ভারতীয় সেনাদের মহিশাষুরায় হেলিড্রপ অপারেশন
সাধারণ
৩ ডিসেম্বরের পরবর্তী সময় থেকে দেশের সর্বত্র ভারতীয় সেনাদের সহায়তায় চূড়ান্ত আক্রমণ বা ফাইনাল অফেনসিভ অপারেশন শুরু হয়। মহিশাম্বুরায় ভারতীয় সেনাদের হেলিড্রপ ছিল তারই অংশ।
উদ্দেশ্য
রায়পুরা থেকে ঢাকা অভিমুখে অগগামী ‘এস’ ফোর্স এবং ৩১১ মাউন্টেন। ব্রিগেডকে অগ্রিম সহায়তার নিমিত্তে নরসিংদী সদরকে মুক্ত করা।
যুদ্ধের স্থান ও সময়সীমা
সঠিক তারিখ পাওয়া যায় নি। তবে ড. মুহাম্মদ তােফাজ্জল হােসেনের মতে, ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বর সকালের দিকে ‘হর খাবিরা গােরস্থান’-এ (স্থানটি মহিশাম্বুরার ১০০ গজ উত্তরে এবং শালিদা গ্রামের ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত) ভারতীয় সেনাদের হেলিড্রপ অপারেশন পরিচালিত হয়।
পরিস্থিতি
আনুমানিক ১২ অথবা ১৩ ডিসেম্বর ‘এস’ ফোর্সের ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড একত্রে পড্রজে রায়পুরা থেকে ঢাকা মুক্ত করার নিমিত্তে শীতলক্ষা নদী অভিমুখে অগ্রাভিযান শুরু করেছিল। তারই লিংক অপারেশন হিসেবে ৪ কোরের আওতাধীন ৪র্থ গার্ড রেজিমেন্টের হেলিড্রপ অপারেশনটি নরসিংদী সদর থানাস্থ হর খাবিরা গােরস্থান এলাকায় ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বর শুরু হয়, যাতে মিত্রবাহিনী ঢাকা অভিমুখে দ্রুত যাওয়ার সময় পথিমধ্যে নরসিংদী সদর এলাকায় কোনােরূপ বাধাগ্রস্ত না হয়।
যুদ্ধের বর্ণনা
উল্লিখিত দিনে সকালের দিকে হঠাৎ করে নরসিংদী শহরের দক্ষিণ-পূর্ব আকাশে মহিশামুরার এলাকায় ভারতীয় সেনাদের ৭টি হেলিকপটার এসে উড়তে থাকে এবং পরবর্তী সময় হর খাবিরা গােরস্থানে হেলিড্রপের মাধ্যমে সেনাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে গ্রামের সাধারণ জনগণ সন্ত্রস্ত্র হয়ে এদিক-ওদিক ছােটাছুটি করতে থাকে। এমতাবস্থায় ড. তােফাজ্জল হােসেন ভারতীয় সেনাদের পােশাক চিনতে পেরে সামনে এগিয়ে আসেন এবং ভারতীয় সেনারা তাকে জিজ্ঞাসা করে যে, খাটেহারা ও পাঁচদোনা ব্রিজ কোন দিকে। তার দিক নির্দেশনা পেয়ে ভারতীয় সেনারা ২টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যথাক্রমে খাটেহারা ও পাঁচদোনা ব্রিজের দিকে যেতে থাকেন। পথিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সাথে ভারতীয় সেনাদের ছােটোখাটো যুদ্ধ হতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সেনারা যেখানে শক্ত বাধা বা স্ট্রং রেজিসটেন্স পেয়েছিল, সে সমস্ত জায়গায় তারা হেলিকপটারের সাহায্য নিয়েছিল এবং হেলিকপটার থেকে পাকিস্তানি সেনাদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছিল।
ফলাফল
ঐ যুদ্ধে আনুমানিক ৩-৪জন ভারতীয় সৈন্য আহত হয়। অন্যদিকে, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের হতাহতের পরিমাণ ছিল প্রচুর। যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি সেনাদের ভারতীয় সেনারা সাথে করে নিয়ে যায়। তবে রাজাকারদের ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া হয় স্থানীয় জনসাধারণের উপর। মূলত নরসিংদী সদর ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর মুক্ত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, ভারতীয় সেনা: দ্রুততা, আকস্মিকতা ও সুচারু পরিকল্পনা ভারতীয় সেনাদের জয় নিয়ে এসেছিল। খ. পাকিস্তানি বাহিনী: ভারতীয় পূর্বপরিকল্পনা সম্পকে পাকিস্তানি বাহিনী মােটেই ওয়াকিবহাল ছিল না। এমনকি তাদের কাছে তা অননুমেয়। ছিল। ভারতীয় সেনাদের হেলিড্রপিংয়ের পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনী অ্যান্টি-হেলিবর্ন অপারেশন করে নি অথবা করার সুযােগ পায় নি।
টিঅ্যান্ডটি ভবন রেইড
যুদ্ধের স্থান ও সময়
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর আনুমানিক দুপুর অথবা বিকালের দিকে নরসিংদী। বাস স্ট্যান্ড থেকে ১ কিলােমিটার উত্তরে এবং রেল স্টেশন থেকে ৮০০ গজ দক্ষিণে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টিঅ্যান্ডটি ভবনে (যেখানে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি বেইস ক্যাম্প ছিল) উল্লিখিত রেইডটি সংঘটিত হয় ।
যুদ্ধের বর্ণনা
বস্তুত ভারতীয় সেনাদের হেলিড্রপ অপারেশনের ফলে নরসিংদী সদর ১২ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত হয়ত পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে ব্যাপারটি সঠিকরূপে মেনে নিতে পারে নি। এহেন পরিস্থিতিতে মজনু মৃধার ১টি দল, মনিরুজ্জামানের ১টি দলসহ সদর থানার অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা একত্রে (মােট ৫০-৬০জনের ১টি দল) চারদিক থেকে টিঅ্যান্ডটি ভবনটি ঘিরে। ফেলেন। এদিকে মজনু মৃধা উচ্চ কণ্ঠে বার বার পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, “দেশ মুক্ত হয়ে গেছে এবং আমরা তােমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছি। অতএব তােমরা আত্মসমর্পণ করাে।” এক পর্যায়ে ঐ বেইস ক্যাপটির সবাই মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং পরবর্তী সময়। তাদের ভারতীয় সেনাদের কাছে যুদ্ধবন্দি হিসেবে হস্তান্তর করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের একত্রে নেয়া সম্ভব হয় নি, বিধায় কিছু সংখ্যক যুদ্ধবন্দিকে ইদ্রিস মােল্লার দলের কাছে রেখে যাওয়া হয় (ইদ্রিস মােল্লার। ভাষ্য মতে) এবং তাদেরকে পরবর্তী সময় দেড় মাস নরসিংদী থানাতে যুদ্ধবন্দি হিসেবে রেখে দেওয়া হয়।
ফলাফল
ঐ ঘটনাটিতে কোনাে পক্ষেরই কোনােরূপ গুলি খরচ হয় নি এবং কোনাে দলেরই কোনােপ্রকার হতাহত হয় নি। ঐ ক্যাল্পটি নরসিংদী সদরে পাকিস্তানি। সেনাদের বেইস ক্যাল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতাে এবং ধরে নেয়া যায় যে, শত্রুর সকল প্রকারের অপরাধমূলক কাজের পরিকল্পনা এবং এ ক্যাম্পেই মুক্তিবাহিনীর সর্বপ্রকারের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতাে। পরবর্তী সময় ঐ ক্যাম্প থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে রেইড
যুদ্ধের স্থান ও সময়
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৭টার সময় চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে (যা নরসিংদী বাস স্ট্যান্ড থেকে ২ কিলােমিটার পশ্চিমে এবং সাহে প্রতাপ মােড় থেকে ২.৫ কিলােমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত) মুক্তিবাহিনী কর্তৃক রেইড করা হয়। পটভূমি চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে ১টি স্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেছিল। বস্তুত এ ক্যাপটি ছিল নরসিংদী শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু। ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী শহর এলাকা মুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও ঐ ক্যাম্পটিতে পাকিস্তানি সেনাদের ডিউটিরত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। যুদ্ধের বর্ণনা। তাজুল ইসলাম মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক মনিরুজ্জামানকে সংবাদ প্রদান করেন। যে, নরসিংদী শহর মুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও পাকিস্তানি সেনারা চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি দখল করে আছে। সংবাদ পাওয়া মাত্রই মনিরুজ্জামান ঐ ক্যাম্পটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী উল্লিখিত দিন সকাল ৭টার সময় মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ১৩-১৪জনের ১টি দল (যাদের মধ্যে তাজুল ইলাম, বাতেন মিয়া, নূরুল ইসলাম, আরমান মিয়া, মাহবুব, আলী।
আকবর ও শুকুর আলীর নাম পাওয়া যায়) দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে চেীয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে ক্যাম্পের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা পালটা গুলি বর্ষণ করে নি। কিন্তু পরবর্তী সময় যখন মুক্তিযােদ্ধারা গ্রেনেড চার্জ করেন, তখন তারা পালটা গুলি বর্ষণ শুরু করে। এ পর্যায়ে গ্রাবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সম্পূর্ণ ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে। এবং জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
ফলাফল
এ রেইডে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হয় নি। তবে পাকিস্তানি সেনাদের প্রায়। ৩জন মৃত্যুবরণ করে বলে জানা যায় এবং আনুমানিক ১১জনকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়। পরবর্তী সময় ভারতীয় সেনাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঐ ক্যাম্প থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড