ঘাটাইল থানা আক্রমণ
১৮ জুন ২০জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানা আক্রমণ করে। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে থানা আক্রমণের একপর্যায়ে থানায় অবস্থানরত ১৩জন পুলিশ, ২জন এএসআই এবং ১জন এসআই মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনী থানা থেকে ১৮টি রাইফেল, বেশ কিছু গােলাবারুদ ও কিছু টাকা উদ্ধার করে।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন
: ১. আফছার উদ্দিন।
২. জবেদ আলী
৩. সুবেদার জিয়াউল হক
৪, রফিকুল ইসলাম।
৫. জালাল উদ্দিন
৬, মাহবুব আলম
৭. আবুল কাশেম।
৮. লােকমান হােসেন প্রমুখ।
বাশাইল এলাকার যুদ্ধ
টাঙ্গাইল জেলা সদরের পূর্ব-দক্ষিণে বাশাইল থানা সদর। থানা সদরের পশ্চিম ও উত্তর দিকে কামুটিয়া নদী প্রবাহমান। এ নদীর পূর্ব পাড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ছিল। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রায়ই ফাইটিং প্যাট্রল বের হতাে। ১৯ জুন কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এরূপ একটি প্যাট্রল দল বের হয়। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর প্যাট্রল দলটি দেখতে পায়, কামুটিয়া নদীপথে একটি নৌযানে করে বেশ কয়েকজন পুলিশ বাশাইল থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কাদের সিদ্দিকী এ নৌযানের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁরা কামুটিয়া নদীর তীরে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। নৌযানটি তাদের ফায়ারের আওতায় এলে ফায়ার শুরু করেন। উভয় পক্ষে তুমুল গুলিবিনিময় হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সমস্ত বাঙালি পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে বাঙালি পুলিশ আত্মমর্পণ করে। পুলিশের কাছে থাকা সব অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
গােপালপুর থানা আক্রমণ
টাঙ্গাইল জেলার সর্ব-উত্তরে জামালপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে গােপালপুর থানা। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পর্যায়ক্রমে টাঙ্গাইলের সব থানা দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে ১৯ জুন সকাল ৭টায় গােপালপুর থানা দখলের উদ্দেশ্যে মুক্তিযােদ্ধারা গােপালপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ৯টায় গােপালপুর থানার কাছাকাছি পৌছে। দলটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে দ্রুততার সাথে থানা ঘেরাও করে ফেলে। পূর্ব দিকের দলটি প্রথম থানার উপর ফায়ার করে। ফলে পুলিশরা মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা ফায়ার করা শুরু করে। কাদের সিদ্দিকী ২০জনের আরেকটি দল। নিয়ে থানা থেকে মাত্র ৭০-৮০ মিটার দূর থেকে দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ। করে। পুলিশরা ভাবতে পারেনি যে তাদের উপর আরও কোনাে দিক থেকে আক্রমণ হতে পারে। চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছে দেখে পুলিশ দল। হাত তুলে চিৎকার করতে থাকে এবং বলতে থাকে যে, তারা আত্মসমর্পণ। করছে। এক মিনিটের মধ্যে থানার সামনে অস্ত্র ফেলে সব পুলিশ দাড়িয়ে যায়। ৮জন পুলিশ ও ১জন এএসআই যার যার রাইফেল মাটিতে ফেলে উপরে হাত তুলে দাড়ায়। কারও পায়ে জুতাে একটা আছে তাে আরেকটা নেই। কারও পা একেবারে খালি। কেউ লুঙ্গি পরা, আবার কারও গায়ে গেঞ্জি। মুক্তিযােদ্ধারা ত্বরিতগতিতে তাদের ঘিরে ফেলে। গােহাইল বাড়ির কাশেমকে থানা আক্রমণ সফল হওয়ার সংকেত দিতে নির্দেশ দেন অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। কাশেম। ভেরি-লাইট পিস্তল থেকে একটি সবুজ আলাের গুলি ছোড়েন। গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে গােপালপুর শহর সবুজ আলােয় আলােকিত হয়ে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের এ সবুজ আলাে বিজয়ের সংকেত। যুদ্ধক্ষেত্রে নানা রঙের। আলাের কার্টিজ ব্যবহার করা হয়। সাদা, লাল, হলুদ, সবুজ ও গােলাপি – নানা ধরনের আলাে বিভিন্ন সময় নানা অর্থ বহন করে। সংকেতের অর্থ আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখা হয়।
সফলতার সংকেত পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ছুটে আসেন। গ্রেপ্তার হয় সিআই। মমতাজ আলী। এ মমতাজ আলীই বইলানপুরে পুলিশদের অভিযানে নেতৃত্ব দিতে গিয়েছিল। ধুরন্ধর ও ঘুষখাের মমতাজ আলী গােপালপুর থানায় থাকার সংবাদ মুক্তিযােদ্ধারা আগেই সংগ্রহ করেছিলেন। সিআই মমতাজ আলীর ধরা পড়াটা বেশ অভিনব, রীতিমতাে চমকপ্রদ ঘটনা। গােপালপুর থানা ঘেরাও করে প্রথম গুলি ছোড়ার সাথে সাথে চতুর ও ধুরন্ধর মমতাজ আলী বুঝে ফেলে, মুক্তিবাহিনী এসে গেছে। অতএব, ধরা পড়লে উপায় নেই। সে তার ঘর থেকে ছুটে সােজা পায়খানায় গিয়ে পালায়। আত্মসমর্পণকারী পুলিশদের মমতাজ আলী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায়, সে পালিয়েছে। অনেক খোজাখুজি করা হলেও তাকে পাওয়া গেল না। খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ফিরে আসার সময় গােহাইল বাড়ির ১৬-১৭ বছরের আবু হেনা মােস্তফা কামাল বলল, “বিপদ দেখলে আমাগাের অনেকেই পায়খানায় গিয়া পলায়। পায়খানাটা দেইখ্যা যাই।
ক্যান?” এ বলেই তারা কয়েকজন এগিয়ে যায়। পায়খানার দরজা ধরে টান মেরে দেখা গেল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। অনেক টানাটানি হলাে, অথচ কোনাে উত্তর নেই। ভিতরে মানুষ কি ভূত, তা জানা গেল না। ফলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলাে। মুক্তিযােদ্ধারা জোরে জোরে পায়খানার দরজায় কয়েকটা লাথি মারলেন। তবু কোনাে সাড়াশব্দ নেই। আবু হেনা মােস্তফা কামালকে সরে আসতে বললেন দলীয় নেতা মকবুল হােসেন খােকা। খােকা চিৎকার করে বললেন, “অত টানাটানি করার দরকার নেই, গুলি চালাচ্ছি। যে বেটা ভিতরে। আছে, বের হলে হবে, না হলে ওখানেই ভর্তা হয়ে যাবে।” সাথে সাথে উলঙ্গ মমতাজ আলী সুড়সুড় করে পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসে। এ লােকটা যে। সত্যিকার অর্থেই বেশরম আর বেহায়া তার ভুরি ভুরি নজির আছে। বইলানপুর থেকে পালানাের সময় সে সবকিছু ফেলে শুধু একটি জাইঙ্গা পরে সাগরদীঘি হয়ে ত্রিশাল পর্যন্ত দৌড়ে পালায়। আজও সে উলঙ্গ অবস্থায় পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসে। গােপালপুর থানায় বেশি কিছু উদ্ধার হয়নি। এর আগে বাশাইল থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করা হয়। গােপালপুর থানায় ৬টি রাইফেল ও ৬,০০০ গুলি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় নি।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড