You dont have javascript enabled! Please enable it! টাঙ্গাইল জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
টাঙ্গাইল জেলা
বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, বহুকাল পূর্বে টাঙ্গাইল ছিল আসাম কামরূপ অঞ্চলের অধীন। টাঙ্গাইল জেলার ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়, যার এক স্থানের সাথে অপর স্থানের কোনাে সংগতি নেই। ভূমির গঠনও নানা প্রকারের। মধুপুর গড় অঞ্চল ব্যতীত টাঙ্গাইল অঞ্চলের মৃত্তিকা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পলি অবক্ষেপণ দ্বারা সৃষ্ট। সুপ্রাচীনকাল থেকেই অসংখ্য নদনদীর শাখা-প্রশাখায় পরিকীর্ণ এ অঞ্চল গড়ে উঠেছে নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে। যে কারণে বৈচিত্র্যও পরিলক্ষিত হয় নানা স্থানের মৃত্তিকার গঠনে। ভূতত্ত্ব বিভাগের জরিপে এ অঞ্চলের মৃত্তিকাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
ক, পুরাতন পলিজ অবক্ষেপণ অঞ্চল
খ, আন্তঃনদী অববাহিকা অঞ্চল। 
গ. নদী অবক্ষেপণ অঞ্চল।
টাঙ্গাইলের ভূমি অতি প্রাচীন। জেলার অধিকাংশ এলাকা বিশেষত মধুপুরের ভূমি লাল মাটিতে গঠিত। জেলার অধীনস্থ বিভিন্ন স্থানে প্রত্নকীর্তির নিদর্শন পরিলক্ষিত হলেও এ যাবৎকাল অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংসাবশেষগুলাে চিরদিনের জন্য বিলুপ্তপ্রায়। জেলায় পুরাকীর্তির মধ্যে অন্যতম ঝরকা হলাে ঘাটাইল থানা সদরের ৩ কিলােমিটার পূর্ব দিকে মধুপুর গড়ের প্রায় লাগােয়া একটি বিচিত্র প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ। চারদিকে ক্ষুদ্র জলাশয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ইমারতটির অবস্থান। ঝরকার উত্তর পাশে সমতল পাহাড়ের উপর প্রায় ৫ একর ভূমির উপর।
বৃহৎ অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়, যা বর্তমানে মাটির নিচে চলে গেছে। বর্তমানে ঐ স্থান কৃষিভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখানে এককালে রাজবাড়ি ছিল। লােকমুখে জানা যায়, এ বাড়ি ছিল হােড় রাজার বাড়ি। এ জেলায় আটিয়া জামে মসজিদসংলগ্ন পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি বৃহৎ আকারের দীঘি। দীঘিটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। দীঘির বৈশিষ্ট্য হলাে, পাড়ের উপর থেকে দীঘির তলদেশ পর্যন্ত প্রাচীন ইট মৃৎপাতের ভগ্নাংশ দ্বারা আচ্ছাদিত। এ ছাড়া টাঙ্গাইল জেলার পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে হিন্দু পালের গড়, সন্তোষ জমিদারবাড়ি, সাগরদীঘি, গুপ্ত বৃন্দাবন, বারতীর্থ ও অন্যান্য কীর্তি। যদিও তার সবই ধ্বংসাবশেষ। দেশের অন্যান্য জেলার অধিবাসীদের সাথে এ জেলার জনমানুষের জীবনাচার ও সংস্কৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জনপদ থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতি, গােষ্ঠী ও গােত্রের এবং রাজন্যবর্গের শাসনের ফলে এ এলাকায় ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। প্রাচীনকাল থেকেই টাঙ্গাইল নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। টাঙ্গাইলের হস্ত ও কুটিরশিল্পের মধ্যে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, কাগমারীর কাঁসার বাসন, পােড়াবাড়ির চমচম, বাঁশ ও বেতের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। টাঙ্গাইল জেলার আর্থিক জীবন কৃষিভিত্তিক। শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্যে এ জেলা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তারপরও টাঙ্গাইলের শাড়ির কদর দেশজোড়া। মসলিন ও জামদানির পর বাংলাদেশের বস্ত্রখাতে টাঙ্গাইল শাড়ি নতুন মাত্রা যােগ করতে সমর্থ হয়েছে। তাই বলা হয়, “নদীচর খালবিল, গজারির বন/টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন।” প্রকৃতিগত কারণে টাঙ্গাইল একটি বহুমাত্রিক জেলা। কারণ পাহাড়, বনভূমি, সমতলভূমি, চরাঞ্চল, সমুদ্রের মতাে যমুনা, ধলেশ্বরী নদীসহ অজস্র নদী, খালবিল ও সবুজ ফসলের ক্ষেত নিয়ে টাঙ্গাইলের ভূপ্রকৃতি।
আছে গারাে। ও মান্দাই উপজাতি, আছে উচ্চ বর্ণ হিন্দু, নিম বর্ণ হিন্দু, মুসলমান ও হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে কৃষিজীবী মানুষ। এদের কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে নানা লােকসাহিত্য। এর মধ্যে বারােমাসি গান, ধুয়া গান, ভজন, বিচ্ছেদ গান, মরমি। সংগীত, মেয়েলি গীত, জারিগান, সারিগান, বিচারগান, পুঁথি ও বাউলগান উল্লেখযােগ্য। মুহম্মদ তুঘলকের রাজত্বকালে বাংলাদেশ লখনৌতি, সােনারগাঁ ও সাতগাঁও – এ ৩টি এলাকায় বিভক্ত ছিল। সামন্ত শাসিত এলাকা ব্যতীত টাঙ্গাইলের অধিকাংশ অঞ্চল তখন সােনারগাঁ ইতকার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে অনুমান করা হয়।  আলাউদ্দিন হােসেন শাহের আমলে টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকার কিছু কিছু এলাকার শাসনভার তার পুত্র নসরত শাহের হাতে অর্পণ করা। হয়েছিল। তখন থেকেই এ অঞ্চল নসরতশাহী’ নামে পরিচিতি লাভ করে।  মােগল সম্রাট আকবরের আমলে টোডরমলের ব্যবস্থাপনায় মােগল। সাম্রাজ্যকে কয়েকটি সুবায়, সুবাকে সরকারে এবং সরকারগুলােকে পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল। সামান্য কিছু এলাকা সরকার সােনারগাঁ ও সরকার ঘােড়াঘাটের অধীন ব্যতীত বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার অধিকাংশ অঞ্চল তখন সুবা বাংলার বাজুহার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধে নবাব। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সাধিত হয় বহুমুখী। পরিবর্তন। ১৭৭৩ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনকার্যের সুবিধার্ধে বাংলাকে ৫টি বিভাগে ভাগ করা হয় যথা: কলকাতা, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর ও ঢাকা। একই সময় বিভাগগুলােকে ২৮টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। ১৭৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক কাউন্সিল। একই সময় রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি আদালতের কার্যাদি সম্পাদনের জন্য নায়েবের পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রাদেশিক কাউন্সিলকে করা হয় দেওয়ানি আদালতের ‘অ্যাপিলেট অথরিটি’। ১৭৮১ সালে প্রাদেশিক কাউন্সিল বাতিল করে জেলাগুলােয় কালেক্টর ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ােগ করা হয়। এ ব্যবস্থার অধীন মি. ডে সর্বপ্রথম কালেক্টর ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন। বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা তখন ঢাকা কালেক্টরের অধীন ছিল। তখন বিশাল এ জেলার আয়তন ছিল ১৫,৩৯৭ বর্গমাইল। ১৮৪২ সালে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মহকুমাব্যবস্থা চালু করা হয় এবং প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৪৫ সালে ময়মনসিংহ জেলাকে বিভক্ত করে জামালুপর, শেরপুর, হাজিপুর, পিংনা ও সিরাজগঞ্জ থানা সমন্বয়ে জামালপুর। মহকুমা এবং নাসিরাবাদ, গাবতলী, মধুপুর, নেত্রকোনা, ঘােষাগাঁও, ফতেপুর, গফরগাঁও, মাদারগঞ্জ, নিকলি ও বাজিতপুর থানা সমন্বয়ে সদর মহকুমা স্থাপন করা হয়। এ ব্যবস্থায় বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার আটিয়া থানা ঢাকা জেলায়, মধুপুর থানা ময়মনসিংহ সদর মহকুমার এবং অন্যান্য অঞ্চল জামালপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৬৯ সালের ৩ মে আটিয়া, পিংনা ও মধুপুর থানা সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় আটিয়া মহকুমা। পরবর্তীকালে ১৮৭০ সালের ১৫ নভেম্বর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে মহকুমা সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ব্রহ্মনাথ সেন ছিলেন টাঙ্গাইল মহকুমার প্রথম প্রশাসক।
১৮৭২ সালে টাঙ্গাইল মহকুমার আয়তন ছিল ১,০৪১ বর্গমাইল। তখন এ মহকুমায় টাঙ্গাইল, কালিহাতি ও গােপালপুর – এ ৩টি থানা এবং নাগরপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল ও জগন্নাথগঞ্জ – এ ৪টি ফাড়ি থানা ছিল। মধুপুর থানা তখন। ময়মনসিংহ সদর মহকুমার সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরে জগন্নাথগঞ্জ ফাড়ি থানাকে পাবনা এবং মধুপুর থানাকে টাঙ্গাইলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯০৬ সালের ১৬ জুন তদনীন্তন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নাগরপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল ও জগন্নাথগঞ্জ ফাড়ি থানাকে পূর্ণাঙ্গ থানায় রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার থানার সংখ্যা ১১টি। যথা: টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, বাশাইল, মির্জাপুর, সখীপুর, কালিহাতি, ঘাটাইল, মধুপুর, গােপালপুর, ভুয়াপুর ও নাগরপুর । ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের কাছে ময়মনসিংহকে বিভক্ত করে কায়েদাবাদ, নাসিরাবাদ, টাঙ্গাইল ও ইসলামাবাদ নামে ৪টি জেলা স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবে টাঙ্গাইলে জেলা সদর স্থাপন করে। টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ মহকুমা সমন্বয়ে টাঙ্গাইল জেলা প্রতিষ্ঠাসহ গােপালপুরে পৃথক মহকুমা স্থাপনের কথা বলা হয়। ১৯৬৪ সালের ৮ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ কর্তৃক টাঙ্গাইলে পৃথক জেলা স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬৮ সালে ৩৪১ একর জমি হুকুমদখল করে টাঙ্গাইল জেলা সদরের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।
১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল এস। এম আহসান টাঙ্গাইল জেলার শুভ উদ্বোধন ঘােষণা করেন। টাঙ্গাইল জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ এন কলিমুল্লাহ।  ১৮৮৭ সালের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইল পৌরসভা স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে ৫২৫ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে স্থাপিত টাঙ্গাইল পৌরসভার সীমানা ছিল উত্তরে লৌহজং নদের কিছু অংশ, সাবালিয়া, ধুল, দেউলা ও কোদালিয়া কৃষি অঞ্চলের কিছু অংশ। দক্ষিণে কাজিপুর, চরকাজিপুর, বেড়াবুচনা ও ভূতভূরিয়া গ্রাম। পূর্বে টাইট্টা, পয়লাবিল দরাত ও গােলাবাড়িয়া গ্রামগুলাে এবং লৌহজং নদের কিছু অংশ। পশ্চিমে কাবিলাপাড়া, গদুরগাতি ও বিন্নাফৈর গ্রাম। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন জনপদ টাঙ্গাইলের  রয়েছে নানা ঐতিহ্য। ঐতিহ্যবাহী এ জেলায় জন্ম নিয়েছেন বহু মনীষী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। ভৌগােলিক অবস্থানের কারণে এ জেলার মানুষের সাথে সারা দেশের মানুষের রয়েছে সহজ যােগাযােগ এবং রাজধানীর সাথে গড়ে উঠেছে সহজ যােগাযােগব্যবস্থা। টাঙ্গাইল হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার এক অদূরবর্তী জনপদ। বহু ধর্মের মানুষের সুদীর্ঘকাল পাশাপাশি অবস্থান ও বসবাসের ভিতর দিয়ে টাঙ্গাইল জেলা পেয়েছে স্বকীয় সত্তা, ইতিহাস যার সাক্ষ্য প্রদান করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড