না এবং তা এ দেশের জনগণও সমর্থন করেন না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য খুনি সরকারের প্রতিনিধিকে এ দেশে স্থান দেওয়া হলাে; সারা ভারতের জনগণ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন অথচ আমাদের দেশের গণতন্ত্রবাদী সরকার জনগণের এই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন না। কারণ এই সরকারই ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের ভারত ভূখণ্ড ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন।
যে চারটি রাজ্যে শরণার্থীরা এসেছেন তাদের মধ্যে ত্রিপুরার অবস্থা খুবই খারাপ; আমি বিভিন্ন শিবির ঘুরে দেখেছি তারা নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এক সাবরুমে ৫৩,০০০ পুরনাে অধিবাসীর জায়গায় আরাে ২ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন। ইতিমধ্যে নানা প্রকার রােগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের দাম দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এবং ত্রিপুরার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। অবিলম্বে শরণার্থীদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার না নিলে অবস্থা আরাে চরমে উঠবে।
পুনর্বাসন মন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন শরণার্থীদের অন্য কোনাে রাজ্যে পাঠানাে হবে না। কিন্তু আরাে অনেক শরণার্থী আসবেন। ত্রিপুরার মতাে ছােট রাজ্যের পক্ষে এই ভার বহন করা সম্ভব হবে না। তাই অবিলম্বে এই রাজ্যগুলাে থেকে শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে সরাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
যে ইয়াহিয়ার মিলিটারি গুণ্ডা বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে তারা আমাদের দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগরতলার নিকটবর্তী আখাউড়া থেকে শহরের উপর পাক সেনারা তীব্র গােলাবর্ষণ করল যার ফলে ১ জন মারা গেলেন এবং ৪ জন গুরুতর আহত হলেন কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে এখনাে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আমাদের সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে কিছুই করলাে না অথচ ওরা সীমান্তে শান্তির সাদা পতাকা তুললাে। তাদের সাথে শান্তির প্রশ্ন কী? অবশ্য এই গােলা বর্ষণের ব্যাপারে আমাদের সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কী গােপনীয়তা আছে তা আমি জানি না।
যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীরা পাক সৈন্যদের উচ্ছেদ করে সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত করতে পারেন তার জন্য অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে ত ও সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে আমি আবার দাবি জানাচ্ছি।
সূত্র: দেশের ডাক
০৪ জুন, ১৯৭১