You dont have javascript enabled! Please enable it!
খাগডহরের যুদ্ধ
খাগডহরের অবস্থান ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ৫ কিলােমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে খাগডহর গ্রামটি অবস্থিত। এখানে ইপিআর উইং সদর দপ্তরের অবস্থান। এ উইং সদর দপ্তরের উত্তর দিকে ময়মনসিংহ-জামালপুর রেললাইন ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। এ নদ উত্তর দিকে রেললাইন বরাবর প্রবাহিত হয়ে জামালপুর থেকে দুই ভাগ হয়ে একটি বাহাদুরাবাদ ঘাট এবং অপরটি জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের কাছে যমুনা নদীতে মিলিত হয়েছে। খাগডহর যুদ্ধের পটভূমি। ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকায় ছিল ইপিআর উইং সদর দপ্তর। এ সময় ইপিআর-এর সদস্যদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালির মিশ্রণ ছিল। ২৫ মার্চ ময়মনসিংহ উইং সদর দপ্তরে কমান্ড স্তরে অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের প্রাধান্য ছিল। উইং অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস সম্ভাব্য গােলযােগের আভাসে সীমান্ত থেকে সমস্ত অবাঙালি সদস্যকে উইং সদর দপ্তরে নিয়ােজিত করেন। একই সঙ্গে বাঙালি সদস্যদের কার্যকলাপের উপর নজর রাখার নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ রাতেই ময়মনসিংহের ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা ঢাকার সংবাদ অবহিত হয়ে নিজেদের মধ্যে করণীয় বিষয়ে আলােচনার চেষ্টা চালান। অবাঙালি সহকর্মীদের আড়ালে আলাপ করা তাদের জন্য দুরূহ থাকায় কয়েকজন সদস্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যােগাযােগ করেন। ২৬ মার্চ উইং অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস কৌশলে সমস্ত বাঙালি ইপিআর সদস্যকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালান। তিনি অস্ত্রাগারের দায়িত্ব অবাঙালি ইপিআর সদস্যের কাছে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেন। এ সময় নানা অজুহাতে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্তব্যপালন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়টি সব বাঙালি সদস্যদের সন্দিহান করে তােলে। 
২৬ মার্চ রাতে বাঙালি ওয়্যারলেস অপারেটর ফরহাদ উইং অধিনায়কের এক নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত হন। এ নির্দেশে বলা হয়েছিল যে, ২৭ মার্চ রাতে বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করা হবে, এমনকি প্রয়ােজনে তাদের হত্যা করা হবে। পাকিস্তানি উইং অধিনায়কের এ নির্দেশ জানতে পেরে ওয়্যারলেস অপারেটর ফরহাদ বিষয়টি সুবেদার ফরিদ উদ্দিনসহ অন্যান্য ইপিআর সদস্যকে জানিয়ে দেন। এর ফলে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা কোনাে অবস্থায় অস্ত্র ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেনএবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি মােকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খাগডহরের গুরুত্ব
ময়মনসিংহ শহর এবং জেলার অন্যান্য স্থানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে অসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করার ভার অনেকাংশে খাগডহর ইপিআর উইং সদর দপ্তরের উপর ন্যস্ত ছিল। ঢাকা থেকে সমস্ত দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের সাথে রেল যােগাযােগ ময়মনসিংহের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার বিষয়টিও জড়িত ছিল বলে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ময়মনসিংহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের অনুকূলে রাখা মুক্তিযােদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনী উভয়ের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানি বাহিনীর পরিকল্পনা
খাগডহর ২ নম্বর ইপিআর উইং-এর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস (অবাঙালি), মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় উইং-এ কর্মরত সব বাঙালি জেসিওকে কৌশলে সীমান্তের ফাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে অবাঙালি জেসিও, এনসিওদের উইং সদর দপ্তরে জমায়েত করেন। একমাত্র বাঙালি সুবেদার ফরিদ উদ্দিন এবং কয়েকজন এনসিও ২৫ মার্চ উইং সদর দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। ২৫ মার্চ খাগডহর ক্যাম্পে আনুমানিক ১৩৮জন অবাঙালি এবং ২২০জন বাঙালি ইপিআর সৈনিক কর্মরত ছিল। একই সময় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনে আগত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি সৈনিক (‘সি’ কোম্পানি) এ ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। কোম্পানির অধিনায়ক। ছিলেন মেজর নূরুল ইসলাম শিশু (বাঙালি) এবং তাঁর সাথে অপর অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান (বাঙালি)। উভয় অফিসার ময়মনসিংহ সিঅ্যান্ডবি ডাকবাংলােয় অবস্থান করতেন। মেজর নূরুল ইসলাম শিশু সে সময় একইসাথে উপ-আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আন্দোলনরত স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের সাথে যােগাযােগ মার্চের অসহযােগ আন্দোলনের সময় খাগডহরে অবস্থিত ইপিআর বাঙালি সদস্যদের সাথে সংগ্রামী ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের যােগাযােগ স্থাপিত হয়। বিশেষ করে ছাত্র-যুবক নেতারা অস্ত্র ও যুদ্ধের প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য ইপিআর সদস্যদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরােধ সংগ্রাম শুরু করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল থেকে হাজার হাজার জনতা খাগডহরের ইপিআর উইং সদর দপ্তরের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, দা, কুড়াল, তীর, ধনুক প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্র। ২৭ মার্চ মধ্যরাতের পর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বাঙালি ইপিআর সদস্য ছিল। প্রায় ২২০জন এবং সাথে কয়েক হাজার নিরস্ত্র জনতা। এ সময় সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল ময়মনসিংহের সংগ্রামী জনতা। মূলত এখান থেকেই শুরু হয় ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কার্যক্রম ২৭ মার্চ সকালে ছাত্রনেতা ম. হামিদের নেতৃত্বে একদল যুবক ইপিআর ক্যাম্পে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশি পতাকা উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত নেন। ম. হামিদ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে উইং অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাসের সাথে কথা বলেন এবং পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশি পতাকা উত্তোলনের দাবি জানান। উইং অধিনায়ক বিষয়টি কোনােভাবে মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় উভয়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত ২য় ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি অফিসার মেজর নূরুল ইসলাম শিশু বিষয়টি অনুধাবন করে ম. হামিদকে শান্ত এবং ধৈর্যধারণের কথা বলে বুঝিয়ে ফেরত পাঠান। এ ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবাঙালি অফিসারদের কাছে স্থানীয় বাঙালিদের মনােভাব প্রকাশিত হয়।
২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস বাঙালি সুবেদার ফরিদ উদ্দিনকে তার অফিসে বিশ্রামে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর উইং অধিনায়কের অফিস থেকে বেরিয়ে সুবেদার ফরিদ উদ্দিন ইপিআর-এর অবাঙালি সৈনিকদের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রশস্ত্র বের করে ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাসের বাসায় নিয়ে যেতে দেখেন। উইং অধিনায়কের নির্দেশ এবং অস্ত্র স্থানান্তরের বিষয়টি তার চিন্তায় নতুন মাত্রা যােগ করে। অল্প সময়ের মধ্যে সুবেদার ফরিদ উদ্দিন তার সহকর্মীদের কাছে উইং অধিনায়কের মনােভাব এবং তার বাসায় অস্ত্র নেয়ার বিষয়টি অবহিত করেন। এ আলােচনায় উপস্থিত বাঙালি হাবিলদার সিরাজ, আরিফ আহম্মদ, আবদুল হাকিম- সবাই একমত হয়ে নিজেদের ব্যবহৃত অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস বাঙালি সৈনিকদের মনােভাবের বিষয়টি অনুধাবন করে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালনরত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি মেজর নূরুল ইসলাম শিশুকে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে তাদের শান্ত করার অনুরােধ জানান। এ সময় মেজর নূরুল ইসলাম শিশু সব সৈনিককে শান্ত থাকতে এবং ধৈর্যধারণ করতে বলেন। একই দিনে ইপিআর-এর অবাঙালি হাবিলদার আজিম আকস্মিকভাবে অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত বাঙালি সিপাহি আফতাব, নানু ও ইদ্রিসকে এলএমজি জমা দিতে নির্দেশ দেন। বাঙালি সৈনিকেরা তার নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এলএমজি নিয়ে ডিউটিতে থাকেন। এর পাশাপাশি ২জন অবাঙালি হাবিলদার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে টহল দিতে থাকে এবং তারা কয়েক দফা আফতাব ও নানুকে ব্যারাকে ফিরে বিশ্রাম করতে বলে। কিন্তু সৈনিকদ্বয় তাদের কথায় কর্ণপাত না করে যথারীতি প্রহরায় নিযুক্ত থাকেন।
সন্ধ্যার পর ইপিআর-এর ২জন বাঙালি সদস্য ওয়্যারলেস অপারেটর রেজা ও জগলুল শাহ ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী খাগডহর বাজারে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত স্থানীয় নেতাদের কয়েকজনের সাথে অবাঙালি ইপিআরদের আক্রমণের বিষয় নিয়ে আলােচনা করেন। আলােচনায় খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত অবাঙালি সদস্যদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আলােচনায় ছাত্র-জনতার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ম. হামিদ, শফিউল ইসলাম, মঈনুদ্দিন প্রমুখ। এ আলােচনায় সিদ্ধান্ত। হয় যে, ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ম, হামিদ, শফিউল ইসলাম প্রমুখ যুদ্ধের। নেতৃত্ব প্রদান করবেন। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, আক্রমণের সংকেত হিসেবে রাত ১১টায় ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী অবস্থানে পৌছে পাকিস্তানের অবস্থান লক্ষ্য করে ২ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হবে। তার পূর্বে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। পরিকল্পনা মােতাবেক রাত ১০টায় ছাত্রনেতা ম, হামিদ, শফিউল ইসলাম, মঈনুদ্দিন, সােলায়মান ও ড্রাইভার হায়দার আলী ভেটেরিনারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সামনে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন। রাত। ১১টায় ম. হামিদ ও শফিউল ইসলাম দেশি বন্দুক থেকে ইপিআর ক্যাম্পের প্রতি ২ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। একইসাথে ক্যাম্পের চারপাশে অবস্থানকারী। জনতা গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করে তােলে। খাগডহর ক্যাম্পে অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা জনতা ও ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ভেবে সাথে সাথে বাঙালি। ইপিআরদের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। সিপাহি আফতাব, নানু, হারুন, এলএমজি নিয়ে তীব্র গুলিবর্ষণ।
করতে থাকেন। সিপাহি মােস্তফা আরও একটি এলএমজি নিয়ে মূল ভবনের সিড়ির মুখে পাহারায় থাকেন, যাতে ভবনের দোতলা ও তিনতলা থেকে কোনাে অবাঙালি নিচে নামতে না পারে। নান্ন ও আফতাব এলএমজি’র সাহায্যে একটানা গুলি ছুড়তে থাকেন যাতে শত্রু সৈন্যরা কোনােভাবে আর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যবহার করতে না পারে। ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যরা যার কাছে যে অস্ত্র ছিল, তা-ই নিয়ে অবাঙালিদের উপর আক্রমণ চালান। এ সময় জনতার একটি অংশ ইপিআর ক্যাম্পের ভিতর ঢুকে পড়ে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা। অস্ত্রাগারের জানালা ভেঙে ভিতর থেকে অস্ত্র নিয়ে জনতার মধ্যে বণ্টন করতে থাকেন। ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েব। সুবেদার বড়ুয়া, নায়েব সুবেদার মােশাররফ হােসেন ও সুলতান উদ্দিন তাদের। সৈন্যদের নিয়ে ইপিআর সদস্যদের সাথে একত্র হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতাে জনতা অগ্রসর হয়ে বাঙালি ইপিআরদের পাশে এসে দাড়ায় এবং তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। সারারাত উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে।
২৮ মার্চ ভােরে ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস তার বাংলাে থেকে ১০১২জন অবাঙালি ইপিআরসহ উইং সদর দপ্তরে রি-ইনফোর্সমেন্টের চেষ্টা চালায়। সিপাহি হারুন, নানু, আফতাবসহ কয়েকজন ৩টি এসএমজিসহ উইং সদর দপ্তরের অদূরে রেললাইনের উপর তাদের প্রতিহত করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাসসহ সব অবাঙালি সৈনিক নিহত হয়। এদিন সকালে আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা সামছুল হক, জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান আবুল হাশেম, ছাত্রনেতা ম, হামিদ, মাহমুদ, পুলিশ লাইন স্কুলশিক্ষক সামছুল আলম প্রমুখ জেলখানা ও পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সাথে যােগদান করেন। কিছু পুলিশ সদস্যও ইপিআর সদস্যদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়। ডাকবাংলােয় অবস্থানরত মেজর নূরুল ইসলাম শিশু ও লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন ভেবে ব্রহ্মপুত্রের বিপরীত তীরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
যুদ্ধের ফলাফল
২৭ মার্চ রাত ১১টা থেকে ২৮ মার্চ সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে প্রায় ১২১জন অবাঙালি ইপিআর সদস্য নিহত হয়। সুবেদার মেজর জিন্নাত গুলসহ ১৭জন অবাঙালি সদস্যকে আটক করে জেলখানায় রাখা হয়। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ময়মনসিংহ শহর মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানি বিমান হামলার আশঙ্কায় সুবেদার ফরিদ উদ্দিন সকল সৈনিককে সাথে নিয়ে তৎকালীন রাবেয়া গার্লস স্কুলে (বর্তমানে মহিলা ক্যাডেট কলেজ) এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অবস্থান গ্রহণ করে। খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প থেকে ৩৫০০টি রাইফেল, ৪০টি এলএমজি, ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার উদ্ধার করা হয়। সীমান্তবর্তী নকশী বিওপিতে অবস্থানকারী সুবেদার হাকিম, কড়ইতলীতে অবস্থানকারী সুবেদার জিয়াউল হক এবং লেংগুড়া বিওপিতে অবস্থানরত সুবেদার আজিজুল হক অস্ত্র, গােলাবারুদ ও সৈন্যদের নিয়ে ময়মনসিংহে যােগদান করেন। ফলে ময়মনসিংহে ইপিআর বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের বিভিন্ন যুদ্ধে এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাগডহর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা খাগডহর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা নিমে উল্লেখ করা হলাে: ১. ওয়্যারলেস অপারেটর ফরহাদ ২. সুবেদার ফরিদ উদ্দিন। ৩. ছাত্রনেতা ম. হামিদ ৪. হাবিলদার সিরাজ ৫. ইপিআর সদস্য আরিফ আহম্মেদ
৬. ইপিআর সদস্য আবদুল হাকিম
৭. ইপিআর সদস্য আফতাব আহম্মেদ
৮, ইপিআর সদস্য নানু মিয়া।
৯. ইপিআর সদস্য মােহাম্মদ ইদ্রিস
১০. ওয়্যারলেস অপারেটর মােহাম্মদ রেজা
১১. ইপিআর সদস্য জগলুল শাহ।
১২. শফিউল ইসলাম
১৩. মঈনুদ্দিন আহম্মেদ
১৪, মাে. সােলায়মান
১৫, ড্রাইভার হায়দার আলী
১৬. ইপিআর সদস্য হারুন-অর-রশিদ।
১৭. ইপিআর সদস্য গােলাম মােস্তফা।
১৮, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েব সুবেদার বড়ুয়া
১৯. নায়েব সুবেদার মােশাররফ হােসেন।
২০. নায়েব সুবেদার সুলতান উদ্দিন
২১. আবুল হাশেম।
২২. স্কুলশিক্ষক শামসুল আলম
২৩. ইপিআর সুবেদার জিয়াউল হক
২৪. ইপিআর সুবেদার আজিজুল হক
২৫. আবদুল কুদ্ছ।
২৬. রফিকুল ইসলাম
২৭. আব্দুস সাত্তার।
২৮, শাহাব উদ্দিন
২৯. মকবুল হােসেন।
৩০. আনিসুজ্জামান
৩১. হাফিজ খান।
৩২. মমতাজ উদ্দিন।
৩৩. আবদুল খালেক
৩৪, আবদুল জব্বার
৩৫. তােতা মিয়া
৩৬. সেলিম সরদার।
৩৭. আলাউদ্দিন
৩৮. নূরুল ইসলাম
৩৯, আশরাফ আলী
৪০. মােশাররফ আলী খান
৪১. এমদাদুল হক
৪২. আক্কাস আলী
৪৩. আব্দুর রশিদ
৪৪. আবদুল মান্নান
৪৫, আবদুল করিম
৪৬, বাবু মান্নান।
৪৭. আবুল কালাম
৪৮. লালু মিয়া।
৪৯. চান মিয়া
৫০. আলাউদ্দিন
৫১. নূরুল ইসলাম
৫২. আশরাফ আলী
৫৩. সেলিম সরদার
৫৪, আকমল আলী
৫৫. জবেদ আলী।
৫৬. মমতাজ উদ্দিন।
৫৭, শহিদ আহম্মদ
৫৮, আবদুল করিম
৫৯. আশরাফ আলী খান প্রমুখ।
খাগডহরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহিদ মুক্তিযােদ্ধা নিমে খাগডহর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা দেওয়া হলাে:
১. আনােয়ার হােসেন।
২. এমদাদুল হক
৩, আবু তাহের
৪. অজিত দত্ত 
৫. আবদুর রাজ্জাক
৬. দেলােয়ার হােসেন প্রমুখ। উপসংহার খাগডহরের যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে সংঘটিত যুদ্ধগুলাের মধ্যে অন্যতম। এ যুদ্ধে বিজয় অর্জন বাঙালি সশস্ত্র সৈনিকদের মনােবল বাড়িয়ে দেয়। একইসাথে এ সশস্ত্র বিদ্রোহের বিজয় বাঙালি সৈনিকদের সাথে। জনগণের একসাথে অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!