পােড়াদিয়া বাজার অ্যামবুশ
যুদ্ধের স্থান
নরসিংদী জেলার বেলাবাে থানাধীন পাটুলি ইউনিয়নে একটি গ্রাম পােড়াদিয়া। এটি থানা সদর থেকে আনুমানিক ৭ কিলােমিটার উত্তরে আড়িয়াল খাঁ নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। এ গ্রামেরই বাজার এলাকায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশ পরিচালনা করে।
যুদ্ধের সময়সীমা
১৯৭১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর।
যুদ্ধের বর্ণনা
২২ নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ২০০জনের একটি দল সরারচর এলাকা থেকে মনােহরদী থানা সদরে যায়। যাওয়ার পথে তারা পােড়াদিয়া। বাজারে আবদুল হকের কাপড়ের দোকানসহ বেশ কয়েকটি দোকান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। উক্ত এলাকায় তখন মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি ক্ষুদ্র দল অপারেশন করছিল। ক্ষুদ্র দলটি বিশাল বাহিনীর উপর আক্রমণ না করে শক্তিবৃদ্ধির জন্য এবং অন্য দলের সাথে মিলে একত্রে অপারেশন করার অপেক্ষায় থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা সমন্বয়ের অভাবে শত্রুর মােকাবিলা করতে পারেন নি। ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের ১টি দল কুলিয়ারচর থেকে পােড়াদিয়া বাজারের উপর দিয়ে মনােহরদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গ্রামবাসীর মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আগমনের সংবাদ ও আসার পথ সম্পর্কে জানতে পারেন। এবার তারা শত্রুকে ফাদ পেতে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আবেদ আহমেদ প্রায় ৬০জনের এ মুক্তিযােদ্ধা দলটির নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযােদ্ধারা পােড়াদিয়া বাজারের পূর্বে নদীর পশ্চিম পাশে শত্রুর মােকাবিলার জন্য ফাঁদ পেতে অবস্থান গ্রহণ করেন। সকাল সাড়ে ৯টায় শত্রু তাদের অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করে। সাথে সাথে গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের রাইফেল, এলএমজিসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র । পাকিস্তানি সেনারাও পালটা গুলি বর্ষণ করে। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে এ গােলাগুলি চলে। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জানা যায় যে, এ যুদ্ধে যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা অংশ নেন তারা হলেন: ১. মাে. আবেদ আহমেদ (অধিনায়ক)। ২. মাে. মাইন উদ্দিন ৩. মাে. শফিকুর রহমান ৪, মাে. সিরাজুল হক ৫. মাে. ফজলুল হক ৬, মাে. আবদুল বাতেন ৭. মাে. জয়নাল আবেদীন ৮. মাে. নাজিম উদ্দিন ৯, মাে. নুরুল আমিন ১০. মাে. হাফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া। ১১. নুর মােহাম্মদ ১২. শাহাবুদ্দিন। ১৩. আবদুস সালাম ১৪. তমিজ উদ্দিন ১৫. সিরাজউদ্দিন ভূঁইয়া ১৬. মফিজউদ্দিন ১৭. রাজু মিয়া। ১৮. আবদুল জব্বার। ১৯, জয়নাল আবেদীন ২০. আবুল বাশার ২১. মাে. কুদরত আলী ২২. রমিজউদ্দিন ২৩. আবু সাঈদ ২৪. নুরুল আমিন (কাঞ্চন) ২৫. আফসার উদ্দিনসহ আরও অনেকে।
ফলাফল
এ যুদ্ধে কোনাে পক্ষেরই উল্লেখযােগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। পাকিস্তানি সৈন্যরা সতর্ক থাকায় তাদের ১জন সদস্য আহত হয় এবং তারা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। গােলাগুলি চলাকালীন পােড়াদিয়া বাজার সংলগ্ন ব্রাহ্মণেরগাঁও নামক। গ্রামের জনৈক ইজামত মৌলবি শহিদ হন।
দৌলতকান্দি প্রতিরক্ষা অভিযান
সাধারণ
১৯৭১ সালের ১১-১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধের মধ্যে দৌলতকান্দি প্রতিরক্ষা অভিযান ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতার ভিত্তিতে অপারেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি একটি উদাহরণ। দৌলতকান্দি প্রতিরক্ষা অভিযানে মুক্তিযােদ্ধারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। | পাকিস্তান বাহিনীর ভৈরব প্রতিরক্ষা যখন হুমকির সম্মুখীন এবং মিত্র বাহিনী যখন ভৈরবের দক্ষিণ দিকে লালপুর হয়ে ভৈরবকে পাশ কাটিয়ে নরসিংদী তথা ঢাকা অভিমুখে চলে যাচ্ছিল, তখন মুক্তিযােদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের সমন্বয়ে নেয়া দৌলতকান্দি প্রতিরক্ষা অবস্থান ভৈরবে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীকে পিছন থেকে অবরােধ করে ফেলে। কাজেই পাকিস্তানি সৈন্যরা দৌলতকান্দির এ প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনর্দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রণী ভূমিকার ফলে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্য দৌলতকান্দিতে ভারতীয় ৩০০-৪০০জন সৈন্যের সাথে সমন্বয়পূর্বক প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে ভৈরব বাজারের পাকিস্তানি সেনাদের অবরােধ করা এবং তাদের। পশ্চাদপসরণ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে ধ্বংসসাধন করা। স্থান ও সময়সীমা ভৈরব বাজার থেকে ৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল সড়কের উভয় পাশে দৌলতকান্দি গ্রাম। এ প্রতিরক্ষা অভিযান ১৯৭১ সালের ১১-১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল।
যুদ্ধের পটভূমি
স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ১০-১১ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৭ পদাতিক ব্রিগেড আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব চলে যায়। ১১ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ভৈরব ব্রিজের ভৈরব সংলগ্ন অংশ বিস্ফোরকের সাহায্যে ভেঙে ফেলে। তাদের ভৈরব প্রতিরক্ষা বেশ সুদৃঢ় ছিল। মিত্র বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে, ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ভৈরবে অবরােধ করে রাখবে এবং
‘এস’ ফোর্স ও ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড ভৈরবকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদী। অতিক্রম করে নরসিংদী হয়ে ঢাকা অভিমুখে যাবে। ১২ ডিসেম্বর আশুগঞ্জের ৪ কিলােমিটার দক্ষিণে লালপুর হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করে ‘এস ফোর্স ও ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেড রায়পুরা হয়ে নরসিংদী চলে যায়। ভৈরবকে অবরােধ করার জন্য মেঘনার পশ্চিম পাশে (ভৈরব থেকে ১০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে) ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানি। হেলিকপটারযােগে অবতরণ করানাে হয়। ঐ সময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি বৃহৎ দল পাকিস্তানি বাহিনীর সুযােগমতাে আক্রমণের জন্য মেঘনার পশ্চিম পাড়ে ভৈরবের আশপাশে অবস্থান করছিল।
মুক্তিযােদ্ধারা হেলিকপটারে আগমনরত সৈনিকদের স্বাগত জানায়। ঘটনাদৃষ্টে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় এ সেনা সদস্যদের সাথে নিয়েই মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় ১০০জনের ১টি দল দৌলতকান্দিতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার। পিছনে অবস্থান নেয়। ভারতীয় সেনাদের এ দলটি ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড অথবা। ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের সদস্য হতে পারে বলেও অনেকে মত প্রকাশ করেন। যাহােক ভারতীয় সৈন্যদের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০জন (১ ব্যাটালিয়নের কিছু কম সংখ্যক সৈন্য)।
যুদ্ধের বর্ণনা
ভৈরববাজার থেকে ৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দৌলতকান্দি রেল স্টেশনের উভয় পাশে দৌলতকান্দি গ্রাম অবস্থিত। একটি কাঁচা উঁচু সড়ক এ গ্রামের অগ্রভাগ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে, যা ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের সাথে সমান্তরালভাবে অবস্থিত। ১১ ডিসেম্বর (মতান্তরে এর পূর্বে) ভারতীয় সেনা দল ও মুক্তিযােদ্ধারা দৌলতকান্দি স্কুল মাঠ, তুলাতলি গ্রাম, শুকুইরা বাজার ও গাটিয়া মাঠ এলাকায় উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। এতে ভৈরব বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে রামনগর গ্রামে অবস্থিত বাকি সেনা দলের সাথে মিলে রামনগর ও রামনগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে দৌলতকান্দি প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ ও গুলি বিনিময় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা। পর্যন্ত চলে। এমতাবস্থায় ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর প্রচণ্ড বােমা বর্ষণ করে এবং পরবর্তী সময় আর্টিলারি গােলা বর্ষণ করে। ফলে পাকিস্ত নি সেনাবাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয় এবং পুনরায় রামনগর গ্রামে চলে যায়। এ অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর কমপক্ষে ৩০জন সৈন্য নিহত হয়। ভুল। রাস্তায় পালানাের সময় ২জন পাকিস্তানি সৈন্য জনগণের হাতে ধরা পড়ে এবং
জনগণ তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। এ যুদ্ধে ভারতেরও প্রায় ১৫জন সৈন্য শহিদ। হন এবং মুক্তিযােদ্ধা হানিফ, মমতাজ ও হারুনসহ প্রায় ২০-২১জন মুক্তিযােদ্ধা। শহিদ হন। এ যুদ্ধের শেষের দিকে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, যেখানে মিত্র বাহিনী দৌলতকান্দি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী রামনগরে পরস্পরের মুখােমুখি প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকে। ঐ অবস্থা চলাকালীন ১৬ ডিসেম্বরে রামনগর প্রতিরক্ষায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ।
ফলাফল
দৌলতকান্দি প্রতিরক্ষা যুদ্ধের পর প্রায় ৩০০-৪০০ পাকিস্তানি সৈন্য রামনগর গ্রামে আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে প্রচলিত প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পিছনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে নি। বলেই মিত্র বাহিনী দৌলতকান্দিতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। যে-কোনাে যুদ্ধে পশ্চাদভাগ (রিয়ার এরিয়া) নিরাপদ না থাকলে। তা যুদ্ধে পরাজয় ডেকে আনে। খ. উপযুক্ত ভূমিতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিলে অপেক্ষাকৃত বেশি সংখ্যক শত্রুকে হারিয়ে দেওয়া যায়। যুদ্ধে পর্যাপ্ত বিমান সহায়তা পেলে তা শত্রুর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে একটি জোরালাে আক্রমণকেও নস্যাৎ করে দিতে পারে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড