You dont have javascript enabled! Please enable it!
সেক্টর গঠন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ। জনগণ, রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক বাহিনীর বাঙালি সেনাদের উপর বর্বরােচিত হামলা চালায়। নিজেদের আত্মরক্ষার তাগিদে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনােরূপ পূর্ব দিকনির্দেশনা ছাড়াই সামরিক, আধা । সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনগণের সহায়তায় এলাকাভিত্তিক প্রতিরােধ গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সারা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণ। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে গড়ে তােলে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী। নেতৃস্থানীয় চাকমা ব্যক্তিত্ব ও চাকমা উপজাতির কিছু সংখ্যক সদস্য ব্যতীত অন্যান্য সকলেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ছিলেন। উল্লেখ্য, চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (পিতা: নলিনাক্স রায়) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের সমর্থক ছিলেন এবং সে সময়ে তিনি মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না যে, চাকমা রাজপরিবারের অধিকাংশ সদস্যই আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। চাকমা রাজপরিবারের সদস্য তপন কুমার। রায়ের পিতা এবং দুই সহােদর আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ হন। আত্মত্যাগের এমন শত শত দৃষ্টান্ত রয়েছে। শুধু পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা উপজাতিরাই নয়, পার্বত্য জেলা বান্দরবনের বােমাং এবং খাগড়াছড়ির মং সার্কেলের মারমা জাতিগােষ্ঠীর সর্বস্তরের জনতাও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মং সার্কেলের রাজা মপ্রু সেইন স্বয়ং রাজপরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ২৫ মার্চ থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় সব বাঙালি ইউনিট প্রাথমিক অবস্থাতেই বিদ্রোহের মাধ্যমে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে। এ দিনই রাত ৯টায় ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে প্রতিরােধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ইপিআর ও সামরিক বাহিনী স্থানীয় ভিত্তিতে প্রতিরােধ গড়ে তুললেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ ক্রমে তীব্রতর হতে থাকলে আঞ্চলিক ভিত্তিতে পক্ষত্যাগকারী সৈনিক, ইপিআর ও সশস্ত্র ব্যক্তিরা সম্মিলিত উদ্যোগে সমন্বিত প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে সীমিত অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে বেশি দিন টিকে থাকতে না পারায় পুরাে বাহিনীই বিভিন্ন পথে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। | শুরুতে কোনাে রাজনৈতিক বা সামরিক দিকনির্দেশনা না থাকায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তা, সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, সশস্ত্র ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-জনতা প্রতিরােধ ভেঙে পড়ার পটভূমিতে অসংগঠিতভাবে প্রতিবেশী ভারতের পথে পাড়ি জমায়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনাে সরাসরি যােগাযােগ গড়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায় পূর্বাঞ্চলে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ সদস্যরা মেজর খালেদ মােশারফের অস্থায়ী দপ্তর তেলিয়াপাড়ায় ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল এক সভায় মিলিত হন। তেলিয়াপাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তের নিকটবর্তী একটি চা-বাগান এলাকা।
সভায় সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী। এ ছাড়া সভায় উপস্থিত ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মঈনুল হােসেন চৌধুরী, মেজর মােমিন চৌধুরী, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাহ উদ্দিন মাে. রাজা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রব, মেজর শাফায়েত জামিল। এ সভায় উপস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তারা সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা ও বিশ্লেষণ করে পরিকল্পিত যুদ্ধ গড়ে তােলার। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহ ঘােষণাকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫টি ইউনিটসহ ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার ও ছাত্র সংগঠনগুলােকে এলাকাভিত্তিক সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাদের কাছে সারা দেশের বিভিন্ন বাহিনীর বিদ্রোহের সার্বিক চিত্র না থাকায় মােটামুটিভাবে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের উপর দায়িত্ব দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি অঞ্চলে ভাগ করে সমন্বিত যুদ্ধপ্রচেষ্টার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ অঞ্চল এবং অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা ছিলেন:
১. চট্টগ্রাম অঞ্চল মেজর জিয়াউর রহমান
২. কুমিল্লা অঞ্চল মেজর খালেদ মােশাররফ
৩. সিলেট অঞ্চল মেজর কে এম শফিউল্লাহ
৪. যশাের অঞ্চল। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী
প্রাথমিক অবস্থায় সমন্বিত যুদ্ধপ্রচেষ্টা ও অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন তেমন ফলপ্রসূ না হলেও সকলে সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর উপর মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব অর্পণ করে স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হন। প্রথম প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণ ছিল ইতােমধ্যেই পক্ষ ত্যাগকারী বাঙালি সেনা অধিনায়কগণ নিজ নিজ সৈন্যসহ এলাকাভিত্তিক প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন। বলা যেতে পারে, একটা অনিশ্চয়তা ও পারস্পরিক সমন্বয়হীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত থাকে এবং ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।
ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার মুখে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনা ইউনিটে কর্মরত এবং ছুটি ভােগরত বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈনিক এবং অসামরিক ক্ষেত্রের ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী এককথায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পথে পাড়ি জমান এবং পরবর্তীকালে এঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত হন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আগরতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর থানার বৈদ্যনাথতলায় এ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রবাসী সরকারের কাঠামাে ছিল নিমরূপ: রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ আইন সংসদ ও পররাষ্ট্র। খন্দকার মােশতাক আহমদ। স্বরাষ্ট্র। এইচ এম কামরুজ্জামান। অর্থ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুষ্ঠানিকভাবে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে ক্যাবিনেটমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধান সেনাপতি নিয়ােগ করে। একই সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকারিভাবে আঞ্চলিক বিন্যাস এবং সামরিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়ােজন। যে, মুজিবনগর সরকারের এ আঞ্চলিক যুদ্ধ এলাকা বিন্যাস ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতারই অংশ। মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধ অঞ্চল বিন্যাস ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ছিলেন :
১. সিলেট-কুমিল্লা অঞ্চল মেজর খালেদ মােশাররফ ২. চট্টগ্রাম-নােয়াখালী মেজর জিয়াউর রহমান অঞ্চল দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ৪. ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল। মেজর কে এম শফিউল্লাহ। অঞ্চল
১৯৭১ সালের জুন মাসে মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। বৈঠকে যুদ্ধপরিস্থিতির সার্বিক পর্যালােচনা ও বিশ্লেষণপূর্বক সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন যুদ্ধ অঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বয় সভা আয়ােজনের নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ মােতাবেক ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল ও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কিত বিস্তারিত আলােচনার পর উপস্থিত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং কর্নেল আবদুর রবকে চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতিটি সেক্টরে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। সমগ্র যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্তির পর সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে যিনি যে এলাকায় যুদ্ধরত ছিলেন, তাদের অধীনস্থ দল ও উপদলকে একক অধিনায়কত্বে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসংগঠিত যুদ্ধকৌশল অবলম্বন ও পরিচালনার বিষয়টি পূর্বের তুলনায় সমৃদ্ধ হয়। উক্ত বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি একটি নিয়মিত বাহিনী গঠনের সময়ােপযােগী পরিকল্পনাও গৃহীত হয়। মুক্ত এলাকায় কর্তৃত্ব গ্রহণ এবং সমন্বিত পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ কৌশল অবলম্বন সহজতর করার লক্ষ্যেই মূলত নিয়মিত বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।

পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৩টি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয়। এগুলাে হলাে: জেড ফোর্স, কে ফোর্স এবং এস ফোর্স। ৩টি ব্রিগেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান (জেড ফোর্স), মেজর খালেদ মােশাররফ (কে ফোর্স) এবং মেজর কে এম শফিউল্লাহ (এস ফোর্স)। ১১টি সেক্টরের মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টরটির অবস্থান ছিল বার্মা সীমান্তে। মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে বার্মা সরকার বাংলাদেশকে সহযােগিতা না করায় এ সেক্টরটির কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তী সময়ে ১০ নম্বর সেক্টরকে একটি বিশেষ সেক্টর হিসেবে সংগঠিত করা হয়। ভৌগােলিক সীমারেখা বিহীন এ সেক্টরটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর কর্তৃর্ক বিশেষভাবে প্রণীত রণকৌশল বাস্তবায়ন করতাে। প্রধান সেনাপতি নিজেই এ সেক্টরের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন। এ সেক্টরের অধীন বিশেষ নৌ-কমান্ডাে এবং প্রধান সেনাপতির বিশেষ দল গঠন করা হয়। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এ গেরিলা দল প্রয়ােজন অনুযায়ী সেক্টরগুলাের নেতৃত্বে বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাে।

১১ নম্বর সেক্টর গঠন
যুদ্ধের প্রারম্ভে ভারত সরকার তার সীমান্ত এলাকাকে অনেক সেক্টরে বিভক্ত করে। ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে চিহ্নিত করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার বাংলা ক্রমিক সংখ্যার ভিত্তিতে সেক্টরের সীমানা চিহ্নিত করে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগ তাদের গণনা শুরু করে খুলনা থেকে এবং গণনা শেষ হয় চট্টগ্রামে। ভারতীয় সেক্টর এলাকা বিভাজন অনুযায়ী বাংলাদেশের ১১ নম্বর সেক্টর ভারতীয় এফ সেক্টর হিসেবে গণ্য হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিজস্ব এফ সেক্টর ছিল রাজস্থান। ফলে এফ সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চিঠিপত্রগুলাে রাজস্থানে অবস্থিত ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের বরাবর চলে যাওয়ায় চিঠিপত্র আদান-প্রদানে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এ অসুবিধা দূরীকরণ এবং বিষয়টি নির্দিষ্টকরণের জন্য কর্তৃপক্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের এ সেক্টরটিকে বাংলাদেশ সীমান্তের এফ সেক্টরের সাথে একটি জে বর্ণ যােগ করে এফজে সেক্টর (জে ফর ‘জয় বাংলা’) হিসেবে চিহ্নিত করে। ডালু ছিল এফজে সেক্টরের সদর দপ্তর। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বাংলাদেশ সেক্টর গঠন পর্যন্ত ভারতীয় বিএসএফ অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার শান্ত সিং বাবাজী এ সেক্টরটির দায়িত্বে ছিলেন। এ সেক্টরের অধীন ছিল মূলত ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও এফএফ বা ফ্রিডম ফাইটার বা মুক্তিযােদ্ধা (ছাত্র-যুবক)। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকেই কয়েকজনকে সাব-সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। যাদের মধ্যে আবুল হাশেম, ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, শহিদ নাজমুল আহসান, নাজমুল হক তারা, তােফাজ্জল হােসেন চুন্নু। বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
৭ জুলাই মেজর জিয়াউর রহমানের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্যদের নিয়ে জেড ফোর্স গঠন করে এ ১১ নম্বর সেক্টরের সব সৈনিককে জেড ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি এবং তার বাহিনী এ এলাকায় কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এসব যুদ্ধ জেড ফোর্সের যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত। যদিও যুদ্ধগুলাে ১১ নম্বর সেক্টর এলাকায় সংঘটিত হয়েছে এবং এসব যুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সাথে অনেক ছাত্র, কৃষক ও সর্বস্তরের মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেছে। ১২ আগস্ট মেজর আবু তাহের প্রধান সেনাপতির নির্দেশে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সেক্টর এলাকা
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা (কিশােরগঞ্জ মহকুমা বাদে), টাঙ্গাইল জেলা ও ১ জেলার বর্তমান কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) অংশবিশেষ নিয়ে ১১ নম্বর সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টরের অধীন মােট ৮টি সাব-সেক্টর ছিল এবং সাব-সেক্টর অধিনায়কগণ হলেন:
১. মানকার চর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদউল্লা খান
২. মহেন্দ্রগঞ্জ লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান।
৩, পুরাখাসিয়া। সামছুল আলম। ডালু। ডা, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। শিববাড়ি নাজমুল হক তারা। বাগমারা তােফাজ্জল হােসেন চুন্ন রংড়া। নাজমুল আহসান ৮. মহিষখােলা মতিউর রহমান। এ সেক্টরে একটি সেক্টর টুপসের অধীন এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং ২০ হাজার মুক্তিযােদ্ধা যুদ্ধরত ছিল। ১২ আগস্ট-১৪ নভেম্বর পর্যন্ত মেজর আবু তাহের সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৪ নভেম্বর তিনি কামালপুর যুদ্ধে মারাত্মক আহত হলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদউল্লা খান ভারপ্রাপ্ত সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন সামরিক কর্মকর্তাগণ হলেন:
১. মেজর আবু তাহের (সেক্টর অধিনায়ক)
২. ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ
৩, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লা খান
৪. লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান
৫. লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী খান
৬. লেফটেন্যান্ট তাহের আহমেদ
৭. লেফটেন্যান্ট আসাদুজামান।
৮. লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমান
৯. লেফটেন্যান্ট গিয়াস আহমেদ
১০. লেফটেন্যান্ট মিজানুর রহমান
১১. লেফটেন্যান্ট মইনুল ইসলাম
১২. লেফটেন্যান্ট সামছুল আলম
১৩. লেফটেন্যান্ট কামাল
১৪. মেজর মতিউর রহমান।
১৫. ক্যাপ্টেন এম এ হামিদ।
এখানে একটি বিষয় অবশ্যই স্মরণযােগ্য যে, ১১ নম্বর সেক্টর এলাকার অধীন টাঙ্গাইল জেলায় বিপুলসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা কাদের সিদ্দিকী, আবদুল বাতেন ও সুবেদার মেজর আফছার উদ্দিনের নেতৃত্বে স্বতন্ত্রভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সাফল্য অর্জন করেন। স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট এ বাহিনী ৩টি দেশের অভ্যন্তরে থেকে যুদ্ধ করার কৌশল গ্রহণ করে।
এদের বেশির ভাগ মুক্তিযােদ্ধা ভারতে গমন করেন নি। শত্রু বাহিনীর অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েই তারা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। টাঙ্গাইলের মধুপুরের গড়, জলাভূমি, চর অঞ্চল এবং জেলার গভীর অরণ্য ছিল বাহিনী ৩টির আশ্রয়স্থল। প্রাথমিকভাবে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল নাটিয়াপাড়া যুদ্ধের পর ছত্রভঙ্গ হওয়া এবং ১৯ এপ্রিল ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনীকে কালিহাতিতে বাধা প্রদানের মধ্য দিয়ে। কাদের সিদ্দিকী সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার তার বাহিনীকে জন্য ৫টি সেক্টরে বিভক্ত করেন। তার অধীনস্থ মুক্তিযােদ্ধারা বিভক্ত ছিলেন ৯৭টি কোম্পানিতে। বাহিনীর উর্ধ্বতন সদর দপ্তর ছিল মহানন্দপুরে। মুক্ত এলাকায় তিনি বেসামরিক শাসনব্যবস্থা ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই চালু করেছিলেন। বাহিনীর একজন বেসামরিক প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। নভেম্বর মাস থেকে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী শক্তিসম্পন্ন বেতার যােগাযােগব্যবস্থা চালু করতে সমর্থ হয়। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর অধীনস্থ মুক্ত এলাকা ছিল উত্তরে মধুপুর-ময়মনসিংহ সড়কের দক্ষিণ থেকে কালিয়াকৈরের উত্তর পর্যন্ত প্রায় ৫০ মাইল জঙ্গল এলাকা, পূর্বে ভালুকা, গফরগাঁও ও শ্রীপুর। পশ্চিমে টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের প্রায় ৩০ মাইল। সর্বমােট প্রায় ১,৫০০ বর্গমাইল এলাকা ছিল তার আওতাভুক্ত। তিনি দাবি করেন যে, তার অধীন ১৭ হাজার মুক্তিযােদ্ধা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ১২ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত হলে মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার শান্ত সিং-এর ভারতীয় বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী ১২ ডিসেম্বর পরবর্তী কয়েক দিন অগ্রাভিযান পরিচালনা করে। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী যখন ঢাকা প্রবেশ করে, তখন তার সাথে ছিল টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী এবং বাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। এদিন নিয়াজির আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার মল্লিকবাড়ি গ্রামে মাত্র কয়েকটি রাইফেল নিয়ে সুবেদার মেজর আফছার উদ্দিন আহমেদ মুক্তিবাহিনীর গােড়াপত্তন করেন। ক্রমান্বয়ে তার দল ভারি হতে থাকে এবং সাথে সাথে শত্রুর কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে তিনি বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তােলেন। তার অধীনস্থ সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজারে। এর মধ্যে আড়াই । হাজার সদস্যের কাছে অস্ত্র ছিল। তাঁর দলে অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৩০৩ রাইফেল, বেটাগান, রকেট লঞ্চার, এলএমজি ইত্যাদি।  তিনি মুক্ত এলাকায় জাগ্রত বাংলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তার বাহিনীর অধীন ১৩জন ডাক্তার ও ৩জন নার্স সমন্বয়ে একটি ভ্রাম্যমাণ । হাসপাতালও পরিচালিত হতাে। তিনি মুক্ত এলাকায় সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা চালু রাখেন। ফলে মুক্ত এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি। তার অধীনস্থ । মুক্তিবাহিনীকে ২৫টি কোম্পানি অর্থাৎ ৫টি ব্যাটালিয়নে ভাগ করা হয়। প্রতিটি কোম্পানিতে ৩টি প্ল্যাটুন, প্রতিটি প্লাটুনে ৩টি সেকশন এবং প্রতিটি সেকশনে। ১৫জন করে মুক্তিযােদ্ধা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মিত্রবাহিনীর অবস্থান
ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯৩ পদাতিক ব্রিগেডের বিপরীত দিকে ভারতের মেঘালয়ে অবস্থান করছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোন এরিয়া। এর নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল শুরুবক্স সিং। যুদ্ধে তিনি আহত হলে পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল জি সি নাগরা এ জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১০১ কমিউনিকশেন জোন এরিয়ার সদর দপ্তর ছিল। মেঘালয়ের শিলংয়ে। ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অপারেশনাল দায়িত্ব ছিল। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনীকে লজিস্টিক সহায়তা প্রদান। যাতায়াতের দিক থেকে ১১ নম্বর সেক্টরের বিপরীতে ভারতীয় অঞ্চলটি খুব উন্নত ছিল না। খুব বেশি বড়াে। আকারের কোনাে বাহিনীর জন্য সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তােলা অসুবিধাজনক। ছিল। তাই এ সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর জন্য দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয় বিপরীত দিকে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্ষণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করে। তাদের (পাকিস্তানি বাহিনীকে) এ অঞ্চলে আটকে রাখা, যাতে মূল ভারতীয় আক্রমণকারী বাহিনী দ্বিতীয় এবং চতুর্থ কোর ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে পারে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!