You dont have javascript enabled! Please enable it! ময়মনসিংহ জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
ময়মনসিংহ জেলা
আদিতে ময়মনসিংহের নাম ছিল মােমনশাহী। কথিত আছে, মােগল সম্রাট আকবরের সময় মমিনশাহ নামে কোনাে ব্যক্তি মােগল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ বাজুহার এলাকার অধীশ্বর ছিলেন। সেই মমিনশাহ থেকে তার অধীনস্ত মহালের নাম মমিনশাহী হয়েছিল। বস্তুত মােগল আমল থেকে এ সমগ্র অঞ্চলের ইতিহাসের একটি সাধারণ চিত্র পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক আইন-ই আকবরী’। গ্রন্থে মমিনশাহী মহালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ মমিনসাহীর ‘শাহী’ শব্দই লিপি বিড়ম্বনায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিংহ রূপ ধারণ করে ক্রমে বর্তমানে একেবারে ময়মনসিংহে পরিণত হয়েছে। মুসলিম শাসনামলে এ অঞ্চলের ৩টি পরগণার নাম পাওয়া যায়। এগুলাে হলাে আলাপশাহী, মােমেনশাহী ও হােসেনশাহী। প্রথম ২টি বিকৃত হয়ে যথাক্রমে আলাপসিংহ, মৈমনসিংহ হয়েছে। আর ইংরেজদের উচ্চারণ বিভ্রাটের ফলে হয়েছে Mymensingh, Dacca। ইংরেজদের সে অশুদ্ধ উচ্চারণ আজও বদলে যায়নি। ঢাকার Dacca অশুদ্ধ উচ্চারণকে পরিবর্তন করে Dhaka করা হলেও Mymensingh পরিবর্তন করে এখন পর্যন্ত মােমেনশাহী’ বা ময়মনসিংহ’ করার কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। ব্ৰহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা বিধৌত উর্বর মৃত্তিকার এ অঞ্চল বহু নদনদীর খাত পরিবর্তন, মৃত্তিকার রূপবদল ও প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আদি ব্রহ্মপুত্রের পলিজ অবক্ষয়ের দ্বারা গঠিত। জেলার উত্তরে গারাে পাহাড় ও আসামের গােয়ালপাড়া জেলা, পশ্চিমে টাঙ্গাইল জেলা, দক্ষিণে ঢাকা ও গাজীপুর জেলা এবং পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলা অবস্থিত। আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অধিকাংশ অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। শুধু মধুপুর ও ভাওয়ালের বনাঞ্চল সেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরে ক্ষুদ্র ভূখণ্ড ছিল যেখানে আদিম মানবগােষ্ঠী বসবাস করতাে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ অব্দে মেগেস্থিনিসের ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘ইন্ডিকা’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত মানচিত্রে দেখা যায়, ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বভাগ তখন কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে প্রায় ৪০০ বছর সময়কাল পাল রাজারা বঙ্গদেশ শাসন করেন। এ সময় ময়মনসিংহের দক্ষিণ অংশে পাল বংশীয়। তিনজন নৃপতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৩টি রাজ্য শাসন করতেন। একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বীরসেন পাল বংশের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলাে দখল করে নেয়ার ফলে ময়মনসিংহ ও। ঢাকা জেলার পাল রাজাদের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলাের বিলুপ্তি ঘটে। ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলের অরণ্য ভূমিতে কয়েকটি রাজ্যের উদ্ভব হয়। কোচ, হাজং, গারাে প্রভৃতি জনগােষ্ঠী কিশােরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও জামালপুরের অন্তর্গত বিভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করে। এ শতাব্দীর শেষ ভাগে সােমেশ্বর পাঠক কনৌজ থেকে বহু অনুচর সমভিব্যাহারে পূর্ব ময়মনসিংহের গারােদের বিতাড়িত করে রাজ্যের শাসন ক্ষমতা দখল করেন। ১৪৯১ সালে দ্বিতীয় ফিরােজ শাহ বাংলার স্বাধীন সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি তাঁর সেনাপতি মজলিস খাঁকে ময়মনসিংহের উত্তর ভাগে শেরপুর প্রদেশ দখলের জন্য প্রেরণ করেন। শেরপুরের অন্তর্গত গড় দলিপায় তখন দলিপ সামন্ত নামে জনৈক কোচরাজা রাজত্ব করছিলেন। মজলিস খাঁ কর্তৃক দলিপ সামন্ত পরাজিত ও নিহত হন।
তখন শেরপুর প্রদেশে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪৯৮ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ও তাঁর পুত্র নাসির উদ্দিন। নুসরত শাহ ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ কামরূপ বিজয় করেন। নাসির উদ্দিনের নামানুসারেই এতদঞ্চলের নামকরণ করা হয় নাসিরাবাদ। নসরত শাহ। কামরূপের শাসনভার প্রাপ্ত হলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তিনি পূর্বেকার রাজা কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে পূর্ব ময়মনসিংহে আগমন করেন এবং এখানকার শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর শাসন ক্ষমতার অন্তর্গত প্রদেশের নামকরণ করেন নসরতশাহী। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা এ নসরতশাহীর নামান্তর। চতুর্দশ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের পূর্ব প্রান্তস্থ খালিয়াজুরী (এ অঞ্চলটিকে ভাটি নামে অভিহিত করা হতাে) কামরূপে রাজ্যের রাজধানী ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে জিতারী নামক এক সন্ন্যাসী এ অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি দিল্লির বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছে থেকে ভাটি মুলুকের যে পাঞ্জা ফরমান প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাতে এ সন্ন্যাসী বংশকে ভাটির শাসনকর্তা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সে সময় থেকে পূর্ব ময়মনসিংহ আর কামরূপ রাজ্যের অধীনস্থ থাকেনি। এ অঞ্চল সম্রাট আকবরের শাসনামলে সরকার বাজুহা’ এবং পরবর্তী। সময় ইংরেজ শাসনামলে ‘জেলা ময়মনসিংহ’ বলে পরিচিতি লাভ করে। হুসেন শাহ ও নসরত শাহ ময়মনসিংহ অঞ্চলে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
ষােড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে বারাে ভূঁইয়াদের অন্যতম ভাওয়ালের ফজল গাজী স্বাধীনভাবে ভাওয়াল ও পাশাপাশি অপর কয়েকটি পরগণা শাসন করেন। তার পরগণা বুড়িগঙ্গার উত্তর তীর থেকে গারাে পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মােগল শাসনামলে ময়মনসিংহের শাসনভার ঈশা খাঁর উপর অর্পিত ছিল। ঈশা খার শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি বা গােষ্ঠীর অভ্যুত্থানের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল শুরু হয়। সুবা বাংলার রাজধানী তখন জাহাঙ্গীরনগরে। এরপর শাহ সুজা এ অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। শাহ সুজার পলায়নের পর মীর জুমলা বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। এ সময় কোচ রাজা আসাম জয় করে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত অধিকার করেন। সুবেদার শায়েস্তা খাঁর সময়ও বাংলাদেশে আরাকানি মগ ও পর্তুগিজদের এ তৎপরতা অব্যাহত ছিল। তখন বিশেষত পূর্ব বাংলার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ইউরােপ থেকে আগত পর্তুগিজ বণিক ও মিশনারিদের ব্যাপক তৎপরতা ছিল বাংলার ইতিহাসের একটি লক্ষণীয় দিক। এ সময় উপকূলীয় অঞ্চল মগ দস্যুদের লুণ্ঠন, পর্তুগিজ ক্যাথলিক মিশনারিদের অত্যাচার, নিপীড়ন এবং এ দেশের মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ সমগ্র পূর্ববঙ্গের জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। সামাজিক জীবনকে করেছিল অস্থির। পর্তুগিজরা ঢাকার ফিরিঙ্গি বাজার ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রবেশ করে কুঠি নির্মাণ করে। কুঠিগুলাের মধ্যে বাজিতপুর, কিশােরগঞ্জ ও বেগুনবাড়ির কুঠি অন্যতম। পর্তুগিজদের নিপীড়নের সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছিল।
১৭০৩ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হয়ে রাজধানী পুনরায় মকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। এ মকসুদাবাদ পরবর্তী সময় মুর্শিদাবাদ নাম ধারণ করে। সে সময় বর্তমানের বৃহত্তর ময়মনসিংহের উত্তরে ছিল শেরপুর ও সুসঙ্গ, জাফরশাহী, সেলবরস, বড়ােবাজু, আটিয়া, কাগমারী, সুলতান প্রতাপ, আলাপসিংহ, ময়মনসিংহ ও ভাওয়াল; পূর্বে ছিল সরাইল, জয়ানশাহী ও তরফ। মুসলমান রাজত্বের অবসানকালে ঢাকায় ডেপুটি গভর্নরের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের জমিদাররা ঢাকায় রাজস্ব প্রদান করতেন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলার সাথে ঢাকা অধিকার করে। তারা প্রথমে পর্তুগিজ ও অন্যান্য বিদেশি বণিকদের বাণিজ্য কুঠি দখল করে নেয় এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহের বেগুনবাড়িতে ইংরেজরা এক কুঠি স্থাপন করে এবং কিশােরগঞ্জ ও বাজিতপুরের পর্তুগিজ কুঠি দখল করে নেয়।
আঠারাে শতকের শেষ দিকে কোম্পানির গভর্নর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ঢাকায় রেভিনিউ বাের্ড স্থাপিত হয় এবং হুজরি নিজামতের অধীন। আসে। ১৭৮৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ময়মনসিংহে কালেক্টর নিযুক্ত করে। পরে ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ নিযুক্ত করা হয়। কোম্পানির এ পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক হলেও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব পরিদর্শকের পদ উঠিয়ে দিয়ে কালেক্টরের পদ সৃষ্টি করেন। এ সময় দেওয়ানি আদালতের সৃষ্টি হয়। এ আদালত প্রথমে কলকাতায় এবং পরে ১৭৮১ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয়। ১৭৯১ সালে সেহরা। অঞ্চলে পুরােনাে ঐতিহ্য স্মারক হিসেবে নাসিরাবাদ শহর স্থাপিত হয়। এ সেহরাই বর্তমান ময়মনসিংহ শহর। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। এর দুই বছর আগেই ময়মনসিংহে ডাকব্যবস্থা ও পুলিশ স্টেশন চালু হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য স্থানে স্থানে কাচারি স্থাপিত হয়। মফস্বলে বিচার ও শাসনব্যবস্থা জমিদার, ইজারাদার ও সিজয়াল দ্বারাই পরিচালিত হতাে।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সীমাহীন শােষণ, অত্যাচার ও লুণ্ঠন বাংলার জনজীবনে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভূমিভিত্তিক অর্থনীতি কোম্পানির শােষণে ভেঙে পড়ে। একই সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে ভূমি সম্পর্ক এ পটভূমিতে ইংরেজ কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। বাংলায় কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশাল স্থান দখল করে আছে আঠারাে শতকের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩১৮০০)। এ ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঢেউ এসে আঘাত করেছিল তঙ্কালীন ময়মনসিংহ জেলাকে। ১৭৭০-৭২ সালে ফকির (সন্ন্যাসী) বিদ্রোহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে বিস্তৃত হয়। এ সময় ফকির ও সন্ন্যাসী নেতাদের ময়মনসিংহ অঞ্চলে আগমনের মধ্য দিয়ে এখানে কৃষক বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। বিদ্রোহী দল ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করতে থাকে।
ক্রমে ঢাকা জেলার ভাওয়াল পরগণা পর্যন্ত এ বিদ্রোহের বিস্তৃতি ঘটে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের মূল ঘাঁটি ছিল। মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়। বিদ্রোহীরা ১৭৭০-৭৩ সালের দিকে জাফরশাহী। পরগণার নায়েবকে আটক করে ১,৬০০ টাকা আদায় করে। এ সময় ইংরেজ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডের সাথে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়। এ ঘটনার পর ময়মনসিংহ ফকির (সন্ন্যাসী) বিদ্রোহের একটি প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ১৭৭৬ সালে ফকির (সন্ন্যাসী) বিদ্রোহের মূল নায়ক ফকির মজনু শাহ উত্তরবঙ্গ থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে আগমন করেন। ১৭৮৩ সালে মজনু শাহ এক হাজার সশস্ত্র অনুচরসহ ময়মনসিংহে। আগমন করে নতুনভাবে কৃষক বিদ্রোহকে শক্তিশালীভাবে সংগঠিত করেন। এ সময় গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ ও ফকির মজনু শাহকে দমনের জন্য সেনাদল প্রেরণ করেন। মজনু তার বিশাল বাহিনীসহ গ্রামে আত্মগােপন করেন। তখন ইংরেজ সেনাদল ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত হয়ে বিদ্রোহী দলের অনুসন্ধান করতে থাকে। ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে কৃষকেরা উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার কুঠি লুণ্ঠন করতে থাকে। ১৭৯০ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলে ফকির (সন্ন্যাসী) বিদ্রোহ কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যায় । ময়মনসিংহের ইতিহাসে আঠারাে শতকের গারাে বিদ্রোহ একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ১৭৭৫ সালের দিকে ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের গারাে উপজাতি তাদের নেতা ছাপাতির নেতৃত্বে স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সহজসরল ও পরিশ্রমী গারাে উপজাতির বিদ্রোহের মূল কারণ হলাে জমিদারগণ কর্তৃক ঐ অঞ্চলের জমি দখল এবং তাদের চিরায়ত জীবনধারায় হস্তক্ষেপ।
ব্রিটিশ সরকারের সহযােগিতায় স্থানীয় জমিদাররা অত্যন্ত নৃশংসভাবে এ বিদ্রোহ দমন করেন। ১৭৯০ সাল থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে একটানা খরা, বন্যা ইত্যাদি চলতে থাকে। ফলে কোম্পানির রাজস্ব আদায়ে সমস্যা দেখা দেয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলিত হওয়ার পর জমিদারদের শােষণের মাত্রা বহুলভাবে বেড়ে যায়। একটানা দুর্ভিক্ষ ও জমিদারদের শােষণের বিরুদ্ধে ১৮১২ সালে সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। কোম্পানির সরকার কঠোরভাবে এ বিদ্রোহ দমন করে। এ সময় কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে হাজং বিদ্রোহ বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইতিহাসে এ বিদ্রোহ ‘হাতিখেদা বিদ্রোহ’ নামে সমধিক পরিচিত। সুসঙ্গ দুর্গাপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। উনিশ শতকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায় হলাে গারাে বিদ্রোহ। ব্রিটিশ শাসন ও জমিদারদের শােষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে গারাে বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮৩৭ সালে এবং ১৮৮২ সাল পর্যন্ত একটানা চলতে থাকে। এ বিদ্রোহ দমনের জন্য স্থানীয় জমিদারদের সহায়তায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এ অঞ্চলে পুনঃপুনঃ গারাে উপজাতিদের উপর হামলা চালায়। গারাে সম্প্রদায় তাদের প্রচলিত ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে বীরত্বের সাথে মােকাবিলা করে। পরিশেষে ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ সরকার এ বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়।
ইংরেজ সরকার ১৮৫০ সালে বাংলাদেশে স্থানীয় শাসন প্রবর্তন করে। ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল নাসিরাবাদ, জামালপুর, শেরপুর, কিশােরগঞ্জ ও বাজিতপুরে পৌরসভা স্থাপিত হয়। ১৮৭৫ সালের অক্টোবরে মুক্তাগাছা এবং ১৮৮৭ সালের ১ জানুয়ারি নেত্রকোনা ও ১৮৮৭ সালের ১ জুলাই টাঙ্গাইলে পৌরসভা স্থাপিত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকার বলে পৌরসভার সভাপতি ছিলেন এবং অন্য সদস্যরা জনগণের মধ্য থেকে নির্বাচিত হতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ময়মনসিংহ জেলায় ১৭৮৭ সালের ১ এপ্রিল কালেক্টর পদে মি, রটনকে নিয়ােগ করে এবং ১৭৮৭ সালের ১ মে ময়মনসিংহ জেলা স্থাপিত হয়।
ইংরেজ আমলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছিল একটি জেলা। এ জেলার কিশােরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ সদর প্রতিটি ছিল একটি মহকুমা। প্রতিটি মহকুমাই পৌর এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়া বাজিতপুর আর ভৈরব বাজার ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের ২টি পুরাতন পৌর এলাকা। পাকিস্তান আমলে টাঙ্গাইল একটি পৃথক জেলা হিসেবে ময়মনসিংহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বাংলাদেশ হওয়ার পর জামালপুর পৃথক জেলায় পরিণত হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কিশােরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও শেরপুর পৃথক পৃথক জেলায় পরিণত হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ বর্তমানে ৫টি জেলা যথা: ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশােরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও জামালপুর জেলায় বিভক্ত। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার থানাগুলাে হলাে: ধােবাউড়া, হালুয়াঘাট, ফুলপুর, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, গফরগাঁও, ভালুকা, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা ও ময়মনসিংহ সদর। পরিশেষে বলা যায়, নানা ঐতিহ্যমণ্ডিত ময়মনসিংহ জেলা এ দেশের বৃহত্তর জেলা হিসেবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমলিন। উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রশাসনিক প্রয়ােজনে এ জেলার বিভক্তি অনিবার্য। হয়ে উঠলেও এর উত্তরাধিকারের একটি অখণ্ড স্মৃতি বিদ্যমান। ভৌগােলিক অবস্থানের কারণে এ জেলার মানুষের সাথে সারা দেশের মানুষের এক নিবিড় যােগাযােগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে ময়মনসিংহ পেয়েছে এক স্বকীয় সত্তা, ইতিহাস। যার সাক্ষ্য প্রদান করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড