কালিহাতি সেতুর যুদ্ধ
কালিহাতির অবস্থান টাঙ্গাইল জেলার টাঙ্গাইল-মধুপুর প্রধান সড়কের টাঙ্গাইল থেকে উত্তর দিকে ১২ কিলােমিটার দূরত্বে কালিহাতির অবস্থান। কালিহাতি থেকে ৮ কিলােমিটার উত্তরে ঘাটাইল এবং ২০ কিলােমিটার উত্তরে মধুপুর অবস্থিত। কালিহাতির পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে বাংড়া, নারান্দীয়া, এলেঙ্গা, সাহাদেবপুর, মাগরা, দীঘলকান্দি নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গের সাথে সড়কপথে যানবাহন যাতায়াতের জন্য এটিই ছিল প্রধান সড়ক। এ সড়ক সংযুক্ত ছিল ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী রেলপথের সাথে। এ রেলপথেই জগন্নাথগঞ্জ ও বাহাদুরাবাদ ঘাট ফেরিপথে পারাপারের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে যােগাযোেগ রক্ষিত হতাে। সুতরাং সামগ্রিক বিবেচনায় যুদ্ধ চলাকালে টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, উত্তরবঙ্গের সাথে যােগাযােগ ও সরবরাহ পথ অব্যাহত রাখার জন্য এ সড়কের উপর দখল রাখা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে, প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রস্তুতিতে এ পথে বাধা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গতি রােধ করার বিষয়টি মুক্তিবাহিনীর জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঝেনাই নদীর উপর কালিহাতি সেতু পাকিস্তানি বাহিনীর এ যােগাযােগ ব্যবস্থায় বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি উল্লেখযােগ্য স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
অসহযােগ আন্দোলনের সময় টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ শহরে পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল। এ রেজিমেন্টের সদর। দপ্তর ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। ঢাকা ব্রিগেডের অধীনস্থ বাঙালি এ রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। করে। যার ফলে ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্য কোনাে সৈন্যদল না থাকায় এলাকার নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুনভাবে সৈন্য মােতায়েনের প্রয়ােজন দেখা দেয়। ঢাকা ব্রিগেডের অধীনস্থ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টকে এ এলাকায় অবস্থান নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট প্রথমে টাঙ্গাইল এবং পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহে অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তরে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে ঢাকাসহ সারা দেশে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, ইপিআর ও পুলিশ। সদস্যরা জনগণের সাথে একত্র হয়ে আঞ্চলিকভাবে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলে। এ সময় ময়মনসিংহে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীর ২নং উইং সদর দপ্তর সুবেদার এ কে এম ফরিদ উদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ২৯ মার্চ ময়নসিংহে অবস্থানরত ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক মেজর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাথে ময়মনসিংহ উইং-এর সব ইপিআর সদস্য একত্র হয়। মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা এলাকাভিত্তিক প্রতিরােধ যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার জিয়াউল হককে মুক্তাগাছার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য, সুবেদার আবদুল হাকিমকে জামালপুর, সুবেদার আজিজুল হককে। নেত্রকোনা এলাকায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য পাঠানাে হয়। একইসাথে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা বাড়ানাের বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে দেশের বিভিন্ন কর্মস্থান থেকে পালিয়ে আসা এবং অবসরপ্রাপ্ত আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ সদস্যরা এসে প্রতিরােধ যুদ্ধে যােগদান করতে থাকে। ছাত্র-যুবকদেরও একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কৌশলগত কারণে ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করার পর অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে অনেকটা অসংগঠিতভাবে এ এলাকার বিভিন্ন স্থানে ইপিআর কোম্পানি ও জনগণের সাথে প্রতিরােধ লড়াইয়ের জন্য অবস্থান এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ পর্যায়ে স্থানীয় নেতাদের সাথে প্রতিরােধ যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন ইপিআর সুবেদার এ কে এম ফরিদ উদ্দিন।
যুদ্ধের পরিকল্পনা
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি সৈন্যদল ঢাকা থেকে জয়দেবপুর হয়ে টাঙ্গাইল শহরে পৌছানাের লক্ষ্যে যাত্রা করে। পথে একাধিক ব্যারিকেড পার হওয়ার কারণে দলটি ঠিকমতাে চলার গতি রাখতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ৮ এপ্রিল কালিহাতি সেতুর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের প্রচেষ্টায় যথাসম্ভব প্রস্তুতি গ্রহণ। করে। সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের ইতিহাসে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রথম যুদ্ধ হচ্ছে কালিহাতি সেতুর
যুদ্ধের বিবরণ
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের জননেতা লতিফ সিদ্দিকী বিভিন্ন যুদ্ধে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছিয়ে আসা ইপিআর সদস্যদের একত্র করে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মােকাবিলা করার জন্য এগিয়ে আসেন। এ সময় ইপিআর সৈন্যদলের নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার জিয়াউল হক। দলের মূল লক্ষ্য ছিল কালিহাতি সেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি সৈন্যদলের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা। প্রাথমিক অবস্থায় হাতুড়ি, শাবল দিয়ে সেতুটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেও তা সম্ভব না হওয়ায় ভারত থেকে ডিনামাইট বা বিস্ফোরক জোগাড়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিস্ফোরক পৌছানাের পূর্বেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেতুর পাশে দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলে। সেতুর অপর পাড়ের কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনীর জোরালাে অবস্থান থাকায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে পুনরায় সেতু ধ্বংস করার চেষ্টা চালানাে সম্ভব হয়নি। এ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী রাস্তার উভয় পার্শ্বে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চেষ্টা করে। একই দিন দুপুরের পর পাকিস্তানি বাহিনী সেতু অতিক্রম করে সামনের দিকে অগ্রসরের চেষ্টা চালালে মুক্তিবাহিনী রকেট লঞ্চার ও এলএমজি’র সাহায্যে আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে কয়েক ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। এ আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈনিক ও ১জন অফিসার নিহত হয় এবং তাদের ৪-৫টি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ উপেক্ষা করে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক গােলাগুলির মাধ্যমে তাদের অগ্রাভিযান যথারীতি অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালালে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এলাকা ত্যাগে বাধ্য হন। কালিহাতির এ যুদ্ধে ১১জন বীর মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। ৭-৮জন আহত হয়ে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন। ইপিআর সুবেদার জিয়াউল হক তার অধীনস্থ সৈনিকদের নিয়ে এ সময় এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় অবস্থান গ্রহণ করেন। কালিহাতি সেতুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা নিমে কালিহাতি সেতুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা উল্লেখ করা হলাে :
১. ইপিআর সুবেদার এ কে এম ফরিদ উদ্দিন ২. ইপিআর সুবেদার জিয়াউল হক ৩. ইপিআর নায়েব সুবেদার আবদুল আজিজ ৪. সুবেদার এম এ রহিম, ৫. আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ৬. জাহেদ আলী ৭. নূরুল ইসলাম ৮, হাসান আলী
৯. এফাজ উদ্দিন
১০. ইব্রাহিম।
১১. আমির আলী।
১২. লুত্যর রহমান
১৩. হুমায়ূন কবীর
১৪. মনছুর আলী।
১৫. নূরুল ইসলাম
১৬. ইউনুছ আলী।
১৭. আব্দুল মজিদ
১৮. নাজিম উদ্দিন
১৯. সুরুজ আলী।
২০. মােশাররফ হােসেন
২১. এস এম বদরুল আলম ফারুক।
২২. এস এম জিয়াউল হুদা।
২৩. নূরুল ইসলাম
২৪. দুলাল মিয়া
২৫. আবুল বাশার
২৬. জামাল উদ্দিন
২৭. রমিজ উদ্দিন
২৮. ইস্তাজ আলী
২৯. গনু সিকদার।
৩০. আক্কাছ মিয়া প্রমুখ। সামগ্রিক মূল্যায়ন কালিহাতির যুদ্ধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রাথমিক প্রতিরােধ যুদ্ধ। কর্মস্থান ত্যাগ করে আসা ইপিআর পুলিশ, ছাত্র, যুবকেরা প্রায় বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীকে মােকাবিলা করেন। কালিহাতি সেতুর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পরাজয় এবং বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধের বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। | যুদ্ধের ইতিহাসে কালিহাতি সেতুর যুদ্ধ ছিল একটি সম্পূর্ণ অসম যুদ্ধ। এ যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানকে রােধ করা। প্রতিরােধ। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় অসংগঠিত মুক্তিবাহিনীর পক্ষে দক্ষ পেশাধারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মােকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। তবুও এ প্রতিরােধ যুদ্ধের ভিতর দিয়ে বাঙালি ইপিআর পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-যুবকদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃঢ় প্রত্যয় প্রমাণিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কালিহাতি যুদ্ধ দেশমাতৃকার স্বাধীনতার লড়াই ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র-যুবকদের গভীরভাবে আন্দোলিত ও অনুপ্রাণিত করে। এদিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কালিহাতির যুদ্ধ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
ভৈরবের যুদ্ধ
ভৈরবের অবস্থান
ভৈরব কিশােরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি প্রসিদ্ধ নদীবন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। ঢাকা থেকে ৮৪ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ভৈরব কিশােরগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলার (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা) সীমান্তবর্তী একটি থানা। এ থানার বিপরীত তীরে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র আশুগঞ্জ। এখানে বেশ কিছু শিল্পকারখানা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অবস্থিত। এখান থেকে কিছুটা ব্যবধানে দক্ষিণ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি বর্ধিষ্ণু শহর ও মহকুমা সদর। ঢাকা থেকে ভৈরব, আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া একই রেলপথে সরাসরি সংযুক্ত। ভৈরব একটি রেলওয়ে জংশন। ঢাকা থেকে রেললাইন ভৈরব গিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এর একটি লাইন ভৈরব থেকে কিশােরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহে পৌছেছে। অন্য লাইন ভৈরবের উপর মেঘনা সেতু পার হয়ে আশুগঞ্জের উপর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আখাউড়া জংশনে গিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এখান থেকে একটি লাইন হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট এবং অন্য লাইন কুমিল্লা, ফেনী হয়ে বন্দর নগর চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। এ সময় রাজধানী ঢাকার সাথে বন্দর নগর চট্টগ্রামের সরাসরি কোনাে সড়ক যােগাযােগ ছিল না। শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গােমতী নদী ফেরি দ্বারা অতিক্রমের ব্যবস্থা ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম সরাসরি সংযুক্ত ছিল রেলপথ দিয়ে। আর এ রেলপথ ভৈরবের উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। পাশেই মেঘনা নদী। এবং গুরুত্বপূর্ণ ভৈরব রেলসেতু। অবস্থানগত ও সামরিক কৌশলগত দিক থেকে ভৈরব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকেই মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী উভয়ই ভৈরবের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
পূর্ব থেকেই ভৈরব একটি বৃহৎ নদীবন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভৈরবের গুরুত্ব অধিক ছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ স্থান। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি রেলপথ সংযােগ অব্যাহত রাখার জন্য ভৈরব সেতুর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকা-চট্টগ্রাম সরাসরি সংযােগ বিচ্ছিন্ন করা, সরবরাহ লাইন বন্ধ এবং দেশের পূর্বাঞ্চলে সামরিক চলাচলকে ব্যাহত করার জন্য ভৈরব ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ থেকে অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করার জন্য পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত ২টি পদাতিক ডিভিশনকে ঢাকায় আনয়ন করে। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ খারিয়ানে অবস্থানরত ৯ম ডিভিশনকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। ২-৭ এপ্রিলের মধ্যে ডিভিশনটি ঢাকায় আগমন করে। এ ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল শওকত রেজা। সামরিক কর্তৃপক্ষ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই ৯ম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল শওকত রেজাকে মে মাসের মধ্যে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এলাকা শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দেন। একইসাথে পাকিস্তানি সামরিক সদর দপ্তর থেকে এক নির্দেশে ৯ম ডিভিশনের অধীনস্থ ২৭তম ব্রিগেডকে ১৪তম ডিভিশনের অধীন ন্যস্ত করে ময়মনসিংহের পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৪তম ডিভিশনের অভিযান নিয়ন্ত্রণ এলাকা নির্ধারিত হয় ঢাকা, যশাের ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। ২৭তম ব্রিগেডকে ময়মনসিংহ গন্তব্যস্থলে পৌছানাের পূর্বে কুমিল্লা-সিলেট সড়ক ও রেলপথ মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ ব্রিগেডের ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ খান। ভৈরব-আশুগঞ্জ-লালপুর যুদ্ধের পর এ ২৭তম ব্রিগেড ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কসবা, আখাউড়া, সাইদাবাদ, কুঠি-গঙ্গাসাগর অঞ্চলের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত হয়। এ ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। লক্ষ্য অর্জনে ব্রিগেডটি প্রবল গতিতে ভৈরব বাজারের মেঘনা নদী অতিক্রম করে। এ তৎপরতায় ট্যাংক, কমান্ডাে, হেলিকপ্টার ও জঙ্গিবিমান ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া। ব্রিগেডের কাছে ছিল গানবােট ও ল্যান্ডিং ক্রাফট বা জলে অস্ত্রশস্ত্রসহ অবতরণের ব্যবস্থা। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৭তম ব্রিগেড ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হয়। তাদের অগ্রসর হওয়ার অবস্থানগুলাে হলাে: ক, ১ ব্যাটালিয়ন স্থলপথে ঢাকা-নরসিংদী ভৈরব রেললাইন বরাবর অবস্থান নেয়। খ, ১ ব্যাটালিয়ন মেঘনা নদী হয়ে নৌপথে যাত্রা করে। গ, পদাতিক বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে সাপোের্ট দেয়ার জন্য ১টি আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন খানাবাড়ি রেল স্টেশন এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। ঘ, পদাতিক বাহিনীর ২ কোম্পানি হেলিকপ্টারযােগে মধ্যেরচর ও। সােহাগপুরে অবতরণ করে অবস্থান নেয়।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করলে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটগুলাে প্রতিরােধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থানরত মেজর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় সকল ইউনিট ২৭ মার্চ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান গ্রহণ করে। এ রেজিমেন্ট সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়। এদিকে ঢাকার জয়দেবপুরে অবস্থানরত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। এ রেজিমেন্ট ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ভৈরব হয়ে ৩১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদ মােশাররফের সাথে মিলিত হয়। তখন এ দুই রেজিমেন্ট সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানকে বাধা প্রদান এবং একইসঙ্গে সিলেট ও কুমিল্লায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে।
প্রসঙ্গত
প্রয়ােজন যে, যুদ্ধের এ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত হতে পারে নি। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যােদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মেঘনা নদী ও ভৈরবকে সামনে রেখে পরিকল্পনামাফিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুক্তিবাহিনীর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা ছিল দুঃসাহসী কাজ। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলাে হলাে: ১. আশুগঞ্জে ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে এক কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য মােতায়েন করা হয়। আশুগঞ্জের ৩ মাইল উত্তরে আজবপুর নামক স্থানে একজন জেসিও’র
অধীন মােতায়েন করা হয় এক কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য।
আশুগঞ্জ থেকে ২ মাইল দক্ষিণে লালপুরে লেফটেন্যান্ট হেলাল মােরশেদের নেতৃত্বে নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈনিকদের সংমিশ্রণে গঠিত ১টি কোম্পানিকে মােতায়েন করা হয়। এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল ঐ এলাকায় নৌপথে যাতে কোনাে শত্রু সৈন্য অবতরণ করতে পারে, তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। ৪. ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন ১টি মিশ্র কোম্পানিকে নিয়ে তিতাস নদীর পাড়ে গােকর্ণঘাট এলাকা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন। ক্যাপ্টেন মতিন এক কোম্পানি ইপিআর নিয়ে সরাইলে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ কোম্পানিকে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে গণ্য করা হয়। ভৈরবের ২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রামনগর রেলসেতুতে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে ম্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে এক কোম্পানি ইপিআর সদস্য। ১৩ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় আগত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম দলটিকে তার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের অবস্থান ছিল ভৈরব আশুগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংযুক্ত এলাকায়। যুদ্ধের পরিকল্পনা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থায় এটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ একটি অপরিকল্পিত আক্রমণ । তবে যুদ্ধ চলাকালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটে। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লার দিকে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। তাদের দায়িত্ব ছিল রেল ও সড়কপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আগত পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা প্রদান। আর ২য় ইস্ট বেঙ্গল ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব ও আশুগঞ্জ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। তবে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন তার ডেল্টা কোম্পানি ও ইপিআর-এর বেশ
কিছু সদস্যসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন।
কিন্তু এ সময় (১১ এপ্রিলের মধ্যে) ২য় ইস্ট বেঙ্গল থেকে ২টি কোম্পানি সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রেরণের ফলে এ এলাকায় সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা দেখা দেয়। এ স্বল্পতা পূরণের জন্য ইপিআর পুলিশ এবং অল্প সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিরােধ যুদ্ধের এ পর্যায়ে সামগ্রিক অবস্থা বিচার করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কগণ অতি দ্রুত কার্যকর একটি ডিনায়াল পরিকল্পনা কার্যকর করেন। এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল রেলসেতু ও সড়কসেতু ভেঙে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানকে ব্যাহত করা। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভৈরব থেকে ২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের উপর রামনগর সেতু ভেঙে ফেলা হয়। একই সাথে ভেঙে ফেলা হয় কিশােরগঞ্জের কাছে রেল ও সড়কসেতু।
যুদ্ধের বিবরণ
২য় ইস্ট বেঙ্গলের এক দল সৈন্য ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে পাঁচদোনা ও নরসিংদীতে অগ্রাভিযানরত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরােধ করে। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রবল শক্তি প্রয়ােগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর পাকিস্তানি বাহিনীকে ক্রমান্বয়ে বাধা দিতে দিতে ভৈরবের দিকে পিছিয়ে আসতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীও তাদের অনুসরণ করে সম্মুখে অগ্রসর হয়। কিন্তু পূর্বেই পরিকল্পিতভাবে ভৈরবের কিছু আগে। অবস্থিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের উপর রামনগর রেলসেতুটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর তার বাহিনী নিয়ে রামনগরে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি বহর আশুগঞ্জের ২ মাইল দক্ষিণে লালপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে অবস্থান গ্রহণ করে। এ সৈন্যবহর অবতরণের জন্য উপযুক্ত স্থান পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এ সময় পূর্ব থেকে লালপুরে অবস্থানরত লেফটেন্যান্ট হেলাল মােরশেদের বাহিনী। নৌবহরটিকে আক্রমণ করে। প্রায় এক ঘণ্টা উভয়ের মধ্যে গােলাগুলি চলে এবং নৌবহরটি অবস্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণ দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে লালপুর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় সরাইলে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি লালপুরে চলে আসে। ১৫ এপ্রিল ভাের সাড়ে ৫টায় ভৈরব, লালপুর ও আশুগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর গােলাবর্ষণ শুরু হয়। খানাবাড়ি রেল স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন এ গােলাবর্ষণ চালায়। এটা ছিল প্রিএইচ আওয়ার গােলাবর্ষণ। এ গােলাবর্ষণের সুযােগে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌবহরটি আবারও লালপুরে এসে উপস্থিত হয়। এরা মূলত গােলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় লালপুরে অবতরণের জন্য আসছিল। নৌবহরে ছিল ২টি গানবােট, ২টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট ও ৪টি লঞ্চ।
একই সময় রেলপথ ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ভৈরবের দিকে। অগ্রসর হয়। ইতােপূর্বে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে শত্রুদের প্রতিহত করে তাদের অগ্রগতি বিলম্বিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যায়ে তাকে আশুগঞ্জে পিছিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। এদিকে লালপুরে নৌবহরটি যখন আরও এগিয়ে আসে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান নির্ণয়ের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়, তখন মুক্তিবাহিনীর একজন সৈনিক উত্তেজনাবশত গুলি করে বসেন। এ অবস্থায় পাকিস্তানি সৈন্যরা সাথে সাথে ট্যাংক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে গােলাবর্ষণ শুরু করে। জবাবে মুক্তিবাহিনীও রকেট লঞ্চার ও মর্টার দিয়ে গােলাবর্ষণের পাল্টা জবাব দেয় । মুক্তিবাহিনীর এ আক্রমণের প্রচণ্ডতায় পাকিস্তানি নৌবহর তীর থেকে অন্যত্র ভেসে যেতে থাকে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি বিমানবাহিনী যুদ্ধে যােগদান করে। ৬টি স্যাবর জেট ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর বােমাবর্ষণ শুরু করে। বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সৃষ্টি করার মতাে কোনাে অস্ত্র তখন মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল। বিমান আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টা বিমান আক্রমণ চলে। ১৫ এপ্রিল ভােরে এক ঝাক এমআই-৮ হেলিকপ্টার আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মাঝামাঝি সােহাগপুরে পাকিস্তানি ছত্রীসেনা নামাতে শুরু করে। হেলিকপ্টার অবতরণে। বাধা দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন নাসিম বিমান আক্রমণ উপেক্ষা করে শক্রর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। এমজি পােস্টের অধিনায়ক আবদুল হাই রেলপথের উপর। স্থাপিত উন্মুক্ত পরিখা থেকে শত্রুদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। কিন্তু শক্রর ৮৩ মিলিমিটার আর্টিলারি গান থেকে নিক্ষিপ্ত গােলা সরাসরি আবদুল হাইকে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তিনি শহিদ হন।
একপর্যায়ে শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ঘিরে ফেলে। এখানে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ঘণ্টা হাতাহাতি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেফটেন্যান্ট হেলাল মােরশেদ আহত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। অবস্থা বুঝে অধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ সৈন্যদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যায় আঁধারের আড়ালে ক্যাপ্টেন নাসিম। সরাইলের দিকে সরে আসতে সক্ষম হন। শফিউল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী পুরাে বাহিনী নিরাপদ স্থানে সরে যায়। | অপরদিকে, পাকিস্তানি নৌবহরটি তিতাসের মুখে সৈন্য নামিয়ে দেয়। দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয় দেখে ক্যাপ্টেন মতিন সন্ধ্যায় রেলপথ বরাবর হেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি তার বাহিনী সরাইলে স্থানান্তর করেন। অবশেষে সৈন্যরা ৮ মাইল পথ হেঁটে শাহবাজপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে ক্যাপ্টেন মতিউরের পক্ষে নদীর পশ্চিমে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় এবং মেঘনা সেতু ও নদী পারাপারের পথ অপর তীর পাকিস্তানি বাহিনীর করায়ত্ত হওয়ায় মুক্তিবাহিনীর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে উত্তর দিকে ভৈরব ও ময়মনসিংহ রেলপথ ধরে ক্যাপ্টেন মতিন তার বাহিনীসহ কুলিয়ারচরে। পৌছেন। পরে চাতালপাড় হয়ে তিনি মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হন। ১৯৭১ সালের ১৩-১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত ভৈরব-আশুগঞ্জ-লালপুর যুদ্ধ ছিল সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রথম প্রহরের একটি পূর্ণাঙ্গ লড়াই। পরিস্থিতি ও অবস্থানের বিবেচনায় এ যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারণ খুব দুঃসাধ্য কাজ। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে নিরাপদ অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর পিছু হটে যাওয়ার কারণগুলাে নিচে উল্লেখ করা হলাে:
সামগ্রিক পরিস্থিতি
সময়ের বিবেচনায় সামগ্রিক পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে সাধারণ মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাে ছিল অনেকটা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে। ফলে বলা যায়, যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে ছিল না।
প্রয়ােজনীয় অস্ত্রের অভাব
যুদ্ধের এ পর্যায়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলােকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতাে প্রয়ােজনীয় এবং যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র তাদের হাতে ছিল না। একমাত্র ৭৫ মিলিমিটার আরআর, এমজি, আরএল ও কিছু মর্টার ছিল তাদের সম্বল। সৈনিকদের নিজস্ব প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ছিল না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে হয়। আর্টিলারি ফায়ারের অভাব মুক্তিবাহিনীর কাছে আর্টিলারি ফায়ারের ব্যবস্থা ছিল না। তাদের কাছে বিমানবিধ্বংসী কামান না থাকায় বিমান আক্রমণ যেমন মােকাবিলা করা যায়নি, তেমনি হেলিকপ্টারযােগে ছত্রীসেনা নামানাের বিষয়টিতেও বাধা দেয়া সম্ভব হয় নি। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর বিমান আক্রমণ হওয়ার পর পিছু হটা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর জন্য কোনাে বিকল্প ছিল না। যােগাযােগের অভাব ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুরের যুদ্ধে লড়াইরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাের মাঝে কোনাে যােগাযােগ ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মােকাবিলা করতে হয়েছে। একটি কোম্পানির সাথে অপর কোম্পানির যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম ওয়্যারলেস সেট সব সময় কার্যকর ছিল।
বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয়েছে রানার বা বার্তাবাহকের উপর। যােগাযােগের অভাবের কারণে যুদ্ধে সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ জন্য এ যুদ্ধে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শিথিল হয়ে পড়েছিল। সংরক্ষিত বাহিনীর অভাব যে-কোনাে যুদ্ধে সংরক্ষিত শক্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনাে সংরক্ষিত শক্তি ছিল না। সরাইলে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন মতিন এক কোম্পানি ইপিআর নিয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনায় রিজার্ভ হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। এ কোম্পানির দায়িত্ব ছিল যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করলে তালশহর ও গােকর্ণঘাট এলাকায় প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলা। কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতিগত কারণে এ কোম্পানি লালপুরের অবস্থান পিরবর্তন করায় আক্রমণে নিয়ােজিত পুরাে বাহিনী সংরক্ষণ বা রিজার্ভবিহীন হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান বিশ্লেষণ
এটা বলাই বাহুল্য যে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ। তাদের আক্রমণ ছিল পরিকল্পিত । তাই তাদের মনােবল ছিল দৃঢ় ও উন্নত। ভৈরব, আশুগঞ্জ ও লালপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। জল, স্থল বিশেষত বিমান আক্রমণের ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতি পাকিস্তানি বাহিনীর অনুকূলে চলে যায়। তাদের যুদ্ধ জয়ের কারণ ছিল প্রচুর যুদ্ধসরঞ্জাম ব্যবহার। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ছিল আক্রমণাত্মক ভূমিকা। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী বা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাে ছিল রক্ষণাত্মক ভূমিকায়। সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে, আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে সংঘটিত এ যুদ্ধে অবস্থানগত কারণেই পাকিস্তানি বাহিনী জয়লাভ করে। মুক্তিবাহিনী কোনাে সংগঠিত নেতৃত্ব বা নির্দেশ ছাড়াই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। নানামুখী প্রতিকূলতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান আক্রমণের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন, যে মনােবল দেখিয়েছেন, তা জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। মুক্তিযােদ্ধাদের এ অকুতােভয় লড়াই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবলকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। একই সঙ্গে পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ পরিচালনায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড