You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাশাইল থানা রেইড
টাঙ্গাইল সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পূর্ব পার্শ্বে বাশাইল থানা সদর অবস্থিত। এ থানা সদরের পশ্চিম ও উত্তর দিকে কামুটিয়া নদী। প্রবহমান। কাদের সিদ্দিকী তার সাথীদের সাথে আলাপ-আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁরা এক এক করে টাঙ্গাইলের সব থানা দখল করবেন। এ বিষয়ে তারা বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।  এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১৩ জুন রাতে বাশাইলের শুন্যার কাছে। তারা অবস্থান নেন এবং ১৪ জুন দুপুরে খাবারের পরও মুক্তিযােদ্ধাদের ঘর থেকে বেরােতে নিষেধ করা হয়। কাদের সিদ্দিকীর সাথে ৪০জন এবং আফসার মেম্বারের সাথে ১২৫জন, মােট ১৬৫জন মুক্তিযােদ্ধা এ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। দুপুর ১টার পর মুক্তিযােদ্ধারা তিন দলে ভাগ হয়ে বাশাইল থানা। রেইড করার পরিকল্পনা করেন। সেদিন ছিল বাশাইলের হাটবার। পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব তিন দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা বাশাইল থানা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। পশ্চিম দলের নেতৃত্ব দেন সােহরাব, মােকাদ্দেছ এবং আর,ও, সাহেব। দক্ষিণে অবস্থান নেন ফেরদৌস আলম রঞ্জু ও আবদুস সবুর খান। আর পূর্বের দলকে নেতৃত্ব দেন কাদের সিদ্দিকী। পশ্চিমের দল থানার ১০০ মিটার থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে দক্ষিণে সবুর ও ফেরদৌসের নেতৃত্বাধীন দল বাশাইল থানা উন্নয়ন অফিসকে সামনে রেখে। অবস্থান গ্রহণ করে। তৃতীয় দলটি নিয়ে কাদের সিদ্দিকী থানার পূর্বপার্শ্বে। কয়েকটি পুরােনাে ভাঙা দালানের আড়ালে অবস্থান নেন। কোনাে দলের দূরত্ব থানা থেকে ১০০-১৫০ মিটারের বেশি নয়। থানা ও মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের মাঝে ছােট্ট একটি পুকুর, তাতে অথই পানি। ডানে বাশাইল সাহাপাড়া আর বামে থানা উন্নয়ন অফিস। নির্দেশমতাে সােহরাব, মােকাদ্দেছ ও আর,ও. সাহেবের দল প্রথম আঘাত করবে। প্রয়ােজনে দক্ষিণের সবুর ও ফেরদৌসের দল তাদের সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকে। সিদ্ধান্ত ছিল এ দল ২টি থানায় প্রবেশ করবে না। থানায় ঢােকার দায়িত্ব কাদের সিদ্দিকীর দলের ।
নির্ধারিত সময়ের জন্য রুদ্ধশ্বাসে অস্ত্র উচিয়ে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। দেখতে দেখতে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে দুই মিনিট চলে যায়। কিন্তু অপর দিক থেকে গুলি ছোড়ার কোনাে শব্দ নেই। কাদের সিদ্দিকী ধাঁধায় পড়ে যান। এমন হওয়ার কথা নয়। ১ ঘণ্টাও হয়নি, ঘড়ির সাথে প্রতিটি দলের ২টি করে ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়া হয়। মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে ঘড়ির সাথে এত হেরফের হওয়ার। সম্ভাবনা নেই। কাদের সিদ্দিকী ধারণা করে নেন, হয়তাে পশ্চিমের দল ঠিক সময় যথাস্থানে পৌছাতে পারেনি, কিন্তু তারা নিজেরা নির্ধারিত সময় ঠিকই যথাস্থানে পৌছে গেছে। এমনি নানা চিন্তাভাবনায় প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে যায় । খবর সংগ্রহের জন্য কাদের সিদ্দিকী একজন দূত পাঠাতে যাবেন, এমন সময় নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার ছয় মিনিট পর থানা থেকে চিৎকার ভেসে আসে, তারা উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, থানা দখল করা হয়েছে এবং কাদের সিদ্দিকীকে চলে আসতে বলেন। আর,ও. সাহেব, সােহরাব এবং দলের কয়েকজন পুকুর সাঁতরে কাদের সিদ্দিকীর সামনে এসে হাজির হন। অন্যদিকে, থানার ভিতর থেকে ওসি আরও জোরে চিৎকার করে সারেন্ডারের কথা বলে। কাদের সিদ্দিকী দৌড়ে থানায় যান। তিনি চারদিকে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা একবার ভালাে করে দেখে থানার সামনে মাটিতে বসেন। অধিনায়ক সােহরাব ও মােকাদ্দেছকে অভিনন্দন জানানাে হয়। ১৭জন পুলিশকে হাত বেঁধে থানা প্রাঙ্গণে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আটককৃত সবাই ছিল বাঙালি পুলিশ। তাদের কাছে থাকা অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি হয় নি।
বাশাইল থানা আক্রমণ ও পুনরুদ্ধার
টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী প্রাথমিক পর্যায়ে যুদ্ধের প্রয়ােজনে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহে বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাড়ি আক্রমণ করে। তারই একটি প্রধান যুদ্ধ ছিল বাশাইল থানা পুনরুদ্ধার। বাশাইল থানাটি টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। শত্রুর উপস্থিতি খর্ব করা এবং মুক্তিবাহিনীর প্রভাবকে প্রসারিত করার জন্য বাশাইল থানা দখল করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের আগমনে মুক্তিযােদ্ধারা দখলকৃত থানা থেকে পশ্চাদপসরণ করে। পরবর্তী সময়। মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণের পর সুসংগঠিত হয়ে। বাশাইল থানা পুনরুদ্ধার করেন। বাশাইল থানা কমপ্লেক্স ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের ১৬ কিলােমিটার পূর্বে করটিয়া-সখীপুর রাস্তায় অবস্থিত। থানা কমপ্লেক্সের ৫ কিলােমিটার পশ্চিমে লাঙ্গলী নদী উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় একটি ঘনবসতিপূর্ণ সমতল ভূমি। অসংখ্য পায়ে চলার পথ গ্রামগুলােয় বিস্তৃত। ১৯৭১ সালে এ রাস্তা ভারি যানবাহন চলাচলের উপযােগী ছিল না। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থিত করটিয়া থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি বাশাইল হয়ে সখীপুরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবিরসহ সব কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ছিল সখীপুর। তাই সমগ্র এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে। বাধাগ্রস্ত করাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য।
এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কোম্পানি করটিয়া-সখীপুর রাস্তায় অগ্রসর হয়। আপাত দৃষ্টিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ঐ কোম্পানি বাশাইল এবং তদসংলগ্ন এলাকায় তাদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিকে প্রসারিত করে করটিয়া-সখীপুর রাস্তা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। প্রথমে বাশাইল থানা আক্রমণ করে থানা থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ, সামগ্রিকভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি এবং কর্মকাণ্ডের দ্বারা পাকিস্তানি। সেনাদের উপর মানসিক চাপ প্রয়ােগ করাই ছিল মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য। বাশাইল থানা পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে অত্র এলাকায় টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দ্বারা বাঙালির মনােবল বৃদ্ধি করাই ছিল বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ৪০জন এবং আরও ১২৫জনকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ- এ তিন দিক থেকে ৩টি গ্রুপ থানা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। পশ্চিম দলের অধিনায়ক সােহরাব ও মােকাদ্দেছের নেতৃত্বে থানার ১০০ গজ পশ্চিমে, দক্ষিণের দল অধিনায়ক। ফেরদৌস ও সােহরাবের নেতৃত্বে বাশাইল থানা উন্নয়ন অফিসে এবং পূর্বের দল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ভাঙা দালানের আড়াল করে অবস্থান নেয়। পশ্চিমের দল দ্বারা প্রথমে আঘাত এবং দক্ষিণের সাহায্যকারী দল হিসেবে ছিল। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পূর্বের দল অস্ত্রাগারে আক্রমণ করার দায়িত্বে ছিল। ১৩ জুন বেলা ১টার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিন দল নিজ নিজ অবস্থানে পৌছায়। উপস্থিত রাজাকার মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আগমনে হতবিহ্বল হয়ে থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে কোনাে গুলিবিনিময় ছাড়াই কাদের সিদ্দিকী এবং তার দল থানা দখলে সক্ষম হয়। এর পর থেকেই থানা। মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকে। থানার নিয়ন্ত্রণ রক্ষার্থে নায়েক সােহরাব আলী খানের নেতৃত্বে অপর দল লাঙ্গলী নদীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান নেয়। ১৭ জুন পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কোম্পানি সখীপুর ক্যাম্প ও বাশাইল দখল করার উদ্দেশ্যে করটিয়া-সখীপুর রাস্তায় অগ্রাভিযান শুরু করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানের সংবাদে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আরও ৩০জন লাঙ্গলী নদীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে। নদীর অপর পার্শ্বে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬-৪জনকে দেখামাত্রই মুক্তিযােদ্ধারা গুলি করেন এবং এতে ৩-৪জন গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিক্ষিপ্ত মর্টার গােলাবর্ষণ। আব্দুস সবুরের নেতৃত্বে একটি দল নদীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেয়া। মুক্তিবাহিনীর দলটি ঐদিন পাকিস্তানি বাহিনীর চাপের মুখে পশ্চাদপসরণ করে নাকাসিম-বাশাইল হয়ে সখীপুরে চলে যায়। ১৭ জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে থাকে। ১টি কোম্পানি এবং পরবর্তী সময় আনুমানিক ২টি রাজাকার কোম্পানির সমন্বয়ে পাকিস্তানি বাহিনী থানা উন্নয়ন অফিস কমপ্লেক্সে মেশিনগান নিয়ে একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। ঐ এলাকা থেকে আশপাশের এলাকায় টহল প্রেরণ এবং মুক্তিবাহিনীর চলাচলে বাধা প্রদান করে এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখাই ছিল তাদের মূল কাজ। দুই পর্যায়ে ২টি পৃথক আক্রমণের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা বাশাইল থানা পুনরুদ্ধার করেন।  প্রথম পর্যায়ে আক্রমণে অংশ নেয় ২টি কোম্পানি। প্রথম কোম্পানি অধিনায়ক নায়েক মাে. মােকসেদ আলী এবং দ্বিতীয় কোম্পানি অধিনায়ক ল্যান্স নায়েক মাে. লােকমান হােসেন। ৩ ইঞ্চি মর্টার সন্নিবেশিত সাপাের্ট প্লাটুনের অধিনায়ক ছিলেন খােরশেদ। প্রথম কোম্পানি অবস্থান নেয় থানার উত্তরে বাজারসংলগ্ন এলাকায় এবং দ্বিতীয় কোম্পানি থানার উত্তর-পূর্বে গােবিন্দ পাইলট হাই স্কুলসংলগ্ন এলাকায়। সাপাের্ট প্লাটুন গােবিন্দ পাইলট হাই স্কুল এবং বাজারের মধ্যবর্তী বনী কিশােরী এলাকায় অবস্থান নেয়, যা বাজার।
এলাকার ৫০ গজ পূর্বে অবস্থিত। ১৯-২০ নভেম্বর তারিখ রাতের আক্রমণে মর্টারের অবস্থান থেকে থানা এলাকা সঠিকভাবে দেখা না যাওয়ায় মর্টার নির্ভুল ফায়ার সমর্থন পাওয়া যায়নি। মর্টারের ভুল অবস্থানের কারণে এ আক্রমণ ব্যর্থ হয়। প্রথম পর্যায়ের ব্যর্থতার পর ২টি কোম্পানি একই অবস্থানে থেকে শুধু সাপাের্ট প্ল্যাটুনকে বাশাইল থানার পশ্চিমে আন্দিরপাড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়। কাদের সিদ্দিকী নাকাসিম এলাকায় অবস্থান নিয়ে মূল আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। অপরদিকে, বাথুলিতে প্রতিরক্ষায় অবস্থিত কোম্পানি থেকে ১টি প্লাটুন গােলাম মােস্তফার নেতৃত্বে এ আক্রমণে যােগ দেয় এবং প্রথম কোম্পানি পশ্চিমে পিসুরিতে রিজার্ভ হিসেবে অবস্থান নেয়। ২০-২১ নভেম্বর রাতে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। ২১ তারিখ সকালে মুক্তিযােদ্ধাদের মুহুর্মুহু চাপে পাকিস্তানি বাহিনী বাশাইল থানা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর কোম্পানি লাঙ্গলী নদীর দিকে পশ্চাদপসরণ করে। পাকিস্তানি বাহিনী মনােবলের অভাবের কারণে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পুনঃপুনঃ চাপের মুখে বাশাইল থানা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।  টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী সীমিত অস্ত্র ও জনবল থাকা সত্ত্বেও শুধু প্রচণ্ড মনােবল। দ্বারা বাশাইল থানা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বাসাইলের নিয়ন্ত্রণ হারানােয় মুক্তিবাহিনীর পদচারণ প্রসারিত হয়, যা পরবর্তী সময় সমগ্র টাঙ্গাইল জেলায় মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কামুটিয়ার যুদ্ধ
বাশাইল থানাটি টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে পূর্ব-দক্ষিণে এবং সখীপুর ও মির্জাপুর থানার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ১৭ জুন, সকাল ৮টা। মুক্তিযােদ্ধারা অন্যত্র যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। দু-এক মিনিটের মধ্যেই রওনা হবেন। এমন সময় খবর আসে, টাঙ্গাইল থেকে করটিয়া হয়ে এক দল পাকিস্তানি সৈন্য বাশাইলের দিকে আসছে। খবর পেয়ে কাদের সিদ্দিকী তার কর্মসূচি বাতিল করে ঐ অবস্থাতেই বাশাইল থানার পশ্চিমে কামুটিয়া নদীর দিকে ছুটে যান। কামুটিয়া নদীর পাড়ে পূর্ব থেকেই মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষাব্যুহ ছিল। ৩০জনের একটি দল নিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যে ৩ মাইল অতিক্রম করে নদীর পাড়ে হাজির হন কাদের সিদ্দিকী। সেখানে যারা ছিলেন, তাদের কাছ থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করে সেখানে অবস্থান নেয়া মুক্তিযােদ্ধাদের পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা শক্রর জন্য শিকারির মতাে ওত পেতে বসে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধারা কামুটিয়া নথখােলা খেয়াপারে পশ্চিমমুখী হয়ে দৃঢ় অবস্থান নেন। হাত ট্রিগারে, দৃষ্টি সামনে শক্রর গতিবিধির উপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৬৭জন শত্রু নদীর পাড়ে এসে ডানে-বামে দেখতে থাকে। ঘাটে খেয়া না দেখে তারা ডাকাডাকি করে, “ভাইলােগ । তুম লােগ কাহা হাে । হামলােগ দুশমন নেহি। দোস্ত হু, কিস্তি লে আও।” এ সময় আরও ১০-১৫জন এগিয়ে আসে। মাত্র ৬০-৭০ মিটার দূরে অপর পাড়ে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ১৭জন পাকিস্তানির উপর মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিতে গুলি ছোঁড়া শুরু করেন। প্রথম ঝাঁক গুলিতেই ৪জন বিশালদেহী শত্রু গড়িয়ে নদীতে পড়ে যায়। ৩জন নদীর পাড়াে উচু বাঁধের উপর পড়ে থাকে।
তাদের কোনাে সাড়াশব্দ নেই, নড়াচড়াও নেই। বােঝা যায়, দেহে প্রাণ নেই। তবু আরও কয়েক রাউন্ড গুলি চালানাে হয়। এবার শত্রুপক্ষ থেকে পাল্টা গুলি শুরু হয়। শত্রুর মেশিনগান দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে বৃষ্টির মতাে অবিশ্রান্ত গুলি ছুঁড়ে চলে। ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং রকেট লঞ্চার থেকে গােলা নিক্ষেপের বিরাম নেই। গােলাতে চারদিক প্রকম্পিত করে। গগনবিদারী আওয়াজ হয়। পাকিস্তানিরা প্রায় আধ ঘণ্টা অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে কোনাে উত্তর না পেয়ে ভাবে, মুক্তিযােদ্ধারা ভয়ে পালিয়েছে অথবা মারা গেছে। তাই খুশি মনে আবার আস্তে আস্তে ২-১জন করে বাঁধের কাছে এগিয়ে আসে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধা মালেকের গুলি তাদের একজনের বক্ষ ভেদ করে যাওয়ায় সে উল্টে নদীতে পড়ে যায়। এ রকম একটা হতাশাজনক বিভ্রান্তিকর অবস্থার মুখে শক্র সাহস ও শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য চিৎকার করে স্লোগান তােলে: ‘ইয়া আলী, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মুক্তিযােদ্ধারাও ততােধিক জোরে চিৎকার করে আকাশবাতাস মাটি কাপিয়ে মুহূর্তেই স্লোগান তােলেন, ‘ইয়া আলী’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় মুক্তিবাহিনী’। গ্রামবাসীও মুক্তিযােদ্ধাদের বুকে হিম্মত বাড়ানাের উদ্দেশ্যে স্লোগানে যােগ দেয়। তাদের সে কি আনন্দ! কি উল্লাস! মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীর তখনকার মিলিত অনুভূতি প্রকাশ করা রীতিমতাে কঠিন ব্যাপার। মুক্তিযােদ্ধাদের স্লোগান শুনে শত্ৰু চিল্কার করে ওঠে, “শালা কাফের লােগ। শালা লােগ ইয়া আলী ভি বােলতা হ্যায়, জয় বাংলা ভি বােলতা হ্যায়। শালা লােগ এ কিয়া চিজ হ্যায়।”
এ সময় কাদের সিদ্দিকী একটি অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেন। মােটামুটি জোরে জোরে ওয়্যারলেসে ম্যাসেজ পাঠানাের মতাে কোম্পানিগুলােকে ডান ও বামে শক্র ঘিরে ফেলতে ম্যাসেজ পাঠাতে থাকেন। যখন ডানের কোম্পানিকে এগিয়ে যেতে বলা হয়, তখন শত্রুর বন্দুকের নলও ডান দিকে ঘুরে যায়। আবার বাম দিকে মুক্তিযােদ্ধাদের সরে যেতে বললে শত্রুর বন্দুকের নলও সে দিকে ঘােরে। এ যুদ্ধে আবদুস সবুর নদীর পাড়ে প্রায় আধা মাইলব্যাপী একবার ডানে, একবার বামে দৌড়াদৌড়ি করে প্রায় তিন ঘণ্টা গুলি চালান। এ আধমাইল এলাকাজুড়েই মুক্তিবাহিনী অবস্থান নিয়েছে, শত্রুকে এটা বুঝিয়ে দেয়াই ছিল সবুরের উদ্দেশ্য। এ কাজে সবুর পুরােমাত্রায় সফল হন। তিনি দুই শত্রুকে গুলি করে বালুচরে ফেলে রেখেছেন। এমন জায়গায় ২জন পাকিস্তানির পড়ে আছে, যেখান থেকে তাদের উদ্ধার করা শত্রুর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ তখন মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে। ৬-৭জন সহযােদ্ধা নিয়ে অনেকটা উত্তরে গিয়ে নদীর পাড়ে যান কাদের সিদ্দিকী। নদী পার হওয়ার ঘটনাও অভিনব। পানিতে ডুবিয়ে রাখা ১০-১২ হাত লম্বা একটি ডিঙি নৌকা কয়েকজন যুবক ডাঙায় তুলে কাত করে পানি ফেলে দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন। নৌকা ডাঙায় তােলা ও নদীতে ভাসানাের কাজে যুবকদের অত্যন্ত কম সময় লাগে। যুবকেরা যােদ্ধাদের দুই মিনিটে নদী পার করে দেন। আব্দুস সবুর, সামসু, সাইদুর ও ছানােয়ারকে নিয়ে উধ্বশ্বাসে কিছুটা পশ্চিমে এগিয়ে দক্ষিণ দিকে ছােটেন কাদের সিদ্দিকী।
শত্রু অবস্থানের ৩০০ মিটারের মধ্যে গিয়ে গুলি। ছোড়েন। কিন্তু এ কি! কোনাে উত্তর নেই। কোনাে সাড়াশব্দ নেই। দূরবিন দিয়ে খুব ভালােভাবে দেখতে চেষ্টা করা হয়। দেখা যায়, পাকিস্তানিরা অনেক দূর পিছিয়ে গেছে। তাদের সর্বশেষ সদস্যটি বাংড়া পর্যন্ত চলে গেছে। শত চেষ্টা করেও পালিয়ে যাওয়া শত্রুর ৩০০ মিটারের বেশি কাছে যেতে পারেননি মুক্তিযােদ্ধারা। ৩০০ মিটার দূর থেকেই এক ঝাঁক গুলি ছোড়া হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলির জবাবে তারা একটা গুলি না ছুঁড়ে কামুটিয়ায় এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে হুড়মুড় করে বাসে-ট্রাকে উঠে টাঙ্গাইলের দিকে চলে যায়। মােকাদ্দেছ, রঞ্জু, মালেক ও সােহরাব করটিয়ার সাবেক জমিদারদের বাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে কয়েকটি ২ ইঞ্চি মর্টারের গােলা ছোড়েন। কাদের সিদ্দিকী তাড়াতাড়ি লােক পাঠিয়ে তাদের গােলাগুলি ছুঁড়তে নিষেধ করেন। শত্রু পালিয়ে যাওয়ার পর গােলাগুলি ছোঁড়ার কোনাে মানে হয় না। বরঞ্চ ক্ষতি হতে পারে। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাক, তা মুক্তিযােদ্ধাদের কোনােক্রমেই কাম্য হতে পারে না। তিনবার একইভাবে আক্রমণের মুখে পড়ে শত্রু ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। তাদের মনােবল যেমন কিছুটা ভেঙে যায়, ঠিক তেমনি মুক্তিবাহিনীর মনােবল অনেকটা বেড়ে যায়। এ যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি হতাহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তেমন কোনাে ক্ষতি হয় নি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!