You dont have javascript enabled! Please enable it!
উত্তরের আক্রমণ ও ছত্রীসেনা অবতরণ
 
বহু চেষ্টা ও ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার পর কামালপুরের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা। অবস্থানের পতন ঘটানাে সম্ভব হয় ৪ ডিসেম্বর। ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড কামালপুর-জামালপুর অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করে জামালপুর অবরােধ করে ৭ ডিসেম্বর। অবশেষে জামালপুরের পতন ঘটে ১১ ডিসেম্বর। ব্রিগেডটি ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে পরদিন ১২ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর সেনাসদর থেকে ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের ২টি ব্রিগেড ১৬৭ ও ৫-এর অপারেশন। নিযুক্তির অনুমােদন আসে। কিন্তু ততক্ষণে এ ২টি ব্রিগেডের ব্যবহারের কোনাে অবকাশ ছিল না। ব্রিগেড ২টি ব্যবহার করা গেলে জামালপুরকে অবরুদ্ধ রেখে অন্তত ৩ দিন আগে ঢাকা পৌছানাে সম্ভব হতাে। এর মধ্যে ১১ ডিসেম্বর বিকালে টাঙ্গাইলের পুংলীতে ২ প্যারাশুট ব্যাটালিয়ন অবতরণ করে। প্যারাশুট ব্যাটালিয়নটির ১টি কোম্পানি ৩ ডিসেম্বর পশ্চিম রণাঙ্গনে। স্থানান্তরিত হয়। এফ-জে সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংয়ের অধীন ৬ বিহার রেজিমেন্ট ন্যস্ত করা হয়। তিনি ৬ বিহার এবং ১১ সেক্টরের। মুক্তিবাহিনী নিয়ে দুর্গাপুর-ময়মনসিংহ অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করেন।  কামালপুর ও জামালপুর পতনের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায়। মােতায়েনকৃত পাকিস্তানি ৯৩ পদাতিক ব্রিগেড বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা অভিমুখে। পশ্চাদপসরণ শুরু করে। প্রায় প্রতিরােধহীন অগ্রাভিযানে ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা এবং ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লের সাথে ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে সমবেত হন। ভৈরব বাজারে শত্রু দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ২৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও ভগ্নাংশগুলাে একত্র করে শেষ শক্তি সঞ্চার করে রাখেন।
ভৈরব বাজার আক্রমণে ভারতীয় বাহিনীর সমূহ ক্ষতি হয়। তারা অতঃপর ভৈরব বাজারের শত্রুকে অবরুদ্ধ রেখে দক্ষিণ দিক থেকে মেঘনা নদী অতিক্রমের পরিকল্পনা করে। মেঘনার পশ্চিম পাড়ে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের কারণে নদী অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছিল না। পিটি-৭৬ উভচর ট্যাংক প্রশস্ত মেঘনা নদী পার হতে গিয়ে ইঞ্জিন অত্যধিক গরম হয়ে ইঞ্জিন সিজ হওয়ার দশা হয়।  এমআই-৪ হেলিকপটারে পারাপার শুরু হয় ৯ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টায়। হেলিকপটটারে কিছু ইনফ্যান্ট্রি সৈন্যকে মেঘনার পশ্চিমে অবতরণ করা। সম্ভব হয়। অবতরণকৃত সৈন্যরা শক্ৰবেষ্টিত হয়ে ভীতির মধ্যে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ১৪টি হেলিকপটারের মধ্যে ৭-৮টির বেশি কখনােই। ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায় নি। এ সমস্যাটি পূর্বে বিবেচনায় আনা হয় নি। অবশেষে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ছােটো হেলিকপটার অ্যালুয়েট-৩ বিস্ময়কর। ঘটনা ঘটায়। নিচু দিয়ে উড়ে এসে রকেট ক্ষেপণের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। নিরাপদ হয় অবতরণকৃত ভারতীয় সৈন্যরা। গ্রামের লােকজন দেশি নৌকা করে ভারতীয় সৈন্যদের তাদের। সরঞ্জামসহ পার করে দেয়। ১১ ডিসেম্বর হেলিকপটারের সাহায্যে সেনা অবতরণের মাধ্যমে নরসিংদী। দখল করা হয়। এ সৈন্যরা রিকশায়, দেশীয় যানবাহনে ও সাইকেলে চড়ে ১৩ ডিসেম্বর শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে পৌছে। এদের কিছু অপরিকল্পিতভাবে এবং অসংগঠিতভাবে পরদিন ১৪ ডিসেম্বর শীতলক্ষ্যা অতিক্রম করে। এরা কেউই ঢাকা পৌছতে পারে নি। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের কলাম টঙ্গীর দিকে অগ্রসর হতে সমর্থ হলেও ঢাকা শহরের পতন ঘটাবার মতাে আঘাত হানতে পারে নি। ১৪ ডিসেম্বর রাতে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের কিছু পদাতিক সৈন্যকে চাঁদপুর থেকে ফেরি করে দাউদকান্দির অপর পারে বাসায় পৌছে দেয়। ক্রমে। তারা বৈদ্যের বাজার (বর্তমানে সােনারগাঁও) এলাকায় সংগঠিত হয়।
আর্টিলারি ও যানবাহন আনতে না পারার কারণে এরা আর ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে পারে নি। ৩৩ কোর পশ্চিম দিক থেকে ঢাকা পৌছার চেষ্টা করে। কিন্তু যমুনা নদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়। সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের বাস্তবতা বিবর্জিত নির্দেশ এবং মাঠে যুদ্ধরত সেনা নায়কদের মধ্যে ভুল। বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয় ঢাকা দখল নিয়ে। ১৩ ডিসেম্বর যখন ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব দিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন জেনারেল মানেকশ আদেশ দেন ফেলে আসা শহর দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা দখল করতে। শেষ পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড তাদের ঢাকা দখলের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আমেরিকা তার প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডে অবস্থিত সপ্তম নৌবহর থেকে শক্তিশালী জাহাজের ১টি বহর বঙ্গোপসাগরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নৌবহরের নাম দেওয়া হয় টাস্ক ফোর্স-৭৪’। অপারেশনের নাম দেওয়া হয়। “ওহ্ ক্যালকাটা’ (Oh Calcutta)। নৌবহরে ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম আণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ (USS Enterprise)। এতে লােকবল ছিল ৫,০০০ বিমান ছিল ৭৫টি আর ছিল ৫টি হেলিকপটার। টাস্ক ফোর্স-৭৪-এ আরও ছিল ৩টি গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার। ইউএসএস কিং (USS King), ইউএসএস ডেকাটুর (USS Decatur) এবং ইউএসএস ফারসন্স (USS F), ৪টি গান ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস বাউসেল (USs Bausell), ইউএসএস অরলেক (USS Orleck), ইউএসএস মিউকিন (Uss Mukean) এবং ইউএসএস অ্যান্ডারসন (USS Anderson)। ২৫টি মেরিন অ্যাসল্ট হেলিকপটারবাহী জাহাজ ইউএসএস ত্রিপােলি (USS Tripoli) সহ ২ কোম্পানি মেরিন সৈন্য ছিল এ নৌবহরে। তা ছাড়া ছিল আনুষঙ্গিক সরবরাহ জাহাজ (Supply Ships) ও তেলবাহী জাহাজ (Naval Oiler)। | টাস্ক ফোর্স-৭৪-কে প্রথম দেখা যায় ১৩ ডিসেম্বর ভাের ৪টায় মালাক্কা প্রণালি দিয়ে ভারতমহাসাগরে ঢুকতে। এর অধিনায়ক ছিলেন রিয়ার। অ্যাডমিরাল ডি ডব্লিউ কুপার (Rear Admiral D W Cooper)।
এ নৌবহর বাংলাদেশ থেকে বিদেশি বিশেষ করে আমেরিকান নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য পাঠানাে হচ্ছে বলে আমেরিকা ঘােষণা করে। টাস্ক ফোর্স৭৪-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে যুদ্ধরত ভারতীয় বিমানগুলােকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া, ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ আইএনএস ভিক্রান্তকে (INS Vikrant) বাংলাদেশ উপকূল বঙ্গোপসাগর থেকে সরিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় নৌ অবরােধ ভেঙে দেওয়া। এসবই করার জন্য শক্তি প্রয়ােগের সমূহ ব্যবস্থা ছিল। আদতে পাকিস্তানকে রক্ষা করার অথবা সাহায্য করার যে উদ্দেশ্য আমেরিকার ছিল, এ। ছিল তার সর্বশেষ বাহ্যিক প্রদর্শন। টাস্ক ফোর্স-৭৪-এর ভারতমহাসাগরে আগমন ভারতীয়দের আতঙ্কিত করে তােলে। আমেরিকার এ বিশাল শক্তি মােকাবিলার সামান্য শক্তিও ভারতের নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী। সংগ্রামরত জনতা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভের চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়ে। বাস্তবে আমেরিকার ভারতমহাসাগরে টাস্ক ফোর্স-৭৪ প্রেরণ রাশিয়ানদেরও। তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বাধ্য করে। এ দুই পক্ষ এক পর্যায়ে কেবল । আঙুলের চাপ প্রয়ােগের অপেক্ষায় থাকে যার একটিই আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের। সূচনার জন্য যথেষ্ট ছিল। শেষ অবধি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাই আমেরিকাকে টাস্ক ফোর্স-৭৪ ব্যবহার থেকে বিরত রাখে।
শেষ অঙ্ক
সামরিক শক্তিতে বিজয়ী হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নিয়াজী ত্যাগ করে ৬ ডিসেম্বর যখন তার ১৬টি স্যার জেটের ১টিও উড্ডয়নের উপযুক্ত রইল না । এবং বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে বলা হলাে ‘শতকরা ৭৫জন নিহত না হওয়া পর্যন্ত। পশ্চাদপসরণ করা চলবে না। এমনই অবস্থায় নিয়াজি একটির পর একটি বার্তা পাঠাতে থাকেন ইয়াহিয়া ও তার চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ। খানকে সামরিক সাহায্যের আবেদন জানিয়ে। এসব বার্তার উত্তরে আসে। কেবলই মিথ্যা আশ্বাস, সমবেদনা আর দোয়া। নিয়াজী অবশেষে তাঁর মর্যাদাহানিকর আত্মসমর্পণকে অপেক্ষাকৃত কম অমর্যাদাকর করার চেষ্টায় ব্রত ছিলেন। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তান তার শেষ সম্মানটুকু হারিয়ে (পশ্চিম) পাকিস্তান দখল বা ভাঙন রােধে চিন্তিত থাকে। | ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ২৫ মিনিট (আনুমানিক) লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা, পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চীফ এবং লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, (প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, জোন বি এবং অধিনায়ক, ইস্টার্ন কমান্ড পাকিস্তান)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘আত্মসমর্পণ দলিল’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ। করে। জয় হয় স্বাধীনতার, জয় হয় মুক্তিকামী জনতার। সৃষ্টি হয় বহু কাক্সিক্ষত । দেশ – বাংলাদেশ।
 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!