বায়তুল মােকাররম অপারেশন
বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে ১১ নভেম্বর এক বিস্ফোরণ ঘটে। এ অপারেশনে। অংশগ্রহণ করেন গেরিলা আসাদ (বর্তমানে তিনি নিয়মিত টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন), ফিরােজ, ফেরদৌস, আরিফ, জন, সহর, মুরির, জাহেদ ও বাবু (বর্তমানে টেলিভিশনে ক্যামেরাম্যান হিসেবে চাকরিরত)। এ অপারেশনের জন্য সিদ্বেশ্বরী এলাকায় বসবাসকারী লুই অ্যান্ড ডুসেল ডফ কোম্পানির ১জন কর্মচারীর বাড়ি থেকে ১টি ভক্সহল গাড়ি কেড়ে নেয়া হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ, সেফটি ফিউজ পুড়তে পুড়তে নিভে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বার বেলা আড়াইটার সময় গেরিলারা আবার ফিরে এসে বায়তুল মােকাররমে ফ্যান্সি হাউজের সামনে গাড়ি পার্ক করেন। তখন ফ্যান্সি হাউজের সামনে ৬জন পাকিস্তানি সেনা কলা কিনছিল এবং ফ্যান্সি হাউজের মধ্যে গােয়েন্দা বিভাগের মেজর ফতেহ মােহাম্মদ মালিক কয়েকজন অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গ কেনাকাটা করছিল। আসাদ ছাড়া বাকি সবাই গাড়ি থেকে নেমে যান এবং আসাদ সিগারেট খাওয়ার ভান করে সেফটি ফিউজ জ্বালিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। দেড় মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল সমস্ত এলাকা। এ অপারেশনে ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং কয়েকজন অফিসার হতাহত হয়। ১জন আহত মহিলাকে কোলে নিয়ে মেজর ফতেহ মালিক ফ্যান্সি হাউজ থেকে বেরিয়ে আসছে – এ ধরনের ১টি ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনী সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত অপারেশন নির্দেশনামা (Operational Instructions) না এলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (Eastern Commond – EASTCOM) মে মাস থেকেই আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। সড়ক ও রেল। যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং টেলিফোন যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে রাজ্যসরকারগুলাের সাহায্য নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। ভৌত অবকাঠামাে উন্নয়ন ছাড়া এ অঞ্চলে ভারতীয়দের পক্ষে প্রস্তুতিপর্ব শুরু করা সম্ভব হচ্ছিল না, বিশেষ করে ত্রিপুরা রাজ্যে। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে সে সময় যে সেনা ফরমেশন ছিল, তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় (NEFA – North East Frontier Area) চীন সীমান্ত পাহারা দেওয়া এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলােতে (সাত বােন বা Seven Sisters নামে খ্যাত) পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং সশস্ত্র বাম রাজনীতির উত্থান দমন করা। ভুটানের উপর সম্ভাব্য চীনা আগ্রাসন রােধ করাও ছিল পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্ব। ভৌগােলিকভাবে এ অঞ্চলগুলাে পাহাড় ও পর্বতসংকুল হওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনস্ত ফরমেশনগুলাে ছিল মাউন্টেন ডিভিশন। যার অর্থ এ ডিভিশনগুলাের আর্টিলারি গানগুলাে সহজে বহনযােগ্য (অংশগুলাে খুলে গাধা বা খচ্চরের পিঠে) প্যাক হাউইটজার এবং স্বভাবতই এগুলাের ক্যালিবার ছিল কম, এ ক্ষেত্রে ৭৬ মিলিমিটার এবং ২৫ পাউন্ড। সেতু তৈরির কোনাে সরঞ্জাম (Bridging Equipment) ছিল না।
বিভিন্ন ধরনের গাড়ির প্রাধিকার ছিল সাধারণ ফরমেশনের চেয়ে বহু কম। এসব প্রতিকূলতা ছাড়াও অস্ত্র, সেতু তৈরির সরঞ্জাম, অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ, ম্যাপ ইত্যাদি সমস্যা ছিল ব্যাপক। সর্বোপরি বাংলাদেশে সামরিক অভিযান পরিচালনার সময় নিয়ে ভারত সরকার ও ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী ঐক্যমতে পৌছতে পারে নি শুরুর দিকে। চীনের আক্রমণ সম্ভাবনা তিরােহিত করতে ডিসেম্বর মাসে অভিযান : পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় চীন ভারত সীমান্ত উঁচু বরফে আচ্ছাদিত থাকে। এ অবস্থায় গােটা এলাকা সামরিক অপারেশনের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযােগী হয়ে যায়। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জুন মাসে অপারেশন। নির্দেশনামার খসড়া সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে প্রেরণ করা হয় অনুমােদনের জন্য। অনুমােদিত অপারেশন নির্দেশনামা পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পায় ১৬ আগস্ট। বিভিন্ন ফরমেশনের সঞ্চালন শুরু হয়। সিকিম থেকে ৩৩ কোর আসে। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকা থেকে ৪ কোর আনা হয় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে, সিলেটের বিপরীত থেকে ফেনী নদীর বিপরীত পর্যন্ত। ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তরপূর্বে ধর্মনগরে স্থাপিত হয় সদর দপ্তর। আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ যােগাযােগকারী রেললাইনের শুরু ধর্মনগর থেকে অর্থাৎ ধর্মনগর ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের একমাত্র এবং শেষ রেল স্টেশন। আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরায় নিয়ােজিত বিভিন্ন ফরমেশন ও ইউনিটগুলােকে প্রশাসনিক ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে শিলিগুড়িতে অবস্থিত ১০১ কমিউনিকেশন জোনকে আসন্ন অভিযানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডকে এর অধীনস্থ করা হয়।
প্রয়ােজনীয় ফরমেশন চূড়ান্ত অভিযানের জন্য পূর্বাঞ্চলে আনার পর আরও ১টি কোর সদর দপ্তরের প্রয়ােজন দেখা দেয়। ৩১ অক্টোবর ২ কোর গঠন করা হয় এবং এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয় পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে। অপারেশন জ্যাকপটের (Op-Jackpot) আওতায় ভারতীয় ৬টি সেক্টরের প্রতিটির অধীনে ১টি/২টি পদাতিক ইউনিট দিয়ে এবং মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের বিভিন্ন ভূমিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ফিল্ড ফরমেশনে রূপান্তর করা হয়। চূড়ান্ত অভিযানের পরিকল্পনায় এ ৬টি সেক্টরকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর সেক্টর ট্রপসদের এ অপারেশন পরিকল্পনায় অজ্ঞাত কারণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। ১০টি সেক্টরের সেক্টর অধিনায়কগণ চূড়ান্ত অভিযানের সময় তাঁদের মতাে করে যুদ্ধ করেন সেক্টর ট্রপসদের নিয়ে। | প্রচলিত যুদ্ধের জন্য গঠন করা হয় ৩টি ফোর্সেস ব্রিগেড – ‘এস’ ফোর্স। ব্রিগেড, ‘কে’ ফোর্স ব্রিগেড ও ‘জেড’ ফোর্স ব্রিগেড। ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে মেঘালয় রাজ্যের তুরা শহরের প্রায় ১০ কিলােমিটার উত্তরপশ্চিমে তেলঢালা নামের এক পাহাড়ি বন এলাকায় ব্রিগেড তৈরির কার্যক্রম শুরু হয় মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। এ ৩টি ব্রিগেডের প্রথম ব্রিগেডটির গঠনপ্রক্রিয়া শেষ হয় ৭ জুলাই। গােপনীয়তার স্বার্থে এ ব্রিগেডের নামকরণ। করা হয় ১ আটিলারি ব্রিগেড। ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম। দেওয়া হয় যথাক্রমে ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, অধিনায়ক মেজর মইনুল। হােসেন চৌধুরী, ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল এবং ৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, অধিনায়ক মেজর এ জে এম আমিনুল হক। মেজর জিয়াউর রহমানকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্যাংকে পদোন্নতি দিয়ে এ ব্রিগেডের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।
সেপটেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আরও ২টি ব্রিগেড গঠন করা হয়। ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের হাজামারাতে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরােনাে সৈনিক এবং গণযােদ্ধাদের নির্বাচন করে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২টিকে নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী মােহাম্মদ সফিউল্লাহর কমান্ডে গঠিত হয় এ ব্রিগেড। ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন যথাক্রমে মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী ও মেজর আবু সালেহ মােহাম্মদ নাসিম।
ত্রিপুরার মেঘালয়ে সদর দপ্তর স্থাপন করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে গঠিত হয় আরও ১টি ব্রিগেড। গণযােদ্ধাদের প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরােনাে সৈনিকদের নিয়ে ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনর্গঠন করা হয় । ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অপর ১টি ব্রিগেড গঠন সমাপ্ত হয়। ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন যথাক্রমে মেজর আবদুল গফফার হালদার, মেজর মাে. আইনুদ্দিন ও মেজর জাফর ইমাম। | সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩জন ব্রিগেড অধিনায়কের ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে ব্রিগেড ৩টি নামকরণ করা হয় ‘এস’ ফোর্স, ‘জেড’ ফোর্স ও ‘কে’ ফোর্স। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ‘কে’ ফোর্স অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মােশাররফ ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ছােটো ব্যারেলের ৬টি ৩.৭ ইঞ্চি প্যাক হাউইটজার সংগ্রহ করেন। সদর দপ্তর ৫৭ মাউন্টেন আর্টিলারি ব্রিগেডের ৫৯ মাউন্টেন আর্টিলারি রেজিমেন্ট থেকে এ গানগুলাে ইস্যু করা হয়। এ রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডি সিলভা।
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপটেন আবদুল আজিজ পাশার অধিনায়কত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ত্রিপুরার কোনাবনে ৬টি গান দিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রথম আর্টিলারি ‘মুজিব ব্যাটারি’ গঠিত হয়। মুজিব ব্যাটারি পরবর্তী সময় কে’ ফোর্সের ৪ ও ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিভিন্ন যুদ্ধে সফলতার সাথে কার্যকরী ফায়ার সাপাের্ট প্রদান করে। | সেপটেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আসামের ভারতীয় সেনানিবাস মাছিমপুর থেকে নির্দেশিত হয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কাজী সাজ্জাদ আলী জহির ৬টি ১০৫ মিলিমিটার প্যাক হাউইটজার সংগ্রহ করে গানারদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। গানগুলাে ৪ নম্বর সেক্টরের কুকিতল ক্যাম্পে এনে ২ ফিল্ড ব্যাটারি আর্টিলারি গঠন করা হয়। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপটেন এ এম রাশেদ চৌধুরী এ ইউনিটের অধিনায়ক মনােনীত হন। অপর অফিসার ছিলেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। ২ ফিল্ড ব্যাটারি আর্টিলারি ৪। নম্বর সেক্টরের ‘জেড’ ফোর্সের ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুদ্ধে অত্যন্ত সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, এই ব্যাটারিটি বড়ােলেখা, শমসেরনগর, জুরি, কুলাউড়া, ফেঞ্চুগঞ্জ, মংলাবাজার এবং সিলেট শহরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং দুই বার প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর তরফ থেকে প্রশংসা বাণী প্রাপ্ত হয়। চূড়ান্ত অভিযানে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর ৩টি ব্রিগেডকে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে নিয়ােজিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে উদ্দেশ্যে ৫ ও ৬ অক্টোবর ‘জেড’ ফোর্সকে তেলঢালা থেকে সিলেটের সীমান্ত এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। সিলেটের উত্তর সীমান্ত থেকে দক্ষিণে পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি কাপ্তাই এলাকা ছাড়া গােটা চট্টগ্রাম সীমান্তের দায়িত্বে ছিল ভারতীয় ৪ কোর ।
৮, ৫৭ ও ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন নিয়ে গঠিত এ কোরের একেকটি ডিভিশনের অধীনে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর একেকটি ব্রিগেড ন্যস্ত করা হয়। ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীন ‘জেড’ ফোর্স, ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীন ‘এস’ ফোর্স এবং ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীন ‘কে’ ফোর্স। ২২ অক্টোবর ‘কে’ ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মােশাররফ কসবার কাছে কমলাসাগরে, কপালে প্রিন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হন। ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আর ডি হীরার নির্দেশে ডিভিশনের রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৪ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সাথে মিজোরাম এলাকায়। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিয়ােজিত ২টি রূপান্তরিত (Modified) ব্যাটালিয়ন ৩১ জাট ও ৩২ মাহার রেজিমেন্টকে একত্র করা হয়। এ ৪টি পদাতিক ব্যাটালিয়নের সাথে আরও ১টি বিএসএফ ব্যাটালিয়ন, ১টি সিআরপি (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ) ব্যাটালিয়ন, ১টি মাউন্টেন রেজিমেন্ট, ‘মুজিব ব্যাটারি এবং বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ১টি বিএসএফ পােস্ট গ্রুপ যােগ করা হয়। এ বাহিনীর নাম দেওয়া হয় কিলাে (Kilo) ফোর্স।
আগরতলার শালবাগান এলাকায় অবস্থিত ভারতীয় ‘ডি’ (ডেন্টা) সেক্টরের। অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংকে ‘কিলাে’ ফোর্সের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি তার সামরিক সুনাম ক্ষুন্ন হবে’ – এ যুক্তি দেখিয়ে এ বাহিনীর অধিনায়কত্ব গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। পরে আগরতলার অদূরে অবস্থিত কাউন্টার ইনসারজেন্সি স্কুলের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপকে এ বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। চূড়ান্ত অভিযানের সময় ‘কিলাে’ ফোর্সকে ফেনী হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কক্সবাজার এলাকা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা যেন বার্মায় পালিয়ে। যেতে না পারে, এজন্য তড়িঘড়ি করে একটি উভচর অপারেশনের (Amphibious Operation) আয়ােজন করে ভারতীয় বাহিনী। উভচর। অপারেশনের জন্য প্রয়ােজন বিশেষ প্রশিক্ষণ, বিশেষ জাহাজ ও বিশেষ। সরঞ্জামাদি। এর কোনােটাই ভারতীয়দের ছিল না। কক্সবাজারের উখিয়া অঞ্চলে জাহাজ থেকে সৈন্য অবতরণের পরিকল্পনা করা হয়। এ এলাকাটি রেকি করা হয় নি এবং এলাকাটি সম্বন্ধে ভারতীয়দের ধারণাও ছিল অস্বচ্ছ। কেবল মানচিত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে অপারেশনটির পরিকল্পনা করা হয়।
৮ মাউন্টেন আর্টিলারি ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এস এস রায়কে এ অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। এ সদর দপ্তরটি ছিল ২ কোরের অধীন। যাহােক, ব্রিগেডিয়ার রায়কে ১-৩ গাের্খা রেজিমেন্ট, ১১ বিহার রেজিমেন্টের ২ কোম্পানি এবং ১ ব্যাটারি মাউন্টেন আর্টিলারি দেওয়া হয়। নৌবাহিনী থেকে ১৫০জন নাবিকও এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। তারা শেষ অবধি। এসে পৌছায় নি। এ বাহিনীর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় রােমিও’। সমুদ্রগামী অসামরিক বাণিজ্যিক জাহাজ ‘বিশ্ব বিজয় দিয়ে এ বাহিনীর। কলকাতা বন্দর ত্যাগ করার কথা ছিল ১০ ডিসেম্বর । তারা ত্যাগ করে ২ দিন। পর, ১২ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর গভীর সমুদ্রে বাহিনীটিকে বাণিজ্যিক জাহাজ ‘বিশ্ব বিজয় থেকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আইএনএস গিলদার ও আইএনএস ঘড়িয়ালে স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে কক্সবাজার উপকূলে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনােও হদিস পাওয়া যায় নি। অপারেশনটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড