You dont have javascript enabled! Please enable it!
ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা ঢাকায় পরিচালিত গেরিলা অপারেশন
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই হাজারাে ছাত্র-জনতা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেওয়ার জন্য এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে গমন করে। প্রথমেই এঁদের রাজনৈতিক প্রেষণা চালানাের জন্য যুব ক্যাম্পে রাখা হয় এবং পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরে , গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। এসব গেরিলাদের যুদ্ধ কৌশল, ক্ষুদ্র অস্ত্রের ব্যবহার, মাইন ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদির উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং এদের ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানাে হয়। এদের অধিকাংশই ঢাকায় অপারেশনের জন্য আসে এবং ২ নম্বর সেক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অধিকাংশ সময় এ গেরিলারা পাকিস্তানি বাহিনী-অধ্যুষিত বাংলাদেশে অপারেশন পরিচালনার জন্য কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত ব্যবহার। করত। ২ নম্বর সেক্টর কর্তৃক পরিচালিত ঢাকায় যে গেরিলা গ্রুপগুলাে অপারেশন করে তার মধ্যে সুইসাইড স্কোয়াড এবং ক্র্যাক প্লাটুন ছিল বিখ্যাত। এ গ্রুপগুলােকে ঢাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষুদ্র। অপারেশনগুলাের লক্ষ্য ছিল ভীতির মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক গােলাগুলি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােয় বিস্ফোরণ ঘটানাে। এ গেরিলা অপারেশনগুলাে বাংলাদেশে শুরু হয় ১৯৭১ সালের জুন মাস থেকে। এ গেরিলা দলগুলাে তাদের সাথে পিস্তল, স্টেনগান ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি বহন করত।
হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিস্ফোরণ
ঢাকার প্রথম গেরিলা অপারেশন চালানাে হয় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ১৯৭১ সালের ৯ জুন, যা বর্তমানে হােটেল শেরাটন নামে পরিচিত। ঐ সময় হােটেলে প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানসহ আরও কিছু বিদেশি প্রতিনিধিদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী তুলে ধরতে চেয়েছিল, শুধু সীমান্ত এলাকা ব্যতীত ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ। এ সময় গেরিলারা হােটেলটি আক্রমণের এক সাহসী পদক্ষেপ নেয়, যাতে ঐ হােটেলে আগত বিদেশি প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারেন। | বিদেশি সাংবাদিক এবং প্রতিনিধিদের সম্মানে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আয়ােজিত নৈশভােজের সময় হােটেল প্রাঙ্গণটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় গেরিলারা। পরিকল্পনা মােতাবেক গেরিলারা বিকালে পুরাে হােটেল এলাকাটি রেকি করে এবং ৬জন কমান্ডাে প্রেরণ করে গ্রেনেডের ব্যবহারের মাধ্যমে পুরাে এলাকায় একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় গুলশানের এক অবাঙালির কাছ থেকে ১টি গাড়ি ছিনতাই করে ৬জন গেরিলা ঐ গাড়ি নিয়ে হােটেলে উপস্থিত হন। গাড়ি থেকে নেমে দেয়াল টপকে ৩জন ভিতরে প্রবেশ করে আবছা অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয় হােটেলের সামনে দণ্ডায়মান বিশ্বব্যাংকের গাড়ির উপর, পর পর আরও ২টি গ্রেনেড ছােড়া হয় হােটেলের বারান্দায় এবং সাথে সাথে হােটেলে আগত লােকজন। আর্তচিৎকার শুরু করে এবং কাউকে কোনাে কিছু বুঝতে না দিয়ে ঐ গাড়িতে করেই গেরিলারা স্থান ত্যাগ করেন এবং যাওয়ার সময় মগবাজারে অ্যাডভােকেট শফিকুল ইসলামের বাসায় হামলা করে। তখন সেখানে শান্তি। কমিটির বৈঠক চলছিল। ঐ বাসায় ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তারপর তারা দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ অফিসে এসে আরও ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে গাড়ি ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায়। মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, চুন্ন, স্বপন, জিয়া, আলম ও বাদল এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
ফার্মগেটে পাকিস্তানি আর্মি পােস্টে রেইড
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ফার্মগেট এলাকায় পাকিস্তানি সেনা চৌকির উপর। হামলা স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত আরেকটি বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ১টি প্লাটুন ফার্মগেট সেনা চৌকিতে অবস্থান করত। গাড়ি থামিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য চালানকৃত অস্ত্র, গােলাবারুদ ও বিস্ফোরক অনুসন্ধান করাই ছিল তাদের দায়িত্ব। ফার্মগেটে পাকিস্তানি সেনা চৌকির আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযােদ্ধা আলম, বদি, স্বপন, চুলু, বুলু ও সামাদ। আক্রমণের জন্য প্রয়ােজনীয় পর্যবেক্ষণ শেষে বিস্তারিত পরিকল্পনার মাধ্যমে আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এ অপারেশনে টি গাড়ি ব্যবহৃত হয়। সন্ধ্যার পর পরই গাড়িতে করে গেরিলারা পাকিস্তানি চৌকির দিকে এগােতে শুরু করেন। চৌকির প্রথম গেটে পৌছানাের পর পরই ৯ মিলিমিটার স্টেনগান ও চাইনিজ তাবুর অভ্যন্তরে বিশ্রামরত সৈনিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। পাকিস্তানি ১২জন সৈনিক এ আক্রমণে নিহত হয়। কার্যত পুরাে ক্যাম্পটি এতে ধ্বংস হয়ে যায়। মৃতদেহগুলাে পরদিন সকাল পর্যন্ত সেই স্থানে পড়ে থাকে। ফলে ঢাকা শহরে কর্তব্যরত পাকিস্তানি সেনাদের উপর এক বিরাট মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!