You dont have javascript enabled! Please enable it! গণ-আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে ময়মনসিংহ - প্রতিরােধ যুদ্ধে ময়মনসিংহ - ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যের অবস্থান - সংগ্রামের নোটবুক
গণ-আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে ময়মনসিংহ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের গারাে, হাজং ও পাগলাপন্থি বিদ্রোহসহ অনেক কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এ জেলার ইতিহাসের একটি উল্লেখযােগ্য দিক। এমনকি উনিশ শতকের ফরায়েজি ও নীলকর আন্দোলন এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৯ সালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, কলমাকান্দা, সুসঙ্গ দুর্গাপুর প্রভৃতি অঞ্চলে লেভি ও টংক দান আদায়ের ব্যাপারে মুসলিম লীগ সরকার সীমাহীন অত্যাচার, উৎপীড়ন ও পাশবিকতার রাজত্ব কায়েম করে। লাঠি ও বন্দুক সজ্জিত ন্যাশনাল গার্ড, আনসার বাহিনী ও কুখ্যাত সরকারি গুণ্ডাদের লেলিয়ে। দেয়া হয় গারাে, হাজং, রাজবংশী পল্লীগুলােয়। তাদের পাশবিকতা নিপীড়িত চাষিদের আন্দোলন সংগ্রামে নামতে বাধ্য করে। ফলে জমিদার-চাষিতে, পুলিশ-চাষিতে সংঘর্ষ এ অঞ্চলের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। লেঙ্গুরা হাটে মুসলিম লীগ সরকারের সিপাহি দল শঙ্খমণিসহ ১৫জন বীর কৃষককে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর পাশবিক দমননীতির বিরুদ্ধে কৃষকসমাজ তীব্র আন্দোলন ও প্রতিরােধ গড়ে তােলে। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুযােগ নিয়ে মুসলিম লীগ সরকার উপজাতিদের উচ্ছেদ করে সেখানে মােহাজেরদের জন্য বসতি স্থাপন করে এবং কৃষক সংগ্রামের ঐতিহ্য বহনকারী। উপজাতিদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। মুসলিম লীগ শাসনের মৃত্যুর পরােয়ানা রচিত হয়েছিল এ ময়মনসিংহেই। নূরুল আমিনের অন্যতম রাজনৈতিক সহচর আবদুল মােনায়েম খার অশ্লীল। কটুবাক্য সত্ত্বেও ১৯৫০ সালে মওলানা ভাসানী ও হােসেন শহিদ সােহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে ময়মনসিংহে আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের কমিটি গঠিত হয়। এ ছাড়া ১৯৫৩ সালের মে মাসে ময়মনসিংহ শহরেই আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন বসে, যেখানে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়।
ঐতিহাসিক ২১-দফা প্রণয়ন কার্যও সম্পন্ন হয়। ময়মনসিংহেই। আইয়ুবের স্বৈর শাসনামলে ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময় ময়মনসিংহেরই। সন্তান আবদুল মােনায়েম খান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং নূরুল আমিন মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে এ জেলারই কৃতী সন্তান আবুল কালাম শামসুদ্দিন, হাসান।হাফিজুর রহমান, খালেক নেওয়াজ খান, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ নেতাদের অবদান অনস্বীকার্য। | এরই বিপরীত পিঠে রয়েছে সংগ্রামের মশাল হাতে জেলার রাজনৈতিক কর্মীদের অগ্রযাত্রা। মণি সিংহ, খােকা রায়, রবি নিয়ােগী, পুলিন বকশী, জ্যোতিষ বসু, ললিত সরকার, ওয়ালী নেওয়াজ খান, হেমন্ত ভট্টাচার্য, আব্দুল বারী এবং এমনই আরও বহু নাম, যাদের নেতৃত্ব গ্রামাঞ্চলে জাগরণের জোয়ার বয়ে আনে। বাঙালির মুক্তিসনদ ৬-দফা আন্দোলন সংগঠনের ব্যাপারে আইয়ুবী। দুঃশাসনের দিনগুলােয় এ জেলারই কৃতী সন্তান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিক উদ্দিন ভূঞা প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকা এ দেশের ইতিহাসের গতিপথে বৈপ্লবিক প্রেরণা জুগিয়েছিল। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডের অভ্যন্তরে ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহের ছাত্রনেতা সুখেন ভট্টাচার্য করুণ মৃত্যুর শিকার হন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে ময়মনসিংহের শঙ্খমণিসহ নাম না-জানা বীরের রক্তধারা যুক্ত হয়ে ময়মনসিংহের রাজনৈতিক অঙ্গনকে তখন চাঙা করে তুলেছিল। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরশাসক আরােপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শােভাযাত্রার নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
তারপর জনতা আসাদের রক্তমাখা লাশ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য মুখােমুখি লড়েছিল সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে। আসাদের শার্ট সেদিন বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক হয়ে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। এ গণ-অভ্যুত্থানে। প্রকম্পিত হয়েছিল গােটা ময়মনসিংহ অঞ্চল । অনুরূপভাবে ময়মনসিংহের সন্তান আলমগীর মনসুর পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেন। পরবর্তীকালে তার নামানুসারেই প্রতিষ্ঠিত হয় আলমগীর মনসুর মেমােরিয়াল (মিন্টু) কলেজ। এসব অকুতােভয় তেজোদ্দীপ্ত যুবকের জীবন উৎসর্গই সেদিন স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারেরা পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে যখন অসহযােগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম দুর্বার রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তখন ময়মনসিংহেরই এক জনসভায় মওলানা ভাসানী ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলার কথা ঘােষণা করেন। এরও আগে একাত্তরের মার্চের গােড়ায় ময়মনসিংহের বুদ্ধিজীবীসমাজ আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে বৃহত্তর জনতার সাথে একাত্ম। হওয়ার প্রত্যয়ে বুদ্ধিজীবী শিবিরে সংগঠিত হয়েছিলেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে।” – বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এ ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে এ সময় জেলায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ময়মনসিংহ টাউন হলে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, টাঙ্গাইল, |নেত্রকোনা, কিশােরগঞ্জে স্থানীয় নেতারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সংগ্রামী শপথ নিয়ে সালাম জানান। ২৩ মার্চের প্রতিরােধ দিবসে বুদ্ধিজীবী শিবিরের পক্ষ থেকে ইশতেহার বিলি ও পথসভার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
অসহযােগ আন্দোলনের শুরুতে ময়মনসিংহ শহরের সিটি স্কুলে আওয়ামী লীগের এবং মহাকালী পাঠশালায় কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আনন্দমােহন কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, নাসিরাবাদ গালর্স স্কুল, জিলা স্কুল, আখতারুজ্জামান কলেজ ও মিন্টু কলেজের মাঠে প্রশিক্ষণ এবং প্রতিরােধের প্রস্তুতি শুরু হয়। এ প্রশিক্ষণ গ্রহণে মিন্টু কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর। রহমান শহরের সম্ভাব্য স্থানগুলাে থেকে অস্ত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালান। অনুরূপভাবে জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, গৌরীপুর, গফরগাঁও, ভৈরব ও কিশােরগঞ্জ এলাকায় সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট’ কার্যক্রম শুরু হলে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর থেকে ময়মনসিংহে ওয়্যারলেস বার্তা আসে। এ বার্তা পরদিন জেলা সদর, মহকুমা ও থানাপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। অসহযােগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র, স্বেচ্ছাসেবক দল, জয় বাংলা বাহিনী, শ্রমিক-জনতা নির্মম। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাসহ মিছিল বের করে। উল্লেখ্য, ২৩ মার্চ দেশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
প্রতিরােধ যুদ্ধে ময়মনসিংহ
২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ। লাইন ও পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ রাজারবাগ পুলিশ ওয়্যারলেস ও ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ময়মনসিংহ ইপিআর ও পুলিশ লাইনে প্রেরিত হয়। পরদিন সকালে এ সংবাদ জেলা সদরসহ সব মহকুমা ও থানাপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণ বিদ্রোহী হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মােকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৬ মার্চ টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা ও কিশােরগঞ্জ এলাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বান অনুযায়ী প্রতিরােধ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্থানীয় নেতারা ময়মনসিংহ টাউন হল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কিশােরগঞ্জের বিভিন্ন বাড়িতে এবং অফিস-আদালতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সংগ্রামী শপথ। গ্রহণ করেন। জনতা চলমান আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। প্রাথমিক অবস্থাতেই স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের শহর থেকে সরে যেতে শুরু করলেও শহরের রাজনৈতিক নেতারা এবং ছাত্র ও যুবসমাজ পাকিস্তানি বাহিনীর আসন্ন। হামলা প্রতিরােধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণসহ স্থানীয় পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। টাঙ্গাইল সা’দত কলেজ, জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ, নেত্রকোনা কলেজ, কিশােরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ, ভৈরব হাজী আসমত কলেজ, গৌরীপুর কলেজ, গফরগাঁও কলেজ, ময়মনসিংহ মিন্টু কলেজ, আখতারুজ্জামান কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, আনন্দমােহন কলেজ ও ভুয়াপুর কলেজের সংগ্রামী ছাত্ররা রাজনৈতিক নেতাদের। পাশাপাশি থেকে নিজ নিজ এলাকার প্রতিরােধ পরিকল্পনায় নিয়ােজিত হয়। 
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া ও তার সহকর্মীদের পরামর্শ মােতাবেক সিদ্ধান্ত হলাে সিভিল ও পুলিশ লাইন থেকে যেসব অস্ত্র পাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী যুবসমাজের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হবে। টাঙ্গাইলের নেতারা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হাতেম তালুকদার, ব্যারিস্টার শওকত আলী, ড. আলীম আল রাজী, লতিফ সিদ্দিকী, হুমায়ূন। খালেদ, আবদুল রহমান, মােশাররফ হােসেন, শামসুর রহমান খান এবং আরও অনেক নেতার সহযােগিতায় ইপিআর ও পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র দিয়ে। প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও প্রতিরােধ প্রস্তুতি চলতে থাকে। আনন্দমােহন কলেজে অধ্যাপক কফিল উদ্দিন আতাহারের তত্ত্বাবধানে ভিপি আব্দুল হামিদের ব্যবস্থাপনায় ইউওটিসি-এর সমস্ত রাইফেল নিয়ে ক্যাডেট ও তরুণ ছাত্রদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নাসিরাবাদ কলেজ, নাসিরাবাদ গার্লস। স্কুল, জিলা স্কুল, আখতারুজ্জামান কলেজ ও মিন্টু কলেজের মাঠে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান আবুল হাসেম, যুবদলের শামসুদ্দীন (গফরগাঁও), আবুল হােসেন বাদল, ছাত্র ইউনিয়নের প্রদীপ চক্রবর্তী, নজরুল ইসলাম সম্মিলিতভাবে প্রতিরােধের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। অনুরূপভাবে জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, গৌরীপুর, গফরগাঁও, ভৈরব ও কিশােরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ও আজিমউদ্দিন হাই স্কুল মাঠে প্রতিরােধের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অপরদিকে ২৭ মার্চ দুপুর নাগাদ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার সব এলাকায় শুরু হয় প্রতিরােধ প্রস্তুতির সার্বিক প্রক্রিয়া। ময়মনসিংহ শহরের নিকটস্থ খাগডহরে ইপিআর উইং সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল। এ উইং-এর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস। এখানে বেশ কিছু অবাঙালি ইপিআর সদস্য ছিল।
এ ছাড়া এ উইং-এর এনসিও, জেসিওদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। ঢাকার অবস্থা অনুমান করে ইপিআর-এর অবাঙালি সৈনিকেরা বাঙালি ইপিআরদের নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা শুরু করে। বাঙালি ইপিআর-এর সদস্যরা বিষয়টি অনুধাবন করে আন্দোলনরত নেতাদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। ইপিআর সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হবে’- এ সংবাদ প্রচারিত হলে শহর ও গ্রাম থেকে হাজার হাজার জনতা ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করতে শুরু করে। জনতার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অবাঙালিদের আটক করে ময়মনসিংহ শহর শত্রুমুক্ত করা।  স্থানীয় জনগণের মনােভাব অনুধাবন করে ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যরা অবাঙালি সৈন্যদের আক্রমণের পূর্বেই তাদের আটক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনায় ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় বাঙালি ইপিআর সদস্য রেজা, জগলুল শাহ খাগডহর বাজারে এসে ছাত্র-জনতাকে রাত ১১টায় ফাঁকা গুলি করার পরামর্শ দেন, যাতে এ অজুহাতে পাঞ্জাবিদের আক্রমণ করা যায়। তদনুযায়ী স্থানীয় মুক্তি সংগ্রামী শফিউল ইসলাম, মইনুদ্দীন, সােলায়মান, আবদুল হামিদ ও হায়দার আলী ড্রাইভার রাত ১০টার দিকে ভেটেরিনারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সামনে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং রাত ১১টার দিকে সিএসডি গুদামের এক কোণা থেকে শফিউল ও হামিদ বন্দুকের গুলি ছুঁড়লে সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানিরা ফায়ার শুরু করে। সারারাত উভয় দলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। ভােরবেলায় রফিক ভূঁইয়া, শামসুল হক, জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান আবদুল হাশেম, মেডিক্যাল কলেজের ভিপি মাহমুদ, এএম কলেজের ভিপি হামিদ, পুলিশ লাইন স্কুলের শিক্ষক শামসুল আলমসহ স্থানীয় নেতারা জেলখানা ও পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্রগােলাবারুদ নিয়ে বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের সাহায্য করেন।
ছাত্র-জনতা ও ইপিআর-এর সৈনিকেরা একসময় অস্ত্রাগারের দেয়াল ভেঙে অস্ত্রশস্ত্র জনতার মধ্যে বিতরণ করেন। ২৮ মার্চ সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ মূল যুদ্ধ শেষ হলে সমস্ত ইপিআর ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এ অঞ্চলে অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের অনেকে নিহত হয় এবং কিছুসংখ্যক বন্দি হয়। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের গৃহীত অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনায় তাদের প্রধান টার্গেট ছিল বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলােকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। পাকিস্তানি বাহিনীর এ হামলার মুখে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাে দুর্ভেদ্য প্রতিরােধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে অবস্থানরত ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে ২৮ মার্চ টাঙ্গাইল, মুক্তাগাছা হয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ২৯ মার্চ ময়মনসিংহে পৌছে। মেজর শফিউল্লাহর উপস্থিতিতে ২৯ মার্চ ময়মনসিংহ শহরে প্রতিরােধসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার, ইপিআর-এর জেসিও, এনসিও, নির্বাচিত এমএনএ, এমসিএ, ছাত্রনেতা এ যৌথ বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে মেজর শফিউল্লাহর উপর যুদ্ধপরিকল্পনা ও পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ময়মনসিংহ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশের সমস্ত পথ রুদ্ধ করার বিষয়টি এ বৈঠকের প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল।
স্থানীয় এমএনএ, এমসিএরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, খাদ্য সরবরাহ ও সিভিল প্রশাসনের দায়িত্ব নেন। বৈঠকে স্থানীয় পুলিশ, ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যােগাযােগের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ইপিআর সৈনিকেরা সংগঠিত হয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে। ২৯ মার্চ স্থানীয় নেতাদের সাথে আলােচনার পর মেজর কে এম শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বিকাল ৪টায় ময়মনসিংহ সিটি হলে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব পদবির সৈনিকেরা একত্র হয়ে। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে শপথ গ্রহণ করেন। মেজর শফিউল্লাহ এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। একই দিনে বিশাল জনতার উপস্থিতিতে মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে আনুষ্ঠানিকভাবে। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। জনগণ নতুন উদ্দামে সংগ্রামী শপথে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একত্র হয়। ৩০ মার্চ মেজর শফিউল্লাহর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি দিকনির্দেশনাসহ একটি লিফলেট বিলি করা হয়।  ৩০ মার্চ রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, শামসুল হকসহ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের সাথে একত্র হয়ে ভারতের করইতলী এলাকায় ৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক কর্নেল রাংগাজান ও ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ত্যাগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য বিএসএফ-এর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সাহায্য চান।
বিএসএফ অফিসারগণ কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে অস্ত্র-গােলাবারুদপ্রাপ্তি ভারত সরকারের সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এভাবে ময়মনসিংহ এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের সংগঠিত করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধ গড়ে তােলে। ৩০ মার্চ রাতে রেলযােগে মেজর শফিউল্লাহ ঢাকা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে নরসিংদীর পথে যাত্রা করেন। একই সময় ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে সুবেদার ফরিদের ইপিআর কোম্পানি ভৈরব হয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের আগমনে বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসী বিশেষত টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কিশােরগঞ্জ এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা যতটা আশান্বিত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রস্থানে সাময়িকভাবে হলেও অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন।  ৩১ মার্চ স্থানীয় ভিত্তিতে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরােধের প্রয়াস হিসেবে ভৈরব, কিশােরগঞ্জ, নান্দাইল, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, মধুপুর, মুক্তাগাছা, কালিহাতি, টাঙ্গাইল, মির্জাপুর এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী যুব প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে ওঠে। অজ্ঞাত অথচ সম্ভাব্য পাকিস্তানি হামলা প্রতিরােধ করার জন্য সামান্য কয়েকটি রাইফেল কিংবা কার্তুজ ও বন্দুক নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের মহড়া শুরু হয়। একই সময় স্থানীয় জনতা তাদের ঘরের পুরােনাে রামদা, বল্লম, তীর, ধনুক এ যুদ্ধ মহড়ার কাজে ব্যবহার করে। ঢাকা দখলের পর পাকিস্তানি সেনারা যে অন্যান্য শহরাঞ্চলে আঘাত হানবে, এ কথা বুঝতে স্থানীয় নেতাদের একটুও দেরি হয়নি। শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বৃহত্তর ময়মনসিংহের রেলপথে, সড়কপথ ও শহরের রাস্তায় রাস্তায় নানা ধরনের ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।
বহু স্থানে সড়ক কেটে নালা তৈরি করা হয়। গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলা হয়। কোথাও ছােটোখাটো সেতু ভেঙে ফেলা হয় এবং অনেক স্থানে রেললাইন উপড়ানাের চেষ্টা চলে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম টার্গেট ছিল টাঙ্গাইল । ঢাকা থেকে মর্টারকামানেসজ্জিত প্রায় ১০০ গাড়ি পাকিস্তানি সৈন্য ২ এপ্রিল টাঙ্গাইলের পথে রওনা দেয়। ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইলের নাটিয়া পাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ প্রতিরােধ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সমরশক্তির কাছে বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইলে প্রবেশের পর ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিরােধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বিশেষ করে মধুপুরের বনাঞ্চল প্রতিরােধের জন্য উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল কয়েকটি গাড়ি করে। মধুপুরের কাছাকাছি আসে। এ এলাকায় মাত্র ২২জন ছাত্রের একটি দলের। অবস্থান ছিল। এ দলটি আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ। করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন ট্রাক ড্রাইভার ও একজন জিপ ড্রাইভার মারা যায়। পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য সেদিন পিছু হটে। এ ঘটনার পর পরই ইপিআর ও ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত ৫০৬০জনের একটি দল রাইফেল ও এলএমজি নিয়ে মধুপুর এলাকায় পৌছালে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
১৪ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে একই পথে অগ্রসর  হলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে শত্রুপক্ষ ১টি ট্রাক, ১টি জিপ, ৪০টি অটোমেটিক রাইফেল, ১৫০ বাক্স গুলি, মর্টার শেল এবং কিছু মৃতদেহ ফেলে ঘাটাইল কালিহাতি পর্যন্ত পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু অসংগঠিত মুক্তিযােদ্ধাদের এ প্রতিরােধ দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ১৫ এপ্রিল মধুপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক গােলাবর্ষণ ও বিমান হামলার মুখে মুক্তিযােদ্ধারা বাধ্য হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইল অবস্থান থেকে ময়মনসিংহ বা জামালপুর পৌছাতে নানাভাবে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। টাঙ্গাইলের সংগ্রামী নেতারা বাছিত সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ হুমায়ূন খালেদ, হাতেম আলী তালুকদারসহ অন্যান্যদের সহযােগিতায় কালিহাতি ও মধুপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে সর্বাত্মক প্রতিরােধ গড়ে তােলার প্রয়াস চালায়।
পাকিস্তানি বাহিনী মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে ১৫ এপ্রিল ভৈরবে উপস্থিত হয় এবং সেখান থেকে কিশােরগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাস্তব অবস্থায় এ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রতিরােধব্যবস্থা জোরদার করা সম্ভব ছিল না। তথাপি স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা দলবদ্ধ হয়ে গচিহাটা-যশােদল এলাকায় রেল ও সড়কসেতু ভেঙে দেন এবং কালিকাপ্রাসাদ এলাকায় রেললাইন উপড়ে ফেলে। এসব বাধা পার হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ১৮ এপ্রিল কিশােরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি মধুপুর ও কালিহাতিতে প্রতিরােধের প্রয়াস ছিল নানামুখী প্রয়াসসমন্বিত। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন নেতাসহ কাদের সিদ্দিকী, ময়মনসিংহের ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবীরা, জিয়াউল হকের অধীন ইপিআর বাহিনী, শ্রীবর্দী থেকে জমিরউদ্দিন সরকার প্রেরিত আনসার দল এবং ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ মিলে ৩-৪টি ইউনিট গঠিত হয়। ৫-১৭ এপ্রিল পর্যন্ত এসব দল বিভিন্নভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী স্থলপথে বাধাগ্রস্ত হয়ে জনগণকে আতঙ্কিত এবং শহরাঞ্চল জনমানবহীন করার। উদ্দেশ্যে বিমানবাহিনীর মাধ্যমে ১৭ এপ্রিল গফরগাঁও, শম্ভুগঞ্জ ও জামালপুর ফেরিঘাটে বােমাবর্ষণ করে এবং বিমান থেকে মেশিনগান দিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে গফরগাঁওয়ে ৩০জন, শম্ভুগঞ্জে ৪-৫জন এবং জামালপুরে বেশ কয়েকজন শহিদ এবং বহু আহত হন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় গয়েশপুর-কাওরাঈদ এলাকার ছাত্রনেতা, রাজারবাগ-পিলখানা থেকে আসা পুলিশ-ইপিআর এবং ময়মনসিংহ থেকে প্রেরিত ইপিআর-ছাত্র-আনসার-মুজাহিদের মিলিত শক্তি কাওরাঈদের নিকটবর্তী নদীর উত্তর পাড়ে গয়েশপুর এলাকায় প্রতিরােধ ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৯-২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী রেলযােগে কাওরাঈদ রেল স্টেশনে পৌছামাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আবুল বাশার ও নায়েব সুবেদার মােশাররফের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর এলএমজি, মর্টার, রকেট লঞ্চারসমৃদ্ধ আক্রমণ প্রতিরােধ করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণপণ চেষ্টা চালান। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ ও আহত হওয়ার পর বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একসময় বাধ্য হয়ে মুক্তিযােদ্ধা দল পশ্চাদপসরণ করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে এটিই ছিল শেষ প্রতিরােধ যুদ্ধ। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি মধুপুর ও কালিহাতিতে প্রতিরােধের প্রয়াস ছিল নানামুখী প্রয়াসসমন্বিত। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন নেতাসহ কাদের সিদ্দিকী, ময়মনসিংহের ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবীরা, জিয়াউল হকের অধীন ইপিআর বাহিনী, শ্রীবর্দী থেকে জমিরউদ্দিন সরকার প্রেরিত আনসার দল এবং ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ মিলে ৩-৪টি ইউনিট গঠিত হয়। ৫-১৭ এপ্রিল পর্যন্ত এসব দল বিভিন্নভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী। স্থলপথে বাধাগ্রস্ত হয়ে জনগণকে আতঙ্কিত এবং শহরাঞ্চল জনমানবহীন করার উদ্দেশ্যে বিমানবাহিনীর মাধ্যমে ১৭ এপ্রিল গফরগাঁও, শম্ভুগঞ্জ ও জামালপুর ফেরিঘাটে বােমাবর্ষণ করে এবং বিমান থেকে মেশিনগান দিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে গফরগাঁওয়ে ৩০জন, শম্ভুগঞ্জে ৪-৫জন এবং জামালপুরে বেশ কয়েকজন শহিদ এবং বহু আহত হন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় গয়েশপুর-কাওরাঈদ এলাকার ছাত্রনেতা, রাজারবাগ-পিলখানা থেকে আসা পুলিশ-ইপিআর এবং ময়মনসিংহ থেকে প্রেরিত ইপিআর-ছাত্র-আনসার-মুজাহিদের মিলিত শক্তি কাওরাঈদের নিকটবর্তী নদীর উত্তর পাড়ে গয়েশপুর এলাকায় প্রতিরােধ ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৯-২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী রেলযােগে কাওরাঈদ রেল স্টেশনে পৌছামাত্র ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আবুল বাশার ও নায়েব সুবেদার মােশাররফের। নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর এলএমজি, মর্টার, রকেট লঞ্চারসমৃদ্ধ আক্রমণ প্রতিরােধ করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণপণ চেষ্টা চালান। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ ও আহত হওয়ার পর। বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একসময় বাধ্য হয়ে মুক্তিযােদ্ধা দল পশ্চাদপসরণ করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে এটিই ছিল শেষ প্রতিরােধ যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যের অবস্থান
১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর একটিমাত্র ডিভিশনের অবস্থান ছিল। ১৪ পদাতিক ডিভিশন নামে পরিচিত এ ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল ঢাকায়। এ ডিভিশনের অধীনস্ত ৪টি বিগ্রেডের অবস্থান ছিল যথাক্রমে-৫৭ পদাতিক ব্রিগেড ঢাকায়, ৫৩ পদাতিক ব্রিগেড কুমিল্লায়, ১০৭ পদাতিক ব্রিগেড যশােরে এবং ২৩ পদাতিক ব্রিগেড রংপুর সেনানিবাসে। এ সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর সৈন্য অবস্থান বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বিন্যাস আত্মরক্ষা কিংবা আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল অনুযায়ী ছিল না। এ বাহিনীর মূল্য লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর সামরিক শাসনের আদেশ ও নির্দেশ বলবৎ রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ১৪তম পদাতিক ডিভিশনের ব্রিগেডগুলাের অধীনস্ত ইউনিটগুলাের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫টি রেজিমেন্ট কর্মরত ছিল এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ছিল বাঙালি। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সামরিক প্রশাসকদের কাছে এ বাঙালি সংখ্যাধিক্য সেনাবাহিনী দিয়ে বাঙালিদের উপর সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করা সহজতর হবে না বলে বিবেচিত হয়। যার ফলে অসহযােগ আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলােচনার আড়ালে পাকিস্তানি শাসক কর্তৃপক্ষ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দুই ডিভিশন অবাঙালি সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে। | ১ মার্চ থেকে শুরু করে ২৫ মার্চের মধ্যে বিমানযােগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৯ম এবং ১৬তম পদাতিক ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়।
পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের নির্দেশিত অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনায় পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র জনগণ, বাঙালি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ সদস্যদের উপর আক্রমণ চালায়। অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ: অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নে সৈন্য বাটোয়ারা ঢাকা কমান্ড ও কন্ট্রোল: মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, সামরিক আইন সদর দপ্তর জোন বি। সৈন্য ৫৭ ব্রিগেডের সদর দপ্তর, ঢাকায় অবস্থিত সৈন্য, ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজ মােঃ খান জিএসও-১ (ইন্টিলিজেন্স) দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ২২ বালুচ রেজিমেন্ট, ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ১৩ হালকা অ্যাক-অ্যাক রেজিমেন্ট, ৩। কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের ১টি কোম্পানি (কুমিল্লা থেকে) এসে যােগদান করে।
দায়িত্ব
ক, নিরস্ত্রীকরণের মাধ্যমে ২য় ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর সদর দপ্তর, পিলখানা (২,৫০০) ও রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশদের (২,০০০) নিরপেক্ষকরণ। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, ট্রান্সমিটার, রেডিও ও টিভি স্টেশন এবং স্টেট ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার ও তাদের ঠিকানাসহ তালিকা প্রণয়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ যথা: ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, লিয়াকত হল (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ।
শহর সিল করা। সড়ক, রেল ও নদীপথের যােগাযােগ বন্ধ করা। নদীতে টহলের ব্যবস্থা করা। চ, গাজীপুরের অস্ত্রকারখানা ও রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্রাগার রক্ষা করা। বাকি অঞ্চল ১৪ ডিভিশনের সদর দপ্তর। অধিনায়ক মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা। এবং ১৪ ডিভিশনের অধীন। রাজশাহী সৈন্য : ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। সিও লে. কর্নেল শাফকাত বালুচ। দায়িত্ব ক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। খ, রিজার্ভ পুলিশ ও ইপিআর-এর সেক্টর সদর দপ্তরের লােকজনকে নিরস্ত্রীকরণ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। ঘ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার।
যশোের
সৈন্য সদর দপ্তর ১০৭, ২৫ বালুচ রেজিমেন্ট, ২৪ ফিল্ড রেজিমেন্টের। উপকরণ, ৫৫ ফিল্ড রেজিমেন্ট। দায়িত্ব ক. ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর-এর সেক্টর সদর দপ্তর, রিজার্ভ পুলিশ ও আনসারদের নিরস্ত্রীকরণ। খ. যশাের শহর পুনরুদ্ধার এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার। গ. টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও যােগাযােগব্যবস্থা দখল। ঘ. সেনানিবাসের চতুর্দিকের নিরাপত্তা বিধান, যশাের শহর, যশাের-খুলনা সড়ক ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধান। ও, কুষ্টিয়ার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অচল করা। চ. প্রয়ােজনে খুলনায় সৈন্য সমাবেশ ঘটানাে। খুলনা। সৈন্য : ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট। দায়িত্ব ক. খুলনা শহরের নিরাপত্তা বিধান। খ. টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেডিও স্টেশন দখল। গ, ইপিআর-এর উইং সদর দপ্তর, রিজার্ভ কোম্পানি ও রিজার্ভ পুলিশকে নিরস্ত্রীকরণ। ঘ. আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাত্র এবং কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার । রংপুর-সৈয়দপুর সৈন্য : ২৩ ব্রিগেড সদর দপ্তর, ২৯ ক্যাভেলরি রেজিমেন্ট, ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট। দায়িত্ব। ক. রংপুর-সৈয়দপুর শহরের নিরাপত্তা বিধান। খ. সৈয়দপুরস্থ ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিরস্ত্রীকরণ।
যদি সম্ভব হয়, দিনাজপুরের সেক্টর দপ্তর ও রিজার্ভ কোম্পানিকে সীমান্ত ফাড়িগুলােয় প্রহরারত সৈনিকদের সমাবেশ ঘটিয়ে নিরস্ত্রীকরণ। ঘ, রংপুরের রেডিও স্টেশন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল। ঙ. রংপুরের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার ।
চ, বগুড়ার অস্ত্রাগার দখল। কুমিল্লা। সৈন্য ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ১.৫ ইঞ্চি মর্টার ব্যাটারি, স্টেশন ট্রপস, ৩। কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন।
দায়িত্ব 
ক, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর-এর উইং সদর দপ্তর ও জেলা  রিজার্ভ পুলিশ নিরস্ত্রীকরণ। শহরের নিরাপত্তা বিধান এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার । গ. টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল। সিলেট সৈন্য : ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। দায়িত্ব। ক. রেডিও স্টেশন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল। খ. সুরমার উপর সেতুর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। গ. এয়ারফিল্ড দখল। ঘ. আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার। ঙ, পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী নিরস্ত্রীকরণ। চট্টগ্রাম সৈন্য ২০ বালুচ রেজিমেন্ট, ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে একটি মােবাইল কলাম কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম যাবে এবং চূড়ান্ত দিনে মূল বাহিনীকে রাত ১২টায় শক্তিশালী করবে। ইকবাল শফির সাথে থাকবে ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, টুপ হেভি মর্টার, ফিল্ড কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার্স। দায়িত্ব ক. ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও রিজার্ভ পুলিশ নিরস্ত্রীকরণ। খ. কেন্দ্রীয় পুলিশের অস্ত্রাগার দখল। গ. রেডিও স্টেশন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল। ঘ. নেভি কমােডর মমতাজ, ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও শায়াগগীরের সাথে যােগাযােগ। উ. বিগ্রেডিয়ার মজুমদার ও ইবিআরসি-এর সি আই চৌধুরীকে গ্রেপ্তার। চ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গৃহীত অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম শিকার হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসমূহ, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী আক্রমণের প্রথম প্রহরে সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলার আপামর জনগণের সর্বাত্মক প্রতিরােধের পুরােভাগে এসে দাঁড়ায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাে। নিরস্ত্র জনতার সাথে একত্র হয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকিস্তানি বাহিনী অধিক সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে আরও ২টি ডিভিশন গড়ে তােলে। ৩৬ ও ৩৯ ডিভিশন নামের এ ২টি ডিভিশন ছিল অস্থায়ী প্রকৃতির। পশ্চিম পাকিস্তান রেঞ্জার্স, পাঞ্জাব পুলিশ ও মিলিশিয়া সৈন্যদের সমাবেশ ঘটিয়ে এ ডিভিশনের সৈন্যঘাটতি পূরণ করা হয়। মােটামুটিভাবে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত সকল ডিভিশনের পুনর্গঠনকাজ সম্পন্ন করে। ডিভিশনগুলাের সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছিল গােলন্দাজ ও ভারি মর্টার রেজিমেন্ট ও ট্যাংক বহর। ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরের অবস্থান ছিল। সমগ্র বাংলাদেশ ছিল এর অধীনস্থ এলাকা।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ছিল: ডিভিশন ৫টি, ব্রিগেড ১৩টি, পদাতিক রেজিমেন্ট ৩৯টি, আর্টিলারি রেজিমেন্ট ১২টি, ট্যাংক রেজিমেন্ট ১টি, কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন ২টি, পশ্চিম পাকিস্তান রেঞ্জার ইউনিট ৬টি, আজাদ কাশ্মীর রিজার্ভ ফোর্স ২টি, মুজাহিদ ইউনিট ৫টি, অসামরিক সশস্ত্র ইউনিট ১৭টি। মােট সৈন্যসংখ্যার মধ্যে নিয়মিত সৈন্য ৮০ (আশি) হাজার, পশ্চিম পাকিস্তান রেঞ্জার্স ও মিলিশিয়া ২৪ (চব্বিশ) হাজার, অসামরিক সশস্ত্র বাহিনী ২৪ (চব্বিশ) হাজার, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস্ ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার। 
যুদ্ধের
কৌশল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানকে মােটামুটি ৪টি পৃথক সেক্টরে বিভক্ত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। নিমে যুদ্ধের সেক্টরগুলাের বৃত্তান্ত প্রদান করা হলাে ১, উত্তর-পশ্চিম সেক্টর : যমুনার পশ্চিম এবং পদ্মার উত্তরের অঞ্চল ছিল উত্তর-পশ্চিম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। সেক্টরের আওতাধীন জেলাগুলাে ছিল: রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী এলাকা। এ ডিভিশনের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় বগুড়ায় এবং অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন মেজর জেনারেল নাজির হােসেন শাহ। তাঁর অধীন ৩টি পদাতিক ব্রিগেড (২৩, ৩৪, ২০৫) ও ১টি অ্যাডহক ব্রিগেডসহ ২৯। ক্যাভেলরি রেজিমেন্ট, ৪৮ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ৮০ ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ১১৭ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্যাটারি যুদ্ধরত ছিল।
২. পশ্চিম সেক্টর পদ্মার দক্ষিণ ও পশ্চিম এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল পশ্চিম সেক্টর। এ সেক্টরের জেলাগুলাে ছিল: কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশাের, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী। এ সেক্টরে মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯ম পদাতিক ডিভিশনকে মােতায়েন করা হয়। এ সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল যশাের। এ ডিভিশনের ২টি পদাতিক ব্রিগেড ছিল (৫৭, ১০৭) এবং ১টি অ্যাডহক পদাতিক ব্রিগেড ছিল এ ডিভিশনের প্রধান শক্তি। উত্তর সেক্টর উত্তর সেক্টর গঠিত হয়েছিল ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে। ৩৬ পদাতিক ডিভিশনকে এ সেক্টরে মােতায়েন করা হয়। এর সদর দপ্তর ছিল ঢাকা এবং অধিনায়ক। ছিলেন মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদ খান। এ ডিভিশনের ৯৩ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল ময়মনসিংহ। অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদির খান। তার দায়িত্বের আওতায় ৮৩ ইন্ডিপেন্ডেন্ট মর্টার ব্যাটারি কামালপুর, ময়মনসিংহ; ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ, ফুলপুর, হালুয়াঘাট; ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট জামালপুর, রাজেন্দ্রপুর, হাতিবান্ধা, দেওয়ানগঞ্জ, টাঙ্গাইল; ৭০ উইং রেঞ্জার্স ময়মনসিংহ, কিশােরগঞ্জ; ৭১ রেঞ্জার্স জারিয়া, ঝাঞ্জাইল, শিবগঞ্জ, বিরিশিরি ও বিজয়পুরে নিয়ােজিত ছিল। পূর্ব সেক্টর মেঘনার পূর্ব পার্শ্বের এলাকা নিয়ে গঠিত পূর্ব সেক্টরের জেলাগুলাে হচ্ছে সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম।
এ সেক্টরে ছিল ১৪ ডিভিশন ও ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন। ১৪ পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ খান। এ ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল কুমিল্লায় । ডিভিশন অধিনায়কের অধীন ২৭, ২০২, ৩১৩ পদাতিক ব্রিগেডসহ ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ৮৮ ইন্ডিপেন্ডেট মর্টার ব্যাটারি এবং ১৭১ ইন্ডিপেন্ডেট মর্টার ব্যাটারি নিয়ােজিত ছিল। অপরদিকে, ৩৯ পদাতিক ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল চাঁদপুরে। এর অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল রহিম খান। এ ডিভিশনের অধীন ৫৩, ৯১ ও ১১৭ পদাতিক রেজিমেন্টসহ ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল। এ ছাড়া ব্রিগেডিয়ার আতা মােহাম্মদ খানের অধীন ৯৭ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রাম। এর দায়িত্বপূর্ণ এলাকার মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও কক্সবাজার। এ ছাড়া ঢাকা প্রতিরক্ষা অঞ্চল ৫টি এলাকায় বিভক্ত ছিল। পশ্চিম এলাকায় কর্নেল ফজলে হামিদ, উত্তর এলাকায় ব্রিগেডিয়ার কাশেম, পূর্ব এলাকায় ব্রিগেডিয়ার মনসুর এবং ঢাকা শহর এলাকায় ব্রিগেডিয়ার বশির আহমদ নিয়ােজিত ছিলেন। সৈন্য বাহিনীতে ব্যাটম্যান, কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার, অর্ডিন্যান্স, সিগন্যাল, ইএমই ও এএমসি-এএসসি মিলিত সৈন্যের মােট ১২টি কোম্পানি। ছিল। এ ছাড়াও ছিল পূর্ব পাকিস্তান সিভিল আমর্ড ফোর্সের ১,৫০০ সদস্য, পুলিশ বাহিনীর ১,৮০০ সদস্য এবং রাজাকার বাহিনীর ৩০০ সদস্য।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড